দুধ যদি বিশেষ একটা খাদ্য হয়ে থাকে এবং তা যদি নিজেদের আর্থিক কারণে কখনো দুর্লভ হয়ে দাঁড়ায় এবং সেটা যদি অকস্মাৎ কোনো কারণে পাকস্থলীতে প্রেরণ করার অযোগ্য হয়, তবে অকস্মাৎ কেঁদে ফেলা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। মা অমনি কেঁদে ফেললেন, আর আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম. এমন একটা অবস্থায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায়ই নেই। যার ছেলেমানুষের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না আর বিনিয়ে বিনিয়ে কথা আমার চোখের দৃষ্টিপথকে অনেকদূর পর্যন্ত প্রসারিত করে দিল, আরও গভীর করে দিল, আরও গভীর করে তুলল। আমি দেখতে পেলাম আকাশে মধ্যাহ্নের সূর্য প্রচুর অগ্নিবর্ষণ করছে, নীচে পৃথিবীর ধূলিকণা আরও বেশি অগ্নিবর্ষী। আর হৃদয়ের খেতও পুড়ে পুড়ে থাক খাক হয়ে গেল। একটি নীল উপত্যকাও দেখা যায় না, দূরে জলের চিহ্ন মাত্র নেই, মরীচিকাও দিয়েছে ফাঁকি। ভাবলাম স্বামী বিবেকানন্দের অমূল্য গ্রন্থরাজি কোথায় পাওয়া যায়? শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশাবলি অমূল্য। সমগ্র মানব সমাজের কল্যাণব্রতী শ্ৰীঅরবিন্দ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ (তখনও ভাবতাম না দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ কখন শুরু হবে)! আমার মুখভঙ্গি চিন্তাকুল হয়ে এল, হাঁটু দুটি পেটের কাছ এনে কুকুরের মতো শুয়ে আমি ভাবতে লাগলাম—ঘরের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে নিয়েছি ভালো করে ভাবার জন্যে—ভাবতে লাগলাম, এমন কোনো উপায় নেই যাতে এই বিকৃতি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়?
সন্ধ্যার পর বাবা এলেন, খবরটা শুনে এমন ভাব দেখালেন না যাতে মনে হয় তিনি হতভম্ব হয়ে গেছেন অথবা কিছুমাত্র দুঃখিত হয়েছেন, বরং তাড়াতাড়ি বলতে আরম্ভ করলেন—যদিও তাড়াতাড়ি কথা বলাটা তাঁর অভ্যাস নয়, বেশ হয়েছে, ভালো হয়েছে। আমি আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলাম এমন একটা কিছু হবে। আরে মানুষের জান নিয়েই টানাটানি দুধ খেয়ে আর কী হবে বলো!
দেখতে পেলাম বাবার মুখটি যদিও শুকনো তবু প্রচুর ঘামে তৈলাক্ত দেখাচ্ছে, গায়ের ভারী জামাটিও ঘামে ভিজে ঘরের ভিতর গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে। এমন একটা বিপর্যয়ের পরেও তাঁর এই অবিকৃত ভাব দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম। এই ভেবে যে, ক্ষতি যা হয়েছে, হয়েছেই তার আলোচনায় এমন একটা অবস্থা যার কোনো পরিবর্তন নেই বরং একটা মস্ত গোলযোগের সূত্রপাত হবে, তা থেকে রেহাই পাওয়া গেল, খুব শীগগির আর আমার মানসিক অবনতি ঘটবে না।
কিন্তু বাবা কিছুক্ষণ পরেই সুর বদলালেন : তোমরা পেলে কী? কেবল ফুর্তি আর ফুর্তি! দয়া করে আমার দিকে একুট চাও। আমার শরীরটা কী আমি পাথর দিয়ে তৈরি করেছি। আমি কী মানুষ নই? আমি এত খেটে মরি আর তোমরা ওদিকে ফুর্তিতে মেতে আছ। সংসারের দিকে একবার চোখ খুলে চাও? নইলে টিকে থাকাই দায় হবে!
আমার কাছে বাবার এই ধরনের কথা মারাত্মক মনে হয়। তাঁর এই ধরনের কথার পেছনে অনেক রাগ ও অসহিষ্ণুতা সঞ্চিত হয়ে আছে বলে আমি মনে করি।
সময়ের পদক্ষেপের সঙ্গে স্বরের উত্তাপও বেড়ে যেতে লাগল। আমি শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই কঠিন উত্তপ্ত আবহাওয়ায় যে অদ্ভূত নগ্নতা প্রকাশ পাবে, তাতে আমার লজ্জার আর সীমা পরিসীমা থাকবে না। এমন অবস্থার সঙ্গে আমার একাধিকার পরিচয় হলেও আমার গায়ের চামড়া তাতে পুরু হয়ে যায় নি, বরং আশঙ্কার কারণ আরও যথেষ্ট পরিমাণে বেড়েছে। যে পৃথিবীর সঙ্গে আমার পরিচয় তার ব্যর্থতার মাঝখানে এই নগ্নতার দৃশ্য আরও একটি বেদনার কারণ ছাড়া আর কিছুই নয়। বাবা বললেন, আর তর্ক কোরোনা বলছি। এখান থেকে যাও, আমার সুমুখ থেকে যাও, দূর হয়ে যাও বলছি।
মা বললেন, অত বাড়াবাড়ি ভালো নয়। চেঁচামিচি করে পৃথিবী সুষ্ঠু লোককে নিজের গুণপনার কথা জানানো হচ্ছে, খুব সুখ্যাতি হবে।
শুনতে পেলাম, এরপরে বাবার গলার স্বর রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে বোমার মতো ফেটে পড়ল!
-তুমি যাবে? এখান থেকে যাবে কি না বল? গেলি তুই আমার চোখের সামনে থেকে? শয়তান মাগী.বাবা বিড়বিড় করে আরও কত কী বললেন, আমি কানে আঙুল দিলাম, বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে রইলাম একটি অসাড় মৃতদেহ হয়ে, আমার চোখ ফেটে জল বেরোলো বিপর্যয়ের পথে বর্ধিত হলেও আমার মনের শিশুটি আজন্ম যে শিক্ষা গ্রহণ করে এসেছে তাতে এমন কোনো কথা লেখা ছিল না। মনে হল যেন আজ এই প্রথম বিপর্যয়ের মুহূর্তগুলি চরম প্রহরী সেজে আমার দোর গোড়ায় কড়া নাড়ছে। আগে এমন দেখিনি বা শুনিনি তবু আমার এই অনুভূতির শিক্ষা কোথেকে এল? বলতে পারি আমার এই শিক্ষা অতি চুপি চুপি জন্মলাভ করেছে, মাটির পৃথিবী থেকে সে এমন ভাবে শ্বাস ও রস গ্রহণ করেছে যাতে টুঁ শব্দ হয়নি। ফুলের সুবাস যেমন নিঃশব্দে পাখা ছড়িয়ে থাকে তেমনি ওর চোখের পাখা দুটিও নিঃশব্দে এই অদ্ভুত খেলার আয়োজন করতে ছাড়েনি। আরও বলতে পারি আমার মনের শিশুর বাঁচবার বা বড়ো হবার ইতিহাস যদি জানতে হয় তবে ফুলের তুলনা করা চলে। কিন্তু সেই শিক্ষা আজ কাজ দিল কই? বরং আরও কর্মহীনতার নামান্তর হল, আমার কাঁচা শরীরের হাত দুটি কেটে ভাসিয়ে দিল জলে, দুই চোখকে বাষ্পকুল করে কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ করে দিল। আমি কী করব? আমার কিছু করবার আছে কী?