কার্যসিদ্ধি?
জয়ন্তবাবুকে অজ্ঞান করে তাঁর হাত থেকে চাবিটা নিয়ে সিন্দুক খুলে যা বার করার বার করে আবার হাতে চাবি গুঁজে দিয়ে চলে আসা।
সর্বনাশ! এটা তো খেয়াল হয়নি আমার। আমি বললাম তাই যদি হয়ে থাকে তা হলে তো এখন তিনজনের জায়গায় সাসপেক্ট মাত্র দুজন—কাঞ্জিলাল আর কালীনাথ।
নারে তোপ্সে, বলল ফেলুদা ব্যাপারটা অত সহজ নয়। জয়ন্তবাবুর মাথায় কেউ বাড়ি মারলে তো সেটা তিনি জ্ঞান হলে বলতেন; তা তো বলেননি। আর অজ্ঞান করে যে সিন্দুক খুলবে সেটাই বা কী করে সম্ভব-খুড়িমা তো ঘরে থাকতে পারেন। একজন বাইরের লোক সিন্দুক খুলছে দেখলে কি তিনি চুপ করে থাকতেন?
একটা আশার আলো জুলতে না জ্বলতে নিভে গেল। আমি শুয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু অত তাড়াতাড়ি আর ঘুমোনো হল না। ফেলুদা এমনিতেও পায়চারি করছিল, বারোটা নাগাদ লালমোহনবাবু হঠাৎ আমাদের ঘরে এসে নিচু গলায় বললেন, বারান্দায় গোসলুম। চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, মশাই—উপচে পড়ে আলো!
উপ্চে নয়, উছলে, বলল ফেলুদা।
সরি, উছ্লে। কিন্তু একবার বাইরে এসে দেখুন। এ দৃশ্য দেখবেন না। কখনও।
আপনি এক কাব্যি করবেন, এটা হতে দেওয়া যায় না, বলল ফেলুদা। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম।
বাইরে গিয়ে মনে হল এ যেন দিনের বেলার দৃশ্যর চেয়েও ঢের বেশি সুন্দর। একটা পাতলা কুয়াশা নদীর ওপারটাকে প্রায় অদৃশ্য করে ফেলেছে। গঙ্গার আবছা গাঢ় জলের উপর ছড়ানো চাঁদির টুকরোগুলো ধীরে ধীরে দুলছে। তারই মধ্যে ঝিঝির ডাক, হাসনুহানার গন্ধ, ফুরফুরে বাতাস, সব মিলিয়ে সত্যিই অমরাবতী।
ফেলুদা ত্ৰয়োদশীর চাঁদটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, চাঁদের মাটিতে মানুষের পা পড়লেও, এর মজা কোনওদিন নষ্ট করতে পারবে না।
একটা মারাত্মক পোয়েম আছে চাঁদ নিয়ে, বললেন লালমোহনবাবু।
আপনার এথিনিয়াম ইনস্টিটিউশনের সেই বাংলার শিক্ষকের লেখা?
ইয়েস। বৈকুণ্ঠ মল্লিক। এই পোড়া দেশে লোকটা রেকগনিশন পেলে না, কিন্তু আপনি শুনুন কবিতাটা। শোনো, তপেশ।
এতক্ষণ আমরা নিচু গলায় কথা বলছিলাম। কিন্তু আবৃত্তির সময় লালমোহনবাবুর গলা আপনা থেকেই চড়ে গেল।
আহা, দেখ চাঁদের মহিমা
কতু বা সুগোল রৌপ্যথালি
কতু আধা কভু সিকি কভু একফালি
যেন সদ্য কাটা নখ পড়ে আছে নভে—
সেটুকুও নাহি থাকে, যাবে
আসে অমাবস্যা——
সেই রাতে তুমি তাই
অচন্দ্রমপশ্যা!
