নীলু কেঁদে ফেলল, বাবাগো বলে নাকিসুরে কাঁদতে লাগল।
ওদিকে মা-ও কাঁদতে আরম্ভ করে দিয়েছেন। বেলাও তাঁর পাশে বসে দুই হাঁটুর ভিতর মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এ ছাড়া সমস্ত বাড়ির মধ্যে একটা ভয়াবহ গাম্ভীর্য বিরাজ করছে। অন্ধকার নেমেছে রাস্তায়। ঘরের অন্ধকার আরও সংঘাতিক। আলো জ্বালাবে কে? ঘরের আবহাওয়া ভুতুড়ে হয়ে উঠেছে। বাইরে ঘন ঘন বাসের হর্ন শোনা যায়। সৈন্যরা টহল দিচ্ছে। যেন কোনো যুদ্ধের দেশ। অথবা কোনো সাম্রাজ্যবাদের শেষে শঙ্খধ্বনি, বার্ধক্যের বিলাপ।
পাশের বাড়িতে ভয়ানক তাসের আড্ডা জমেছে। বেশ গোলমাল শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে আড্ডা ছেড়ে টর্চ হাতে করে বিমল এল। বিমল ছেলেটিকে ভালোই মনে হয়, কথাবার্তায় অনেক সময় ছেলেমানুষ। অনেক সময় পাকাও বটে। সে বললে, অশোকবাবু চলুন।
অশোক প্রস্তুত হয়েই ছিল। খালিপায়েই সে বিমলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বিমল টর্চ জ্বালিয়ে এগুতে লাগল। মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখল, কোনো পুলিশ আসছে কি না! বাড়িটা বেশি দূরে নয়। অলিগলি দিয়ে নিরাপদেই যাওয়া যায়। বিমল যথাস্থানে গিয়ে ডাকল, সূর্যবাবু? সূর্যবাবু বাড়ি আছেন?
ভিতর থেকে আওয়াজ এল, কে?
-আমরা। দরজাটা খুলুন।
সূর্যবাবু নিজেই এসে দরজা খুললেন, হেসে বললেন,–কী ব্যাপার?
বিমল বললে, আমরা আপনার ফোনে একুট কথা বলতে পারি?
—নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। সুর্যবাবু সাদরে ফোন দেখিয়ে দিলেন। বিমল স্টিমার অফিসে ফোন করল, অনেকক্ষণ পরে কে একজন লোক এসে বলল, সুরেশবাবু কে? সুরেশবাবু টুরেশবাবু বলে এখানে কেউ নেই। ও দাঁড়ান দাঁড়ান। ভুল হয়ে গেছে। আচ্ছা ঘণ্টাখানেক পরে আবার আসুন। আমি খুঁজে আসছি।বিমল অনেকবার ডেকেও আর কোনো উত্তর পেলো না। ফোন রেখে অশোকের দিকে তাকিয়ে বলল, চলুন, আবার আসবখন।
অশোক ফিরে এল। দরজার কাছে মার জল ভরা চোখ ছল ছল করছে। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন। অশোক বললে, পরে যেতে বলছে? এই শুনে মা আবার ভেঙে পড়লেন, ভগ্নস্বরে কাঁদতে আরম্ভ করলেন। মাটির দিকে চেয়ে অশোক মনে মন বললে, আগামী নতুন সভ্যতার যারা বীজ, তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে আমি যোগ দিয়েছি, তাদের সুখ দুঃখ আমারও সুখ দুঃখ। আমি যেমন বর্তমানের সৈনিক, আগামী দিনেরও সৈনিক বটে। সেজন্য আমার গর্বের আর সীমা নেই। আমি জানি, আজকের চক্রান্ত সেদিন ব্যর্থ হবে, প্রতিক্রিয়ার ধোঁয়া শূন্যে মেলাবে। আমি আজ থেকে দ্বিগুণ কর্তব্যপরায়ণ হলাম, আমার কোনো ভয় নেই।
এমন সময় পাশের ঘরে আলো দেখা গেল—আলো নায় তো আগুন। কাগজ পোড়ার গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। অশোক গিয়ে দেখল হিন্দু মুসলমান ঐক্যের আবেদনের ইস্তাহারগুলি স্তূপীকৃত করে অজয় তাতে আগুন দিয়েছে। অশোক তৎক্ষণাৎ আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে করতে বললে এসব কী করছিস?
