ডাঃ সরকার হাসলেন।
কাল রাত্রে যে আমি হাসপাতাল থেকে ফোন করেছিলাম সে কথা তো আমি শঙ্করবাবুকে বলিনি।
তবে কোত্থেকে করছিলেন?
আমার বাড়ি থেকে। কাল যাবার পথেই জয়ন্তবাবুর জ্ঞান হয়। তখন বুঝতে পারি আঘাত গুরুতর নয়, কনকাশন হয়নি। তবু একবার দেখব বলে আমার বাড়িতেই নিয়ে যাই। তখনই ঠিক করি রাত্তিরটা ওখানে রেখে সকালে পৌঁছে দিয়ে যাব।
এবার জয়ন্তবাবুকে একটা প্রশ্ন, বলল ফেলুদা। আপনি কাল যে সিন্দুক খোলার জন্য চাবিটা নিলেন, সেটা তো আপনার হাতেই ছিল?
হ্যাঁ, কিন্তু মাথা ঘুরে পড়ার পর আর হাতে নাও থাকতে পারে।
হাতে না থাকলেও, কাছাকাছিই পড়ে থাকার কথা। কিন্তু তা তো ছিল না।
সেটার আমি কী জানি? চাবি আপনারা খুঁজে পেলেন কি না পেলেন তার আমি কী করতে পারি? আপনি কী বলতে চাইছেন সেটা সরাসরি বলুন না।
আর একটা প্রশ্ন আছে, সেটা ডাক্তারকে। তার পরেই সরাসরি বলছি। ডাঃ সরকার, হিমোগ্লোবিন বলে একটা পদাৰ্থ আছে সেটা আপনি জানেন নিশ্চয়ই।
কেন জানব না?
সাধারণ লোকের চোখে সেটার রঙের সঙ্গে রক্তের কোনও তফাত ধরা পড়ে না সেটাও নিশ্চয়ই জানেন।
ডাক্তার সরকার গলা খাক্রানি দিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানিয়ে দিলেন।
আমার বিশ্বাসটা কী তা হলে এবার বলি? বলল ফেলুদা। সকলে একদৃষ্টি চেয়ে আছে ফেলুদার দিকে। আমার বিশ্বাস জয়ন্তবাবু অজ্ঞান হননি, অজ্ঞান হবার ভান করেছিলেন–ডাক্তার সরকারের সঙ্গে একজোট হয়ে। কারণ তাঁদের দুজনের এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার দরকার ছিল!
ননসেন্স! চেঁচিয়ে উঠলেন জয়ন্তবাবু। কেন, চলে যাব কেন?
কারণ মাঝরাত্তিরে গোপনে আবার ফিরে আসবেন বলে।
ফিরে আসব?
হ্যাঁ। উত্তরের ফটক দিয়ে ঢুকে, পিছনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে আপনার মার ঘরে যাবেন বলে।
আপনি একটু বাড়াবাড়ি করছেন মিঃ মিত্তির। মাঝ রাত্তিরে মা-র ঘরে যাব, আর মা টের পাবেন না? মা রাত্তিরে তিনঘণ্টার বেশি ঘুমোন না সেটা আপনি জানেন?
এমনিতে ঘুমান না—কিন্তু ঘুমের ওষুধ খাওয়ালে? ধরুন যদি ডাক্তারবাবু, গতকাল তাঁকে দেখার সময় তাঁর দুধভাতে কিছু মিশিয়ে দিয়ে থাকেন?
জয়ন্তবাবু আর ডাঃ সরকার দুজনেরই ডোন্ট-কেয়ার ভাবটা মিনিটে মিনিটে কমে আসছে সেটা বুঝতে পারছি। ফেলুদা বলে চলল, আপনার ফিরে আসতে হয়েছিল কারণ এক বছর আগে যে কাঁচা কাজটা করেছিলেন, এবার আর সেরকম করলে চলত না। শঙ্করবাবুর পুরো প্ল্যানটাই ভেস্তে দিয়ে মাঝরাত্তিরে এসে চুরিটা সারার দরকার ছিল। সে চুরি ধরা পড়ত কবে তার কোনও ঠিক নেই। অবিশ্যি চাবি আপনার কাছে ছিল না, তাই আপনার মা-র আলমারি থেকে ডুপলিকেট বার করে নিতে হয়েছিল। সেই সময় আমার এই বন্ধুর আবৃত্তি শুনে আপনি কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়ে পড়েন। তাই গায়ে একটা থান জড়িয়ে দরজার মুখে এসে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে আপনার মা জেগেই আছেন, এভরিথিং ইজ অল রাইট। তার পরে আমাদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল করার জন্য হামানদিস্তা পিটতে শুরু করেন। এতেও আমার সন্দেহ হয়েছিল, কারণ হামানদিস্তায় পান থাকলে শব্দটা হয় একটু অন্যরকম; এটা ছিল ফাঁকা শব্দ।
সবই বুঝলাম, মিঃ মিত্তির, বললেন জয়ন্তবাবু, কিন্তু তারপর?
