- বইয়ের নামঃ রয়েল বেঙ্গল রহস্য
- লেখকের নামঃ সত্যজিৎ রায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ ফেলুদা সমগ্র
০১. মুড়ো হয় বুড়ো গাছ
মুড়ো হয় বুড়ো গাছ
হাত গোন ভাত পাঁচ
দিক পাও ঠিক ঠিক জবাবে।
ফাল্গুন তাল জোড়
দুই মাঝে তুই ফোড় ।
সন্ধানে ধন্দায় নবাবে।।
ফেলুদা বলল, আমাদের এবারের জঙ্গলের ঘটনাটা যখন লিখবি তখন ওই ছ লাইনের সংকেতটা দিয়ে আরম্ভ করিস। সংকেতের ব্যাপারটা ঘটনার একটু পরের দিকে আসছে; তাই যখন জিজ্ঞেস করলাম ওটা দিয়ে শুরু করার কারণটা কী, তখন ও প্রথমে বলল, ওটা একটা কায়দা। ওতে পাঠককে সুড়সুড়ি দেবে। উত্তরটা আমার পছন্দ হল না বুঝতে পেরেই বাধহয় আবার দু মিনিট পরে বলল, ওটা শুরুতে দিলে গল্পটা যারা পড়বে তারা প্রথম থেকে মাথা খাটাতে পারবে।
আমি ফেলুদার কথা মতোই সংকেতটা গোড়ায় দিচ্ছি বটে, কিন্তু এটাও বলে দিচ্ছি যে মাথা খাটিয়ে বোধহয় বিশেষ লাভ হবে না, কারণ সংকেতটা সহজ নয়। ফেলুদাকে অবধি পাঁচে ফেলে দিয়েছিল। অবিশ্যি ও বুঝিয়ে দেবার পর ব্যাপারটা আমার কাছেও বেশ সহজ বলেই মনে হয়েছিল।
এত দিন ফেলুদার সব লোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চারগুলো লেখার সময় আসল লোক আর আসল জায়গার নাম ব্যবহার করে এসেছি, এবার একজন বারণ করায় সেটা আর করছি না। নকল নামের ব্যাপারে অবিশ্যি ফেলুদার সাহায্য নিতে হয়েছে। ও বলল, জায়গাটা য়ে ভূটান-সীমানার কাছে সেটা বলতে কোনও আপত্তি নেই। নামটা করে দে লক্ষ্মণবাড়ি। যে ভদ্রলোক গল্পের প্রধান চরিত্র, তার পদবিটা সিংহরায় করতে পারিস।ও নামের জমিদার এ দেশে অনেক ছিল, আর তাদের মধ্যে অনেকেরই আদি নিবাস ছিল রাজপুতানায়, অনেকেই বাংলাদেশে এসে তোডরমল্লের মোগল সৈন্যের হয়ে পাঠানদের সঙ্গে যুদ্ধ করে শেষে বাংলাদেশেই বসবাস করে একেবারে বাঙালি বনে গিয়েছিল।
আমি ফেলুদার ফরমাশ মতোই ঘটনাটা লিখছি। নামগুলোই শুধু বানানো, ঘটনা সব সত্যি। যা দেখেছিলাম, যা শুনেছিলাম, তার বাইরে কিছুই লিখছি না।
ঘটনার আরম্ভ কলকাতায়। ২৭ মে, রবিবার, সকাল সাড়ে নটা। তাপমাত্রা একশো ডিগ্রি ফারেনহাইট )। গরমের ছুটি চলেছে। ফেলুদা কলকাতাতেই ফরডাইস লেনে একটা খুনের ব্যাপারে অপরাধীকে একটা আলপিনের কু-এর সাহায্যে ধরে দিয়ে বেশ নাম-টাম কিনে দু পয়সা কমিয়ে ঝাড়া হাত-পা হয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে, আমি আমার ডাকটিকিটের অ্যালবামে কয়েকটা ভুটানের স্ট্যাম্প আটকাচ্ছি, এমন সময় জটায়ুর আবির্ভাব।
রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাস লেখক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু আজকাল মাসে অন্তত দু কার করে আমাদের বাড়িতে আসেন। ওঁর বইয়ের ভীষণ কাটতি, তাই রোজগারও হয়। ভালই। সেই নিয়ে ভদ্রলোকের বেশ একটু দেমাকও ছিল, কিন্তু যেদিন থেকে ফেলুদা ওঁর গল্পের নানারকম তথ্যের ভুল দেখিয়ে দিতে শুরু করেছে, সেদিন থেকে লালমোহনবাবু ওকে বিশেষ সমীহ করে চলেন, আর নতুন কিছু লিখলেই ছাপার আগে ফেলুদাকে দেখিয়ে নেন।
এবার কিন্তু হাতে কাগজের তাড়া নেই দেখে বুঝলাম, ওঁর আসার কারণটা অন্য। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই সোফায় বসে পকেট থেকে একটা সবুজ তোয়ালের টুকরো বার করে। ঘাম মুছে ফেলুদার দিকে না তাকিয়ে বললেন, জঙ্গলে যাবেন?
