আর কালীনাথ? প্রশ্ন করলেন শঙ্করবাবু।
সে তো বাগানে নেমেই আলাদা হয়ে গেল! বলছিল শুকনো ফুলকে টাটকা করে দেবার একটা ম্যাজিক দেখাবে, তাই–
মিঃ কাঞ্জিলালের কথা আর শেষ হল না, কারণ সেই সময় বুড়ে চাকর অনন্তর চিৎকার শোনা গেল।
দাদাঝাবু!
অনন্ত গঙ্গার দিকে বারান্দায় সিঁড়ি দিয়ে নেমে অত্যন্ত ব্যস্তভাবে ছুটে এল আমাদের দিকে।
কী হল অনন্ত? শঙ্করবাবু উদ্বিগ্নভাবে প্রশ্ন করে এগিয়ে গেলেন।
ছোট দাদাবাবু অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন দোতলায়।
০৩. খুড়িমার ঘর
দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠে ল্যান্ডিং পেরিয়েই খুড়িমার ঘর, সেটা আগেই বলেছি। জয়ন্তবাবু সেই ঘরের চৌকাঠের হাত তিনেক এদিকে চিত হয়ে পড়ে আছেন, তাঁর মাথার পিছনের মেঝেতে খানিকটা রক্ত চুঁইয়ে পড়েছে।
ডাক্তার সরকার দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠে সবচেয়ে আগে পৌঁছে জয়ন্তবাবুর নড়ি টিপে ধরলেন। ফেলুদাও প্রায় একই সঙ্গে পৌঁছে জয়ন্তবাবুর পাশে হাঁটু গেড়ে বসেছে। তার মুখ গম্ভীর, কপালে খাঁজ।
কী মনে হচ্ছে? চাপা গলায় প্রশ্ন করলেন শঙ্করবাবু।
পালস সামান্য দ্রুত, বললেন ডাঃ সরকার।
মাথার জখমটা?
মনে হচ্ছে পড়ে গিয়ে হয়েছে। এই সময় খালি মাথায় রোদে ঘোরা ডেনজারাস সেটা অনেকবার বলেছি ওঁকে।
কনকাশন—?
সেটা তা পরীক্ষা না করে বলা সম্ভব না। আজ আবার আমি যন্ত্রপাতি কিছুই আনিনি সঙ্গে। একবার হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে ভাল হত।
তই করুন না। গাড়ি তো রয়েছে।
ভদ্রলোক বেশ ভাল ভাবেই অজ্ঞান হয়েছেন, কারণ ফেলুদা সমেত চারজন ধরাধরি করে গাড়িতে তোলার সময়ও তাঁর জ্ঞান হল না। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় অবিশ্যি কালীনাথবাবুর সঙ্গেও দেখা হল। বললেন, আমি জাস্ট ওষুধটা খাবার জন্য ঘরে গেছি—আর তার মধ্যে এই কাণ্ড!
আমি সঙ্গে আসব কি? শঙ্করবাবু ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন।
কোনও দরকার নেই, বললেন ডাঃ সরকার, আমি হাসপাতাল থেকে আপনাকে ফোন করব।
গাড়ি চলে গেল। এই দুর্ঘটনার জন্য শঙ্করবাবুর প্ল্যান যে ভেস্তে গেল সেটা বুঝতে পারছি। বেচারি ভদ্রলোকের জন্মতিথিতে এমন একটা ঘটনা ঘটার জন্য আমারও খারাপ লাগছিল।
আমরা সবাই এসে বসবার ঘরে বসেছিলাম, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফেলুদা কেন যে, ‘আমি আসছি’ বলে উঠে গেল তা জানি না। অবিশ্যি মিনিট দুয়েকের মধ্যে আবার ফিরে এল।
শঙ্করবাবু অতিথিদের সামনে যথাসম্ভব স্বাভাবিক হাসিখুশি ব্যবহার করছিলেন। এমনকী তাঁর আশ্চর্য প্রপিতামহ সম্বন্ধে অদ্ভুত সব ঘটনাও বলছিলেন, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম যে সেটা করতে তাঁর বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
প্রায় ঘণ্টাখানেক। এইভাবে চলার পর হাসপাতাল থেকে ডাঃ সরকারের ফোন এল। জয়ন্তবাবুর জ্ঞান হয়েছে। তিনি অনেকটা ভাল। মনে হচ্ছে কাল সকালেই আসতে পারবেন।
এই সুখবরের পর অবিশ্যি ঘরের আবহাওয়া খানিকটা হালকা হল, কিন্তু আমি জানি যে শঙ্করবাবুর মোটেই ভাল লাগছে না, কারণ চোরের রহস্য রহস্যই থেকে যাবে।
খাওয়া দাওয়ার পর, ভিডিও-ক্যাসেট ছবি দেখতে চাই কি না জিজ্ঞেস করাতে আমরা সকলেই না বললাম। এ অবস্থায় ফুর্তি চলে না। তাই ম্যাজিকও বাদ পড়ল।
সকলকে গুড নাইট জানিয়ে নিজেদের ঘরে আসতেই আমি যে প্রশ্নটা ফেলুদাকে করব ভাবছিলাম, সেটা লালমোহনবাবু করে ফেললেন।
আপনি তখন ফস করে বেরিয়ে কোথায় গেলেন মশাই?
