এই শুনে সকলেই হেসে উঠল। সুরেনের গলাটাই শোনা যায় সবচেয়ে বেশি। সে আস্তে কথা বলতে পারে না। যত বাজে বা হাস্যকর কথাই হোক সকলের
দৃষ্টি আকর্ষণ করে তবে সে কথা বলবে। জামার বোতাম তার কোনো কালেই থাকে না। তবু বোতাম লাগানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে সে বললে, কী বোঝেন, বলুন, আমরা সবাই শুনি।
মা তার দিকে একদৃষ্টে চাইল, এই মধুর স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় মুখের কাঠিন্য চেষ্টা করল দূর করতে, কিন্তু চেষ্টা করেও যেন পারল না।
সুকুমার বললে, বুঝবে না। আপনারা পাভেলকে জানেন?
–পাভেল?
—সে কী, গোর্কির মা পড়েননি?
—হুঁ, পড়েছি, পড়েছি।
–ইনিও সেই পাভেলের মা, সেই মা! সুকুমার মা-র দিকে চেয়ে হাসতে লাগল। এর কয়েকদিন পরেই সন্ধ্যায় লক্ষ্মীর প্রদীপ জ্বালিয়ে অনেকদিন পরে মা একখানা বই খুলে বসল। বইটা পড়ে তার এত ভালো লেগে গেল যে ওদিকে যে নটা বেজে গেছে, সেদিকে তার এতটুকু খেয়াল নেই। এক সময় কুকুরটার কলরবে বই-এর প্রতি তার মনোযোগ কিছুক্ষণের জন্যে ভেঙে ছিল বটে, কিন্তু একটু পরেই আবার সে পড়তে আরম্ভ করে দিয়েছিল। ভাবল, ছেলের আসতে এখনও দেরি, রাত এগারোটার আগে সে কখনো আসে না। কিন্তু সেদিন সুকুমার হঠাৎ এসে পড়ল। দরজা খোলা পেয়ে এত চুপি চুপি সে আসতে পেরেছিল যে, ভোলা একবার আনন্দে ঘেউ ঘেউ করে উঠলেও বইটি তাড়াতাড়ি লুকোনোর অবসর মা পায়নি।
তার হাতে বই দেখে সুকুমার বিস্মিত। জামা-কাপড় খুলতে খুলতে সে বললে, ও কী বই পড়ছে, মা! ভ্রূ কুঁচকে দাঁতে দাঁত চেপে—কিন্তু বোকার মতো একবার হেসে মা বললে, কেন, তোরা পড়িস আমরা পড়তে পারিনে? আমাদের পড়ায় দোষ আছে নাকি?
বই-এর মলাট দেখেই সুকুমার চিনতে পেরেছে।
ভয়ানক খুশি হয়ে সে বললে, তুমিও এই বই পড়ছো, মা? দোষ আছে কে বললে? কিছু দোষ নেই। তুমি সত্যি সত্যি পাভেলের মা হতে পারবে। আমি অবশ্যি পাভেলের মতো হতে এখনও পারিনি। তবে হব।–
সুকুমার মাটির ওপর শুয়ে পড়ল, মার কোলে মাথা রেখে বললে, মাথায় একটু হাত দাও না, মা? পিঠেও একটু হাত বুলিয়ে দেবে?
—বারে আমি পড়ব না বুঝি?