-কী করব আবার? মড়া পোড়াচ্ছি।
–অজু, তুই ভুল বুঝেছিস। চোখ যখন অন্ধ হয়ে যায়নি, তখন আগে। পড়াশোনা কর। তারপর পলিটিক্স করিস।
—দাদা তোমার কমিউনিজম রাখো! আমরা ওসব জানি।
–কী জানিস বল অশোকের স্বরের উত্তাপ বাড়ল।
–সব জানি। আর এও জানি তোমরা দেশের শত্রু–
—অজু, চুপ করলে?
অজয় নিজের মনে গুম গুম করতে লাগল।
অশোক উত্তপ্ত স্বরে বললে, ফ্যাসিস্ট এজেন্ট। বড়োলোকের দালাল। আজ বাদে কালের কথা মনে পড়ে যখন হিন্দু মুসলমান ভাই বোনরা বলে গাধার ডাক ছাড়বি? তখন তোর দাদার ডাক শুনবে কে। পেট মোটা হবে কার? স্টুপিড, জানিস দাঙ্গা কেন হয়? জানিস প্যালেস্টাইনের কথা? জানিস আয়ারল্যাণ্ডের কথা, মূর্খ।–কিন্তু একটা তীব্র আর্তনাদ শুনে হঠাৎ অশোক থেমে গেল, পাশের ঘরে গিয়ে দেখলো, মা আরও অস্থির হয়ে পড়েছেন।
কয়েকদিন পরে। অশোক বাইকে চড়ে একাট সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী মিটিং-এ যোগদান করতে যাচ্ছিল। এক জায়গায় নির্জন পথের মাঝখানে খানিকটা রক্ত দেখে সে বাইক থেকে নেমে পড়ল। সারাদিন আকাশ মেঘাবৃত ছিল বলে রক্তটা তত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়নি, এখনও খানিকটা লেগে রয়েছে। কার দেহ থেকে এই রক্তপাত হয়েছে কে জানে। অশোকের চোখে জল এল, সব কিছু মনে পড়ে গেল। সে চারিদিক ঝাপসা দেখতে লাগল, ভাবল এই চক্রান্ত ব্যর্থ হবে কবে?
পথবর্তী
ঘরে আর কেউ নেই।
মালতী জিনিসটা এপিট-ওপিট করে বল্লে, আহা এটা কী দিয়ে তৈরি বলুন তো?
সুব্রত ঢালটি পরীক্ষা করে বললে, নিশ্চয় লোহা।
মালতী খিলখিল করে হেসে উঠল, হাসতে হাসতে বল্লে, মোটেই নয়, তার ধার কাছ দিয়েও নয়। এটা গন্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরি। দেখতে ঠিক লোহার মতো মনে হয়, না?
সুব্রত বিস্ময়ের স্বরে বললে, হ্যাঁ, কিন্তু এ দিয়ে গুলি ফেরানো যায়?
-হুঁ খুব যায়। গন্ডারের চামড়া যে খুব শক্ত এটা জানেন না?
-জানি।
—তার চেয়েও শক্ত এটা। জলে ভিজিয়ে রোদে শুকিয়েছে, একেবারে লোহার মতো হয়ে গেছে। এগুলো আগে আরও অনেক ছিল, হাতে হাতে কতকগুলি নিখোঁজ হয়ে গেছে, এখন এই কয়টি মাত্র আছে। মালতী ঢালটি আবার নেড়েচেড়ে বললে, মনে করুন এর মধ্যে কতগুলি এসে লেগেছে, কত লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছে এটা।
সুব্রত বললে, অনেক ক্ষেত্রেই এর প্রাণ বাঁচানোর কোনো অর্থই হয়তো নেই মালতী। ধরো, এখন যারা আত্মরক্ষা করে এটা দিয়ে অথচ নীতি তাদের ভালো নয়, হয়তো পাজি, অত্যাচারী তখন সেই আত্মরক্ষার পক্ষে কী অর্থ হতে পারে?