- বইয়ের নামঃ কবিতাবলী
- লেখকের নামঃহেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আর্যা সাহিত্য সামাচার
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অশোকতরু
১
কে তোমারে তরুবর, করে এত মনোহর,
রাখিল এ ধরাতলে, ধরা ধন্য কর্যে?
এত শোভা আছে কি এ পৃথিবী ভিতরে!
দেখ দেখ কি সুন্দর, পুষ্পগুচ্ছ থরেথর,
বিরাজে শাখীর পর সদা হাস্যভরে—
সিন্দূরের ঝারা যেন বিটপী উপরে!
মরি কিবা মনোলোভা, ছড়ায়ে রয়েছে শোভা,
আভা যেন উথলিয়া পড়িছে অম্বরে।—
কে আনিল হেন তরু পৃথিবী ভিতরে?
২
বল বল তরুবর, তুমি যে এত সুন্দর
অন্তরও তোমার, কি হে, ইহারি মতন?
কিম্বা সুধু নেত্রশোভা মানব যেমন?
আমি দুঃখী তরুবর, তাপিত মম অন্তর,
না জানি মনের সুখ, সন্তোষ কেমন;
তরুবর তুমি বুঝি না হবে তেমন?
অরে তরু খুলে বল, শুনে হই সুশীতল,
ধরণীতে সদানন্দ আছে এক জন,—
না হয় সন্তাপে যারে করিতে ক্রন্দন।
৩
জানিতাম, তরুবর, যদি হে তব অন্তর,
দেখাতাম একবার পৃথিবী তোমায়—
মানবের মনচিত্রে কি আছে কোথায়।
কত মরু, বালুস্তূপ, কত কাঁটা, শুষ্ক কূপ,
ধূ ধু করে নিরবধি অন্ধ ঝটিকায়—
সরসী নির্ঝর, নদী, কিছু নাহি তায়।
তা হ’লে বুঝিতে তুমি, কেন ত্যজি বাসভূমি,
নিত্য আসি কাঁদি বসি তোমার তলায়;
ত্যজে নর, ধরি কেন তোমার গলায়।
৪
তুমি তরু নিরন্তর, আনন্দে অবনী পর,
বিরাজ বন্ধুর মাঝে, স্বজন সোহাগে;
তরুবর, কেহ নাহি তোমারে বিরাগে।
ধরণী করান পান, সুরস সুধা সমান,
দিবানিশি বার মাস সম অনুরাগে,—
পবন তোমার তরে যামিনীতে জাগে।
স্রোতোধারা ধরি পায়, কুলু কুলু করি ধায়,
আপনি বরষা নীর ডালে শিরোভাগে;—
তরু রে বসন্ত তোর স্নেহ করে আগে।
৫
কলকণ্ঠ মধুমাসে, তোমারি নিকটে আসে,
শুনাতে আনন্দে বসে কুহু কুহু রব;
তরুবর, তোমার কি সুখের বিভব।
তলদেশে মখমল, তৃণ করে ঢল ঢল,
পতঙ্গ তাহাতে সুখে কেলি করে সব,
কতই সুখেতে তরু, শুন ঝিল্লীরব!
আসি সুখেপাঁতি পাঁতি, ছড়ায়ে বিমল ভাতি,
খদ্যোত যখন তব সাজায় পল্লব—
কি আনন্দ তরু তোর হয় অনুভব!
৬
তরু রে আমার মন, তাপদগ্ধ অনুক্ষণ,
কেহ নাই শোকানলে ঢালে বারিধারা;
আমি, তরু, জগতের স্নেহ, সুখ হারা!
জায়া, বন্ধু, পরিবার, সকলি আছে আমার,
তবু এ সংসার যেন বিষতুল্য কারা;—
মনে ভাল, কেহ মোরে, বাসে না তাহারা!
এ দোষ কাহারো নয়, আমিই কলঙ্কময়,
আমারি অন্তর হয়, কঙ্কালেতে ভরা—
আমি, তরু, বড় পাপী, তাই ঠেলে তারা।
৭
বড় দুঃখী তরু আমি, জানেন অন্তরষামী,
তোমার তলায় আসি ভাসি অশ্রুনীরে,
দেখিয়া জীবের সুখ ভবের মন্দিরে।
এই ভিন্ন সুখ নাই, তরু তাই ভিক্ষা চাই,
পাই যেন এই রূপে কাঁদিতে গম্ভীরে,
যত দিন নাহি যাই বৈতরণী তীরে।
এক ভিক্ষা আছে আর, অন্য যদি কেহ আর,
আমার মতন দুঃখী আসে এই স্থানে,
তরু, তারে দয়া করে তুষিও পরাণে।
ইন্দ্রের সুধাপান
১
একদিন দেব দেবপুরন্দর,
বামে শচীসতী নন্দন ভিতর,
বলিল গন্ধৰ্ব্ব সখারে ডাকি;–
যাও চিত্ররথ, সুধাভাণ্ড ভরি
আন ত্বরা করি পীযূষ লহরী,
আন বাদিত্রবাদকে ডাকি।
আন বাদিত্র সুধাতরঙ্গে,
যত দেবগণ বলিল রঙ্গে,
অমর মাতিল সুরেশ সঙ্গে।
২
সুবৰ্ণ মঞ্চেতে সুর আখণ্ডল,
চারিদিকে যত অমরের দল,
বিজলীর মত করে ঝলমল,
শোভে পারিজাত হার গ্রীবাতে;
বামে দৈত্যবালা রূপে করে আল,
কোথা যে চঞ্চল তড়িত উজ্জ্বল,
কোথা বা উমার রূপ নিরমল?
পলকে পারে সে জগতে ভুলাতে।
আহা মরি মরি কিবা ভাগ্যধর,
যার কোলে হেন নারী মনোহর,
কত সুখ তার হয় রে।
বীর বিনা আহা রমণীরতন,
বীর বই আর রমণীরতন,
বীর বিনা আহা রমণীরতন,
কারে আর শোভা পায় রে!
(চিতেন[১])
আহা মরি মরি কিবা ভাগ্যধর,
গাহিল যতেক কিন্নরী কিন্নর,
কত সুখ তার হয় রে;
বীর বিনা আহা রমণীরতন,
বীর বই আর রমণীরতন,
বীর বিনা আহা রমণীরতন
কারে আর শোভা পায় রে।
৩
এলো চিত্ররথ মনোরথ গতি,
স্বর্ণপাত্রে সুধা, সঙ্গে বিদ্যারথী,[২]
উঠিল সুরব “জয় শচীপতি”
অমর মণ্ডলী মাঝেতে;
দেব পুরন্দর দেবদল সহ,
সুধা, সোমরস পিয়ে মুহমুহ,
গন্ধে আমোদিত মারুত প্রবাহ,
গগন কাঁপিল বেগেতে—
বায়ু মাতোয়ারা, রবি, শশী, তারা,
অরুণ, বরুণ, দিক্পাল যারা,
সবে মাতোয়ারা সুধা পানেতে।
হ’লো ভয়ঙ্কর কাঁপে চরাচর
আকাশ, পাতাল, মহী, মহীধর,
জলধি হুঙ্কারে বেগেতে।
( চিতেন )
বায়ু মাতোয়ারা রবি, শশী, তারা,
অরুণ, বরুণ, দিক্পাল যারা,
সবে মাতোয়ারা সুধা পানেতে।
৪
বসিয়ে উন্নত আসন উপরে,
গুণী বিশ্বাবসু বীণা নিল করে,
মেঘের গরজে গভীর ঝঙ্কারে,
মোহিত করিল অমরগণে;
দেবাসুর রণ গাহিতে লাগিল,
কিরূপে অসুরে অমরে নাশিল,
কিরূপে ইন্দ্র দেবরাজ হ’লো,
শুনাইল বীণা বাজায়ে ঘনে।
“পুলোমদুহিতা তোমারি গৃহীতা,
ওহে দেবরাজ তুমিই দেবতা;
রণে পরাজয় করি বাহুবলে,
এ অমরপুরী নিলে করতলে,
সমুদ্র মথিয়া অমৃত লভিলে,—
অহে দেব তব অসাধ্য ক্ষমতা।”
হ’লে প্রতিধ্বনি—“পুলোমদুহিতা,
অহে দেবরাজ তোমারি গৃহীতা;”—
ঘন ঘন ঘোর সুগভীর স্বরে,
কাননে, বিপিনে, নদী, সরোবরে,
উঠিল নিনাদি যতেক দেবতা।
ভাবে গদ গদ মুদিত নয়ন,
উঠিয়া গরজি গরজি সঘন
ছাড়িল হুঙ্কার দনুজঘাতা।
( চিতেন )
হ’লো প্রতিধ্বনি,—“পুলোম দুহিতা,
অহে দেবরাজ তোমারি গৃহীতা”—
ঘন ঘন ঘোর সুগভীর স্বরে,
কাননে, বিপিনে, নদী, সরোবরে,
উঠিল নিনাদি যতেক দেবতা।
৫
অতি সুললিত মৃদু মধুস্বরে,
আবার গাহক বীণা নিল করে,
মজাইল সুরললনা।
“দেখ দেখ চেয়ে নাগরের বেশে,
চোক্ ঢুলু ঢুলু আসে হেসে হেসে,
আড়ে অাড়ে কথা নাহি অভিমান,
সদা আশুতোষ খুলে দেয় প্রাণ,
ওরে সুধা তোর নাই তুলনা।
সদা সেবে যারা সোমরস সুধা
ক্ষোভ লোভ শোক থাকে না ক্ষুধা,
রণজয়ী যেই সুধাপায়ী সেই,
শূর বিনে সুধা-স্বাদ জানে না।
(চিতেন)
“সুধার প্রেমেতে বাজ্রে বীণা,
বল্ সুধা বই ধন্ চাহিনা,
অমন মধুর নাই পিপাসা !
সুধা কিবা ধন সুধা সে কেমন,
সাধক বিনে কি জানিবে চাষা।”
(৬)
দৈত্য অরিদল দম্ভে কোলাহল
করে আস্ফালন করিল কত,
মত্ত মধুপানে দিতিসুতগণে
কি রূপে কোথায় করেছে হত।
তখন আবার বীণা-বাদ্যকর
বীণা নিল করে, সকরুণ স্বরে,
অমর দৰ্প করিল চূর ;
আরক্ত লোচন ঘন গরজন;
ক্রমে ক্রমে সব হ’লো অদর্শন,
স্তব্ধ হইল অমরপুর।
সকরুণ স্বরে বীণা করে ধরে,
গাহিল,—“যখন প্রলয় হবে,
যখন ঈশান হর হর বোলে,
বাজাবে বিষাণ ঘন ঘোর রোলে,
জলে জলম্ময় হবে ত্রিভুবন,
না রবে তপন শশীর কিরণ,
জগত মণ্ডল কারণ বারিতে,
ছিঁড়িয়া পড়িবে ত্রিলোক সহিতে,
তখন কোথা এ বিভব রবে ।
এই সুরপুরী এ সব সুন্দরী
এ বিপুল ভোগ কোথায় যাবে!”—
অতি ক্ষুণ্ণমন যত দেবগণ,
ঘন ঘন শ্বাস করে বিসর্জ্জন,
ভাবিয়ে অধীর প্রলয় যবে ;
এই সুরপুরী এসব সুন্দরী
এ বিপুল ভোগ কোথায় রবে !
(চিতেন)
এ বিপুল ভোগ কোথায় রবে,
বলিয়া কিন্নর গাহিল সবে,
জগত মণ্ডল কারণ বারিতে,
ছিঁড়িয়া পড়িবে ত্রিলোক সহিতে,
তখন কোথা এ বিভব রবে!
৭
গুণী বিশ্বাবসু সঙ্গীতের পতি,
বীণা যন্ত্রে পুনঃ মধুর ভারতী,
গাহিতে লাগিল প্রেমের গাথা;
বিলাপ ঘুচিল প্রেম উপজিল
রসে ডগমগ তনু শিহরিল।
একি সুত্রে প্রেম করুণ গাঁথা।
মৃদুল মৃদুল তাজ বে তাজ,[৩]
মৃদুল মৃদুল নও বে নও,
বাজিতে লাগিল মধুর বোলে;
শ্রবণে শীতল যতেক শ্রোতা।
“সংগ্রামে কি সুখ, সকলি অসুখ,
দিন রাত নাই প্রাণ ধুক ধুক্,
মান মর্য্যাদা কথার কথা।
ঘোড়া দড়বড়ি, অসি ঝনঝনি,
কাটাকাটি, গোল, তীর স্বন্স্বনি,
কাণে লাগে তালা করে ঝালাপালা,
দেহ হয় আলা সমর-স্রোতে ;
গতি অবিরাম নাহিক বিরাম,
সমরে কি সুখ নারি বুঝিতে।
চির দিন আর দনুজ সংহার
করে কত ভার সহিবে দেব;
বামে শচীসতী হের সুরপতি,
কর সুখভোগ রাখ বুকেতে।”—
বাখানিল যত কিন্নর কিন্নরী,
বাখানিল যত স্বর্গ-বিদ্যাধরী,
বাখানিল দেবগণ পুলকে।
রতিপতি জয় হলো সুরপুরে
ললিত মধুর বীণার সুরে;
সঙ্গীতের জয় হলো ত্ৰিলোকে।
স্মরে জর জর দেহ থর থর,
হেরে ঘন ঘন দেব পুরন্দর,
হৃদয়ে বামারে রাখিতে চায়;
নিমেষে হেরিছে নিমেষে ফিরিছে
নিমেষে নিশ্বাস বহিছে তায়।
শেষে পরাজিত অচেতন চিত,
শচী বক্ষস্থলে ঘুমায়ে রয়।
( চিতেন)
গাহিল কিন্নর,—“স্মরে জর জর
দেব পুরন্দর হলো পরাজয়,
নিমেষে হেরিছে নিমেষে ফিরিছে,
নিমেষে নিশ্বাস বহিছে তায়।
শেষে পরাজিত অচেতন চিত
শচী বক্ষস্থলে ঘুমায়ে রয়।”
৮
“বাজ্ রে বীণা বাজ্ রে আবার,
ঘন ঘোর রবে বাজ এইবার,
আরো উচ্চতর গভীর সুরে;
যাক্ দূরে যাক্ কামের কুহক
মেঘের ডাকে ডাক্ রে পূরে!
অহে সুররাজ ছিছি একি লাজ,
দেখ দেখ অই দনুজ সমাজ,
রণসাজ করে আসিছে ফিরে;
শিরে ফণীবাঁধা করে উল্কাপাত,
কর সুরনাথ দনুজ নিপাত,
দেখ চরাচর কাঁপিছে ডরে।
জলদ নিনাদে করে হুহুঙ্কার,
এ অমরপুরী করে ছারখার,
পূরণ আহুতি করিবে এবে।
কর দম্ভ চূর, বজ্র ধর শূর,
রাখ হে ব্রহ্মাণ্ড, বাঁচাও দেবে।”
শুনে বজ্রধর বেগে বজ্র ধরে,
কড় কড় ধ্বনি গরজে অম্বরে,
ভয়ে হিমগিরি টলিল।
তখন উল্লাসে, বিদ্যারথী হেসে,
বীণাযন্ত্র পাশে রাখিল।
(চিতেন)
“বেগে বজ্রধর,” গাহিল কিন্নর,
“কড় কড় নদে গরজে অম্বর,
ভয়ে হেমগিরি টলিল।
তখন উল্লাসে বিদ্যারথী হেসে
বীণাযন্ত্র পাশে রাখিল।”
————–
১. ইংরাজিতে এইরূপ স্থলে কোরস্ বলে। ঐ শব্দের অনুরূপ ঠিক অন্য কোন শব্দ না পাওয়ায় চিতেন লেখা হইয়াছে।
২. এই অমর গায়কের আর একটী নাম বিশ্বাবসু।
৩. দেবতারই সঙ্গীতের সৃষ্টিকর্ত্তা, সুতরাং এই লক্ষ্ণৌই সুরও দেবতাদিগের মধ্যে প্রচলিত থাকা সম্ভব।
উন্মাদিনী
অঙ্গে মাখ ছাই বলিহারি যাই,
কে রমণী আই পথে পথে গাই
চলেছে মধুর কাকলী করে।
কিবা উষাকাল, কিবা দ্বিপ্রহর,
বীণা ধরে করে ফিরে ঘরে ঘর,
পরাণে বাঁধিয়া মিলায়ে সুতান,
গায় উচ্চস্বরে সুললিত গান,
উতলা করিয়া কামিনী নরে।
অঙ্গে মাখ ছাই বলিহারি যাই,
কে রমণী আই পথে পথে গাই,
চলেছে মধুর কাকলী করে।
নয়নের কোণে চপলা খেলিছে,
নিতম্বের নীচে চিকুর দুলিছে,
করুণা মাখান বদনের ছাঁদ,
যেন অভিনব অবনীর চাদ,
কটি কর পদে ছড়ান মাধুরী,
গেরুয়া বসনে তনুয়া আবরি,
চলেছে সুন্দরী ভাবনা ভরে।
বলিহারি যাই অঙ্গে মাখা ছাই,
কে রমণী অই পথে পথে গাই,
চলেছে মধুর কাকলী করে।
২
অই শুন গায়, প্রাণের জ্বালায়—
“পাবনা পাবনা পাবনা কি তায়?
নাহি কি বিশাল ধরণী ভিতরে,
যেখানে বসিয়া স্নেহের নির্ঝরে,
মিটাই পিপাসা জুড়াই পরাণ,
দেখাই কিরূপ নারীর পরাণ,
প্রণয়ের দাম হৃদয়ে পর্যে।
যেখানে বহে না কলঙ্কের শ্বাস
কাঁদাতে প্রণয়ী, ঘুচাতে উল্লাস,
বায়ুতে, তরুতে, মাটীতে, আকাশে,
যেখানে মনের সৌরভ প্রকাশে,
ঘরের, পরের, মনের ভাবনা,
লোকের গঞ্জনা, প্রাণের যাতনা,
যেখানে থাকে না সখীর তরে।
৩
“কিবা সে বসন্ত শরত নিদাঘ,
নয়নে নয়নে নব অনুরাগ
ওঠে নিতি নিতি ফোটে অভিলাষ,
নিশিতে যেমন কাননে প্রকাশ
কলিকা কুসুমে ফুটাতে শশী।
দিবা, দণ্ড, পল, প্রভাত, যামিনী,
বার, তিথি, মাস, নক্ষত্র, মেদিনী
থাকে না প্রভেদ, প্রণয় প্রমাদে
হেরি পরস্পর মনের অবাধে;
জীবনে পরাণে মিশিয়া দুজনে
নেহারি আনন্দে মুখের স্বপনে—
নয়নে নয়ন, গণ্ডে গণ্ডতল,
করে করযুগ, কণ্ঠে কণ্ঠস্থল,
যেন পরিমল পবন হিল্লোলে,
যেন তরু লতা তরু শাখা কোলে,
যেমন বেণুতে বাণীর সুস্বর,
যেমন শশীর কিরণে অম্বর,
তেমনি অভেদ দুজনে মিশিয়া,
তনু মন প্রাণ তনু মনে দিয়া,
ভুলে বাহ্যজ্ঞান, ত্যজে নিদ্রা ক্ষুধা,
পান করি সুখে আনন্দের সুধা,
অগাধ প্রেমের সাগরে বসি।
৪
“ত্যজে গৃহবাস, হয়ে সন্ন্যাসিনী,
ভ্রমি পথে পথে দিবস যামিনী,
আকাশের দিকে অবনীর পানে,
দেখি অনিমিষে আকুল পরাণে,
জবাসম রবি, শ্বেত সুধাকর,
মৃদু মৃদু আভা তারকা সুন্দর,
তরু, সরোরর, গিরি, বনস্থল,
বিহঙ্গ, পতঙ্গ, নদ, নদী, জল,
যদি কিছু পাই খুঁজিয়া তাহাতে,
স্নেহের অমিয়া হৃদয়ে মাখাতে,
যদি কিছু পাই তাহারি মতন,
হেরিতে নয়নে করিতে শ্রবণ,
দেবতা মানব নারী কি নরে।
সুখে থাকে তারা, সুখে থাকে ঘরে
পতি পদতল বক্ষঃস্থলে ধরে,
বিবাহিতা নারী—সখের খেলনা,
খায় দায় পরে নাহিক ভাবনা,
জানে না ভাবে না প্রণয় কেমন,
প্রাণের বল্লভ পতি কিবা ধন,
ইহারাই সতী—বিঘত প্রমাণ
আশা, রুচি, স্নেহ, ইহাদের প্রাণ —
নারীর মাহাত্ম্য, রমণীর মন
কত যে গভীর ভাবে কত জন,
প্রণয় কি ধন নারীর তরে?
৫
“আমি মরি ঘুরে পৃথিবী ভিতরে,
প্রাণের মতন প্রাণনাথ তরে;
কই—কই পাই পূরাতে বাসনা?
পেয়ে নাহি পাই হায় কি যাতনা!
আরে মত্ত মন, সে অনিত্য আশা
ত্যজে ধৈর্য্য ধর, মুখে ভালবাসা
ধরে গৃহ কর, করে পরিণয়
না থাকিবে আর কলঙ্কের ভয়,
পাবি অনায়াসে পতি কোন জন,
পাবি অনায়াসে অন্ন আচ্ছাদন,
তবে মিছে কেন এত বিবাদ?
জ্বলিবে না হয় পুড়িয়া পুড়িয়া
পরাণ হৃদয় প্রণয়, স্মরিয়া,
সাহারার[১] মরু তপনে যেমন;
কিম্বা অগ্নিগিরি গর্ভে হুতাশন,
জ্বলে জ্বলে পুড়ে উঠিবে যখন,
হৃদয় পাষাণে রাখিব চাপিয়া,
মরিব না হয় মরমে ফাটিয়া,
তবু ত পূরিবে লোকের সাধ।
সুখে থাকে তারা জানে না কেমন
প্রাণের বল্লভ সখা কিবা ধন,
মনের সুখেতে থাকে রে ঘরে।”
বলিতে বলিতে কাঁদিয়া কাঁদিয়া,
চলিল সুন্দরী নয়ন মুছিয়া;
গাহিয়া মধুর মৃদুল স্বরে।
৬
“কেনই থাকিব কিসেরি তরে,
তনু বাঁধা দিয়ে গৃহের ভিতরে?
কারাবন্দী সম চির-হতাশ্বাস,
কেনই ত্যজিব এমন বাতাস,
এমন আকাশ, রবির কিরণ,
বিশাল ধরণী, রসাল কানন,
প্রাণী কোলাহল, বিহঙ্গের গান,
সাধের প্রমাদ—স্বাধীন পরাণ;
কেনই ত্যজিব, কাহার তরে?
ত্যজিতাম যদি পেতাম তাহায়,
যারে খুঁজে প্রাণ ভুবন বেড়ায়,
যাহার কারণে নারীর ব্যভার
করেছি বর্জ্জন, কলঙ্কের হার
পরেছি হৃদয়ে বাসনা করে।
৭
কোথা প্রাণেশ্বর কই সে অামার,
কিসের কলঙ্ক—সুধার অাধার—
সুধার মণ্ডলে সুধারি শশাঙ্ক,
এসো প্রাণনাথ—নহে ও কলঙ্ক
তোমা লয়ে সুখে থাকি হে কাছে!
