হলের মাঝখানে দাঁড়াইয়া একদল গল্প করিতেছে। অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট অবনী সিংহ এক বন্ধুর ছেলের সঙ্গে নিজের মেয়ের পরিচয় করাইয়া দিতেছিলেন, ছেলেটির গায়ে এখনও বিলাতের গন্ধ তীব্র। সিংহ-কন্যা সেই গন্ধই শুকিতে লাগিল। নিজেও তিনি কয়েক বছর আগে তাঁহার বাবার সঙ্গে বিলাতে গিয়াছিল। সে-কথাও জানাইতে ভুলিল না। অবনী সিংহ নিজে আর এক পাশে সরিয়া মিশনারি উইলিয়ামসনের সঙ্গে আলাপ আরম্ভ করিলেন। বাহিরে এখনও একটু আলো আছে বটে, ভিতরে অন্ধকার। তাই সবগুলি আলো জ্বলিয়া উঠিয়াছে। সেই আলোতে মেয়েদের শাড়ী ঝলমল। মুখে স্নিগ্ধতা। মসৃণ মেঝেতে জুতার মৃদু আওয়াজ, কথার গুঞ্জনে কতকটা চাপা পড়িয়াছে।
জীবানন্দ জানিতেন, ইহাদের বেশিরভাগই ছবি কিনিবেন না, ইহাদের অনেকেই ঠিক সমঝদার নন, এবং-জীবানন্দ আরও কিছু হয়তো জানিতেন কিন্তু তবুও আশা! যাই বলল, এমন সমাবেশ আর কোনোবারই হয় নাই। না, না, তাঁহাদের সম্বন্ধে অভিযোগ করা মিথ্যা।
আবার কে আসিলেন?
সকলে বাহিরের দিকে তাকাইল। জীবানন্দ অগ্রসর হইলেন। বাইরে হাসি, কথা—আর জুতার শব্দ। ক্রমেই স্পষ্ট হইতেছে।
তাহারা কয়েকটি ছেলে ও মেয়ে-বাইশ তেইশ হইতে তিরিশ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সের। ছেলেমেয়েদের মধ্যে পরনে কারোর সুট, কারুর সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি। তাহাদের আসার সঙ্গে সঙ্গে সারা হলটি কোলাহলে ভরিয়া উঠিল। একেক জন উজ্জ্বল হাসিয়া, জোরে কথা বলিয়া স্বাস্থ্যের প্রসন্নতায় এখান হইতে সেখানে ঘুরিয়া ছবির পর ছবি দেখিয়া চলিল।
সকলে বিরক্ত হইল। মিসেস গুপ্ত আজকালকার ছেলেমেয়েদের—বিশেষত ওই নবাগত দলটির মধ্যে ফর্মালিটির নিতান্ত অভাব দেখিয়া নাক সিঁটকাইলেন। কী বিশ্রী। সাধারণ এটিকেটও কী ইহাদের জানা নাই?
এটর্নি অতুল সরকার নিজের মেয়ের দিকে হইতে এমন কোনো দোষ নাই ভাবিয়া মনে মনে আশ্বস্ত হইলেন। আর কী চেঁচামেচি? তাহাদের দিকে মাঝে মাঝে আড়চোখে চাহিয়া শকুন্তলা কথা বলিতে লাগিল। পেছনে চুলে হাত দিয়ে অবনী সিংহের মেয়ে ভাবিলেন : আহা মেয়েগুলির চেহারার যা ছিরি! তেমনি কাপড় আর জামা। যেন এইমাত্র কোথা হইতে যুদ্ধ করিয়া আসিল! বুকের উপরে আঁচল টানিবার সাধারণ স্টাইলটুকুও কী উহাদের জানা নাই? ওরকম পাড়ের আর রঙের কাপড় আর আজকাল চলে না, যাই বলো।
জীবানন্দও দারুণ বিরক্ত হইয়া এদিকে আসিয়া যোগ দিলেন।
বেগনী রঙের শাড়ি-পরিহিতা একজোড়া তীক্ষ্ণ ভ্র-বিশিষ্ট শ্যামবর্ণা একটি মেয়ে প্রায় চীৎকার করিয়া উঠিয়াছেঃ আয়ার? আরার?
একপাশে দাঁড়াইয়া আরও কয়েকটির সঙ্গে মিলিয়া আরার একটা ছবি দেখিতেছিল, ডাক শুনিয়া ইংরাজিতে বলিল, কেন?
