আমরা মিনিটখানেকের মধ্যেই উঠে পড়লাম।
সিঁড়িতে পৌঁছাতে হলে বৈঠকখানা দিয়ে যেতে হয়। এখানে বলে রাখি—বহারের আসবাব, কার্পেট, মখমলের পদা, ঝাড়লণ্ঠন, শ্বেতপাথরের মূর্তি ইত্যাদি মিলিয়ে এমন জমজমাট বৈঠকখানা আমি বেশি দেখিনি।
সিঁড়ি উঠতে উঠতে ফেলুদা বলল, আপনার খুড়িমা ছাড়া দোতলায় আর কে থাকেন?
খুড়িমা থাকেন উত্তর প্রান্তে, বললেন শঙ্করবাবু, আর দক্ষিণে থাকি আমি। জয়ন্ত এলেও দক্ষিণেরই একটা ঘরে থাকে।
দোতলার ল্যান্ডিং পেরিয়ে আমরা ঢুকলাম খুড়িমার ঘরে। বেশ বড় ঘর, কিন্তু এতে কোনও জাঁকজমক নেই। পশ্চিমে দরজার বাইরে আলো আর বাতাসের বহর দেখে বোঝা যায়। ওদিকেই গঙ্গা। দরজার পাশেই বুড়ি মাদুরে বসে মালা জাপছেন। তাঁর পাশে একটা হামানদিস্তা, একটা পানের বাটা আর একটা মোটা বই। নিঘাঁত রামায়ণ কি মহাভারত হবে। আসবাব বলতে একটা খাট আর একটা ছোট আলমারি।
আমরা ঘরে ঢুকতেই খুড়িমা মাথা তুলে পুরু চশমার ভিতর দিয়ে আমাদের দিকে চাইলেন।
কজন অতিথি এসেছেন কলকাতা থেকে, বললেন শঙ্করবাবু।
তাই এই ঘাটের মড়াকে দেখাতে আনলি?
আমরা তিনজনে এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করতে বৃদ্ধ বললেন, তা বাপু তোমাদের পরিচয় জেনে আর কী হবে, নাম তো মনে থাকবে না। নিজের নামটাই ভুলে যাই মাঝে মাঝে। এখন তো বসে বসে দিন গোনা।
আসুন—
শঙ্করবাবুর ডাকে আমরা ঘুরলাম। বৃদ্ধ আবার বিড়বিড় করে মালা জপতে শুরু করলেন।
এবার দেখলাম ঘরের উলটাদিকে খাটের পাশে একটা প্ৰকাণ্ড সিন্দুক রয়েছে। শঙ্করবাবু পকেট থেকে চাবি বার করে সিন্দুকটা খুলতে খুলতে বললেন, এবারে আপনাদের যে জিনিস দেখাব সে হল আমার প্রপিতামহের সম্পত্তি। রামপুরে থাকতে বহু নবাব-তালুকদার তাঁর মক্কেল ছিলেন। এগুলো তাঁদের উপটৌকন। এরই বেশ কিছু আমার ঠাকুরদাদা বিপাকে পড়ে বেচে দিয়েছিলেন। তবে তার পরেও কিছু আছে। যেমন এই যে দেখুন–
শঙ্করবাবু একটা থলি বার করে তার মুখটা ফাঁক করে হাতের তেলোয় উপুড় করলেন। ঝনঝন করে কিছু গোল চাকতি তেলোয় পড়ল।
জাহাঙ্গীরের আমলের স্বর্ণমুদ্রা, বললেন শঙ্করবাবু।দেখুন, প্রত্যেকটিতে একটি করে রাশির ছবি খোদাই করা। এই জিনিস একেবারেই দুষ্প্রাপ্য।
রাশিচক্র হলে এগারোটা কেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।বারোটা হওয়া উচিত নয় কি?
একটা মিসিং।
আমরা পরস্পরের দিকে চাইলাম।
আরও জিনিস আছে, বললেন শঙ্করবাবু, সেগুলো এই আইভরির বাক্সটার মধ্যে। সোনার উপর চুনি বসানা ইটালিয়ান নস্যির কৌটো, জেড পাথরে চুনি আর পান্না বসানা মোগল সুরাপত্র, আংটি, লকেট…কিন্তু সে সব আপনারা দেখবেন আজ সন্ধ্যাবেলা, সর্বসমক্ষে। এখন নয়।
এর চাবি তো আপনার কাছেই থাকে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ, আমার কাছেই। একটা ডুপলিকেট আছে, থাকে খুড়িমার আলমারিতে।
কিন্তু সিন্দুক আপনার ঘরে নয় কেন?