তবু ও এলে না?—বুঝেছি বুঝেছি,
এ জনমে আর পাব না জেনেছি;
যখন ত্যজিব মাটীর শিকল,
ভ্রমিব শূন্যেতে হইয়া যুগল,
হরি হর রূপে তনু আধ অাধ,
তখন মিটিবে মনের এ সাধ,
রবির মণ্ডলে, চাঁদের আলোকে,
কৈলাস শিখরে, শিব ব্রহ্ম লোকে,
বরুণের বারি, পবনের বায়ু,
এই বসুন্ধরা, প্রাণী, পরমায়ু,
হেরিব সুখেতে পলকে ভ্রমিয়া,
আধ আধ তনু একত্র মিশিয়া,
তখন মিটিবে মনের সাধ!—
তখন, পৃথিবী, সাধিস্ বাদ
তুলিস কলঙ্ক যতই আছে।”
————–
১. আফ্রিকা খণ্ডস্থ স্বনাম প্রসিদ্ধ মরুভূমি।
কুলীন মহিলা বিলাপ
“এই না, ইংলণ্ডেশ্বরি, রাজত্ব তোমার?
তবে যেন ক্রীতদাস হয় গো উদ্ধার
তোমার পরশ মাত্র—সরস অন্তরে
ছিঁড়িয়া শৃঙ্খলমালা স্বাধীনতা ধরে?
তবে যেন রাজ্যেশ্বরি রাজ্যেতে তোমার
সকলে সমান স্নেহ উৎসাহ সবার?
নাহি যেন ভিন্নভাব কন্যাসুত প্রতি?
নাহি যেন তব রাজ্যে নারীর দুর্গতি?
শুনেছি না বৃটনের শ্বেতাঙ্গী মহিলা
পুরুষের সহচরী সঙ্গে করে লীলা?
সন্তান ধরেছ গর্ভে তুমি মা আপনি,
সন্তানের কত মায়া জান ত জননী।
তবে কেন আমাদের দুর্গতি এমন,
এখনো মা ঘুচিল না অশ্রুবিসর্জ্জন!”
আয় আয় সহচরী, ধরি গে বৃটনেশ্বরী,
করি গে তাঁহার কাছে দুঃখের রোদন;
এ জগতে আমাদের কে আছে আপন?
বিমুখ বান্ধব ধাতা, বিমুখ জনক ভ্রাতা,
বিমুখ নিষ্ঠুর তিনি পতি নাম যাঁর—
রাজ্যেশ্বরী বিনে ভবে কোথা যাব আর?
আয় আয় সহচরী, ধরি গে বৃটনেশ্বরী,
করি গে তাঁহার কাছে দুঃখের রোদন;
এ জগতে আমাদের কে আছে আপন?
“সাতশতবর্ষ, মাতঃ, পৃথিবী ভিতরে
এই রূপে অহরহঃ অশ্রুধারা ঝরে
মাতা মাতামহী চক্ষে জন্ম জন্মকাল,
আমাদেরো সে দুর্দ্দশা হায় রে কপাল!
কত রাজ্য হলো গেলো, কত ইন্দ্রপাত,
নক্ষত্র খসিল কত, ভূধর নিপাত,
হিন্দু বৌদ্ধ মুসলমান ম্লেচ্ছ অধিকার,
শাস্ত্র ধর্ম্ম মতামত কতই প্রকার
উঠিল ভারতভূমে, হইল পতন,
আমাদের দুঃখ আর হলো না মোচন!
সেই সে দিনান্তে দুটী পরান্ন আহার
নিশিতে কাঁদিয়া স্বপ্ন দেখি অনিবার।’’
আয় আয় সহচরী, ধরি গে বৃটনেশ্বরী,
করি গে তাহার কাছে দুঃখের রোদন;
এ জগতে আমাদের কে আছে আপন?
বিমুখ বান্ধব ধাতা, বিমুখ জনক ভ্রাতা,
বিমুখ নিষ্ঠুর তিনি পতি নাম যাঁর—
রাজ্যেশ্বরী বিনে ভবে কোথা যাব আর?
আয় আয় সহচরী, ধরি গে বৃটনেশ্বরী,
করি গে তাঁহার কাছে দুঃখের রোদন—
এ জগতে আমাদের কে আছে আপন?
“ডেকেছি মা বিধাতারে কত শত বার,
পূজেছি কতই দেব সংখ্যা নাহি তার,
তবুও মা খণ্ডিল না কপালের মূল,
অমরাবতীতে বুঝি নাহি দেবকুল!
বারেক বৃটনেশ্বরি অায় মা দেখাই
প্রাণের ভিতরে দাহ কি করে সদাই;
কাজ নাই দেখায়ে মা, তুমি রাজ্যেশ্বরী,
হৃদয়ে বাজিবে তব ব্যথা ভয়ঙ্করী।
ছিল ভাল বিধি যদি বিধবা করিত,
কাঁদিতে হতো না পতি থাকিতে জীবিত!
পতি, পিতা, ভ্রাতা, বন্ধু ঠেলিয়াছে পায়,
ঠেলো না মা, রাজমাতা, দুঃখী অনাথায়।”
আয় আয় সহচরী, ধরি গে বৃটনেশ্বরী,
করি গে তাঁহার কাছে দুঃখের রোদন;
এ জগতে আমাদের কে আছে আপন?
বিমুখ বান্ধব ধাতা, বিমুখ জনক ভ্রাতা,
বিমুখ নিষ্ঠুর তিনি পতি নাম যাঁর—
রাজ্যেশ্বরী বিনে ভবে কোথা যাব আর?
“কি জানাব জননী গো হৃদয়ের ব্যথা—
কিঙ্করীরো হেন ভাগ্য না হয় সর্ব্বথা?
কি ষোড়শী বালা, আর প্রবীণারমণী,
প্রতিদিন কাঁদিছে মা দিন দণ্ড গণি।
কেহ কাঁদে অন্নাভাবে আপনার তরে,
শিশু কোলে কারো চক্ষে বারিধারা ঝরে।
কত পাপস্রোত মাতা প্রবাহিত হয়,
ভাবিতে রোমাঞ্চ দেহ, বিদরে হৃদয়।
হা নৃশংস অভিমান কৌলীন্য-আশ্রিত!
হা নৃশংস দেশাচার রাক্ষসপালিত!
আমাদের যা হবার হয়েছে, জননি—
কর রক্ষা এই ভিক্ষা এ সব নন্দিনী।”
আয় আয় সহচরী, ধরি গে বৃটনেশ্বরী,
করি গে তাঁহার কাছে দুঃখের রোদন—
এ জগতে আমাদের কে আছে আপন?
বিমুখ বান্ধব ধাতা, বিমুখ জনক ভ্রাতা
বিমুখ নিষ্ঠুর তিনি পতি নাম যাঁর—
রাজ্যেশ্বরী বিনে ভবে কোথা যাব আর?
আয় আয় সহচরী, ধরি গে বৃটনেশ্বরী,
করি গে তাঁহার কাছে দুঃখের রোদন—
এ জগতে আমাদের কে আছে আপন?
কোন একটি পাখীর প্রতি
১
ডাক্ রে আবার, পাখি, ডাক্ রে মধুর!
শুনিয়ে জুড়াক প্রাণ, তোর সুললিত গান
অমৃতের ধারা সম পড়িছে প্রচুর।
আবার ডাক্ রে পাখি, ডাক্ রে মধুর!
বলিয়ে বদন তুলে, বসিয়ে রসালমূলে,
দেখিনু উপরে চেয়ে আশায় আতুর।
ডাক্ রে আবার ডাক্ সুমধুর সুর।
২
কোথায় লুকায়ে ছিল নিবিড় পাতায়;
চকিত চঞ্চল আঁখি, না পাই দেখিতে পাখী,
আবার শুনিতে পাই সঙ্গীত শুনায়,
মনের আনন্দে বসে তরুর শাখায়।
কে তোরে শিখালে বল, এ সঙ্গীত নিরমল?
আমার মনের কথা জানিলি কোথায়?
ডাক্ রে আবার ডাক্ পরাণ জুড়ায়।
৩
অমনি কোমল স্বরে সেও রে ডাকিত,
কখন আদর করেকভু অভিমান ভরে
অমনি ঝঙ্কার করে লুকায়ে থাকিত।
কি জানিবি পাখী তুই, কত সে জানিত!
নব অনুরাগে যবে, ডাকিত প্রাণবল্লভে,
কেড়ে নিত প্রাণ মন পাগল করিত;
কি জানিবি পাখী তুই কত সে জানিত।
৪
ধিক্ মোরে ভাবি তারে আবার এখন!
ভুলিয়ে সে নব রাগ, ভুলে গিয়ে প্রেমযাগ,
আমারে ফকীর করে আছে সে যখন;
ধিক্ মোরে ভাবি তারে আবার এখন।
ভুলিব ভুলিব করি, তবু কি ভুলিতে পারি,
না জানি নারীর প্রেম মধুর কেমন,
তবে কেন সে আমারে ভাবে না এখন?
৫
ডাক্ রে বিহগ তুই ডাক্ রে চতুর;
ত্যজে সুধু সেই নাম, পূরা তোর মনস্কাম,
শিখেছিস্ আর যত বল সুমধুর।
ডাক্ রে আবার ডাক্ মনোহর সুর!
না শুনে আমার কথা, ত্যজে কুসুমিত লতা,
উড়িল গগন-পথে বিহগ চতুর;—
কে আর শুনবে মোরে সে নাম মধুর।
গঙ্গার উৎপত্তি
১
হরিনামামৃত পানে বিমোহিত
সদা আনন্দিত নারদঋষি,
গাহিতে গাহিতে অমরাবতীতে
আইল একদা উজলি দিশি।
২
হরষ অন্তরে মহা সমাদরে
স্বগণ সংহতি অমর পতি,
করি গাত্রোত্থান, করিয়া সম্মান
সাদর সম্ভাষে তোষে অতিথি।
৩
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া মুনিরে পূজিয়া
চন্দ্রাগ্নি প্রভৃতি অমরগণ ;
করিয়া মিনতি কহে ঋষিপতি
“কহ কৃপা করি করি শ্রবণ,
8
কি রূপে উৎপতি হলো ভাগীরথী
গাও তপোধন প্রাচীন কথা।
বেদের উকতি, তোমার ভারতী,
অমৃত লহরী সদৃশ গাথা।”
৫
গুণী বিশারদ মুনি সে নারদ,
ললিত পঞ্চমে মিলায়ে তান,
আনন্দে ডুবিয়া নয়ন মুদিয়া।
তুম্ব বাজাইয়া ধরিল গান।
৬
“হিমাদ্রি অচল দেবলীলাস্থল
যোগীন্দ্রবাঞ্ছিত পবিত্র স্থান;
অমর কিন্নর যাহার উপর
নিসর্গ নিরখি জুড়ায় প্রাণ।
৭
যাহার শিখরে সদা শোভ করে
অসীম অনন্ত তুষার রাশি;
যাহার কটিতে ছুটিতে ছুটিতে
জলদকদম্ব জুড়ায় আসি।
৮
যেখানে উন্নত মহীরুহ যত
প্রণত উন্নত শিখর কায়;
সহস্র বৎসর অজর অমর
অনাদি ঈশ্বর মহিমা গায়।
৯
সেই হিমগিরি শিখর উপরি
অঙ্গিরাদি যত মহর্ষিগণ
আসিত প্রত্যহ, ভকতির সহ
ভজিতে ব্রহ্মাণ্ড আদিকারণ।
১০
হেরিত উপরে নীলকান্তি ধরে
শূন্য ধূ ধূ করে ছড়ায়ে কায়;
হেরিত অযুত অযুত অদ্ভুত
নক্ষত্র ফুটিয়া ছুটিছে তায়।
১১
মণ্ডলে মণ্ডলে শনি শুক্র চলে
ঘুরিয়া ঘেরিয়া আকাশময়;
হেরিত চন্দ্রমা অতুল উপমা
অতুল উপমা ভানু উদয়।
১২
চারি দিকে স্থিত দিগন্ত বিস্তৃত
হেরিত উল্লাসে তুষার রাশি;
বিস্ময়ে প্লাবিত বিস্ময়ে ভাবিত
অনাদি পুরুষে আনন্দে ভাসি।”
১৩
বলিতে বলিতে আনন্দ বারিতে
দেবর্ষি হইল রোমাঞ্চ কায়;
ঘনঘনস্বর গভীর, প্রখর
তান্পূরা ধ্বনি বাজিল তায়।
১৪
গাহিল নারদ, ভাবে গদগদ,
“এমন ভজন নাহি রে আর,
ভূধর শিখরে ডাকিয়া ঈশ্বরে
গাহিতে অনন্ত মহিমা তাঁর।
১৫
ইহার সমান ভজনের স্থান
কি আছে মন্দির জগত মাঝে;
জলদ-গর্জ্জন তরঙ্গ-পতন
ত্রিলোক চমকি যেখানে বাজে।
১৬
কিবা সে কৈলাস বৈকুণ্ঠ নিবাস
অলকা আমরা নাহিক চাই;
জয় নারায়ণ বলিয়া যেমন
ভুবনে ভুবনে ভ্রমিতে পাই।”
১৭
নারদের বাণী শুনি অভিমানী
অমর মণ্ডলী বিমর্ষ হয়;
আবার আহ্লাদে গভীর নিনাদে
সঙ্গীত তরঙ্গ বেগেতে বয়!
১৮
“ঋষি কয় জন সন্ধ্যা সমাপন
করি এক দিন বসিলা ধ্যানে;
দেবী বসুন্ধরা মলিনা কাতরা
কহিতে লাগিলা আসি সেখানে;”
১৯
‘রাখ ঋষিগণ—সমূলে নিধন
মানব সংসার হলো এবার;
হলো ছার খার ভুবন আমার
অনাবৃষ্টি তাপ সহে না আর।’
২০
শুনে ঋষিগণ করে দৃঢ় পণ
যোগে দিল মন একান্ত চিতে;
কঠোর সাধন ব্রহ্ম আরাধনা
করিতে লাগিলা মানব-হিতে।
২১
মানব মঙ্গলে ঋষির সকলে
কাতরে ডাকিছে করুণাময়;
মানবে রাখিতে নারায়ণ চিতে
হইল অসীম করুণোদয়।
২২
দেখিতে দেখিতে হলো আচম্বিতে
গগন-মণ্ডল তিমিরময়;
মিহির নক্ষত্র তিমিরে একত্র
অনল বিদ্যুৎ অদৃশ্য হয়।
২৩
ব্রহ্মাণ্ড ভিতর নাহি কোন স্বর,
অবনী অম্বর স্তম্ভিত প্রায়;
নিবিড় আঁধার জলধি হুঙ্কার
বায়ু বজ্রনাদ নাহি শুনায়।
২৪
নাহি করে গতি গ্রহদলপতি
অবনী-মণ্ডল নাহিক ছুটে;
নদ-নদী-জল হইল অচল
নির্ঝর না ঝরে ভূধর ফুটে।
২৫
দেখিতে দেখিতে পুনঃ আচম্বিতে
গগনে হইল কিরণোদয়;
ঝলকে ঝলকে অপূর্ব্ব আলোকে
পূরিল চকিতে ভুবনত্রয়!
২৬
শূন্যে দিল দেখা কিরণের রেখা
তাহাতে আকাশে প্রকাশ পায়—
ব্রহ্ম সনাতন অতুল চরণ
সলিল নির্ঝর বহিছে তায়।
২৭
বিন্দু বিন্দু বারি পড়ে সারি সারি
ধরিয়া সহস্র সহস্র বেণী;
দাঁড়ায়ে অম্বরে কমণ্ডলু করে
আনন্দে ধরিছে কমলযোনি।
২৮
হায় কি অপার আনন্দ আমার
ব্রহ্ম সনাতন চরণ হতে;
ব্রহ্মা কমুণ্ডলে জাহ্নবী উথলে
পড়িছে দেখিনু বিমানপথে।
২৯
গভীর গর্জ্জনে দেখিনু গগনে
ব্রহ্মা কমণ্ডলু হতে আবার
জলস্তম্ভ ধায়, রজতের কায়,
মহাবেগে বায়ু করি বিদার।
৩০
ভীম কোলাহলে নগেন্দ্র অচলে
সেই বারিরাশি পড়িল আসি;
ভূধর শিখর সাজিয়া সুন্দর
মুকুটে ধরিল সলিল রাশি।
৩১
রজত বরণ স্তম্ভের গঠন
অনন্ত গগন ধরেছে শিরে,
হিমানী আবৃত হিমাদ্রি পর্ব্বত
চরণে পড়িয়া রয়েছে ধীরে।
৩২
চারি দিকে তার রাশি স্তূপাকার
ফুটিয়া ছুটিছে ধবল ফেনা;
ঢাকি গিরি চুড়া হিমানীর গুঁড়া
সদৃশ খসিছে সলিল কণা।
৩৩
ভীষণ অাকার ধরিয়া আবার
তরঙ্গ ধাইছে আচল কায়;
নীলিম গিরিতে হিমানী রাশিতে
ঘুরিয়া ফিরিয়া মিশায়ে যায়।
৩৪
হইল চঞ্চল হিমাদ্রী অচল
বেগেতে বহিল সহস্র ধারা;
পাহাড়ে পাহাড়ে তরঙ্গ আছাড়ে
ত্রিলোক কাঁপিল আতঙ্কে সারা।
৩৫
ছুটিল গর্ব্বেতে গোমুখী পর্ব্বতে
তরঙ্গ সহস্র একত্রে মিলি,
গভীর ডাকিয়া আকাশ ভাঙ্গিয়া
পড়িতে লাগিল পাষাণ ফেলি।
৩৬
পালকের মত ছিঁড়িয়া পর্ব্বত
কুঁদিয়া চলিল ভাঙ্গিয়া বাঁধ,
পৃথিবী কাঁপিল তরঙ্গ ছুটিল
ডাকিয়া অসংখ্য কেশরি-নাদ।
৩৭
বেগে বক্রকায় স্রোতঃস্তম্ভ ধায়
যোজন অন্তরে পড়িছে নীচে;
নক্ষত্রের প্রায় ঘেরিয়া তাহায়
শ্বেত ফেনরাশি পড়িছে পিছে।
৩৮
তরঙ্গনির্গত বারিকণা যত
হিমানী চূর্ণিত আকার ধরে;
ধূমরাশি প্রায় ঢাকিয়া তাহায়
জলধনু শোভা চিত্রিত করে।
৩৯
শত শত ক্রোশ জলের নির্ঘোষ
দিবস রজনী করিছে ধ্বনি;
অধীর হইয়া, প্রতিধ্বনি দিয়া
পাষাণ খসিয়া পড়ে অমনি।
৪০
ছাড়ি হরিদ্বার শেষেতে আবার
ছড়ায়ে পড়িল বিমল ধারা;
শ্বেত সুশীতল স্রোতস্বতীজল
বহিল তরল পারা পারা।
৪১
অবনীমণ্ডলে সে পবিত্র জলে
হইল সকলে আনন্দে ভোর;
‘জয় সনাতনী পতিতপাবনি’
ঘন ঘন ধ্বনি উঠিল ঘোর।”
চাতক পক্ষীর প্রতি
১
কে তুমি রে বল পাখি,
সোণার বরণ মাখি,
গগনে উধাও হয়ে
মেঘেতে মিশায়ে রয়ে,
এত সুখে সুধামাখা সঙ্গীত শুনাও।
২
বিহঙ্গ নহ ত তুমি;
তুচ্ছ করি মর্ত্ত্যভূমি
জ্বলন্ত অনল প্রায়
উঠিয়া মেঘের গায়,
ছুটিয়া অনিল-পথে সুস্বর ছড়াও।
৩
অরুণ উদয় কালে
সন্ধ্যার কিরণ-জালে
দূর গগনেতে উঠি,
গাও সুখে ছুটি ছুটি,
সুখের তরঙ্গ যেন ভাসিয়া বেড়াও।
৪
আকাশের তারাসহ
মধ্যাহ্নে লুকায়ে রহ,
কিন্তু শুনি উচ্চস্বরে
শূন্যেতে সঙ্গীত ঝরে;
আনন্দ প্রবাহ ঢেলে পৃথিবী জুড়াও।
৫
একাকী তোমার স্বরে
জগত প্লাবিত করে,
শরতের পূর্ণশশি
বিমল আকাশে বসি
কৌমুদী ঢালিয়া যথা ব্রহ্মাণ্ড ভাষায়।
৬
কবি যথা লুকাইয়ে,
হৃদয়ে কিরণ লয়ে,
উন্মত্ত হইয়ে গায়,
পৃথিবী মাতিয়ে তায়
আশা মোহ মায়া ভয় অন্তরে জড়ায়।
৭
রাজার কুমারী যথা
পেয়ে প্রণয়ের ব্যথা,
গোপনে প্রাসাদ পরে
বিরহ সান্ত্বনা করে
মধুর প্রেমের মত মধুর গাথায়।
৮
যেমন খদ্যোত জ্বলে
বিরলে বিপিন তলে,
কুসুম তৃণের মাঝে
আতোষী আলোক সাজে
ভিজিয়া শিশির নীরে আঁধার নিশায়।
৯
পাতায় নিকুঞ্জ গাঁথা
গোলাপ অদৃশ্য যথা
সৌরভ লুকায়ে রয়,
যখনি পবন বয়,
সুগন্ধ উথলি উঠি বায়ুরে খেপায়।
১০
সেই রূপ তুমি, পাখি,
অদৃশ্য গগনে থাকি,
কর সুখে বরিষণ
সুধাস্বর অনুক্ষণ,
ভাসাইতে ভূমণ্ডল সুধার ধারায়।
১১
কেবা তুমি জানি নাই,
তুলনা কোথায় পাই;
জলধনু চূর্ণ হয়ে
পড়ে যদি শূন্য বয়ে,
তাহাও অপূর্ব্ব হেন নাহিক দেখায়।
১২
যত কিছু ভূমণ্ডলে
সুন্দর মধুর বলে—
নবীন মেঘের জল
মুক্ত মাখা তৃণদল—
তোমার মধুর স্বরে পরাজিত হয়।
১৩
পাখী কিম্বা হও পরি
বল রে প্রকাশ করি
কি সুখ চিন্তায় তোর
আনন্দ হয়েছে ভোর?