ফেলুদা তক্তাপোশের উপর কত হয়ে শুয়ে থর হাইয়ারডালের লেখা আকু-আকু বইটা পড়ছিল; লালমোহনবাবুর কথায় কনুইয়ে ভর করে খানিকটা উঠে বসে বলল, আপনার জঙ্গলের ডেফিনিশনটা কী?
একেবারে সেন্ট পারসেন্ট জঙ্গল। যাকে বলে ফরেস্ট।
পশ্চিম বাংলায়?
ইয়েস স্যার।
সে তো এক সুন্দরবন আর তেরাই অঞ্চল ছাড়া আর কোথায়ও নেই। সব তো কেটে সাফ করে দিয়েছে।
মহীতোষ সিংহরায়ের নাম শুনেছেন?
প্রশ্ন করেই লালমোহনবাবু একটা মেজাজি হাসিতে তাঁর ঝকঝকে দাঁতের প্রায় চব্বিশটা এক সঙ্গে দেখিয়ে দিলেন। মহীতোষ সিংহরায়ের নাম আমিও শুনেছি। ফেলুদার কাছে ওঁর একটা শিকারের বই আছে–সে নাকি দারুণ বই।
তিনি তো উড়িষ্যা না আসাম না কোথায় থাকেন না?
লালমোহনবাবু বুক-পকেট থেকে সাড়াৎ করে একটা চিঠি বার করে বললেন, নো স্যার। উনি থাকেন ডুয়ার্সে–ভূটান বর্ডারের কাছে। আমার লাস্ট বইটা ওঁকে উৎসর্গ করেছিলুম। আমার সঙ্গে চিঠি লেখালেখি হয়েছে।
আপনি তা হলে জ্যান্ত লোককেও বই উৎসর্গ করেন?
এখানে লালমোহনবাবুর উৎসর্গের ব্যাপারটা একটু বলা দরকার। ভদ্রলোক বিখ্যাত লোকদের ছাড়া বই উৎসর্গ করেন না, আর তাদের মধ্যে বেশির ভাগই মারা গেছে এমন লোক। যেমন, মেরুমহাতঙ্ক উৎসর্গ করেছিলেন রবার্ট স্কটের স্মৃতির উদ্দেশে গেরিলার গোগ্রাস— ডেভিড লিভিংস্টোনের স্মৃতির উদ্দেশে, আণবিক দানব (যেটা ফেলুদার মতে ম্যাক্সিমাম গাঁজা) আইনস্টাইনের স্মৃতির উদ্দেশে। শেষটায় হিমালয়ে হৃৎকম্প উৎসর্গ করতে গিয়ে লিখে বসলেন শেরপ-শিরোমণি তেনজিং নোরকের স্মৃতির উদ্দেশে! ফেলুদা তো ফায়ার। বলল, আপনি জলজ্যাস্ত লোকটাকে মেরে ফেলে দিলেন? লালমোহনবাবু আমতা-আমতা করে বললেন, ওরা তো কনস্ট্যান্ট পাহাড়ে চড়ছে।–অনেক দিন কাগজে নাম-টাম দেখিনি তাই ভাবলুম পা-টা হড়কে গিয়ে বোধহয়৷.। দ্বিতীয় সংস্করণে অবিশ্যি উৎসর্গটা শুধরে দেওয়া হয়েছিল।