খুড়িমার ঘরে।
খুড়িমাকে দেখতে গেসলেন? অবিশ্বাসের সুরে প্রশ্নটা করলেন লালমোহনবাবু।
সেই সঙ্গে অবিশ্যি সিন্দুকের হাতল ধরে একটা টানও দিয়ে এলাম।
খোলা নাকি?
বন্ধ। সেটাই স্বাভাবিক। যে ভাবে ঘরের দরজার দিকে পা করে পড়েছিলেন ভদ্রলোক, তাতে মনে হয়। ঘরে ঢোকার আগেই পড়েছেন।
কিন্তু চাবিটা কোথায়, ফেলুদা? আমি জিজ্ঞেস করলাম। প্রশ্নটা কিছুক্ষণ থেকেই আমার মাথায় ঘুরছিল।
ফেলুদা বলল, শঙ্করবাবু হয়তো দুর্ঘটনায় ওটার কথা ভুলেই গিয়েছিলেন।
কথাটা বলতে বলতেই শঙ্করবাবু এসে ঢুকলেন আমাদের ঘরে। দেখুন তো কী বিশ্ৰী ব্যাপার ঘটে গেল! বললেন ভদ্রলোক। জয়ন্তর আর একবার এরকম হয়েছিল। ওর ব্লাড প্ৰেশারটা একটু বেশি নেমে যায় মাঝে মাঝে।
ফোনে আর কী বললেন ডাঃ সরকার?
সেটাই তো বলতে এলাম। তখন লোকজনের সামনে বলিনি। চাবির কথাটা তো গোলমালে ভুলেই গিয়েছিলাম; এখন কী হয়েছে জানেন তো? ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করতে বললেন জয়ন্তর কাছে চাবি ছিল না। হয়তো অজ্ঞান হবার সময় হাত থেকে পড়ে গেছে।
আপনি খুঁজেছেন চাবি?
তন্ন-তন্নকরে। সিঁড়ি, ল্যান্ডিং, সদর দরজার বাইরে, কোথাও বাদ দিইনি। সে চাবি হাওয়া।
যাকগে, ডুপ্লিকেট আছে তো, বলল ফেলুদা।ও নিয়ে ভাববেন না।
তা না হয় ভাবব না, গম্ভীরভাবে বললেন শঙ্করবাবু, কিন্তু রহস্য তো দূর হল না! চার তো অজ্ঞাতেই রয়ে গেল। আর আপনাকে একটা মাথা খেলানোর সুযোগ দেব ভেবেছিলাম, সেটাও হল না।
তাতে কী হল? ফেলুদা বলল। এখানে এসে লাভ হয়েছে বিস্তর। একে এরকম বাড়ি, তার উপর আপনার আতিথেয়তা।
শঙ্করবাবু যাবার আগে বলে গেলেন যে সকালে সাড়ে ছটায় চা দেবে, আর আটটায় ব্রেকফাস্ট।
এটা অ্যাটেমটেড মার্ডার নয়তা মশাই? লালমোহনবাবু ফিস্ ফিস্ করে প্রশ্ন করলেন।
মিঃ কাঞ্জিলাল আর মিঃ ম্যাজিশিয়ান দুজনেই কিন্তু বাড়ির মধ্যে ঢুকেছিলেন।
মাডারের দরকার কী? কার্যসিদ্ধির জন্য তো শুধু অজ্ঞান করলেই চলে।