—শয়তান মাগি, বেরিয়ে যা!
আবার ভেসে এল অদ্ভুত কথাগুলি। এসব আমি শুনতে চাইনে তবু শুনতে হয়। বাতাসের সঙ্গে খাতির করে তা ভেসে আসবে, জোর করে কানের ভিতর ঢুকবে, আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমার মনের মাটিতে সজোরে লাথি মারবে।
—যা বলছি!
গোলমাল আরও খানিকটা বেড়ে গেল।
কিছুপরে মা বাষ্পচ্ছন্ন স্বরে ডাকলেন, সুকু! সুকু!
ঠিক তখুনি উত্তর দিতে লজ্জা হল, ভয় করল, তবু আস্তে বললাম, বলো।
মা বললেন, দরজা খোল।
ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দিলাম, ভয় হল এই ভেবে যে, এবার অনেক বিচারের সম্মুখীন হতে হবে, যা শুনতেও ভয় পাই ঠিক তারই সামনে এক বিচারপতি হয়ে সমস্ত উত্তেজনাকে শূন্যে বিসর্জন দিয়ে রায় দিতে হবে।
কিন্তু যা ভেবেছিলাম তা আর হল না। মা ঘরের ভিতর ঢুকেই ঠাণ্ডা মেঝের ওপর আঁচলখানা পেতে শুয়ে পড়লেন। পাতলা পরিচ্ছন্ন শরীরখানি বেঁকে একখানা কাস্তের আকার ধারণ করল। কেমন অসহায় দেখাল ওঁকে, ছোটো বেলায় যাঁকে পৃথিবীর মতো বিশাল ভেবেছি, তাঁকে এমনভাবে দেখে এখন কত ক্ষীণজীবী ও অসহায় মনে হচ্ছে। যাকে বৃহত্তম ভেবেছি, সে এখন কত ক্ষুদ্র, সে এখনও শৈশব অতিক্রম করতে পারেনি বলে মনে হচ্ছে। আর আমি কতো বৃহৎ, রক্তের চঞ্চলতায়, মাংসপেশির দৃঢ়তায়, বিশ্বস্ত পদক্ষেপ কত উজ্জ্বল ও মহৎ, ওই হরিণের মতো ভীরু ছোটো দেহের রক্তপান করে একদিন জীবন গ্রহণ করলেও আজ আমি কতো শক্তিমান! আমাকে কেউ জানে? এমনও তো হতে পারত, আজ লণ্ডনের কোনো ইতিহাস বিখ্যাত ইউনিভার্সিটির করিডোরের বুকে বিশ বছরের যুবক সুকুমার গভীর চিন্তায় পায়চারি করছে, অথবা খেলার মাঠে প্রচুর নাম করে সকল সহপাঠিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, অথবা ত্রিশ বছরের নীলনয়না কোনো খাঁটি ইংরেজ মহিলার ধীর গভীর পদক্ষেপে ভীরুর মতো অনুসরণ করে একদিন তাঁর দেহের ছায়ায় বসে প্রেম যাঞ্চা করছে। এমন তো হতে পারত, তার সোনালি চুল, দীর্ঘ পক্ষ্মাবৃত চোখ দেহের সৌরভ—আহা, কে সেই ইংরেজ মহিলা? সে এখন কই..আর সেই স্বর্ণাভ রাজকুমার সুকুমারের মা ওই ঠাণ্ডা মেঝের ওপর কাপড় বিছিয়ে শুয়ে? এখান থেকে কতো ছোটো আর কতো অসহায় মনে হয়! এক অর্থহীন গর্বে বুকটা প্রশস্ততর করে আমি একবার মার দিকে তাকালাম।
ডাকলাম, মা? ও মা?
কোনো উত্তর নেই। গভীর নিস্তব্দতা ভঙ্গ করে কোনো ভগ্ন নারীকণ্ঠ আমার কানের দরজায় এসে আঘাত করল না। ঘুমিয়ে পড়েননি তো?
