অসহ্য! সহিতে না পারিয়াও অতিকষ্টে জীবানন্দ মনের বিরক্তি চাপিলেন। বলিলেন, ল্যাণ্ডসকেপ ছাড়াই কি ওতে একটা Loneliness ফুটে ওঠেনি!
—হ্যাঁ, তা ফুটে উঠেছে অবিশ্যি।
—তাহলে? যে জিনিসটির কথা আপনি বলেছেন, সেটা আপনার—শুধু আপনার কেন, সকলের কল্পনায় জন্ম নিক, আমার আঁকার বিষয় নয়, আমি ওই পর্যন্ত এঁকে বোঝাতে পেরেছি, ওখানেই শেষ করেছি, ওই ছবি উপলব্ধি করার পক্ষে আমার আর কোনো দায়িত্ব নেই।
আশ্চর্য হইয়া লাবণ্য একবার শিল্পীর দিকে, একবার ছবির দিকে চাহিল।
—যদি আপনার এ সম্বন্ধে কিছুমাত্র জ্ঞান থেকে থাকে তবে নিশ্চয় বুঝতে পারবেন প্রেজেন্টেশনের ওই টেকনিকই আমার আবিষ্কারের কৃতিত্ব।
ব্যাপার দেখিয়া পূর্বাগতদের যে নিশ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? তাঁহারা যেন কোণঠাসা হইয়া পড়িয়াছেন। বয়স্করা যথাসম্ভব স্বাভাবিক ও সহজ হইয়া ছবি দেখিতে লাগিলেন। বয়স যাদের অল্প, শকুন্তলা ও অন্যান্য মেয়েরা, আড়চোখে চাহিয়া সব দেখিয়া দেখিয়া চরকির মতো ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।
পল চলিয়া গিয়াছে। সুব্রত হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল, সামনের ছবিটি তার চোখে অপূর্ব হইয়া উঠিল, নত হইয়া খুব ভালো করিয়া সেটা দেখিয়া সে আবার চারিদিকে চাহিল। একটু পরে স্বাভাবিকভাবে কতকটা অগ্রসর হইয়া দেখিল, ইতিমধ্যে আর একজন কার অত্যন্ত গা ঘেঁয়িয়া শকুন্তলা কথা বলিতেছে।
-Aweful, aweful! সেক্সপিরিয়ান নায়কের মতো আরও কাছে গিয়া বলা হইল না যে—অথবা কানের কাছে মুখ দিয়া বিনা আড়ম্বরে এবং স্বাভাবিকভাবে মিস চক্রবর্তী, ছবি দেখা হল?—ইহাও বলা হইল না। চুলোয় যাক! নিজের উপর অনেক অভিমান করিয়াই সুব্রত একথা বলিতে বাধ্য হইল এবং কাছেই একটি বয়স্কা, ছিপছিপে অত্যন্ত লম্বা, ছুঁচলো মুখের, শাড়ী-পরিহিতা শ্বেতাঙ্গিনীকে দেখিয়া তাহার কানে কানে না হোক, সামনেই একটু ঝুঁকিয়া সুব্রত বলিল,
— Have you finished, Madam?
–No. Thank you.
অনেকক্ষণ পরে যখন প্রায় সকলেই চলিয়া গিয়াছে, সেই দলটি কেবল তখন একটা মস্ত বড়ো ছবির সামনে জটলা করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল।
জীবানন্দ মাথায় হাত দিয়া বসিয়াছেন, দুই একটি সস্তা ছবি ছাড়া আর বিক্রি হইল না। আশ্চর্যের বিষয় সন্দেহ নাই। তার উপর এই মেয়ে আর ছেলেগুলির যন্ত্রণা। তাঁহার সব রাগ যেন উহাদের উপর গিয়া পড়িল।
বড়ো ছবিখানার নাম Mass.
সীতা বলিল, কী সুন্দর!
