আপনি লন্ডনেই থাকেন?
না। কিলবার্নে। এখান থেকে বেশি দূর নয়! ওখানে একটা ইস্কুলে মাস্টারি করি। পিটার ডেক্সটরের সঙ্গে একসঙ্গে আমি কেমব্রিজে ছিলাম।
তার মানে রঞ্জন মজুমদারও আপনার সহপাঠী ছিল?
তা তো বটেই।
তাকে মনে আছে?
স্পষ্ট। পিটারের খুব বন্ধু ছিল। অবিশ্যি দুজনের মধ্যে ঝগড়াও হত প্রায়ই।
কী নিয়ে?
পিটার ভারতীয়দের একেবারে পছন্দ করত না। রঞ্জনকে দেখে একেবারে সাহেব বলে মনে হত, তাই পিটার তাকে বন্ধু হিসেবে মেনে নেয়। বলত—ইউ আর নট ইন্ডিয়ান, ইউ আর হাফ ইংলিশ।
আপনার সঙ্গে পিটারের কীরকম সম্পর্ক ছিল?
আমার গায়ের রং তো দেখতেই পাচ্ছেন। আমাকে সে বহুবার ডার্টি নিগার বলে সম্বোধন করেছে। আমি ব্যাপারটা হজম করে নিতাম।
পিটারের মৃত্যুর কথা মনে আছে?
তা থাকবে না? এমন কী দিনটাও মনে আছে-হুইট-সানডের আগের দিন। পিটার, যখন সাঁতার জানত না তখন ওর নৌকোয় চড়া অত্যন্ত ভুল হয়েছিল।
ওর সঙ্গে আর কে ছিল?
রঞ্জন।
সে বিষয় আপনি নিশ্চিত?
অ্যাবসোলিউটলি। রঞ্জনের সর্বাঙ্গ জলে ভেজা চেহারাটা এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে। আমি তখন আমার ঘরে ছিলাম। আমাদের মালী হুকিনসের চেচামেচিতে বাইরে বেরিয়ে এসে সব ব্যাপারটা জানতে পারি। রঞ্জন তার বন্ধুকে বাঁচাবার জন্যে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাই ইট ওয়জ ঢুঁ লেট। রেজিনাল্ডও চেষ্টা করেছিল দাদাকে বাঁচাতে, কিন্তু পারেনি।
পিটারের পরের ভাই?
হ্যাঁ। সে আমাদের পরের বছরই কেমব্রিজে ভর্তি হয়। সেই একই ছাঁচে ঢালা। ভারতীয়দের সঙ্গে প্রায়ই হাতাহাতি লেগে যেত। অনেকবার ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনও ফল হয়নি। রেজি:ন্যান্ডের ধারণা ছিল রঞ্জন ইচ্ছা করলে পিটারকে বাঁচাতে পারত। এই কথা সে সারা কলেজে বলে বেড়াত-হি ডেলিবারেটলি লেট হিম ড্রাউন।
রঞ্জন মজুমদার তো এক বছরের বেশি কেমব্রিজে পড়েনি?
না। একটা বাইসিক্ল অ্যাক্সিডেন্টের পর সে দেশে ফিরে যায়।
কথা শেষ, তাই সত্যুনাথন উঠে পড়লেন। ওঁর কাছ থেকে একটা মূল্যবান তথ্য জানা গেল—নীকোঁতে পিটারের সঙ্গে রঞ্জন ছিলেন, আর তিনি বন্ধুকে বাঁচাতে চেষ্টা করে পারেননি। সত্যনাথন চলে যাবার পর থেকেই লক্ষ করলাম ফেলুদার ভুরুটা কুঁচকে গেল। লাঞ্চ খেতে খেতে লালমোহনবাবু বললেন, আপনাকে যেন ডিসস্যাটিসফায়েড বলে মনে হচ্ছে। কারণটা জানতে পারি কি?
একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে।
কী?
মনে হচ্ছে হুকিনস যা বলেছে তার চেয়ে বেশি ও জানে এবং ওর মনে আছে। কোনও একটা কারণে তথ্য লুকিয়ে যাচ্ছে।
তা হলে কী করবেন?
আরেকবার কেমব্রিজ যাওয়া দরকার। এবারে হুকিনসের বাড়ি। রাস্তার নামটা ও বলেছিল। মনে আছে, তোপ্সে?
