কিন্তু শ্রীবিলাস উঠেছে।
বিছানা থেকে উঠেই প্রথমে খুঁজল লাঠি,—এটা ছাড়া সে চলতে পারে না, তার অন্ধত্বকে সে কতকটা উপহাস করে ওই লাঠির সাহায্য নিয়ে। ওই লাঠি তার মস্ত বড়ো সাথি। খুঁজতে খুঁজতে সাথিকে সে খুঁজে পেলোও, তার ডগাটি একবার ডানপাশে, একবার বাঁ-পাশে ফেলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল এবং আন্দাজে দিক ঠিক করে করযোড়ে সূর্যকে প্রণাম করল।
ঘরের ভিতর তার স্ত্রী বিন্দু দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে, ভোরের বাতাসের ছোঁয়ায় বেঘোরে ঘুমুচ্ছে।
লাঠিটা একপাশে রেখে শ্রীবিলাস দেয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝেয় বসে পড়ল। একটু বসে থেকে ডাকতে লাগল, ও বউ, বউ? ওরে কেলো, ওরে হেবো, ওঠ বাবা ওঠ, আর কত ঘুমুবি বল, রোদুর উঠে গেছে যে, ও মা সদু–
অনেক ডাকাডাকিতে বিন্দুর ঘুম ভাঙল, বললে, রাত না পোয়াতে কী আরম্ভ করেছ শুনি?
শ্রীবিলাস বললে, এখনও কি তোমার রাত রয়েছে? কত লোক উঠে গেছে। আমি কতক্ষণ ধরে উঠে বসে আছি।
ছেলেপিলেগুলো ওঠেনি, বিন্দু বাইরে এসে ধপ করে মেঝের উপর বসে চোখ রগড়াল, গা মোড়ামুড়ি দিল, হাই তুলল, তারপর স্থির হয়ে বলল, এই তো এখন উঠলে, আমি বুঝি দেখিনি? কত লোক উঠেছে। একটিকেও তো দেখছিনে বাপু!
—তাতে কী হয়েছে, সকলে পাগল হলে কি তুমিও পাগল হবে বউ?
বিন্দু কি একটা কাজে ভেতরে গেল, যেতে যেতে বললে, আমি বলছি, কেন মিথ্যে কথা? সারারাত যে গরম গেছে, ঘুম একরকম হতেই চায় না, তার ওপর–
—মিথ্যে কথা? শ্রীবিলাস জোরে বললে, আমি মিথুক আর তুমি খুব সত্যবতী না? দেখবে, সকলে উঠেছে কি না? দেখবে দেখবে?
—দেখব, বিন্দু নিঃশব্দে হাসল।
–ওরে সতে, ওগগা শিবনাথ, ও মনুর মা,—কিছুক্ষণ এমনি নিষ্ফল ডেকে হতাশ হয়ে শ্রীবিলাস বললে, আর মেয়েমানুষের অত ঘুমই বা কেন!
-মেয়েমানুষের ঘুমেই চোখ টাটায়, না! বুঝি ঘুম শুধু পুরুষের? শ্রীবিলাস রেগে কী বলতে যাচ্ছিল এমন সময় ঘরের পাশে কার পায়ের শব্দ শোনা গেল।
—ও দাদা, কি করছ?
–কে, বীরু?
-হ্যাঁ।
-এই তো দাদা বসে আছি একা, যাব একা, শ্রীবিলাস যেন এক মুহূর্তে বদলে গেল, বললে, কিছু সঙ্গে যাবে না, কেউ সঙ্গে যাবে না, স্ত্রী নয়, পুত্র নয়, ভাই নয়, বোন নয়, ধন-দৌলত নয়—শ্রীবিলাস গুনগুন করে পরলোকতত্ত্ব বিষয়ক একটা গান ধরলে, তারপর থেমে বীরুর দিকে তাকিয়ে বললে—বাঁশি বেজেছে। কারখানায় চললে এত সকালে?
বীরু বললে, ঠিক এসময়ই তো রোজ আমি যাই দাদা।
—রোজই এসময় যাও? তা হবে, শ্রীবিলাস বললে, ঘড়ি তো নেই যে সময় ঠিক রাখব, কি বল বীরু?