সুকুমার আশ্চর্য হয়ে গেল, এমন সহজ চাপল্য-ভরা কথা সে অনেকদিন শোনেনি।
কিন্তু ছেলের মুখের দিকে চেয়ে পরক্ষণেই মা-র মুখ কঠিন হয়ে এসেছে, মনে হল যেন একটা ভয়ানক অপরাধ করে ফেলেছে সে, দোষের চারপাশের চামড় তার কুঞ্চিত হয়ে গেল, তীক্ষ্ণ নাক আরও তীক্ষ্ণ হয়ে এল, বইটে পাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে সে ভারী গলায় বললে, দাঁড়া, দিচ্ছি।
মা এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু গভীর নয়—গভীর ঘুম তার কখনো হয় না–তন্দ্রার মতো খানিকটা। তার গলার খর খর শব্দ বেশ শোনা যায়, হয়ত এখুনি উঠে কাশতে বসবে। চোখের জল এখনও শুকোয়নি।
ওদিকের বারান্দায় একটি কেরোসিন কাঠের বাক্সের ওপরে পড়ে ভোলা ঘুমুচ্ছে। কোথায় একটু খর খর শব্দ শুনে একবার চোখ মেলে চাইল।, বাক্স থেকে নেমে এদিক-ওদিক একটু হাঁটাহাঁটি করল, তারপর বাক্সের ওপর উঠে আবার শুয়ে পড়ল। বারান্দায় ওদিকটায় শুয়ে-শুয়ে সেখানে কেমন গন্ধের সৃষ্টি করেছে
তার এই বাসায় স্থানলাভের ইতিহাসটা কিছু বিচিত্র। তখন একদল বিদেশি সৈন্য শহরের প্রান্তে আস্তানা গাড়ছে। তাদের সঙ্গে জিনিসপত্রের অন্ত নেই। নদীর পার থেকে খচ্চরের গাড়িতে বোঝাই হয়ে সেগুলি যথাস্থানে যাচ্ছিল!—
সৈন্যগুলি খুব লম্বা আর খুবই জোয়ান, পায়ে লোহার মতো বুটের জুতো, গায়ে খাকি শার্ট, গলার আওয়াজ মরচে-পড়া লোহার মতো কর্কশ, তাদের কথাগুলিকে মনে হয় যেন ইস্পাতে ইস্পাতে ঠোকাঠুকি করে মরছে। তাদের দেখে রাস্তার পাশে লোক জমে গেল, মাথার ওপরে আগুনের মত রৌদ্রকেও উপেক্ষা করে তারা বিস্ময়ে তাদের কার্যকলাপ দেখতে লাগল। কোনো একটা কাজে এসে রাস্তা বন্ধ দেখে সুকুমারও সেই জনতার ভিতর দাঁড়িয়েছিল। তখন খচ্চরের গাড়িগুলি বিপুল ঝন ঝন শব্দ করে রাস্তা দিয়ে চলছে, প্রত্যেকটি গাড়ির সামনে আর। পেছনে কিছু কিছু সৈন্য। এমন সময়ে হঠাৎ একাট কাতর কুঁই কুঁই শব্দে সকলে বিস্ময়ে চেয়ে দেখল, ছোট বাদামি রঙের একটা কুকুর-তার গলাটি গাড়ির ওপরে ভারী কলের সঙ্গে একটা সরু দড়ি দিয়ে বাঁধা—খচ্চরের পায়ের তলায় কয়েকবার এদিক-ওদিক হয়ে রাস্তার এই পাশে ঠিকরে পড়ে কাৎরাচ্ছে। ব্যাপার দেখে রাস্তার দুইপাশের লোকগুলির চোখ আতঙ্কে বড়ো হয়ে গেল, সকলেই একসঙ্গে ইস শব্দ করে দুঃখ প্রকাশ করল, তারা অনুমান করল যে, কুকুরটা নিশ্চয় গাড়ির নীচে চাপা পড়েছে। একটু পরেই কাতরাতে কাতরাতে মারা যাবে।
কিন্তু কুকুরটা নেহাতই নাছোড়বান্দা, তার মরবার সম্ভাবনা যদিও সম্পূর্ণই ছিল, তবু সে মরল না। গাড়িটা তখন চলছিল। সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটাও হেঁচড়াচ্ছে।
এমন সময় একটা সৈন্য এসে দড়িটা ছিড়ে তাকে পাশে ফেলে দিল। সুকুমার দৌড়ে গিয়ে তাকে কোলে করে নিয়ে এল। দুপুরের রৌদ্র আগুনের মতো গায়ে বিধছিল, জনতার চাপে গরম আরও বেশি, সৈন্যগুলির উৎকট ঘামের গন্ধে চারিদিকের বাতাস ভরপুর। সুকুমারের বুকের কাছে মুখ রেখে বাচ্চা কুকুরটা চিঁ চিঁ করে কাঁদতে লাগল। রাশি রাশি লোমের উষ্ণতা সুকুমারের গায়ে লাগছে।