দেশাই অত্যন্ত খুশি হইয়া সায় দিল।
লাবণ্যের চোখেও বিস্ময়।
নির্মল বলিল, দেখেছেন, কমরেড ঘোষ, মাস-এর কী চমৎকার রূপ ফুটে উঠেছে এই একখানা ছবিতে। এরা পথ চলতে পারে না, এদের দাঁড়াবার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই, এদের দৃষ্টি নিষ্প্রভ, অথচ এরা জীবনের জীবন, মহাপ্রাণের মূল উৎস, মুষ্টিমেয় মানুষের অসম্ভব বিলাসের উপকরণ জোগায় এরাই! কী আশ্চর্য দেখুন, একখানা ছবিতেই আমাদের কত কথা মনে পড়ে গেল, আমরা অনুভব করলাম (এ কথায় সবচেয়ে আশ্চর্য হইল লাবণ্য, কারণ এই কথাটি জীবানন্দ তাহার কাছেই প্রথম বলিয়াছেন)। কমরেড সীতা, এই একটি ছবি দেখেই আপনার নিশ্চয় মনে হয় আমাদের চারিদিকে চাপা কান্নার শব্দ, আমাদের চারিদিকে জীবনের হীনতম উদাহরণ, খাদ্যের অভাবে, শিক্ষার অভাবে কুৎসিত ব্যায়রামের ছড়াছড়ি, মানুষ হয়ে পশুর জীবন-যাপন। আমাদের চারদিকে অবরুদ্ধ নিশ্বাস, কোটি কোটি ভয়ার্ত চোখ, তারা যেন খুনের অপরাধে অপরাধী একপাল মানুষ। কমরেড দেশাই, এত কথা যাঁর ছবি দেখে আমাদের মনে হয়, তাঁর উদ্দেশে নমস্কার জানাই।—তাহার কণ্ঠস্বর এক অপূর্ব স্নিগ্ধতায় ভরিয়া উঠিয়াছে, চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল।
সকলেই স্তব্ধ, ছবিতে নিবদ্ধ দৃষ্টি।
একটু পরে একজন বলিল, Let us buy this picture.
লাবণ্য তৎক্ষণাৎ অত্যন্ত উৎসাহে বলিয়া উঠিল : আমি সায় দিচ্ছি। আরও সকলের সায় দেওয়ার উৎসাহে সারা হলটি আবার কোলাহলে ভরিয়া উঠিল। জীবানন্দ মুখ তুলিয়া চাহিলেন, রাগে দৃষ্টি তাঁহার তীব্র হইয়া উঠিল।
দেশাই বলিল, ছবিটার দাম কত?
–তিনশো।
নির্মল মুখে মুখে হিসাব করিল আমরা পনেরো জন প্রত্যেকে কুড়ি টাকা করে দিলেই হবে। রাজি?
–রাজি।
লাবণ্য দৌড়াইয়া গেল জীবানন্দর কাছে, তাঁহার হাত ধরিয়া আদরের ভঙ্গিতে বলিল, আমরা অত কষ্ট করে একা একা সব দেখে বেড়াচ্ছি, আর আপনি এখানে চুপ করে বসে আছেন। জানেন আপনার অঙ্কন-পদ্ধতি আমি বুঝতে পেরেছি। তাই তো অত ভালো লাগল। না, না, এখানে বসে থাকলে চলবে না, আপনি চলুন, আমাদের সঙ্গে যোগ দিন। জানেন, আপনার মাস ছবিখানা আমরা কিনব! চলুন, লাবণ্যের দুই চোখে হাসি।
জীবানন্দ আশ্চর্য হইলেন, কিছুই বুঝিতে না পারিয়া অভিভূতের মতো সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন, কাছে গেলে সকলে শ্রদ্ধা আর বিস্ময়ে তাঁহার দিকে চাহিল, দুই হাত তুলিয়া নমস্কার করিল। লাবণ্য কিন্তু হাসিমুখে জীবানন্দর একটি ভারী হাত ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে, যেন তাঁহার অতি আপনার কোনো আত্মীয়! তারপর যখন তাহারা সকলে শিশু-সুলভ হাস্য কোলাহলে চারিদিক ভরিয়া চলিয়া গেল, জীবানন্দ তখনও বিস্ময়ে তাহাদের দীপ্তি গতিপথের দিকে চাহিয়া রহিলেন, কোনো এক সময় সেই বিস্ময়ের ভাব কাটিলে জীবানন্দ ফিরিয়া সেই ছবিখানার দিকে তাকাইলেন, আজ এই মুহূর্তেই নিজের সৃষ্টিরও অত বড়ো রহস্য তাঁহার কাছে দুৰ্ব্বোধ্য হইয়া উঠিল যেন!
অন্ধ শ্রীবিলাসের অনেক দিনের একদিন
সতীশ ওঠেনি, শিবু ওঠেনি, মনুর মা ওঠেনি, এমনকী সূর্যও আকাশে দেখা দেয়নি, তার শুধু আলো পৌঁছেছে পৃথিবীতে।