এমন আহলাদ আহা স্বপ্নে দেখি নাই।
১৪
সুধা প্রণয়ের গীত
প্রাণ করে পুলকিত—
তারো সুললিত স্বর
নহে এত মনোহর
এত সুধাময় কিছু না হেরি কোথাই।
১৫
বিবাহ উৎসব-রব
বিজয়ীর জয়-স্তব,
তোর স্বর তুলনায়
অসার দেখি রে তায়—
মেটেনা মনের সাধ পূর্ণ নাহি হয়।
১৬
তোর এ আনন্দময়
সুখ-উৎস কোথা রয়,
বন কিম্বা মাঠ গিরি
গগন হিল্লোল হেরি—
কারে ভালবেসে এত ভুল সমুদয়।
১৭
তুমিই থাক রে সুখে
জান না ঔদাস্য দুখে,
বিরক্তি কাহারে বলে
জান না রে কোন কালে
প্রেমের অরুচি ভোগে হলাহল কত।
১৮
আমরা এ মর্ত্ত্যবাসী
কভু কাঁদি কভু হাসি,
আগে পাছে দেখে যাই
যদি কিছু নাহি পাই,
অমনি হতাশ হয়ে ভাবি অবিরত।
১৯
যত হাসি প্রাণ ভরে
যাতনা থাকে ভিতরে,
এ দুঃখের ভূমণ্ডলে
শোকে পরিপূর্ণ হলে
মধুর সঙ্গীত হয় কতই মধুর।
২০
ঘৃণা ভয় অহঙ্কার
দূরে করি পরিহার,
পাখি রে তোমার মত
না যদি কাঁদিতে হত,
না জানি পেতেম কি না আনন্দ প্রচুর।
২১
গগন বিহারী পাখী
জগতে নাহি রে দেখি,
গীত বাদ্য মধুস্বর
হেন কিছু মনোহর
তুলনা তুলিতে পারি তোমার কথায়।
২২
যে আহ্লাদ চিত্তে তোর,
অামারে কিঞ্চিৎ ওর
আনন্দ কর রে দান,
তা হলে উন্মাদ প্রাণ
কবিতা তরঙ্গে ঢেলে প্রকাশি ধরায়।
———-
শেলি বিরচিত স্কাইলার্কের অনুকরণ।
জীবন সঙ্গীত
বলো না কাতর স্বরে বৃথা জন্ম এ সংসারে
এ জীবন নিশার স্বপন;
দারাপুত্র পরিবার তুমি কার কে তোমার
বলে জীব করো না ক্রন্দন।
মানব-জনম সার এমন পাবে না আর
বাহ্য দৃশ্যে ভুলো না রে মন।
কর যত্ন হবে জয় জীবাত্মা অনিত্য নয়
অহে জীব কর আকিঞ্চন।
করোনা সুখের অাশ পরো না দুখের ফাঁস
জীবনের উদ্দেশ তা নয়;
সংসারে সংসারী সাজ করো নিত্য নিজ কাজ
ভবের উন্নতি যাতে হয়।
দিন যায় ক্ষণ যায় সময় কাহারো নয়
বেগে ধায় নাহি রয় স্থির;
হয় সম্পদ বল্ সকলি ঘুচায় কাল
আয়ু যেন শৈবালের নীর।
সংসার সমরাঙ্গনে যুদ্ধ কর দৃঢ় পণে
ভয়ে ভীত হইও না মানব;
কর যুদ্ধ বীর্য্যবান যায় যাবে যাক্ প্রাণ
মহিমাই জগতে দুর্ল্লভ।
মনোহর মূর্ত্তি হেরে অহে জীব অন্ধকারে
ভবিষ্যতে করো না নির্ভর;
অতীত সুখের দিনে পুনঃ আর ডেকে এনে
চিন্তা করে হইও না কাতর।
সাধিতে আপন ব্রত স্বীয় কার্য্যে হও রত
এক মনে ডাক ভগবান;
সঙ্কল্প সাধন হবে ধরাতলে কীর্ত্তি রবে
সময়ের সার বর্ত্তমান।
মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করে গমন
হয়েছেন প্রাতঃ স্মরণীয়,
সেই পথ লক্ষ্য করে স্বীয় কীর্ত্তি ধ্বজা ধরে
আমরাও হবো বরণীয়।
সময়-সাগর তীরে পদাঙ্ক অঙ্কিত করে
আমরাও হব হে অমর;
সেই চিহ্ন লক্ষ্য করে অন্য কোন জন পরে
যশোদ্বারে আসিবে সত্বর।
করো না মানবগণ বৃথা ক্ষয় এ জীবন
সংসার-সমরাঙ্গন মাঝে;
সংকল্প করেছ যাহা, সাধন করহ তাহা
রত হয়ে নিজ নিজ কাজে।
জীবন-মরীচিকা
জীবন এমন ভ্রম আগে কে জানিত রে।
হয়ে এত লালায়িত কে ইহা যাচিত রে।
প্রভাতে অরুণোদয়, প্রফুল্ল যেমন হয়,
মনোহরা বসুন্ধরা কুহেলিকা আঁধারে।
বারিদ, ভূধর, দেশ, ধরিয়ে অপূর্ব্ব বেশ,
বিতরে বিচিত্র শোভা ছায়াবাজী আকারে।
কুসুমিত তরুচয়, ব্রহ্মাণ্ড ভরিয়ে রয়,
ঘ্রাণে মুগ্ধ সমীরণ মৃদু মৃদু সঞ্চারে।
কুলায়ে বিহঙ্গদল, প্রেমানন্দে অনর্গল,
মধুময় কলনাদ করে কত প্রকারে।
সেইরূপ বাল্যকালে, মন মুগ্ধ মায়াজালে,
কত লুদ্ধ অাশা আসি স্নিগ্ধ করে আত্মারে।
পৃথিবী ললামভূত, নিত্য সুখে পরিপ্লুত,
হয় নিত্য এই গীত পঞ্চভূত মাঝারে।
ব্রহ্মাণ্ড সৌরভময় মঞ্জু কুঞ্জ মনে হয়,
মনে হয় সমুদয় সুধাময় সংসারে।
মধ্যাহ্ণে তাহার পর, প্রচণ্ড রবির কর,
যেমন সে মনোহর মধুরতা সংহারে।
না থাকে কুহেলি অন্ধ, না থাকে কুসুমগন্ধ,
না ডাকে বিহগকুল সমীরণ ঝঙ্কারে।
সেই রূপ ক্রমে যত, শৈশব যৌবন গত,
মনোমত সাধ তত ভাঙে চিত্তবিকারে।
সুবর্ণ মেঘের মালা, লয়ে সৌদামিনী ডালা,
আশার আকাশে আর নিত্য নাহি বিহারে।
ছিন্ন তুষারের ন্যায়, বাল্য বাঞ্ছা দূরে যায়,
তাপদগ্ধ জীবনের ঝঞ্ঝাবায়ু প্রহারে।
পড়ে থাকে দূরগত জীর্ণ অভিলাষ যত,
ছিন্ন পতাকার মত ভগ্ন দুর্গ প্রাকারে।
জীবনেতে পরিণত এই রূপে হয় কত
মর্ত্ত্যবাসিমনোরথ, হা দগ্ধ বিধাতা রে!
ধর্ম্মনিষ্ঠাপরায়ণ, সুচারু পবিত্র মন,
বিমলস্বভাব সেই যুবা এবে কোথা রে।
অসত্য কলুষলেশ, বিঁধিলে শ্রবণদেশ,
কলঙ্কিত ভাবিত যে আপনার আত্মারে।
বামাশক্তি বামাচার, শুনিলে শত ধিক্কার,
জ্বলিত অন্তরে যার সে তপস্বী কোথারে?
কোথা সে দয়াদ্রচিত্ত, সঙ্কল্প যাহার নিত্য,
পরদুঃখ বিমোচন এ দুরন্ত সংসারে।
অত্যাচার উৎপীড়ন, করিবারে সংযমন,
না করিত যেইজন ভেদাভেদ কাহারে।
না মানিত অনুরোধ, না জানিত তোষামোদ,
সে তেজস্বী মহোদয় বাঞ্ছা এবে কোথা রে।
কত যুবা যৌবনেতে, চড়ি আশা বিমানেতে,
ভাবে ছড়াইবে ভবে যশঃপ্রভা আভারে।
তুলিবে কীর্ত্তির মঠ, স্থাপিবে মঙ্গলঘট,
প্রণত ধরণীতল দিবে নিত্য পূজা রে।
কেহ বা জগতে ধন্য, বীরবৃন্দে অগ্রগণ্য,
হয়ে চাহে চরণেতে বাঁধিবারে ধরারে।
স্বদেশ হিতৈষী কেহ, তাবিয়ে অসীম স্নেহ,
ব্রত করে প্রাণ দিতে স্বজাতির উদ্ধারে।
কার চিত্তে অভিলাষ, হবে শারদার দাস,
পীবে সুখে চিরদিন অমরতা সুধারে।
কালের করাল স্রোতে, ভাসে যবে জীবনেতে,
এই সব আশালুদ্ধ প্রাণী থাকে কোথা রে।
কিশোর গাণ্ডীবধারী, যামদগ্ন্য দৈত্যহারী,
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কালিদাস কত ডোবে পাথারে।
কতই যুবতী বালা, গাঁথে মনোমত মালা,
সাজাইতে মনোমত প্রিয়তম সখারে।
হৃদয় মার্জ্জিত করে, আহা কত প্রেমভরে,
প্রিয়মূর্ত্তি চিত্র ক’রে রাখে চিত্ত-আগারে।
নব বিবাহিত কত, পেয়ে পতি মনোমত,
ভাবে জগতের সুখ ভরিয়াছে ভাণ্ডারে।
এই সব অবলার, কিছু দিন পরে আর
দেখ মর্ম্মভেদী শেল দেয় কত ব্যথারে।
দেখ গে কেহ বা তার, হয়েছে পঞ্জরসার,
শুষ্ক হয়ে মাল্যদাম শূন্যে আছে গাঁথা রে।
মনোমত নহে পতি, মরমে মরিয়ে সতী,
উদ্যাপন করিয়াছে পতিসুখ-আশারে।
কৃতান্তের আশীর্ব্বাদে, দিবানিশি কেহ কাঁদে,
বিষম বৈধব্য দশ নিগড়েতে বাঁধা রে।
দারুণ অপত্যতাপে, দেখ গে কেহ বিলাপে,
অন্নাভাবে জননীর কোথা বক্ষঃ বিদারে।
আগে যদি জানিতাম, পৃথিবী এমন ধাম,
তা হলে কি পড়িতাম আনায়ের মাঝারে।
কোথা গেল সে প্রণয়, বাল্যকালে মধুময়,
যে সখ্যতা পাশে মন বাঁধা ছিল সদা রে।
সহপাঠী কেলিচর, অভেদাত্মা হরিহর,
এবে তাহাদের সঙ্গে কতবার দেখা রে।
পতঙ্গপালের মত কর্ম্মক্ষেত্রে অবিরত,
স্বকার্য্য সাধনে রত, কে বা ভাবে কাহারে।
আহা পুনঃ কত জন করিয়াছে পলায়ন,
মর্ত্ত্যভূমি পরিহরি শমনের প্রহারে।
গগন-নক্ষত্রবৎ, তাহারাই অকস্মাৎ,
প্রকাশে ক্বচিৎ কভু মৃদুরশ্মি মাখারে।
আগে ছিল কত সাধ, হেরিতে পূর্ণিমা চাঁদ,
হেরিতে নক্ষত্র-শোভা নীলনভঃ মাঝারে।
দিনদিন কত বার, জাগ্রতে নিদ্রিতাকার,
স্বপ্নে স্বপ্নে ভ্রমিতাম নদহ্রদকান্তারে।
বসন্ত বরষাকালে, পিকরব, মেঘজালে,
হেরিতে দামিনীলতা, কি আনন্দ আহা রে।
সে সাধ তরঙ্গকুল, এবে কোথা লুকাইল,
কে ঘুচালে জীবনের হেন রম্য ধাঁধাঁ রে।
বিশুদ্ধ পবিত্র মন, স্বর্গবাসী সিংহাসন,
পঙ্কিল করিল কে রে দগ্ধচিতা অঙ্গারে।
দৃষ্টি ও সৃষ্টি
দৃষ্টি ও সৃষ্টি
“Those organs which guide an animal are under man’s guidance and control.”
–Goethe
লক্ষ্য করবার জন্যেই হল চোখ, শব্দ ধরবার জন্যেই হল কান, হাত পা রসনা সব কটাই হল রূপ রস শব্দ স্পর্শ গন্ধ ধরে’ বিশ্বের চারিদিককে বুঝে নেবার জন্যে। সজীব সব মানুষেরই বুদ্ধির চারিদিকে ইন্দ্রিয় সকল নানা শক্তিশেল নিয়ে খবরদারি কাযে দিনরাত ব্যস্ত রইলো, এই হল স্বাভাবিক ব্যাপার; অথচ অর্জুনের লক্ষ্যভেদ, কিম্বা দশরথের শব্দভেদ এমনি নানা রকম ভেদবিদ্যার কৌশল শিক্রে পাখী থেকে আরম্ভ করে শিকারী মানুষে যখন লাভ করলো, দেখলাম তখন সেই জীব অথবা মানুষ নিজের চোখ কান হাত পা ইত্যাদিকে অস্বাভাবিক রকমে অসাধারণ শক্তিমান করে তুল্লে;—এই কথাই বলতে হয় আমাদের। ছেলেকে অক্ষর চিনতে শেখালে, বই পড়তে শেখালে তবে সে আস্তে আস্তে চোখে দেখতে পায় কি লেখা আছে, বুঝতে পারে পড়াগুলো, এবং ক্রমে নিজেই রচনা করার শক্তি পায় একদিন হয়তো-বা। যে মানুষ কেবল অক্ষর পরিচয় করে চল্লো, আর যে অক্ষরগুলোর মধ্যে মানে দেখতে লাগল, আবার যে রচনার নির্মাণ-কৌশল ও রস পর্যন্ত ধরতে লাগলো এদের তিন জনের দেখা শোনার মধ্যে অনেকখানি করে পার্থক্য যে আছে তা কে না বলবে! কাযেই দেখি—শিল্পই বল আর যাই বল কোন কিছুতে কুশল হয় না চোক হাত কান ইত্যাদি, যতক্ষণ এদের স্বাভাবিক কার্যকরী চেষ্টাকে নতুন করে সুশিক্ষিত করে তোলা না যায় বিশেষ বিশেষ দিকে—বিশেষ বিশেষ উপায় আর শিক্ষার রাস্তা ধরে। এই শিক্ষার তারতম্য নিয়ে আমাদের সচরাচর মোটামুটি দর্শন স্পর্শন শ্রবণ ইত্যাদির সঙ্গে শিল্পীর ও গুণীর দেখাশোনার পার্থক্য ঘটে। ছবি কবিতা সুর-সার প্রভৃতি অনেক সময়ে যে আমাদের কাছে হেঁয়ালীর মতো ঠেকে তা দুই দলের মধ্যে এই পরখ ও পরশের পার্থক্য বশতঃই হয়। কথাই আছে—‘কবিতারসমাধুর্য্যম্ কবির্বেত্তি’; ঠিক সুরে সুর মেলা চাই, না হলে যন্ত্র বল্লে ‘গা’, কণ্ঠ বলে উঠলো ‘ধা’।
জেগে দেখার দৃষ্টি ধ্যানে দেখার দৃষ্টির সঙ্গে মিলতে তো পারে না, যতক্ষণ না ধ্যানশক্তি লাভ করাই নিজেকে। এই জন্যেই কবিতা সঙ্গীত ছবি এ সবকে বুঝতে হলে আমাদের চোখ কানের সাধারণ দেখাশোনার চালচলনের বিপর্যয় কতকটা অভ্যাস ও শিক্ষার দ্বারায় ঘটাতে হয়, না হলে উপায় নেই। মানুষের সৃষ্টি বুঝতে যদি এই নিয়ম হল তবে সৃষ্টিকর্তার রচনাকে পুরো রকম বুঝে-সুঝে উপভোগ করার ক্ষমতা অনেকখানি সাধনার যে অপেক্ষা রাখে তা বলাই বাহুল্য।
“The scene which the light brings before our eyes is inexpressively great, but our seeing has not been as great as the scene presented to us; we have not fully seen! We have seen mere happenings, but not the deeper truth which is measureless joy”—Rabindranath
মোটামুটি দৃষ্টি,—তীক্ষ্ণদৃষ্টি, অন্তর্দৃষ্টি, দিব্যদৃষ্টি—এর মধ্যে মোটামুটি রকমের কার্যকরী দর্শন স্পর্শন শ্রবণ ইত্যাদি সমস্ত জীবেরই থাকে; তার উপরে উঠতে হলেই শিক্ষা ও অভ্যাস দিয়ে চক্ষুকর্ণের সাধারণ দেখা শোনার মধ্যে অদল-বদল কিছু না কিছু ঘটাতেই হয়। শিক্রে পাখী কতবার তার শিকার হারায় তবে তার চোখ এবং ঠোঁট আর আঙ্গুলের নখরগুলো সুশিক্ষিত হয়ে ওঠে মেঘের উপর থেকে লক্ষ্যভেদ করতে,—একেই বলে ধরার কায়দা, দেখার কায়দা। এই কায়দা ইন্দ্রিয়সকল লাভ করে অনেক দিনের শিক্ষা ও অভ্যাসে। চা খাবার সময় রুটির টুকরো যখন ফেলে দেওয়া যায়, তখন দেখি কাকগুলো সবাই একই কায়দায় সেগুলো এসে ধরে—মাটিতে রুটি পড়েছে যখন, তখন পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে ঠোঁটে করে সেটা টপ্ করে তুলে নেওয়াই দেখি সব কাকেরই দস্তুর; কিন্তু চিলগুলো সাঁ করে উড়ে এসে মাটিতে রুটি পৌঁছতে না পৌঁছতে লুফে নিয়ে পালায়। এই নতুন কায়দা আমার সাম্নে একটা কাককে দিনে দিনে অভ্যাস করে নিতে এই সেদিন দেখলেম এবং লক্ষ্যভেদ বিদ্যার দখলের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ কাকের দেখাশোনা চালচলন সমস্তই উল্টে-পাল্টে গেল তাও দেখলেম। শুধু ঐ একটুখানি শিক্ষা আর অভ্যাসের দরুণ কাকের মোটা দৃষ্টি বা স্বাভাবিক দৃষ্টি ও চালচলনের ওলট-পালট যদি কাকটা না ঘটাতো, তবে সব কাকদের মধ্যে সে অর্জুন হয়ে উঠতে পারতো না, কিম্বা সময়ে সময়ে চিলটিকেও সে হারিয়ে দিতে পারতো না রুটির লক্ষ্যভেদের সভায় আন্দাজের পরীক্ষায়। কুরু-পাণ্ডবে মিলে একশো পাঁচ ভাই, দ্রোণাচার্য যখন তাদের আন্দাজের পরীক্ষা নিলেন তখন দেখা গেল একশো চার ভায়ের শুধু চোখই আছে,—দৃষ্টি আছে কেবল একমাত্র অর্জুনের! দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরের দিন লক্ষ্যভেদের সময় অর্জুনের এই দৃষ্টিরহস্যের হিসেব আরো পরিষ্কাররূপে পরীক্ষা হয়েছিল। পৃথিবীর ধনুর্ধর একত্র হল স্বয়ম্বরে—কৃপ কৰ্ণ নানা বীর, কিন্তু লক্ষ্যভেদের বেলায় কারো চোখ দ্রৌপদীর রূপের প্রভা দেখলে, কারো দৃষ্টি নিজের গলার মণিহারের চমক্ লক্ষ্য করলে, কিন্তু লক্ষ্যভেদের যা আসল সামগ্রী সেটা জলের তলায় ঘূর্ণ্যমান সুদৰ্শন চক্রের প্রতিবিম্বের আড়ালে একটি বিন্দুর আকারে প্রকাশ পাচ্ছিল। সেটার বিষয়ে একেবারেই রাজারা অন্ধ রইলেন, এক অর্জুনের দৃষ্টি সেটা লক্ষ্য করলে ও বিঁধলে। অস্থির হয়ে ভ্রমণ করছে এই দুটি মাত্র আমাদের চোখের দৃষ্টি, একটু অন্ধকারে ঝাপসা দেখে, বেশী আলো পেলেও ঝলসে যাবার মতো হয়, দূরবীণ না হলে খুব দূরের জিনিষ দেখাই হয় না আমাদের! আবার যখন তিলকে দেখি তখন তালকে দেখি না, তাল দেখতে গেলে তিল বাদ পড়ে যায়। তা ছাড়া দৃষ্টি আমাদের সামনেই চলে, পিঠের দিকে যা ঘটছে একেবারেই দেখা সম্ভব হয় না যে চোখ এখন আছে তার দ্বারা। ঘড়ি যেমন শুধু ঘণ্টা প্রহর গুণে গুণে আমাদের জানিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারে না, গ্রীষ্মের দিন কি শীতের, অথবা দিন দুই প্রহর কি রাত দুই প্রহর, এটা জানাবার সাধ্যই হয়না যেমন ঘড়ির—যতক্ষণ না ঘড়ির মধ্যে কোন একটা বিপর্যয় শক্তি সঞ্চার করে দেওয়া হচ্ছে, তেমনি এই চোখের দৃষ্টির মধ্যে একটু অদল-বদল না ঘটাতে পারলে চোখ আমাদের ওঠা-বসা চলা-ফেরা এমনি কতকগুলো নির্দিষ্ট কাযের সহায় হয়ে যান্ত্রিক ভাবে খবরদারী করতেই নিযুক্ত থাকে। নিত্য চলাচলের পক্ষে যতখানি দরকার শুধু ততটুকু দেখাই, দিনরাতের মধ্যে বস্তু ও ঘটনাগুলোর মোটামুটি খবর পৌঁছে দেওয়াই হয় এদের কায; এই লোক অমুক, ও অমুক, নকিবের মতো এইটুকু ফুকরে যায় চোখ—অমুকের সম্বন্ধে তন্ন তন্ন খবর নেবার অথবা দেবার সময় নেই। একটা গাড়ি এল, চোখ কান চট্ করে সেটা ধরলে—মোটামুটি গাড়ির শব্দ, আর একটা আবছায়া, খুঁটিয়ে দেখার সময় নেই। গলির মোড়ে একটা ভিড় জমেছে—তার মাঝে পাহারাওলার লাল পাগড়ীর লাল রংএর ঝাঁজটা মাত্র লক্ষ্য করেই চোখ—মায় যার চোখ তাকে নিয়ে—কোন্ গলি ঘুঁজি দিয়ে কেমন করে যে একেবারে গড়ের মাঠে হাজির হয় তার কোন হিসেব দিতে পারে না! খুব বাঁধা ও খুব প্রয়োজনীয় কাযের ভার নিয়ে দরওয়ান ব্যস্ত থাকে; অভ্যাগত লোককে দেউড়ি ছেড়ে দেবার সময় শুধু মানুষটা চেনা কি অচেনা, ছোকরা কি বুড়ো এমনি মোটামুটিভাবেই দেখে নিয়েই তার কায শেষ। ঘুমোচ্ছি এমন সময় ঘরে খট্ করে শব্দ হল, কি গায়ে কিছু স্পর্শ করলে, অমনি কান হাত পা ইত্যাদি চট্ করে বুদ্ধিকে গিয়ে খবর দিলে—যন্ত্রের মতো সময় অসময় জ্ঞান নেই! ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে নিমেষে নিমেষে চোখ দেউড়ির ঝাঁপ খুলে বাইরেটা উঁকি দিয়ে দেখে নিচ্ছে আর নোট্ দিচ্ছে মানুষকে—এ হল তা হল, এ গেল সে গেল, এটা দেখা যাচ্ছে, ওটার খবর এখনো আসেনি! নিত্য নৈমিত্তিক কাযের অনেকখানি এই রকম মোটামুটি যান্ত্রিক রকমের দৃষ্টি দিয়েই চোখ আমাদের সম্পন্ন করে যাচ্ছে, এ ছাড়া অনেকখানি কায একেবারে চোখে না দেখে হাত পা ও গায়ের পরশ এবং পরখ দিয়ে একটু, আর সব ইন্দ্রিয়ের পরখের অনেকখানি মিলিয়ে করে চলেছি আমরা। জুতো পরায় জামা পরায়, চোখের পরখের চেয়ে গায়ের পরশ বেশি সাহায্য করে—কোন্টা আমার জুতো বা জামা চিনিয়ে দিতে। মানুষের নিত্য জীবন যাত্রার মধ্যে নিবিষ্টভাবে রয়ে-বসে দেখা এত অস্বাভাবিক আর বিরল যে কাযের মধ্যে হঠাৎ থম্কে দাঁড়ানো, নয়নভরে কিছু দেখে নেওয়া, স্থির হয়ে কিছু উপভোগ করার সময় পায় না বল্লেই হয় সাড়ে পনেরো আনা লোকের দর্শন স্পৰ্শন শ্রবণ ইত্যাদি,—এটা অত্যন্ত অদ্ভূত কিন্তু অত্যন্ত সত্য ঘটনা। এমন ছাত্র নেই যে প্রতি সন্ধ্যায় গোলদীঘির ধারে জমায়েৎ হয়ে দুচার ঘণ্টা না কাটায়, কিন্তু তাদের প্রশ্ন কর—গোলদীঘিটা গোল না চৌকা? হঠাৎ কেউ উত্তর দিতে পারবে না, গোলদীঘির লোহার রেলিং ত্ৰিশূলের আকার না বর্শার ধরণ? একশ’র মধ্যে একজন ছাত্র চট্ করে বলতে পারে কি না সন্দেহ। একটা রেলিং আছে এইটুকুই টুকে আসছে চোখ মনের নোট্ বইখানায় যন্ত্রের মতন, রেলিংএর কারুকার্য গড়ন পেটন নিবিষ্ট হয়ে দেখার প্রয়োজন এবং অবসরের দরকারই বোধ করেনি চোখ। খুব ছোট থেকে খুব বড় বয়সেও আমাদের বুদ্ধির কোঠায় দর্শন স্পর্শন শ্রবণ এরা অহোরাত্র খবর পাঠাচ্ছে; বাইরের ঘটনা বাইরের বস্তুর পরিষ্কার একটি-একটি চুম্বক রিপোর্ট চট্পট্ বুদ্ধির ঘরে টেলিগ্রাম করাই এদের সাধারণ কায। রাত পোহালো চোখ ঝাঁপ খুলেই দেখলে আলো হয়েছে, অমনি সঙ্গে সঙ্গে তার গেল বুদ্ধির কাছে—“রাতি পোহাইল, উঠ প্রিয় ধন, কাক ডাকিতেছে কররে শ্রবণ”। সকাল, এই বুদ্ধি অমনি জাগল মানুষের, দ্বিপ্রহরের রোদ চন্চনে হয়ে উঠলো অমনি স্পৰ্শন বুদ্ধির কাছে তার পাঠালে “ভানুতাপে তাপিত ধরণী”, মধ্যাহ্ন, বুদ্ধি উদয় হল মানুষের। এমনি অষ্টপ্রহর বুদ্ধির তাঁবেদারি করতেই কাট্ছে দিন দর্শনের স্পর্শনের শ্রবণের! একেবারে ঘড়িধরা এদের কায একটু এদিক ওদিক হলেই মুস্কিল—কুয়াশা বেশি হলে, বাদলা ঘন হলে এই প্রহরীরা অনেক সময়ে ঠিক ঠাউরে উঠতে পারে না সকাল কি সন্ধ্যে, টেলিগ্রাফে ভুল থেকে যায়, বিছানা ছাড়তে বেলা হয়, ভাত চড়তে তিনটে বাজে, এমনি নানা বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয় নিত্য কাযে। তখন বার বার ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখতে হয়, নয় তো জানলা খুলে বাইরে উঁকি দিতে হয় ক্রমান্বয়ে। শুনে দেখি, চেয়ে দেখি অথবা পরশ করেই দেখি, সাধারণ মানুষের জীবনে এই তিন দেখার সম্পর্ক হচ্ছে বস্তু-জগতের যেগুলো সচরাচর ঘটনা এবং বাইরের যে মোটামুটি খবর তারি সঙ্গে। প্রহরীর কায খবরদারীর কায; এর বেশি কায এদের দেওয়ার দরকারই হয় না জীবনে ইতর জীব থেকে মানুষ পর্যন্ত কারু, অতএব বলতেই হ’ল চোখ কান হাত এমনি সবার স্বাভাবিক কায ও অবস্থা হয় চট্পট্ দেখা শোনা ছোঁয়া ও জানা যান্ত্রিকভাবে। চোখে দেখলেম বাইরের পদার্থ তার রূপ রং ইত্যাদি, পাঁচ আঙ্গুলে পরশ করে দেখলেম সেগুলো; শুনে দেখলেম বাইরের খবরাখবর, এই ভাবে জগতের বস্তু ও ঘটনার বুদ্ধিটা বেড়ে চল্লো মানুষ থেকে ইতর জীব তাবতেরই। মুখ চোখ কান হাত পা সব দিয়ে জীব যেন পড়ে চল্লো বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ—বড় গাছ, লাল ফুল, ছোট পাতা, কিম্বা জল পড়ে, হাত নাড়ে, খেলা করে, অথবা নূতন বটী, পুরাণ বাটী, কাল পাথর, সাদা কাপড়—শুধু চোখের পড়া; কিম্বা যেমন মেঘ ডাকে, অথবা কাক ডাকিতেছে, বাঁশী বাজিতেছে, বেড়াল কাঁদিতেছে, মা বকিতেছে—শুধু শোনার পড়া; অথবা যেমন—শীতল জল, তপ্ত দুধ, নরম গদি, শক্ত লোহা—শুধু পরশ করার পাঠ। ইন্দ্ৰিয়সকলের সাহায্যে এই উপায়ে সবাই পড়ে চলেছে শিশুশিক্ষা থেকে বোধোদয় পর্যন্ত, এর বেশি পড়া সাড়ে পনেরো অানা মানুষ দরকারই বোধ করে না সারা জীবনে। বস্তু ও ঘটনার মোটামুটি বুদ্ধি হলেই চলে যায় সুখে স্বচ্ছন্দে প্রায় সকলেরই সাধারণ জীবনযাত্রা এবং এই মোটামুটি বুদ্ধির উদ্রেক করে দেওয়ার কাযে লেগে থাকতে থাকতে দর্শন স্পর্শন ও শ্রবণের শক্তিও এমন ভোঁতা হয়ে যায় যে কোন কিছুর সূক্ষ্ম দিকে বা গভীর দিকে যেতেই চায় না তারা। শিল্পকার্য সঙ্গীত, এবং কোন বিষয়ে পটুতা হয় না হ’তে পারে না ততক্ষণ, যতক্ষণ নানা ইন্দ্রিয়ের নিত্য এবং স্বাভাবিক ক্রিয়ার কতকটা অদল-বদল ঘটিয়ে না তোলা যায়। এমন কল সব আজকাল তৈরী হয়েছে যা চোখ যেমন করে দেখে ঠিক তেমনি করেই দেখে ও ধরে নেয় সৃষ্টির সামগ্রী চট্ করে নিমেষ ফেলতে! স্পর্শ করে কল, স্পর্শ ক’রে শিউরে উঠে, দুলে ওঠে গরম ঠাণ্ডার ওজন-মাপে এবং পরশের তন্ন তন্ন হিসেব লিখে চলে; বাদলা হবে কি ঝড় উঠবে তা বাতাসের পরশ পেয়েই বলে দেয় কল; উত্তর মেরুতে ভূমিকম্প হলে তার হিসেব রাখে দক্ষিণ সাগরের পরপারে বসে কল; আবার কল সে শুনছে, যা শুনছে তা লিখছে, যা লিখছে তা শুনিয়ে দিচ্ছে সুর করে বক্তৃতা দিয়ে আবৃত্তি অভিনয় করে পর্যন্ত। কাপড় কাচ্ছে কল, কাপড় ভাঁজ করে কাঁথা সেলাই করছে কল, দ্রুত দৌড়চ্ছে কল, আকাশে উড়ছে কল! এতে করে মনে হয় এই সমস্ত কল মিলিয়ে একটা কলের পুতুল যদি কোন দিন ছবি মূর্তি গান ইত্যাদি নানা জিনিষের সমালোচনা করতে এসে উপস্থিত হয় আমাদের মধ্যে তবে খুবই অদ্ভূত হবে সে ঘটনা, কিন্তু আরো অদ্ভূত হবে কলের পুতুলের ছবি মূর্তি গান কবিতা ইত্যাদির সমালোচনা। বস্তুতন্ত্রতা সেই কলের পুতুলে এত অভ্রান্ত রকমে থাকবে যে ছবি যদি প্রতিচ্ছবি, মূর্তি যদি প্রতিমূর্তি, গান যদি হরবোলার বুলি না হয় তো সে তখনি তার নিন্দা ও কঠিন সমালোচনা করে বসবে, কবিতা কল্পনা এ সবকে সে বলবে পাগলামি এবং ঠিক এখন সাধারণ মানুষ আমরা যেমন শিল্পশালায়, সঙ্গীতশালায় বা অভিনয়-ক্ষেত্রে ব্যবহার করি, অর্থাৎ বাস্তবের সঙ্গে শিল্পকার্য যতটা মেলে ততটা তার বাহবা দিই, একটু বাস্তবিকতার ভ্রান্তি উৎপাদনের ব্যাঘাত হলে বলে বসি ‘দূর ছাই’, কলের পুতুলটিও ঠিক সেই ব্যবহারই করবে। সাধারণতঃ শরীর-যন্ত্রগুলো আমাদের প্রবল বস্তু-পরায়ণতা নিয়ে দেখতে শুনতে পরশ এবং পরখ করতেই পাকা হয়ে উঠছে দিনের পর দিন। সারাজীবন বারে বারে একই জিনিষ দেখে শুনে, পরশ করে পরখ করতে করতে কাজের দক্ষতা এমন বেড়ে যায় হাত পা চোখ কানের, যে মেকি টাকা, ভেজাল ঘী, পাকা ও কাঁচা, সরেস ও নিরেস ছোঁয়া মাত্র দেখা মাত্র শোনা মাত্রই তারা ধরে দিতে পারে; কিন্তু এটুকু হয় শুধু আশপাশের বস্তুগুলোর সঙ্গে অনেক দিনের পরিচয়বশতঃ। শরীর-যন্ত্র, নিত্য ব্যবহারের নিত্য কাযের বস্তু ও ঘটনাগুলোর সম্বন্ধে এই অভ্রান্ত বস্তু-পরিচয়ের পাঠ সাঙ্গ করেই থেমে রইলো, এই হলো সাধারণ মানুষ হিসাবে আমরা দর্শন স্পর্শন শ্রবণ দিয়ে যতটা এগোতে পারি তার চরম পরিণতি। মানুষের দেখা শোনা ছোঁয়া সমস্তই কায ও বস্তু এবং বাস্তবিকতার সঙ্গে লিপ্ত হয়ে রইলো, নিখুঁত করে চিনে নিতে পারলে, অভ্রান্তভাবে ধরতে পারলে বাইরের এটা ওটা সেটা, এ ও তা, এমন তেমন ইত্যাদি বস্তু ও ঘটনা এই যে জ্ঞান একে বলা যেতে পারে বস্তু-বুদ্ধি বা বাস্তব-বুদ্ধি—কিন্তু কিছুতেই একে বলা চলে না বস্তুর রসবোধ শিল্পবোধ সৌন্দর্যবোধ অথবা অর্থবোধ। মানুষের এই বস্তুগত দৃষ্টি চিরদিন তার স্বার্থ-বুদ্ধির সঙ্গেই জড়ানো থাকে। নিত্য জীবনযাত্রার সঙ্গে আশপাশ থেকে যারা এসে মিলছে তাদেরই খবর আমরা দিন রাত অভ্রান্তভাবে নিয়ে চল্লেম এই বস্তুগত দৃষ্টি দিয়ে। ময়রা যেন চমৎকার মিঠাই গড়ে চল্লো মিঠাইয়ের রসবোধ করার কোন অপেক্ষা না রেখেও! কিম্বা জহুরী রত্ন-পরীক্ষায় এমন পাকা হয়ে উঠলো যে হাতে নিয়েই বলতে পারলে সামগ্ৰীটা কাচ কি হীরে, সরেস কি নিরেস; অথবা শব্দে কান এত পরিষ্কার হল যে কোথা কোমল কোথা বা অতি-কোমল পর্দ্দায় ঘা পড়ছে তা শোনামাত্র ধরে দিলে মানুষ। কিন্তু এই হলেই ময়রার জহুরীর ও কালোয়াতের রসবোধ সৌন্দর্য ও সুষমাবোধ সম্পূর্ণ হয়েছে তা জোর করে বলা চলে না। বস্তু-জগতের সঙ্গে পরিচয় বুদ্ধির দিক দিয়ে ঘটিয়ে দর্শন স্পৰ্শন শ্রবণ মানুষকে খুব দক্ষতা, চাতুর্য, বুদ্ধির পরিচ্ছন্নতা দিয়ে পাকা মানুষ কাযের মানুষ করে দেয় এটা যেমন সত্যি, আবার শুধু গুণগুলি নিয়েই মানুষ গুণী, কবি ও শিল্পী হয় না এটাও তেমনি সত্যি। সুরে কান হলেই যে মানুষ গান রচনা করতে পারে তা নয়, জহরৎ চিনলেই যে সবাই চমৎকার অলঙ্কার রচনা করতে পারে অথবা ভাল রসকরা গড়ে চল্লেই সে যে সৃষ্টির রসের রসিক হয়ে ওঠে তাও নয়। বহির্বাটির রাস্তা ঘাট নিয়ম-কানুন সমস্তই যেমন অন্দরমহলের সঙ্গে স্বতন্ত্র তেমনি বুদ্ধির প্রেরণা আর রসবত্তা বিকাশের পথ সম্পূর্ণ আলাদা। সদর দুয়ার দিয়ে বুদ্ধির কাছে পৌঁছচ্চে সৃষ্টির খবরাখবর, চলাচল কোলাহল করে, অবিরাম অস্থিরগতিতে সমস্তই সেখানে যাচ্ছে আসছে—কারো সঙ্গে দুদণ্ড রসালাপ করার সময় সেখানে অল্পই মেলে! নিত্য দেখা শোনা দ্বারায় ভাল করে মুখচেনা ঘটলেও কিছুর সঙ্গে অবসর মতো রয়ে-বসে রসের সম্পর্ক পাতানো সদর রাস্তা এবং সদর বাড়ীতে ক্বচিৎ সম্ভব হয়; এই কারণেই মানুষের ঘর, কাছারি ঘর, খাবার ঘর, শোবার ঘর, বৈঠকখানা, আফিস ঘর এমনি নানা কুঠরিতে ভাগ করা থাকে। অন্দরে অথবা বৈঠকখানার গানের ও নাচের মজলিসে প্রবেশ করতে হলে যেমন আফিসের চোগা চাপকান ছেড়ে উপস্থিত হতে হয়, কাযের দৃষ্টি কাযের কথা মায় কাযকে পর্যন্ত কড়া পাহারায় বাইরে আটকে, তেমনি রসবোধের রাজত্বে ঢোকবার কালে নিত্যকার দর্শন স্পর্শন শ্রবণের অনেকখানি পরিবর্তন করে চলে মানুষ—এটা কেবল মানুষেই পারে, ইতর জীব পারে না। কাযের সংস্পর্শ থেকে কিছুকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে চেয়ে-দেখা, শুনে-দেখা, ছুঁয়ে-দেখার অভ্যাস চোখ কান ও সমস্ত ইন্দ্রিয়কে দেওয়ার ক্ষমতা অনেকখানি সাধনার অপেক্ষা রাখে, তবে মানুষের শিল্পজ্ঞান রসবোধ জন্মায়। মানুষ অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে কখন? প্রাণের সঙ্গে বাক্যকে, চক্ষুর সঙ্গে মনকে, স্তোত্রের সঙ্গে আত্মাকে যখন সে মিলিত করে। মানুষের শরীর-যন্ত্রটাকে জীবনযাত্রার পথে নানা বিঘ্নবিপত্তি থেকে রক্ষা করে স্বচ্ছন্দে চালিয়ে নেবার কাযেই দক্ষ হয়ে উঠলো মানুষের ইন্দ্রিয় কটা নিজের নিজের পরিপূর্ণ শক্তি অনুসারে; দেখা শোনা ছোঁয়া ইত্যাদি নানা উপায়ে এইটুকুই হল। আর কাযভোলা দৃষ্টি সে হল অনন্যসাধারণ অস্বাভাবিক দৃষ্টি, শিশুকালের তরুণ দৃষ্টি কবির দৃষ্টি শিল্পীর দৃষ্টি। নিত্য কাযের ব্যাপার সরিয়ে একটা জিনিষে গিয়ে মানুষের দর্শন স্পর্শন শ্রবণ নিবিষ্ট হল নিবিড়ভাবে যখন, তখনই মন পড়ল জিনিষে, এবং মনে ধরা না ধরার কথা তখনই উঠলো। চোখ কান সমস্তকে কেবলি—পাতা পড়ে, জল নড়ে ইত্যাদি কাযের পড়া থেকে ছুটি দিয়ে সৃষ্টির জিনিষের ও ঘটনার দিকে ছেড়ে দেওয়া গেল, এতে মানুষের পরশ ও পরখ করার একটা কৌতূহল দেখা দিলে। কাযের জগতের বাঁধাবাঁধি নিয়মে দেখা শোনা করতে অপটু থাকে শিশুকালে সব মানুষ স্বভাবতঃই, বাপ মাকে তারা কাজে খাটায় নিজের ইন্দ্রিয়গুলোর চেয়ে, কাযেই সামান্য সামান্য জিনিষকেও বড় মানুষের চেয়ে বেশি কৌতূহলের সঙ্গে শিশুরা দেখবার শোনবার অবসর পায়, মন তাদের আকৃষ্ট হয় বস্তুর উপর ঘটনার দিকে অনেকখানি এবং মন তাদের খেলেও অনেকখানি অনেক জিনিষের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে অগাধ কৌতূহলে। শিশুকালের এই কৌতূহল দৃষ্টির কিছু কিছু রেশ্ মানুষের বয়সকালেও নানা জিনিষ ও ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেখা যায়—চন্দ্রোদয় সূর্যোদয় শুকতারা ফোটাফুল মেঘের ঘটা বিদ্যুৎ কিম্বা এক টুকরো হীরে অদ্ভুত গড়নের ঢেলা অথবা বিচিত্র গড়নের অলঙ্কার কি কিছু অথবা অদ্ভুত একটা সমুদ্রের ঝিনুক ইত্যাদি নানা টুকিটাকি নিয়ে খুব বয়সেও মানুষ অনেক সময়ে নাড়াচাড়া করছে কৌতূহলের বশে দেখা যায়। দক্ষিণাবর্ত শাঁখকে লক্ষ্মীকে ধরে রাখতে খুব কাযের জিনিষ বলে দেখা আর কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ্মীপেঁচার একটা পালকের চিত্র বিচিত্র নক্সা দেখা অথবা লক্ষ্মীর ঝাঁপিটা বোনা কিম্বা ঘড়ির ঘণ্টা শোনা ও নূপুরের ধ্বনি শোনায় প্রভেদ হচ্ছে ঐ কৌতূহলটি নিয়ে। তরুণ দৃষ্টিতে সৃষ্টির সামগ্ৰী কৌতুকে রহস্যে ভরা দেখায়, কাযের সংস্পর্শে বড় হতে হতে মানুষ যতই এগোতে থাকে ততই এই দৃষ্টির তারুণ্য সে হারাতে থাকে এবং শেষে এই সমস্ত বিশ্ব তারি সংসারের কাযে লাগবার জন্যে রয়েছে এমনো একটা বিশ্বাস সে করে ফেলে, বিশ্বে যেটাকে কাযের জিনিস বলে সে নিজে বোধ করে না সেটাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনতে চায় না, আর ছবি কবিতা প্রায় সবই বাজের কোঠায় ফেলে দিয়ে চলে মানুষ! স্ত্রী-পুত্র পরিবার পাড়াপ্রতিবেশী এমন কি টেবিল চেয়ারগুলোকেও খালি প্রয়োজনের দেখা প্রয়োজনের সম্পর্ক নিয়ে উপভোগ করে চলেছে এমন শক্ত মানুষ বড় অল্প নেই একথা সহজে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না, কিন্তু সকালে খবরের কাগজ পড়ার সময় কানের কাছে ছেলেগুলো শুধু-শুধু হৈ চৈ বাধিয়ে দিলে, কিম্বা ডিক্সনারির পাতাটা ছিঁড়ে নৌকা বানিয়ে বর্ষার দিনে জলে ভাসালে, অথবা দস্তুর মাফিক সাড়ে দশটায় ঘড়ির কাঁটা পৌঁছলেই ছেলে ইস্কুলের জন্যে তৈরি না হয়ে বিছানায় গিয়ে সটান শুয়ে পড়লে, ছেলে কাযের ব্যাঘাত করলে অকেজো হয়ে রইলো কাযের জিনিষ নষ্ট করলে এমনি শিশুচরিত্রকে কাযের