-মানে তখন ওর কোনো মূল্যই নেই?
-একেবারে ভুল! মালতী হাত নেড়ে বললে, জীবন রক্ষা তা শত্রু-মিত্র যারই হোক, বা যে কোনো রকমের হোক—শেষ পর্যন্ত জীবনের রক্ষাই। সুকৃতি দুষ্কৃতির মূল্য, সেটা মানুষের দাবি, তারই নিজস্ব ব্যাপার, তাতে এই ঢালের কী এসে যাবে। এর যা মূল্য আছে, আছেই। তেমনি মানুষের বেলায়।
মালতী মাঝে মাঝে গম্ভীর হয়ে কথা বলে বটে। সুব্রত এতে একটুও আশ্চর্য হল না এবং হেসে বললে, তুমি ভুল করছে। যে একটা খারাপ কাজ করছে তাকে জেনে-শুনে সহায়তা করলে প্রশ্রয় দেয়া হয় জানো?
-হুঁ। তাতে আমার কী এসে যাবে?
-এসে যাবে এই যে, তুমিও তার ফল ভোগ করবে। কারণ, একটা পাপকে প্রশ্রয় দিয়েছো।
মালতী হাঁ করে তার দিকে কতক্ষণ চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল, কিছু বলল না।
বেশি রাত না হলেও চারদিক প্রায় নিস্তব্ধ।
এমন সময় ব্রজকিশোর বাবুর ডাক শোনা গেল। মালতী ব্যস্ত হয়ে বললে, আপনাকে বাবা ডাকছেন চলুন।
একটা বড়ো ঘর। পুরোনো আসবাবপত্রে ভরা। দেয়ালে বড়ো বড়ো ছবি, সোনালি কাজ করা ফ্রেম দিয়ে আটা। বেশির ভাগই রবি বর্মার—আর কয়েকটি বিদেশি চিত্রকরের আঁকা। ছাদের সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি অকর্মণ্য ঝাড়। ঘরের আলোটা-তেলের প্রদীপটাও দেয়ালের গায়ে। মেঝেটা আয়নার মতো চকচক করে। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। একপাশে প্রকান্ড পুরোনো দিনের খাট—তাতে খুব পুরু বিছানা—ধবধবে চাদর। সেখানে একটা মোটা তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে ব্রজকিশোরবাবু বসেছিলেন। তাঁর মাথায় চুল বেশি নেই, খুব ছোটো ছোটো করে কাটা, মুখটা বড়ো, বড়ো একজোড়া গোঁফ, শরীরের চামড়া ঢিলে হলেও খুব বলিষ্ঠ। গায়ের রঙ খুব ফর্সা।
তিনি চোখ বুজে বসেছিলেন। সুব্রত যে এসেছে টের পাননি।
সুব্রত বললে, আমাকে ডেকেছিলেন?
ব্রজকিশোর বাবু চোখ মেলে বললেন, হ্যাঁ। একা বসে আছি তাই মনে হল সুব্রতকে ডেকে না হয় কতোক্ষণ গল্প করি। কোনো কাজ ছিল?
–না কাজ আবার কি? এখানে এসেও যদি কাজ থাকে তাহলে তো মুস্কিল। ব্রজকিশোর বাবু হেসে বললেন, কেন ধরো চিঠিপত্র লেখা, পড়াশুনো করা। ও কী–বসো।
সুব্রত বিছানার একপাশে বসল।
ব্রজকিশোর বললেন, পুজো আসছে অথচ এখন মনে হচ্ছে না পুজো বলে কিছু আছে! এমনি দিনকাল। মানুষ কী করবে? আগে খাবার, তারপর তো কাজকর্ম!
