ফরাসিতে সেটা খুব স্বাভাবিক।
লালমোহনবাবু বেশ কয়েকবার মা ব্লাঁ ম ব্লাঁ বলে নিলেন।
আর আমাদের হোটেল যেখানে, বলল ফেলুদা, সেটার বানান দেখে পিকাডিলি বলতে ইচ্ছা করলেও আপনি যদি পিক্লি বলেন তা হলে ওখানকার সাধারণ লোকে বুঝবে আরও সহজে। পিক্লি সার্কাস।
পিক্লি সার্কাস। থ্যাঙ্ক ইউ।
আধা ঘণ্টা লেটে আমাদের প্লেন লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল। ফেলুদা বলল, এখান থেকে সেন্ট্রাল লন্ডন তিনরকমে যাওয়া যায়। এক হল বাস, দুই হল ট্যাক্সি আর তিন টিউব। ট্যাক্সিতে দেদার খরচা, আর বাসের চেয়ে টিউবে কম সময় লাগে। আমার ম্যাপ বলছে একেবারে পিকাডিলি সার্কাস পর্যন্ত টিউব যায়, কাজেই তাতেই যাওয়া ভাল।
টিউবটা কী ব্যাপার মশাই? লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
টিউব হল কলকাতায় আমরা যাকে মেট্রো বলি, সেই। অর্থাৎ পাতাল রেল। লন্ডনের নীচ দিয়ে কিলবিল করে ছড়ানো রয়েছে এই টিউবের লাইন। একবার বুঝে নিলে টিউবে যাতায়াতের মতো সহজ জিনিস আর নেই। ম্যাপ পাওয়া যায়; একটা আপনাকে এনে দেব।
০৫. আমাদের হোটেলটা বেশ বড়
আমাদের হোটেলটা বেশ বড় আর পরিচ্ছন্ন, অথচ ভাড়া খুব বেশি নয়। ট্র্যাভল এজেন্ট ভালই চয়েস করেছিল মশাই বললেন লালমোহনবাবু। টিউব থেকে বেরিয়ে শহরের চেহারা দেখে প্রথমে ভদ্রলোকের মুখ দিয়ে কথাই বেরোচ্ছিল না। শেষে বললেন, আচ্ছা মশাই, আমাদেরও লাল ডবল ডেকার, আর এখানেও দেখছি লাল ডবল ডেকার, এগুলো কেমন ছিমছাম, আর আমাদেরগুলো এমন ছিবড়ে চেহারা কেন বলুন তো?
লাঞ্চ হোটেলে সেরে ফেলুদা বলল, তোরা যদি খুব টায়ার্ড না বোধ করিস তা হলে একবার অক্সফোর্ড স্ট্রিটটা ঘুরে দেখে আয়। ব্যস্ত লন্ডনের এমন চেহারা আর কোথাও পাবি না।
আর তুমি কী করবে?
বলছিলাম না—আমার এক কলেজের বন্ধু—বিকাশ দত্ত—এখানে ডাক্তার। তাকে একবার ফোন করে জানিয়ে দিই। আমি এসেছি, আর দেখি যদি ও কোনও ইনফরমেশন দিতে পারে।
আমরা অবিশ্যি তেমন কিছু ক্লান্ত হইনি, তাই বেরোনোই স্থির করলাম।
ফোন করে তার বন্ধুকে পেয়ে গেল ফেলুদা। মিনিটখানেক কথা বলে ফোন রেখে বলল, বিকাশ আমার গলা শুনে একেবারে থা। একটা মামলা যে কোনওদিন আমাকে লন্ডনে এনে ফেলবে সেটা ও ভাবতেই পারেনি। তা ছাড়া ওর কাছ থেকে একটা খবরও পাওয়া গেল।
কী খবর? লিন্ডনে এক বৃদ্ধ বাঙালি ডাক্তার আছেন, তিনি নাকি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হবার কিছু পরেই এখানে আসেন ডাক্তারির ছাত্র হয়ে। তারপর লন্ডনে প্র্যাকটিস করেন। নাম নিশানাথ সেন। খুব মিশুকে লোক। বিকাশের ধারণা উনি হয়তো রঞ্জনবাবুর বাবাকে চিনতেন। ওঁর চেম্বারের ঠিকানাটা দিয়ে দিল। আমি একবার ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করে আসি।
