অনেক রাত্রে বাবা গুনগুন স্বরে গান গাইতে লাগলেন। চমৎকার মিষ্টি গলা বেহালার মতো শোনা যাচ্ছে। সেই গানের খেলায় আলোর কণাগুলি আরও সাদা হয়ে গেছে, মনে হয় এক বিশাল অট্টালিকার সর্পিল সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে সেই গানের রেখা পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। শেষ রাত্রির বাতাস অপূর্ব স্নেহে মন্থর হয়ে এসেছে। একটা কাক রোজকার মতো ডেকে উঠেছে। বাবাকে গান গাইতে আরও শুনেছি বটে, কিন্তু আজকের মতো এমন মধুর ও গভীর আর কখনো শুনিনি। তাঁর মৃদু গানে আজ রাত্রির পৃথিবী যেন আমার কাছে নত হয়ে গেল। তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন কার প্রাণ খোলা হাসিতে ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠলাম। হাসির ঐশ্বর্যে বাড়ির ইটগুলি কাঁপছে।
বাবা বললেন, পন্ডিত মশাই, ও পন্ডিত মশাই, উঠুন? আর কত ঘুমুবেন সকালে না উঠলে বড়লোক হওয়া যায় কী? উঠুন?
আমি অনেক কষ্টে চোখমেলে চেয়ে দেখলাম কখন ভোর হয়ে গেছে! বাবার স্নেহময় কথায় আমি কখনো হাসিনে, কেমন, বাধে, যথেষ্ট বয়েস কি না, এককুড়ি বছর তো পেরিয়ে চললাম।
মশারির দড়ি খুলতে খুলতে বাবা বললেন, পৃথিবীতে যত গ্রেট মেন দেখতে পাচ্ছো, সকলের ভোরে ওঠবার অভ্যেস ছিল। আমার বাবা মানে তোমার ঠাকুরদারও এমনি অভ্যেস ছিল। আমরা যতো ভোরেই উঠি না কেন, উঠেই শুনতে পেতাম বাইরের ঘরে তামাক খাওয়ার শব্দ হচ্ছে। অমন অধ্যবসায়ী না হলে আর একটা জীবনে অত জমি-জমা অত টাকা পয়সা করে যেতে পারেন! তিনি তো সবই রেখে গিয়েছিলেন, আমরা কিছুই রাখতে পারলাম না। কিন্তু উঠুন পন্ডিত মশাই, যারা ঘুম থেকে দেরি করে ওঠে জীবনে তারা কখনো উন্নতি করতে পারে না।
অতটা মাতব্বরী সহ্য হয় না, জীবনে একদিন মাত্র সকালে উঠেই বাড়ি সুদ্ধ লোক মাথায় তুলছেন।
সমস্ত বাড়িটা খুসির বাজনায় মুখরিত হয়ে উঠল।
ওদিকে মন্টু সেলুনে চুল ছাঁটাবার জন্য পয়সা চাইতে শুরু করেছে, ঘণ্টাখানেক পরেও পয়সা না পেলে মেঝেতে আছাড় খেয়ে তারস্বরে কাঁদবে। নারু পৰু-পক্ক বাক্য বর্ষণ করে সকলের মনোরঞ্জন করবার চেষ্টায় আছে। ছবি এই মাত্র তার উপন্যাসের পৃষ্ঠায় নায়িকার শয়নঘরে নায়কের অভিযান দেখে মনে মনে পুলকিত হয়ে উঠেছে।
বাবা দারুণ কর্মব্যস্ত হয়ে উঠলেন, এঘর ওঘর পায়চারি করতে লাগলেন।
একসময় আমার কাছে এসে বললেন, তোমরা থিয়োরিটা বার করেছ ভালোই, কিন্তু কার্যকরী হবে না, আজকাল ওসব ভালোমানুষি আর চলবে না। এখন কাজ হল লাঠির। হিটলারের লাঠি, বুঝলে পন্ডিত মশাই?
