বাবার পরবর্তী অভিযান হল রানাঘরে। একখানা সিঁড়ি পেতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে হাসিমুখে বাবা বললেন,—আজ কী রাঁধবে গো?
মুখ ফিরিয়ে অজস্র হেসে মা বললেন, তুমি যা বলবে? বাবাকে এবার ছেলেমানুষিতে পেয়ে বসল—আমি যা বলব, ঠিক তো? বলি, রাঁধবে মাংস, পোলাও, দই সন্দেশ? রাঁধবে চাটনি, চচ্চড়ি, রুই মাছের মুড়ো? রাঁধবে? রাঁধবে আরও আমি যা বলব?
—ওমা গো, থাক থাক, আর বলতে হবে না। মা দুই হাত তুলে মাথা নাড়তে লাগলেন, খিলখিল করে হেসে উঠলেন। ব্যাপার দেখে নারু দৌড়ে গেল, দুজনের দিকে দুইবার চেয়ে তারপর মাকে মুচকে হাসতে দেখে বললে, মাগো কী হয়েছে? অমন করে হাসছো কেন? বাবা তোমায় কাতুকুতু দিয়েছে?
-আরে, নারে না, অত পাকামি করতে হবে না। খেলগে যা—
বাঁ হাত তুলে মা বাইরের দিকে দেখিয়ে দিলেন।
একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে বাবা আবার বললেন, আচ্ছা তোমাকে যেদিন প্রথম দেখতে গিয়েছিলাম সেদিনের কথা মনে পড়ে?
একটু চিন্তা না করে মা বললেন, আমার ওসব মনে-টনে নেই?
-আহা, বিলের ধারে মাঠে সেই যে গোরু চরাচ্ছিলে?
মার চোখ বড়ো হয়ে গেল—ওমা, আমি কী ভদ্দরলোক নই গো যে মেয়েলোক হয়েও মাঠে-মাঠে গোরু চরাব?
—গোরু চরানোটা কী অপরাধ? দরকার হলে এখানে সেখানে একটু নেড়েচেড়ে দিলে দোষ হয়? আসল কথা তোমার সবই মনে আছে, ইচ্ছা করেই কেবল যা-তা বলছ?
-হ্যাঁ গো হ্যাঁ, সব মনে আছে, সব মনে আছে।
মৃদু মৃদু হেসে বাবা বললেন, নৌকা থেকেই দেখতে পেলাম বিলের ধারে কে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকার রাত্রে একটি মাত্র দীপশিখার মতো; নৌকো থেকে নেমেও দেখলাম, সেই মেয়ে তার জায়গা থেকে এতটুকুও সরে দাড়াচ্ছে না বা পাখির মতো বাড়ির দিকে উড়ে চলে যাচ্ছে না, বরং আমাদের দিকে সোজাসুজি চেয়ে আছে, অপরিচতি বলে এতটুকু লজ্জা সেই, কাছে গিয়ে দেখলাম ঠিক যেন দেবী প্রতিমা, খোলা মাঠে জলের ধারে মানিয়েছে বেশ। গভীর বর্ষায় আরও মানাবে। তারপর এক ভাঙা চেয়ারে বসে ভাঙা পাখার বাতাস খেয়ে যাকে দেখলাম সে-ও সেই একই মেয়ে। কিন্তু এবার বোবা, লজ্জাবতী লতার মতো লজ্জায় একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
বাবা হা-হা করে প্রাণ খুলে হাসতে লাগলেন। কততক্ষণ পরে বললেন, তোমার কী চাই–বললে না?
আমার জন্য একখানা রান্নার কাপড় এনো।
–লাল রঙের?
–হ্যাঁ।
তারপর কার জন্যে কী এনেছিলেন খবর রাখিনি, কিন্তু নিজের জন্যে ছ-আনা দামের এক জোড়া চটি এনেছিলেন দেখেছি। মাত্র ছ-আনা দাম। বাবা এ নিয়ে অনেক গর্ব করেছেন, কিন্তু একেবারে কাঁচা চামড়া বলে কুকুরের আশঙ্কাও করছেন।
কুকুরের কথা জানিনে, তবে কয়েকদিন পরেই জুতো জোড়ার এক পাটি কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল কেউ বলতে পারে না। আশ্চর্য!
