না, এখন স্নান করব। রমলা উঠে জুতো খুলল।
অদিতি বলল, তা হলে তুমি কাপড় বদলাও, আমি যাই।
যাও। রমলা মিষ্টি হেসে বলল, আবার এখনই এসো কিন্তু। বাথরুমটা দেখিয়ে দেবে এসে।
স্নানের পর শরীরটা বেশ ঝরঝরে হল, ভালো লাগল।
অদিতি বলল, বয়কে ডাকি। কী খাবার বল?
–সে সম্বন্ধে আমার কোনো প্রেজুডিস নেই; যা ভালো হয়।
-বেশ। অদিতি খাবার ব্যবস্থা করল। রমলা বলল, সাহেবের হোটেল। খরচ। দাও কত?
–তা কি তোমায় বলিনি রমলা? সে সংসারে অনেক ছেলেমেয়ে, এক স্বামী আর এক স্ত্রী, তাদের বুড়ি মা–বেশ চলে এ টাকায় যত আমি দিই এখানে খাওয়া আর থাকায়। অবিশ্যি এই আমার ভালো লাগে। কোনো ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হয় না।
রমলা বলল, মাইনেয় কুলোয় তাহলে?
–কোনো মাসে কুলোয়, কোনো মাসে কুলোয় না। জানো তো, আমার এক বিধবা বোন আছে, তাকে সাহায্য করতে হয়।
—জানি, রমলা এমনি হাত দুটো এক করে বলল, কিন্তু একটা কথা বলব
-কী?
—বলো কিছু মনে করবে না—
অদিতি হেসে বললো, না বল। রমলা বলল, আমার তো মোটেই খরচ নেই। তোমার যখন দরকার, কেন নাও না–
–চেয়ে? অদিতি আবার হাসল।
রমলার একবার ইচ্ছে হল বলে, না, চেয়ে নয়, জোর করে। কিন্তু লজ্জায় বলতে পারল না।
তাকে নীরব দেখে অদিতি বলল, কি, প্রস্তাব করে বুঝি ঠকে গেলে? এ তো জানোই মেয়েদের অর্জিত টাকা পুরুষে নেয় না।
—কিন্তু তা তো অনেকে নেয় দেখেছি।
–না, তা নয়। আমি বলছিলুম, তাহলে যে চুক্তি ভঙ্গ হবে।
—ও, বলে রমলা একটা নিশ্বাস ফেলল চেপে। অদিতি তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলল, তুমি একটু পাতলা হয়ে গেছ।
-খুব কি খাটুনি পড়েছে?
–না। বেশি পরিশ্রম আমার ধাতে কোনোদিনই সইল না, তুমি তো জানো, রমলা হেসে বলল, তবু কেমন করে যে রোগা হলুম বুঝতে পারছি না তো। কিন্তু তুমি টের পেলে।
অদিতি বলল, না, রোগা নয়। তুমি যেন আরও slim, আরও graceful হয়েছ।
রমলা নীরবে হাসল।
বয়ের হাতে খাবার এল। টেবিলের দুপাশে মুখোমুখি তারা বসল।
রমলা বললে, তুমি খাবে না?
–বেশিক্ষণ হয়নি যে খেয়েছি, অদিতি বলল, তুমি খাও, আমি গল্প করি।
রমলা হাত গুটিয়ে বসল।—এত খেতে আমি কিছুতেই পারব না। তুমি এসো সঙ্গে।
ভঙ্গিটা কতকটা ছোটো মেয়ের আবদারের মতে, এ পরিচয় যেন অদিতির চোখে নতুন ঠেকল। সে হেসে বলল, আচ্ছা এসো।
খাওয়া শেষ হলে পর, অদিতি কৌটো থেকে একটা সিগারেট নিয়ে বললে, তোমাদের নির্মলাদি কেমন, এখনও বিয়ে করেননি? এখনও কুমারী নির্মলা রায়?
