একথা আগেই বলেছি যে আমার মা-ও ইঁদুর দেখলে দারুণ ভীত হয়ে পড়েন, তখন তাঁকে সামলানো দায় হয়ে ওঠে। ইঁদুর যে কাপড় কাটবে সেদিকে নজর না দিয়ে তখন তাঁর দিকেই নজর দিতে হয় বেশি। একবার তাঁর একটা কাপড়ের নীচে কেমন করে জানিনে একটা ইঁদুর আটকে গিয়েছিল। সে থেকে থেকে কেবল পালাবার চেষ্টা করছিল, ছড়ানো কাপড়ের ওপর দিয়ে সেই প্রয়াস স্পষ্ট চোখে পড়ে। মা পাঁচ হাত দূরে সরে গিয়ে ভাঙা গলায় চীৎকার করে বললেন,
—সুকু, সুকু।
প্রথম ডাকে উত্তর না দেওয়া আমার একটা অভ্যাস। তাই উত্তর দিয়েছি এই ভেবে চুপ করে রইলাম।
-সুকু? সুকু?
এবার উত্তর দিলাম, কেন?
মা তাঁর হলুদ-বাটায় রঙিন শীর্ণ হাতখানা ছড়ানো কাপড়ের দিকে ধরে চোখ বড়ো করে বললেন,
-ওই দ্যাখ!
আমি বিরক্ত হলাম। ইদুরের জ্বালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে আর কী! এত উঁদুর কেন? পরম শত্ৰু কী কেবল আমরাই। আমি কাপড়টা সরাতে অমনি মা চেঁচিয়ে উঠলেন, আহা, ধরিসনে, ওটা ধরিসনে।
-খেয়ে ফেলবে না তো!
-আহা,বাহাদুরি দেখানো চাই-ই।
—মা, তুমি যা ভীতু।–ইঁদুরটা অনবরত পালাবার চেষ্টা করছিল, বললাম, আচ্ছা মা,বাবাকে একটা কল আনতে বলতে পারো না? কোনোদিন দেখবে আমাদের পর্যন্ত কাটতে শুরু করে দিয়েছে।
—আহা, মেরে কী হবে? অবোধ প্রাণী কথা বলতে পারে না তো। আর কল আনতে পয়সাই বা পাবেন কোথায়? মা-র গলার স্বর এমনি অকাতর থাকে এবং অত্যন্ত সংক্ষেপে শেষ হয়ে যায়। শেষ হওয়ার পর আর এক মিনিটও তিনি সেখানে থাকেন না। তিনি অমনি চলে গেলেন।
একটা ইঁদুর মারা কল কিনতে পয়সা লাগবে, এটা আমার আগে মনে ছিল না। তাহলে আমি বলতাম না। কারণ এই ধরনের কথায় এমন একটা বিশেষ অবস্থার ছবি মনে জাগে যা কেবল একটা সীমাহীন মরুভূমির মতো। মরুভূমিতেও অনেক সময় জল মেলে, কিন্তু এ-মরুভূমিতে জল মিলবে, এমন আশাও করিনে। এই মরুভূমির ইতিহাস আমার অজানা নয়। আমার পায়ের নীচে যে বালি চাপা পড়েছে, যে বালুকণা আশে পাশে ছড়িয়ে আছে, তার ফিসফিস করে সেই ইতিহাস বলে। আমি মন দিয়ে শুনি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আঠারো বছর বয়েস অবধি এগিয়ে আবোল-তাবোল অনেক ভেবেছি, কিন্তু আবোল-তাবোল ভাবনা মস্তিষ্কের হাটে কখনো বিক্রি হয় না। ঈশ্বরের প্রতি সন্দেহ এবং বিশ্বাস দুই-ই প্রচুর ছিল, তাই ঈশ্বরকে কৃষ্ণ বলে নামকরণ করে ডেকেছি, হে কৃষ্ণ, এ পৃথিবীর সবাইকে যাতে একেবারে বড়ো—লোক করে দিতে পারি তেমন বর আমাকে দাও। রবীন্দ্রনাথের পরশমণি কবিতা পড়ে ভেবেছি, ইস, একটা পরশমণি যদি পেতাম। সঙ্গে সঙ্গে অনেক লোককে সত্যই জিজ্ঞেস করে বসেছি, আচ্ছা, পরশমণি পাথর আজকালও লোকে পায়? কোথায় পাওয়া যায় বলবে?