আমি মনে মনে হাসলাম। বাবা যা বলেন তা এমনভাবে বলেন যে মন মনে বেশ আমোদ অনুভব করা যায়। তাঁর কী জানি কেন ধারণা হয়েছে, আমরা সব ভালোমানুষের দল। নিজের খেয়ে চিন্তা করি, শুষ্কমুখ হয়ে শীতল জল বিতরণ করতে চাই, নিজেরা স্বর্গচ্যুত, অথচ পরের স্বর্গলাভের পথ আবিষ্কারে মত্ত।
আবার বলেন : তোমাদের রাশিয়া কেবল সাধুরই জন্ম দিয়েছে, অসাধু দেয়নি! কেবল মার খেয়ে মরছে। লেনিন তো মস্ত বড়ো সাধু ছিলেন, যেমনি টলস্টয় ছিলেন। কিন্তু ওঁরা লাঠির সঙ্গে পারবেন কী? কখনো নয়।
বলতে ইচ্ছে হয় চমৎকার! এমন স্বকীয়তা, এমন নূতনত্ব আর কোথাও চোখে পড়েছে! এমন করে আমার বাবা ছাড়া আর কেউ বলতে পারেন না, এটা জোর করে বলতে পারি। তিনি একবার যা বললেন তা ভুল হলেও তা থেকে একচুল কেউ তাঁকে সরাবে, এমন বঙ্গ সন্তান ভূভারতে দেখিনে। এক হিটলারি দম্ভে তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
কিন্তু একমাত্র আশার কথা এই যে, এসব ব্যাপারে তিনি মোটেই সিরিয়াস নন, একবার যা বলেন দ্বিতীয়বার তা বলতে অনেক দেরি করেন। নইলে আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠত। পৈত্রিক অধিকারে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি তার অপব্যবহার করতেন সন্দেহ নেই।
ওদিকে কর্মব্যস্ত মাকে দেখতে পাচ্ছি। গভীর মনোযোগে তিনি তাঁর কাজ করে যাচ্ছেন, কোথাও এতটুকু দৃষ্টিপাত করবার সময় নেই যেন। কাঁধের ওপর দুই গাছি খড়ের মতো চুল এলিয়ে পড়েছে, তার ওপর দিয়েই ঘন ঘন ঘোমটা টেনে দিচ্ছেন, পরনে একখানা জীর্ণ মলিন কাপড়, ফর্সা পা-দুটি জলের অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত বিশীর্ণ হয়ে এসেছে। পেছনে পেছনে নারু ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি ছেড়ে বাবা এবার ঘরোয়া বৈঠকে যোগ দিলেন। নারুকে ডেকে বললেন, নারু, বাবা তোমার কী চাই বল?
নারু তার ছোটো ছোটো ভাঙা দাঁতগুলি বের করে অনায়াসে বলে ফেলল, একটা মোটরবাইক। সার্জেন্টরা কেমন সুন্দর ভট ভট করে ঘুরে বেড়ায়, না বাবা?
কিন্তু মন্টুর বুদ্ধিশুদ্ধি হয়েছ। সে হঠাৎ পিছন ফিরে মুখটা নীচের দিকে নিয়ে কামানের মতো হয়ে বললে, বাবা, এই দ্যাখো?
দেখতে পাওয়া গেল, তার পেছনটা ছিড়ে একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন, বললেন, বাঃ বেশ তো হয়েছে, মন্টুবাবুর যা গরম, এবার থেকে দুটি জানালা হয়ে গেল বেশ তো হল। এবার থেকে হু হু করে বাতাস আসবে আর যাবে, চমৎকার, না।
মন্টু সকল ত্রুটিবিচ্যুতি ভুলে বুদ্ধিমানের মতো হেসে উঠল; নারু তার ভাঙা দাঁত বের করে আরও বেশি করে হাসতে লাগল, বাবাও সে হাসিতে যোগ দিলেন। আমাদের সামান্য বাসা এক অসামান্য হাসিতে নেচে উঠলে, গুম গুম করতে লাগল।
হাসলাম না কেবল আমি। শুধু মনে মনে উপভোগ করলাম। ভাবলাম আনন্দের এই নির্মল মুহূর্তগুলি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে খুশির আর অন্ত থাকে না। মানুষ মানুষ হয়ে ওঠে।