সুরমা সব বললে।
ভাড়াটে এনে মহা মুস্কিলে পড়া গেছে আর কি! কী আর করি, একদিন গেলাম। ফার্স্ট সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে চোদ্দো নম্বর বেড। শৈলেশ আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন; বললেন, আপনি এসেছেন!
বললাম, হ্যাঁ। কিন্তু শৈলেশবাবু এসব কী?
—আর বলবেন না, ব্যাটারা ভয়ানক পাজি।
–সে কারা? কেমন করে এমন হল?
—সামান্য একটা কথা নিয়ে তর্ক হল, সেই তর্কেই শেষ পর্যন্ত মারামারি। ওরা ছিল পঁচিশ জনের ওপরে, আর আমি একেবারে একা। তবু শৈলেশ চক্রবর্তীর হাতে যা মার ওরা খেয়েছে সেটা ওরাই জানে। আর আমার এই যে দেখছেন, মাথা ফেটেছে, হাতে একটু ব্যথা পেয়েছি, জানেন তো, মার দিতে গেলে মার খেতেও হয়। দেখুন কী সাহস, আমাকে ওরা চেনে না, মনে করছে, ওদের মতো আমিও এক পথের ধুলোরই মানুষ। ওদের এও খেয়াল নেই যে আমি একজন Ex-soldier.
শৈলেশ উত্তেজনায় বসে পড়লেন, উত্তেজনায় তাঁর শরীর কাঁপছে।
বললাম, থাক থাক, আগে সেরে উঠুন, তারপর যা হয় করা যাবে। কিন্তু ওরা কে তাতো বুঝতে পারলাম না?
——চায়ের দোকানের মালিক।
শুনে সত্যি একটু রাগ হল। বললাম, তাহলে দেখছি, ভয়ানক পাজি তো! সামান্য তর্কের জন্যে এমন করল! ওদের পুলিশে দেওয়া হয়নি?
শৈলেশ হেসে বললেন, সে কখন।
-বেশ হয়েছে। আপনি এখানে আর ওদিকে সকলে আপনার জন্যে ভয়ানক চিন্তায় পড়েছে।
—সকলে কে কে?
—এই ধরুন, আপনার স্ত্রী, কেবলই কাঁদছেন।
শৈলেশ বাইরের আকাশের দিকে গম্ভীরভাবে তাকালেন, চোখের উপরে ম্লান ছায়া। সুরমার কথা বিশ্বাস করতে হল, তার প্রত্যক্ষ পরিচয় এখন পেলাম। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, অত চিন্তার কী হল? একটা অন্যায় দেখেও চুপ করে থাকবে, ওরকম জীবন শৈলেশ চক্রবর্তী রাখে না। আর এই তো প্রথম নয়, সারাজীবন তাই করে এলাম, মরণকে এতটুকু ভয় করিনি; এখনও করি না, সেইজন্যেই তো লোকে অত ভয় করে, সম্মান করে চলে। আর সে জায়গায় ব্যাটারা কি না সামান্য চায়ের দোকানের মালিক হয়ে—
বললাম, সে যাক, এখন ওসব বলে লাভ নেই। এখন যাই।
—এখনই যাবেন? আচ্ছা, যান। গিয়ে বলবেন, ভালোই আছি, ডিসচার্জড হবার আগেই ফিরে আসবো। এখানে থাকা আমাদের পোষায় না।
-আচ্ছা, বলব। চলে আসছিলাম, আবার পেছন থেকে ডাক এল, দেখুন—
কাছে গেলাম, বললাম, কী?
-নার্সগুলো বড়ো অযত্ন করে, মনে করেছে একটা সাধারণ লোকই আমি। আপনি একটু আর-এম-ও বা ছাত্রদের বলে যাবেন আমার কথা।
ভাবলাম, আমি কি লাটসাহেব নাকি যে ওরা আমার কথা শুনবে? তবু বললাম, আচ্ছা বলব।
প্রায় মাসখানেক পরে শৈলেশ এলেন।
এতদিন পরে নীচের ঘরের মেয়েতে ছেলেপিলেদের অশ্রান্ত দাপাদাপি আর হাসির শব্দ পেয়ে ভালো লাগল। আর একজনেরও ব্যাকুল প্রতীক্ষারও এতদিনে অবসান হয়েছে।
কিন্তু দুদিন পরে আবার সব ঠাণ্ডা।
সুরমাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?
