হরিণ ভয় পেয়ে গেল।
হরিণ বললে : কেন ভাই? কেন? যদি তোমায় আমি লেজটি দিই, তাহলে আমি যে আমার বাচ্চাদের হারাব।
অবাক হয়ে মাছি বললে : তোমার লেজ তাদের কি কাজে লাগবে?
হরিণ বললে : বাঃ, কী প্রশ্নই না তুমি করলে। ধর, যখন একটা নেকড়ে আমাদের তাড়া করে–তখন আমি বনের মধ্যে ছুটে গিয়ে লুকোই আর ছানারা আমার পিছু নেয়। কেবল তারাই আমায় গাছের মধ্যে দেখতে পায়, কেননা আমি আমার ছোট্ট সাদা লেজটা রুমালের মতো নাড়ি, যেন বলি : এই দিকে, বাছারা, এই দিকে। তারা তাদের সামনে সাদা মতো একটা কিছু নড়তে দেখে আমার পিছু নেয়। আর এইভাবেই আমরা নেকড়ের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচি,
নিরুপায় হয়ে মাছি উড়ে গেল।
সে উড়তে লাগল-যতক্ষণ না সে একটা বনের মধ্যে গাছের ডালে একটা কাঠঠোকরাকে দেখতে পেল।
তাকে দেখে মাছি বলল : কাঠঠোকরা, তোমার লেজটা আমায় দাও। এটা তো তোমার শুধু সুন্দর হবার জন্যে!
কাঠঠোকরা বললে : কী মাথা-মোটা তুমি! তাহলে কি করে আমি কাঠ ঠুকরে খাবার পাব? কি করে বাসা তৈরী করব বাচ্চাদের জন্যে?
মাছি বলল : কিন্তু তুমি তো তা তোমার ঠোঁট দিয়েই করতে পার!
কাঠঠোকরা জবাব দিল : ঠোঁট কেবল ঠোঁটই। কিন্তু লেজ ছাড়া আমি কিছুই করতে পারি না। তুমি দেখ, কিভাবে আমি ঠোকরাই।
কাঠঠোকরা তার শক্ত লেজ দিয়ে গাছের ছাল আঁকড়ে ধরে গা দুলিয়ে এমন ঠোক্কর দিতে লাগল যে তার থেকে ছালের চোকলা উড়তে লাগল।
মাছি এটা না মেনে পারল না যে, কাঠঠোকরা যখন ঠোকরায় তখন সে লেজের ওপর বসে। এটা ছাড়া সে কিছুই করতে পারে না। এটা তার ঠেক্নার কাজ করে।
মাছি আর কোথাও উড়ে গেল না। মাছি দেখতে পেল সব প্ৰাণীর লেজই কাজের জন্যে। বে-দরকারী লেজ কোথাও নেই–বনেও না, নদীতেও না। সে মনে মনে ভাবল–বাড়ি ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করবার নেই। “আমি লোকটাকে সোজা করবই। যতক্ষণ না সে আমায় লেজ করে দেয়। আমি তাকে কষ্ট দেব।”
মানুষটি জানলায় বসে বাগান দেখছিল। মাছি তার নাকে এসে বসল। লোকটি নাক ঝাড়া দিল, কিন্তু ততক্ষণে সে তার কপালে গিয়ে ব’সে পড়েছে। লোকটি কপাল নাড়ল-মাছি তখন আবার তার নাকে?
লোকটি কাতর প্রার্থনা জানাল : আমায় ছেড়ে দাও, মাছি।
ভন ভন করে মাছি বলল : কিছুতেই তোমায় ছাড়ব না। কেন তুমি আমায় অকেজো লেজ আছে কি না দেখতে পাঠিয়ে বোকা বানিয়েছে। আমি সব প্ৰাণীকেই জিগ্গেস করেছি—তাদের সবার লেজই দরকারী।
লোকটি দেখল মাছি ছাড়বার পাত্র নয়—এমনই বদ এটা। একটু ভেবে সে বলল; মাছি, মাছি। দেখ, মাঠে গরু রয়েছে। তাকে জিগগেস করো তার লেজের কী দরকার।
মাছি জানলা দিয়ে উড়ে গিয়ে গরুর পিঠে বসে ভন ভন করে জিগগেস করল : গরু, গরু। তোমার লেজ কিসের জন্যে? তোমার লেজ কিসের জন্যে?