তারপর চাবি দিয়ে সিন্দুক খোলা।
আপনি কোন অপরাধে আমাদের অভিযুক্ত করছেন, মিঃ মিত্তির? অজ্ঞান হবার ভান করা? আমার মাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া? রাত্তিরে ফিরে এসে ডুপলিকেট চাবি বার করে সিন্দুক খোলা?
তার মানে এর সবগুলোই করেছেন স্বীকার করছেন তো?
এর কোনওটার জন্য শাস্তি হয় না সেটা আপনি জানেন? আসল ব্যাপারটায় আসছেন না। কেন আপনি?
ঘটনা যে দুটো জয়ন্তবাবু, একটা তো নয়। আগে প্রথম ঘটনাটা সেরে নিই-এক বছর আগের চুরি।
সেটা আপনি সারবেন কী করে, মিঃ মিত্তির? আপনি কি অন্তর্যামী? আপনি তখন কোথায়?
আমি ছিলাম না ঠিকই, কিন্তু অন্য লোক তো ছিল। যিনি চুরি করেছিলেন তাঁর ঠিক পাশেই লোক ছিল। তাদের মধ্যে অন্তত একজন কি টের পেয়ে থাকতে পারেন না?
এবারে শঙ্করবাবু কথা বললেন। তিনি বেশ উত্তেজিত।
এটা আপনি কী বলছেন, মিঃ মিত্তির? চুরি হয়েছে সেটা জানবে অথচ আমায় বলবে না, আমার এত কাছের লোক হয়ে?
ফেলুদা এবার ম্যাজিশিয়ান কালীনাথবাবুর দিকে ঘুরল।
আপনি কাল রাত্তিরে কী বিপদের কথা ভেবে আমাকে তদন্ত বন্ধ করতে বলছিলেন সেটা বলবেন, কালীনাথবাবু?
কালীনাথবাবু হেসে বললেন, আপ্রিয় সত্য প্রকাশ করায় বিপদ নেই? শঙ্করের মনের অবস্থাটা ভেবে দেখুন তো!
না, নেই বিপদ, দৃঢ়স্বরে বললেন শঙ্করবাবু! অনেক’দিন ব্যাপারটা ধামা চাপা রয়েছে। এবার প্রকাশ হওয়াই ভাল। তুমি যদি কিছু জেনে থাক তো বলে ফেলো, কালীনাথ।
সেটা বোধহয় ওঁর পক্ষে সহজে নয়, মিঃ চৌধুরী, বলল ফেলুদা, কারণ তদন্তে চোর ধরা পড়লে যে ওঁরাও বিপদ হত। এই একটা বছর যে উনি চোরকে নিংড়ে শেষ করেছেন।
ব্ল্যাকমেল?
ব্ল্যাকমেল, শঙ্করবাবু। সেটা উনিও স্বীকার করবেন না, চারও স্বীকার করবেন না। অবিশ্যি চোরের যে দোসর আছে সেটা সম্ভবত কালীনাথবাবু জানতেন না, উনি একজনকেই লক্ষ্য করেছিলেন। কিন্তু আমার ধারণা এই অনবরত ব্ল্যাকমেলিং-এর ঠেলায় দ্বিতীয় চুরিটার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আর তাই—
ভুল! ভুল? তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন জয়ন্তবাবু।সিন্দুক থেকে যা নেবার তা আগেই নেওয়া হয়ে গেছে। বনোয়ারিলালের আর একটি জিনিসও তাতে নেই! সিন্দুক খালি!