সে অনুভব করল, তার হাতের মধ্যে অদিতির হাতটি আরও চেপে এসেছে।
সন্ধ্যা গাঢ় হল।
জিমখানা ক্লাবের উৎসবের বাজনা শোনা যাচ্ছে; রাত নটা। রমলা আর অদিতি হোটেলে ফিরল। নীচের তলায় গ্রামাফোনে মার্লিনের গান হচ্ছে। ওপরে ওঠার সিঁড়ির পাশে জানালা দিয়ে দেখা গেল, কর্মরত দু-তিনটে মেম আর টেবিল ঘিরে সাহেব।
ওপরে গিয়ে অদিতি চেয়ারে বসে পড়ল আর রমলা দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে।
অদিতি একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বললো, কি, দাঁড়িয়ে যে!
–বিছানা করতে হবে না?
–কোথায় হবে? অদিতি ধোঁয়া ছেড়ে বলল, জায়গা নেই তো। ওটা তো একজনের খাট। তুমিই না হয় ঘুমাও, আমি এখানে বসে–।
রমলা একরকম চেঁচিয়ে উঠল—তবে আমি কী করব? এখন গাড়ি আছে?
-ভয় পাও কেন রমলা? এ পর্যন্ত আগাগোড়া আমার স্বভাবটায় কী দেখতে পেলে, একবারটি ভেবে দেখ না। আজ রাতেই তোমাকে যেতে হবে, অসম্ভব এ কথা। অনেকদিন পর স্বামী-স্ত্রীতে দেখা হলে পর তারা রাত জাগতেও তো পারে? কি বল? তারপর মেঝে আছে। সে কথা কি তুমি এত ভুলে গেলে যে, চেঁচিয়ে উঠলে ভয় পেয়ে?
অদিতি হাসতে হাসতে খুব কাছে এসে বলল, কী মজা, লক্ষ্য দুজনেরই আমাদের এক হলেও ভান করে তোমাকে একটু রাগিয়ে দিলাম, তোমাকে সুন্দর দেখাল, তুমি ধরা পড়লে—আর—এখন হাসছ? অদিতি রমলার মুখের ওপর নত হয়ে তার পাতলা ঠোঁটে একটি চুমো খেয়ে বলল,
খিদে পেয়েছে বড়ো। বয়কে খবর দিই।
-না আমার মোটেই ক্ষিদে নেই, তুমি খেলে খেতে পারো–
—তবে আমারও নেই।
—কি বল? আশ্চর্যের ভাবে রমলা তাকাল, এই যে বললে—
অদিতি হেসে বলল, মনে আছে, তোমার খাওয়ার সময়, হাত গুটিয়ে বসলে–
-তারই শোধ নেওয়া হচ্ছে বুঝি?
–হ্যাঁ।
–আচ্ছা বয়কে ডাকো। আমি হার মানছি।
খাওয়া, দাওয়ার পর।
রাত্রি গভীর হয়ে এসেছে, আর বেড়ে উঠছে তার রহস্যময়তা। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, আকাশে অজস্র তারা চোখ মেলে রাত জাগছে, আবার দিনের বেলা। ঘুমুবে। গির্জের ঘড়িতে বাজল বারোটা, বাজল একটা…
রাত্রির রহস্য গভীরতর হল। তারপর একটু একটু করে ভোরের আভাস।
বাজলো বেলা আটটা।
শহরের চোখে নেশা জমে রাতে, আর ভোর হতেই সে নেশা যায় টুটে, শুরু হয় কোলাহল, ব্যস্ততা, মোটরের হর্ণ। দিনের আলোয় মানুষগুলো মুখখাস পরে।
অদিতি চেয়ারে বসে সিগারেট খাচ্ছে।
আর—রমলা শুয়ে আছে মেঝেতে পাতা বিছানায়।
রমলা—
কি?
