আপনি তাঁকে দেখেই চিনেছিলেন?
তা চিনেছিলাম। তা ছাড়া ইস্কুলের বহু পুরনো গল্প করল। সে যে আমার সহপাঠী তাতে সন্দেহ নেই। গোলমালটা হচ্ছে, সে যে এখন কী করে তা কিছুতেই ভেঙে বলে না। জিজ্ঞেস করলেই বলে, ধরে নাও তোমারই মতো ব্যবসা করে। এদিকে গুণ যে নেই। তা নয়। খুব আমুদে রসিক লোক। ইস্কুলে থাকতে ম্যাজিক দেখাত, এখনও সে অভ্যাসটা রেখেছে। হাত সাফাই রীতিমতো ভাল।
আপনার ভাইও তো অন্ধকারের মধ্যে ঘরে ছিলেন।
সে ছিল। তবে সে তো এ জিনিস আগে দেখেছে, তাই সে টেবিলের কাছে ছিল না। নিয়ে থাকলে ওই তিনজনের একজনই নিয়েছে।
তারপর আপনি কী করলেন?
কী আর করতে পারি বলুন। এমন লোক আছে যারা এই অবস্থায় সোজাসুজি পুলিশ ডেকে তিনজনের বাড়ি সার্চ করাত। কিন্তু আমি পারিনি। ওই তিনজনের সঙ্গে বসে কত ব্রিজ খেলেছি, আর তাদের একজনকে বলব চোর?
তার মানে স্রেফ হজম করে গেলেন ব্যাপারটা?
স্রেফ হজম করে গেলাম। ফলে এখনও কেউ জানেই না যে আমি ব্যাপারটা টের পেয়েছি। সেই ঘটনার পরেও তো এদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কতবার, কিন্তু কেউ তো কোনওরকম অসোয়াস্তি বা অপরাধ বোধ করছে বলে মনে হয়নি। অথচ আমি জানি যে এই তিনজনের মধ্যেই একজন দোষী। একজন চোর।
আমরা তিনজনেই চুপ। ঘটনাটা অদ্ভুত তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ অবস্থায় কী করা যায়?
আমার মনের প্রশ্নটা ফেলুদাই করল। শঙ্করবাবু বললেন, এরা জানে যে আমি এদের সন্দেহ করি না। তাই এদের আবার ডেকেছি, এবং আজ রাত্রে আমি আবার এদের সামনে বনোয়ারিলালের কিছু মূল্যবান জিনিস বার করব। মাসখানেক থেকে ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় সন্ধ্যা সাতটায় লোডশেডিং হচ্ছে এখানে। তার ঠিক আগে আমি জিনিসগুলো টেবিলে সাজাব। ঘর আবার অন্ধকার হবে। আশা করছি সেই অন্ধকারে চারের প্রবৃত্তি আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। সব মিলিয়ে এই সম্পত্তির মূল্য চল্লিশ-পঞ্চাশ লাখের কম নয়। হয়তো আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু আমার বিশ্বাস চার লোভ সামলাতে পারবে না। চুরির পর আপনি আপনার আসল ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। তখন প্রদোষ মিত্তিরের কাজ হবে চার ধরা এবং চোরাই মাল বার করা।
ফেলুদা বলল, আপনার ভাই এ সম্বন্ধে কী বলেন?
সেও তো কাল অবধি কিছুই জানত না, বললেন শঙ্করবাবু, কাল আপনাকে ইনভাইট করার পর ওকে বলি।
উনি কী বললেন?
খুব চাটপাট করল। বলল–তুমি অ্যাদ্দিন চেপে রেখেছ ব্যাপারটা।–তখন তখনই পুলিশে খবর দেওয়া উচিত ছিল। এক বছর পরে কি মিঃ মিত্তির কিছু করতে পারবেন, ইত্যাদি।
একটা কথা বলব মিঃ চৌধুরী?
