কালীনাথবাবু নিজের ঘরে ফিরে গেলেন।
লোকটা অনেক কিছু জানে বলে মনে হচ্ছে? চাপা গলায় বললেন লালমোহনবাবু।
একটা জিনিস তো জানতেই পারে, বলল ফেলুদা।
কী? আমরা দুজনে একসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম।
চুরিটা কে করেছিল। যে করেছিল। সে তে ওঁর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল।
আমি বললাম, কিন্তু সেটা তো উনি নিজেও করে থাকতে পারেন। উনি তো হাত সাফাই জানেন।
এগজ্যাক্টলি, বলল ফেলুদা।
০৪. জিনিয়াস
সাড়ে ছটায় বেড টি না দিলে হয়তো ঘুম ভাঙতে আরও দেরি হত, কিন্তু ফেলুদাকে দেখে। মনে হল সে অনেকক্ষণ আগেই উঠেছে। জিজ্ঞেস করাতে বলল, শুধু উঠেছি নয়, এর মধ্যে একটা চক্করও মেরে এসেছি।
কোথায়?
শহরের দিকে।
কী দেখলে?
কী দেখলাম না সেটাই বড় কথা।
কিছু বুঝতে পারলে?
পানিহাটিতে আসা বৃথা হয়নি এটা বুঝেছি।
লালমোহনবাবু এসে বললেন এমন সলিড় ঘুম নাকি ওঁর অনেকদিন হয়নি।
খুড়িমার উঠতে দেরি দেখে তিনিও খুব সলিড ঘুমিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে, বলল ফেলুদা।
আমি বললাম, সেটা আবার কী করে জানলে?
অনন্তকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে বলল। মা-ঠাকরুণ এখনও গঙ্গাস্নানে যাননি। এমনিতে ছটার মধ্যে নাকি ওঁর স্নান সারা হয়ে যায়।
আমরা তিনজন বারান্দায় গিয়ে বসেছিলাম, মিনিট দশোকের মধ্যে শঙ্করবাবু এসে পড়লেন। স্নান-টান সেরে ফিটফাট।
আমি কিন্তু ধরা পড়ে গেছি, মিঃ চৌধুরী, বলল ফেলুদা।আপনার বাল্যবন্ধু আমায় চিনে ফেলেছেন।
সে কী?
আপনি ঠিকই বলেছিলেন। ভদ্রলোক গভীর জলের মাছ।
তা হলে কি বলছেন আপনার পরিচয়টা দিয়েই দেব?
তা হলে কিন্তু সেই সঙ্গে আপনার জানিয়ে দিতে হবে আপনি কেন আমাকে ডেকেছেন। অর্থাৎ এতদিন যে কথাটা চেপে রেখেছিলেন সেটা প্রকাশ করতে হবে।
শঙ্করবাবুর কপালে আবার দুশ্চিন্তার রেখা দেখা দিল।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কাঞ্জিলাল আর কালীনাথবাবু বারান্দায় এসে পড়লেন, আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাইরে একটা গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। কাঞ্জিলাল আর. কালীনাথ বারান্দায় রয়ে গেলেন, আমরা চারজন সদর দরজায় গিয়ে হাজির হলাম।
লাল ক্রস-মারা একটা কালো অ্যামবাসাডর থেকে নামলেন জয়ন্তবাবু আর ডাঃ সরকার। জয়ন্তবাবুর মাথার পিছনের চুল খানিকটা কামিয়ে সেখানে প্লাস্টার লাগানো হয়েছে।
জয়ন্তবাবু নেমেই তাঁর দাদার কাছে ক্ষমা চাইলেন। —ভেরি সরি। তোমার জন্মতিথিতে এমন একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেললাম। আসলে প্রেশারটা…।
কোনও চিন্তা নেই, বললেন ডাঃ সরকার। আমি ওষুধ দিয়ে দিয়েছি। তবে রোদে বেশি ঘোরাঘুরি চলবে না।
আপনারা চা খাবেন তো? বললেন শঙ্করবাবু!
