তার নামকরণ করা হয়েছে ভোলা। ভোলা এমন অনেক বড়ো হয়েছে। একলাই নির্ভয়ে এদিক ওদিক বেড়িয়ে আসে, তার দাপটে এখন মানুষও ভয় পায়, অনেক কুকুরও লেজ তুলে দৌড় দেয়। কিন্তু সুকুমার তাকে স্পষ্টই বলে দিয়েছেঃ দ্যাখ কুকুর পোষাটা নিতান্তই বড়লোকি ব্যাপার কিন্তু আমি গরিব। একবেলা ভাত জোটে তো আর একবেলা জোটে না। আমি যা খাই, তুইও তাই খাবি। তাতে বাঁচতে হয় বাঁচবি, না হয় মরবি। বুঝলি?
এই ভোলা একদিন এদিক-ওদিক ঘুরে অনেক চিন্তা করে আস্তে আস্তে ওপরের ঘরের কাছে বারান্দাটিতে গিয়ে হাজির হল। বীণা শুয়ে-শুয়ে একটা বই পড়েছিল। তাকে দেখে নেমে এসে নিতান্ত আপনার জনের মতো বললে এখানে কেন? নিশ্চয়ই টের পেয়েছিলি, আমি আজ মাংস বেঁধেছি? (দীননাথ মদ যেমন নিত্যই খায়, মাংস তেমন প্রায়ই আনে) খাবি?
ভোলা এখানে ওখানে হুস হুস করে অনেক শুঁকলো;তারপর ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে লেজ নাড়তে লাগল।
বীণা একটা অদ্ভুত মমতা বোধ করল এই কুকুরটার ওপর। সুকুমার ঘরের দিকে একবার চেয়ে বললে, ভাল লোকের হাতেই পড়েছিস, নিজরে শরীরের দিকেই নজর দেয়ার সময় যার নেই ওই পাশে গদাধরের স্ত্রীকে বীণা দেখে বীণা থেমে গেল, হঠাৎ রেগে বললে,–
—যা এখান থেকে, যা বলছি, একেবারে ওপরে এসে হাজির হয়েছেন, ভারী ইয়ে আমার! যা এখান থেকে, যা বলছি। ও মাসিমা আপনাদের কুকুরের কান্ড দেখেছেন? বীণা তাকে তাড়া দিতে দিতে একেবারে নীচে নিয়ে গেল, রান্নাঘর থেকে কিছু মাংস নিয়ে তার পায়ের কাছে ফেলে চুপি চুপি বললে, মা!– তাকে খেতে দিতে গিয়ে সুকুমারের কথা মনে করে বীণার মুখ লাল হয়ে গেল।
কয়েকদিন পরে। বীণা নাক সিঁটকিয়ে বললে, তোর গায়ে কী গন্ধ রে! একদিনও চান করিস না বুঝি? কেউ তোকে চান করিয়ে দেয় না, না? দেবে কী, নিজের শরীরের দিকেই নজর দেয়ার সময় যার নেই— তারপর বীণা চারদিকে চেয়ে নিজের কথাটাকে অর্ধ সমাপ্ত রেখেই একটা সাবান নিয়ে বসে গিয়েছে, তাড়াতাড়ির মধ্যে যতটা পারা যায় তাকে ধুইয়েছে, বোয়াবার সময় তার সেমিজ ঘামে ভিজে গেল।
বেলা তিনটের পরে সুকুমারের ঘরের কাছে গিয়ে ডাকল, মাসিমা?
মা চোখ বুজে শুয়ে ছিল, মেয়েটার ডাক শুনে চোখের পাতার নীচে তার চোখের মণিও কুটিল হয়ে উঠেছে, সে ইচ্ছা করেই কোনো সাড়া দিল না।
বীণা তবু ঘরে ঢুকে মাকে ঘুমুতে দেখে নিঃশব্দে জানালার তাকের কাছে গেল, একটা মোটা বই খুলে সেটা নাকের কাছে ধরে একটু এঁকে আবার বাইরে এসে ভোলাকে লেজ নাড়তে দেখে বললে, তা হলে আমিও শুয়ে থাকিগে কী বলিস? কাজের মধ্যে তো কেবল শুয়ে থাকা—কিন্তু মনে মনে বললে, সুকুমারের কাজের কি শেষ নেই?
অনেক রাতে ভোলার গায়ে সুগন্ধি সাবানের গন্ধ পেয়ে সুকুমার বলছিল, মা, তুমি কি আজ ওকে চান করিয়ে দিয়েছ?
