লোকটা মাঠ ছেড়ে রাস্তায় পড়ল। তার পরনে ছেঁড়া ময়লা একখানা লুঙ্গি, কাঁধে ততোধিক ময়লা একটি গামছা, মাথার চুলগুলি কাকের বাসার মতো উস্কখুস্ক, মুখটি করুণ। তার পায়ে অনেক ধুলো জমেছে, কোনো গ্রামবাসী মনে হয়।
এমন সময় কথাবার্তা নেই দুটি ছেলে এসে হাজির, তাদের মধ্যে একজন কোমর থেকে একটা ছোরা বের করে লোকটার পেছনে একবার বসিয়ে দিল। লোকটা আর্তনাদ করে উঠল, ছেলেটি এতটুকু বিচলিত হল না, লোকটার গায়ে যেখানে সেখানে আরও তিনবার ছোরা মেরে তারপর ছুটে পালাল, কুকুর যেমন লেজ তুলে পালায় তেমনি ছুটে পালাল। লোকটা আর্তনাদ করতে করতে গেটের কাছে গিয়ে পড়ল, তার সমস্ত শরীর রক্তে ভিজে গেছে, টাটকা লাল রক্ত, একটু আগে দেখেও মনে হয়নি এত রক্ত ওই কংকালসার দেহে আছে!
মিনিট দশেক পরে এক সৈন্য বোঝাই গাড়ি এল, সৈন্যরা বন্দুক হাতে করে গাড়ি থেকে পটাপট নেমে সার্জেন্টের আদেশে হাতের কাছে যাকে পেল তাকেই ধরল। হিন্দি বুলি ছেড়ে, সিগার খেয়ে এদি ওদিক ছুটোছুটি করে সার্জেন্টদের শ্বেতবর্ণ আরক্ত হয়ে এল। যারা এদিকে জেলের ভাত খেতে আসছিল তাদের থামিয়ে দিল। উধার মৎ যাইয়ে বাবু, মৎ যাইয়ে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তিন নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় অর্ধেকটা ঘেরাও হয়ে গেল, ছোটো ছোটো গলি এবং সমস্ত রাস্তার মাথায় সশস্ত্র পুলিশ সঙ্গীন উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কেউ ঢুকতে পারবে না, কেউ বেরোতেও পারবে না, শৃঙ্খলিত করে একটা সামরিক বন্দিশালা তৈরি হল।
কিন্তু শৃঙ্খলের ভিতরেও সংগ্রাম হয়। এক বিরাট সংগ্রাম শুরু হল। সকলেই এখানে সেখানে ছুটোছুটি করতে লাগল, চোদ্দো বছরের বালক থেকে আরম্ভ করে সত্তর বছরের বুড়ো পর্যন্ত। এমন দৃশ্য শহরে জীবনে অভিনব।
লাইনের পাশে যাদের বাসা তাদের পালাবার আর অবসর কোথায়? তাদের মুখ চুন হয়ে গেল, কেউ হিন্দুত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে বীরের মতো অগ্রসর হল। এক রিটায়ার্ড অফিসার ভদ্রলোক একটা ব্যাপার করলেন চমৎকার। বাক্স থেকে বহু পুরোনো একটি পাতলুন বের করে সেটা পরে এবং তার ওপর একটা পুরোনো কোট চাপিয়ে এক সুদর্শন যুবকের মতো ওপর থেকে নীচে নেমে এলেন, তাঁর শরীরের ভিতর আগের সেই তেজ দেখা দিয়েছে, যখন ওপরওয়ালা অনেক সাহেব-সুবোকেও বকে ঝকে নিজের কাজ তিনি করে যেতেন। সেই দিন আর এখন কই, হায়, সেই দিনগুলি এখন কোথায়!
