রমলা বললে, ভারী exhausted feel করছি।
বোর্ডিং-এ চলে যেতে চাও?
If you permit—
নির্মলা তাড়াতাড়ি বললেন, যাও।
একটু হেসে রমলা চলে এল।
কলেজের লাইব্রেরি। বুড়ো লাইব্রেরিয়ান টেবিলের ওপর ভর দিয়ে বই পড়ছেন। ঘরে আর কেউ নেই।
রমলা একটা বই নেবে। বই দিয়ে সে তার ভালো-না-লাগার সময়গুলো কাটাবে। সে বললে, শর কোন বই সবচেয়ে ভালো হবে আপনি জানেন বড়োবাবু?
বড়োবাবু বললেন, আমাদের এখানে তো সব বই নেই, Man and Superman ছিল, এখন লাইব্রেরিতে নেই—কে যে নিয়েছে! Doctors Dilemma নিতে পারেন।
দিন তো।
যদুবাবু বই এনে দিলেন।
রমলা বই হাতে করে বোর্ডিং-এ চলে এল। দুটো বেজে গেছে। সে হাত থেকে ঘড়ি খুলতে খুলতে দেখল।
সমুখের জানালা দিয়ে হু হু করে আসছে বাতাস। তারই প্রতাপে একটা পাতলা ক্যালেণ্ডার দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে শব্দ করছে।
দুপুরের নিস্তব্ধতা চারিদিকে।
রমলা জুতো ছেড়ে আয়নার কাছে এসে দাঁড়াল। আয়নাটা ছটো। বোর্ডিংয়ে এরকমই থাকে। কিন্তু রোজই কারণে অকারণে আয়নার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে রমলার একটা বড়ো আয়নার কথা মনে পড়ে যাতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত যথাযথ দেখা যায়। কিন্তু দেয়ালে ঝোলানো ছোটো ওই জাপানি আয়নায় দেহের সবটুকু দেখা যায় না। রূপ কি শুধু মুখেই!
পোষাক-পরিচ্ছদ বদলাবার পর রমলা গামছা সাবান নিয়ে স্নানের ঘরে গেল। কিছু পরে হাতমুখ ধুয়ে আবার নিজের ঘরে ফিরে এল।
গত রাত্রির বিছানা এখনও পাতাই রয়ে গেছে। টেবিলের ওপর ক-টা বই ছড়ানো।
Writing pad-এর পাতা বাতাসে ফরফর করছে।
রমলা আবার আয়নার কাছে দাঁড়িয়ে আংশিক প্রসাধন সেরে বইটা হাতে করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। বই খুলতেই Preface–
এক—
দুই—
তিন পৃষ্ঠা—রমলার আবার বিরক্তি এসে গেল। ক্রমাগত আরও পাতা উলটিয়ে দেখল, প্রায় অর্ধেক বই-ই কেবল Preface! তারপরে আসল নাটক।
ওরে বাপরে!
