ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার অজ্ঞতায় নিজের মনে যে কল্পনায় সৌধ গড়ে তুললাম তাতে নিজের মনে মনে প্রচুর পরিতৃপ্ত হলাম। যে উপবাসকৃশ বিধবারা তাদের সক্ষম মেয়েদের দৈহিক প্রতিষ্ঠায় সংসার যাত্রার পথ বেয়ে বেয়ে কোনোরকমে কালাতিপাত করছেন, তাদের জন্য করুণা যেমন হল, মনে মনে পুজো করতে লাগলাম আরও বেশি। কিন্তু সেসব ক্ষণিকের ব্যাপার! শরতের মেঘের মতো যেমনি এসেছিল তেমনি মিশে গেল। মগজের মধ্যে জায়গা যদিও একটু পেয়েছিল, বেশি দিন থাকবার ঠাঁই হল না। আজ ভাবছি আমাকে মুক্তি দিয়ে গেছে। নইলে এক অসম্পূর্ণ সংকীর্ণ পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় হয়ে থাকত, সে ভাবনা নিয়ে মনে মনে পরিতৃপ্ত থাকতাম বটে, কিন্তু গতির বিরুদ্ধে চলতাম। এক ভীষণ প্রতিক্রিয়ার বিষে জর্জরিত হতাম।
এমন দিনে এক অলস মধ্যাহ্নের সঙ্গে আমি সাংঘাতিক প্রেমে পড়েছিলাম। সেই দুপুরটিকে যা ভালো লেগেছিল কেবল মুখে বললে তা যথেষ্ট বলা হবে না। সেদিন যতটুকু আকাশকে দেখতে পেলাম তার নীলকে এত গভীর মনে হল যে চোখের ওপর কে যেন কিছু শীতল জলের প্রলেপ দিয়ে দিল। ভাবনার রাজ্যে পায়চারি করে আমি আমার মীমাংসার সীমান্তে এসে পৌঁছোলাম সেই মধ্যাহ্নে, সেখানে রাখলাম দৃঢ় প্রত্যয়। আকাশের নীলিমায় দুই চোখকে সিক্ত করে আমি দেখতে পেলাম চওড়া রাস্তার পাশে সারি-সারি প্রকান্ড দালান, তার প্রতিকক্ষে সুস্থ সবল মানুষের পদক্ষেপ। সিঁড়িতে নানারকম জুতোর আওয়াজ, মেয়ে পুরুষের মিলিত চীৎকার ধ্বনি পৃথিবীর পথে পথে বলিষ্ঠ দুয়ারে হানা দেয়, বলিষ্ঠ মানুষ প্রসব করে আমি দেখতে পেলাম ইলেকট্রিক আর টেলিগ্রাফ তারের অরণ্য, ট্রাকটর চলেছে মাঠের পর মাঠ পার হয়ে—অবাধ্য জমিকে ভেঙে চুরে দলে মুচড়ে, সোনার ফসল আনন্দের গান গায়, আর যন্ত্রের ঘর্ষণে ও মানুষের হর্ষধ্বনিতে এক অপূর্ব সংগীতের সৃষ্ট হল। একদা যে বাতাস মাটির মানুষের প্রতি উপহাস করে বিপুল অট্টহাসি হেসেছে, সেই বাতাসের হাত আজ করতালি দেয় গাছের পাতায় পাতায়। কেউ শুনতে পায় ?
যারা শোনে তাদের নমস্কার। তাই অলস মধ্যাহ্নকে মধুরতর মনে হল। দেখলাম এক নগ্নদেহ বালক রাস্তার মাঝখানে বসে একটা ইটের টুকরো নিয়ে গভীর মনোযোগে আঁক কষছে। কোন বাড়ি থেকে পচা মাছের রান্নার গন্ধ বেরিয়ছে বেশ, সঙ্গীত—পিপাসুর বেসুরো গলায় গান শোনা যাচ্ছে হারমোনিয়াম সহযোগে এই অসময়ে, রৌদ্র প্রচন্ড হলেও হাওয়া দিচ্ছে প্রচুর, ও বাড়ির এক বন্ধু রাস্তার কলে এইমাত্র স্নান করে নিজ বুকের তীক্ষ্ণতাকে প্রদর্শনের প্রচুর অবকাশ দিয়ে সংকুচিত দেহে বাড়ির ভিতর ঢুকল, দুটি মজুর কোনোরকমে খাওয়া দাওয়া সেরে কয়লামলিন বেশে আবার দৌড় দিচ্ছে। এ দৃশ্য বড়ো মধুর লেগেছে অবশ্য কোনো বুর্জোয়া চিত্রকল্পের চিরন্তনী চিত্র বলে নয়। এ চিত্র যেমন আরাম দেয়, তেমনি পীড়াও দেয়। আমার ভালো লেগেছে এই স্মরণীয় দিনটিতে এক বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির রাজত্বে খানিকটা পায়চারি করতে পেরেছি বলে। চমৎকার। চমৎকার! চমৎকার!
