–পছন্দ হলে রাখব, বল তুই।
–আমি কী নাম রাখব! রাণি হেসে ফেললে, বললে, যা, রাখলুম চয়ন।
-বাঃ, বেশ নাম তো। তোর ভাই পছন্দ আছে। এই নামই রাখব। একটু দাঁড়া, আমি আসিগে, এই নামই রাখা হল।
ললিতার খুশি আর ধরে না। বিকেলবেলা রাণিকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির সুমুখে বাগানের ধারে গিয়ে বসল।
রাণি বলল, আর কতক্ষণ থাকব বল, সেই কখন এসেছি।
ললিতা তার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, তাতে কী হয়েছে, আজ বৈ তো নয়। আর তুই যদি এমন কথা বলিস, তবে কে আর বলবে না? রানু, টের পাচ্ছিস, দক্ষিণা বাতাস বইতে শুরু করেছে, আর ওই যে ঝাউ গাছ, দেখছিস তো?
রাণি কিছুদূরে একটা ঝাউগাছের দিকে স্বপ্নাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে চেয়ে বললে, হুঁ দেখছি।
—ওগুলো দেখে কি মনে পড়ে?
–মনে পড়ে অনেককিছু। কিন্তু লতা, সে-সব কথা মনে করে কী লাভ?
—লাভ নেই, কি বলিস? আমার কী ইচ্ছে করছে জানিস? ললিতা রাণির মুখটি দুহাতে চেপে ধরে তার গালে একবার ঠোঁট দুটি স্পর্শ করে খিলখিল করে হেসে উঠল।
রাণি হাসল। কিন্তু ললিতার হাসি যেন তাকে বিধছে। ঝাউগাছের নীচে টুকরো ছায়া বাতাসে কাঁপছে। রাণি কাতরভাবে বললে, আজ আসি ভাই, সেই কখন এসেছি।
—না কিছুতেই যেতে পাবি না।
–আমাকে মাপ কর ভাই।
এ-কথায় যদিও ললিতা একটু বিমর্ষ হয়ে গেল, কিন্তু তবুও তার কাছে রেহাই পাওয়া শক্ত।
রাত নটা অবধি কিছুতেই বাড়ি যেতে পারল না। বিদায় দেওয়ার সময় গেটের কাছে ললিতা এল, আর তার স্বামী এসে দাঁড়ালেন। কিন্তু রাণি তার নিজের মুখে একটা বিদায় সম্ভাষণ পর্যন্ত জানাতে পারল না।
বাসায় এসে বিমল বলল, চমৎকার লোক। কি বল?
ছোট্ট একটা হুঁ বলে রাণি কাপড় বদলাতে চলে গেল।
বিমলের একটা নতুন উপসর্গ জুটেছে। তাদের অফিসের তার এক ফেলো অফিসার এসেছেন এ-পাড়ায়। বুড়োমানুষ, রিটায়ার্ড হবার সময় হয়ে এসেছে। অত্যন্ত রসিক, আর ভয়ানক গল্প বলতে পারেন, এঁকে ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে বিমলের তাসের আড্ডা চলে, অনেক রাত অবধি, সময়কে চোখ রাঙিয়ে।
রোজ রাতে নীচের ঘরে আলো জ্বলে নিষ্কম্প। জানালা দিয়ে সে-আলো গিয়ে অনেক দূরে পড়ে। ভেতরে চারটি প্রাণী খেলায় রত। হঠাৎ একদিন রাণি ডাকল, বললো, তোমার খাওয়া-দাওয়া নেই?
-ওঃ, ভুলেই গেছলাম। তোমার কষ্ট হচ্ছে খুব, না?
স্বামীর এই অপ্রতিভ ভাব দেখে রাণির একটু কষ্ট হয়, বলে, না, কষ্ট আর কি? আমার তো বেশ মজা! খালি ঘুমুই, আর জেগে থাকলে বই পড়ি।
কিন্তু ওঁরা কি গেছেন? আলোটা ধরে বিদেয় দিয়ে এসো, নইলে কে জানে কোথায় হোঁচট খেয়ে পড়বেন।
কথায় ইঙ্গিত ধরে বিমল লজ্জা পেল, নম্রভাবে বলল, না পথ তো খারাপ নয়। যে হোঁচট খেয়ে পড়বেন।
-এই রাতে তুমি হেঁটে দেখেছ?
