বিল্ডিং-এর ইলেকট্রিক লাইন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পুরো বিল্ডিং অন্ধকার। আগুনের হলকায় অস্পষ্টভাবে সবকিছু চোখে আসছে। আমি চলে গিয়েছি এক ধরনের ঘোরের মধ্যে।. হুস করে বড় একটা আগুন ধরল। তার আলোয় চোখে পড়ল, দেয়ালে বিরাট একটা কেমিক্যাল ফায়ার এক্সটিংগুইসার। সাধারণত ল্যাবের আগুনে এদের ব্যবহার করতে হয়। কিভাবে এদের ব্যবহার করতে হয় তাও জানি না। গায়ে বড় বড় অক্ষরে নির্দেশনামা আছে। চেষ্টা করা যাক। আমি ছুটে গেলাম ফায়ার এক্সটিংগুইসারের দিকে। নির্দেশ নাম্বার ওয়ান–বড় লিভারটি টেনে নিচে নামাও। কোনটি বড় লিভার? দুটিই তো এক রকম লাগছে। নির্দেশ নাম্বার দুই–ছোট লিভারটির কাউন্টার ক্লক ঘুরাও। কাউন্টার ক্লক মানে কি? ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিক? ঘড়ির কাঁটা কোনদিকে ঘুরে?
আশ্চর্যের ব্যাপার, ফায়ার এক্সটিংগুইসার চালু করতে পারলাম। এই অদ্ভুত যন্ত্রটি মুহূর্তের মধ্যে পুরো ল্যাব সূক্ষ সাদা ফেনায় ঢেকে দিল। আমরা ডুবে গেলাম ফেনার ভেতর। আগুন নিভে গেল। তারো মিনিট দশেক পর ফায়ার সার্ভিসের মুখোশ পরা লোকজন আমাদের দুজনকে উদ্ধার করল। উমেশকে নিয়ে গেল হাসপাতালে। তার কথাও বন্ধ হয়ে গেছে। কথা বলতে পারছে না। জিহ্বাও শক্ত হয়ে গেছে।
.
উমেশকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছি। আমি ভেবেছিলাম, সে আমাকে দেখে আনন্দিত হবে। তা হল না। মুখ কালো করে বলল, তুমি কেন এসেছ? তুমি তো আমাকে দেখতে পার না। আমি শুধু তোমাকে বিরক্ত করি। তুমি চলে যাও।
আমি হাসলাম।
উমেশ হাসল না। চোখ বন্ধ করে পাশ ফিরল। সে আসলেই আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না।
সে যে আমার ব্যবহারে কি রকম আহত হয়েছিল তা বুঝলাম যখন দেখলাম–তাকে আগুন থেকে উদ্ধারের মত ঘটনাতেও সে অভিভূত হয়নি। আমাকে দেখলে। আগের মতই চোখ ফিরিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে যায়। সে নর্থ ডাকোটা থেকে চলে গেল মুরহেড স্টেটে। যাবার আগের দিন আমাকে একটা খামবন্ধ চিঠি দেয়া হল। চিঠিটি তার লেখা না। তার বাবার লেখা। ভদ্রলোক লিখেছেন—
জনাব,
আপনি আমার মা-হারা পুত্রের জীবন রক্ষা করেছেন। এর প্রতিদান আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। ঈশ্বর আপনাকে তার প্রতিদান দেবেন। ঈশ্বর কোন সৎকর্ম অবহেলা করেন না। উমেশ লিখেছে, আপনি তার জন্যে আপনার জীবন বিপন্ন করেছেন। আপনার থিসিসের কাগজপত্র আগুনে নষ্ট হয়েছে। আপনাকে আবার নতুন করে লিখতে হয়েছে। আমি নিজে একজন পাপী মানুষ। পাপী মানুষের প্রার্থনায় ফল হয় না, তবু আমি প্রতিদিন ঈশ্বরের। কাছে আপনার জন্যে প্রার্থনা করি। যতদিন বাঁচব, করব। আপনি আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম গ্রহণ করুন।
.