আপনারা শুনে আরও আশ্চর্য হবেন রমলা গুপ্তা এম-এ বইটা পাশে রেখে দিল। অদ্ভুত বটে! এরকম মনের অবস্থায় আপনি আমি হয়তো ক্ষমা পেতে পারি কিন্তু কলেজের অধ্যাপিকা রমলা গুপ্তা কখনো পান না।
আমি জানি এ আপনাদের চোখে ঠেকবে। কিন্তু ঘটেছিল সত্যি। কেন যে ঘটেছিল তা এখন খুলে বলি।
দু-বছর আগেকার কথা।
প্যাক্ট হল। কেউ কারোর স্বাধীনতায় বাধা দিতে পারবে না। যদি কখনো প্রয়োজন হয় পরস্পরে স্বামী-স্ত্রীর মতো ব্যবহার করবার তখন দুজনের সম্মতিতেই হবে, তার আগে নয়।
পূর্ববঙ্গের কোনো এক বেসরকারি কলেজের তরুণ অধ্যাপক অদিতি গুপ্ত চুক্তিপত্রে সায় দিলেন। রমলা তখন নতুন চাকরি পেয়েছে। তখন তার প্রাচুর্যের আনন্দ, নতুন জীবনের আনন্দ যেন খোলা মাঠের বাতাস, যেন বাধা না পাওয়া মধ্যরাত্রির জ্যোৎস্না।
অদিতি গুপ্তের মতো মানুষ দেখা যায় না। মনে হল, এই তার স্বামী হওয়ার উপযুক্ত। এতটুকু অভিযোগ নেই; জোর খাটাবার ইচ্ছে নেই।
কতকগুলো চিঠি আছে। বিয়ের পর এগুলোই সম্বল। রমলা আবার উঠে ডেস্ক থেকে চিঠিগুলো বার করল। একটি সে খুলে বসল।
চিঠির কাগজ প্যাড থেকে নেওয়া নয়, সামান্য ছেঁড়া কাগজ। অন্য কোনো বাহুল্য নেই; অদিতি গুপ্তের মনের একদিক এখান দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু লেখার বাহুল্য আছে; মানে পড়তে বেশ লাগে।
সেটিতে লেখা :–রমলা, কলেজের ছাত্রদের এক সভায় শরৎচন্দ্রের নারীচরিত্র সম্বন্ধে কিছু বলতে হবে, ছাত্রদের পক্ষ থেকে এই আদেশ এসেছে। কারণ আমি পড়াই বাংলা। যাই বলো, তুমি আছ বেশ, তোমার জীবনে ওটা কখনোই লাগবে না কাজে, অন্তত বক্তৃতা দিতে বলবে না কেউ।
তারপর আগের দিন রাতে প্রবন্ধ লিখে পরের দিন বলেছি কিছু। শুনেছি খুব ভালো নাকি হয়েছে। আমার প্রবন্ধে এমন একটা দিক নাকি প্রকাশিত হয়েছে যা আগে কখনো দেখা যায় নি। সম্পূর্ণ অভিনব। অভিনবই বটে।
নারী-চরিত্রে সর্বজ্ঞ আমি। হয়তো আরও কিছু লিখলে একটি অথরিটি হয়ে যেতাম!–
কী যেন এক অস্পষ্ট ইঙ্গিত, মনে এক আভাস আছে এই চিঠিতে, রমলা যেন আজ এই প্রথম বুঝতে পারল।
কিন্তু এ চিঠি আজকের নয়, অনেক দিনের। তখনকার মনের অবস্থা যা ছিল, এখনও তাই আছে কি না, কে জানে?
রমলা বাইরের দিকে চাইল! বোর্ডিংয়ের মাঠের পামগাছের কতখানি দেখা যাচ্ছে আর লম্বা ইউক্যালিপটাসের ছোটো পাতা বাতাসে কাঁপছে।
ফাল্গুনের বাতাস, একটু শীত করে যেন। রমলা তার একহারা পরা চাদর আরও খুলে গায়ে চেপে ধরল। তা ছাড়া শরীরটাও ক্লান্ত বোধ হচ্ছে।
অদিতি বিস্ময়ে বলল, কোনো খবর না দিয়েই যে!
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে রমলা বলল, ও খবর দিইনি বুঝি?
সে তো তুমিই জানো।
সে কথা আগে ভাববার সময় পাইনি।
এত কাজ! একরকম নোটে ছাত্রীরা আর খুশি নয়, তাই অন্য অথরের বই পড়তে হয় বুঝি খুব?
না, ইকনমিক্স সম্বন্ধে কেউ বড়ো আগ্রহ প্রকাশ করে না। রমলা হাসল। ঘরে ঢুকে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে বলল, ঘরটি বেশ পরিষ্কার সাজানো তো! আমার ঘরের তুলনায় এ স্বর্গ। ইস, তুমি যদি দেখতে–
থাক, দেখার আর দরকার নেই। মেয়েদের বোর্ডিংয়ে পুরুষের যাবার অধিকার তো নেই।
অদিতি রমলাকে হাত ধরে বসাল। তারপর বলল, সারারাত ট্রেনের জার্নি, খুব strain হয়েছে নিশ্চয়ই, ঘুমও হয়নি। তুমি বিশ্রাম করো।