হাত দিয়া কাছে আসিতে ইঙ্গিত করিল মেয়েটি। কিন্তু উত্তর দিয়া আর আয়ার সেদিকে তাকায় নাই, নিজ মনে ছবি দেখিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে মেয়েটি তাহার কাছে আসিয়া বলিল
–Am I to shout your name this whole evening comrade ?,outs হাসিয়া ফেলিল, বলিল, এ-তো তোমাদেরই দেশ কমরেড। তোমরা তো ঘরের লোক, আমরা তোমাদের অতিথি।
মেয়েটি বলিল come, come, কিন্তু ওধারে তোমাকে একটি জিনিস দেখাবার আছে, চলো৷ ভাসা, ভাসা, সুন্দর চক্ষুবিশিষ্ট আরেকটি মেয়ে কাছে আসিয়া বলিল, লাবণ্য কেমন লাগছে?
লাবণ্য আর এক দিকে যাইতে যাইতে বলিল,-এখনও বলতে পারিনে।
-–তার মানে? কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই ফর্সা মেয়েটি হাসিয়া ফেলিল।
নির্মল আসিয়া বলিল, মিস, সীতা, আপনার দেখা হয়েছে?
—মোটেই না।
–কমরেড আয়ার এসব দেখে খুশি হচ্ছে নিশ্চয়ই।
–তাই মনে হল।
—আর, দেশাই?
—ওই তো-সীতা আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিল।
দেখা গেল, দেশাই ভয়ানক নত হইয়া গভীরভাবে কী একখানা ছবি দেখিতেছে।
নির্মল তাহার উপরে গিয়া পড়িল, হ্যালো, কমরেড দেশাই, Youve found something, I see?
মিসেস গুপ্তা যেন আর এখানে থাকিতে না পারিয়াই স্বামীকে লইয়া মোটরে উঠিলেন।
লাবণ্য আবার আর এক গোলমাল বাধাইয়াছে। জীবানন্দর কাছে গিয়া বলিল, আপনিই জীবানন্দবাবু?
বিরক্তি চাপিয়া তিনি বলিলেন, হ্যাঁ।
–একটু এদিকে আসুন। পরিত্যক্ত একখানা ছবির কাছে গিয়া লাবণ্য বলিল Loneliness বলে এই যে ছবিখানা, এতে ল্যাণ্ডসকেপ নেই কেন।
জীবানন্দর বলিতে ইচ্ছা হইল, ফুটপাথের ধারে ল্যাণ্ডসকেপের অনেক ছবিই পাওয়া যায়, সেগুলি কিনলেই তো হয়।
লাবণ্য বলিল, কিন্তু তার আগে বলে রাখি, আপনার ছবি সম্বন্ধে আমার কোনো জ্ঞান নেই, বুঝিনে। তবে আপনি আমাকে বুঝিয়ে বলুন, আপনার আরও আঁকা ছবি সম্বন্ধেও বুঝিয়ে বলুন। আমি জানি, তাতে আমার মনে হয়তো একটা নূতন রুচি জন্মাবে, যাতে আপনার ছবি আমার খুব ভালো লাগবে। বিশ্বেস হচ্ছে না? নতুন একটা টেস্ট জন্মানো বুঝি অসম্ভব? কখনো নয়। তাহলে একটা ব্যাপার বলি শুনুন। ছেলেবেলা থেকেই আমি পুঁই চচ্চড়ি–
পুঁই চচ্চড়ি? এই আন্তর্জাতিক আবহাওয়ায় পুঁই চচ্চড়ির নাম শুনিয়া জীবানন্দ সভয়ে একবার চারিদিকে চাহিলেন।
লাবণ্য বলিল, হ্যাঁ। ওটা আমি কখনো দেখতে পারিনে, গন্ধ পর্যন্ত শুকতে পারিনে, অথচ সকলের মুখে তার কত নাম শুনেছি; শুনেছি, খেতে নাকি চমৎকার—এসব দেখে আশ্চর্য হয়েছি, ভেবেছি, তাহলে আমার কী হল। কিন্তু আপনিও আশ্চর্য হবেন, আজ আমি পুঁই চচ্চড়ি ভালোবাসি, ভালো জিনিসের প্রতি মানুষের রুচিও তেমনিভাবে জন্মায়, যদি দুর্ভাগ্যবশত তেমন জিনিস তার কোনোদিন ভালো না লাগে। পুঁই চচ্চড়ির ইতিহাস অবশেষে লাবণ্য শেষ, করিল, আপনার ছবিও আমার তেমনি ভালো লাগবে আপনি বুঝিয়ে বলুন। এই ছবিতে ওই লোকটির নিঃসঙ্গতাকে ফুটিয়ে তুলতে ল্যাণ্ডসকেপের দরকার ছিল বলে মনে হয় না? লাবণ্য আগ্রহভরা চোখে কতকটা বিজ্ঞের মতো শিল্পীর দিকে চাহিল।