—শেষ পর্যন্ত দেখলেই তো জানা যেত, বিমল বললে, কিন্তু আমি জানি, বই পড়েছি, Anna আত্মহত্যা করল।
—আমিও তাই ভাবছিলুম। ওরকম জীবন কখনো ভালো নয়। তার শেষ কখনো ভালো হতে পারে না।
—কিন্তু মানুষের ভুল বলে একটা জিনিষ আছে, এটা তো স্বীকার করো।
–করি, কিন্তু এও জানি, সে ভুল আমরা জেনেশুনেই করি। তাই তার ফল কখনো ভালো হয় না। কেবল দুঃখ আর দুঃখ। তার পরের জীবন একটা কান্নার সমুদ্র। ওর জন্যে দুঃখ হয়, কিন্তু সেজন্যে তুমি আর কী করতে পারো বল? যে মেয়ে স্বামী আর ছেলে থাকতে আর একজনকে ভালোবাসে, সে ভালোবাসার, ধরো তোমার কাছেই যদি ওরকম কোনো ঘটনা ঘটে, তার পক্ষে তুমি কি তাহলে সাক্ষী দিতে পারবে? পারবে না। কেবল দুঃখই হয়।
—তা ছাড়া আর উপায় কী বল? কিন্তু তুমি যা বললে তা না করতে পারলেও নিজের দিক থেকে প্রশান্ত মনে ক্ষমাও তো করতে পারি?
—তা পারো। রাণি আবার শুয়ে পড়ল। কতক্ষণ কাটল চুপচাপ। বিমলের সিগারেটটা শেষ হয়ে গেছে। সে হাত-পা গুটিয়ে বসেই রইল। পাশের বাড়ির বাসন মাজার শব্দ কানে আসছে।
—ঘুমুলে?
—না।
—হঠাৎ অত মনমরা হয়ে গেলে কেন? বিমল যেন অনেক সাহসে বললে।
–কী হবে অত পরেরটা ভেবে? রাণির স্বর ভারী হয়ে এল।
বিমল লক্ষ করছে, তবু বললে, তা ঠিক। তবে শুধু নিজের ভাবনাই তো সার নয়।
—এও ঠিক, কিন্তু সার নয় কখন, যখন নিজের ভাবনা বলে একটা কিছু অন্তত থাকে।
বিমল আবার জিজ্ঞেস করলে, সে কি একেবারেই নেই?
—আছে কি নেই তা কি তুমি নিজেই জান না? রাণি উষ্ণ হয়ে উঠল, কেন আবার আমাকেই জিজ্ঞেস করছ? তুমি আমার চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান, এটুকু বোঝবার শক্তি আমার থাকলে তোমারও নিশ্চয়ই আছে। ভাবনা! সে কার থাকে? তুমি বলো। তুমিই খুঁজে বের করো।
-আমি তো অনেক দেখেছি, পাইনি। জানতাম, তোমারও নেই। এখন দেখছি কিছু আছে। বলো তাহলে। কিছু সময় কাটানো যাবে। যে দিনগুলো এত অবহেলায় আর আলস্যে সেগুলোর কিছু অন্তত কাজে লাগানো যাবে।
-ইস, আমি তো আর পারিনে। রাণি আর বলতে পারলে না, স্বর বাষ্পচ্ছন্ন, সে বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে রইল।
বিমলও চুপ করে গেল। রাত বেড়ে চলেছে। চারদিক একেবারে নিস্তব্ধ। দূর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল। সঙ্গে হুইসিলের শব্দ। শহরের প্রান্তে গভীর রাতের ট্রেন যাচ্ছে।
বিমলের চোখে ঘুম নেই। সে নড়েচড়ে বসল। কী শীত! ঘরের আলোটাও দুরন্ত শীতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। কিন্তু একটা কিরকম যেন অলসতায় বিমল চেয়ার থেকে উঠল না।
গির্জার ঘড়িতে বারোটা বাজল।