এ ঘরটা অতীতে ছিল আমার প্রপিতামহের ঘর। সিন্দুক তাঁরই আমলের। ওটা আর সরাইনি। আর কড়া পাহারা আছে গেটে, এ ঘরে খুড়িমা প্রায় সর্বক্ষণ থাকেন, তাই এক হিসেবে ওটা এখানে যথেষ্ট সেফ।
আমরা আবার নীচের বারান্দায় ফিরে এলাম। চেয়ারে বসার পর ফেলুদা টেপরেকডার চালু করে দিয়ে বলল, একটি মুদ্রা মিসিং হল কী করে?
সে কথাই তো বলছি, বললেন শঙ্করবাবু। তিনজনকে উইক এন্ডে নেমন্তান্ন করেছিলাম গত জন্মতিথিতে। একজন হলেন আমার বিজনেস পার্টনার নরেশ কাঞ্জিলাল। আরেকজন এখানকারই ডাক্তার অর্ধেন্দু সরকার। আর তৃতীয় ব্যক্তি হলেন কালীনাথ রায়। ইনি ইস্কুলে আমার সহপাঠী ছিলেন; পিয়ত্ৰিশ বছর পর আবার, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমার প্রপিতামহের মহামূল্য সম্পত্তির কথা। এঁরা সকলেই শুনেছিলেন, কিন্তু চোখে দেখেননি। আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত্তিরে ডিনারের পর জয়ন্ত সিন্দুক থেকে স্বর্ণমুদ্রার থলিটা বার করে নীচে বৈঠকখানায় আনে। কয়েনগুলো টেবিলের উপর ছড়িয়ে রেখেছি, সকলে ঘিরে দেখছে, এমন সময় হল লোডশেডিং। ঘর অন্ধকার। এটা অবিশ্যি অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। চাকর দুমিনিটের মধ্যে মামবাতি নিয়ে আসল, আমি কয়েনগুলো তুলে নিয়ে আবার সিন্দুকে রেখে এলাম। একটা যে কমে গেছে সেটা তখন খেয়াল করিনি। এমন যে হতে পারে কল্পনাও করিনি। পরদিন সকলে চলে যাবার পর মনে একটা খটকা লাগাতে সিন্দুক খুলে দেখি কৰ্কট রাশির মুদ্রাটি নেই।
কয়েনগুলো আপনিই তুলে রেখেছিলেন?
হ্যাঁ, আমি। ব্যাপারটা বুঝুন। মিঃ মিত্তির। তিনজন নিমন্ত্রিত। একজনকে পাঁচশ বছর চিনি—আমার বিজনেস পার্টনার। অর্ধেন্দু সরকার হলেন ডাক্তার এবং ভালই ডাক্তার। খড়দা টিটাগড় থেকে কল আসে ওঁর। আর কালীনাথ আমার বাল্যবন্ধু।
কিন্তু এদের সকলকেই কি অনেস্ট লোক বলে জানেন আপনি?
সেখানেই অবিশ্যি গণ্ডগোল। কাঞ্জিলালের কথা ধরুন। ব্যবসায় অনেকেই জেনেশুনে অসৎ পস্থা নেয়, কিন্তু কাঞ্জিলালের মতো এমন অম্লান বদনে নিতে আমি আর কাউকে দেখিনি। আমাকে ঠাট্টা করে বলে—তুমি ধর্মযাজক হয়ে যাও, তোমার দ্বারা ব্যবসা হবে না।
আর অন্য দুজন?
ডাক্তারের কথা আমি জানি না। খুড়িমা মাঝে মাঝে বাতে ভোগেন, ডাক্তার তাঁকে এসে দেখে যান। এর বেশি জানি না। তবে কালীনাথ বোধহয় গভীর জলের মাছ। এক যুগ দেখা নেই, হঠাৎ এক’দিন টেলিফোন করে আমার কাছে এল। বলল-বয়স যত বাড়ছে ততই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। তাই একবার ভাবলাম তোমার সঙ্গে দেখা করি।