—আর হেবো, ওটাও কাঁদছে?
—হুঁ, কেলো বললে, ভয়ানক কাঁদছে।
–কই আমি তো শুনতে পাইনি?
–পাবে কি গো! কতক্ষণ আর কাঁদবে? দিলাম এক চড়, বললাম, মা এলে খাবি ছোঁড়া। তারপরই তো ফট করে চুপ করে গেল।
-চড় দিলি! শ্রীবিলাস তার লাঠিটা হাতে তুলে নিল, সেটা দিয়ে মেঝের ওপর এক শব্দ করে বললে, কেন চড় দিলি বল, নইলে আজ তোকে–
যে এত মিথ্যে কথা বলতে জানে, সে তার সাফাই গাইতেও জানে, বিশেষভাবে তার কাছে—যে ব্যক্তি চোখে কিছুই দেখতে পায় না।
কেলো বললে, খুব জোরে নয় বাবা। আমি কেন জোরে মারব ওকে বলো! এই এরকম আস্তে করে—সে শ্রীবিলাসের গায়ে আস্তে মৃদু একটা আঘাত করে বললে, হাতটা কেবল একটু লাগিয়েছিলাম, আর অমনি কেঁদে ফেলল ভ্যাঁ করে। এমন ছিচকাঁদুনে আর কখনও দেখিনি, বাপরে।
শ্রীবিলাস আবার শান্ত হল। মাটির ওপর একপাশে লাঠিটা রেখে, আঁচলের গিট খুলে পয়সা দুটো বার করল, বললে, শিরীষ দোকানির কাছে যা, মুড়ি নিয়ে আয়। দু-পয়সার, বুঝলি?
-আচ্ছা।
শ্রীবিলাস কেলোর হাতে পয়সা দিয়ে বললে, মুড়ির সাথে একটু তেল আর নুনও চেয়ে নিস বাবা, ভুলিসনি যেন, বুঝলি?
কেলো কি আর সেখানে রয়েছে, পয়সা পেয়ে তক্ষুনি দৌড়ে পালিয়েছে।
কিছুক্ষণ পরে–
আসতে দেরি দেখে শ্রীবিলাস ডাকল ছেলেটাকে, কেলো—
ঘরের পূর্বদিকের দরজার সামনেই একটা ভাঙা উঠোন ছিল, সেখানে বসে ওরা খাচ্ছিল। শ্রীবিলাস ছিল এপারের বারান্দায়, টের পায়নি।
—কেলো!
উত্তর এল, কী বাবা?
—খেলি?
–বাবা।
–হেবো আর সদু, ওরা?
—ওরাও তো খাচ্ছে, কিরে হেবো, খাচ্ছিস না তুই আমার সঙ্গে? কেলো ফিসফিস করে হেবোকে বললে, বলনা, চেঁচিয়ে বল।
হেবো চেঁচিয়ে বললে, হুঁ, আমি খাচ্ছি।
শ্রীবিলাস লাঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ঘরের দরজা পেরিয়ে বললে, সবই খেলি?
—সবই তো বাবা।
শ্রীবিলাস তাড়াতাড়ি তাদের কাছে যেতে যেতে বললে, একটুও রাখিসনি?
—হুঁ, সে তো আছেই বাবা, এই একেবারে তলায়, এই আধমুঠোও হবে না। শ্রীবিলাস দাঁত-মুখ খিচিয়ে বললে, পাজি ছেলে, সবই খেয়ে ফেললি? বয়েস আমাদের বেশি হয়েছে বলে বুঝি খিদে পেতে নেই মোটেই? শয়তান ছেলে, হতচ্ছাড়া, তোর হাড়গুলো ভেঙে গুঁড়ো করে ফেলব আমি–
কেলো ভয়ে দৌড়ে পালাল।
-বউ এলে পর বলব, এরকম ছেলে পিঠমোড়া করে বেঁধে চাবুক লাগানো। দরকার, শুধু নিজের খাওয়া, সাতদিন না খাইয়ে রাখলে তবে ঠিক হয়—হবে না এমন, কেবল ছোটোলোকদের সঙ্গে মিশলে এরকম হয়ই। বউকে কত বলেছি, না ওর কেবল টাকা আর টাকা! আরে বাপু, ইদিকে যে ছেলেপিলেগুলো অমানুষ হয়ে গেল তা চোখে পড়ছে? আবার কোথায় গেল ওটা?
