- বইয়ের নামঃ সোমেন চন্দর গল্প
- লেখকের নামঃ সোমেন চন্দ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অকল্পিত
একটিমাত্র হলে এত পরিচ্ছদ, এত শাড়ীর বৈচিত্র্য, তবু গুঞ্জন কোলাহল হইয়া ওঠে নাই, আর হয় না। কারণ যে সমাবেশ, যে পরিবেশ—এখানকার বাতাসে যে সুরুচির সৌরভ, জীবনের বিশেষ অভিব্যক্তি।
মিসেস ঘোষ সমুদ্রপারের মেয়ে, আরও অনেক ইংরেজমেয়ের মতোই একটি বাঙালি ছেলেকে বিবাহ করিয়া আজ বছর দশেক হয় কলিকাতায়, অর্থাৎ ভারতবর্ষের আকাশের নীচে। বিদেশি এই বিহঙ্গীর বয়স হইয়াছে কিন্তু চেহারার জৌলুস এতটুকু কমে নাই। বিশেষ করয়ি হাসিটি—বরফের কুচির মতো দাঁতগুলি কী সুন্দর চকচক করিয়া ওঠে! যাই বলো, ঘোষ লোকটি ভাগ্যবান, পত্নী ভাগ্যে ভাগ্যবান। সেই মিসেস ঘোষ আজ এখানে আগত কয়েকটি স্বজাতির সঙ্গে একেবারে মিশিয়া গিয়াছেন। হয়তো মুখের দিকে চাহিয়া লণ্ডনের রাজপথের অনেক তুষারভেজা সকালের কথা, বা গ্রীষ্মকালের সমুদ্রস্নান, তীরবর্তী বালুর আঘ্রাণ, অথবা কলেজবিল্ডিং-এর করিডোরে একদিনের চপলতায় নিঃশঙ্ক আচরণ ও বিচরণের কথা মনে হইতেছে।
বাহিরে মোটরের ভিড় বাড়িয়া চলিয়াছে। শিল্পী জীবানন্দ সেন একা মানুষ, কারের হুশহুশ আর জুতার মচমচ আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত এবং ব্যস্ত হইয়া আসেন অভ্যর্থনা করিতে। নিঃসঙ্গতাহেতু এই ভয়, তার চারদিকে দৃষ্টি না দেওয়ার ফলে যদি কোনো সম্ভান্ত অতিথি অভ্যর্থনার উষ্ণতা হইতে বাদ পড়িয়া যান।
এটর্নি অতুল চৌধুরী একটি বন্ধুর ছবি দেখিয়া আশ্চর্য হন, পাশে জীবানন্দের দিকে চাহিয়া বলিলেন, বাঃ চমৎকার। জীবানন্দবাবু শুধু এই ছবিখানা দিয়েই আপনাকে পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পীরূপে অভিহিত করা যায়; সত্যি, চমৎকার! জীবানন্দ মুচকিয়া হাসেন। এটর্নি সাহেবের সময় নাই, তাড়াতাড়ি সারিতে হইবে, চারিদিকে একবার দৃষ্টি বুলাইয়া পাশে অগ্রসর হন।
আর একটি মেয়ে—যে মেয়েটির আঘ্রাণ পাইয়া নেহাৎ আত্মাভিমানী কোনো মেয়েরও চোখে তাক লাগিবে, তির্যকদৃষ্টিতে একবার অন্তত সেদিকে চাহিবে সেই মেয়েটিকে অনেকেই জানে, ব্যারিস্টার প্রতুল চক্রবর্তীর কন্যা, অপরূপ রূপবতী (নেহাৎ আত্মাভিমানী কোনো মেয়েও একথা বলিবে)।
গায়ের রঙ এত ফর্সা যে ঠোঁটের নকল রঙও সৌন্দর্যে তীব্র হইয়া উঠিয়াছে। মাথার চুল কপালের পাশে ঈষৎ কোঁকড়ান, কালো কুচকুচ। মসৃণ নগ্ন দুই হাতে চুড়ির ভার অল্প, পরনের শাড়িতে আগুন জ্বলে, লাল।
প্রোফেসর সুব্রত রায়ের বয়েস অল্প, ছেলেরা তাহার সঙ্গে ইয়ার্কি দেয়, তাহার সম্বন্ধে অনেক কিছু জানে, এমনকি তাহার ব্যক্তিগত জীবনেও দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়াছে। অবশ্য সুব্রতর সেখানে অসম্মতি ছিল না, সে বলে: কেবল পড়ার সময় পড়া, অন্য সময় আমরা বন্ধুর মতো ব্যবহার যেন করি। কিন্তু ভাগ্যিস এখানে কোনো ছেলেই আসে নাই। তাহার পরনে ছাই রঙের সুট, চুলগুলি ব্যাক-ব্রাশ করা, কতকটা লালচে রং ধরিয়াছে।
তাড়াতাড়ি অগ্রসর হইয়া বলিল, মিস চক্রবর্তী? পাশে চাহিয়া শকুন্তলা হাসিয়া ফেলিল-আপনি? তাহার মুখের দিকে চাহিয়া সুব্রত বলিল, ওই দিকটাতে একটা ছবি ছিল, সেটাকে আমার মতে শ্রেষ্ঠ বলা চলে—দেখেছেন? এ্যস্তভাবে কথা বলা শকুন্তলার অভ্যাস। বলিল, আমি তো সব ছবিই দেখেছি, কোনটা বলুন তো?