চশমা দিয়ে উল্টো বুঝে নিজের চোখ কান লাল করে না তোলে এমন মানুষ কমই দেখি। কাযের জগতে চলাচল করতে করতে এই অত্যন্ত কাযের পরকলা এত শক্ত হয়ে আমাদের চোখে-দেখা, শুনে-দেখা ছুঁয়ে-দেখার উপরে বসে যায় যে মনে হয় চিরদিন এই ভাবে দেখে চলাই বুঝি সব মানুষেরই কায; কিন্তু অত্যন্ত ছেলে মানুষ যারা তারা আমাদের এই ধারণা উল্টে দিয়ে যায়, কবিরা উল্টে দিয়ে যায়, শিল্পীরা উল্টে দিয়ে যায়, আর ঠিক সেই মানুষগুলিকেই আমরা বালক পাগল নিৰ্বুদ্ধি বলে উড়িয়ে দিয়ে নিজেদের বুদ্ধিমত্তার দাবি সপ্রমাণ করে করে চলি। কিন্তু সৌন্দর্যে ভরা, রসে ভরা, রংএ ভরা, রূপে ভরা, ভাব লাবণ্য সব দিয়ে অনিন্দ্যসুন্দর করে রচনা করা এই সৃষ্টির মাঝে মানুষ কেবল বুদ্ধিমত্তার সত্তা নিয়ে বর্তে থাকবে নয়ন ভরে কিছু দেখে নিতে চাইবে না, প্রাণভরে মন দিয়ে কিছু শুনে যেতে চাইবে না, পরশ করে পুলকিত হতে চাইবে না, মানুষ সমস্ত বিশ্বের রস, এ যিনি মানুষকে মন দিয়ে সৃষ্টি করলেন তাঁর ইচ্ছে কখনও হতে পারে না। এবং এই কথাই সপ্রমাণ করতে প্রথমেই এল কায-ভোলা কায-ভোলানো শিশু খুব কাযের জগতে অফুরন্ত কৌতূহল অকারণ হাসি কান্না ইত্যাদি নিয়ে। সেই শিশু, দিন রাত কাযে কর্মে ভরা মানুষের ঘরের মধ্যে এসে তার কৌতুক কৌতূহল যারা জাগালো—মাটির ঢেলা, কাঠের টুকরো—তাদের নিয়ে নিরিবিলি আপনার খেলাঘর বাঁধলে—কল্পনা পক্ষিরাজের অতি অপূর্ব আস্তানা, সেখানে কায হয়ে গেল একেবারে খেলা, খেলাই হয়ে উঠলো মস্ত কায! কিন্তু কাযের জগৎ সেই শিশুর উপরে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো, শিশুকাল যেমন শেষ হতে থাকলো অমনি কাযও কোন কোন শিশুকে আস্তে আস্তে আপনার ঘরের দিকে টেনে নিতে লাগলো, একটু একটু করে খেলাঘর ভেঙ্গে গেল এবং কচি ছেলেকে কাযের যন্ত্রতন্ত্রগুলো দাঁতে চিবিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দিলে। আবার কোন ছেলেকে কায তেমন করে জোরে ধরতে পারলে না, কিম্বা কোন ছেলেটা কাযে পড়েও বাজের সাধনা অনেকখানি করে চল্লো, তারাই কাযের চাবুক এড়িয়ে গিয়ে কিম্বা সরে গিয়ে হয়ে উঠলো ভাবুক, অদ্ভুত কৌশলে তারা তাদের চোখে-দেখা, শুনে-দেখা, ছুঁয়ে-দেখা ইত্যাদি যে অত্যন্ত কাযের অফিস যোড়া তাদের পিঠে পক্ষিরাজের ডানা যুড়ে দিয়ে কায বাজাতে না গিয়ে, বাঁশি বাজাতে বেরিয়ে পড়লো জগতে। শিশুকালের হারানো চমৎকারি কাচ অনেক কষ্টে খুঁজে খুঁজে সেইটে বার করে সাদাসিধে কাযের চোখে-দেখা, শুনে-দেখা, ছুঁয়ে-দেখার উপরে যেমনি বেশ করে এঁটে দিলে মানুষ, অমনি স্বৰ্গ মর্ত পাতাল আবার তার কাছে তরুণ হয়ে দেখা দিলে, কৌতুকে কৌতূহলে ভরে উঠলো সৃষ্টির সামগ্ৰী! যে সব ইন্দ্রিয় কেবলি হিসেবের কাযে, পাহারার কাযে লেগেছিলো তারা হয়ে উঠলো কৌতূহলপরায়ণ এবং সন্ধানী, দিনের পর দিন বস্তুকে নিয়ে ঘটনাকে নিয়ে উল্টে-পাল্টে খেলতে আর দেখতে অথবা শুনতে লেগে গেল; শুধু ‘জল নড়ে ফল পড়ে’ এ পড়ায় আর রুচি হল না, কেমন করে জল চলচে, কেমন করে ফুল ফুটছে ঝরছে, কিবা সুরে পাখী গাইছে, আকাশের তারা কেমন করে চাইছে ইত্যাদি কেমন তা জানার আগ্রহ এবং চেষ্টা জেগে উঠলো। সাদাসিধে রকমের বুদ্ধির চাষ করে চলাতেই চোখে-দেখা, শুনে-দেখা ছুঁয়ে-দেখা বদ্ধ রইলো না। চঞ্চল দৃষ্টি এ-ফুলে ও-ফুলে এখনো উড়ে পড়তে লাগলো বটে, কিন্তু হঠাৎ দৃষ্টির চঞ্চলতার মধ্যে এক একটা সম্ আর ফাঁক পড়তে লাগলো, প্রজাপতি যেন হঠাৎ ডানা দুখানা স্থির করে আলোর পরশ, ফুলের পাপড়ির রং এবং ফুলের ভিতরকার কথা ধরবার চেষ্টা করতে থাকলো! দর্শন স্পর্শন শ্রবণের যান্ত্রিকতা কতকটা দূর হয়ে তাদের মধ্যে আন্তরিকতা একটু যেন বিকশিত হল। যে সব শরীর-যন্ত্রের কাযই ছিল বুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাইরের প্রেরণায় চট্পট্ সাড়া দেওয়া নির্বিচারে, অন্তরের সঙ্গে মানুষ যেমনি তাদের মুক্ত করে দিলে অমনি ভিতরকার প্রেরণায় তারা ধীরে সুস্থে একটুখানি যত্নের সঙ্গে একটু কৌতূহল নিয়ে যেন আত্মীয়তা পাতাতে চল্লো বাইরের এটা ওটা সেটার সঙ্গে, একটু দরদ পৌঁছল দেখা শোনা ছোঁয়ার মধ্যে। এ একটা মস্ত ওলট-পালট ঘটলো হাত পা চক্ষু কর্ণের কাযের স্বাভাবিক ও যান্ত্রিক ধারার—উজান টান ধরলো যমুনায়। ফুলের পাতার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সাড়া ধরার জন্য আচার্য জগদীশচন্দ্রের যে যন্ত্রটা, সেটা থেকে থেকে আনমনে যদি ফুলের এবং পাতার শোভা নিরীক্ষণ করতে আরম্ভ করে কায ভুলে, তবে নিশ্চয়ই সবাই বলবে যন্ত্রটা বিগড়েছে—যে ভাবে দেখা যে ভাবে শোনা যন্ত্রটার উচিত ছিল তা করছে না। কিন্তু যন্ত্রের ঐরূপ ব্যবহার দেখে একটা অত্যন্ত বিস্ময়কর বিপর্যয় শক্তি যে যন্ত্রটা লাভ করেছে তা কারু অগোচর থাকবে না। তেমনি ইন্দ্ৰিয়সকলের সাধারণ ক্রিয়ার মধ্যে নিরূপণ-ইচ্ছা নিবিষ্ট হবার চেষ্টা যারা ঘটায় অভ্যাস শিক্ষা ও সাধনার দ্বারায়, বলতেই হবে সেই সব মানুষের দেখা শোনা সমস্তই অনন্যসাধারণ বা অসামান্য রকমের একটা শক্তি পেয়েছে। এই যে কৌতূহল-প্রবণতা, দরদ দিয়ে সব জিনিষ দেখার অভ্যাস, কাযের দেখার প্রায় বিপরীত উপায়ে সৃষ্টির জিনিষকে আলিঙ্গন করে পরখ করা, ছেলেবেলাকার হারিয়ে-যাওয়া খেলাঘরের কাজ-ভোলা দৃষ্টি,—একে ফিরে পাওয়া দরকার কি না, এ নিয়ে মানুষে মানুষে মতভেদ দেখা যায় কিন্তু একদিনও মানুষ একটিবার সেই ছেলেবেলার দেখা শোনা খেলা ধূলোর মধ্যে ফিরে যেতে ইচ্ছা করলে না এমন ঘটনা মানুষে বিরল। চেষ্টা করলেই ছেলেবেলার সেই কাজ-ভোলা হারানো দৃষ্টি যে ফিরে পাওয়া যায় তা নয়। নাসার ডগায় দৃষ্টি স্থির করলেও, চাঁদ তারা মেঘ অথবা সূর্যের দিকে উদয়াস্ত হাঁ করে চেয়ে থাকলেও অথবা খাঁচায় কোকিল পুষে তার গান দিন রাত শুনে এবং দক্ষিণ বাতাসকে চাদর উড়িয়ে ছুঁয়েও যোগীর এবং ভাবুকের দৃষ্টি পাচ্ছে না কত যে লোক তার ঠিকানা নেই। সখ করে’ নানা সৌখীন জিনিষের সাজসজ্জার দিকে অথবা বিচিত্রা এই বিশ্ব প্রকৃতির শোভা সৌন্দর্যের দিকে চাওয়া হল বিলাসীর চাওয়া। বেতাল পঁচিশের ভোজনবিলাসী শয্যাবিলাসী এরা সাতপুরু গদির তলায় একগাছি চুল, রাজভোগ চালে শবগন্ধ অতি সহজেই ধরতে পারতো, কিন্তু বিলাসীর দেখা প্রকাণ্ড রকম স্বাৰ্থ নিয়ে দেখা, অত্যধিক মাত্রায় কাযের দেখা এ দৃষ্টি ভাবুকের দৃষ্টি কিম্বা কায-ভোলা শিশুর সরল দৃষ্টি একেবারেই নয়, অতিমাত্রায় বস্তুগত দৃষ্টিই এটা! এই ইন্দ্রিয়পরায়ণ দৃষ্টি নিয়ে শয়নবিলাসী, ভোজনবিলাসী দুটোতে মিলে বাসকসজ্জার কবিতা লিখতে চেষ্টা করলে যা হতো তা এই—
সুন্দরীর সহচরী ভাল জানে চর্য্যা।
রতন মন্দিরে করে মনোহর শয্যা॥
দুই দুই তাকিয়া খাটের দুই ধারি।
ডৌল ভাঙ্গি টাঙ্গাইল চিকন মশারি॥
ভক্ষ্য দ্রব্য নানা জাতি মণ্ডা মনোহরা।
সরভাজা নিখতি বাতাসা রসকরা॥
অপূর্ব্ব সন্দেশ নামে এলাইচ্ দানা।
ফুল চিনি লুচি দধি দুগ্ধ ক্ষীর ছানা॥
চিনির পানা কর্পূর চন্দন কালাগুরু বিছানা-বালিস লেপ-তোষক ইত্যাদি দিয়ে যে ত্রিপদী চৌপদী, সে গুলো কবিতা কিম্বা ভাবের তিন পায়া চার পায়া টেবিল চৌকি বল্লেও বলা চলে। বিলাসীর দৃষ্টির সঙ্গে ভাবুকের দৃষ্টির কোনখানে যে তফাৎ তা স্পষ্ট ধরা যাবে দুই ভাবুকের লেখা বাসকসজ্জার বর্ণন দিয়ে; যথা—
অপরূপ রাইক রচিত।
নিভৃত নিকুঞ্জ মাঝে, ধনী সাজয়ে
পুনঃ পুনঃ উঠয়ে চকিত॥
ধুয়োতেই, ভাব-সচকিত চাহনি নিভৃত নিকুঞ্জের অপরূপ শোভা মনকে দুলিয়ে দিলে; আবার যেমন—
আজ রচয়ে বাসক শেজ,
মুনিগণ চিত হেরি মুরছিত
কন্দর্পের ভাঙ্গে তেজ।
ফুলের অচির, ফুলের প্রাচীর
ফুলেতে ছাইল ঘর,
ফুলের বালিস আলিস কারণ
প্রতি ফুলে ফুলশর।
বিলাসীর দৃষ্টিতে ধরা পড়লো ভাল ভাল কাযের সাজ সরঞ্জাম যা টপ করে গিলে খেতে ইচ্ছে হয় তাই, আর ভাবুকের দৃষ্টিতে ধরা গেল সেইগুলো যাদের দিকে নয়ন ভরে দুদণ্ড চেয়ে দেখতে সাধ হয়। বিলাসীর দৃষ্টি স্বার্থের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থেকে সৃষ্টির যথার্থ শোভা সৌন্দর্য ও রসের বিষয়ে মানুষটাকে বাস্তবিকই অন্ধ করে রাখে অনেকখানি, আর ভাবুকের দৃষ্টি কায-ভোলা ছেলেবেলার দৃষ্টি সৃষ্টির অপরূপ রহস্যের খুব গভীর দিকটায় নিয়ে চলে মানুষকে। কাযেই ভাবুকের শোনা-দেখা বলা-কওয়ার মধ্যে শিশুসুলভ এমনতরো সরলতা ও কল্পনার প্রসার থাকে। ভাবুকদৃষ্টি এত অপরূপ অসাধারণভাবে দেখে-শোনে, দেখায়-শোনায় যে কাযের মানুষের দেখা-শোনা ইত্যাদির সঙ্গে তুলনা করে দেখলে ভাবুকের চোখে দেখা ছবি কবিতা সমস্তই হেঁয়ালী বা ছেলেমান্ষির মতই লাগে। কাযের দৃষ্টি নিয়ে মানুষের মন কোন্খানে কি ভাবেই বা খেলা করছে, আর ভাবুকের দৃষ্টি নিয়েই বা মন কোথায় কি খেলছে কেমন করে, দেখলেই দুয়ের তফাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠবে। প্রথমে কাযের কাজির দেখা দিয়ে লেখা মনের খেলা ঘরের দৃশ্য—
মন খেলাওরে দাণ্ডা গুলি
আমি তোমা বিনা নাহি খেলি॥
এড়ি বেড়ি তেড়ি চাইল,
চম্পাকলী ধুলা ধুলী।
এইবার ভাবুকের দৃষ্টি কবির মনটিকে কোন কায-ভোলা জগতের খেলাঘরের ছুটির মাঝে ছেড়ে দিয়ে গেল তারি ছুটি গান—
“আকাশে আজ কোন চরণের আসা-যাওয়া,
বাতাসে আজ কোন পরশের লাগে হাওয়া,
অনেক দিনের বিদায় বেলার ব্যাকুল-বাণী,
আজ উদাসীর বাঁশীর সুরে কে দেয় আনি,
বনের ছায়ায় তরুণ চোখের করুণ চাওয়া।
কোন ফাগুনে যে ফুল ফোটা হল সারা,
মৌমাছিদের পাখায় পাখায় কাঁদে তারা,
বকুল তলায় কায-ভোলা সেই কোন্ দুপুরে,
যে সব কথা ভাসিয়েছিলেম গানের সুরে,
ব্যথায় ভরে ফিরে আসে সে গান গাওয়া।”
কাযের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির মাঝে মনের মরুভূমির উপরে যেন হঠাৎ আকাশ থেকে শ্যামল ছায় নাম্লো, জল ভরে এলো চোখের কোণে, কান শুনলে বাঁশীর সুর উন্মনা হয়ে, কায-ভোলা মন বকুল তলার নিবিড় ছায়ায় খুঁজতে লাগলো ছেলেবেলার হারানো খেলার সাথীকে, আর গাইতে লাগলো ক্ষণে ক্ষণে—
“শূন্য করে ভরে দেওয়া যাহার খেলা
তারি লাগি রইনু বসে সকল বেলা।”
এমনিতরো ভাবুক দৃষ্টি দিয়ে সব মানুষের শিশুকাল সৃষ্টির যা কিছু—আকাশের তারা থেকে মাটির ঢেলাটাকে পর্যন্ত—একদিন দেখে চলেছিল, কিন্তু অবোলা শিশুকাল আমাদের কেমন দেখলে কেমন শুনলে সেটা খুলে বলতে পারলে না, এঁকে দেখাতে পারলে না। কবিতা ছবি ইত্যাদি লেখার কৌশল, ভাষার খুঁটিনাটি, ছন্দের হিসেব না জানার দরুণ শিশুকাল আমাদের কবির ভাষায় ছবির ভাষায় আপনাকে ব্যক্ত করতে পারলে না। শিশুর তরুণ দৃষ্টির মধ্যে সৃষ্টির সামগ্রীকে সখীভাবে খেলাবার সাথী বলে চেয়ে দেখবার শুনে দেখবার ছুঁয়ে দেখবার একটা আগ্রহ থাকে, সেই একাগ্রতা দিয়ে দেখা শোনা ছোঁয়ার রসটা ছেলেমেয়েরা উপভোগ করে মহানন্দে, কিন্তু সে আনন্দ ব্যক্ত করে কেবল অভিনয় ছাড়া আর কিছু দিয়ে এমন সাধ্য শিশুর পুঁজি নিয়ে হয় না। শিশু যখন একটা কিছু বর্ণনা করে তখন তার মুখ চোখ হাত পা সমস্তই যেন ঘটনাটাকে মূর্তি দিয়ে বাইরে হাজির করবার জন্যে আকুলি ব্যাকুলি করছে দেখা যায়, যেটা বড় হয়ে আমরা কবিতায় অথবা ছবিতে ব্যক্ত করি সেটা অভিনয় ক’রে ব্যক্ত করা ছাড়া শিশুকাল আর কিছুই করতে পারে না; এমন বিচিত্র ভঙ্গিতে হেসে কেঁদে নেচে, কখন গলা জড়িয়ে, কখন ধূলায় লুটিয়ে, আধ আধ কথায় অতি মনোহর অতি চমৎকারী একটা নিজের অদ্ভুত রকমে সৃষ্টি করা ভাষায় শিশু আপনার দেখা শোনা সমস্তই ব্যক্ত করে চলে যে, বড় হয়ে যারা আপনাদের দৃষ্টি শ্রবণ স্পর্শনের উপরে অত্যন্ত কাযের চশমা এঁটে দিয়েছে তাদের বোঝাই মুস্কিল হয় শিশুকাল অনাসৃষ্টি কি দেখছে, কিবা দেখাতে চাচ্ছে, কি শুনছে কিবা শোনাচ্ছে! শিশুর হৃদয় যে ভাবে গিয়ে স্পর্শ এবং পরখ করে নেয় বিশ্বচরাচরকে, একমাত্র ভাবুক মানুষই সেই ভাবে বিশ্বের হৃদয়ে আপনার হৃদয় লাগিয়ে দেখতে পারেন শুনতে পারেন, এবং অবোলা শিশু যেটা বলে যেতে পারলে না সেইটেই বলে যান ভাবুক কবিতায় ছবিতে,—রেখার ছন্দে লেখার ছন্দে সুরের ছন্দে অবোলা শিশুর বোল, হারানো দিনগুলির ছবি। অফুরন্ত আনন্দ আর খেলা দিয়ে ভরা শিশুকালের দিন-রাতগুলোর জন্যে সব মানুষেরই মনে যে একটা বেদনা আছে, সেই বেদনা ভরা রাজত্বে ফিরিয়ে নিয়ে চলেন মানুষের মনকে থেকে থেকে কবি এবং ভাবুক—যাঁরা শিশুর মতো তরুণ চোখ ফিরে পেয়েছেন। খুব খানিকটা ন্যাকামোর ভিতর দিয়ে নিজেকে এবং নিজের বলা কওয়া গুলোকে চালিয়ে নিয়ে গেলেই আমাদের সৃষ্টির ও দৃষ্টির মধ্যে তারুণ্য ফিরে পাওয়া সহজেই যাবে এটা অত্যন্ত ভুল ধারণা—শিশুকাল ন্যাকামি দিয়ে আপনাকে ব্যক্ত করে না, সে যথার্থই ভাবুক এবং আপনার চারিদিককে সে সত্যই হৃদয় দিয়ে ধরতে চায় বুঝতে চায় এবং বোঝাতে চায় ও ধরে দিতে চায়। শুধু সে যা দেখে শোনে সেটা ব্যক্ত করার সম্বল তার এত অল্প যে, সে খানিকটা বোঝায় নানা ভঙ্গি দিয়ে, খানিক বোঝাতে চায় নানা আঁচড় পোঁচড় নয় তো ভাঙ্গা ভাঙ্গা রেখা লেখা ও কথা দিয়ে,—এইখানে কবির সঙ্গে ভাবুকের সঙ্গে পাকা অভিনেতার সঙ্গে শিশুর তফাৎ। দৃষ্টি দুজনেরই তরুণ কেবল একজন সৃষ্টি করার কৌশল একেবারেই শেখেনি, আর একজন সৃষ্টির কৌশলে এমন সুপটু যে কি কৌশলে যে তাঁরা কবিতা ও ছবির মধ্যে শিশুর তরুণ দৃষ্টি আর অস্ফুট ভাষাকে ফুটিয়ে তোলেন তা পর্যন্ত ধরা যায় না।
ন্যাকামো দিয়ে শিশুর আবোল তাবোল আধ-ভাঙ্গা কতকগুলো বুলি সংগ্রহ করে, অথবা শিশুর হাতের অপরিপক্ব ভাঙ্গাচোরা টানটোন আঁচড় পোঁচড় চুরি করে বসে বসে কেবলি শিশু-কবিতা শিশু-ছবি লিখে চল্লেই মানুষ কবি শিল্পী ভাবুক বলতে পারে নিজেকে এবং কাজগুলোও তার মন-ভোলানো হয়, এ ভুল যারা করে চলে তারা হয়তো নিজেকে ভোলাতে পারে কিন্তু শিশুকেও ভোলায় না, শিশুর বাপ-মাকেও নয়। ছেলে-ভুলানো ছড়া একেবারেই ছেলেমান্ষি নয়, তরুণ দৃষ্টিতে দেখা শোনার ছবি ও ছাপ সেগুলি—
“ও পারেতে কাল রং, বৃষ্টি পড়ে ঝম্ ঝম্
এ পারেতে লঙ্কা গাছ রাঙ্গা টুক্ টুক্ করে
গুণবতী ভাই আমার মন কেমন করে!”
অজানা কবির গান ছেলেমান্ষি মোটেই নয়, এতে ছেলে বুড়ো সবার মন ভুলিয়ে নেয়। আমাদের খুব জানা কবি এই সুরেই সুর মিলিয়ে বাঁধলেন এরি মত সরল সুন্দর ভাষায় ও ছন্দে আপনার কথা—
“ওই যে রাতের তারা
জানিস্ কি মা কারা?
