বাইরে কিছু কিছু কুয়াশা পড়ছে, কোনো গাছের চারিদিকে একটা মোটা আংটির মতো মনে হয়, বাড়ির সামনের আঙিনায় যে শেফালি গাছটি একটা ছোলা মুরগির মতো আজও বেঁচে আছে, তার অবশিষ্ট কয়েকটি ডাল থেকে কিছু ফুল একটি করে আঙিনার কর্কশ শরীরে ঝরে পড়েছে। এমন সময় বাইরে হঠাৎ একটা গোলমাল, কতকগুলি ভারী পদশব্দ, হিন্দি বাংলায় মিশ্রিত বুলি, দরজার ধাক্কাধাক্কি। লাথির শব্দও শোনা যায়। তাড়াতাড়ি বই বন্ধ করে সুকুমার দ্রুত জানালার তাকের কাছে গেল। ওদিকে মা-ও জেগে উঠেছে। ব্যাপারটা সহজেই অনুমান করে ভয়ে তার গলা যেন বুজে আসতে চায়। সে বললে, সুকু, তোকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি।
-বলো?
–তোকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি।
সুকুমার কী একটা জিনিস তাড়াতাড়ি খুঁজতে খুঁজতে অন্যমনস্কভাবে বললে, বলো।
-ওরা আর একদিন এসে তোকে খুঁজেছিল।
সুকুমার কেবল বললে, ও– তারপর তাক থেকে একটা কাগজের বান্ডিল বার করে তার হাতে দিয়ে বললে, এটা কোথাও রেখে এসো গো।
কাঁপতে কাঁপতে মা অমনি বীণার কাছে গেল, তাকে এখন কত আপনার মনে হচ্ছে। বললে, বীণা, মা, তোর কাছে এটা রাখ।
খানাতল্লাশি হতে বেলা আটটা বেজে গেল।
দারোগা তাঁদের সঙ্গে সুকুমারকে নিয়ে যেতে ভুললেন না। সবই স্বপ্নের মতো মনে হয়। স্বপ্ন যখন ভেঙেছে তখন দেখা গেল, মা-র শুকনো দুইগাল বেয়ে দরদর করে জল পড়ছে। কিন্তু একসময় গলা তার খুশ খুশ করতে লাগল, এমন কাশি যে, চোখ দুটি ছুটে বের হয়ে আসতে চায় যেন, তার কাশি কী ইহজীবনেও আর যাবে না। ওদিকে ভোলাও চি চি করে গোঙাচ্ছে।
মার বীণার অবস্থা আরও মারাত্মক।
সে আজ বাড়ির সকলকে উপেক্ষা করে যেন প্রকাশ্য রাজপথে নেমে এল, সুকুমারের ঘরে ঢুকে দেখল ঘরময় ইতস্তত ছড়ানো নানা জিনিসপত্র, বই কাগজ, সেই রাশি রাশি বই আর কাগজের স্কুপে মুখ গুঁজে বীণার চোখে জল ভরে এল, চুলের খোঁপা তার খুলে গেল, পিঠ থেকে কাপড়ের আঁচল খসে পড়ল।
আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হল পরদিন। সেদিন দুপুরবেলায় ভীষণ বৃষ্টি শুরু হয়ে
গিয়েছে। বিকেলবেলায় তা খানিকটা থামল বটে, কিন্তু বৃষ্টি টিপ টিপ করে পড়তেই লাগল। সেদিনের পাইকারী ধরপাকড়ে শহরে একটা বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। বিকেলে শত শত শোভাযাত্রাকারী বৃষ্টি উপেক্ষা করে মুখে প্রতিধ্বনি দিয়ে নগরের অনেক পথ অতিক্রম করল। মা বুঝতে পেরেছিল, এরা কারা এবং কেন?
সে ব্যস্ত হয়ে ডাকল, বীণা! ও বীণা!
–বলুন!