এবার সে চমকে উঠল। চেয়ার থেকে উঠে জানালাগুলো আগে বন্ধ করল, তারপর সেইখানেই কতক্ষণ উদ্দেশ্যহীন ভাবে দাঁড়িয়ে খাটের কাছে গেল। রাণি ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই। ঘুমের চোখেই হয়তো আলোর দিকে পাশ ফিরে শুয়েছে। বাইরের পোশাকই এখন গায়ে। সেই জরিপেড়ে নীল সিল্কের শাড়ি, গায়ের সবকিছু একেবারে একটা গরম জামায় গিয়ে শেষ, বুকের মাঝখানে সবগুলো জামা ঈষৎ ফাঁক হয়ে একটা কোণের মতো সৃষ্টি করেছে। শুভ্র কতটুকু বুক। একটা সরু হার। চারিদিকে একটি মিষ্টি গন্ধ।
বিমল ডাকল না।
নিঃশব্দে ভাঁজ করা লেপটি তার গায়ের ওপর টেনে দিয়ে এবার টেবিলের কাছে একটা বই খুলে পড়তে লাগল। সময়ের বিরাম নেই। একটা বিড়াল এসেছে ঘরে। ব্যাপারটা খুব আশ্চর্যের নয়। কিন্তু আশ্চর্যের যা তা হচ্ছে ওর ভীষণ চেহারা–গায়ের রঙ মিশকালো, একটু সাদা ছিট নেই, আর চোখদুটো আলোর ভাঁটার মতো জ্বলজ্বল করছে। হঠাৎ দেখলে ভয় করে।
বিড়াল। বিমল দেখতে পেয়েছিল। সে এটা আরও অনেকবার দেখেছে, কিন্তু অন্যবার আজ রাতের মতো হয়ে ওঠেনি। সে চেয়ে রইল তার দিকে একদৃষ্টে, বিড়ালটাও চেয়ে রয়েছে একইরকম ভাবে।
বিমলের হঠাৎ ভয়ানক হাসি পেল : মনে মনে বললে, ওরে তোরও কি নিদ্রাবিহীন রাত্রি?
কিন্তু এখন হাসবার কথা নয়। ভয় পাওয়ার, নইলে রাগবার কথা। বিমল এবার রেগে গেল, হাতের কাছে ছিল একটা খালি সিগারেটের কৌটো, খুব চুপিচুপি সেটা হাতে নিয়ে হঠাৎ ছুঁড়ে মারল বিড়ালটার দিকে। কিন্তু তার পায়ে সেটা লাগল না। বিড়ালটা যেখান দিয়ে এসেছিল সেখান দিয়েই দৌড়ে পালাল।
ইতিমধ্যে কৌটোর শব্দে রাণি জেগে উঠেছে। বিমল অপ্রতিভ হয়ে তাড়াতাড়ি আবার বইয়ে মন দিলে। রাণি আশ্চর্য হয়ে বললে, ওকি, তুমি এখনও বসে!
সে আস্তে উঠে তার কাছে এল, বললে, ক-টা বেজেছে?
–বোধহয় একটা।
–একটা! রাণির চোখ দুটি বড়ো হয়ে গেল, বলল, আর তুমি এখনও জেগে?
-তা এমনকী হয়েছে? রাত একটা, এমনকী! বেশি ঘুমোনো কি ভালো? জগতে যত বড়ো বড়ো লোক আছেন তাঁরা কখনও বেশি ঘুমোননি, বই খুলে দেখো গিয়ে।
এই কয়েক ঘণ্টা আগের কথা রাণির মনে পড়লো, হঠাৎ অনুতাপে, আর একটা দুঃখে তার চোখ দুটি সজল হয়ে এল। বলল, তুমি কি বড়োলোক?
-না, তা নই, কিন্তু মহাজনপন্থা অনুসরণ তো করতে হবে।
–দরকার নেই। রাণি যেন ভয়ানক অনুতপ্ত হয়ে বলল, আমার অনেক অপরাধ হয়েছে। তুমি এখনও না খেয়ে আছ, আর আমি কি না ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা করো।
মাথাটি নীচু করে সে দুহাত জোড় করল। বিমল তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে উঠে তার দুটি হাত নিজের হাতে নিয়ে বললে, আহা, একি করছ? তোমার কিছু অপরাধ হয়নি। আমি এতটুকু মনে করিনি।