- বইয়ের নামঃ শকুন্তলার কণ্ঠহার
- লেখকের নামঃ সত্যজিৎ রায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই, ফেলুদা সমগ্র
০১. শেষ পর্যন্ত লালমোহনবাবুর কথাই রইল
শেষ পর্যন্ত লালমোহনবাবুর কথাই রইল। ভদ্রলোক অনেকদিন থেকে বলছেন, মশাই, সেই সোনার কেল্লার অ্যাডভেঞ্চার থেকে আমি আপনাদের সঙ্গে রইচ, কিন্তু তার আগে লখ্নৌ আর গ্যাংটকে আপনাদের যে দুটো অ্যাডভেঞ্চার হয়ে গেছে তখন তো আর আমি ছিলাম না। কাজেই সে দুটো জায়গাও আমার দেখা হয়নি। বিশেষ করে লখ্নৌ-এর মতো একটা ঐতিহাসিক শহর। আপনারা তো গেছেন সেই কবে, চলুন না। এবার পুজোয় আরেকবার যাওয়া যাক।
ফেলুদার লখ্নৌ ভীষণ ভাল লাগে জানি, আর সেই সঙ্গে আমারও। আইডিয়াটা মন্দ না। প্রথমবার যখন যাই, আর আমাদের বাদশাহী আংটির অ্যাডভেঞ্চারটা হয়, তখন আমি খুব ছাট। এখন গেলে লখ্নৌ আরও ভাল লাগবে সেটা আমি জানি।
ফেলুদা বলল, আমারও লখ্নৌ-এর কথা হলেই মনটা চনমান করে ওঠে। আর অত সুন্দর শহর ভারতবর্ষে কমই আছে। শহরের মাঝখান দিয়ে নদী বয়ে গেছে। এ রকম কটা জায়গা পাবেন আপনি? ব্রিজের একদিকে শহরের অর্ধেক, বাকি অর্ধেক অন্য দিকে। তা ছাড়া নবাবি আমলের গন্ধটা এখনও যায়নি। চারিদিকে তাদের কীর্তির চিহ্ন ছড়ানো। তার উপর সেপাই বিদ্রোহের চিহ্ন। নাঃ-আপনার কথাই শিরোধাৰ্য। ক’দিন থেকে ভাবছি কোথায় যাওয়া যায় এবার পূজোয়। লখ্নৌই চলুন।
ফেলুদা আজকাল ভাল রোজগার করে। প্রাইভেট গোয়েন্দাদের মধ্যে ওর নামডাকই সবচেয়ে বেশি। মাসে অন্তত সাত-আটাটা কেস আসে, আর প্রতি তদন্তের জন্য দু হাজার করে পায়। অবিশ্যি রোজগারের দিক দিয়ে লালমোহনবাবুকে টেক্কা দেওয়া মুশকিল। একবার বলেছিলেন ওঁর বইয়ের থেকে বার্ষিক আয় নাকি প্রায় তিন লাখ টাকা। তার উপরে নতুন নতুন বই প্রতি বছরই বেরোচ্ছে।
আমরা আর দ্বিধা না করে লখ্নৌ যাবার ব্যবস্থা করে ফেললাম। দুন এক্সপ্রেসে তিনটি প্রথম শ্রেণীর টিকিট-রাত নষ্টায় বেরোনো, পরদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় পৌঁছানো। সেই সঙ্গে অবিশ্যি হোটেল বুকিংও টেলিগ্ৰাম করে ফেলা হল! ফেলুদা বলল, যাবই যখন তখন আরামে থাকব, নইলে ক্লান্তি যাবে না।
কোন হোটেলে উঠবেন? জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু।
হোটেল ক্লার্কস-আওয়ধ।
আওয়ধ? আওয়ধ ব্যাপারটা কী?
আওয়ধ হল অযোধ্যার উর্দু নাম।
লখ্নৌ বুঝি অযোধ্যায়?
সেটাও জানেন না? লখ্নৌ নামটাও এসেছে লক্ষ্মণ থেকে।
রামের ভাই লক্ষ্মণ?
ইয়েস স্যার। আওয়ধ হল। লখ্নৌ-এর সেরা হোটেল। একেবারে গুমতীর উপরে। হোটেলের পাশ দিয়ে নদী বয়ে গেছে।
বাঃ—আইডিয়াল। আওয়ধ অন দি গুম্তী। ঠাণ্ডা কেমন হবে?