অনেক রাত্রে ইঁদুরের উৎপাত আবার শুরু হল। ওরা টিন আর কাঠের বাক্সে দাপাদাপি শুরু করে দিল, বীরদর্পে চোখের সামনে দিয়ে ঘরের মেঝে অতিক্রম করে দারুণ উপহাস করতে লাগল।
রান্না শেষ করে এসে মা সকলকে ডাকাডাকি শুরু করে দিলেন, ওরে মন্টু ওরে ছবি, ওরে নারু, ওঠ বাবা ওঠ!
মন্টু উঠেই প্রাণপণে চীৎকার আরম্ভ করে দিল। ছবি যদিও এতক্ষণ তার উপন্যাসের ওপর উপুড় হয়ে পড়েছিল, এখন বই টই ফেলে চোখ বুজে শুয়ে পড়ল। —ওরে ছবি, খেতে আয়, খাবি আয়!
বার বার ডাকেও ছবি টুঁ শব্দটি করে না।
মা ভগ্ন কণ্ঠে বললেন, আমার কী দোষ হল? আমার ওপর রাগ করিস কেন? গরিব হয়ে জন্মালে…
মার চোখ ছল ছল করে উঠল, গলা কেঁপে গেল, আমি রাগ করে বললাম, আহা, ও না খেলে না খাবে, তুমি ওদের দাও না?
মধ্যরাত্রির ইতিহাস আরও বিস্ময়কর।
এক অনুচ্চ কণ্ঠের শব্দে হঠাৎ জেগে উঠলাম। শুনতে পেলাম বাবা অতি নিম্নস্বরে ডাকছেন, কনক, ও কনক, ঘুমুচ্ছো?
বাবা মাকে ডাকছেন নাম ধরে। ভারী চমৎকার মনে হল। মনে মনে বাবাকে আমার বয়েস ফিরিয়ে দিলাম; আর আমার প্রতি ভালোবাসা কামনা করতে লাগলাম তাঁর কাছ থেকে। যুবক সুকুমার একদিন তার বউকেও এমনি নাম ধরে ডাকবে, চীৎকার করে ডেকে প্রত্যেকটি ঘর এমনি সঙ্গীতে প্রতিধ্বনিত করে তুলবে।
-কনক? ও কনক?
প্রৌঢ়া কনকলতা অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোনো উত্তর দিলেন না, কঁকিয়ে উঠলেন, কোনবার উঃ আঃ করলেন। আমি এদিকে রুদ্ধ নিঃশ্বাসে নিম্নগামী হলাম। বালিশের ভিতর মুখ গুঁজে হারিয়ে যাবার কামনা করতে লাগলাম। লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠলাম। শরীর দিয়ে ঘামের বন্যা ছুটল।
ওদিকে মধ্যরাত্রির চাঁদ উঠেছে আকাশে, পৃথিবীর গায়ে কে এক সাদা মসলিনের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে, সঙ্গে এনেছে জলের স্রোতের মতো বাতাস, আমার ঘরের সামনে ভিখিরি কুকুরদের সাময়িক নিদ্ৰাময়তায় এক শীতল নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। কিন্তু মাঝে মাঝে ও বাড়ির ছাদে নিদ্রাহীন বানরদের অস্পষ্ট গোঙানি শোনা যায়। মধ্যরাত্রের প্রহরী আমায় ঘুম পাড়িয়ে দেবে কখন?
অবশেষে প্রৌঢ়া কনকলতার নীরবতা, ভাঙল, তিনি আবার আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন, অল্প একটু ঘোমটা টেনে কাপড়ের প্রচুর দৈর্ঘ্য দিয়ে নিজেকে ভালোভাবে আচ্ছাদিত করলেন। তারপর এক অশিক্ষিতা নববধুর মতো ধীর পদক্ষেপে অগ্রসর হতে লাগলেন। অঙ্গ-ভঙ্গির সঞ্চালনে যে সঙ্গীতের সৃষ্টি হয়, সেই সঙ্গীতের আয়নায় আমার কাছে সমস্ত স্পষ্ট হয়ে উঠল। আমি লক্ষ করলাম দুই জোড়া পায়ের ভীরু অথচ স্পষ্ট আওয়াজ আস্তে বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।