-হুঁ কাজ না ছাই। কাজের আর অন্ত নেই কী না! তোদের কথা শুনবে কে রে? কেউ না। বুঝতে পেরেছি তোদের কতখানি জোর। কেবল মুখেই পটপটি, হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা!
—জানো কংগ্রেস মিনিস্ট্রির সময় কানপুরে কী হয়েছিল? আমরা দাঙ্গা থামিয়ে দিয়েছিলুম।
মা দুই হাত তুলে বললেন, হয়েছে। অমন ঢের বড়ো বড়ো কথা শুনেছি। তোদের রাশিয়ার কী হল শুনি? পারবে জার্মানির সঙ্গে? পারবে?
অশোক বাইরের দিকে চেয়ে বললে, পারবে না কেন মা? বিপ্লবের কখনো মরণ হয়?
মা হাঁ করে চেয়ে রইলেন, একটু পরেই চুপি চুপি বললেন,
-হ্যাঁরে, একি সত্যি?
–কী মা?
—ওই যে উনি বললেন, জার্মানি রাশিয়ার সব নিয়ে গেছে, একেবারে আমাদের দেশের কাছে এসে পড়েছে?
অশোক হো হো করে হেসে উঠল, এঁরা হিটলারের চেয়েও লাফিয়ে লাফিয়ে চলেন।
এমন সময় অজু মানে অজয় এসে হাজির। অজু অশোকের ছোটো ভাই। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, নবাব বাড়ি সার্চ হয়ে গেছে। অশোক চোখ পাকিয়ে বললে, এটি কোথেকে আমদানি, শুনি!
–বারে আমি এইমাত্র শুনলুম যে!
–তোমার দাদারা বলেছে নিশ্চয়?
অজু একজন হিন্দু সোসালিষ্ট। সম্প্রতি দাঙ্গার সময় জিনিসটির পত্তন হয়েছে। এই বিষয় শিক্ষা নিতেই সে পাগলের মতো ঘোরাফেরা করে। উচ্চস্বরে মানুষের সঙ্গে তর্ক করে, হিটলারের জয়গান করে, হানাহানিতেও প্রচুর আনন্দিত হয়।
–বারে আমি নিজের কানে শুনেছি। একটা সোলজার আমায় বললে,–
–তোমায় কচু বলেছে।
অজু কর্কশ স্বরে বললে, তোমরা তো বলবেই— তারপর মৃদুস্বরে—তোমরা হিন্দুও নও, মুসলমানও নও–
—আমরা ইহুদির বাচ্চা, নারে? অশোক হা হা করে হেসে উঠল, বললে, সার্চ হোক বা না হোক, তাতে Rejoice করবারই বা কী আছে, দুঃখিত হবারই বা কী আছে? আসল ব্যাপার হল অন্যরকম। দেখতে হবে এতে কার কতোখানি স্বার্থ রয়েছে। অজয় চুপ করে ছিল, সে খুক খুক করে হেসে উঠল।
দুপুর আস্তে বিকেলের দিকে এগিয়ে গেল।
অশোক রাস্তায় বেরিয়ে দেখতে পেল, এই মাত্র পুলিশ তুলে নেওয়া হয়েছে। লোকে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। এই অঞ্চলেরই অধিবাসী যারা বাইরে ছিল, আহারে তাদের মুখ শুকিয়ে গেছে, কিন্তু বেশিরভাগ লোকেরই মুখের হাসিটি শুকোয়নি। ভিতরে এবং বাইরে যারা ছিল তাদের সকলেরই অভিজ্ঞতার বর্ণনা চলতে লাগল। ওদিকে দুই গাড়ি বোঝাই ভদ্রলোকদের ধরে নিয়ে গেছে। একজন ভদ্রলোক বাড়িতে বসে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন।
–কার আবার স্বার্থ থাকবে। স্বার্থ রয়েছে হিন্দু আর মুসলমানের।–এই বলে অজয় অন্যদিকে চেয়ে একটা গান গাইতে লাগল!