বারোটায় ছাড়বে কলকাতার গাড়ি। এখন আটটা বেজে গেছে। আমার স্বভাবটা তো জানো, আপনভোলো নই কিন্তু নিজেকে ভুলতে পারি ইচ্ছে করলে। তুমি চলে যাও, এতটুকু জোর আমি করব না,—থাকো, তোমাকে ভয়ানক ভালোবাসব– ওঠো। না গেলে কলেজে যাওয়া হবে না, ছুটিও নাওনি। ওঠো। তোমার অনেক কাজ–
আমাকে ঠাট্টা কোরো না।
তুমি কি স্বপ্ন দেখছো।
হ্যাঁ, খুব ভালো একটা স্বপ্ন, আগে কখনও দেখিনি। খুব সুন্দর, আমার ভালো লাগছে। এত ভালো লাগছে যে তা তোমায় মুখে বোঝাতে পারব না। এত ভালো, গভীর…
রমলার ঠোঁট চেপে আসছে, চোখের পাতা অর্ধেক খোলা।
তুমি ঘুমোও আমি সব ব্যবস্থা করি গে।
না, রমলা এবার যেন জেগে উঠল, বললো, না, তুমি কোথায় যাচ্ছ আমায় একা ফেলে?
অদিতি হেসে বলল, কেন সম্মতির অপেক্ষা করতে হবে নাকি?
রমলাও হেসে বলল, আচ্ছা কাল বিকেল থেকে এ পর্যন্ত ভেবে দ্যাখো তো আমার সম্মতির দিকে কতদূর চাওয়া হয়েছে?
অদিতি বললে, বৃথাই এতদিন প্রফেসারি করলুম রমলা। অনেক আগেই এটা আমার জানা উচিত ছিল যে, মেয়েরা মুখে কিছু বলে না তাদের ডাকাতি করতে হয়, অর্জুনের মতো হরণ করতে হয়। ডাকাত জড়িমায় রমলা চোখ বুজল আবার, তার রাত্রি এখনও শেষ হয়নি।
মরুভূমিতে মুক্তি
আশ্চর্য, এমন একটা ছবি রানির ভালো লাগল না। অর্ধেকও হয়নি, তখনি সে অস্বস্তি বোধ করেছিল। আগে, পেছনে ও পাশের দর্শকগুলো তন্ময় হয়ে দেখছে, কিন্তু রাণি তার চোখ দুটি যদিও পর্দার দিকে রেখেছে, ভালো লাগছে না তার। অথচ এখানে আসতে তারই আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি।
সে বিমলকে চুপি চুপি বললে, চলো বাড়ি যাই।
–কেন, ভালো লাগছে না?
–না, তুমি চলো।
—বিমল বললে, দাঁড়াও ইন্টারভ্যালটা তো হোক।
হলের ভেতরের হাওয়া যেন ভারী হয়ে উঠেছে, রাণি নিশ্বাস ফেলতে পারছে না।
বিশ্রাম হল, কিন্তু বিমল যা মনে করেছিল তা হল না, রাণি আর থাকল না। সে আর কী করে, নীল আলোর নীচ দিয়ে বাইরে এসে গাড়িতে উঠল।
কনকনে শীত। চলতি গাড়িতে বাতাসও লাগছে। রাণি আরও ঘন হয়ে বসল।
বাসায় চাকর রামলোচন অপেক্ষা করছিল। রাণি গিয়ে তাকে বিদায় দিয়ে দিলে। তারপর ওপরে গিয়ে একেবারেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। যেন এই শীতের রাতেও অনেক ক্লান্ত। ওর এই এক দোষ, একটা সামান্যতম কিছু অসঙ্গতি ঘটলে, সে তা চেপে রাখতে পারে না, প্রকাশ করে ফেলে। কিন্তু ওদিকে আবার কী যে অসঙ্গতি ঘটেছে তাও সহজে জানাবে না, এখন যদি কেউ তার অনুভবের তীক্ষ্ণতায় জানতে পারে।
বিমল একটা চেয়ারে বসেছিল। ঘরের জানালাগুলো বন্ধ। টেবিলের ওপর আলো জ্বলছে। কিন্তু পরে রাণি জানালাগুলো খুলে দিয়ে খাটের ওপর বসল।
-বাইরে ভয়ানক হিম পড়ছে, জানলা খোলার কী দরকার ছিল?
–থাক না খোলা, পরে বন্ধ করে দেব।
বিমল একটা সিগারেট ধরাল। কথায় কথায় রাণি বললে, আচ্ছা মেয়েটি যে ওরকম অবৈধভাবে ভালোবেসে চলল, এর শেষ কোথায় জান?