পরদিনও আবহাওয়ার গভীরতা কিছুমাত্র দূর হল না। মা-র এমন অস্বাভাবিক নীরবতা দেখে আমার ছোটো ভাই বোনেরা প্রচুর আস্কারা পেয়ে গেছে দেখতে পাচ্ছি। তারা নগ্ন গাত্র হয়ে যথেচ্ছ বিচরণ করতে লাগল। স্কুলহীন ছোটো বোনটি তার নিত্যকার অভ্যাসমত প্রেমকুসুমাস্তীর্ণ এক প্রকান্ড উপন্যাস নিয়ে বসেছে, অন্যদিকে চাইবারও সময় নেই।
সেদিন অনেক রাতে সারা বাড়ি গভীর ধোঁয়ায় ভেসে গেল, সকলের নাক-মুখ দিয়ে জল বেরুতে লাগলো, দম বন্ধ হয়ে এল। ছোটো ভাই বোনেদের খালি মাটিতে পড়ে ঘুমুতে দেখে রান্নাঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এখনও রান্না হয়নি, মা?
চোখের জলে ভিজে উনানের ভিতর প্রাণপণে ফু দিতে দিতে মা বললেন, না। এখন চড়াচ্ছি।
—এত দেরি হল কেন?
মা চুপ করে রইলেন।
বুঝতে পারলাম সেই পুরোনো কাসুন্দি। বুঝতে পারলাম এ জিনিস সহজে এড়াতে চাইলেও সহজে এড়াবার নয়, ঘুরে ফিরে চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় পাশ কাটাতে চাইলে হাত চেপে ধরে, কোনো রকমে এড়িয়ে গেলেও হাত তুলে ডাকতে থাকে। এই ডাকাডাকির ইতিহাসকে যদি আগাগোড়া লিপিবদ্ধ করি তবে সারাজীবন লিখেও শেষ করতে পারব না, তাতে কতগুলি একই রকমের চিত্র গলাগলি করে পাশাপাশি এসে দাঁড়াবে, আর সৌখিন পাঠকের বিরক্তিভাজন হবে। আমি তো জানি পাঠকশ্রেণিকে? তাঁদের মনোরঞ্জন করতে হলে কান্নাকাটির ন্যাকামি চলবে না, কিংবা কিছু লিখলেও টাকার হিসাবটাকে সযত্নে এড়িয়ে দিতে হবে বা হাসিমুখে বরণ করতে হবে। যেমন আমার বাবা অনেক সময় করেন প্রচুর অভাবের চিত্রকেও এক দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়ে পরম আনন্দে ঘাড় বেঁকিয়ে হাসতে থাকেন। কিংবা যেমন আমাদের পাড়ার প্রকান্ড গোঁফওয়ালা রক্ষিত মশায় করেন—ঘরে অতি শুকনো স্ত্রী আর একপাল ছেলেমেয়েদের অভুক্ত রেখেও পথে ঘাটে রাজা-উজির মেরে আসেন। বা যেমন আমাদের প্রেস কর্মচারী মদন, শূন্যতার দিনটাকে উপবাসের তিথি বলে গণ্য করে, কখনো পদ্মাসন করে বসে নির্মীলিত চোখে দুই শক্ত দীর্ঘ বাহু দিয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে ঈশ্বরকে সশরীরে ডেকে আনে। এমন নয়। এ ছাড়া আর উপায় কী? স্বর্গের পথ রুদ্ধ হলে মধ্যপথে এসে দাঁড়াই, জীবন আমাদের কুক্ষিগত করলেও জীবনকে প্রচুর অবহেলা করি, প্রকৃতির করাঘাতে ডাক্তারের বদনাম পাই, অথবা উধ্ববাহু সন্ন্যাসী হয়ে ঈশ্বরের আরাধনা করি। এসব দেখে আমি একদিন সিদ্ধান্ত করেছিলাম যে, দুঃখের সমুদ্রে যদি কেউ গলা পর্যন্ত ডুবে থাকে তবে তা এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। মধ্যবিত্তের নাম করতে গিয়ে যাদের জিহ্বায় জল আসে সেদিন আমি তাদেরই একজন হয়েছিলাম। বন্ধুকে এক ধোঁয়াটে রহস্যময় ভাষায় চিঠি লিখলাম। এরা কে জানো? এরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান বটে, কিন্তু না খেয়ে মরে। যে ফুল অনাদরে শুকিয়ে ঝরে পড়ে মাটিতে, এরা তাই। এরা তৈরি করছে বাগান, অথচ ফুলের শোভা দেখেনি! পেটের ভিতর উঁচ বিধছে প্রচুর, কিন্তু ভিক্ষা পাত্রও নয়। পরিহাস! পরিহাস!