হাসি পেলো খুব, না হেসে বললাম, এখন আপনার আর ভাই সব কোথায় গেল?
এখন কি আর সব একখানে আছে। এই তো ধরুন, আমি এখানে, কেউ কলকাতায়, কেউ থাকে চাটগাঁ, কেউ জলপাইগুড়ি, কয়েক ভাই গাঁয়ের বাড়িতে থেকে জমি-জমা দেখছে, আর কয়েকজন মারা গেছে।
শৈলেশ অনায়াসে একটা হিসাব দিলেন, আমি হাসি চেপে চুপ করে গেলাম। সেদিন এই পর্যন্ত।
তারপর এক রবিবার দুপুরবেলা, আমি বসে একটা বই পড়ছি। সুরমা গেছে খেতে। বাইরে ভারী পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম।
-কী করছেন? শৈলেশ কিছু না বলেই একটু হেসে ঘরে এসে একটা চেয়ারে। বসে পড়লেন।
দুপুরবেলা সুরমার বদলে এই লোকটির নিমন্ত্রণহীন উপস্থিতিকে উৎপাত ভেবে বিরক্ত হলাম। এখন দুঘণ্টা বসে অনর্গল বকুনি শুনতে হবে আর কি! কিন্তু মুখে কিছু না বলে বললাম, এ কয়দিন আপনাকে দেখিনি যে?
-আর বলেন কেন মশাই! গিয়েছিলাম বন্ধুর বিয়েতে, ধরে নিয়ে গেল, কি আর করি? মেয়ের বাড়ী গাঁ-দেশে। কিন্তু গিয়ে দেখি একেবারে অজ পাড়াগাঁ, যত ছোটোলোকের আড়া। এর চেয়ে খারাপ জায়গা আমি আর জীবনে দেখিনি। আরে। বাপরে, কী জঙ্গল! তার ওপর আবার ক-দিন সমানে বৃষ্টি, এখানেও হয়েছিল কিন্তু ক-দিন সমানে তো নয়? ওখানে হয়েছিল খুব। আর কেবল কাদা। আমি তো ঘরের বারই হইনি।
তার কথার দিকে বেশি মনোযোগ আমার নেই দেখে আমার দিকে ঝুঁকে বললেন, কী বই ওটা?
-এমনি একটা ইতিহাস। বইটা পাশে রেখে বললাম, বসে আছি তাই টেনে নিয়ে পাতা উলটোচ্ছিলাম।
—তাহলে এই দেখুন, শৈলেশ খুশি হয়ে বললেন, ভাগ্যিস আমি এসেছিলাম। আপনি আমাকে ডাক দিলে তো পারতেন। লোকটার নির্বুদ্ধিতা ক্ষমার যোগ্য নয়।
গোঁফে কয়েকবার হাত বুলিয়ে শৈলেশ বললেন, মানুষের কান্ড দেখে অবাক হতে হয়।
—আবার কী হল?
-শুনুন একটা ব্যাপার। আশ্চর্য হয়ে যাবেন। কিছু খারাপ কথাও আপনাকে শুনতে হবে, কিছু মনে করবেন না যেন। সেদিন বিকেলে বাইরে বেরোচ্ছিলাম। গলির মাথায় যে বাসাটি আছে—এখনও তো ভালো করে এ পাড়ার সকলকে চিনি না—সেই বাসার দোতলার বারান্দায় কয়েকটা মেয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেতে যেতে আমি লক্ষ করলাম, তারা আমাকে দেখে হাসল। আমি ভাবলাম, আমাকে দেখে হাসবার কী আছে, না, অন্য কারোর দিকে চেয়ে হাসল? আশেপাশে চেয়ে দেখলাম কেউ নেই। তারপর চলেই যাচ্ছিলাম, হঠাৎ খিল-খিল হাসির শব্দ শুনে ফিরে তাকিয়ে দেখি, ওরা আমাকে ঠাট্টা করছে। একটা মেয়ে তার ঠোঁটের দুদিকে দুহাতে আঙুল দিয়ে টেনে আর একজনকে এমনি করে দেখাচ্ছে—শৈলেশ নিজের হাতে তা দেখিয়ে বললেন, মানে তোরা দ্যাখ, লোকটার কতো বড়ো গোঁফ! এ নিয়েই হাসাহাসি। আচ্ছা বলুন তো, এসব কী? এগুলো কি ভালো? বড়োলোক বলে মানুষকে এমন ঠাট্টা করে নাকি? অমন দু-চারটে বড়োলোক আমি এখনও কিনে রাখতে পারি।
এমন ব্যাপার শুনলে কার না হাসি পায়, হেসে বললাম, তারপর কী হল?