গরু একটি কথাও বলল না-একটি কথাও না। তারপর হঠাৎ সে তার লেজ দিয়ে নিজের পিঠে সপাৎ করে মারল—আর মাছি ছিটকে পড়ে গেল।
মাটিতে পড়ে মাছির শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেলা-পা দুটো উচু হয়ে রইল। আকাশের দিকে।
লোকটি জানলা থেকে বলল : এ-ই ঠিক করেছে মাছির। মানুষকে কষ্ট দিও না, প্ৰাণীদেরও কষ্ট দিও না। তুমি আমাদের কেবল জ্বালিয়ে মেরেছি।
[ সোভিয়েট শিশুসাহিত্যিক ভি. বিয়াঙ্কির “টেইল্স্” গল্পের অনুবাদ। ]
ষাঁড়-গাধা-ছাগলের কথা
একটি লোকের একটা ষাঁড়, একটা গাধা আর একটা ছাগল ছিল। লোকটি বেজায় অত্যাচার করত তাদের ওপর। ষাঁড়কে দিয়ে ঘানি টানোত, গাধা দিয়ে মাল বওয়াত আর ছাগলের সবটুকু দুধ দুয়ে নিয়ে বাচ্চাদের কেটে কেটে খেত, কিন্তু তাদের কিছুই প্ৰায় খেতে দিত না। কথায় কথায় বেদম প্ৰহার দিত।
তিনজনেই সব সময় বাধা থাকত, কেবল রাত্তির বেলায় ছাগলছানাদের শেয়ালে নিয়ে যাবে ব’লে গোয়ালঘরের মাচায় ছাগলকে না বেঁধেই ছানাদের সঙ্গে রাখা হত।
একদিন দিনের বেলায় কি ক’রে যেন ষাঁড়, গাধা, ছাগল তিনজনেই ছাড়া অবস্থায় ছিল। লোকটিও কি কাজে বাইরে গিয়ে ফিরতে দেরি ক’রে ফেলল। তিনজনের অনেক দিনের চাড়া দিয়ে উঠতেই গাধা সোজা রান্নাঘরে গিয়ে ভাল ভাল জি খেতে আরম্ভ করল। ষাঁড়টা কিছুক্ষণের মধ্যেই সাফ করে ফেলল লোকটির চমৎকার তরকারির বাগানটা। ছাগলটা আর কী করে, কিছুই যখন খাবার নেই, তখন সে বারান্দায় মেলা একটা আস্ত কাপড় খেয়ে ফেলল মনের আনন্দে।
লোকটি ফিরে এসে কাণ্ড দেখে তাজব ব’নে গেল। তারপর চেলাকাঠ দিয়ে এমন মার মারল তিনজনকে যে আশপাশের পাঁচটা গ্ৰাম জেনে গেল লোকটির বাড়ি কিছু হয়েছে। সেদিনকার মতো তিনজনেরই খাওয়া বন্ধ করে দিল লোকটি।
রাত হতেই মাচা থেকে টুক ক’রে লাফিয়ে পড়ল ছাগল। তারপর গাধা আর ষাঁড়কে জিজ্ঞেস করল : গাধা ভাই, ষাঁড় ভাই, জেগে আছ।
দুজনেই বলল : হ্যাঁ, ভাই!
ছাগল বলল : কি করা যায়?
ওরা বলল : কী আর করব, গলা যে বাঁধা।
ছাগল বলল সে জন্যে ভাবনা নেই, আমি কি-না খাই? আমি এখুনি তোমাদের গলার দড়ি দুটো খেয়ে ফেলছি। আর খিদেও যা পেয়েছে।
ছাগল দড়ি দুটো খেয়ে ফেলতেই তিনজনের পরামর্শ-সভা। শুরু হয়ে গেল।
তারা পরামর্শ করে একটা ‘সমিতি’ তৈরী করল। ঠিক হল আবার যদি এই রকম হয়, তাহলে তিনজনেই একসঙ্গে লোকটিকে আক্রমণ করবে। ষাঁড় আর গাধা দুজনে একমত হয়ে ছাগলকে সমিতির সম্পাদক করল। কিন্তু গোল বাধল সভাপতি হওয়া নিয়ে। ষাঁড় আর গাধা দুজনেই সভাপতি হতে চায়। বেজায় ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। শেষকালে তারা কে বেশী যোগ্য ঠিক করবার জন্যে, সালিশী মানতে মোড়লের বাড়ি গেল। ছাগলকে রেখে গেল লোকটির ওপর নজর রাখতে। মোড়ল ছিল লোকটির বন্ধু। গাধাটা চেঁচামেচি করে ঘুম ভাঙাতেই বাইরে বেরিয়ে মোড়ল চিনল এই দুটি তার বন্ধুর ষাঁড় আর গাধা। সে সব কথা শুনে বলল : বেশ, তোমরা এখন আমার বাইরের ঘরে খাও আর বিশ্রাম কর, পরে তোমাদের বলছি কে যোগ্য বেশী। ব’লে সে তার গোয়ালঘর দেখিয়ে দিল। দুজনেরই খুব খিদে। তারা গোয়ালঘরে ঢুকতেই মোড়ল গোয়ালের শিকল তুলে দিয়ে বলল : মানুষের বিরুদ্ধে সমিতি গড়ার মজাটা কি, কাল সকালে তোমাদের মনিবের হাতে টের পাবে।