কতক্ষণ এমনি কাটল। রাণি হঠাৎ বললে, চল খেতে।
বিমল খেতে গেল।
কয়েকদিন পর। একদিন সাইকেলে করে একটি চোদ্দো-পনেরো বছর বয়সি ছেলে এল। দুপুরবেলা।
কী একটা পর্ব উপলক্ষে বিমলের অফিসে ছুটির দিন।
ছেলেটি রাণিকেই খুঁজছিল। রাণি তার কাছে গিয়ে বললে, কাকে ডাকছো?
—বিমলবাবুর বাসা না এটা?
-হ্যাঁ।
-মানে, তারই—মানে, আমার দিদির বন্ধু রাণি বলে কেউ আছে এখানে?
–আছে। রাণি মুচকি হেসে বলল।
—তাকে একটু ডেকে দিন না।–আমিই।
-ওঃ, আপনি। ছেলেটি তাড়াতাড়ি শার্টের পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে তার হাতে দিয়ে বললে, দিদি লিখেছে। কালকে আবার ঠিক দশটার সময় আসব।
ছেলেটি চলে যাচ্ছিল, রাণি তাড়াতাড়ি বললে, আমাকে এখনই আবার উত্তর দিতে বলেনি তো?
-ওঃ, একেবারেই ভুলে গেছি। ছেলেটি সাইকেল রেখে আবার কাছে এসে বললে, আমার সঙ্গেই উত্তর দিয়ে দিতে বললে।
—এই দ্যাখো, আমি মনে করে দিয়েছি বলেই না! তুমি এই ঘরে একটু বোসো, আমি আসছি।
—আচ্ছা।
-রাণি আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ঘরে গিয়ে খাম ছিড়ে চিঠিখানা খুলে পড়ল। লেখিকা তার স্কুলের সময়কার অন্তরঙ্গ বন্ধু ললিতা। তার ছেলের অন্নপ্রাশন কাল। তাকে আর বিমলকে যেতেই হবে, নইলে ভয়ানক রাগ করবে। আরও নানা কথা।
রাণী হাসল, এই না সেদিন বিয়ে হল! হ্যাঁ, সেদিন বলেই তো মনে হচ্ছে, আর আজই ছেলের অন্নপ্রাশন!
আর লিখেছে, রাগ করবে। কুমারী জীবনে যখন ও ছাড়া আপনার বলতে আর কেউ ছিল না, তখন একথা শুনলে কী ভয়ই না পেত, কিন্তু আজ আর ভয় হয় না, চোখেও জল আসে না, বরং—
এই তো সেদিন বিয়ে হল। আর আজই ললিতা ছেলের চিন্তায় মশগুল। সমস্ত চিঠিতে কেবল তারই কথা। বরং এখন রাণির যেরকম অবস্থা—তার বুক কোথাও যেন ব্যথায় কনকনিয়ে উঠল, কোথাও যেন একটু রাগও সঞ্চিত হয়েছে।
সে থমকে দাঁড়াল, না আমি যাব না। একদিন যখন ভাব ছিল তখনই এসব।
আবদার খাটত, আজ আবার তার পুনরালোচনা কেন?
—রাণি, ওখানে দাঁড়ালে কেন? চিঠি কার? বিমল এসে দাঁড়াল।
–কারোর নয়। সে তাড়াতাড়ি টেবিলের কাছে গিয়ে একখন্ড কাগজে তার কিছুতেই যাওয়া হবে না, এই লিখে ভাঁজ করে ছেলেটিকে দিয়ে এল। সে সাইকেল নিয়ে চলে গেল।
বিমল কিছুই বুঝতে পারেনি, ব্যাপার দেখে আশ্চর্য হয়েছিল, জিজ্ঞেস করল, কী হল, ও কার চিঠি?