তা হলে মন্দ হত না। চা-পানের সময় পাইনি এখনও।
এরা সব কোথায়? জয়ন্তবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
বারান্দায়, বললেন শঙ্করবাবু।
জয়ন্তবাবু আর ডাঃ সরকার বারান্দার দিকে চলে গেলেন।
চলুন, সকলে একসঙ্গেই বসা যাক, ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন শঙ্করবাবু!
দাঁড়ান, আগে একটা কাজ সেরে নেওয়া দরকার।
ফেলুদা কথাটা বেশ জোরের সঙ্গেই বলল। কী কাজের কথা বলছে ও?
কাজ? শঙ্করবাবু একটু যেন অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন।
আপনার খুড়িমার কাছে সিন্দুকের যে ডুপ্লিকেট চাবিটা আছে সেটা চাইলে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই।
তা নিশ্চয়ই যাবে, কিন্তু–
একবার সিন্দূকটা খুলে দেখতে চাই।
খুড়িমার ঘরে গিয়ে দেখি বুড়ি গামছা নিয়ে স্নানে বেরোচ্ছেন।
আজ তোমার এত দেরি? শঙ্করুব্বাবু প্রশ্ন করলেন।
আর বলিস না। চোখ মেলে দেখি ঝাঁ ঝাঁ রোদ। একেকদিন কী যে হয়!
তোমার চাবিগোছাটা একবার দিতে হবে খুড়িমা। সিন্দুকটা খুলব।
কিন্তু তোর কাছে যে–?
আমারটা খুঁজে পাচ্ছি না।
খুড়িমা আলমারি খুলে চাবির গোছা বার করে দিয়ে চলে গেলেন।
শঙ্করবাবু সিন্দুকের দিকে এগিয়ে গেলেন, আর সেই ফাঁকে কেন জানি ফেলুদা হামানদিস্তাটা হাতে নিয়ে একবার নেচেচেড়ে দেখল।
সৰ্ব্বনাশ!
শঙ্করবাবুর চিৎকারে চমকে লালমোহনবাবু সেলিম আলির বইটা তাঁর হাত থেকে ফেলেই দিলেন।
থলি বাক্স কিছুই নেই, বলল ফেলুদা।
শঙ্করবাবুর ফ্যাকাসে মুখ দিয়ে কথাই বেরোচ্ছে না।
ওটা বন্ধ করুন, বলল ফেলুদা।তারপর চলুন নীচে যাওয়া যাক। সত্য উদঘাটনের সময় এসেছে। আমার আসল পরিচয়টা সকলকে জানিয়ে দিন এবং কতকগুলো প্রশ্ন করব। সেটাও জানিয়ে দিন।
বুঝতে পারছি শঙ্করবাবুকে অনেকখানি মনের জোর প্রয়োগ করতে হচ্ছে, কিন্তু তিনি গত বছরের চুরির ব্যাপারটা আর আজ এইমাত্র সিন্দুক খুলে যা দেখলেন সেটা মোটামুটি গুছিয়ে সকলকে বলে বললেন, আমার বাড়িতে আমারই অতিথি হয়ে এসে আমার এত কাছের লোক যে এমন একটা কাজ করতে পারে সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু ঘটনা যে ঘটেছে তাতে কোনও ভুল নেই, আর সেই কারণেই আমি কলকাতার স্বনামধন্য ইনভেসটিগেটর প্রদোষ মিত্ৰকে ডেকেছি। এর কিনারা করার জন্য। ইনি তোমাদের কয়েকটা প্রশ্ন করবেন। আশা করি তোমরা তার ঠিক জবাব দেবে।
সকলে চুপ। কার মনে কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে দেখে বোঝার উপায় নেই।
ফেলুদা শুরু করল। প্রথম প্রশ্নটা ডাঃ সরকারকে, আর সেটা যাকে বলে অপ্রত্যাশিত।
ডাঃ সরকার, আপনাদের এই পানিহাটিতে কটা হাসপাতাল আছে?
একটাই বললেন ডাঃ সরকার।
তার মানে সেখানেই আপনি নিয়ে গিয়েছিলেন জয়ন্তবাবুকে, আর সেখান থেকেই কাল রাত্রে ফোন করেছিলেন?
হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন জানতে পারি কি?
কারণ আজ সকালে আমি সে হাসপাতালে গিয়েছিলাম, জয়ন্তবাবু সেখানে যাননি।