সুকুমার হেসে ফেলল, হাসতে হাসতে ভোলাকে লক্ষ করে বললে, যা, এখান থেকে, দুর হয়ে যা, পাজী কুকুর কোথাকার—আমাদের জাত ধর্ম খুইয়ে ছাড়বি দেখছি!
একটু একটু করে খানিকটা এগিয়ে পেছিয়ে গিয়ে ভোলা এখন অন্ধকারে শুয়ে পড়ল! অনেক আগেই তার খাওয়া হয়ে গিয়েছে। ওপরের ঘরের মাতাল দীননাথ চক্রবর্তীর মেয়ে বীণা কয়েকদিন ধরে তাকে রোজ খাইয়ে দেয়। কিন্তু এ ইতিহাসের বিন্দুবিসর্গও সুকুমার জানে না।
খাওয়া-দাওয়া পরে সুকুমার একটা বই খুলে বসল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সারাদিনের পরিশ্রমে চোখ তার জড়িয়ে এল। বইটা পাশে সরিয়ে রেখে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
মা এবার ছেলের পাশে বসল। ছেলের নিদ্রিত মুখের দিকে চেয়ে চোখের দৃষ্টি তার অদ্ভুত নরম হয়ে এসেছে।
সে তার দেহে গভীর স্নেহে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। তার নিজের ফ্যাকাসে বর্ণহীন চোখেও একরাশ অশ্রু জমা হয়েছে, একটু পরেই বাঁধ ভেঙে হয়তো বইতে থাকবে।
ওদিকে ওপরের ঘরে বসেও দুই করুণ চোখে যে মেয়েটি রাত জাগছে সে। বীণা। কার জন্যে এই রাত জাগা? অন্তত তার বাবার জন্যে যে নয়, এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া চলে। দীননাথ ঘোর মাতাল, বুড়ো হবার আগেই গোরুর মতো শান্ত বউটাকে লাথি-গুঁতো মেরে যমের বাড়ি পাঠিয়েছে। এখন বউর অভাবে বাইরে রাত কাটিয়ে আসে। সুতরাং, দীননাথ চক্রবর্তীর একমাত্র মেয়ে বীণা তার অপেক্ষায় যে রাত জাগে না, এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া চলে।
কিন্তু এতক্ষণে সে আলোটা নিভিয়ে দিল।
সুকুমারের ঘরের ওপর নিবদ্ধ দৃষ্টিকে এতক্ষণে সে অন্ধকারে ঠেলে দিল একটা কুকুরের মতো কুঁকড়ে শুয়ে অনেক আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল।
এখন সমস্ত বাড়িটাই বিদেশে প্রথম আসা কোনো মূঢ় বালকের মতো স্তব্ধ। অন্যান্য ভাড়াটেদের তো অর্ধেক রাতের ঘুম হয়ে গিয়েছে। তারা সারাদিন একমুষ্ঠি অপ্রচুর অন্নের জন্যে দেহের রক্ত জল করে বাড়ি ফেরে, তারপর সন্ধ্যার পরেই খেয়ে দেয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়, সবগুলি ছেলেমেয়েকে ঘুমিয়ে পড়তে দেয়ার অবসরও তাদের নেই, তার আগেই তাদের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে। তারপর সেদিন যা একটা কান্ড ঘটল, তা যেমন হাস্যকর, তেমনি করুণ। সকলের শেষে কলতলার দক্ষিণ দিকের ঘরটিতে থাকে নকুল, সে কোনো এক বইয়ের দোকানে কাজ করে। তার শরীরটা এত মোটা, ভারী আর লম্বা যে হঠাৎ দেখলে কোনো কাল্পনিক দৈত্যের কথা মনে হয়। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। কিন্তু ঘরে একপাল ছেলেমেয়ে, তার বউ চিরটাকাল কেবল ছেলেমেয়ে প্রসব করে, তারপর একদিন হঠাৎ বলা-নেই-কওয়া-নেই মরে গেল। নকুল তখন আর কি করবে? সে তখন আর এক দরজা দিয়ে কোনো এক গাঁয়ে মেয়ে দেখতে চলে গেল। যখন ফিরে এল, তখন তার গায়ে সিল্কের জামা পরনে নকশি পাড়ের ধুতি, পয়ে চকচকে পাম্পসু, মুখে সিগারেট আর একরাশ পান, আর তার পেছনে দুই হাত লম্বা একটি বউ, তার আড়াই হাত ঘোমটা। কাপড়টুকু ভালো করে পরতে জানে না, কোমরের নীচে দেহের প্রস্থটুকু কাঠির মতো সরু। সেদিন রাত্রে এই বউটিই হঠাৎ ভীষণ চীৎকার করে কেঁদে উঠল, তারপর বাকি রাতটুকুও শূকরের মতো চি-চি করে কেঁদেছিল। বাস্তবিক এমন কান্ড কমই দেখা যায়। তখন এই গল্প নিয়ে বাড়ির অন্যান্য বন্ধু আর মেয়েদের ভিতরও একটা খোরাক জুটেছিল মন্দ নয়, তারা এই নিয়ে অনেক বলাবলি অনেক ফিসফাস করছে।
দূরে গির্জার দড়িতে একটা বেজে ফেল। দীননাথ এখনও ফেরেনি। বীণা আকাশ পাতাল অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে সুকুমারও গভীর ঘুমে অচেতন কিন্তু মা-র ঘুম কখনো গভীর হয় না। সে কেবল শুয়ে থাকে মাত্র। মাঝে মাঝে জেগে কাশতে থাকে। এই মাত্র সে কেঁদে একটু চোখ বুজেছে, এখনও কান্নার ছাপে অপরিচ্ছন্ন আর বিকৃত তার মুখ। সুকুমার তাকে আর কত কাঁদাবে?
সুকুমারের কাছে কত লোক যায় আসে তার ইয়ত্তা নেই। সারাদিন ডাকাডাকি লেগেই আছে। সর্বদা যারা আসে তাদের গ্লাস-ওয়ার্কসের সামসুর একজন। তার চোখ আর চুল—দুই-ই কটা, চোখে-মুখে সর্বদাই একটা খুশি ঝরে পড়ে। এই সামসুর ছাড়া আরও অনেকেই আসে। তাদের কারোর বয়স চোদ্দো, কারোর বয়স চল্লিশ; যার বয়স চোদ্দো, তার নাম অনিল। এদের নিয়ে মাঝে-মাঝেই জটলা করে সুকুমার, সকলে মিলে রুদ্ধ ঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়। রাশিয়া, লেলিন ইত্যাদি দুই-একটি পরিচিত কথা ছাড়া মা এদের কথা কিছুই বুঝতে পারে না।
একদিন একটা ব্যাপার ঘটল চমৎকার। সুকুমার হঠাৎ সামসুরকে লক্ষ করে বললে, একা-একা বিড়ি খাচ্ছেন! দিন একটা? সামসুর অমনি মেঝের ওপর একটা বিড়ি ফেলে দিল। এবং সেই বিড়িটা জ্বালিয়ে সুকুমারের কী সহজ স্বচ্ছন্দ টান।
ব্যাপার দেখে মা-র দুই চক্ষু স্থির। আর কখনো সে তাকে বিড়ি বা সিগারেট টানতে দেখেনি। তার চোখের দৃষ্টি তীব্র হয়ে এল।
হা-হা করে হেসে সুকুমার বললে, দেখুন মা কেমন রেগেছে! …সুকুমার তার হলদে দাঁতগুলি বের করে হাসল।
সুরেন মুখ বাড়িয়ে বললে, আমাদের দোষ নেই, মা! মা দাঁতে দাঁত চেপে বললে, উঁহুঁ তোমাদের কিছু দোষ নেই, তোমরা সব শান্ত সুবোধ বালক! তারপর সুকুমারের দিকে লক্ষ করে তোরা মনে করিস আমি কিছুই বুঝিনে। কিন্তু আমি সব বুঝি, সব বুঝি!