আমার নামও তো একটা চাই বললেন লালমোহনবাবু।
আপনি হলেন ভবতোষ সিংহ, আপনার ভাইপো প্রবীর আর আমি সামেশ্বর রায়। পৌনে নটায় রওনা হয়ে আমরা দশটা বেজে পাঁচে পানিহাটিতে শঙ্করপ্রসাদ চৌধুরীর বাড়ি অমরাবতীতে পৌঁছে গেলাম। আমাদের গাড়ি দেখেই বন্দুকধারী গুখ দারোয়ান এসে বিকট ক্যাঁ-চ শব্দে লোহার গেট খুলে দিল।
ফেলুদা বলে, গল্পের শুরুতেই একগাদা বর্ণনা হাড় হড় করে ঢেলে দিলে পাঠক হাবুডুবু খায়; ওটা দিবি গল্পের ফাঁকে ফাঁকে। তাই শুধু বলছি—বিশাল জমির ওপর লাল বাড়িটা পোল্লায়, থমথমে আর অনেকটা বিলিতি কাসলের ধাঁচে তৈরি। বাড়ির দক্ষিণে ফুলবাগান, তার পরে গাছপালা রাখার কাচের ঘর, আর তারও পরে ফলবাগান। নুড়ি বিছানা প্যাঁচালো পথ দিয়ে আমরা সদর দরজায় পৌঁছলাম।
বাড়ির মালিক গাড়ির শব্দ পেয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, আমরা নামলে হেসে বললেন, ওয়েলকাম টু অমরাবতী। এর বর্ণনা হল—মাঝারি হাইট, ফরসা রং, বয়স পঞ্চাশ-টঙ্কাশ। পরনে পায়জামা আর আদির পাঞ্জাবি, পায়ে শুড় তোলা লাল চটি, ডান হাতে চুরুট।
আমার খুড়তুতো ভাই জয়ন্তও কাল এসেছে, তাকেও দলে টেনে নিয়েছি। অর্থাৎ সে আপনার আসল পরিচয় জানলেও অন্যদের সামনে প্ৰকাশ করবে না।
অন্যরা কি এসে গেছেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
না। তাঁরা আসবেন বিকেলে। চলুন, একটু বসে জিরোবেন। আর সেই সুযোগে কিছু কথাও হবে।
আমরা বাড়ির পশ্চিমদিকের বিরাট চওড়া বারান্দায় গিয়ে বসলাম। সামনে দিয়ে গঙ্গা বয়ে চলেছে, দেখলেও চোখ জুড়িয়ে যায়। অমরাবতীর প্রাইভেট ঘাটও দেখতে পাচ্ছি। সামনে ডান দিকে। একটা তোরণের নীচ দিয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে জল অবধি।
ওই ঘাট কি ব্যবহার হয়? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
হয় বইকী, বললেন শঙ্করবাবু। আমার খুড়িমা থাকেন তো এখানে। উনি রোজ সকালে গঙ্গাস্নান করেন।
উনি একা থাকেন এ বাড়িতে?
এক কেন? আমিও তো দু বছর হল এখানেই থাকি। টিটাগড় আমার কাজের জায়গা। কলকাতায় আমহাস্ট স্ট্রিটের বাড়ির চেয়ে এ বাড়ি অনেক কাছে হয়।
আপনার খুড়িমার বয়স কত?
সেভেনটি এইট। আমাদের পুরনো চাকর অনন্ত ওঁর দেখাশোনা করে। এমনিতে
আর মাথায় সামান্য ছিট দেখা দিয়েছে। নাম ভুলে যান, খেতে ভুলে যান, মাঝরাত্তিরে পান ছাঁচতে বসেন—এই আর কী। ঘুম তো এমনিতে খুবই কম— রাত্তিরে ঘণ্টা দুয়েকের বেশি নয়। আসলে চার বছর আগে কাকা মারা যাওয়ার পর উনি আর কলকাতায় থাকতে চাননি। এখানে থাকাটা ওঁর কাছে একরকম কাশীবাসের মতো।
বেয়ারা ট্রেতে করে চা আর মিষ্টি নিয়ে এল।
দুপুরে খেতে খেতে সেই একটা-দেড়টা হবে, বললেন শঙ্করবাবু, কাজেই আপনার মিষ্টিটিার সদ্ব্যবহার করুন। এ মিষ্টি কলকাতায় পাবেন না।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে ফেলুদা বলল, আমাদের আসল আর নকল দুটো পরিচয়ই তো জানেন, এবার আপনাদের পরিচয়টা পেলে ভাল হত। আপনি কী করেন জিজ্ঞেস করাটা কি অভদ্রতা হবে?
