থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।
গাড়িতে উঠে লালমোহনবাবু বললেন, স্কুল-কলেজের বাইরেও তো বন্ধু হয় মশাই। অ্যাট প্রেজেন্ট আমার যে কজন বন্ধু আছে তাদের কেউই আমার সহপাঠী ছিল না।
এটা ঠিকই বলেছেন, বলল ফেলুদা। আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত খবরের কাগজে ছবি দিয়ে এনকোয়ারি করতে হবে। তবে আগে এই হেস্টিংসের ডাক্তারকে একটু বাজিয়ে দেখা যাক।
জ্যোতির্ময় সেন আমাদের অ্যাপিয়েন্টমেন্ট দিয়েছিলেন তিন দিন পরে, সকাল সাড়ে নটায়। ফেলুদার নাম শুনেছেন, যথেষ্ট সম্রামের সঙ্গে কথা বললেন, আর বললেন উনি দশটায় চেম্বারে যান, তার আগেই আমাদের সঙ্গে কাজটা সেরে নিতে চান। ফেলুদা বলল, আর এটাও জানিয়ে রাখি যে এর সঙ্গে ব্যারামের কোনও সম্পর্ক নেই; ব্যাপারটা আমার একটা তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
লালমোহনবাবুও অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথাটা জেনে নিয়েছিলেন; তাঁর গাড়িতেই আমরা শুক্রবার সকালে ঠিক সাড়ে নটায় হেস্টিংসে জ্যোতির্ময় সেনের বাড়ি পৌঁছে গেলাম।
এঁর পসার যে ভাল সেটা বাড়ি দেখেই বোঝা যায়। বেয়ারা এসে সেলাম ঠুকে আমাদের বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে বলল, ডাক্তারবাবু পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসবেন।
লালমোহনবাবু গলা নামিয়ে ফেলুদাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কার বিষয় জানতে চাইবেন— রঞ্জন মজুমদার, না ছবির অন্য ছেলেটি?
ফেলুদা বলল, রঞ্জন মজুমদার লোকটাকে একটু ভাল করে জানা দরকার। এখন পর্যন্ত খুবই সামান্য জানি। তাঁর বন্ধুর বিষয় এই ডাক্তার কিছু বলতে পারবেন বলে মনে হয় না।
ফেলুদার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই জ্যোতির্ময়বাবু এসে গেলেন।
আপনি তো প্রদোষ মিত্র, বললেন ভদ্রলোক সোফায় বসে। অবিশ্যি ফেলুদা নামেই বেশি। প্ৰসিদ্ধ। ইনি তো তোপ্সে, বুঝতেই পারছি, আর ইনি নিশ্চয়ই জটায়ু। আপনার তদন্তের সব কাহিনী আমার বাড়ির ছেলে বুড়ো সবাই পড়ে, তাই আপনাকে একরকম আত্মীয় বলেই মনে হয়। বলুন, কী প্রয়োজন আপনার।
এই ছবির দুজনের একজনকেও চেনেন?
এ তো দেখছি রঞ্জন মজুমদার। পরিষ্কার মনে পড়ছে। এ চেহারা। এই দ্বিতীয় ছেলেটাকে চিনলাম না।
কলেজে আপনাদের ক্লাসে ছিল না?
উঁহু–তা হলে মনে থাকত।
তা হলে এই রঞ্জন মজুমদার সম্বন্ধে দু-একটা প্রশ্ন করব।
কলেজে রঞ্জন আমার ইন্টিমেট বন্ধু ছিল। আমরা দুজনে এক বেঞ্চে বসতাম, একসঙ্গে সিনেমা দেখতাম। ও আমার হয়ে প্রক্সি দিত, আমি ওর হয়ে দিতাম। অবিশ্যি এখন আর কোনও যোগাযোগ নেই।
কীরকম ছেলে ছিলেন তিনি? অর্থাৎ, মানুষ হিসেবে কীরকম?
জ্যোতির্ময় সেন ভুরু কুঁচকে একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, একটু খ্যাপাটে গোছের। অবিশ্যি সেটা আমি মাইন্ড করতাম না।
খ্যাপাটে কেন বলছেন?