শূন্যের বাতাস ভারী, আকাশ মেঘাবৃত, পৃথিবী প্রাণহীনতায় স্তব্ধ, শেষরাতে কুকুরের ডাক, নিশাচর মানুষের ক্লান্ত পদধ্বনি আর কঠিন শীত—আর পাষাণ শীতল দেহ।
রাণি কেবল বসে থাকে। বিষণ্ণ সন্ধ্যা, রাত্রি আসে চুপিচুপি, যায় নিঃশব্দে, সে তখন চমকে ওঠে।
বসন্তের হাওয়ার পরশ নেই!
রোজই রাত্রে বিমলকে ডেকে পাঠাতে হয়, নইলে তার হুঁশ হয় না, কিন্তু মাঝে-মাঝে ভুল হয়ে যায়। সেদিন হয়তো রাণি ঘুমিয়ে থাকল, আর রাত বারোটা-একটা অবধি তাস খেলে বিমল শোবার ঘরে সেই চেয়ারে বসেই বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দিল। রাণিকে জাগাতে তার ভয় হয়।
আর পান্ডুর আলোয়, তার হাতে যে ধরানো সিগরেটটা থাকে তার সাদা ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে ওপরের দিকে ওঠে।
ল্যাম্পের আলোর রঙ যেন ধূসর, শীত যেন সহ্য করা যায় না। সমস্ত খাট জুড়ে ঘুমিয়ে আছে রাণি।
বিমলের বন্ধু অশোক; শিলং-এ থাকে, তার আসার কথা ছিল। সে চিঠি লিখেছিল। একদিন হঠাৎ এসে হাজির হল।
বিমল খুশি হয়ে বললে, এতদিন পরে যে? সেই কবে লিখেছো তো?
–সময় যে করে উঠতে পারিনে, কিন্তু আগে যদি জানতুম তোমার গৃহে আমার এমন বউদি আছেন তবে কি আর এত দেরি করি!
অশোকের কথাই এরকম, অথচ কেউ কাউকে দেখেনি। রাণির চমক লাগল।
অশোক বললে, আমি মনে করেছিলুম, ইস্কুলের সেই ফার্স্ট বয় বিমল আমাদের জন্যে আর এমন কী বউদি আনবে! ওঃ, এখনও বুঝি নমস্কারটা জানানো হয়নি? ভারী অন্যায় হয়ে গেছে। নমস্কার বউদি।
নমস্কার। রাণি হেসে বললে।
চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে অশোক বললে, বাঃ, বেশ সাজানো গোছানো তো! বউদি, আপনারই হাতের গৌরব।
সে হাসতে লাগল।
অনেকদিন এ ধরনের কথা শোনা হয়নি, সে আজ পাঁচ-ছ-বছর হয়ে গেল, বিমল উৎফুল্ল হয়ে বললে, নাঃ, তুই এখনও সেই চন্ড অশোকই রয়েছিস, কবে মানুষ হবি বলত?
—মানুষ আর হব না, অশোক বললে, আর কেমন করেই বা হই বল? বিয়ে তো আর করিনি–
—যাক, বিমল বললে, একটু বিশ্রাম করো বন্ধু, আমি আসছি।
দুপুরবেলা। বিমল অফিসে।
অশোক কয়েকটা চিঠি লেখা শেষ করে রাণিকে খুঁজতে গেল। রাণি এখনও ভালো করে কথা বলেনি, কিন্তু সে আর এরকমভাবে থাকতে পারে না, তার অভ্যাস নয়।
অশোক দোতালার সিঁড়ির ওপর থেকে, নীচে গিয়ে, আবার উপরে এসে বউদি বলে ডাকল অনেক, কিন্তু কোনো সাড়া নেই। তারপর শোবার ঘরের কাছে পর্দার বাইরে থেকে ডাকল, বউদি, ও বউদি! বারে আমি বুঝি একা-একা কাটাব এমনি করে?
রাণির মাথার নীচে একটা হাত রেখে শুয়েছিল, তন্দ্রাও একটু এসেছিল। হঠাৎ জেগে তাড়াতাড়ি বাইরে এসে বললে, ওঃ, আপনি!