বলুন।
আপনি মানুষটা এত নরম বলেই কিন্তু চার তার সুযোগটা নিয়েছিল। অতিথিকে চুরির অপবাদ দিতে সবাই পেছপা হত না।
সেটা জানি। সেই জন্যই তো আপনাকে ডাকা। আমি যেটা পারিনি, সেটা আপনি পারবেন।
০২. গঙ্গার ইলিশ
সরষেবাটা দিয়ে চমৎকার গঙ্গার ইলিশ সমেত দুপুরের খাওয়াটা হল ফাস্ট ক্লাস। জয়ন্তবাবুর সঙ্গে আলাপ হল খাবার টেবিলে। ইনি মাঝারি হাইটের চেয়েও কম, বেশ সুস্থ, সবল মানুষ। শঙ্করবাবুর পাসোনালিটি এঁর নেই, কিন্তু বেশ হাসিখুশি চালাক চতুর লোক।।
খাবার পর শঙ্করবাবু বললেন, আপনাদের এখন আর ডিস্টার্ব করব না, যা মন চায় করুন। আমি একটু গড়িয়ে নিই। বিকেলে চায়ের সময় বারান্দায় আবার দেখা হবে।
আমরা জয়ন্তবাবুর সঙ্গে বাড়ির আশপাশটা ঘুরে দেখব বলে বেরোলাম।
পশ্চিম দিকে একটানা একটা নিচু থামওয়ালা পাঁচিল চলে গেছে নদীর ধার দিয়ে। পাঁচিলের পরেই জমি ঢালু হয়ে নেমে গেছে জল অবধি। এই পাঁচলাই বাকি তিনদিকে হয়ে গেছে। দেড় মানুষ উঁচু। জয়ন্তবাবুর ফুলের শখ, তাই তিনি আমাদের বাগানে নিয়ে গিয়ে গোলাপ সম্বন্ধে একটা ছাটখাটা বক্তৃতা দিয়ে দিলেন। গোলাপ যে তিনশো রকমের হয় তা এই প্ৰথম জানলাম।
বাড়ির উত্তরে গিয়ে দেখলাম সেদিকে আর একটা গেট রয়েছে। শহরে কোথাও যেতে হলে এই গোটটাই নাকি ব্যবহার করা হয়।
আরেকটা সিঁড়িও রয়েছে এদিকে। জয়ন্তবাবু বললেন খুড়িমা, মানে ওঁর মা, গঙ্গাস্নানে যেতে ওটাই ব্যবহার করেন। একতলায় নদীর দিকে আর গঙ্গার দিকে চওড়া বারান্দা, দুদিক দিয়েই সিঁড়ি রয়েছে নীচে নামার জন্য।
দেখা শেষ হলে পর আমরা ঘরে ফিরে এলাম। জয়ন্তবাবু কাচের ঘরে চলে গেলেন অর্কিড দেখার জন্য।
আমাদের থাকার জন্য একতলায় একটা প্যাসেজের এক দিকে পর পর দুটো ঘর দেওয়া হয়েছে। উলটোদিকে আরও তিনটে পাশাপাশি ঘর দেখে মনে হল তাতেই বোধহয় তিনজন অতিথি থাকবেন। ঘরে ঢুকে বাহারে খাটে নরম বিছানা দেখে লালমোহনবাবু বোধহয় দিবানিদ্রার তাল করছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বললেন, পাখির বইগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া দরকার।
আমি একটা কথা ফেলুদাকে না জিজ্ঞেস করে পারলাম না।
আচ্ছা, এক বছর আগে যে লোক চুরি করেছে, সে যদি এবার আর চুরি না করে, তা হলে তুমি চার ধরবে কী করে?
ফেলুদা বলল, সেটা এই তিন ভদ্রলোককে স্টাডি না করে বলা শক্ত। যার মধ্যে চুরির প্রবৃত্তি রয়েছে, তার সঙ্গে আর পাঁচটা অনেস্ট লোকের একটা সূক্ষ্ম তফাত থাকা উচিত। চোখ-কান খোলা রাখলে সে তফাত ধরা পড়তে পারে। ভুলিস না, যে লোক চুরি করে তার বাইরেট যতই পালিশ করা হোক না কেন তাকে আর ভদ্রলোক বলা চলে না। সত্যি বলতে কী, ভদ্রলোক সাজার জন্য তাকে যথেষ্ট অভিনয় করতে হয়।