সন্ধের জন্য একটা পুলোভার নিয়ে নেবেন। অথবা আপনার গরম জহর কোিট। আপনি সাহেব সাজবেন না বাঙালি সাজবেন তার উপর নির্ভর করছে।
দুটোই নেব।
ভেরি গুড।
ওখানে তো বাঙালি অনেক?
বিস্তর। ছ-সাত পুরুষ থেকে লখ্নৌতে প্রবাসী এমন বাঙালিও আছে। বেঙ্গলি ক্লাব আছে—সেখানে পুজো হয়। বলা যায় না-আপনার অনুরাগী পাঠকও সেখানে কিছু পেয়ে যেতে পারেন।
তা হলে আমার লেটেস্ট বই সাংঘাইয়ে সংঘাত। কয়েক কপি সঙ্গে নিলে বোধহয় মন্দ হয় না।
কয়েক কপি কেন—এক ভজন নিয়ে নিন।
৫ই অক্টোবর শনিবার আমরা বেরিয়ে পড়লাম। স্টেশনে প্রচুর ভিড়। রিজার্ভেশন ক্লার্ক দেখলাম ফেলুদাকে দেখে চিনলেন—বললেন, চলুন স্যার, আপনাদের বোগি দেখিয়ে দিচ্ছি। একটা ফোর্থ-বাৰ্থ কম্পার্টমেন্টে তিনটে বার্থ-এই তো? এই যে আপনাদের বোগি। তিন নম্বর কামরা আপনাদের জায়গা–একটা লোয়ার, দুটো আপার বার্থ।
আমরা গিয়ে আমাদের জায়গা দখল করলাম। বাড়ি থেকে তাড়াতাডি ডিনার খেয়ে এসেছি, তাই ট্রেনে খাবার ঝামেলা নেই। একটা লোয়ার বার্থে আরেকজন ভদ্রলোক বসে আছেন, বছর পঞ্চাশ বয়স, মাঝারি হাইট, ঠোঁটের উপর একটা সরু গোঁফ। আমাদের দেখে একটু সরে বসে পাশে জায়গা করে দিলেন। ফেলুদা সেখানে বসল, আমরা দুজন উলটা দিকের বার্থে। দশ দিন থাকব। আমরা লখ্নৌ। মালপত্র বেশি নিইনি; আমার আর ফেলুদার জিনিস একটা বড় সুটকেসে আর লালমোহনবাবুর জিনিস তাঁর বিখ্যাত লাল জাপানি সুটকেসে। বলেন। ওটা নাকি ওঁর পাড়ার এক ধনী ব্যবসাদার বন্ধু হৃষীকেশ চৌধুরী জাপান থেকে স্পেশালি লালমোহনবাবুর জন্য এনে দিয়েছেন।
আমাদের সহযাত্রীটি বাঙালি কি না সে বিষয় একটু সন্দেহ ছিল। সেটা দূর হল ভদ্রলোক যখন নিজে আলাপ করলেন।
আপনারা কদ্দুর যাবেন? জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।
লখ্নৌ, বললেন লালমোহনবাবু। আপনি?
আমিও লখ্নৌ যাচ্ছি। ওখানেই থাকি। আমরা তিন পুরুষ ধরে ওখানেই আছি। আপনারা কি বেড়াতে যাচ্ছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ, বললেন লালমোহনবাবু।
এবার ফেলুদা বলল, আপনার সুটকেসে দেখছি তিনটি ইংরেজি হরফ লেখা রয়েছে-এইচ. জে. বি.। এরকম অদ্ভুত ইনিশিয়ালস তো বড় একটা দেখা যায় না। আপনার নামটা জিজ্ঞেস করলে আশা করি আপনি বিরক্ত হবেন না।
মোটেই না। আমার নাম জয়ন্ত বিশ্বাস। এইচ-টা হল হেক্টর। আমি ক্রিশ্চান। আমাদের পরিবারের সকলেরই একটা করে ক্রিশ্চান নাম আছে।
ধন্যবাদ, বলল ফেলুদা। আপনার নামটা যখন বললেন তখন আমাদের নামও বলা সমীচীন। আমি প্রদোষ মিত্র, এটি আমার খুড়তুতো ভাই তপেশ, আর ইনি আমাদের বন্ধু লালমোহন গাঙ্গুলী।