খিলখিল করিয়া হাসিয়া ওঠা শীলাবতীর অভ্যাস। হাসির বেগে চোখ দুইটি ছোটো হইয়া আসে, গাল ফুলিয়া ওঠে, চিবুকের ওপর কয়েকটি রেখার—দাগ পড়ে।
অশোক তাহার দিকে খানিকক্ষণ চাহিয়া রহিল। খুশির প্রাবল্যে শীলাবতীর মুখখানা কীরকম হইয়া আসে দেখিয়া তৃপ্তি অনুভব করে। তারপর অকস্মাৎ গম্ভীর হইয়া গেল, দারুণ গম্ভীর।
দুইজনেই চুপচাপ; কেবল খুন্তি নাড়ার ঠুংঠাং শব্দ, তার সঙ্গে হাতের চুড়িতে অনুচ্চ আওয়াজ।
ঘাড় কাত করিয়া গালটা একপাশে উচাইয়া ধরিয়া শীলাবতী ভুরু কুঁচকাইয়া বলে–কি হল?
—কেবলই মনে হচ্ছে, কালকেই যে চলে যাব।
—হ্যাঁ! শীলাবতী মুখ নীচু করিয়া নিল।
—হ্যাঁ মানে?
–একেবারেই সোজা কথাটি। মানে আবার আসবে।
—আসব। যেন অশোকের মতো জলমগ্ন প্রায় হতভাগ্য, একটা ভাসন্ত তৃণ দেখিতে পাইয়াছে।
শীলাবতী মাথা নাড়িয়া বলিলঃ–হ্যাঁ শীতের ছুটিতে।
-ও, এই কথা, সে তো আমিও জানি।–
অশোকের চোখে-মুখে যেন হতাশার চিহ্ন।
শীলাবতী এবার নিজের সঙ্গে কথা বলে তোমার কিন্তু মজা মন্দ নয়; শহরে থেকে গাড়ি-ঘোড়ায় দৌড়াও, কত কিছু দেখ, কত কিছু খাও, আবার মুখের চোখের স্বাদ বদলাতে চলে আসো গাঁয়ে! কী মজা!
অন্য সময়ে হয়তো অশোক হাসিমুখে অন্য কথাই বলিত, যোগ্য উত্তর ছিল। কিন্তু এখন তেমনই গম্ভীরভাবে, ঝুঁকিয়া পড়িয়া বলিল— তুমি আমার সঙ্গে যাবে শীলা?
শীলাবতীর মুখ ঘুরিয়া গেল–কোথায়?
—যেখানে কত কিছু দেখি, কত কিছু খাই।
তৎক্ষণাৎ মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়া গেল–ছিঃ!
তার কাঁধে হাত রাখিয়া অশোক বলিল, ছিঃ কেন?
–পাগলামি কোরো না। তোমার মা নেই? বোন নেই? তারা মানুষ নয়? তারা এখানে পড়ে থাকবে—আর আমাকে একলা নিয়ে যাবে তুমি?
অশোক হাত সরাইয়া নিল। চুপ করিয়া সামনের উঠানের দিকে তাকাইয়া থাকা। ছাড়া গত্যন্তর কোথায়? কিছুক্ষণ পরে আবার কি মনে করিয়া নিজেই বলিল :
আমার দোষ? তুমিই তো বললে!
—বললাম বলেই বুঝি যেতে চাইলাম? শীলাবতী সশব্দে হাসিয়া উঠিয়া বলিল–হা ঈশ্বর! সে কথা তুমিও জানতে, ওটা পাগলামি। তবু তো বললে, বলে আবার নিজেই দুঃখু পেলে! না বাপু, অমন হাঁড়িপানা মুখ আমি সইতে পারিনে, অত রাগ আমি ভালবাসিনো—এই বলিয়া সে একটু পিছন ঘুরিয়া অশোকের ডান হাতটি নিজের হাতে নিল। মুখ নীচু করিয়া নিজের বুকে চাপিয়া ধরিল।
তারপেই খিলখিল করিয়া দুজনেরই উচ্ছ্বসিত হাসি। এমন সময় বাহিরে দ্রুত পদশব্দ এবং কাশি। সঙ্গে সঙ্গে ডাক ভূতো, ভূতো?