পরদিন দুপুরবেলা রেলওয়ে ইয়ার্ডের ওপর দিয়ে যেতে যেতে কার ডাকে মুখ। ফিরে তাকালাম। দেখি। শশধর ড্রাইভার, হাত তুলে আমার ডাকছে। এখানে ইউনিয়ন করতে এসে আমার একেবারে প্রথম আলাপ হয়েছিল এই শশধর ড্রাইভারের সঙ্গে। সেদিন সঙ্গে কমরেড বিশ্বনাথ ছিল। তখন গভীরভাবে শশধর বলেছিল, দেখুন বিশ্ববাবু, সায়েব সেদিন আমায় ডেকেছিল।
-কেন?
-শালা বলে কি না, ড্রাইভার, ইউনিয়ন ছেড়ে দাও। নইলে মুস্কিল হবে। বলছি। শুনে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। মুখের ওপর বলে এলাম, সায়েব আমার ইচ্ছে আমি ইউনিয়ন করব। তুমি যা করতে পারো করো। এই বলে তখুনি ঠিক এইভাবে চলে এলাম। আসবার ভঙ্গিটা দেখবার জন্যে শশধর হেঁটে অনেকদূর পর্যন্ত গেল। তারপর আবার যথাস্থানে ফিরে এল।
আমার প্রথম অভিজ্ঞতায় সেদিনের দৃশ্যটি আমার চমৎকার লেগেছিল। আমার এই মধ্যাহ্নের ট্রাকটর-স্বপ্নের ভিত পাকা করতে আরম্ভ করলাম সেদিন থেকে। একদা বলাই বাহুল্য যে ইতিহাস যেমন আমাদের দিক নেয়, আমিও ইতিহাসের দিক নিলাম। আমি হাত প্রসারিত করে দিলাম জনতার দিকে, তাদের উষ্ণ অভিনন্দনে আমি ধন্য হলাম। তাদেরও ধন্যবাদ, যারা আমাকে আমার এই অসহায়তার বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে গেছে, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ। সেবাব্রত নয়, মানবতা নয়, স্বার্থপরতা অথচ শ্রেষ্ঠ উদারতা নিয়ে এক ক্লান্তিহীন বৈজ্ঞানিক অনুশীলন।
বিকেলের দিকে আমি শশধরের কাছে গেলাম। শশধর বললে, উঠুন।
সে আমাকে তার ইঞ্জিনে উঠিয়ে নিলে। তারপর একটা বিড়ি হাতে দিয়ে বললে, খান, সুকুমারবাবু।
বিকেলের দিকে একটা গ্যাঙের দিকে দেখা করতে গেলাম। একটা মিটিং অ্যারেঞ্জ করবার ছিল। ওরা আমার দিকে কেউ তাকাল কেউ তাকাল না। অদূরে ইঞ্জিনের ঝাঁ ঝাঁ সাঁ সাঁ শব্দ হচ্ছে। পয়েন্টসম্যান—গানারদের চিৎকার আর হুইসিল শোনা যাচ্ছে।
ইয়াসিন এতদিন পরে ছুটি থেকে ফিরেছে দেখলাম। আমাকে দেখে কাজিয়া থামিয়ে বললে, ওরা কী বলছিল জানেন?
হেসে বললাম, কী?
-বলছিল আপনি একটা ব্যারিষ্টার হলেন না কেন?
সকলে হো হো করে হেসে উঠল, আমিও হাসতে লাগলাম। মেট সুরেন্দ্র গম্ভীরভাবে বললে, তোমার কাছে আমাদের আর একটা নিবেদন আছে, ইয়াসিন মিঞা! আমরা সবাই মিলে চাঁদা তুলে তোমায় ইস্কুলে পড়াতে চাই!
এবারে হাসির পালা আরও জোরে। কাজ ফেলে সবাই বসে পড়ল।
ইয়াসিন রেগে গেল, বললে, বাঃ, বাঃ বাঃ খালি ঠাট্টা আর ঠাট্টা, না? চারটে পয়সা দিয়েই খালাস না? চারটে পয়সা দিলেই বিপ্লব হবে, না? বিপ্লব আকাশ থেকে পড়বে না?