কারণ ওই বয়সে অতি স্ট্রং ন্যাশনালিস্ট ফিলিং আমি কারুর মধ্যে দেখিনি! এটা মনে হয় ওর ঠাকুরদাদার কাছ থেকে পাওয়া। রঘুনাথ মজুমদার। ইয়াং বয়সে টেররিস্ট দলে ছিলেন, বোমা-টেমা তৈরি করতেন। রঞ্জনের বাবার মধ্যেও বোধহয় এ জিনিসটা ছিল। বিলোতে ডাক্তারি করতেন। কোন এক সাহেবের সঙ্গে বনেনি বলে আবার দেশে ফিরে আসেন।
বিলেতে থাকার সময় রঞ্জনবাবু তো ওখানকার স্কুলে পড়তেন।
তা পড়ত হয়তো, কিন্তু সে সম্বন্ধে ও নিজে কিছুই বলেনি। ওর তো ওখানে একটা বিশ্ৰী অ্যাক্সিডোন্ট হয়–সে বিষয় জানেন বোধহয়?
হ্যাঁ। উনি নিজেই বলেছিলেন।
তার ফলে ও পাঁচ-সাত বছরের ঘটনা একদম ভুলে যায়। অর্থাৎ বিলেতের সব ঘটনাই ওর মন থেকে লোপ পেয়ে যায়।
তা হলে ওখানে কার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল না-হয়েছিল সেটাও জানবার কোনও উপায় নেই?
না। যদি না ঘটনাচক্ৰে স্মৃতি আবার ফিরে আসে। তবে এটা বলে রাখি-রঞ্জন খুব সাধারণ ছেলে ছিল না। অসুখে ওর কী ক্ষতি করেছিল জানি না-বা ইংল্যান্ডের ছাত্র অবস্থা ওর কীরকমভাবে কেটেছে জানি না, কিন্তু ওর মধ্যে একটা ব্যক্তিত্ব ছিল যেটা ওই বয়সেও বোঝা যেত।
পরদিন সকালে টেলিফোনে আপয়েন্টমেন্ট করে আমি আর ফেলুদ রঞ্জন মজুমদারের বাড়ি গেলাম। কদ্দূর এগোলেন? ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।
এই ছেলেটি যে কলকাতায় আপনার সহপাঠী ছিল না সেটা জানতে পেরেছি। এবার একটা স্টেপ নেব ভাবছি। যেটা নিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই এবং আপনার অনুমতি চাই।
কী স্টেপ?
এই ছবি থেকে অচেনা ছেলের ছবিটা খবরের কাগজে ছাপতে চাই—একটা বিজ্ঞাপনে। কলকাতা আর দিল্লির কাগজে দিলেই হবে।
ভদ্রলোক একটু ভেবে বললেন, আমার নামের কোনও উল্লেখ থাকবে না তো?
মোটেই না, বলল ফেলুদা। আমি শুধু জানতে চাই এই ছেলের পরিচয় কেউ জানে কি না। যদি জানে তা হলে আমার সঙ্গে যেন যোগাযোগ করে! আমার নাম-ঠিকানা থাকবে।
ঠিক আছে। আপনার ইনভেস্টিগেশনের জন্য যা যা করার দরকার সে তো আপনাকে করতেই হবে! আমার কোনও আপত্তি নেই।
০৩. দিল্লির স্টেটসম্যানে বিজ্ঞাপন
পাঁচ দিন পরে রবিবারে কলকাতা আর দিল্লির স্টেটসম্যানে বিজ্ঞাপনটা বোরোল।
প্রথম দিন কোনও ফলাফল নেই, কেউ যোগাযোগ করল না।
বোঝাই যাচ্ছে কলকাতার কেউ নয়; তা হলে এর মধ্যে টেলিফোন এসে যেত, বলল ফেলুদা।
বুধবার সকালে ফেলুদার একটা ফোন এল। গ্র্যান্ড হোটেল থেকে। জন ডেক্সটর বলে একজন টুরিস্ট। তিনি একটা অষ্ট্রেলিয়ান দলের সঙ্গে ভারতবর্ষ ভ্ৰমণে বেরিয়েছেন, দিল্লিতে এসে আচমকা কাগজে ছবিটা দেখেই স্থির করেছিলেন কলকাতায় এসে ফেলুদার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। বললেন আজই বিকেলে কাঠমাণ্ডু চলে যাচ্ছেন, দুপুর একটা নাগাত আমাদের বাড়ি আসতে পারেন।