মার চোখ তখন ছোটো হয়ে গেল; গলার ভিতর একটা খুশ খুশ বোধ করছিল, কাশতে কাশতে তারমুখ লাল হয়ে গেল, চোখ দুটি যেন ছুটে বের হয়ে আসতে চায়, তবু সে বলল, আমাকে একটা ওধুষ এনে দিবি, সুকু?
কেরোসিন কাঠের ওপর ভোলা তেমনি ঘুমুচ্ছে, এখন রাত দুটোর কম নয়। ভাঙা কলতলায় সঞ্চিত উচ্ছিষ্ট ভাত, পচা ডাল, তরকারি আর মাছের কাঁটার দুর্গন্ধকে ক্ষীণ বাতাসও বয়ে আনে। দেয়ালের কোণ ঘেঁসে মালপত্র ডিঙিয়ে ছোটো-বড়ো অনেক দুর এখানে সেখানে আসা যাওয়া করে, তাদের খুট খুট আওয়াজ শোনা যায়।
এমন সময় দীননাথ এসে জড়িতস্বরে ডাকল,-বীণা, ও বীণা? কোনো উত্তর না পেয়ে নিজের মনে জড়িয়ে জড়িয়ে বলতে লাগল, বীণা? ও বীণাপাণি, একবারটি দরজা খোল মা? তোর বজ্জাত মা-মাগীর মতো তুইও আমায় সারারাত বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবি কী? দরজা খোল, মা?
বীণা নিঃশব্দে এসে দরজা খুলে দিল, মদের তীব্র গন্ধ সইতে না পেরে নাকে কাপড় চেপে একটু দূরে সরে দাঁড়াল।
কিন্তু দীননাথকে খাইয়ে দাইয়ে বিছানায় আশ্রয় দিতে রাত চারটের আর বাকি থাকে না। নাকে মুখে কাপড় দিয়ে বীণা শুয়ে পড়ল।
এদিকে কিছুক্ষণ পরেই আবার সুকুমার ঘুম থেকে উঠে বসল, কিছুক্ষণ অর্ধনিমীলিত চোখে চেয়ে বসে তারপর আলো জ্বালিয়ে একটি বই খুলে বসল। বইখানা রালফ ফক্স-এর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক নীতি। সুকুমার পড়তে লাগল—সাম্রাজ্যের রাজধানী আড়ম্বরপূর্ণ দিল্লি নগরী তার প্রয়োজনাতিরিক্ত জাঁকজমকময় প্রাসাদগুলি নিঃসম্বল কৃষকদের শোষিত অর্থে নির্মিত। দুইটি শাসন পরিষদ, রাজন্য পরিষদ মন্ত্রীবৃন্দ ও সেক্রেটারী গোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও শাসন সংস্কার ও নিয়মতান্ত্রিক সুবিধা সত্ত্বেও ভারত সরকারের ভিত্তি ১৮৫৭ সনের মহাবিদ্রোহের পরে ১৮৫৮ সালে যাহা স্থাপন করা হইয়াছিল ঠিক সেই অবস্থায়ই আছে..সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে এই ছাপার অক্ষরগুলি মাঝে মাঝে ঝাপসা হয়ে যায়, অথবা যেন খুব দীর্ঘ হয়ে তাড়া করে মারতে আসে; বা বিশাল যুদ্ধক্ষেত্রে এক ঝাঁক সৈন্য, চমৎকার এক-একটি বলির পাঠা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অথবা এও মন হয়, এক বিশাল মরুভূমি, তার মাঝখানে পাঠশালার মতো সরু জোড়া জোড়া ঠ্যাং-এ ভর করে বড়ো মাথাওয়ালা একদল লোক, বালির ভিতর মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে।
এরা কে! সুকুমার একটু নড়ে চড়ে বসে চোখ ঘষতে লাগল। এখন শেষ রাতে বেশ ঠাণ্ডা লাগছে, একটু পরেই ভোর হবে। দূরে হঠাৎ অনেকগুলি কুকুরের। মিলিত চিৎকারধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়, শেষ রাতে পুলিশকে টহল দিতে দেখে তারা নিত্যকার মতোই বিদ্রোহ জানাচ্ছে। ভোলাও সেই শুনে বক্সে থেকে নেমে একবার বারান্দার এপাশে আর ওপাশে ঘুরে আবার স্বস্থানে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ওদিকে কলের জল পড়তে শুরু করেছে। প্রকান্ড চৌবাচ্চায় গপ গপ শব্দ হচ্ছে। ওটা যেন পড়বার জন্যেই প্রস্তুত থাকে এবং চিরকালই পড়তে থাকবে এইভাবে।