–শুনিস!—এই বলতেই সেই কাশি আবার শুরু হয়ে গেল। কিন্তু ওই বীণা এখন কত আপনার।
এক্স-সোলজার
ছোটো দোতালা বাড়ি, তবুও আমাদের পক্ষে বেশি হয়ে যায় বলে নীচের ঘরে। অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় একজন ভাড়াটে আনলাম।
লোকটির নাম শৈলেশ, সঙ্গে স্ত্রী আর চারটি ছেলে-মেয়ে।
যেদিন তারা প্রথম এল তখন রাত্রি, লোকটাকে সেদিন আর দেখিনি। কিন্তু পরদিন কলের পাড়ে মুখ ধুতে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলাম তার চেহারা দেখে। মিশকালো তার গায়ের রঙ, চোখ দুটি বড়ো, লম্বা আর ভয়ানক জোয়ান, সমস্ত গা লোমে ভরতি, মাথায় চুল ওলটানো। আর সবচেয়ে বিস্ময়কর যা তা হচ্ছে তার গোঁফজোড়া। স্যর আশুতোষেরও বোধ করি এমন গোঁফ ছিল না। নিজেকে ধন্যবাদ দিলাম, এই ভেবে যে রাতে না দেখে ভালোই করেছি, দেখলে হয়তো মূচ্ছ যেতাম। এখানে বলে রাখা দরকার যে, তাকে যে আমার নীচের ভাড়াটে ঠিক করেছিলাম, আমি নিজে দেখে নয়, কথাবার্তা চলেছিল অন্যের মধ্যস্থতায়, আর সে বাসাও দেখে গিয়েছিল আমার অ-সাক্ষাতেই।
সে যাক।
আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। বাইরেটা দেখে প্রথম যা ভেবেছিলাম তেমন কিছুই নয়। লোকটা গল্প করতে পারে খুব, যখন একবার আরম্ভ হয় কিছুতেই আর শেষ হয় না। কথা শুনে যা বুঝলাম তাতে অবস্থা ভালোই মনে হয়।
একদিন রাত্রে নীচ থেকে একটি ছেলের ভয়ানক কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। অনেকক্ষণ অমন চিৎকার শুনে আর থাকতে না পেরে বারান্দায় এসে ডাকলাম,—শৈলেশবাবু, ও মশাই—
জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? ছেলেটাকে অত মারছেন কেন?
—আর মশাই! এমন দুষ্টু ছেলে কারোর ঘরে নেই। সন্ধ্যে থেকে বলছি পড়তে বসতে, না, ওর কানেই যায় না। আজ বাদে কাল পরীক্ষা, এখনও পর্যন্ত নাউন কাকে বলে জিজ্ঞেস করলে হাঁ করে বসে থাকে, আবার এদিকে পড়তেও বসে না। তাই এমন রাগ হল যে খুব মার দিলাম।
–তা বলে কি এমনভাবে মারতে আছে?
শৈলেশ চেঁচিয়ে বললেন, কি জানেন, আমরা ওর চেয়ে বড়ো হয়েও বাপের কাছ থেকে অনেক বেশি মার খেয়েছি। এমনকি, হাত-পা বেঁধে পর্যন্ত ঘরের ছাদে ঝুলিয়ে রেখেছে। এত শাসন ছিল। আর সেই শাসন পেয়েই না আজও সবকে ভয় না করে চলি! আমি চাই, আমার ছেলেও তেমনি হোক। লোকে বলুক, হ্যাঁ, এ ছেলে শৈলেশ চক্রবর্তীর নাম রেখেছে বটে।
ছেলেটার কান্নার শব্দ ক্রমে কমে আসছে।
নীচের থেকেই শৈলেশ বললেন, দেখুন, চক্রবর্তী পরিবারের আমরা তখন একটি দুটি নয়, পঞ্চাশটা ভাই ছিলাম। শুনে আশ্চর্য হবেন। আমার বাবারা ছিলেন পাঁচ ভাই, সব একসাথে। আজকালের মতো নাকি যে দুটি ভাইয়েতেও একান্নবর্তী সংসার চলে না? হাঁ, তখন আশেপাশের সমস্ত গাঁ আমাদের নামে ভয় পেত। এত নাম ছিল চারদিকে।