ফেলুদা উঠে পড়ল।
অন্ধকারে ঢিল। যদি ছুড়তেই হয়, তা হলে সেটা এখনই আরম্ভ করে দেওয়া ভাল।
আমরা একসঙ্গেই বেরেলাম। ফেলুদা টিউব স্টেশনের দিকে গেল, আমরা ওর কাছ থেকে ডিরেকশন নিয়ে অক্সফোর্ড স্ট্রিটের দিকে হাঁটা দিলাম।
অক্টোবর মাস, তাই বেশ ঠাণ্ডা। আমরা দুজনেই গলায় মাফলার জড়িয়ে নিয়েছি।
পথে অনবরত ভারতীয় চোখে পড়ছে, তাই বোধহয় জটায়ু বললেন, বেশ অ্যাট-হাম ফিল করছি ভাই তপেশ। অবিশ্যি রাস্তায় মসৃণ চেহারা মোটেই হামের কথা মনে পড়ায় না।
অক্সফোর্ড স্ট্রিটে পৌঁছে চোখ টেরিয়ে গেল। শুধু যে দোকানের বাহার তা নয়; এরকম ভিড় আর কোনও রাস্তায় কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
জনসমুদ্র! ওশন অফ হিউম্যানিটি, তপেশ, ওশন অফ হিউম্যানিটি।
এই জনসমুদ্রের সঙ্গে তাল রেখে চলতে হচ্ছে, তাই আস্তে হাঁটার উপায় নেই। সমস্ত রাস্তাটাই যেন একটা অবিরাম ব্যস্ততার ছবি। আর দোকানের কথা কী আর বলব! ঝলমলে লোভ লাগানো চেহারা নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল বিশাল ডিপার্টমেন্ট স্টোর। নামগুলো পড়ছি। –ডোবনহ্যাঁম, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসরস, বুটস, ডি এইচ এভানস…
একটা বড় দোকানের কথা আমি আগেই জানতাম-সেলফ্রিজেস। –আর এটাও জানতাম যে সেটা অক্সফোর্ড স্ট্রিটের একেবারে শেষ প্রান্তে। দোকানটা যে এত বড় সেটা আমি ভাবতেই পারিনি। চলুন, একটা জিনিস দেখাই বলে। লালমোহনবাবুকে হাত ধরে রাস্তা পার করে সেলফ্রিজেসের সামনে এসে দাঁড়ালাম। তারপর ঘুরপাক খাওয়া দরজা দিয়ে দুজনে দোকানের ভিতর ঢুকলাম। আমাদের মুখ হাঁ হয়ে গেল। রাজ্যের সবরকম জিনিস এই এক দোকানে পাওয়া যায়, তাই ক্রেতাদের ভিড়ও দেখবার মতো। সেই ভিড়ের চাপে এদিকে ওদিকে। টলছি, এক পা এগোচ্ছি। তো দু পা পেছোচ্ছি। জটায়ু যাতে হারিয়ে না যান। তাই তাঁর হাতটা চেপে ধরে আছি।
মানুষেরও যে ট্র্যাফিক জ্যাম হয় তা এই প্রথম দেখলাম, বললেন ভদ্রলোক।
খানিক দূর এগিয়ে একটা মোটামুটি কম ভিড়ের জায়গায় পৌঁছলাম।
এমন জায়গায় এসে কিছু না কিনে ফিরে যাব? বললেন লালমোহনবাবু।
কী, কিনতে চাইছেন আপনি?
চারিদিকে তো দেখছি কলম পেনসিল নেটবুকের সম্ভার। একটা মাঝারি দামের ফাউন্টেন পেনিও যদি কিনতে পারতাম। সামনের উপন্যাসটা লন্ডনে কেনা। কলমে লিখতে পারলে…
বেশ তো, আপনি দেখে বেছে নিন।
মিনিট পাঁচেক দেখার পর ভদ্রলোক একটা মনের মতো কলম খুঁজে পেলেন। খ্রি। পাউন্ডস থাটি পেন্স। তার মানে আমাদের দেশের হিসেবে কত হল?
তা প্রায় পঁচাত্তর টাকা।