-হ্যাঁ, এখনও কুমারী নির্মলা রায়। রমলা মুচকি হাসল।
সিগারেটে আগুন লাগানো হয়নি। অদিতি তা মুখে দিয়ে এমনি বসেছিল। রমলা, দেশলাই-এর কাঠি জ্বালিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে দিল।
তাতে একটি টান দিয়ে কতকগুলো ধোঁয়া ছেড়ে অদিতি বলল, তুমি ঘুমোও, সারারাত জেগেছ।
রমলা সত্যি বড়ো ক্লান্তি বোধ করছিল। সে পাতা বিছানায় শুয়ে পড়ল।
অদিতি টেবিলের ওপর থেকে একটা বই নিয়ে পড়তে লাগল।…
রমলা চোখ রগড়িয়ে ভাবলো, সে কোথায় এসেছে! এই তো কাল ছিল একা, আর আজ? কে আছে পাশে? এ কোন জায়গা?
সমস্ত ঘরটিতে রমলা চাপা আনন্দে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। কিন্তু অদিতি ঘরে নেই। সে হাতের কাছে ছোটো টেবিল থেকে ঘড়ি তুলে দেখলো। পাঁচটা বেজেছে।
বেশিক্ষণ ঘুমুইনি তো! তবে অদিতি গেল কোথায়? একটু ভয় হলে যেন। খাট থেকে নেমে সে বাইরে বারান্দায় গেল। সেখানে অদিতি নেই। তার ইচ্ছে হল চেঁচিয়ে ডাকে।
নীচে গিয়ে হোটেলের মেমগুলোকে জিজ্ঞেস করলে হয়। কিন্তু ওরা কি জানে? বারান্দায় রেলিং ধরে সে ভাবতে লাগল।
-রমলা।
রমলা চমকে ফিরে তাকাল, অদিতি খালি গায়ে ভিজে কাপড়ে দাঁড়িয়ে, কাঁধে টার্কিস টাওয়েল।
–এ কী?
অদিতি হেসে বলল, কাপড়-চোপড় নিতে মনে নেই।
বাথরুমে ঢুকেও মনে হল না?
হয়েছিল, কিন্তু তখন অর্ধেক স্নান করে ফেলেছি কি না!
রমলা খিলখিল করে হেসে উঠল। এই প্রথম সে এমনভাবে হাসল। তারপর ঘরে গিয়ে কাপড় এনে দিল।
একটু পর অদিতি ঠিক হয়ে বলল, বেড়িয়ে আসবে?
চলো।
ডাক-বাংলো, রেলওয়ে কর্মচারীদের কোয়ার্টার, পথের পাশে বড়ো লাল দালান, গাছের সারি, জনহীনপ্রায় পীচ-ঢালা মসৃণ রাস্তা।
শহরের বুকে নেমেছে ধূসর পাতলা অন্ধকার, সারি সারি বাড়ি আর গাছপালার মধ্যে ছায়া এসেছে ঘন হয়ে।
আঁকাবাঁকা রাস্তা সাপের মতো, কালো তার রং, বাতাসে আর দীর্ঘ সেগুন পাতার সঙ্গে শব্দ হচ্ছে মাঝে মাঝে।
পাশে লম্বা লেক। তারপরেই অনেক দূর পর্যন্ত মাঠ। জলের মাঝখানে ছোটো ঢেউ।
এখানে এই খোলা মাঠে, নরম ঘাসে, গাছের ছায়ায় আকাশের নীচে বসলে পর চোখে কেমন যেন নেশা লাগে, হাত দুটি কাকে যেন হাতড়ায়।
অদিতি সবুজ ঘাসের ওপর পা ফেলতে ফেলতে বলল, একটা কথা এখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি, তুমি কেমন আছো?
রমলা হাত ধরে ছিল, একটু হাসল, বললে—ভালো। তুমি?
ছোটোবেলায় কোনো কিছু হলেই আগে থেকেই বলে রাখতুম, তোমরা যাই বলবে তার চেয়ে একবার বেশি আমার। এখনও তাই বলছি। তুমি যতটুকু ভালো, তা যদি ডিগ্রি দিয়ে মাপা যায়, তার চেয়ে এক ডিগ্রি সবসময়ে আমি বেশি।
হাসিমুখে রমলা বলল, জায়গাটা বেশ না?
-হুঁ, কিন্তু একা নয়। আমরা দুজনে আছি বলে।
—মানে?
–মানে, আমি আছি বলে তোমার ভালো লাগে, আর তুমি আছো। বলে আমার ভালো লাগে। অন্য সময়ে, অন্য কেউ হলে রমলা করত প্রতিবাদ, কিন্তু এখন করল না।