শ্রীবিলাস দরজায়, চৌকাঠে, দেওয়ালে কয়েকবার খুব করে লাঠির আঘাত করে বললে, ছেলেটা কোথায় গেল?
হেবো আর সদু কাছেই ছিল, বাপের রাগ দেখে ভয়ে এতক্ষণ কিছু বলেনি, এখন কাঁদো-কাঁদো স্বরে বললে, দাদা পালিয়েছে বাবা।
—পালিয়েছে বাবা! ন্যাকামি! যা আমার সুমুখ থেকে, যা বলছি, নইলে মার খেয়ে মরবি বলে দিলাম।
হেবোটা সত্যিই ছিচকাঁদুনে, ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললে।
শ্রীবিলাস বললে, আবার কাঁদছিস কেন?
—দুমুঠো করে আমাদের দিয়ে দাদা আর সবই নিজে খেয়েছে বাবা।
নিজে খেয়েছে! রাগে শ্রীবিলাসের চোখ ফেটে জল আসে আর কি! সবই নিজে খেয়েছে, আর আমরা বুঝি ভেসে এসেছি। দাঁড়া তো আসুক!
শ্রীবিলাস গুম হয়ে বসে রইল।
প্রায় এগারোটা অবধি বসে বসেই কেটে গেল। কাজই বা কী? অন্ধের আবার কী কাজ?
কিন্তু শ্রীবিলাসের কাজ আছে, সে দিনরাত কেবল বকে, বারান্দায় আর ঘরে আসা-যাওয়া করে, ছেলেপিলেগুলোকে নিষ্ফল শাসন করে, আরও কত কী করে?
বিন্দুর আসতে দেরি হচ্ছিল, আজকে বেশি কাজ, উৎসব-আয়োজনে রোজকার চেয়ে একটু দেরি হবেই তো।
বেলা বারোটা বাজল।
ছোটোছেলেদের এমনি একটা স্বভাব, যেমন ভুলে থাকতে পারে খুব, তেমনি অনেক সময় যার জন্যে একবার ঝোঁক চাপল তার জন্যে একেবারে মরিয়া হয়ে ওঠে।
কেলো ওরাও ক্ষিদে ভুলে তখনও কোথায় খেলছিল।
শ্রীবিলাস নিজেই অস্থির হয়ে উঠল।
চারিদিক প্রায় নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে দু-একটা কাকের ডাক।
পাশের ঘরে থাকে সতীশ। এক বাদ্যযন্ত্রের দোকানে কাজ করে। বিয়ে করেছে। বেশিদিন হয়নি, এখনও সন্তান হয়নি।
শ্রীবিলাস বললে, ও সতীশ, গলার আওয়াজ যে পাচ্ছি, কাকে কী বলছ? কী হয়েছে?
ওপাশ থেকে জবাবা এল, এই তো দাদা, একটা কাচের গ্লাস গেল ভেঙে। গ্লাসটা ভালো দাম দিয়ে কিনেছিলাম এই ভেবে যে অতিথি মানুষ-টানুষ এলে পর জল দেওয়া যাবে—তাও আবার ভেঙে গেল। আমরা গরিব মানুষ, আমাদের এমন হলে কি চলে, বলুন?
-কে ভাঙলে?
-ভাঙবে আবার কে? এই হল কি–
ওদিকে দেওয়ালের ওপাশে সতীশের বউ তাকে চুপিচুপি বলছে, বাইরে থেকে ভয়ানক তেষ্টা নিয়ে এসে আমায় বললে, বউ, দাও এক গ্লাস জল, সেই গ্লাসটি করে। দারুণ তেষ্টা পেয়েছে আমার। আনলুম জলের বদলে সরবৎ করে, এসে দেখি তুমি হাসছো, হাত থেকে সরবৎ তো নিলে না, নিলে আমাকে, গ্লাস পড়ে ভেঙে গেল, আমি কী করব বল? আমার কী দোষ? আবার হাসছে, আরে, আরে, দ্যাখো, অত ফাজলামি কোরো না। দেবো মুখের ভিতর এই ভাঙা কাচ ফুটিয়ে–
এদিকে আবার শ্রীবিলাস সতীশের দিক থেকে কোনো আওয়াজ না পেয়ে বললে, সতীশ, ও সতীশ–