সারাটি-খন ঘুম না জানে
চেয়ে থাকে মাটির পানে
যেন কেমন ধারা।
অামার যেমন নেইক ডানা
আকাশেতে উড়তে মানা,
মনটা কেমন করে,
তেমনি ওদের পা নেই বলে
পারে না যে আসতে চলে
এই পৃথিবীর পরে।”
আমাদের তরুণ-চোখের নয়নতারা একদিন আকাশের তারার দিকে চেয়ে সে সব কথা ভেবেছিল, কিন্তু যে ভাবনা ব্যক্ত করতে পারেনি আমাদের শিশুকাল, এতকাল পরে সেই ভাবনা ফুটে উঠলো কবির ভাষায়।
কাযের চশমা পরানো দৃষ্টি যেটা বড় হয়ে অবধি মানুষ দর্শন স্পর্শন শ্রবণের উপরে লাগিয়ে চলাফেরা করছে, সেটার মধ্যে দিয়ে উঁকি দিয়ে চল্লে তারাগুলো মিট্মিটে আলোর কিম্বা খুব মস্ত মস্ত পৃথিবীর মতও দেখায়, কিন্তু আকাশের তারার মাটিতে নেমে আসা দেখা অথবা আকাশে বসে তারাগুলো যে কথা ভাবছে সেটা শুনিয়ে দেওয়া একেবারেই সম্ভব হয় না উক্ত চশমা দিয়ে দেখে। ভাবুক যাঁরা, সচরাচর যান্ত্রিক দৃষ্টি যাঁদের নয়, তাঁদেরই পক্ষে সহজ হয় শিশুদের মতো হৃদয় দিয়ে আত্মীয়ভাবে বিশ্বচরাচরের সঙ্গে পরিচয় করে নিয়ে বিশ্বের গোপন কথা বলা, আর গদ্যময় কাযের সাধারণ চশমা দিয়েই দেখলেম অথচ দেখতে চাইলেম ভাবুকের মতো গাঁথতে চাইলেম পদ্য—কিন্তু পদ্য কেন, ভাল একটা গদ্যও রচা গেল না সেই যান্ত্রিক দৃষ্টি নিয়ে—কল্পনা ভাবুকতা এ সবের বদলে সাধারণ কথা এবং কাযের কথাই সেখানে বিকট ছাঁদে আমাদের সামনে হাজির হল; যথা—
“মন্ত্রী রূপে চারিদিকে যত তারাগণ
ঘেরিয়াছে নলিনীরে শৈবাল যেমন।
শশী আর তারাবৃন্দ গগনে শোভিত
দেখিলেই মনোপথ হয় প্রফুল্লিত॥”
চাঁদকে ঘিরে তারাগুলো যখন সারারাত কি যেন মন্ত্রণা করছিল, নিশ্চয়ই এই কবিতার কবি সেই সময় লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুম দিচ্ছিলেন, নয় তো খুব কাযের চশমা পরে মকদ্দমার নথি পড়ছিলেন। সুতরাং ‘মনোপথ’ যাতে ‘প্রফুল্লিত’ হয় এমন একটা সামগ্ৰী তিনি দিয়ে যেতে পারলেন না, কিন্তু ধরতেও পারলেন না চোখ কান হাত পা কিছু দিয়েই।
“ভোলা” “বাঁকা” হিন্দুস্থানীতে এ দুটোর অর্থ সুশ্রী, আবার কুব্জাও বাঁকা শ্যামও বাঁকা, একজন সুন্দর বাঁকা একজন যৎকুচ্ছিত বাঁকা; তেমনি একথা যদি কেউ বোঝেন যে সব জিনিষকে সোজাসুজি সাধারণ দৃষ্টি দিয়ে না দেখে বাঁকা রকম করে দেখলেই কিম্বা উল্টো পাল্টা করে দেখালেই নিজের দৃষ্টির মধ্যে এবং নিজের বলা কওয়া লেখা ইত্যাদির মধ্যে ভাবুকতা রস সৌন্দর্য প্রভৃতি ভরে উঠবে কানায় কানায়, তবে তার মত ভুল আর কিছু হবে না।
ভাবুকের কায-ভোলা দৃষ্টি অত্যন্ত কাযের সামগ্রী। ধানক্ষেতটা ঠিক কাযের মানুষ হিসেবে না দেখলেও ক্ষেত ও মাঠের সৌন্দর্য যে নির্ভুল ও নিখুঁতভাবে তার কাছে ধরা পড়ে এবং সেই দৃষ্টি দিয়ে দেখা মাঠের বর্ণনা ও ছবি খুব কাযের চশমা দিয়ে দেখা ও দেখানো মাঠের রূপটার চেয়ে মনোরম পরিষ্কার হয়ে যে ফুটে ওঠে ভাবুকের লেখায় বণে বর্ণে, তা এই কাযের চশমা আর ভাবের চশমা দিয়ে দেখা ক্ষেত আর মাঠের দুটি বর্ণনা থেকে পরিষ্কার ধরা যাবে।
প্রথম কাযের চশমা দিয়ে দেখা মাঠ বর্ণন, মাষ্টার মশায় যেন উপদেশ দিলেন শিশুকে—যে মাঠে ছুটাছুটিই করতে চায় তাকে—
“হে বালক! মাঠে গিয়ে দেখে এস তুমি
কত কষ্টে চাষা লোক চষিতেছে ভূমি॥
পরিপাটি করে মাটি হ’য়ে সাবধান
তবে তায় শস্য হয়—ছোলা মুগ ধান৷”
এই কাযের দৃষ্টি দিয়ে মাঠকে তো দেখাই গেল না, শস্য কেমন করে হয়, মাটি পরিপাটি হয় কিসে, তাও দেখলেম না; মাটি পরিপাটিরূপে বর্ণন ও দর্শন কি করে হয় তা জানতে কাযেই ভাবুকের কাছে দৌড়োতেই হল আমাদের। সেখানে গিয়ে শস্যক্ষেত্রের এক অপরূপ রূপ দেখলেম—
নবপ্রবালোদ্গমশস্যরম্যঃ প্রফুল্ললোধ্রঃ পরিপক্বশালিঃ
বিলীনপদ্মঃ প্ৰপতত্তুষারঃ
কিম্বা যেমন—
পরিণত-বহুশালি-ব্যাকুল-গ্রাম-সীমা
সততমতিমানজ্ঞক্রৌঞ্চনাদোপগীতঃ॥
নিছক কাযের দৃষ্টি দিয়ে কাযের মানুষের কাছে মাঠখানা কৃষিতত্ত্বের ও নীতিশাস্ত্রের বইয়ের পাতার মতোই দেখালো, মাঠের সবুজ প্রসার কেমন করে গ্রামের কোন্ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে তা দেখলে ভাবুক। কাযের দৃষ্টি দেখলে মুগ মুসুরী ছোলা কলা ধান ফলানো হচ্ছে মাঠের পাট করে, কিন্তু ধান পেকে কোথায় সোনার মতো ঝক্ছে, লোধ্র গাছ গ্রামের ধারে কোথায় ফুল ফুটিয়েছে, রাঙ্গা, সবুজ, নানা বর্ণের শস্য, শিশিরে নুয়ে পড়া পদ্মফুল এসব কিছু ধরতে পারলে না অত্যন্ত কাযের কাজি দৃষ্টিটা, অথচ মাঠের ছবি যথার্থ যদি দিতে হয় কি দেখতে হয় মাঠ কেমন করে চষা হয় এটা দেখানোর চেয়ে মাঠে কোথায় কি রং লেগেছে কি ফুল ফুটেছে ইত্যাদি নানা হিসেব না নিলে তো চলে না, সে হিসেবে ভাবুক দৃষ্টি ঠিক দেখার মতো দেখাই দেখলে বলতে হবে।
কাযের দৃষ্টি মানুষের স্বার্থের সঙ্গে দৃষ্টির জিনিষকে জড়িয়ে দেখে, আর ভাবুকের দৃষ্টি অনেকটা নিঃস্বাৰ্থ ভাবে সৃষ্টির সামগ্ৰী স্পর্শ করে। কাযের মানুষ দেখে কেম্বিসটা পর্দা কি ব্যাগ অথবা জাহাজের পাল প্রস্তুতের বেশ উপযুক্ত, কিন্তু ভাবুক অমন মজবুত কাপড়টা একটা ছবি দিয়ে ভরে দেবারই ঠিক উপযোগী ঠাউরে নেয়। সাদা পাথর, কাযের দৃষ্টি বলে সেটা পুড়িয়ে চুণ করে ফেল, ভাবুক দৃষ্টি বলে সেটাতে মূর্তি বানিয়ে নেওয়াই ঠিক। নির্মম স্বাৰ্থদৃষ্টি, কাযের চোখ নিয়েই সাধারণ মানুষ নিজের মুঠোয় ফুটন্ত ফুলগুলোর গলা চেপে ধরে বলির পাঁঠার মতো, সেগুলোকে বাগানের বুক থেকে ছিঁড়ে নিয়ে পূজোর ঘরের দিকে চলে, আর ভাবুক যে দৃষ্টি নিয়ে ফুলের দিকে চায় তাতে স্বার্থের ভার এত অল্প যে প্রজাপতি কি মৌমাছির পাতলা ডানার অত্যন্ত লঘু অতি কোমল পরশও তার কাছে হার মানে। অতি মাত্রায় সাধারণ অত্যন্ত কাযের দৃষ্টি সেটা ফুলের গুচ্ছকে পরকালের পথ পরিষ্কারের ঝাঁটা বলেই দেখছে, ছেলেবেলার কৌতূহল-দৃষ্টি সেটা রাঙ্গা ফুলের দিকে লুব্ধ দৃষ্টি নিয়ে ডাকাতের মতো বাগান থেকে বাগানের শোভাকে লুটে নিয়ে খেলতে চাচ্ছে। কিম্বা বিলাসের দৃষ্টি যেটা ফুলগুলোর বুকে সূঁচ বিঁধে বিঁধে ফুলের ফুলশয্যা রচনা করে তার উপরে লুণ্ঠন বিলুণ্ঠন করে ফুলের শোভা মলিন করে দিয়ে যাচ্ছে। এদের চেয়ে ভাবুকের দৃষ্টি কতখানি নিঃস্বার্থ নির্মল অথচ আশ্চর্যরকম ঘনিষ্ঠভাবে ফুলকে দেখলে, ভাবুকের লেখাতেই ধরা রয়েছে—
“চল চলরে ভঁবরা কঁবল পাস
তেরা কঁবল গাবৈ অতি উদাস।
খোঁজ করত বহ বার বার
তন বন ফুল্যৌ ভার ভার॥”
—কবীর
কবি কালিদাস এই দৃষ্টি দিয়েই দুষ্মন্ত রাজাকে দেখালেন শকুন্তলার রূপ—
অনাঘ্ৰাতং পুষ্পং কিসলয়মলূনং কররুহৈ……মধুনবমনাস্বাদিতরসম্!
কিন্তু রাজার বিদূষকের ইন্দ্রিয়পরায়ণ দৃষ্টি অত্যন্ত মোটা পেটের মতই মোটা ছিল, কাযেই রাজার কাছে শকুন্তলার বর্ণন শুনে সে পিণ্ডি খেজুর আর তেঁতুলের উপমা রাজাকে শোনাতে বসে গেল। রাজা বিদূষককে ধমকে বলেন—
অনবাপ্তচক্ষুঃফলোঽসি, যেন ত্বয়া দ্রষ্টব্যানাং পরং ন দৃষ্টম্॥
তুমি দর্শনীয় বস্তুর যেটি দেখবার যোগ্য সেইটি যখন দেখতে পেলে না তখন তুমি বিফলই চক্ষু পেয়েছো।
রাবণটার চেয়ে-দেখা, শুনে-দেখা, ছুঁয়ে-দেখা সমস্তই রামের দেখার চেয়ে দশগুণ বেশি ছিল—
“কুড়ি হাত কুড়ি চক্ষু দশটা বদন
রাক্ষসের রাজা সেই লঙ্কার রাবণ।
ত্ৰিভুবন তাঁহার ভয়েতে কম্পবান
মনুষ্য রামেরে সেটা করে কীটজ্ঞান।”
রাবণের দশটা মাথার মধ্যে কি ভয়ঙ্কর রকম বস্তুগত বুদ্ধিই দিনরাত প্রবেশ করতো তার দশ দিকে বিস্তৃত দর্শন স্পর্শন শ্রবণ ইত্যাদির রাস্তা ধরে, ভাবলেও অবাক হতে হয়। কিন্তু সীতার পণ ভাঙ্গা সুসাধ্য হল বালক রামের—কুড়ি-হাত রাবণের নয়। কেননা ধনুকভঙ্গের সময় রামের মনটি রামের হাতের পরশে গিয়ে যুক্ত হয়েছিল, আর রাবণের মন নিশ্চয়ই সীতার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়েছিল, ধনুক তোলা ধনুক ভাঙ্গা যে ক’টা আঙ্গুলে হতে পারে তাদের ডগাতেও পৌঁছোয়নি সময়মতো।
দিনরাতের মধ্যে যে সব ঘটনা হঠাৎ ঘটে কিম্বা আকস্মিকভাবে উপস্থিত হয় প্রতিদিনের বাঁধা চালের মধ্যে সেগুলোকে মানুষ খুব কাযে ব্যস্ত থাকলেও অন্ততঃ এক পলের জন্যেও মন দিয়ে না দেখে থাকতে পারে না। হঠাৎ পূব কি পশ্চিম আকাশ রঙ্গে রাঙ্গা হয়ে উঠলো; দৃষ্টির সঙ্গে মন তখনি যুক্ত হয়ে দেখে কি হল; পাড়ায় ট্রামের ঘন্টার টুং টাং এর উপরে হঠাৎ কোন সকালে বাঁশীর সুর বাজলে মন বলে ওঠে, কি শুনি? হঠাৎ দক্ষিণ বাতাস ঘরের ঝাপটা নাড়িয়ে দিলে, মন যেন ঘুম ভেঙ্গে চমকে বলে, শীত গেল নাকি দেখি! পাড়ার যে ছেলেটা প্রতিদিন বাড়ির সামনে দিয়ে ইস্কুলে যায় তাকে দু’একদিনেই চিনে নিয়ে চোখ ছেলেটার দিকে ফেরা থেকে ক্ষান্ত থাকে; কিন্তু সেই ছেলেটা হঠাৎ বাঁশী বাজিয়ে বর সেজে দুয়োর গোড়া দিয়ে শোভাযাত্রা করে যখন চলে তখন নয়ন মন শ্রবণ সবাই দৌড়ে দেখতে চলে—আর সেই দেখাটাই মনের মধ্যে লুকোনো রস জাগিয়ে দেয় হঠাৎ। তাং রাঘবং দৃষ্টিভিরাপিবন্তো, নার্য্যোন জগ্মুর্ব্বিষয়ান্তরাণি তথাপি শেষেন্দ্রিয়বৃত্তিরাসাং সর্ব্বাত্মনা চক্ষুরৈব প্রবিষ্টা। —যা হঠাৎ এল তার দিকে, সমস্ত ইন্দ্রিয়-ব্যাপারের আকৃষ্ট হবার একটা চেষ্টা থেকে থেকে জাগে আমাদের সকলেরই। কিন্তু বাইরে থেকে প্রেরণাসাপেক্ষ চোখ কান ইত্যাদির এই কৌতূহল সব সময়ে জাগিয়ে রাখতে পারেন কেবল ভাবুকেরাই—বিশ্ব-জগৎ একটা নিত্য উৎসবের মধ্যে দিয়ে নতুন নতুন রসের সরঞ্জাম নিয়ে ভাবুকের কাছে দেখা দেয় এবং সেই দেখা ধরা থাকে ভাবুকের রেখার টানে, লেখার ছাঁদে, বর্ণে ও বর্ণনে, কাযেই বলা চলে বুদ্ধির নাকে চড়ানো চলতি চশমার ঠিক উল্টো এবং তার চেয়ে ঢের শক্তিমান চশমা হল মনের সঙ্গে যুক্ত ভাবের চশমাখানি।
এমন মানুষ নেই যার শ্রবণের সঙ্গে ছুটির ঘণ্টা আর কাযে যাবার ঘণ্টার ছেলেবেলা থেকেই বিশেষ যোগাযোগ আছে; কিন্তু সচরাচর এত কাযের ভিড়ে মানুষকে ঘিরে থাকে যে ভাবুক, মন দিয়ে এই ঘণ্টা শুনে যতক্ষণ না বলে দেন ঘণ্টা দুটো কি বলে ততক্ষণ ঘণ্টাটা শোনাই আমাদের হয় নি—যথার্থভাবে একথা বলা যায়। সবারই কানে আসে সন্ধ্যা পূজোর শঙ্খধ্বনি, সন্ধ্যায় আঁধার-করা ছবি চোখে পড়ে সবারই, কিন্তু সেই শঙ্খধ্বনি সন্ধ্যারাগের সঙ্গে মিলিয়ে সুর দিয়ে ছন্দ দিয়ে একটি অপরূপ রূপ ধরিয়ে যখন ভাবুক মানুষ আমাদের শুনিয়ে দিলেন দেখিয়ে দিলেন কেবল তখনই তো সন্ধ্যা, সন্ধ্যাপূজা এমন কি সন্ধ্যাকালের এই পৃথিবীকে যথার্থভাবে দেখতে শুনতে পেলেম আমরা—
“সন্ধ্যা হল গো—
ওমা সন্ধ্যা হল বুকে ধর
অতল কালে৷ স্নেহের মাঝে
ডুবিয়ে আমায় স্নিগ্ধ কর॥
ফিরিয়ে নে, মা, ফিরিয়ে নে গো
সব যে কোথায় হারিয়েছে গো
ছড়ানো এই জীবন, তোমার
আঁধার মাঝে হোক্ না জড়॥
আর আমারে বাইরে তোমার
কোথাও যেন না যায় দেখা
তোমার রাতে মিলাক আমার
জীবন-সাঁঝের রশ্মিরেখা॥
আমায় ঘিরি’ আমায় চুমি’
কেবল তুমি, কেবল তুমি!
আমার বলে যাহা আছে, মা
তোমার করে সকল হর॥”
বুক সন্ধ্যার বুকের স্পন্দন অনুভব করলে, নয়নের দৃষ্টি অতল কালোর স্নেহভরা পরশ নিবিড় করে উপভোগ করলে, ফিরে এলো নতুন করে তরুণ দৃষ্টির করুণ চাহনি, নতুন করে জাগালো প্রাণভরে শুনে নেবার, গেয়ে ওঠবার ইচ্ছা, সারা সংসারে ছড়ানো জীবনের দিনগুলো সাঁঝের আঁধারের মধ্যে দিয়ে মিল্লো এসে একেবারে।
সন্ধ্যা তারার কোলের কাছটিতে রহস্য নিকেতনে, আলো আর কালোর ছন্দে প্রাণকে দুলিয়ে দিলে, রাতের সুরে গিয়ে মিল্লো দিনের সুর, আঁধারে গিয়ে মিশলো—আলো। একেবারে ঢেলে দেওয়া গেল সব স্বার্থে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজকে গভীর রিক্ততার প্রশান্ত আলিঙ্গনে। সন্ধ্যা, কতদিন ধরে যার সঙ্গে দেখা-শোনা হয়ে আসছে তাকে এমন করে দেখা ক’জন দেখলে? নিত্য সন্ধ্যার হাওয়াটা গড়ের মাঠে গিয়ে খেয়ে এসে এবং পূজো-বাড়িতে গিয়ে শাঁখঘণ্টা শুনে এসে আমরা পুঁথিগত ত্রিসন্ধ্যার মন্ত্রগুলোর চেয়ে একটুও অধিক দেখতে শুনতে পেলেম না। কিন্তু কবীর দুছত্রে সমস্ত সন্ধ্যার প্রাণটি একমুহূর্তে টেনে আনলেন আমাদের দিকে—
“সাঁঝ পড়ে দিন বীতরে
চকরী দীন্হা রোয়।
চল চকরা বা দেশকো
জঁহা রৈন ন হোয়॥”
এ কোন্ অগম্য দেশের খবর এসে পৌঁছল! রাত্রির পরপারে যুগল তারার রাজত্বে যাবার সকরুণ ডাক, ভীরু-পাখীর গলার সুর ধরে’ এ কোন্ চির-মিলনের বাণী অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে এসে পৌঁছল যারা দেখেও দেখছে না, শুনেও শুনছে না, ধরেও ধরতে পারছে না তাদের কাছে!
