সুব্রত সাগ্রহে বললে বলুন।
ব্রজকিশোরবাবু গম্ভীর স্বরে বললেন রাতারাতি অনেক লোক মেরে আবার তা লুকিয়ে চাপা দেবার কাহিনি শুনেছ?
সুব্রত শিউরে উঠল।
—আজকাল একে বলে বর্বরতা, কিন্তু তখনকার দিনে কী বলতো জানো? আভিজাত্য সম্মান। ব্রজকিশোরবাবু এক বিকট হাসি হেসে বললেন, তোমাকে আগেই বলেছি সময়ের সঙ্গে সব কিছু বদলাচ্ছে। একদিন যা নিজের হাতে করতে পেরেছি আজ তা ভাবতেও পারিনে-না, না, পারব না কেন, খুব পারি। জানো, মানুষের দৈহিক আবরণের ভিতর একটা পশু লুকিয়ে আছে। হিংস্রতা আর কাকে বলে!
বিস্ময়ে তাঁর বলিষ্ঠ দেহের দিকে সুব্রত চেয়ে রইল।
-হিংস্র আর কাকে বলে! পদ্মাপারের মানুষ আমরা। সয়েছি ওর চিরক্ষুধার রাগকে। সব বুকে পেতে নিয়েছি। তারপর দিনের পর দিন ওর রাগকে হজম করে একদিন আশ্চর্য হয়ে দেখতে পেলাম, আমার চারদিকে কেবল রক্ত আর রক্ত। ওরে বাবা, সে কী লাল রক্ত! ব্রজকিশোর তাঁর চেহারার এক অদ্ভুত ভঙ্গি করে বললেন, তখনও বাবা ছিলেন বেঁচে। জিজ্ঞেস করলাম এগুলো কী? উত্তর এল, কাশিমপুরের দাম্ভিক জমিদারের লাঠিয়ালদের মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে—তাইতেই এত লাল—কিন্তু কিছু নয় ব্রজ। কালই এই রক্তরাঙা পথে উড়বে ধুলো, ধূসর বর্ণের রোজকার মতো বইবে মেঠো বাতাস—সেই সঙ্গে যদি চাও শুনতে পাবে বৈরাগীদের আধ্যাত্মিক তত্ত্ব মেশানো গান। কিন্তু পদ্মার গর্জন নয়-কে আর কী করবে বল?
সুব্রত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কেবল বললে, তারপর?
—তারপর যা কথা তাই! তোমাকে একদিন দেখাব একাটা জিনিস—
এমন সময় মালতী ঘরে ঢুকে সুব্রতর কাছে এসে বললে, আপনাকে মা ডাকছে।
ব্রজকিশোর বাবু একটু উষ্ণ হয়ে বললেন, একটা আলাপ করছি দেখতে পাচ্ছো-আবার ডাকাডাকি! কেন আর কি সময় নেই!
–খাবার যে তৈরি!
–ও, সুব্রত তুমি খাওনি?
সুব্রত নীরবে হাসল। ব্রজকিশোর বাবু মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন, যাও একটু পরে আসবে। বলোগে।
মালতী চলে গেল।
—কত কাহিনি আছে। সে সব বলতে গেলে সময়কে পাওয়া যাবে না খুঁজে —নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হবে অতীতের কোঠায়। তুমি অনুভব করবে—তার চেয়ে অনেক বেশি অনুভব করব আমি। সুব্রত, আজ তোমার সাথে বসে আমি গল্প করছি, কিন্তু পনেরো বছর আগে কী এমনিই ছিলাম? আমি যদিও বদলে যাইনি কিন্তু আমার চার দিকে আবহাওয়া বদলেছে।
-আপনার পাওনা আমরা কী করে কেড়ে নিতে পারি?
ব্রজকিশোর হেসে বল্লেন, তা কেমন করে বিশ্বাস করি বল? আর আমাদের মনের কথা তোমরা কী বুঝতে পারবে? কখনো-না।
—আমাদের মনের কথাও আপনারা বুঝতে পারেন না।
-তা কেমন করে পারব হে? তোমাদের সঙ্গে আমরা দৌড়োতে কী পারি? ব্রজকিশোরবাবু আবার খুব হাসতে লাগলেন। হঠাৎ আবার গম্ভীর হয়ে বললেন, তারপর কী বলছিলাম? পনেরো বছর আগের ব্রজকিশোর রায়চৌধুরীর কথা না?