বুঝতেই পারছি, তপেশ, পদটি একজন লেডিকে অ্যাড্রেস করে লেখা।
একজন লেডিকে তো আপনি আবৃত্তির ঠেলায় ঘর থেকে টেনে বার করেছেন দেখছি।
ফেলুদার দৃষ্টি দোতলার বারান্দার দিকে। এই যে খুড়িমার ঘর। বৃদ্ধ বারান্দার দরজার মুখটাতে এসে দাঁড়িয়েছেন; মিনিটখানেক এদিক ওদিক দেখে আবার ভিতরে ঢুকে গেলেন।
এর পরে আমরা ঘাটের সিঁড়িতে গিয়ে বসেছিলাম আধা ঘণ্টা। মনমেজাজ তাজা, রাতের খাওয়া হজম। তারপর এক সময় ফেলুদা তার হাতঘড়ির রেডিয়াম ডায়াল চোখের সামনে ধরে বলল, পৌনে এক।
আমরা তিনজনেই উঠে পড়লাম, আর তিনজনেই একসঙ্গে শুনলাম শব্দটা।
সেটা যেন আসছে বাড়ির দোতলা থেকেই।
খট্ খট্ খটু খট্ ঠং খট্ খট্…
আমরা ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলাম।
সিঁদ কাটছে নাকি মশাই? লালমোহনবাবু ফিসফিস্ করে জিজ্ঞেস করলেন। আলো জ্বলছে। আওয়াজটা আসছে ওই ঘর থেকে।
খট্ খট্ খটু খট্ ঠং ঠং…
কিন্তু এই ঘর ছাড়াও আরেকটা ঘরে আলো জ্বলছে। দক্ষিণ দিকের ঘরটিা। খোলা জানাল দিয়ে দেখা যাচ্ছে একজন লোক দাঁড়িয়ে হাত পা নেড়ে উত্তেজিত ভাবে কথা বলছে।
এবার লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
মিঃ কাঞ্জিলাল, বলল ফেলুদা।ওটাই শঙ্করবাবুর ঘর।
এই মাঝরাত্তিরে কী আলোচনা মশাই? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন।
জানি না, বলল ফেলুদা। ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু হবে।
আপনাদেরও ঘুম আসছে না?
নতুন গলা পেয়ে চমকে উঠে দেখি ম্যাজিশিয়ান কালীনাথবাবু।
ভদ্রলোক সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন। খট্ খট্ শব্দটা এখনও হয়ে চলেছে। কালীনাথবাবুর ঘাড় ঘুরে গেল সেই দিকে।
কীসের শব্দ বুঝতে পারছেন তো? প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক।
হামানদিস্তা কি? ফেলুদা বলল।
ঠিক বলেছেন। এই মাঝরাত্তিরে বুড়ি পান ছাঁচতে বসেন। এ শব্দ আগেও পেয়েছি।
কথাটা বলে হাতের তেলের আড়ালে দেশলাই জ্বলিয়ে সিগারেট ধরিয়ে ফেলুদার দিকে একটা সেয়ানা দৃষ্টি দিয়ে বললেন, বনোয়ারিলালের জীবনী লেখার জন্য গোয়েন্দার দরকার হল কেন?
আমি তো থ! লালমোহনবাবুর মুখ হাঁ হয়ে গেছে। ফেলুদা একটু হালকা হেসে বলল, যাক্, অন্তত একজন আমার আসল পরিচয়টা জানে দেখে ভালই লাগল।
তা জানবে না কেন মিঃ মিত্তির? এ শর্ম অনেক ঘাটের জল খেয়েছে। অনেক কিছু দেখে শুনে চোখ কান দুইই খুলে গেছে।
ফেলুদা একদৃষ্টি চেয়ে আছে ভদ্রলোকের দিকে। তারপর বলল, আপনি কি রহস্যই করবেন, না খুলে বলবেন?
খুলে আর কজনে বলতে পারে মিঃ মিত্তির? স্পষ্টবক্তা আর কজনে হয়? বেশির ভাগই তো মুখচারা। আর দুঃখের বিষয়, আমিও যে সেই দলেই পড়ি। আপনি গোয়েন্দা, খুলে বলার কাজ হল আপনার; তবে আপনাকে আমি একটা কথা বলতে চাই। এখানে এসে আপনার পেশাটাকে কাজে লাগানোর কথা ভুলে যান। অমরাবতীতে এসেছেন, দুদিন ফুর্তি করে গঙ্গার হাওয়া খেয়ে ফিরে যান। নইলে বিপদে পড়তে পারেন।
আপনার উপদেশের জন্য ধন্যবাদ।