গুড। এই জিনিসের কলকাতায় দাম হত দুশো।
আর কী–পেমেন্ট করে দিন।
কী বলব বলো তো? মানে, প্রথম দিন তো, একটু গাইডেন্স না পেলে…
আপনাকে কিছুই বলতে হবে না। কলমটা নিয়ে ক্যাশ কাউস্টারে দিন আর একটা পাঁচ পাউন্ডের নোট দিন। ওরা চেঞ্জ ফেরত দেবে, আর কলমটা ওদের একটা খামে পুরে দেবে। ব্যস, খতম!
তুমি প্রথম দিন এত কী করে জানলে বলে তো?
আমি তো এসে অবধি চতুর্দিকে দেখছি। আপনিও দেখছেন, কিন্তু আপনি অবজার্ভ করছেন না।
দু মিনিটের মধ্যে ভদ্রলোক তার নতুন কেনা কলম নিয়ে হাসতে হাসতে ফিরে এলেন আমি বললাম চা খাবেন?
কোথায়?
আমি যত দূর জানি, ওপরে একটা রেস্টোরান্ট আছে।
বেশ তো, চলে যাওয়া যাক।
চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গিয়ে চার তলায় খাবার জায়গাটা আবিষ্কার করলাম, আর সেই সঙ্গে ভাগ্যক্রমে একটা খালি টেবিলও পেয়ে গেলাম।
চা খাওয়া শেষ করে আবার অক্সফোর্ড স্ট্রিটের জনসমুদ্র পেরিয়ে যখন হোটেলে ফিরলাম তখন সাড়ে চারটা বেজে গেছে। ঘরে গিয়ে দেখি ফেলুদা হাজির।
বিলেত ব্যাপারটা কী তার কিছু আন্দাজ পেলেন?
লালমোহনবাবুকে জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
কেমন লাগল বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
কেন, আপনার বই পড়ে তো মনে হয় আপনার বিশেষণের স্টক অফুরন্ত।
বাংলায় বোঝাতে পারব না। বলতে হয় সুপার-সেনসেশনাল। এখনও মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। বিশ্ৰী দেটিানার মধ্যে পড়ে গেছি।
কেন?
লন্ডন দেখব, না আপনার তদন্তের প্রোগ্রেস দেখব।
তদন্ত তো সবে শুরু। তেমন জমে উঠলে আমি নিজে থেকেই বলব। আপাতত লন্ডন দেখে নিন।
সেই ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হল? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
হল, তবে কথা প্ৰায় কিছুই হল না। ভদ্রলোক রুগি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। কাল সকালে ওঁর বাড়ি যেতে বলেছেন। রিচমন্ডে থাকেন।
সেটা কোথায়?
পিকাডিলি আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে রওনা হয়ে সাউথ কেনসিংটনে চেঞ্জ করে গ্রিন লাইন ধরে সোজা রিচমন্ড। এ ধরনের জায়গাও তো দেখা দরকার। ভদ্রলোক স্টেশনের বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবেন আমাদের জন্য। বেশ অমায়িক লোক। রঞ্জনবাবুর বাবাকে চিনতেন এটুকু জেনেছি।
হোটেলের ঘরে ঘরে টেলিভিশন, তাই দেখেই সন্ধেটা দিব্যি কেটে গেল। তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে শুয়ে পড়লাম, আর বালিশে মাথা রাখতেই চোখ ঘুমে ঢুলে এল।
০৬. আকাশ মেঘলা
পরদিন সকালে উঠে দেখি আকাশ মেঘলা, টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আমার একটা ওয়াটারপ্রুফ জ্যাকেট ছিল, সেটা গায়ে চাপিয়ে নিলাম। ফেলুদা আর লালমোহনবাবু দুজনেই ম্যাকিনটশ চাপিয়েছে।
ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেলের বাইরে বেরিয়ে ফেলুদা বলল, মিস্টার জটায়ু, আপনাকে বলে রাখি যে এটাই হল লন্ডনের স্বাভাবিক চেহারা। কাল যে খটখটে দিন আর ঝলমলে রোদ পেয়েছিলেন, সেটা হচ্ছে ব্যতিক্রম।
এখানে কলকাতার মতো জল জমে না নিশ্চয়ই।
তা জমে না। আর খুব যে মুষলধারে বৃষ্টি হয় তাও নয়।
আন্ডারগ্রাউন্ডে দেখি সকলেরই তাড়া, কেউ আস্তে হাঁটছে না। আমরাও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললাম।
এই স্পিডটা দেখছি ছোঁয়াচো, বললেন লালমোহনবাবু। কলকাতায় এমন রুদ্ধশ্বাসে হাটবার কথা কল্পনাই করতে পারি না।
চেঞ্জ করার সময়ও সেই একই তাড়া। এক লাইন থেকে আরেক লাইনে যেতে হচ্ছে, মিনিটে মিনিটে ট্রেন আসছে যাচ্ছে, সময় যাতে নষ্ট না হয় তার জন্য লোকে উঠে পড়ে লেগেছে।
রিচমন্ড পৌঁছলাম। এগারোটা বেজে পাঁচে। নিশানাথবাবু বলে দিয়েছিলেন হাতে কত সময় রাখতে হবে, তাই কোনও অসুবিধা হল না।
স্টেশনের বাইরে বেরোতেই একজন ষাট-বাষট্টি বছরের সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক হাসিমুখে ফেলুদার দিকে এগিয়ে এলেন। এখানে বৃষ্টি হচ্ছে না, যদিও আকাশে মেঘ।
ওয়েলকাম টু রিচমন্ড।
ফেলুদা ভদ্রলোককে সম্ভাষণ জানিয়ে আমাদের দুজনের পরিচয় দিয়ে দিল।
আপনি রাইটার? লালমোহনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক। কতকাল যে বাংলা বই পড়িনি তার হিসেব নেই।
আপনি দেশে যান না মাঝে মাঝে? লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
লাস্ট গেছি সেভেনটি থ্রিতে। তারপর আর না। কার জন্যেই বা যাব বলুন। আমার পুরো ফ্যামিলিই তো এখানে। আমার বাড়িতে অবিশ্যি আমি আর আমার স্ত্রী ছাড়া কেউ থাকে না, কিন্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই ইংল্যান্ডেই রয়েছে আমার দুই ছেলে, দুই মেয়ে, নাতি-নাতনি।
ভদ্রলোকের গাড়িটা একটু দূরে পার্ক করা ছিল; বললেন, এখানে তবু কম; লন্ডনে গাড়ি পার্কিং হচ্ছে একটা বিরাট সমস্যা। আপনি হয়তো সিনেমা যাবেন, গাড়ি পার্ক করতে হবে সিনেমা হাউস থেকে আধ মাইল দূরে।
আমরা গাড়িতে উঠলাম। ভদ্রলোক নিজেই ড্রাইভ করেন, ফেলুদা ওঁর পাশে বসে স্ট্র্যাপ লাগিয়ে নিল। ব্যাপারটা দেখে একটু অবাক হয়ে লালমোহনবাবু আমার দিকে চাইতে বললাম, এখানে গাড়িতে সামনের সিটে বসলে স্ট্র্যাপ লাগানো নিয়ম।
কেন?
যাতে অ্যাক্সিডোন্ট হলে লোকে মুখ থুবড়ে না পড়ে।
নিশানাথবাবু গাড়ি চালু করে দিয়ে বললেন, আমার বাড়ি এখান থেকে দেড় মাইল। এখানে এখনও মাইল চলে। দেশে তো কিলোমিটার, কিলোগ্রাম হয়ে গেছে, তাই না?
রিচমন্ড যে খুব ছোট জায়গা তা মনে হল না, কারণ দোকানপাট সবই রয়েছে। অক্সফোর্ড স্ট্রিটে যে সব দোকানের নাম দেখেছিলাম, তার কিছু কিছু এখানেও দেখলাম।
নিশানাথ সেনের বাড়ি একটা সুন্দর নিরিবিলি জায়গায়, চারিদিকে গাছপালা, গাছের পাতায় শরৎকালের হলদে আর বাদামি রং। দোতলা বাড়িটাও সুন্দর, সামনের বাগানে ফুল— একেবারে পোস্টকর্ডের ছবি।