এই একটু আগেই এই নিয়েই স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করছিল।
—কিন্তু আছে মন, আছে তাতে কাঁটা, মিনিটের নয় কিন্তু ঘণ্টার কাঁটা। তাই ঠিক করে বলতে পারিনে ছ-টা বেজে ক-মিনিট হয়েছে, কিন্তু এটা বলতে পারি যে ছ-টা বেজেছে, কি বল?
শ্রীবিলাস হাসল, বললে, ওই যে কথায় বলে মন না গতি–
বিন্দু আবার বাইরেই এসে দাঁড়িয়েছিল, বললে, আমাদের বীরু এখন একটা বিয়ে থা করুক, ঘরদোর কে দেখে বল? তা ছাড়া, অসুখ-বিসুখও তো আছে? করো ভাই করো, আমরা একটা নেমন্তন্ন খাই।
বীরু যেন লজ্জা পেল।
শ্রীবিলাস হেসে বললে, ওই তো মেয়েমানুষের দোষ, কেবল বিয়ে থা করো! আরে, বিয়ে তো করবে, খেতে দেবে কী? তারপর ছেলেপিলে হলে!
তার কথা শুনে বিন্দুর খিলখিল করে হাসতে বা ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল, কে কাকে বলে ? কিন্তু সে তা করল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
শ্রীবিলাস বললে, তাই অল্প মাইনে, দুজনের পেট কী করে চলবে এতে? হ্যাঁ বীরু, তোমার না মাইনে বাড়বার কথা ছিল?
—ছিল, কিন্তু বাড়াচ্ছে না তো?
–বাড়াচ্ছে না? কথা দিয়েও!
–তাইতো দেখা যাচ্ছে।
—কি বলো, এত অন্যায়? কথা দিয়ে কথা-না-রাখার মতো পাপ আর আছে? বাইবেরটা দেখে মনে হয় শ্রীবিলাস ভয়ানক রেগে উঠেছে, পরক্ষণেই বেড়ালের মতো ঠাণ্ডা হয়ে বললে, ভগবান করুন, দিনে দিনে যেন তোমার উন্নতি হয়।
—আমি যাই?
—এসো ভাই।
কাছেই বিন্দুর নিঃশব্দ উপস্থিতি টের না পেয়ে শ্রীবিলাস জোরে ডাকতে লাগল, বউ, ও বউ–
-কী?
এখনও দাঁড়িয়ে আছ? কাল যে বললে, আজ তোমাকে খুব সকালে যেতে হবে, বাবুদের বাড়ির ছেলের ভাত! যাও তাড়াতাড়ি। আবার যদি রেগে-টেগে যায় তাহলে কি করবে বল? যাও শিগগির।
-যাই।
—আর দ্যাখো, ঘরে কোনো খাবার নেই, কিন্তু ছেলেপিলেগুলো খাবে একটা কিছু, দুটো পয়সা যদি থাকে রেখে যেয়ো না হয়, দু-পয়সার মুড়ি কি চিড়ে কিনে এনে খাবেখন।
-হুকুম করবার বেলায় তো খুবই মজা, আর পয়সা নেবার বেলায় কেবল গৌরী সেন! আঁচলে বাঁধা ছিল পয়সা, বিন্দু তা বার করে মেঝের ওপর ঝনাৎ করে ফেলে চলে গেল। শ্রীবিলাস হাত দিয়ে হাতড়াতে হাতড়াতে আপন মনে বললে, আমার হাতের ওপর দিয়ে গেলে কি দোষটা হত শুনি? এখন পয়সা দুটো আমি কী করে পাই? কোথায় না কোথায় গড়িয়ে চলে গেছে কে জানে? লোকে বলে, টাকা-পয়সার হাত-পা আছে।
ছেলেপুলেদের মধ্যে কেলো সকলের বড়ো।
শ্রীবিলাস ডাকলো, ওরে কেলো—
কাছেই কোথায় সে খেলছিল, দৌড়ে এসে বললে, কী বাবা?
-তোদের খুব খিদে পেয়েছে না রে?
–পেয়েছে।
–খুব?
—হ্যাঁ বাবা, খুব।
—হেবো, সদু, ওরা কোথায়?
—ওই তো, আমি যেখানে খেলছিলাম সেখানেই তো খেলছে। সদুটা পিট পিট করে কাঁদছেই কেবল, বলে, খিদে পেয়েছে দাদা। কেলোটা অবলীলাক্রমে মিথ্যে বলে ফেলল।