সতীন আবার বলিতেছে, ভাইসব, সমাজের যারা পরগাছা-যারা আমাদের গায়ের রক্ত শুষে শুধু বসে খায় তাদের উপড়ে ফেলবার দিন এসেছে আজ। ভাইসব আমাদের জিনিস দিয়েই ওরা মোটর হাঁকায়। ব্যাঙ্কে লাখ লাখ টাকা জমা রাখে, কিন্তু আমরা না-খেয়ে মরি। এ অত্যাচার কেন আমরা না-খেয়ে সহ্য করব? কেন সহ্য করব? এমনসময় আর এক কান্ড ঘটিল। হঠাৎ একটা হুড়াহুড়ি পড়িয়া গেল। লাঠি হাতে মস্ত জোয়ান একদল লোক বাঁধানো জায়গাটিতে উঠিয়া অনবরত লাঠি চালাইতে লাগিল।
দুই-এক ঘা খাইয়াও সতীন চীৎকার করিয়া বলিল, ভাইসব এদের চিনে রাখুন, এরা সেই জমিদারদেরই ভাড়াটে গুন্ডা, লাঠি চালিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করতে এসেছে!
সতীন আর বলিতে পারিল না, আরও কয়েকটা লাঠির ঘা খাইয়া বসিয়া পড়িল, রক্তে তাহার শরীর ভাসিয়া গেল, যে মাটি একদিন সিঁদুর আর শত শত পাঁঠার রক্তে লাল হইয়াছে, তা আজ মানুষের রক্তে লাল হইয়া গেল।
এক মুহূর্তে যা ঘটিয়া গেল, তা কল্পনাও করা যায় না। ব্যাপার দেখিয়া যে যার মতো পলাইল। আর যাহারা সেই প্রকান্ড, বৃদ্ধ এবং জীর্ণ বটগাছের অত বড়ো হাটের মাঝখানে মুখ থুবড়িয়া পড়িয়া রহিল, তাহাদের দেখিবার কেহ নাই।
ইহার কয়েকদিন পরেই এক ভীষণ ঝড় আসিল, এমন ঝড় এ-অঞ্চলে ইদানীং আর হয় নাই। ঝড়ের ঝাপটা মৃতপ্রায় বটগাছের উপরেই লাগিয়াছিল বেশি। বটগাছ ভাঙিয়া পড়িল, যেন প্রকান্ড এক দৈত্য ধরাশায়ী হইল। আর যেটুকু বাকি ছিল, তাহাও কাটিয়া লওয়া হইল। দেবাংশী গাছের কাঠ ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা ব্যবহার করে না বটে কিন্তু স্থানীয় জমিদার উহা বেচিয়া বেশ দু-পয়সা লাভ করিলেন।
দীর্ঘ দুইশ বছর পরে বটগাছ অবশেষে মারা গেল। ইহার নীচে অনেক ইতিহাস রচিত হইয়াছে, কত দীর্ঘশ্বাস চাপাকান্নার শব্দ ইহার প্রতিটি পাতার নিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত; ইহার নীচে কত লোক চাপা পড়িয়াছে, তারপর এক রক্তের গঙ্গা বহিয়া গেল, এখনও কত রক্তের বীজ ছড়াইয়া আছে, সেই বীজ হইতে একদিন অঙ্কুর দেখা দিবে, তারপর অনেক নতুন বৃক্ষ জন্ম লইবে, ইহাও আশা করা যায়।
ভালো-না-লাগার-শেষ
রমলা বিরক্ত হয়ে উঠল। যেন এত বিরক্তি তার কোনোদিন আসেনি। নইলে ইকনমিক্সের পপুলেশন চ্যাপ্টারটা তো জমে ওঠবার কথা, কিন্তু আজকার ক্লাসে কিছুতেই যেন তার লেকচার গভীর হয়ে উঠল না।
এমন এক একটা দিন আসে সত্যি যখন কিছুই ভালো লাগে না। আজ যেন তাই। সে যেন আজ প্রথম টের পেল, ইস্কুলের মেয়েদের চেয়ে কলেজের মেয়েরা গোলমাল করে বেশি। অথচ এখানে কিছুই বলা যায় না, ইস্কুলের মতো যায় না কান মলে দেওয়া। ইস্কুল থেকে কলেজে উঠে মনে করে কি-না-কি করে ফেললাম; দুর্ভাগা সব। তার মেয়ে যদি হয়, সে কোনোদিন তাকে কলেজে পড়াবে না। পড়িয়ে বা লাভ কী? কিছু বোঝে না, কিছু জানে না, কেবল চোখ বুঝে মুখস্থ; আর পরীক্ষা খারাপ দিলে হাউহাউ করে কান্না, ফিট—আরও কতো কী! কিন্তু কাজের বেলায় দ্যাখো সব পেছনে পড়ে আছে।