ভদ্রলোক নীচে নেমে এলেন, পাতলুনের দুই পকেটে কায়দা করে দুই হাত ঢুকিয়ে দুই পা ফাঁক করে গেটের ওপর দাঁড়ালেন। ওই যে, রক্তবর্ণ সার্জেন্টটি এদিকেই আসছে। ভদ্রলোক তার সঙ্গে বড়োবাবু সুলভ ইংরিজি আরম্ভ করে দিলেন।
শিক্ষয়িত্রী সুপ্রভা সেনের ব্যাপার আরও চমৎকার। সে তো মেয়েদের কোনো ইস্কুলে চাকরি করে। শহর দাঙ্গা-বিধ্বস্ত বলে প্রচুর ছুটি উপভোগ করছিল, আজও এইমাত্র দুপুরের রেডিও খুলে বসেছে। ছুটির দিন বলে একটা পান চিবুচ্ছে। ভোরবেলা ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী ছোটো ভাইকে গাধা বলে শাসিয়েছে, খানিকক্ষণ গম্ভীরভাবে কিছু ভেবেছে আর এখন বসেছে রেডিয়োর গান শুনবে বলে। তার চোখে চশমা, একগাছি খড়ের মতো চুল সযত্নে বাঁধা। আঙুলগুলি শুকনো হাড়ের মতো দেখতে, আর শরীরের গঠন এমন হয়ে এসেছে যে যত্নবতী না হলেও চলে। এমন সময় বাইরের রৌদ্রে গুর্খাদের বন্দুকের সঙীন ঝলমল করে উঠল, তাদরে শ্বেত অধিনায়কের গর্বোন্নত শির আরও চোখে পড়ে, এবং বুটের খটমট আওয়াজ শুনে সুপ্রভা সেন আর তিলমাত্র দ্বিধা না করে নীচে চলে গেল, বসনে এবং ব্যবহারে বিশেষ যত্নবতী হয়ে সাহেবের সম্মুখীন হল।
মুহূর্তে এই গল্প লাফিয়ে চলল এবং সুপ্রভা সেনের অনেক খ্যাতি ও অখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
লাইনের পাশে কোনো বাড়িই খানাতল্লাশির হাত থেকে রেহাই পেল না, রাজনৈতিক বন্দিদের বেলায় যেমন খানাতল্লাশি হয় তেমন অবশ্য নয়, তল্লাশি হয় শুধু মানুষের।
ভিতরের দিকে তেমনি ছুটোছুটি, একবার এদিকে একবার ওদিকে। কিন্তু সকলের মুখেই হাসি, বিরক্তি বা রাগের চিহ্নমাত্র নেই। অশোকের দেখে রাগ হল, এই ব্যাপক ধরপাকড় আর ব্যাপকতর ঘেরাও মানুষের কাছে একটা Sports হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধঃপতন বা পচন একেই বলে। অশোকের ইচ্ছে হয় চীকার করে বলে, আপনারা কেন হাসবেন? কেন হাসছ তোমরা?
একটা জায়গায় কিছু লোক জমা হয়ে গেল বটে, কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভেঙে গেল। লোকগুলির মুখে হাসি আর ধরে না, তারা আর কিছুতেই সিরিয়াস হতে পারছে না। অশোকের মন হল, এরা একেবারে জর্জরিত হয়ে গেছে।
রাস্তা দিয়ে একটা ফেরিওয়ালা যাচ্ছিল পুরোনো কাগজের বোঝা নিয়ে। তার পায়ে একটা ময়লা কাপড়ের প্রকান্ড ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। সে হঠাৎ থেমে বললে, বাবুরা হাসছেন। হাসুন, আপনাদেরই দিন পড়েছে, গভর্নমেন্টের যেমন পড়েছে। দিন পড়েনি শুধু আমাদের, আমরা মরব, মরব!
অশোক মন্থর পায়ে হেঁটে বাসায় গেল। এই মাত্র আর একটা ঘটনার সংবাদ পাওয়া গেছে। দোলাইগঞ্জ স্টেশনের ডিস্ট্যান্টসিগন্যাল পার হয়ে এক বৃদ্ধ যাচ্ছিল–একটা বিবরণ শুনতে আর ভালো লাগে না। কখনো নিজেকে এত অসহায় মনে হয়।
অশোকের মা খালি মাটিতে পড়ে ভয়ানক ঘুমুচ্ছিলেন, ছেলের ডাকে ঘুম থেকে উঠে তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন, যা শীগগির, বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা বলছি। একশোবার বলেছি যে, যা বাপু মামাবাড়িতে কিছুদিন ঘুরে আয়, মারামারিটা কিছু থামলে পরে আসিস, না তবু এখানে পড়ে থাকা চাই, একটা ছেলেও যদি কথা শোনে। মাটি কামড়ে পড়ে থাকা চাই, শহরের মাটি এমন মিষ্টি, না? অশোক হেসে বললে, এত কাজ ফেলে কোথায় যাই বল?