নিমেষমধ্যে হাত ছাড়িয়া দিয়া স্খলিত ঘোমটা মাথায় তুলিয়া শীলাবতী রান্নায় মন দিল। যেন ভালো মানুষটি। বিরক্তির সুরে অশোক বলিল— তোমায় তো কতবার বলেছি মা, ও নাম ধরে আমায় ডেকো না; তবু তোমার কি যেন খেয়াল, কিছুতেই ও নামটি ছাড়বে না। যেন জিদ করে বসে আছ। আড়ালে শুনে লোকে ভাববে, লোকটা বুঝি সত্যি ভূতের মতো দেখতে।
আঁচলটা খসিয়া গিয়াছিল। সেটা আবার কোমরে জড়াইতে জড়াইতে মাথায় শুকনো খড়ের মতো দুই গাছি চুলকে একটা গুটির মতো পাইয়া অত্যন্ত ব্যস্ত এবং এস্ত নিরুপমা বলিলেন–ভূতো দেখ দিকিন। কাজের সময়েই যত ঝকমারি!
ঝকমারি!–অনিচ্ছা সত্ত্বেও অশোক বলে।
—তা নয় তো কী? যত বলি, ব্যাটা যেন আরও চেপে বসে। আমি বলি বাপু আমি তো আর কত্তা নই, যিনি কত্তা তাকে জিজ্ঞেস করে এসো। বলে, তাহলে ডেকে দিন। আমার দুহাত ভরা কাজ, আমি নাকি পারি অতদিকে নজর রাখতে? ঝকমারি! কিছুই বুঝিতে না পারিয়া অশোক বলিল কিন্তু লোকটা কে?
-কি জানি? ও নাম বলতে আমার দাঁত ভাঙে, আমার মনে থাকে না বাপু। সেই যে পশ্চিম পাড়ার বুড়ো সর্দার।–
নিরুপমা নাম মনে করিতে চারিদিকে তাকাইলেন।
—কে? আস্রফ মিঞা?
—হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেই সর্দারই বলে কিনা, শুধু আপনি বললেই হয় ঠাকরুন, আমরা এবার ভাসান শোনাবই। আমি বলি বাপু আমাকে কেন? কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি-নীচু হইয়া গলার স্বর নামাইয়া নিরুপমা বলিলেন, চমৎকার গায় ওরা। লখিন্দর যে ছেলেটা সাজে, আহা কি সুন্দর চেহারা, কী গায়ের রং আর এই যে সর্দার, ওর যা গলা, শুনলে বাক্যিহারা হতে হয়। চমৎকার!-আবার গলার স্বর স্বাভাবিক করিয়া বলিলেন, বলি আমাকে ধরে কি হবে? টাকা-পয়সার মালিক তো আর আমি নই।
খুশি হইয়া অশোক বলিল, তা হলে বলে দাও গে মা।
-আজই তো? কালকে তো চলে যাবি। যাই তাহলে কথা দিয়ে দিইগে। বলিয়া নিরুপমা দ্রুতপদে তাঁহার চারিদিকের ঝামেলা পোহাইতে চলিলেন।
মুখ টিপিয়া শীলাবতী হাসিতেছিল। ঘোমটা তুলিয়া দরজার দিকে চাহিয়া বলিল :
—ভাগ্যিস নিজের চোখে দেখেছিলাম, তা নইলে ওই নাম শুনে কে আর বিয়ে করে!
পরম উৎসাহে অশোক সায় দিয়া কহিল,
–এই দেখো ওই জন্যে কতবড়ো একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। তুমি আজ অন্যের হয়ে যেতে পারতে; ইস, কত বড়ো একটা ফাঁড়ার হাত এড়ানো গিয়েছে।
–নাকি? খিলখিল করিয়া শীলাবতী আবার হাসে।
বিকালের খানিকটা আগে হইতে উদ্যোগপর্ব শুরু হইল। সর্দার নিজে তদারক করে। মাথার উপরে টাঙানোর জন্য নৌকার পাল, বসিবার জন্য একটা ছোটো সতরঞ্চি, দরকার হইলে তক্তা পাতিয়া দেওয়া যাইবে। এইভাবে সারাটা বিকাল কাটিল। অশোকের ছোটো বোন অরু ও পাড়ার ছেলেমেয়েরা উৎসুক দৃষ্টিতে অসামান্য খুশি হইয়া দেখিতেছিল। সর্দারের মুখটি আজ কী পরিষ্কার, পালিশ, চকচকে। চুলে সাবান দেওয়া হইয়াছে; আজ আর তেল চপচপে নয়, আজ তার ঘাড় পর্যন্ত বড়ো বড়ো চুল রেশমের মতো নরম আর হালকা,বাতাসে ফর ফর করিয়া উড়িতেছে। যাই বল, সর্দার এককালে সুন্দরই ছিল। আজ নয় বুড়া হইয়াছে; কিন্তু যাই বল লখিন্দরের মতো অমন জোয়ান মদ্দর মা-র পার্টে তাহাকে মানাইবে ভালো; বেশ মানাইবে।