সে একখানা পোট্রেট। শকুন্তলার গা ঘেঁষিয়া সেই ছবিটার দিকে যাইতে যাইতে সুব্রত বলিল। প্রথমে চারদিকে একবার যথাসম্ভব সুন্দর ভঙ্গিতে তাকাইয়া তারপর শকুন্তলা ছবির দিকে দৃষ্টি দিল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কতক্ষণ দেখিয়া বলিয়া উঠিল, শ্রেষ্ঠ একে বলা চলে না, রয়, আপনার বিচারকে তারিফ করতে পারিনে।
সুব্রত হাসিয়া বলিল, তাই নাকি? তাহার চোখে চোখ চাহিয়া শকুন্তলা বলিল, ছবিটার দিকে একবার চেয়ে দেখুন, যে অঙ্কন পদ্ধতিতে এই ছবিটা এঁকেছেন, সেই ধরনের অনেকগুলো ছবি তাঁর আছে। এই দেখুন না এটাও। এগুলোই নাকি তাঁর আজকালকার আঁকা—আমার কিন্তু ভালো লাগে না। তবে এখানাকে কিছু সইতে পারি, বেশ ভালোই এটা, কিন্তু তাবলে শ্রেষ্ঠ নয়।
-সেই হিসেবে দেখতে গেলে অবিশ্যি আপনার কথাই ঠিক, হ্যাঁ, আপনি যা বলেছেন…। টানিয়া টানিয়া বলিতে লাগিল সুব্রত। কোন হিসেবে দেখিতে গেলে যে তাহার কথাটা ঠিক, সেটা সে নিজেও জানে না।
তাড়াতাড়ি আর এক পাশে গিয়া আঙুল বাড়াইয়া শকুন্তলা বলিল, দেখুন তো এটা কী, wonderful execution।
অতিরিক্ত হাসিয়া সুব্রত বলিল, wonderfull।
–মিস চক্রবর্তী।
পেছনে ফিরিয়া শকুন্তলা আশ্চর্য হইল, হাত বাড়াইয়া বলিল, good Heavens ! কখন এলেন? মৃদু হাসিয়া পল বলিল, এই তো এখন। আপনি?
—আমিও বেশিক্ষণ হয়নি এসেছি।
–সব ছবি দেখা হল?
—হ্যাঁ। শকুন্তলা তাহার হাত ধরিয়া বলিল,-চলুন আপনাকে দেখাচ্ছি।
ভয়ানকভাবে সুব্রত ছবি দেখায় মন দিল। কিন্তু মাঝে মাঝেই চোখদুটি ছবি হইতে সরিয়া সেই ছোকরা সাহেবটি আর শকুন্তলার উপরে গিয়া পড়ে। পল বড়ো সোজাসুজি—দেরি সহিতে পারে না, সম্মুখের ছবির বিষয়ে শকুন্তলার বক্তব্যকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়াই বলিয়া ফেলিল: মিস চক্রবর্তী, আপানাকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে।
হাসিয়া শকুন্তলা বলিল, Thank you.