নাচের যত পারফর্ম্যান্সই দিক, একাই কলেজে আসুক, বেড়াক একা, এক মিনিটে হাজারো কথা বলুক, পাঁচ হাজার বলো তো দশ হাজার বছর আগেকার আদিম মনোবৃত্তি আছে বেঁচে।
অথচ পুরুষেরা এমনি বোকা যে এসব তারা মোটেই জানে না, ধরে নেয়। অন্যরকম। কত কবিতা লিখে ফেলে, দেহের রূপ সাধনায়, হয়ে ওঠে তৎপর। রমলা যদি পুরুষ হত তবে দিত সব প্রকাশ করে।
রমলা হাসল, তাহলে কী মজা হবে। দুর্মুল্যতা, অহঙ্কার, লজ্জা সব চুরমার হয়ে যাবে।
রমলার মন আজ ভালো নেই। বলেছি তো, এত বিরক্তি আর অবসাদ তার কোনোদিন আসেনি। দেড়টার পর এত ঘণ্টা লীজার। সে কলেজ বিল্ডিংয়ের সবচেয়ে নির্জন জায়গা দোতলার ছাদে যাওয়া সিঁড়ির কাছে যে এক টুকরো বারান্দা আছে সেখানে এসে দাঁড়াল। অন্যদিন হয় তো লাইব্রেরিতে গিয়ে বসত; গল্প করত প্রভাদির সঙ্গে, ভারী মজার লোক তিনি, হাসাতে হাসাতে মারেন, কিন্তু আজ তার কি হল সে রেলিংয়ে ভর দিয়ে বুকের কাছে এক হাতে মার্শালের ইকনমিক্স চেপে দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। নীচে কিছুদূরে দেখা যায়, গেটের কাছে বেলগাছের ছায়ায় বসে কলেজের দরওয়ান কার সঙ্গে গল্প করছে। ঘণ্টা পড়বার পর মেয়েরা ক্লাস বদলিয়েছে, এখনও দু-একটি মেয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। দুপুরের দমকা বাতাস মাঝে মাঝে গায়ে এসে লাগছে; কপাল আর গালের কাছে দু-এক গোছা চুল উড়ছে বাতাসে। আকাশে ছেঁড়া সাদা মেঘ।
রমলা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার কি মনে করে প্রফেসরদের বিশ্রাম-কক্ষের দিকে গেল। কিন্তু সেখানে প্রভাদি নেই। তাহলে তিনি আসেননি, নাকি আবার প্রিন্সিপালের ঘরে গিয়ে গল্প করছেন?
একপাশে বসে নতুন নিযুক্ত অরুন্ধতী বসু নিবিষ্ট মনে কী যেন পড়ছে। রমলা কোনো সাড়া না দিয়ে নিঃশব্দে প্রিন্সিপালের ঘরে গিয়ে হাজির হল।
প্রভাদি সত্যি আসেননি।
প্রিন্সিপাল নির্মলা রায় গম্ভীরভাবে কাগজপত্র দেখছেন। পাশের চেয়ারে ইংরেজির অধ্যাপক সুধীরবাবু বসে আছেন, কোনো কাজ আছে বোধহয়।
রমলা চকিতে একবার সেদিকে চেয়ে বললে, শরীরটা ভারী খারাপ বোধ হচ্ছে নির্মলাদি। নির্মলা মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কী বললে ভাই? তিনি রমলাকে তুমি বলেই সম্বোধন করেন, রমলার সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার একটু সূত্র নাকি আছে, আর তা ছাড়া সে কলেজের সবচেয়ে অল্পবয়সি অধ্যাপিকা।