-একটু শান্ত হয়ে ইয়াসিন শেষে একটা গল্প বলল।
গল্পটি হচ্ছে এই : সে এবার বাড়ি গিয়ে তার গাঁয়ের চাষিদের একটা বৈঠকে যোগ দিয়েছিল। সেই বৈঠকে যে লোকটা বক্তৃতা করছিল সে হঠাৎ তার দিকে চেয়ে বললে, ভাই ইয়াসিন, তোমাদের ওখানে ইউনিয়ন নেই? ইয়াসিন বুক ঠুকে বললে, আলবৎ আছে! এবং সঙ্গে সঙ্গে বুক পকেট থেকে একখানা রসিদ বের করে দিল লোকটি তখন ভয়ানক খুশি হয়ে বলেছিল, তুমি যে আমাদের কমরেড, ভাই ইয়াসিন! তুমি যে আমাদেরই, ইয়াসিন তখন বিচক্ষণের মতো হেসেছিল। —দুনিয়ার সবাই এরকম জোট হচ্ছে, আর আমরাই কেবল চুপ করে বসে থাকব না? চারটে পয়সা দিলেই খালাস, না? বলতে বলতে ইয়াসিনের ঘর্মাক্ত মুখ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই আবার সে কাজে লেগে গেল গম্ভীর মনোযোগের সঙ্গে ঠকঠক শব্দ করে তার কাজ করতে লাগল।
আমি ফিরে এলাম। সাম্যবাদের গর্ব, তার ইস্পাতের মতো আশা, তার সোনার মতো ফসল বুকে করে ফিরে এলাম। এখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ঝির ঝিরে বাতাসের সঙ্গে শেডঘর থেকে তেল আর কাঁচা কয়লার ধোঁয়ার গন্ধ আসছে বেশ। আমি বাঁ-দিকে শেড-ঘর রেখে পথ অতিক্রম করতে লাগলাম। একটু এগিয়ে দেখি লাইনের ওপর অনেকগুলি ইঞ্জিন দাঁড়িয়ে আছে মনে হয় গভীর ধ্যানে বসেছে যেন। আমার কাছে ওদের মানুষের মতো প্রাণময় মনে হল, এখন বিশ্রাম করতে বসেছে। ওদের গায়ের মধ্যে কত রকমের হাড়, কতো কলকবজা, মাথার ওপর ওই একটিমাত্র চোখ, কিন্তু কতো উজ্জ্বল। মানুষ ওদের সৃষ্টিকর্তা। হাসি নেই, কান্না নেই, কেবল কর্মীর মতো রাগ। এমন বিরাট কর্মী পুরুষ আর আছে। সত্য কথা বলতে কী, এত কলকবজার মাঝে, এতগুলি ইঞ্জিনের ভিতর দিয়ে পথ চলতে চলতে আমার শরীরে কেমন একটা রোমাঞ্চ হল। আমি হতভম্ব হয়ে তাদের মাংসহীন শরীরের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলাম।
তারপর সন্ধ্যার অনুকূলে বাসায় ফিরলাম। কয়েকদিন পরে কোনো গভীর প্রত্যুষে একটি ইঁদুর মারা কল হাতে করে আমার বাবা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বোকার মতো হাসতে লাগলেন। দারুণ খুশিতে নারু আর মন্টুও দুই আঙুল ধরে বানরের মতো লাফাচ্ছিল। কয়েক মিনিট পরেই আরও অনেক ছেলেপেলে এসে জুটল।
একটা কুকুর দাঁড়াল এসে পাশে। উপস্থিত ছেলেদের মধ্যে যারা সাহসী তারা কেউ লাঠি, কেউ বড়ো-বড়ো ইট নিয়ে বসল রাস্তার ধারে।
ব্যাপার কিছুই নয়, কয়েকটা ইঁদুর ধরা পড়েছে।
একটি রাত
রাস্তায় লোকজন একটিও নেই। এখন আশ্বিনের শেষ, তাই একটু শীতের আমেজ লাগে। সুকুমার তার জামার কলারটি আরও টেনে ধরল। নিতান্ত অন্যমনস্ক হয়েও সে শুনতে পেল, একটা বিড়াল মিউ মিউ করে কাতরস্বরে ডাকছে, হয়তো হঠাৎ কোনো খোলা ড্রেনে পড়ে স্নান করে উঠেছে। তা ছাড়া ড্রেনের গন্ধও নাকে আসে। রাত্রির নিস্তব্ধতা দিনের বেলার চেয়েও তীব্র। দূরে একটা কেরোসিনের ল্যাম্প টিমটিম করে জ্বলছে। পাশেই একটা দীর্ঘ অস্পষ্ট ছায়া।