আমেরিকার পর্ব শেষ করে দেশে ফিরছি। হেক্টর এয়ারপোর্টে অনেকেই আমাকে বিদায় দিতে এসেছে। হঠাৎ দেখি দূরে উমেশ দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই সে চোখ নামিয়ে নিল। দ্রুত চলে গেল ভেন্ডিং মেশিনের আড়ালে। আমি এগিয়ে গেলাম।
উমেশ বলল, আমি তো তোমাকে বিদায় দিতে আসিনি। আমি যাব লস এঞ্জেলস। তার টিকিট কাটতে এসেছি।
‘ঠিক আছে। যাবার আগে তোমার সঙ্গে দেখা হল। খুব ভাল লাগছে। একদিন তোমার মনে কষ্ট দিয়েছি। তার জন্যে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। প্লেনে ওঠার আগে তোমার হাসিমুখ দেখে যেতে চাই।‘
উমেশ বলল, আমি তোমাকে মিথ্যা কথা বলেছি। আমি আসলে তোমাকে বিদায় দিতেই এসেছি।
উমেশ আমাকে জড়িয়ে ধরল। সে ভেউ ভেউ করে কাঁদছে। প্লেনে ওঠার আগে সিকিউরিটি চেকিং-এ যাচ্ছি। বন্ধু বান্ধবরা হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে। রুমাল উড়াচ্ছে। শুধু উমেশ দু’হাতে তার মুখ ঢেকে আছে। সে তার কান্নায় বিকৃত মুখ কাউকে দেখাতে চাচ্ছে না।
উৎসব
ঈদের আগের দিন বিকেলে আমাদের বাসায় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো। বেশ বড় রকমের দুর্ঘটনা। আমার মেয়ের ঈদের জামাটা তার এক বান্ধবী দেখে ফেলো। দেখার কোন সম্ভাবনা ছিলো না। বাক্সে তালাবন্ধ করে একটা কাগজের প্যাকেটে মুড়ে রাখা হয়েছিলো। কপাল খারাপ থাকলে যা হয়–বোতাম লাগাবার জন্যে জামা বের করা হয়েছে ওমনি বান্ধবী এসে হাজির। আমার মেয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করেও তার জামা। লুকাতে পারলো না। সে আকাশ ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলো–জামা পুরানো হয়ে গেছে। জামা পুরানো হয়ে গেছে।
সবকিছুই পুরানো করা চলে। ঈদের জামা জুতো তো পুরানো করা চলে না। জুতোর প্যাকেটটি বুকের কাছে নিয়ে রাতে ঘুমুতে হয়। জামাটা খুব কম করে হলেও পঁচবার ইস্ত্রি করতে হয়। এবং দিনের মধ্যে অন্তত তিনবার বাক্স খুলে দেখতে হয় সব ঠিক আছে কি না। কিন্তু অন্য কেউ দেখে ফেললেই সর্বনাশ। ঈদের আনন্দের পনেরো আনাই মাটি।
বান্ধবী জামা দেখে ফেলেছে এই দুঃখে আমার মেয়ে যখন কঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলো, তখন বললাম, চল যাই আরেকটা কিনে দেব। রাত দশটায় তাকে নিয়ে জামা কিনতে বেরুলাম। চারদিকে কি আনন্দ! কি উল্লাস! শিশুদের হাতে বেলুন। মায়েদের মুখভর্তি হাসি। হাতে কেনাকাটার ফর্দ। বাবারা সিগারেট ধরিয়ে। গম্ভীর ভঙ্গিতে হাঁটছেন।
আগে যেসব ছোট ছোট শিশু শুকনো মুখে পলিথিনের ব্যাগ বিক্রি করতো, তারা আজ খুব হাসছে। খুব বিক্রি হচ্ছে ব্যাগ। এক ভদ্রলোককে দেখলাম তিনটি ব্যাগ কিনলেন। তিন টাকা দাম। তিনি একটা কচকচে পঁচ টাকার নোট দিয়ে বললেন, যা দুটাকা তোর বকশিশ। ছোট বাচ্চাটি পাঁচ টাকার নোটটি নিশানের মত এক হাতে উঁচু করে ধরে ছুটে চলে গেলো।