যে চোখের দেখায় সন্ধ্যার অন্ধকার রাত্রির কালিমা শুধু আমাদের শঙ্কা আর সংশয়-বুদ্ধিই জাগিয়ে তোলে, ভাবুকের দেখা কি সেই চলতি চোখ দিয়ে দেখা, না তেমন শোনা দিয়ে, তেমন পরখ দিয়ে চেয়ে-দেখা, শুনে-দেখা, ছুঁয়ে-দেখা? এ সে ভাবুকের কবির শিল্পীর সেই দিব্য দৃষ্টি, যা অন্ধকারে আলো দেখলে, দুঃখের পরশেও আনন্দ পেল, অসীম স্তব্ধতার ভিতরে সন্ধান পেয়ে গেল সুরের—
“তিঁবির সাঁঝকা গহিরা আবৈ
ছাবৈ প্রেম মন অসেঁ
পশ্চিম দিগকী খিড়কী খোলো
ডুবহু প্রেম গগন মেঁ।
চেত-সংবল-দল রস পিয়োরে
লহর লেহ যা তনমেঁ॥
সংখ ঘণ্টা সহ নাই বাজে
শোভা-সিন্ধু মহল মেঁ॥”
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, আঁধারের প্রেম তনু মনকে আবৃত করলে, আলো যে দিকে অস্ত যাচ্ছে সেই দুয়ার খোলো, এই সন্ধ্যাকাশের মত বিস্তৃত অন্ধকারের প্রেমে নিমগ্ন হও, চিত্ত-শতদল পান করুক রাত্রির রস, মনে লাগুক, মনে ধরুক অতল কালোর প্রেম-লহরী, সীমাহীন গভীরে বাজ্তে থাকুক আরতির শঙ্খঘণ্টা, মিলনের বাঁশি,—আঁধার-সমুদ্রে ফুটে উঠুক অপরূপ রূপ।
এ যে হৃদয়ে এসে মিলতে চাইলো নূতনতরো দেখা শোনা ছোঁয়া দিয়ে বিশ্বচরাচরের সঙ্গে। আগে আসছিল মানুষের বাইরেটা তার বুদ্ধির গোচরে ইন্দ্রিয়ের সহায়তায় যন্ত্রে ধরা, এখন চল্লো মানুষের অন্তরটা বাইরের সঙ্গে মিলতে হাতে হাতে চোখে চোখে গলায় গলায়—বাইরের আসা এবং বেরিয়ে যাওয়া এরি ছন্দ আবিষ্কৃত হ’ল ভাবুক মানুষের জীবনে। অভিনিবেশ করে বস্তুতে ঘটনাতে নিবিষ্ট হবার শিক্ষা ও সাধনায় আপনার কার্যকরী ইন্দ্রিয়-শক্তি সকলকে নতুনতরো শক্তিমান করে তুল্লেন যে মুহূর্তে ভাবুক—সৌন্দর্যে অর্থে সম্পদে সৃষ্টির জিনিষ ভরে উঠলো, জগৎ এক অপরূপ বেশে সেজে দাঁড়ালো মানুষের মনের দুয়ারে; বারমহল ছেড়ে অভ্যাগত এল যেন অন্দরের ভিতর ভালবাসার রাজত্বে। রসের স্বাদ অনুভব করলে মানুষ, যেটা সে কিছুতে পেতে পারতো না যদি সে ইন্দ্রিয় সমস্তকে কেবলি প্রহরী ও মন্ত্রীর কায দিয়ে বসিয়ে রাখতো বুদ্ধির কোঠার দেউড়িতে। এই নতুন শিক্ষা, নতুন সাধনা যখন মানুষের ইন্দ্রিয়গুলো লাভ করলে, তখন মানুষের কণ্ঠ শুধু বলা-কওয়া হাঁক-ডাক করেই বসে রইলো না; সে গেয়ে উঠলো। হাতের আঙ্গুলগুলো নানা জিনিষ স্পর্শ করে নরম গরম কঠিন কি মৃদু ইত্যাদির পরখ করেই ক্ষান্ত হল না, তারা সংযত হয়ে তুলি বাটালি সূঁচ হাতুড়ি এমনি নানা জিনিষকে চালাতে শিখে নিলে, বীণা-যন্ত্রের উপরে সুর ধরতে লাগলো হাত আঙ্গুলের আগা, শুধু লোহার তারকে তার মাত্র জেনেই ক্ষান্ত হল না, সুরের তার পেয়ে যন্ত্রের পর্দায় পর্দায় বিচরণ করতে থাকলো আঙ্গুলের পরশ গুন্ গুন্ স্বরে ফুলের উপরে ভ্রমরের মতো, কোলের বীণার সঙ্গে যেন প্রেম করে চল্লো হাত, কাণ শুনতে লাগলো প্রেমিকের মতো কোলের বীণার প্রেমালাপ। সরু সূঁচের, সোনার সূতোর, রংএ ভরা তুলির সজীব ছন্দ ধরে তালে তালে চল্লো আঙ্গুল, হাতুড়ি বাটালির ওঠা-পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাণ্ডব নৃত্য করতে শিক্ষা নিলে শিল্পীর হাত—কাযের ভিড় থেকে মানুষের চোখ ও হাত, সেই সঙ্গে মনও ছুটি পেয়ে খেলাবার ও ডানা মেলবার অবসর পেয়ে গেল।
সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে সৃষ্টির দিকে এই অভিনিবিষ্ট দৃষ্টি—এইটুকুই ভাবুকের সাধনার চরম হল তা তো নয়, সৃষ্টির বাইরে যা তাকেও ধরবার জন্যে ভাবুক আরো এক নতুন নেত্র খুল্লেন—খুবই প্রখর দৃষ্টি যার এমন যে দূরবীক্ষণ-যন্ত্র তাকেও হার মানালে মানুষের এই মানস-নেত্র, চোখের দৃষ্টি যেখানে চলে না,—দূরবীক্ষণের দূরদৃষ্টিরও অগম্য যে স্থান। মানুষ এই আর এক নতুন দৃষ্টির সাধনায় বলীয়ান্ হয়ে নিজের মনের দেখা নিয়ে বিশ্বরাজ্যের পরপারেও সন্ধানে বেরিয়ে গেল—সেই রাজত্বে যেখানে সৃষ্টির অবগুণ্ঠনে নিজকে আবৃত করে স্রষ্টা রয়েছেন গোপনে—
“যথাদর্শে তথাত্মনি যথাপ্স্যুৎপরিব তথা গন্ধর্ব্বলোকে
ছায়াতপয়োরিব ব্রহ্মলোকে৷”
এই ব্ৰহ্মলোক যেখানে ছায়া-তপে সমস্ত প্রকাশ পাচ্ছে, গন্ধৰ্বলোক যেখানে রূপ ও সুর উভয়ে জলের উপরে যেন তরঙ্গিত হচ্ছে, এবং আত্মার মধ্যে যেখানে নিখিলের সমস্তই দর্পণের মতো প্রতিবিম্বিত দেখা যাচ্ছে, সমস্তই দিব্য দৃষ্টিতে পরশ ও পরখ করে নিলে মানুষ। দর্শকের ও শ্রোতার জায়গায় বসে মানুষ দেখবার মতো করে দেখলে, শোনবার মত করে শুনে নিলে নিখিলের এই রূপের লীলা সুরের খেলা, এবং এরও ওপরে যে লীলাময় মানুষকে সমস্ত পদার্থ সমস্ত বস্তুর সঙ্গে একসূত্রে বেঁধে একই নাট্যশালায় নাচিয়ে গাইয়ে চলেছেন তাঁকে পর্যন্ত ছুঁয়ে এল মানুষ নেপথ্য সরিয়ে। দেখা শোনা পরশ করার চরম হয়ে গেল, তারপর এল দেখানোর পালা। মানুষ এবারে আর এক নতুন অদ্ভুত অনিয়ন্ত্রিত অভূতপূর্ব সৃষ্টি সাধন করে গুণী শিল্পী হয়ে বসলো। এই দৃষ্টিবলে আপনার কল্পনালোকের মনোরাজ্যের গোপনতা থেকে মানুষ নতুন নতুন সৃষ্টি বার করে আনতে লাগলো। যে এতদিন দর্শক ছিল সে হল প্রদর্শক, দ্রষ্টা হয়ে বসলো দ্বিতীয় স্রষ্টা। অরূপকে রূপ দিয়ে, অসুন্দরকে সুন্দর করে, অবোলাকে সুর দিয়ে, ছবিকে প্রাণ, রঙ্গহীনকে রং দিয়ে চল্লো মানুষ—
“প্রেমের করুণ কোমলতা
ফুটিল তা’
সৌন্দর্যের পুষ্পপুঞ্জে প্রশান্ত পাষাণে॥”
দ্মের মৃণাল
পদ্মের মৃণাল এক, সুনীল হিল্লোলে,
দেখিলাম সরোবরে ঘন ঘন দোলে—
কখন ডুবায় কায়, কভু ভাসে পুনরায়,
হেলেদুলে আশে পাশে তরঙ্গের কোলে—
পদ্মের মৃণাল এক সুনীল হিল্লোলে।
শ্বেত আভা স্বচ্ছ পাতা, পদ্ম শতদলে গাঁথা,
উলটিপালটি বেগে স্রোতে ফেলে তোলে—
পদ্মের মৃণাল এক সুনীল হিল্লোলে।
একদৃষ্টে কতক্ষণ, কৌতুকে অবশ মন,
দেখিতে শোকের বেগ ছুটিল কল্পোলে—
পদ্মের মৃণাল এক তরঙ্গের কোলে।
২
সহসা চিন্তার বেগ উঠিল উথলি;
পদ্ম, জল, জলাশয় ভুলিয়া সকলি,
অদৃষ্টের নিবন্ধন ভাবিয়া ব্যাকুল মন—
অই মৃণালের মত হায় কি সকলি!
রাজ রাজমন্ত্রীলীলা, বলবীর্য্য স্রোতশীলা,
সকলি কি ক্ষণস্থায়ী দেখিতে কেবলি?—
অই মৃণালের মত নিস্তেজ সকলি!
অদৃষ্ট বিরোধী যার, নাহি কি নিস্তার তার,
কিবা পশুপক্ষী আর মানব মণ্ডলী?—
লতা, পশু, পক্ষী সম মানবেরো পরাক্রম,
জ্ঞান, বুদ্ধি, যত্ন, বলে বাঁধা কি শিকলি?—
অই মৃণালের মত হায় কি সকলি!
৩
কোথা সে প্রাচীনজাতি মানবের দল
শাসন করিত যারা অবনীমণ্ডল?
বলবীর্য্য পরাক্রমে ভবে অবলীলা ক্রমে,
ছড়াইত মহিমার কিরণ উজ্জ্বল—
কোথা সে প্রাচীনজাতি মানবের দল?
বঁধিয়ে পাষাণস্তুপ, অবনীতে অপরূপ,
দেখাইলা মানবের কি কৌশল বল—
প্রাচীন মিসরবাসী কোথা সে সকল?
পড়িয়া রয়েছে কূপ অবনীতে অপরূপ,
কোথা তারা, এবে কারা হয়েছে প্রবল
শাসন করিতে এই অবনীমণ্ডল।
৪
জগতের অলঙ্কার আছিল যে জাতি;
জ্বালিল উন্নতিদীপ অরুণের ভাতি;
অতুল্য অবনীতলে এখনো মহিমা জ্বলে,
কে আছে সে নরধন্য কুলে দিতে বাতি?—
এই কি কালের গতি, এই কি নিয়তি।
ম্যারাথন্, থার্মপলি, হয়েছে শ্মশানস্থলী
গিরীস আঁধারে আজ পোহাইছে রাতি;—
এই কি কালের গতি এই কি নিয়তি!
যার পদচিহ্ন ধরে, অন্য জাতি দম্ভ করে,
আকাশ পয়োধিনীরে ছড়াইছে ভাতি—
জগতের অলঙ্কার কোথায় সে জাতি।
৫
দোর্দ্দন্ত প্রতাপ যার কোথায় সে রোম?
কাঁপিত যাহার তেজে মহী, সিন্ধু, ব্যোম।
ধরণীর সীমা যার, ছিল রাজ্য অধিকার,
সহস্র বৎসরাবধি একাদি নিয়ম—
দোর্দ্দন্ত প্রতাপ আজি কোথায় সে রোম!
সাহস ঐশ্বর্য্যে যার, ত্রিভুবন চমৎকার—
সে জাতি কোথায় আজি, কোথা সে বিক্রম?
এমনি অব্যর্থ কি রে কালের নিয়ম!
কি চিহ্ন আছে রে তার, রাজপথ দুর্গে যার,
পৃথিবী বন্ধন ছিল কোথায় সে রোম?—
নিয়তির কাছে নর এত কি অক্ষম!
৬
আরবের পারস্যের কি দশা এখন;
সে তেজ নাহিক আর, নাহি সে তর্জ্জন।
সৌভাগ্য কিরণজালে, উহারাই কোন কালে
করেছিল মহাতেজে পৃথিবী শাসন।—
আরবের পারস্যের কি দশা এখন!
পশ্চিমে হিস্পানীশেষ, পূবে সিন্ধু হিন্দুদেশ,
কাফর যবনবৃন্দে করিয়া দমন—
উল্কা সম অকস্মাৎ হইল পতন!
“দীন” ব’ল্যে মহীতলে, যে কাণ্ড করিলা বলে,
সে দিনের কথা এবে হয়েছে স্বপন—
আরবের উপন্যাস অদ্ভুত যেমন!
৭
আজি এ ভারতে, হায়, কেন হাহাধ্বনি।
কলঙ্ক লিখিতে যার কাঁদিছে লেখনী।
তরঙ্গে তরঙ্গে নত পদ্মমৃণালের মত,
পড়িয়া পরের পায় লুটায় ধরণী।
আজি এ ভারতে কেন হাহাকার-ধ্বনি।
জগতের চক্ষু ছিল, কত রশ্মি ছড়াইল,
সে দেশে নিবিড় আজ আঁধার রজনী—
পূর্ণগ্রাসে প্রভাকর নিস্তেজ যেমনি!
বুদ্ধিবীর্য্য বাহুবলে, সুধন্য জগতী-তলে,
ছিল যারা আজি তারা অসার তেমনি।
আজি এ ভারতে কেন হাহাকার-ধ্বনি?
৮
কোথা বা সে ইন্দ্রালয়, কোথা সে কৈলাস!
কোথা সে উন্নতি আশা, কোথা সে উল্লাস।
দম্ভে বসুধার পরে, বেড়াইত তেজোভরে,
আজি তারা ভয়ে ভীত হয়েছে হতাশ—
কোথা বা সে ইন্দ্রালয়, কোথা সে কৈলাস!
কত যত্নে কত যুগে, বনবাসে কষ্ট ভুগে,
কালজয়ী হলো বল্যে করিত বিশ্বাস—
হায় রে সে ঋষিদের কোথা অভিলাষ!
সে শাস্ত্র, সে দরশন, সে দেব কোথা এখন?
পড়ে অাছে হিমালয় ভাবিয়া হতাশ—
কোথা বা সে ইন্দ্রালয়, কোথা সে কৈলাস!
৯
নিয়তির গতিরোধ হবে না কি আর?
উঠিবে না কেহ কি রে উজলি আবার?
মিসর পারস্য ভাতি, গিরীক রোমীয় জাতি,
ভারত থাকিবে কি রে চির অন্ধকার?
জাপান জিলণ্ডে নিশি পোহাবে এবার!
যত্ন, আশা, পরিশ্রমে খণ্ডিয়া নিয়তি-ক্রমে,
উঠিয়া প্রবল হতে পাবে না কি আর;—
অই মৃণালের মত সহিবে প্রহার?
না জানি কি আছে ভালে, তাই গো মা এ কাঙ্গালে
মিশাইছে অশ্রুধারা ভস্মেতে তোমার:—
ভারত কিরণময় হবে কি আবার?
১০
তোরো তরে কাঁদি আয় ফরাসী জননী,
কোমলকুসুম আভা প্রফুল্লবদনী।
এত দিনে বুঝি সতি, ফিরিল কালের গতি,
হল্যে বুঝি দশাহীন ভারত যেমনি!
সভ্যজাতি মাঝে তুমি সভ্যতার খনি।
হলো যবে মহীতলে রোম দগ্ধ কালানলে,
তুমিই উজ্জ্বল করে আছিলে ধরণী,
বীরমাতা প্রভাময়ী সুচিরযৌবনী।
ঐশ্বর্য্যভাণ্ডার ছিলে, কতই যে প্রসবিলে
শিল্প নীতি নৃত্যগীত চকিত অবনী—
তোরো তরে কাঁদি আয় ফরাসী জননী।
বুঝি বা পড়িলে এবে কালের হিল্লোলে,
পদ্মের মৃণাল যথা তরঙ্গের কোলে।
প্রভাত কাল
যামিনী পোহায়ে যায়,
ভূষা পরি ঊষা ধায়,
আগেভাগে ছুটে গিয়া পথ সজ্জা করিছে।
অরুণে করিয়া সঙ্গে,
অলক্ত লেপিয়া রঙ্গে
দুই ধারে রাঙা রাঙা ঘন গুলি রাখিছে॥
সুধাকরে কোলে করি,
শ্বেত সাটী দিয়া ধিরি
মধুমাখা মুখ তার স্নেহ ভরে ঢাকিছে।
চন্দ্রের খেলনা গুনি—
তারাপুঞ্জ গুণি গুণি,
অঞ্চলের শেষভাগে একে একে বাঁধিছে॥
তুষিতে দিবার রাজা,
ভাল ভাল মুক্ত মাজা
শ্যাম ধরাতল বুকে সারি সারি গাঁথিছে।
রঞ্জিতে তাঁহারি মন,
প্রমুদিত পুষ্পবন,
তরু পরে থরে থরে ফুলমাল বাঁধিছে॥
বিহগ গাহক তায়,
দিবাকর গুণ গায়,
তার সনে তালে তালে সমীরণ নাচিছে।
জয় দিবাকর বলি,
ঊর্দ্ধমুখে পুটাঞ্জলি,
পূর্ব্বাননে দ্বিজগণ স্তবধ্বনি করিছে॥
————–
বীরবাহু কাব্য হইতে উদ্ধৃত।
প্রলয়
প্রলয়(১)
১
ফিরে কি আসিছে প্রলয়ের কাল
নাশিতে পৃথিবী?—ফিরে কি করাল
বাজিবে বিষাণ ভীষণ নিনাদে?
জ্বলন্ত আকাশে বিপুল প্রমাদে
ফিরে কি উঠিবে দ্বাদশ রবি?
২
ভয়ঙ্কর কথা—ব্রহ্মাণ্ড বিনাশ
করিতে আসিছে প্রচণ্ড হুতাশ—
ভানুর মণ্ডলে তড়িতের শিখা
গিরি চুড়াকৃতি, বায়ু পথে দেখা
দিয়াছে অদ্ভুত অনল ছবি।
স্থিরবায়ু ভেদি তড়িত কিরণ
রাশি স্তূপাকার করিছে গমন
পৃথিবীর দিকে—আকৃতি ভীষণ
দেখিতে অদ্ভুত অনল ছবি।
জ্বলন্ত আকাশে বিপুল প্রমাদে
ফিরে কি উঠিবে দ্বাদশ রবি?
৩
আসিছে অনল ব্রহ্মাণ্ড উজলি,
(দেখেছে শূন্যেতে পণ্ডিতমণ্ডলী)
জগত ব্রহ্মাণ্ড করিবে গ্রাস।
একি ভয়ঙ্কর—বিশ্ব চরাচর,
সোম, শুক্র, বুধ, মহী, শনৈশ্চর,—
বিদ্যুৎ অনলে হবে বিনাশ!
আকাশের গ্রহ, নক্ষত্র মণ্ডলী,
অনলে পুড়িয়া পড়িবে সকলি;
অখিল ব্রহ্মাণ্ড হবে শূন্যময়,
সমুদ্র, পবন, প্রাণী সমুচয়,—
এমন পৃথিবী হবে বিনাশ!
৪
হবে কি বিনাশ এমন পৃথিবী?
অথবা যেমন চন্দ্রমার ছবি,
প্রাণীশূন্য মরু হয়ে চিরকাল,
ভ্রমিবে শূন্যেতে হিমানীর তাল—
মানব বিহঙ্গ কিছু না রবে?
না রবে জলধি, নদনদীজল,
অগাধ সাগর হবে মরুতল,
শীত গ্রীষ্ম ঋতু ফুরাবে সকল,
মানব পতঙ্গ কিছু না রবে?
না রবে মানব—বিপুল মহীতে
মানবের মুখ পাব না দেখিতে,
পাব না দেখিতে জগতের সার
রূপের প্রতিমা, সুখের আধার
রমণীর মুখ—ভবের ভূষণ
বিধাতার চারু মানস সৃজন—
চিরদিন তরে বিলীন হবে।
৫
বিহঙ্গের স্বর, তরঙ্গ নির্ঝর,
কুসুমের আভা, ঘ্রাণ মনোহর,
বালকের হাসি, আধ আধ বোল,
ঘন ঘটাছটা, জলের কল্লোল,
চাঁদের কিরণ, তড়িতের খেলা,
ভানুর উদয়, ভূধরের মেলা,
দেখিতে শুনিতে পাব না আর।
এত যে সাধের এত যে বাসনা,
আশা, অভিলাষ, কিছুই রবে না,
আনন্দ, বিষাদ, ভাবনাকলাপ,
প্রণয়ের সুখ, প্রতাপের তাপ,
ধনের মর্য্যাদা, মানের গৌরব,
জ্ঞানের আস্বাদ, প্রেমের সৌরভ,
কিছু কি রবে না রবে না তার?
৬
বিরলে বসিয়া এ মহীমণ্ডলে,
উজানে ভাসিয়া কালের হিল্লোলে,
আর কি পাব না সে ভাবে ভাবিতে,
আর কি পাব না সে সবে দেখিতে,
নয়নে কাঁদিয়া, স্বপনে ডুবিয়া,
মানসে ভাবিয়া পুলকে পূরিয়া,
যে সবে দেখিতে বাসনা হয়!
শিশু বাল্যকাল যৌবন সরল,
(কখন অমৃত কখন গরল)
কুটিল প্রবীণ মানবজীবন,
লহরী লুকায়ে হবে অদশন,
এ জীবপ্রবাহ—হবে প্রলয়!
৭
এত যে সহস্র জীবের রতন—
দেবের সদৃশ মহামতিগণ
যুগে যুগে যুগে পরাণ সঁপিয়া
আকাশ, জলধি, পৃথিবী খুঁজিয়া
জ্ঞান সঞ্চারিল, মানব জাতিতে
আনন্দ নির্ঝর অজস্র করিতে,—
সকলি কি হায় বৃথায় যাবে?
তবে কি কারণ, বৃথা এ সকল
এ মানব জাতি, এ মহীমণ্ডল,
এমন তপন, তারা, শশধর,
এত সুখ দুঃখ, রূপ মনোহর—
বিধির স্বজন কেন, কি ভাবে?
৮
নাহি কি কোনই অভিসন্ধি তার?—
জীবাত্মা, জীবন, সকলি অসার
এত যে যাতনা, যাতনাই সার—
সুধুই বিধির সাধের খেলা!
তবে ভস্মসাৎ হোক্ রে এখনি
দেহ, পরমায়ু, আকাশ, অবনী,
আঁধারে ডুবিয়া হোক্ ছার খার,
কিবা এ ব্রহ্মাণ্ড, জীব জন্তু আর—
চিরদিন তরে যাক্ এ বেলা!
এ মানব জাতি, এ মহীমণ্ডল
বৃথা এ সকল—সকলি নিস্ফল—
এই কি বিধির সাধের খেলা!
বিধাতা হে আর করো না সৃজন
এমন পৃথিবী, এমন জীবন;—
কর যদি প্রভূ ধরা পুনর্ব্বার,
মানব সৃজন করো না অার;
আর যেন, দেব, না হয় ভুগিতে
জীবাত্মার সুখ—না হয় আসিতে,
এ দেহ এ মন ধারণ করিতে,
এরূপ মহীতে কখন আর।
————-
১. গত বৎসর সম্পূর্ণ সূর্য্যগ্রহণকালে ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা দেখিয়ছিলেন যে সূর্য্যমণ্ডল হইতে এক অদ্ভুত বিদ্যুতাকৃতি জ্যোতিরেখা নিৰ্গত হইয়া পৃথিবীর দিকে আসিতেছে; প্রায় অৰ্দ্ধেক পথ অতিক্রম করিয়া আসিয়াছে, এবং যেরূপে বেগে আসিতেছে তাহাতে অনতিবিলম্বে পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করা সম্ভব। সেই উপলক্ষে ইহা বিরচিত হইয়াছিল।
প্রিয়তমার প্রতি
১
প্রেয়সি রে অধীনেরে জনমে কি ত্যজিলে!
এত আশা ভালবাসা সকলি কি ভুলিলে!
অই দেখ নব ঘন গগনে আসিয়ে পুনঃ,
মৃদু মৃদু গরজন গুরু গুরু ডাকিছে।
দেখ পুনঃ চাঁদ আঁকা, ময়ুর খুলিয়ে পাখা,
কদম্বের ডালে ডালে কুতূহলে নাচিছে।
পুনঃ সেই ধরাতল, পেয়ে জল সুশীতল,
স্নেহ করে তৃণদল বুকে করে রাখিছে।
হের প্রিয়ে পুনরায়, পেয়ে প্রিয় বরষায়,
যমুনা-জাহ্ণবী-কায়া উথলিয়া উঠিছে।
চাতক তাপিতপ্রাণ, পুলকে করিয়ে গান,
দেখ রে জলদ কাছে পুনরায় ছুটিছে।
প্রেয়সি রে সুখোদয় অখিল ব্রহ্মাণ্ডময়,
কেবলি মনের দুখে এ পরাণ কাঁদিছে।
২
অই পুনঃ জলধরে বারিধারা ঝরিল!
লতায় কুসুমদলে, পাতায় সরসীজলে,
নবীন তৃণের কোলে নেচে নেচে পড়িল।
শ্যামল সুন্দর ধরা শোভা দিল মনোহরা,
শীতল সৌরভ ভরা বাসে বায়ু ভরিল,
মরাল আনন্দ মনে ছুটিল কমলবনে,
চঞ্চল মৃণালদল ধীরে ধীরে দুলিল।
বক হংস জলচর ধৌত করি কলেবর,
কেলি হেতু কলরবে জলাশয়ে নামিল।
দামিনী মেঘের কোলে, বিলাসে বসন খোলে,
ঝলকে ঝলকে রূপ আলো করে উঠিল।
এ শোভা দেখাব করে, দেখায়ে সন্তোষ যারে,
হায় সেই প্রিয়তমা অভাগারে ত্যজিল।
৩
ত্যজিবে কি প্রাণসখি? ত্যজিতে কি পারিবে?
কেমনে সে স্নেহলতা এ জনমে ছিঁড়িবে।
সে যে স্নেহ সুধাময়, ঘেরিয়াছে সমুদয়,
প্রকৃতি পরাণ মন, কিসে তাহা ভুলিবে?
আবার শরত এলে, তেমনি কিরণ ঢেলে
হিমাংশু গগনে কিরে আর নাহি উঠিবে?
বসন্তের আগমনে, সেরূপে সন্ধ্যার সনে
আর কি দক্ষিণ হতে বায়ু নাহি বহিবে?
আর কি রজনীভাগে, সেইরূপ অনুরাগে,
কামিনী, রজনীগন্ধ, বেল নাহি ফুটিবে?
প্রাণেশ্বরি! পুনর্ব্বার, নিশীথে নিস্তব্ধ আর
ধরাতল সেইরূপে নাহি কি রে থাকিবে?
জীবজন্তু কেহ কবে, কখন কি কোন রবে,
ভুলে অভাগার নাম কণ্ঠেতে না আনিবে?
প্রেয়সি রে সুধাময়, স্নেহ ভুলিবার নয়,
কাঁদালি কাঁদিলি সুধু পরিণামে জানিবে!