রাণী চিঠিটা হাতের মুঠো থেকে বিমলের কাছে ছুঁড়ে দিলে।
-আমি পরের চিঠি পড়ি না, তুমি যদি পার বলো।
—স্বামী যে কী মনে করে তার স্ত্রীর কাছে দেওয়া কারোর চিঠি পড়তে পারে , সে তো আমার জানা নেই।
সে তাড়াতাড়ি অন্য ঘরে চলে গেল। বিমল স্তব্ধ। বিকেলবেলা মনটা হয়তো একটু হালকা হল। রাণি ভাবল, সে কি পাগল হয়েছে? কী করতে কী করে ফেলছে। একসময় এসব কথা মনে হলে যে হাসি পায়।
বিমল তখন যাইরে বেড়াতে বের হচ্ছিল, সে এসে বললে, চিঠিটা লিখেছে আমার বন্ধু ললিতা, সেই যে যার কথা তোমাকে অনেক বলেছি। ওর ছেলের অন্নপ্রাশন।
-ছেলে! বিমল সমস্ত ব্যাপারটা এক মুহূর্তে মনে করে নিল, তার দিকে ম্লান দৃষ্টিতে তাকাল।
—হ্যাঁ, রাণি বললে, তা আমাদের যেতে বলেছে, অনেক অনুরোধ করে চিঠি লিখেছে। কিন্তু কে যায়? আমি যেতে পারব না লিখে দিয়েছি। তুমি কি বল?
বিমল বললে, আমি কী বলব? তবে, একজনের দুঃখ যে তোমার চেয়ে বেশি হবে, এটা বেশ বুঝতে পারি।
—আমার চেয়ে! রাণি অতিকষ্টে বলল।
—হ্যাঁ। আমি কিন্তু যেতেই বলি।
বিমল আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেল।
পরের দিন ললিতা নিজেই এল। রাণি এতটা ভাবতে পারেনি। বড়োলোক, তাদের কতো আত্মীয়-স্বজন, জীবনের কতত প্রাচুর্য, সেসব চাকচিক্য ফেলে তার মতো নগণ্য একজন বান্ধবীকে নিজে নিয়ে যেতে আসবে, এটা কল্পনা করা যায় না।
ললিতা বললে, তুই তো জানিস, আমার এখানে কেউ নেই।
-কেউ নেই? আমি তো জানতুম অনেকে আছে।
-না, আত্মীয় বলতে কেউ নেই। বাবা তো কবেই এখান থেকে বদলি হয়ে গেছেন। কিন্তু রাণি তুই না লিখে দিলি কেন? হায়রে নিষ্ঠুর, ছোটোবেলার কথা আজ বেমালুম ভুলে গেছিস।
দুজনেই হেসে উঠল।
হাসি থামতে ললিতা বললে, তবে আমি যাই, এখনও অনেক কাজ ভাই, অনেক কাজ। ছেলেটাকে আবার ফেলে এসেছি। কী হল কে জানে! তোরা নিশ্চয় করে যাবি। নইলে দেখবি, আবার এসে উপস্থিত হয়েছি। আমার কি এখন আর মরবার সময় আছে? নানাদিকে নজর রাখতে হয়। যাই ভাই।
ললিতা একটা আলেয়ার মতো মিশে গেল। ইস, কী রূপ। একটা অগ্নিশিখার মতো দেখতে হয়েছে। আগে এত সুন্দরী ছিল না। ললিতা ছিল ছোটো, কিন্তু আজ যেন তাকেই বড়ো দেখা যায়।
যথাসময়ে রাণিরা ওদের বাড়ি গেল।
লোকজন সত্যি তেমন নেই। কিন্তু সেই কয়টিতেই সমস্ত বাড়িটা হাসি কোলাহলে মুখরিত করে রেখেছে। ছেলের জন্যে শোবার ঘরেই একটি দোলনা করে দেওয়া হয়েছে। নরম বিছানায় শোয়ানো। সুন্দর, ফুটফুটে, মার আদলই পেয়েছে বেশি। গলায় মালা, কপালে চন্দন, চোখে কাজল। ছোটো হাত-পাগুলো শূন্যের দিকে ছুঁড়ছে আর মুখ দিয়ে এক অদ্ভুত শব্দ করছে। রাণি দোলনাটা একটু দুলিয়ে দিল।
ললিতা বলল, অনেক নাম মজুত হয়েছে। কিন্তু এখনও চূড়ান্ত মীমাংসা হয়নি। তুইও একটা বল, রানু–
-বলে কী হবে, আমার দেওয়া নাম তো আর রাখবিনে!