-আপনি হাসছেন, কিন্তু বলুন তো এরকম করা কি উচিত? তারপর কতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ইচ্ছা হল একবার বলি, পুরুষের পরিচয় হল একজোড়া গোঁফে আর মেয়েদের সৌন্দর্য হচ্ছে–
পরের কথাটুকু আন্দাজ করে বিরক্ত হয়ে বললাম, থাক, থাক, ওসব কথায় কাজ নেই। কিন্তু শৈলেশ থামলে না। বললেন, তোমরা যদি তা কেটে ফেলতে পারো, আমি আমার এই গোঁফজোড়াটিও তাহলে মাত্র দু পয়সা খরচ করে কেটে ফেলব।
—আহা, শৈলেশবাবু আপনি এসব কী বলছেন?
—কী আর বলব বলুন? এতে কার না রাগ হয়? আমি পঁয়তাল্লিশ বছরের একটি পুরুষ মানুষ, আমাকে নিয়ে ওরকম ঠাট্টা যারা করে তাদের ওপর আপনারও কি রাগ হয় না? আগে মানুষ আমার মুখের পানে চেয়ে কথা বলেনি, এত ভয় করত! শৈলেশ চক্রবর্তীর নাম কে না জানে?
শৈলেশ বলে গেলেন, যখন স্টিমার অফিসে চাকরি করি তখন আমাদের ওপরওয়ালা মরিসন সাহেবের সঙ্গে কি খাতিরই না ছিল! ক্যালকাটা ব্যাংকের এখানকার ম্যানেজারজানেন নিশ্চয়ই তাঁকে, সেই বীরেন মুখার্জী আমার আপন মাসতুতো ভাই, তারপর সেদিন অজিত বসাক বলে যে ছেলেটি বিলেতে চার্টার্ড একাউন্টেন্সি পড়তে গেল, সে তত আমাকে ভয়ানক সম্মান করত। এরকম কত লোক আমার ঘনিষ্ঠভাবে চেনা! আর তা ছাড়া-I am an Ex-soldier of the last Great war–
আশ্চর্য হয়ে বললাম, আপনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন নাকি?
হ্যাঁ। শৈলেশ বললেন, জীবনে কী না করেছি! ভেবে দেখুন, না করলেও পারতাম। কেউ আমাকে তাড়িয়েও দেয়নি, অবস্থাও খারাপ নয়, তবুও তো জীবনের বেশিরভাগ সময় কেবল বাইরে ঘুরে কাটিয়েছি। আচ্ছা বলুন, কী দরকার ছিল আমার যুদ্ধে যাওয়ার, না গেলেও তো পরতাম।
আরও কতক্ষণ বকবকানির পর রেহাই পাওয়া গেল।
সুরমা এসে বললে, এমন কী কথা হল এতক্ষণ?
—আর বলো না, ক-দিনেরই বা চেনা, এর মধ্যেই কীরকম সব কথা বলে যায়! এতটুকু মুখে বাধে না!
-আর যাই বলো, আমি লক্ষ্য করেছি, ও বউটিকে ভয়ানক ভালোবাসে।
এটা ওর চেহারা আর কাজকর্ম দেখে দুর্লভ মনে করেছিলাম।
কয়েকদিন পরে এক অদ্ভুত খবর শুনতে পেলাম। শৈলেশ কার সঙ্গে মারামারি করে মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে গেছেন। খবর শুনে আশ্চর্য বেশি হইনি, হতুম এই ভেবে যে, এটাই শুধু এতদিন কেন হয়নি। বউদি কেবল কাঁদছে, এমন বিপদের সময় একটা লোক নেই যে তাকে একটু দেখে শশানে। অথচ নিজের যাবারও সাধ্যি নেই।