মনে ছিল। বললাম, চ্যাটওয়ার্থ স্ট্রিট।
ভেরি গুড। কেমব্রিজ গিয়ে রাস্তার একটা পুলিশকে জিজ্ঞেস করলেই বাতলিয়ে দেবে। এটাও জেনে রাখুন, লালমোহনবাবু-এখানকার পুলিশ, যাকে এরা বলে ববি-এদের মতো হেলপাফুল পুলিশ পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।
লাঞ্চের পর ফেলুদা বলল ওর একটা কাজ আছে, ও একটু বেরোবে। ও ফিরলে তারপর আমরা কেমব্রিজ যাব। ঘণ্টায় ঘণ্টায় কেমব্রিজের ট্রেন ছাড়ে–কোনও অসুবিধা নেই।
সাড়ে চারটায় রওনা হয়ে আমরা যখন কেমব্রিজে পৌঁছলাম, তখন রাস্তার বাতি জ্বলে গেছে। আমরা একটা বড় রাস্ত ধরে এগিয়ে একটা পুলিশের কাছে গিয়ে হাজির হলাম।
চ্যাটওয়ৰ্থ স্ট্রিট কোথায় বলতে পার? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। পুলিশ প্রায় কাগজে নকশা আঁকার মতো করে বুঝিয়ে দিল।
আধঘণ্টা লাগল চ্যাটওয়্যৰ্থ স্ট্রিট পৌঁছতে। এটাকে গলি বললেই চলে, দেখে বোঝা যায় যে খুব অবস্থাসম্পন্ন লোকেদের পাড়া নয়। একটা বাড়ির সামনে একজন লোক রাস্তা থেকে একটা বেড়ালকে তুলে কোলে নিল। তাকেই ফেলুদা জিজ্ঞেস করল হুকিনস কোন বাড়িতে থাকে।
ফ্রেড হুকিনস? ভদ্রলোক বললেন। নাম্বার সিক্সটন।
এখানে সব বাড়ির বাইরেই নম্বর লেখা থাকে, তাই ষোলো খুঁজে পেতে সময় লাগল না।
এগিয়ে গিয়ে দরজায় নক করতে হুকিনস নিজেই দরজা খুলল।
গুড ইভনিং, বলল ফেলুদা।
আমাদের দেখে হুকিনসের মুখ হাঁ হয়ে গেছে। সে কী-তোমরা আবার…?
একটু ভিতরে আসতে পারি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
হুকিনস এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে আমাদের ঢোকবার জায়গা করে দিল। আমরা তিনজনে ঢুকলাম। এটাই বসবার ঘর, যদিও আয়তনে খুবই ছোট। আমরা দুটাে চেয়ারে আর একটা সোফায় ভাগাভাগি করে বসলাম।
ওয়েল?
ফেলুদার দিকে জিজ্ঞাসুর দৃষ্টি দিলে হুকিন্স।
তোমাকে দু একটা প্রশ্ন করার ছিল।
অ্যাবাউট দ্য ড্রাউনিং?
হ্যাঁ।
আমি যা বলেছি তার বেশি তো আর কিছু জানি না।
আমি নতুন প্রশ্ন করব।
কী?
মিস্টার হুকিনস, যে নৌকো ধীরে চলছে, তাতে কেউ বসা অবস্থায় জলে পড়ে যেতে পারে এটা কি তোমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়?
যদি ঝড় থাকে তা হলে নৌকে নিশ্চয়ই উলটে যেতে পারে। দেয়ার ওয়জ এ হাই উইন্ড দ্যাট ডে।
আমি আজই দুর্ঘটনার পরের দিনের খবরের কাগজ দেখেছি। তাতে পিটার ডেক্সটরের মৃত্যু সংবাদ আছে, কিন্তু ঝড়ের কোনও খবর নেই। ওয়েদার রিপোর্টে বলছে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৩৫ মাইল। সেটাকে কি তুমি হাই উইন্ড বলবে?
হুকিনস চুপ। আর একটা টেবিল ক্লকের টিক টিক শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।
ফেলুদা বলল, আমার ধারণা তুমি একটা কিছু লুকোচ্ছ। সেটা কী দয়া করে বলবো?