নিজেদের বসিবার জায়গা করিয়া লইতে আর কতটা সময়ই বা লাগে। কোনো এক মুহূর্তে নিরুপমা, অরু আর শীলাবতী বসিয়া পড়িয়াছে। সস্তা হারমোনিয়ামের রিডে অনভ্যস্ত আঙুলের চাপ পড়িয়াছে। অশোক তাহা ভালো করিয়া খেয়ালই করে নাই।
ভাসান গানে কথা কম, গান বেশি, মিনিটের কাঁটা লক্ষ করিয়া সর্দার ভাসান শোনায় না। তাই, সবেমাত্র সনকা লখিন্দরকে বিদেশ যাইতে বারণ করিয়াছে, তখনই রাত এগারোটা।
অশোক উঠিয়া দাঁড়াইল ও আড়চোখে চাহিয়া দেখিল,-একপাশে আরও কয়েকটি বউ এবং অরুর পাশে শীলাবতী গুটিসুটি বসিয়া আছে, তন্ময় হইয়া পালাগান শুনিতেছে, সকলের সামনে তাহার মা।
অশোক আপন মনেই যেন সরবে বলে ইস রাত হয়েছে অনেক, শুয়ে। থাকি গে।
কেউ সাড়া দিল না, এমন কি ফিরিয়াও তাকায় না। এমনই তন্ময়।
অশোক খানিক বসিল; একটু পরেই আবার উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, কাল ভোর না হতেই তো আবার দৌড়াতে হবে ইস্টিশান। নাঃ, শুইগে যাই।
এবার কেবল অরুই ফিরিয়া তাকায়। চোখে তাহার অশেষ করুণা। অন্য কাহারও কানে কথাটা কি যায় না? অশোক উচ্চারণ করে— ইস যে না গান, তা আবার এত মনোযোগ দিয়ে শোনা? আমার তো কেবল হাসিই পায়! হাসি পায় বলিয়াই বুঝি অশোক একবার হাসিবার চেষ্টা করে।
এবার লখিন্দর নিতান্তই অবাধ্য হইয়া বিদেশযাত্রা শুরু করিবে। রাত তখন বারোটা।
নাঃ, অসহ্য। অশোক আবার দাঁড়ায়। এই জিনিস দেখেই যদি সারাটি রাত জাগতে হয়, তবে তার চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী আছে? শেষ কি আর এখন হবে, হবে সেই বেলা দশটায়—হু–, আমি জানি বলেই তো শুতে যাচ্ছি। ব্যাটাদের তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। বেলা দশটা অবধি ভাসান-যাত্রা!
অরুর সত্যি অশেষ করুণা—এক মা-র পেটের বোন তো? সে তার দাদার দিকে মিটমিট করিয়া তাকায়। ওই তো অতটুক মেয়ে ঘুমে ঢুলছে, তবু ঠায় বসিয়া সমস্তটা দেখা চাই-ই! মেয়েদের তো ওই দোষ। চোখ কটমট করিয়া অশোক তার দিকে তাকাতেই ভয়ে ভয়ে অরু মুখ ফিরাইয়া লইল।
আর না দাঁড়াইয়া অশোক তাতাতাড়ি ভিতরে চলিয়া গেল, দরজা আটকাইয়া কেহ বসিয়া নাই, তা না হইলে হয়তো পথ নাই বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিত। কিন্তু আলো? সবগুলি আলোই কি আত্মহত্যা করিয়াছে?
নাঃ, এমন সব মানুষের সঙ্গে ঘর করা মুশকিল। বিছানাও পাতা হইয়াছে কি না কে জানে। অথচ রাত একটা তত বাজে। অশোক ফিরিয়া আসিয়া দরজার কাছে
একটু দাঁড়াইয়া জোরে বলিল, আমার তো আর সারারাত জাগবার শখও নেই, সময়ও নেই, শোবার ব্যবস্থা কিছু হয়েছে কি না বলো? ওমা, বিছানা কি পাতা আছে?
–একটা মিনিটও নিশ্চিন্তে বসিয়া থাকিবার যো নাই! নিরুপমা এতক্ষণে তাকাইলেন।
অশোক ততক্ষণ আবার ভিতরে চলিয়া গিয়াছে। পায়ের ধাক্কায় কি যেন একটা পড়িয়া গেল। অন্ধকারে ঠিক ঠাহর করিয়া চলা যায়? কিন্তু নিজের ঘরে আসিয়া দেখিল, মিটমিট করিয়া আলো এ ঘরে জ্বলিতেছে। ইস, কী বিকট গান! সারারাত কি ঘুম হইবে?