সে কিছু বলতে পারল না।
বলার দরকারও হল না, একদিন ভোরবেলা সব পরিষ্কার হয়ে গেল। আমাকে নিভৃতে ডেকে শৈলেশ বললেন, দেখুন, এতদিন পরে এসেছি, হাতে একটি টাকা নেই, একেবারে না খেয়ে থাকবার মতো অবস্থা। এই বিপদের সময় যদি কয়টা টাকা দেন তো বড়ো উপকার হয়। ইংরেজি মাস পড়লেই দিয়ে দেব।
চুপ করে রইলাম।
—দেখুন, আপনাকে মিথ্যা বলেছি। আসলে অবস্থা আমার একটুও ভালো নয়। আর সেই যে চায়ের দোকান, ওরা আমার কাছে অনেক টাকা পেত, তাইতো অত বচসা, মারামারি। ভিতরে আর কোনো কারণ নেই। আপনাকে সত্যি কথা বললাম। দিন না কয়েকটি টাকা, আমি ঠিক দিয়ে দেব।
তার গলা ভিজে এল। এযাবৎ ভাড়াও একটি পয়সা পাইনি। বললাম, টাকা আমি দিতে পারি কিন্তু আপনি এ বাসা ছেড়ে কালই চলে যাবেন। আমারও বা এমন অবস্থা কি যে আপনার জন্যে আমি অত ক্ষতি স্বীকার করব? টাকা আমি আর চাইনে, আপনি কেবল চলে যান।
শৈলেশকে টাকা দিলাম।
বাসা ছেড়ে শৈলেশ সত্যি চলে গেলেন, তবে রাত্রে নয়, দিনে। বাড়িওয়ালার ধরবার ভয় নেই। যাবার সময় দেখলাম, দুটো টাকা পেয়ে আগের মতো সেই খুশি এতটুকু অন্তর্হিত হয়নি, ঠিক সেইরকম লম্বা গোঁফে আঙ্গুল বুলিয়ে বললেন, Ex-soldier of the last Great War.
গান
শীলাবতী যেন অপূর্ব সুন্দরী হইয়া উঠিয়াছে—বিশেষত আজিকার দিনটিতে। এক বছর ধরিয়া অশোক তাহাকে দেখিয়াছে, আজও দেখিল।
দেখিল— শীলাবতী ঘামিয়া উঠিয়াছে, কপালে, সরু চিবুকে, গলার নীচে, বুকের মাঝটিতে ছোট ছোট ঘাম-বিন্দু। ডান হাতটি ছন্দোবদ্ধ ভঙ্গিতে লীলায়িত, গালের পাশে অবিন্যস্ত উড়ো চুল।
রান্নাঘর। একপাশে একটিমাত্র জানলা—অপরিসর; সারাটা ঘর একটু আগেও ধোঁয়ার আচ্ছন্ন ছিল, এখনও আছে, কিন্তু গভীরতায় অল্প।
অশোক দুই হাত তুলিয়া বলিয়া উঠিল :
-আহা দেখেছো, সব নষ্ট করে দিলে। অমন মাছটা আর খেতে পেলাম না।
খুন্তী নাড়িতে নাড়িতে, হাসিয়া শীলাবতী বলিল–আহা! নিজের চরকায় তেল দাওগে বাপু, রান্নাঘরে কেন পুরুষের ঝকমারি! টাকা যদি তোমরা আনতে পারো, রাখবার উপায়টা আমরা জানি, তোমরা নও। তোমরা যদি গাছ কাটতে পারো, আমরা জ্বালাতে পারি আগুন।
–এবং জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে দিব্বি আরামে, পায়ের পর পা তুলে ঘুমোও। ওদিকে তো পুরুষের দোকানে ঘিয়ের বাতি।
হাসি চাপিয়া শীলাবতী যেন হঠাৎ গম্ভীর হয়ে ওঠে। বলে— তাই নাকি? তাহলে উপায়? অশোকও গম্ভীর হইয়া বলে–এক কাজ করো। কিছুদিন তোমরাই এখন দোকান সাজাও; আমরা ঘরে এসে বসি।