আমি যখন ছোটো ছিলাম, আমাদের বৃহৎ পরিবারের লোকগুলির নির্মল দেহে তখনও অর্থহীনতার ছায়াটুকু পড়েনি। বুর্জোয়ারাজের ভাঙনের দিন তখনও ব্যাপকভাবে শুরু হয়ে যায়নি। শুরু না হওয়ার আমি এই মানে করেছি যে, তখনও অনেক জনকের প্রসারিত মনের আকাশে তার ছেলের ভবিষ্যৎ স্মরণ করে গভীর সন্দেহের উদ্রেক হয়নি। আমাকে আশ্রয় করেই কম আশা জন্ম নিয়েছিল। অথচ সে সব আশার শাখা-প্রশাখা এখন কোথায়। আমি বলতে দ্বিধা করব না, সে সব শাখা-প্রশাখা তো ছড়ায়ইনি, বরং মাটির গর্ভে স্থান নিয়েছে। একটা সুবিধা হয়েছে এই যে, পারিবারিক স্বেচ্ছাচারিতার অক্টোপাস থেকে রেহাই পাওয়া গেছে, আমি একটু নিরিবিলি থাকতে পেরেছি।
কিন্তু নিরিবিলি থাকতে চাইলেই কী আর থাকা যায়। ইঁদুররা আমায় পাগল করে তুলবে না। আমি রোজ দেখতে পাই একটা কেরোসিন কাঠের বাক্স বা ভাঙা টিনের ভিতর ঢুকে ওরা অনবরত টুং টাং শব্দ করতে থাকে, ক্ষীণ হলেও অবিরত এমন আওয়াজ করতে থাকে যে অনতিকাল পরেই সেটা একটা বিশ্রী সঙ্গীতের আকার ধারণ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে শুধু আমার কেন অনেকেরই বিষম বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
একটা কুকুর যখন কঁকিয়ে কঁকিয়ে আস্তে আস্তে কাঁদতে থাকে, তখন সেটা কেউ সহ্য করতে পারে? আমি অন্তত করিনে। অমন হয়। যখন একটা বিশ্রী শব্দ ধীরে ধীরে একটা বিশ্রী সঙ্গীতের আকার ধারণ করে তখন সেটা অসহ্য না হয়ে যায় না। ইঁদুরগুলির কার্যকলাপও আমার কাছে সেরকম একটা বিরক্তিকর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আর একদিন মা চীৎকার করে ডেকে উঠলেন,–সুকু! সুকু!
বলেছি তো প্রথম ডাকেই উত্তর দেওয়ার মতো কঠিন তৎপরতা আমার নেই।
মা আবার আর্তস্বরে ডাকলেন, সুকু?
আর তৃতীয় ডাকের অপেক্ষা না করে নিজেকে মার কাছে যথারীতি স্থাপন করে তাঁর অঙ্গুলি নির্দেশে যা দেখলুম তাতে যদিও চিন্তিত হবার কারণ থাকে তবু চিন্তিত হলাম না। দেখলাম, আমাদের কচিৎআনা দুধের ভাঁড়টি একপাশে হাঁ করে আমার দিকে চেয়ে আছে আর তারই পাশ দিয়ে একটি সাদাপথ তৈরি করে এক প্রকান্ড ইঁদুর দ্রুত চলে গেল। এখানে একটা কথা বলে রাখি, কোনো বিশেষ খবর শুনে কোনো উত্তেজনা ভাবান্তর প্রকাশ করা আমার স্বভাবে নেই বলেই বার বার প্রমাণিত হয়ে গেছে। কাজেই এখানেও তার অন্যথা হবে না, একথা বলা বাহুল্য। দেখতে পেলাম, আমার মা-র পাতলা কোমল মুখখানি কেমন এক গভীর শোকে পার হয়ে গেছে, চোখ দুটি গোরুর চোখের মতো করুণ, আর যেন পদ্মপত্রে কয়েক ফোঁটা জল টল টল করছে, এখুনি কেঁদে ফেলবেন।