মা বলে উঠলেন, তোরা ভাইয়ে ভাইয়ে এমন ঝগড়া করিস কেন বলত? আমাদের সময় আমরা বড়ো ভাইয়ের দিকে মুখ তুলে কথা কইতাম না, মুখে মুখে তর্ক করা দূরের কথা। কিন্তু দাদা আমায় যা ভালোবাসতেন। ছোটোবেলায় অনেক শীতের রাত্তিরে আমরা এক লেপের তলায় শুয়ে ঘুমিয়েছি।
অশোক গালে হাত দিয়ে বললে, হয়েছে। এবার ভাইয়ের গল্প আরম্ভ হয়ে গেছে, আমাদের তাহলে উঠতে হয়।
তারপর আস্তে আস্তে সন্ধ্যা এগিয়ে এল। এবার তবে বাসায় ফিরতে হয়। কিছু পরেই সান্ধ্য আইন শুরু হয়ে যাবে। রাস্তাঘাট নির্জন হবার আগে একটা মস্ত ঠেলাঠেলি আরম্ভ হয়ে গেছে। পুলিশগুলো মানুষের শরীর সার্চ করে নিচ্ছে। বৃদ্ধ ভদ্রলোকেরা একেবারে হাত তুলে দাঁড়িয়ে যায়। এক ভদ্রলোক একটা পেন্সিল কাটা ছুরি নিয়ে ধরা পড়লেন। সকলে তাঁর নির্বুদ্ধিতার নিন্দা করতে ছাড়ল না। ওদিকে সমস্ত দোকানপত্র আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একটু আগে রাস্তার পাশেও একটা মেলা বসেছিল যেন, এখন সকলেই শেষ ডাক দিয়ে চলে গেছে। রিটায়ার্ড অফিসাররা নিজেদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পরম স্নেহের দৃষ্টিতে সেই অস্থায়ী হিন্দু দোকানদারদের দিকে বার বার তাকাচ্ছেন, ওদের এখন পুত্রবৎ মনে হচ্ছে, অথবা যেন বোমা বিধ্বস্ত লণ্ডন নগরীর অংসখ্য রিফিউজি!
অশোক বাসার কাছে গিয়ে দেখে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে মা দাঁড়িয়ে আছেন। কাছে যেতেই বললেন, বাবা আশু, তোর বাবা তো এখনও এল না। তারপর ফিসফিস করে—তা ছাড়া আজ আবার মাইনে পাবার দিন।
কিছুমাত্র চিন্তার চিহ্ন না দেখিয়ে অশোক তৎক্ষণাৎ বললে,
-আহা, অত ভাবনা কীসের? এখনও তো অনেক সময় আছে।
—অনেক নয় আশু, সাতটা বাজতে আর আধঘণ্টাও বাকি নেই।
অশোক আবার রাস্তায় নেমে এল, পেছনে ছোটো ভাই নীলু মা-র আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে রইল, বেলাও মা-র পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। রাস্তায় ক্রমেই লোক কমে আসছে। যারা কিছুদূরে আছে তাদের দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়েছে। কয়েক মিনিট পরেই ছোটো ছোটো সৈন্যদল মার্চ করে গেল। আকাশের রঙ ক্রমেই ধূসর হয়ে আসছে। রাস্তা আর দালানের গায়ে ছায়া নেমেছে। বাদুড় উড়ে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে।
এই সাতটা বাজল। অশোক ফিরে এল।
মা এখনও বাইরে দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে। চোখ দুটি ভোরের তারার মতো করুণ। আশু এখন উপায়–? মা ভাঙা গলায় বললেন তাঁর চোখ জলে ভরে এসেছে।
অশোক কিছু বললে না। নিঃশ্বব্দে ঘরে ঢুকে খালি তক্তপোষের ওপর শুয়ে পড়ল তার মুখ কুঞ্চিত হয়ে এসেছে, চোখের ওপর একটা বিষম দুর্ভাবনার চিহ্ন স্পষ্ট। হয়তো এক কঠিন কর্তব্যের সম্মুখীন হতে চলেছে সে। নীলু তার হাত ধরে ডাকল, বড়দা, বড়দা গো? বারে কথা বলে না। ও বড়দা? বারে! বারে!