সুব্রত দেখতে পেল, অদূরে উপবিষ্ট ওই মানুষটির মনের দুঃখে চোখ এখন নিজের বিগত আত্ম-ইতিহাসের পাতায়—যেখানে মহিমা উজ্জ্বল পূর্বপুরুষের ছায়া; হয়তো নিষ্ঠুর বর্তমান তাঁকে দিচ্ছে ব্যথা, অপমান।
ব্রজকিশোরবাবু বললেন, সেই পদ্মার কথা না? কী জানো, শহরের এই ইটের স্কুপের আড়ালে বসেও আমি যেন পদ্মার ডাক মাঝে মাঝে শুনি, আমাকে সে ডাকে। তাই একসময় ইচ্ছে হয় সব ফেলে চলে যাই আবার সেখানে। নিজেকে খাপ খাইয়ে নিই, সেখানে গিয়ে নিজেকে অনুভব করি। এখানে বিষাক্ত বাতাস, আমার শ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। সব সময় মনে হয় রায়চৌধুরীর মৃত্যু হয়েছে—এ যে একাট সাদা কঙ্কাল!
–তবে আবার সেখানে ফিরে যান না কেন? ব্রজকিশোরবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, সাতবার আমাদের বাড়ি পদ্মা নিয়েছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি চারবার। বাড়িতে সে কত মহল, কত ঘর-দুয়ার! শুনে আশ্চর্য হবে, এক ঘরে বন্দুকের আওয়াজ করলে অন্যদিকের আর একটি ঘরে কিছুই শোনা যেত না। এত ঘর যে অচেনা কাউকে সেখানে ছেড়ে দিলে বার হতে কষ্ট হত। কিন্তু তাতে পদ্মার কী আসে যায়? এবং বড়ড়ার উপর লোভ তার বেশি। অনেক দিনের পরিশ্রমে তৈরি ঐশ্বর্যকে তাই একরাতে টেনে নিলে। সেই রাতটি আমার এখনও মনে আছে।
—তবু তো পদ্মাকে ভালোবাসেন?
—নিশ্চয়। ধ্বংস করতে যার পরিতৃপ্তি—ধ্বংস হতেও যে তার এতটুকু ভয় নেই। জন্ম হতে যার সঙ্গে দিন কাটিয়েছি, যাকে ভেবেছি স্বভাবমিলের বন্ধু—তার দেওয়া ক্ষতি সহ্য করতে পারব না এমন অহংকার আমার নেই। কিন্তু এই দ্যাখো, তুমি যে খেতে যাবে এটা ভুলেই গেছি। যাও—এই বলে ব্রজকিশোর বাবু চুপ করলেন।
সুব্রত ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের বারান্দায় এল। সেখানে গভীর অন্ধকার, নিস্তব্ধতা। চৌধুরীদের সমস্ত প্রতাপ সমৃদ্ধি যেন ওই সীমাবদ্ধ! সুব্রতর হাসি পেল, কিন্তু হাসতে কষ্ট হল।
এই অন্ধকার হেঁটেই গেল। একটি ঘরে আলো জ্বলছে। সে সেখানে গিয়ে দেখতে পেল, ঘরে কেউ নেই। গলা বেশি উঁচু না করেই সে ডাকল—
–মাসিমা–মাসিমা—
–এসো।
স্বর লক্ষ করে সুব্রত খাবার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হল। লীলাবতী তার অপেক্ষায় বসে আছেন। কাছেই মালতী।
-আপনি আমার জন্য অনেকক্ষণ বসে রয়েছেন!
লীলাবতী কোনো উত্তর না দিয়ে একটু হেসে বসতে বললেন।
পিড়িতে বসে সুব্রত বললে, অল্প দেবেন। আমার কিন্তু খিদে নেই।