বাতিটা উস্কাইয়া বিছানায় গিয়া শুইয়া পড়িল। সমস্ত বিছানা জুড়িয়া শুইয়া গভীর ঘুমের আশা করিতে লাগিল। কিন্তু যে বিকট গান! ও আলোটা আবার নেবানো হইল না; কী জ্বালা! কিন্তু না নিবানোই থাকুক না। জ্বলুক না জ্বলজ্বল করিয়া, তার কী?
গানের এখন নিশ্চয় অর্ধেকও হয় নাই, কখন শেষ হইবে কে জানে! না আছে একটা পরচুলা, না আছে একটা পোষাক—এই দেখিতে আবার সারারাত জাগা! সেই বেলা দশটা অবধি, ওরে বাপরে! চোখে এত ঘুম থাকিতে একটু ঘুমানোর উপায়ও নাই। সামনের জানালাটা অশোক ঠাস করিয়া বন্ধ করিয়া দিল। কাল ভোরেই তো আবার দৌড়াতে হবে ইষ্টিশনে, অথচ এখনও… নাঃ অসম্ভব?
-কেমন সুন্দর হচ্ছিল, তা-ও একটু দেখবার যো নেই! ও মাগো, আলোটা কী রকম জ্বলছে। আগুন লাগবে নাকি? জেগে থেকেও এটা চোখে পড়ছে
?-বাতিটা কমাইয়া দিয়া শীলাবতী বলিল, নিজের ঘুম পেয়েছে সোজা শুয়ে পড়লেই হয়, সঙ্গে অন্য কারোরও ভয়ানক ঘুম পাবে এমন কোনো কথা আছে। কী ভালো লাগছিল, তবু দেখতে পারলাম না!
-মেয়েদের তো ওই দোষ, রুচি কাকে বলে তা জানে না। অশোক বলিল।
থাক, থাক, বক্তৃতার আর দরকার নেই। শীলাবতী কি হাসি চাপিতেছে?
-আমি বুঝি সেদিক থেকেই বলছি? আমি বলেছি এক মহত্তর,–
–থাক, থাক, আর বলতে হবে না।
শীলাবতী বিছানার কাছে আসিল। আস্তে আস্তে পাশ ফিরিয়া অশোক কিছু বলিতে গিয়া শীলাবতীকে দেখিতে পাইয়া চোখ বুজিল। বিড় বিড় করিয়া বলিতে লাগিল, যাও না, প্রাণ ভরে দ্যাখোগে, সারারাত জেগে দ্যাখো আমি তো আর অমন বাজে শখে সারারাত জেগে তারপর ভোরবেলা ট্রেনে চড়ে ঘুমে ঢুলতে পারিনে।
হাসিয়া শীলাবতী বলে, নাঃ, এ ঘুম আর কিছুতেই ভাঙবে না দেখছি।
আকাশ তাহার বুকে এক মৃদু উষ্ণতা অনুভব করিল। চোখ মেলিলে কথা বলিতে হয়, বোধকরি সেই ভয়েই সে চোখ বুজিয়াই পড়িয়া রহিল।
বাইরে ভাসান গান। মেয়ে সাজিলেও সর্দারের গলাটাই সবচেয়ে বেশি জোরে শোনা যায়।
দাঙ্গা
লোকটি খুব তাড়াতাড়ি পল্টনের মাঠ পার হচ্ছিল। বোধহয় ভেবেছিল লেভেল ক্রসিংয়ের কাছ দিয়ে রেলওয়ে ইয়ার্ডে পড়ে নিরাপদে নাজিয়াবাজার চলে যাবে। তাহার হাতের কাছে বা কিছু দূরে একটা লোকও দেখা যায় না—সব শূন্য, মরুভূমির মতো শূন্য। দূরে পিচঢালা পথের ওপর দিয়ে মাঝে মাঝে দুই একটি সুদৃশ্য মোটরকার হুস করে চলে যায় বটে, কিন্তু এত তীব্র বেগে যায় যে মনে হয় যেন এইমাত্র কেউ তাকেও ছুরি মেরেছে, আর সেই ছোরার ক্ষত হাত দিয়ে চেপে বসে পাগলের মতো ছুটে চলেছে। নির্জন রাস্তার ওপর মোটর গাড়ির এমনি যাতায়াত আরও ভয়াবহ মনে হয়। দূরে গভর্নর হাউসের গর্বময় গাম্ভীর্য মানুষকে। উপহাস করে। পথের পাশে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতা মৃদু আন্দোলিত হচ্ছে। মাঠের ওপর কয়েকটা কাক কীসের আশায় হেঁটে বেড়াচ্ছে। অনেক দূরে একটা ইঁদুরের মতো ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে কে? একটি সৈন্য। ওই সৈন্যটি আজ তিনদিন ধরে এক জায়গায় ডিউটি দিয়ে আসছে।