মোটেই না, বললেন শঙ্করবাবু।আপনাকে ডেকেছি তো সব কথা খুলে বলবার জন্যেই; না হলে আপনি কাজ করবেন কী করে?—সোজা কথায় আমি হলাম ব্যবসাদার। বুঝতেই পারছেন, এত বড় বাড়ি যখন মেনটেন করছি তখন ব্যবসা আমার মোটামুটি ভালই চলে।
আপনার কি বংশানুক্রমিক ব্যবসা?
না। এ বাড়ি তৈরি করেন আমার প্রপিতামহ–বনোয়ারিলাল চৌধুরী।
অর্থাৎ যাঁর জীবনী লিখতে যাচ্ছি। আমি?
এগজ্যাক্টলি। তিনি ছিলেন রামপুরের ব্যারিস্টার। অগাধ পয়সা করে শেষ বয়সে কলকাতায় চলে আসেন; এসে এই বাড়িটা তৈরি করেন। উনি এখানেই থাকতেন, এখানেই মৃত্যু হয়। ঠাকুরদাদাও ব্যারিস্টার ছিলেন, তবে তাঁর পিসার আমার প্রপিতামহের মতো ছিল না। তার দুটো কারণ—জুয়া আর মন্দ। তার ফলে চৌধুরী পরিবারের অবস্থা কিছুটা পড়ে যায়। বাড়িতে বনোয়ারিলালের কিছু মূল্যবান সম্পত্তি ছিল—সেগুলোর কথায় পরে আসছি—তার কিছু আমার ঠাকুরদাদা বিক্রি করে দেন। ব্যবসা শুরু করেন আমার বাবা, আর তার ফলে বংশের ভিত খানিকটা মজবুত হয়। তারপর আমি।
জয়ন্ত ব্যবসায় যায়নি। সে আছে।
এক, এনজিনিয়ারিং ফার্মে। ভালই রোজগার করে, তবে ইদানীং শুনছি ক্লাবে গিয়ে পোকার খেলছে। ঠাকুরদাদার একটা গুণ পেয়েছে। আর কী? জয়ন্ত আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট।
এই ফাঁকে ফেলুদা পকেট থেকে তার মাইক্রোক্যাসেট রেকডারটা বার করে চালু করে দিয়েছে। এটা হংকং থেকে আনা। আজকাল মক্কেলের কথা খাতায় না লিখে রেকর্ডারে তুলে নেয়, তাতে অনেক বেশি সুবিধা হয়।
শঙ্করবাবু বললেন, আত্মীয়ের কথা তো হল, এবার অনাত্মীয়ের প্রসঙ্গে আসা যাক।
তার আগে একটা প্রশ্ন করে নিই বলল ফেলুদা।যদিও প্রায় ঘষে উঠে গেছে, তবুও মনে হচ্ছে আপনার কপালে একটা চন্দনের ফোঁটা দেখতে পাচ্ছি। তার মানে—
তার মানে আর কিছুই না, আজ হল আমার জন্মতিথি। ফোঁটাটা দিয়েছেন খুড়িমা।
জন্মতিথি বলেই কি আজ এখানে অতিথি সমাগম হবে?
অতিথি বলতে মাত্র তিনজন। গত বছর ছিল ফিফটিয়েথ বার্থডে, সেবারও ডেকেছিলাম এই তিনজনকেই। ভেবেছিলাম। ওই একটি বারই তিথি পালন করব। কিন্তু একটা বিশেষ কারণে এবারও করছি। বুঝতেই পারছেন, এ বাড়িতে যাঁরা একবার এসেছেন, তাঁদের দ্বিতীয়বার আসতে কোনও আপত্তি হবে না।
এই দ্বিতীয়বারের কারণটা কী?
শঙ্করবাবু একটু ভেবে বললেন, খুব ভাল হয় আপনারা যদি চা খেয়ে একবারটি দোতলায় আসেন আমার সঙ্গে—আমার খুড়িমার ঘরে। তা হলে বাকি ঘটনাটা বুঝতে সহজ হবে। আর আমিও ব্যাপারটা গুছিয়ে বলতে পারব।