সে পুরোনো বাড়িটার একটা ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে সুকুমার থাকে, সামনেই তার মস্ত বড়ো গেট, প্রায় অর্ধেকটা ভাঙা। সর্বাঙ্গ লোনায় ধরেছে। বাড়ি ঢুকতে গিয়ে সুকুমার দেখল, লম্বা একটা লোক হঠাৎ কোথায় সাপের মতো সরে পড়ল। লোকটা কে সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। এদের ছায়া দেখলেও চিনতে কষ্ট হয় না। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে সুকুমার বাড়ি ঢুকে পড়ল। ভিতরে মার কাশির শব্দ শোনা যায়, সেই কাশি। সুকুমার ডাকলো, মা? মার বদলে ভোলা এসে হাজির হল।
ভোলা সুকুমারের কুকুর।
কিন্তু একটা সামান্য কুকুরের আগেও ছেলের ডাক না শোনার এই অক্ষমতায় লজ্জিত হয়ে মা চেঁচিয়ে উঠল—যা এখান থেকে, কেবল পায়ে পায়ে হাটে। কতবার বলি, আমার বাপু এসব ঘেন্না করে, তবু। মা আর বলতে পারল না, দরজা খুলে দিয়ে যেন নিষ্কৃতি পেল। তার চুলগুলি কাকের বাসার মতো উস্কখুস্ক, মুখে একটা অসাধারণ কাঠিন্যের ছাপ, চোখে একটা অদ্ভুত কাতরতা। ভ্রূ কুঁচকে সে কুকুরটার কান্ড দেখল। সুকুমারের বুকে সে শিশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তার সমস্ত শরীরটাকে ফোঁস ফোঁস শব্দ করে শুকছে। সুকুমার বললে, আরে, দাঁড়া, দাঁড়া, আগে ঘরে ঢুকতে দে।
ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে মা আলো হাতে সটান ঘরের দিকে গেল। ভিতরে এই গলির ঠাণ্ডা আর ভারী, চারিদিকে কেমন একটা পচা আবর্জনার গন্ধ।
ঘরে ঢুকে জামা-কাপড় ছেড়ে সুকুমার তক্তপোষের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। ভোলাও তার বুকের ওপর মুখ রেখে গা চাটবার চেষ্টা করল। তার কান দুটি নিয়ে খেলা করতে করতে সুকুমার হঠাৎ বললে, এবেলা কী বেঁধেছো মা? কোনো উত্তর নেই। বোঝা যায়, বাইরে অন্ধকারে কোথাও সে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে।
সুকুমার আবার ডাকল, মা?
কিছুক্ষণ পরে ভারী অস্পষ্ট গলায় উত্তর এল, তুই এখন খাবিনে সুকু? দেখল, অন্ধকারে দেয়ালে হেলান দিয়ে নীরবে সে দাঁড়িয়ে আছে। সুকুমার বললে, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কেন মা? বাইরে যে হিম পড়ছে।
-কোথায় হিম! ব্যঙ্গের সুরে সে বললে, যা গরম পড়েছে!
এই বলে পরক্ষণেই আবার অন্ধকূপের মতো রান্নাঘরে ঢুকে ভাত বেড়ে ডাকল, খেতে আয়।
সুকুমারের পেছনে পেছনে ভোলাও ঢুকছিল। এবার চুপ করে থাকা যায় না। মা চীৎকার করে উঠল : ঢের হয়েছে বাপু, শোবার ঘর এমন কী বিছানা পর্যন্ত তো হয়েছে, এখন খাবার ঘরটা থাক!