সুব্রতও আশ্চর্য হল একথা শুনে। প্রাচীন—বিশেষত যাঁরা ধর্মপ্রাণ তাঁদের মুখে এমন কথা বড়ো শোনা যায় না।
ব্রজকিশোরবাবু বললেন, মানুষের এইসব হৃদয়বৃত্তির মূলে, এটা তো জানো, অনেক শ্রদ্ধা-ইচ্ছা থাকে, কাজেই যখন এগুলোও কোনো অনিবার্য কারণে বন্ধ হয়ে যায় তখন ওপর থেকে কোনো অভিশাপের ভয় নেই—কী বল? অথচ অনেকে এটা বোঝে না। আর এ তো সহজ কথা, যেখানে আমারই বিস্তর প্রয়োজন, অথচ সেই সব অনুষ্ঠান আমাকে বাধ্য হয়ে বন্ধ করতে হল সেখানে তো আমার নিজেরই ক্ষতি। এই বলেও একশ্রেণির লোকদের বোঝানো যায় না। ওরই তো এই দোষ। কত বলি…
সুব্রত বললে, প্রত্যেক মেয়েরই এই দোষ।
—ঠিক বলেছ। এটা যেন তাদের বদ্ধমূল সংস্কার। যদিও আমার কিছু আসে যায় না তাতে। তবে কালের প্রভাবে মানুষের জীবন পদ্ধতি অমনভাবে বদলে যাওয়ায় আমাদের অভ্যস্ত চোখেও ওসব ঠেকে। বিশেষত আমার স্বভাবটাই হচ্ছে তাই। যা নতুন কিছু মঙ্গল আসবে তাকে অবহেলা করি না, বরং প্রসন্ন মনে গ্রহণ করি। বিশ্বাস কর।
-হ্যাঁ। কিন্তু অনেক সময় তখনকার অবস্থানুসারে সব নতুনকেই মঙ্গল বলে মনে হয় না।
-তা ঠিক—ব্রজকিশোরবাবু বাইরের দিকে চাইলেন। এই দৃষ্টির ভিতর দিয়ে যেন কোনো দূরাতীতে তিনি চলে গেলেন। বললেন, তা ঠিক। নইলে মাইকেল যা লিখেছেন তা দিয়ে জীবিতকালে তিনি এতটুকু খ্যাতি বা প্রশংসা পাননি—এবং অনেক কটুক্তি সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু পরে—মরবার পর মানুষ তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধায় স্বীকার করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেনি। অথচ বেঁচে থাকতে খুব কম লোকই তাঁকে বুঝল। আমরা তাঁর কাব্য পড়েছি ছোটোবেলায়। ইস—সে কী ভালোই না লেগেছে। ওই যে কী বলে—
রুষিলা বাসবত্রাস! গম্ভীর যেমতি নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি, কহিলা বীরন্দ্র বলী— চমৎকার না?
–হ্যাঁ।
ব্রজকিশোরবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, কাব্যের কথায় এসে পড়ল কবির কথা। আমার বাবা, জানো, তিনি কবি ছিলেন—অনেক কবিতা লিখেছিলেন। লোককে কত গান বেঁধে দিয়েছেন তিনি। তাঁর প্রায় সব লেখাই আমার কাছে আছে। একদিন দেখো তুমি। তোমাদের যারা লেখে টেখে তাদের অনেকেই এই গুণটি বংশানুক্রমিক পায় শুনি—কিন্তু আমার বেলায় এর ব্যতিক্রম দেখলে, না?
তিনি সুব্রতর মুখের দিকে তাকালেন।
ব্রজকিশোর বাবুকে যারা ভালো জানে, তারা কখনই কথার শেষে তাঁর না-র প্রয়োগ দেখে বিস্মিত হয় না কারণ এটা জানা, তাঁর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে না উক্তি কোনো মতামতের অপেক্ষা না রাখলেও সর্বদা প্রযুক্ত হবে।
সুব্রত বললে, ওটা যে বংশানুক্রমিক সম্পত্তি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় তা সত্যি নয়। তাই আপনি যে ব্যতিক্রম হবেন, তাতে–
-তাতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই, এই তো? ব্রজকিশোরবাবু হাসতে লাগলেন। বললেন, ঠিকই, ওটা কখনোই সত্যি নয়, নইলে রামের ছেলে রামই হত। আমার বাবা যা করেছেন তা তোমাদের কাছে রূপকথার মতো মনে হবে। সে এক বিস্ময়কর ইতিহাস। যুগ অনেক রকম হয়, আমাদের সময়ের সঙ্গে তোমাদের সময়ের মিল নেই। তোমরা যা পেয়েছে আবার আমরা তা পাইনি। এ যেন বিকেলের মেঘ, ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে রং। কিন্তু আমার–