* * * * *
৪
অই দেখ প্রিয়তমে বারিধারা ধরিল।
শরতে সুন্দর মহী সুধা মাখি বসিল।
হরিত শস্যের কোলে, দেখ রে মঞ্জরী দোলে,
ভানুছটা তাহে কিবা শোভ দিয়া পড়েছে!
বহিলে মৃদুল বায়, ঢলিয়ে পড়িছে তায়,
তটিনীতরঙ্গলীলা অবনীতে ছুটেছে।
গোঠে গাভী বৃষ সনে, চরিছে আনন্দ মনে,
হরষিত তরুলতা ফলেফুলে সেজেছে।
সরোবরে সরোরুহ, কুমুদ কহ্লার সহ,
শরতে সুন্দর হয়ে শোভা দিয়ে ফুটেছে।
আচম্বিতে দরশন, ঘনঘন গরজন,
উড়িয়ে অম্বরে মেঘ ডেকে ডেকে চলেছে।
প্রেয়সি রে মনোহরা, এমন সুখের ধরা,
বিহনে তোমার আজি অন্ধকার হয়েছে!
৫
আহা কি সুন্দর বেশ সন্ধ্যা অই আইল!
ভাঙা ভাঙা ঘনগুলি, ভানুর কিরণ তুলি
পশ্চিম গগনে আসি ধীরে ধীরে বসিল।
অস্তগিরি আলো করি, বিচিত্র বরণ ধরি,
বিমল আকাশে ছটা উথলিয়া পড়িল।
গোধূলিকিরণমাখা, গৃহচূড়া তরুশাখা,
প্রেয়সি রে মনোহর মাধুরীতে পূরিল।
কাদম্বিনী ধীরে ধীরি, হয়, তরু, গজ, গিরি,
আঁকিয়ে সুন্দর করি ছড়াইতে লাগিল!
দেখ প্রিয়ে শ্বেত আভা গঙ্গাজলে কিবা শোভা,
সুবর্ণের পাতা যেন ছড়াইয়া পড়িল।
কৃষক মঞ্চের পরে উঠিল আনন্দ ভরে,
চঞ্চুপুটে শস্য ধরে নভশ্চর ফিরিল।
এ সুখ সন্ধ্যায় প্রিয়ে, সাধে জলাঞ্জলি দিয়ে,
শূন্য দেহে নিরাসনে এ অভাগা রহিল।
৬
আজি এ পূর্ণিমা নিশি প্রিয়ে কারে দেখাবে।
কার সনে প্রিয়ভাষে দেহ মন জুড়াবে!
এখনি যে সুধাকর, পূর্ণবিম্ব মনোহর,
পূর্ব্বদিকে পরকাশি সুধারাশি ছড়াবে।
এখনি যে নীলাম্বরে, শ্বেতবর্ণ থরে থরে,
আসিয়ে মেঘের মালা সুধাকরে সাজাবে।
তরুগিরি মহীতল শিশির আকাশ জল,
চাঁদের কৌমুদী মাখা কারে আজি দেখাবে!
প্রেয়সি অঙ্গুলি তুলি কুসুম কলিকাগুলি,
শিশিরে ফুটিছে দেখি কারে আজি সুধাবে—
“অই দেখ চক্রবাক, ডাকে অমঙ্গল ডাক’’
বলে সুধাইবে কারে, কে বাসনা পূরাবে!
তনু মন সমর্পণ, করেছিল সেই জন,
তারে কাঁদাইলে, হায়, প্রণয় কি জুড়াবে!
বিধবা রমণী
১
ভারতের পতিহীনা নারী বুঝি অই রে!
না হলে এমন দশা নারী আর কই রে?
মলিন বসন-খানি অঙ্গে আচ্ছাদন,
আহা দেখ অঙ্গে নাই অঙ্গের ভূষণ!
রমণীর চির-সাধ চিকুর বন্ধন,
হ্যাদে দেখ সে সাধেও বিধি-বিড়ম্বন!
আহাঁ, কি চাঁচরকেশ পড়েছে এলায়ে!
আহা, কি রূপের ছটা গিয়েছে মিলায়ে!
কি নিতম্ব কিবা ঊরু, কিবা চক্ষু কিবা ভুরু,
কি যৌবন মরি মরি শোকে দগ্ধ হয় রে!
২
কুসুম চন্দনে আর নাহি অভিলাষ;
তাম্বুল কর্পূরে আর নাহি সে বিলাস;
বদনে সে হাসি নাই, নয়নে সে জ্যোতিঃ;
সে আনন্দ নাই আর মরি কি দুর্গতি!
হরিষ বিষাদ এবে তুল্য চিরদিন;
বসন্ত শরত ঋতু সকলি মলিন!
দিবানিশি একি বেশ, বারমাস সেই ক্লেশ;
বিধবার প্রাণে হায় এতই কি সয় রে!
৩
হায় রে নিষ্ঠুর জাতি পাষাণ-হৃদয়,
দেখে শুনে এ যন্ত্রণা তবু অন্ধ হয়;
বালিকা যুবতী ভেদ করে না বিচার,
নারী বধ করে তুষ্ট করে দেশাচার।
এই যদি এ দেশের শাস্ত্রের লিখন,
এ দেশে রমণী তবে জন্মে কি কারণ?
পুরুষ দুদিন পরে, আবার বিবাহ করে,
অবল রমণী বলে এতই কি সয় রে?
৪
কেঁদেছি অনেক দিন কাঁদিব না অার;
পূরাইব হৃদয়ের কামনা এবার।—
ঈশ্বর থাকেন যদি করেন বিচার
করিবেন এ দৌরাত্ম্য সমুলে সংহার;
অবিলম্বে হিন্দুধর্ম্ম ছারখার হবে
হিন্দুকুলে বাতি দিতে কেহ নাহি রবে!
দেখ্ রে দুর্ম্মতি যত চিরম্লেচ্ছপদানত—
বিধবার শাপে হায় এ দুর্গতি হয় রে।
৫
হায় রে আমার যদি থাকিত সম্পদ,
মিটাতাম চিরদিন মনের যে সাধ;
সোণার প্রতিমা গড়ে বিধবা নারীর
রাখিতাম স্থানে স্থানে ভারতভূমির;
বিদেশের স্ত্রী পুরুষ এদেশে আসিত,
পতিব্রতা বলে কারে নয়নে হেরিত।
লিখিতাম নিম্নদেশে, “কি স্বদেশে কি বিদেশে,
রমণী এমন আর ধরাতলে নাই রে”
৬
সে ধন সম্পদ নাই দরিদ্র কাঙ্গাল,
অনাথ-বিধবা-দুঃখ রবে চিরকাল
আমার অন্তরে গাঁথা; যখনি দেখিব
সুগন্ধ কুসুমে কীট তখনি কাঁদিব;
রাহুগ্রাসে শশধর, নক্ষত্র পতন
যখনি দেখিব, হায়, করিব স্মরণ
বিধবা নারীর মুখ! হায় রে বিদরে বুক,
ইচ্ছা করে জন্মশোধ দেশত্যাগী হই রে।
ভারতের পতিহীনা নারী বুঝি আই রে॥
ভারত কামিনী
আরে কুলাঙ্গার হিন্দু দুরাচার—
এই কি তোদের দয়া, সদাচার?
হয়ে আর্য্যবংশ—অবনীর সার
রমণী বধিছ পিশাচ হয়ে!
এখনও ফিরিয়া দেখনা চাহিয়া
জগতের গতি ভ্রমেতে ডুবিয়া—
চরণে দলিয়া মাতা, সুতা, জায়া,
এখনো রয়েছ উন্মত্ত হয়ে?
বাঁধিয়া রেখেছ বামা রাশি রাশি
অনাথ করিয়া—গলে দিয়া ফাঁসি,
কাড়িয়া লয়েছ কবরী, কঙ্কণ,
হার, বাজু, বালা, দেহের ভূষণ—
অনন্ত দুখিনী বিধবা নারী।
দেখ রে নিষ্ঠুর, হাতে লয়ে মালা
কুলীন সধবা অনূঢ়া অবলা
অাছে পথ চেয়ে পতির উদ্দেশে,
অসংখ্য রমণী পাগলিনী বেশে—
কেহ বা করিছে বরমাল্য দান
মুমূর্ষুর গলে হয়ে ম্রিয়মাণ
নয়নে মুছিয়া গলিত বারি!
চারিদিকে হেথা ভারত যুড়িয়া,
সরলীকমল যেন রে ছিঁড়িয়া—
কামিনীমণ্ডলী রেখেছ তুলিয়া—
কোমল হৃদয় করেছ হতাশ,
না দেখিতে দেও অবনী আকাশ—
করে কারাবাস জগতে রয়ে।
আরে কুলাঙ্গার, হিন্দু দুরাচার—
এই কি তোদের দয়া, সদাচার?
হয়ে আর্য্যবংশ, অবনীর সার
রমণী বধিছ পিশাচ হয়ে?
এখনও ফিরিয়া দেখনা চাহিয়া
জগতের গতি ভ্রমেতে ডুবিয়া—
চরণে দলিছ মাতা, সুতা, জায়া,
ছড়ায়ে কলঙ্ক পৃথিবী মাঝে।—
দেখ না কি চেয়ে জগত উজ্জ্বল
এই সে ভারত, হিমানী অচল,
এই সে গোমুখী, যমুনার জল,
সিন্ধু, গোদাবরী সরযূ সাজে?
জান না কি সেই অযোধ্যা, কোশল,
এই খানে ছিল, কলিঙ্গ পঞ্চাল,
মগধ, কনৌজ,—সুপবিত্র ধাম
সেই উজ্জয়িনী, নিলে যার নাম
ঘুচে মনস্তাপ কলুষ হরে?
এই রঙ্গভূমে করেছিল লীলা
আত্রেয়ী, জানকী, দ্রৌপদী সুশীলা,
খনা, লীলাবতী প্রাচীন মহিলা—
সাবিত্রী ভারত পবিত্র করে।
এই আর্য্যভূমে বাঁধিয়া কুন্তল
ধরিয়া কৃপাণ কামিনী সকল,
প্রফুল্ল স্বাধীন পবিত্র অন্তরে
নিঃশঙ্ক হৃদয়ে ছুটিত সমরে—
খুলে কেশপাশ দিত পরাইয়া
ধনুদণ্ডে ছিলা আনন্দে ভাসিয়া—
সমর-উল্লাসে অধৈর্য্য হয়ে—
কোথা সে এখন অসিভল্লধার
মহারাষ্ট্র বামা, রাজোয়ার নারী?
অরাতি বিক্রমে পরাজিত হলে
চিতানলে যারা তনু দিত ঢেলে
পতি, পিতা, সুত, সংহতি লয়ে।
বীরমাতা যার বীরাঙ্গনা ছিল,
মহিমা কিরণে জগত ভাতিল—
কোথা এবে তারা—কোথা সে কিরণ?
আনন্দ কানন ছিল যে ভুবন
নিবিড় অটবী হয়েছে এবে!
আর কি বাজে সে বীণা সপ্তস্বরা
বিজয় নিনাদে বসুন্ধরা ভরা?
আর কি আছে সে মনের উল্লাস,
জ্ঞানের মর্য্যাদা, সাহসবিভাস
সে সব রমণী কোথা রে এবে?
সে দিন গিয়াছে—পশুর অধম
হয়েছে ভারতে নারীর জনম;
নৃশংস আচার, নীচ দুরাচার
ভারত ভিতরে যত কুলাঙ্গার
পিশাচের হেয় হয়েছে সবে।
তবে কেন আজও আছে ঐ গিরি
নাম হিমালয়, শৃঙ্গ উচ্চে ধরি?
তবে কেন আজও করিছে হুঙ্কার
ভারত বেষ্টিয়া জলধি দুর্ব্বার?
কেন তবে আজও ভারত ভিতরে
হিন্দুবংশাবলী শুনে সমাদরে
ব্যাস বালমীকি, বারিধারা ঝরে
সীতা, দময়ন্তী, সাবিত্রী রবে?—
গভীর নিনাদে করিয়ে ঝঙ্কার,
বাজ্ রে বীণা বাজ্ একবার,
ভারতবাসীরে শুনায়ে সবে।
দেখ্ চেয়ে দেখ্ হোথা একবার—
প্রফুল্ল কোমল কুসুম আকার
য়ুনানী[১] মহিলা হয় পারাপার
অকূল জলধি অকুতোভয়ে।
ধায় অশ্বপৃষ্ঠে অশঙ্কিত চিতে
কানন, কন্দর, উন্নত গিরিতে—
অপ্সরা আকৃতি পুরুষ সেবিতা
সাহিত্য, বিজ্ঞান, সঙ্গীতে ভূষিতা—
স্বাধীন প্রভাতে পবিত্র হয়ে।
আর কি ভারতে ওরূপে আবার
হবে রে অঙ্গনা-মহিমা প্রচার?—
পেয়ে নিজ মান, পরে নিজ বেশ
জ্ঞান, দত্ত তেজে পূরে নিজ দেশ,—
বীর বংশাবলী প্রসূতি হবে?
এহেন প্রকাণ্ড মহীখণ্ড মাঝে
নাহি কিরে কোন বীরাত্মা বিরাজে—
এখনি উঠিয়া করে খণ্ড খণ্ড
সমাজের জাল করাল প্রচণ্ড—
স্বজাতি উজ্জ্বল করিয়া ভবে?
চৈতন্য গৌতম নাহি কিরে আর,
ভারত সৌভাগ্য করিতে উদ্ধার?—
ঋষি বিশ্বামিত্র, রাঘব, পাণ্ডব,
কেন জন্মেছিলা মহাত্মা সে সব—
ভারত যদি না উন্নত হবে?
ধিক্ হিন্দুজাতি হয়ে আর্য্যবংশ,
নরকণ্ঠহার নারী কর ধংস!
ভুলে সদাচার, দয়া, সদাশয়,
কর আর্যভূমি পূতিগন্ধময়,
ছড়ায়ে কলঙ্ক পৃথিবী মাঝে!—
দেখ না কি চেয়ে জগত উজ্জ্বল
এই সে ভারত, হিমানী অচল,
এই সে গোমুখী, যমুনার জল,
সিন্ধু, গোদাবরী, সরযূ সাজে?
জান না কি সেই অযোধ্যা, কোশল
এই খানে ছিল কলিঙ্গ পঞ্চাল?
মগধ, কনৌজ,—সুপবিত্র ধাম
সেই উজ্জয়িনী—নিলে যার নাম
ঘুচে মনস্তাপ, কলুষ হরে?
এই রঙ্গভূমে করেছিল লীলা
আত্রেয়ী, জানকী, দ্রৌপদী সুশীলা,
খনা, লীলাবতী প্রাচীন মহিলা—
সাবিত্রী, ভারত পবিত্র করে?—
অরে কুলাঙ্গার হিন্দু দুরাচার—
এই কি তোদের দয়া, সদাচার?
হয়ে আর্য্যবংশ, অবনীর সার
রমণী বধিছ পিশাচ হয়ে?
এখনও ফিরিয়া দেখ না চাহিয়া
জগতের গতি ভ্রমেতে ডুবিয়া—
চরণে দলিয়া মাতা, সুতা, জায়া
এখনও রয়েছ উন্মত্ত হয়ে?
————–
১. অর্থাৎ ইউরোপীয়
ভারত বিলাপ
ভানু অস্ত গেল, গোধুলি আইল;—
রবি-কর-জাল আকাশে উঠিল,
মেঘ হ’তে মেঘে খেলিতে লাগিল,
গগন শোভিল কিরণজালে;—
কোথা বা সুন্দর ঘন কলেবর
সিন্দূরে লেপিয়া রাখে থরেথর,
কোথা ঝিকি ঝিকি হীরার ঝালর
যেন বা ঝুলায় গগন ভালে।
সোণার বরণ মাখিয়া কোথায়
জলধর জ্বলে—নয়ন জুড়ায়,
আবার কোথায় তুলারাশি প্রায়
শোভে রাশি রাশি মেঘের মালা।
হেনকালে একা গিয়া গঙ্গাতীরে
হেরি মোনহর সে তট উপরে
রাজধানী এক, নব শোভা ধরে,
রয়েছে কিরণে হয়ে উজলা।
দ্বিতালা ত্রিতালা চৌতালা ভবন,
সুন্দর সুন্দর বিচিত্র গঠন,
রাজবর্ত্ম পাশে আছে সুশোভন—
গোধূলি রাগেতে রঞ্জিত কায়।
অদূরে দুর্জ্জয় দুর্গ গড়খাই,
প্রকাণ্ড মুরতি, জাগিছে সদাই,
বিপক্ষ পশিবে হেন স্থান নাই—
চরণ প্রক্ষালি জাহ্নবী ধায়।
গড়ের সমীপে আনন্দউদ্যান,
যতনে রক্ষিত অতি রম্যস্থান,
প্রদোষে প্রত্যহ হয় বাদ্যগান,
নয়ন, শ্রবণ, তনু জুড়ায়।
জাহ্ণবী সলিলে এদিকে আবার
দেখ জলযান কাতারে কাতার
ভাসে দিবানিশি—গুণবৃক্ষ যার
শালবৃক্ষ ছাপি ধ্বজা উড়ায়।
অহে বঙ্গবাসি জান কি তোমরা?
অলকা জিনিয়া হেন মনোহরা
কার রাজধানী? কি জাতি ইহারা?—
এ সুখ সৌভাগ্য ভোগে ধরায়।
নাহি যদি জান, এসো এই খানে,
চলেছে দেখিবে বিচিত্র বিমানে
রাজপুরুষের বিবিধ বিধানে—
গরবে মেদিনী ঠেকে না পায়।
অদূরে বাজিছে। “রুল বৃট্যানিয়া,”
শকটে শকটে মেদিনী ছাইয়া
চলেছে দাপটে বৃটনবাসীয়া—
ইন্দ্রের ইন্দ্রত্ব আছে কোথায়!
হায় রে কপাল, ওদেরি মতন
আমরাই কেন করিতে গমন
না পারি সতেজে—বলিতে আপন
যে দেশে জনম, যে দেশে বাস?
ভয়ে ভয়ে যাই, ভয়ে ভয়ে চাই,
গৌরাঙ্গ দেখিলে ভূতলে লুটাই,
ফুটিয়ে ফুকারি বলিতে না পাই—
এমনি সদাই হৃদয়ে ত্রাস।
কি হবে বিলাপ করিলে এখন,
ভারত ঐশ্বর্য্য গিয়াছে যখন,
মনের মাহাত্ম্য হয়েছে নিধন—
তখনি সে সাধ ঘুচে গিয়াছে।
সাজে না এখন অভিলাষ করা—
আমাদের কাজ সুধু পায়ে ধরা—
শিরেতে ধরিয়া কলঙ্কের ভরা
ছুটিতে হইবে ওদেরি পাছে!
হায় বসুন্ধরা তোমার কপালে
এই কি ছিল মা, উদয়ের কালে
জগত কাঁদায়ে কিরণ ডুবালে—
পূরাতে নারিলে মনের আশা।
রূপে অনুপম নিখিল ধরায়
করিয়া বিধাতা সৃজালা তোমায়—
দিলা সাজাইয়া অতুল ভূষায়—
তোর কি না আজি এ হেন দশা!
হায় রে বিধাতা, কেন দিয়াছিলি
হেন অলঙ্কার? কেন না গঠিলি
মরুভূমি করে—অরণ্যে রাখিলি,
এ হেন যাতনা হতো না তায়!
পারস্য পাঠান মোগল প্রভৃতি
হরিতে ভারত কিরীটের জ্যোতিঃ
আসিত না হেথা, করিয়া দুর্গতি—
অভাগা হিন্দুরে দলিতে পায়!
এই যে দেখিছ পুরী মনোহর
শতগুণ আরো শোভিত সুন্দর,
এই ভাগীরথী করে থরে থর
ধাইত তখন কতই সাধে!
গাইত তখন কতই সুস্বরে
এই সব পাখী তরু শোভা করে,
কতই কুসুম পরিমল ভরে
ফুটিয়া থাকিত কত আহ্লাদে।
আগেকার মত উঠিত তপন,—
আগেকার মত চাঁদের কিরণ
ভাসিত গগনে—গ্রহ তারাগণ
ঘুরিত আনন্দে ঘেরিয়া ধরা;—
যখন ভারতে অমৃতের কণা
হতো বরিষণ, বাজাইত বীণা
ব্যাস বাল্মীকি—বিপুল বাসনা
ভারত হৃদয়ে আছিল ভরা।
যখন ক্ষত্রিয় অতীব সাহসে
ধাইত সমরে মাতি বীর-রসে,
হিমালয়চুড়া গগন পরশে
গাইত যখন ভারত নাম।
ভারতবাসীরা প্রতি ঘরে ঘরে
গাইত যখন স্বাধীন অন্তরে
স্বদেশ মহিমা পুলকিত স্বরে,—
জগতে ভারত অতুল ধাম।
ধন্য বৃট্যানিয়া ধন্য তোর বল,
এ হেন ভূভাগ করে করতল,
রাজত্ব করিছ ইঙ্গিতে কেবল—
তোমার তেজের নাহি উপমা।
এখন কিঙ্কর হয়েছি তোমার
মনের বাসনা কি কহিব আর,
এই ভিক্ষা চাই করো গো বিচার—
অথর্ব্ব দাসীরে করে গো ক্ষমা।
দেখ্ চেয়ে দেখ্ প্রাচীন বয়েসে
তোর পদতলে পড়িয়ে কি বেশে
কঁদিছে সে ভূমি, পূজিত যে দেশে
কত জনপদ গাহি মহিমা।
আগে ছিল রাণী—ধরা রাজধানী,
স্মরণে যেন গো থাকে সে কাহিনী,
এবে সে কিঙ্করী হয়েছে দুখিনী
বলিয়ে দম্ভ করো না গরিমা।
তোমারো ত বুকে কত কত বার
রিপু পদাঘাত করেছে প্রহার
কালেতে না জানি কি হবে আবার
এই কথা সদা করো গো মনে।
পেয়েছ অমূল্য রতন ধরার
করো না ইহারে চরণে প্রহার—
দিও না যাতনা ভারত প্রাণে।
মদনপারিজাত
[একাদশ খৃষ্টাব্দে ফরাসীদেশে আবেলার্ড নামক একজন প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ছিলেন। তিনি তর্কশাস্ত্র অধ্যাপনা করাইয়া প্রভূত যশস্বী হন। অন্যান্য শিষ্যের ন্যায় ইলইজা নাম্নী এক সম্ভ্রান্ত কন্যা তাহার নিকট অধ্যয়ন করিতেন। এই কামিনী অত্যন্ত রূপবতী এবং বুদ্ধিমতী ছিলেন। ক্রমে গুরুশিষ্যের ভাবান্তর হইয়া উভয়ের প্রতি উভয়ের আসক্তি জন্মে, এবং সেই কলঙ্ক দেশমধ্যে প্রচারিত হয়। তাহাতে ইলইজার পিতৃব্য অসহ্য রোষপরতন্ত্র হইয়া ইলইজাকে একটী কনভেন্টে আবদ্ধ করিয়া রাখেন, এবং আবেলার্ডকে ক্ষতদেহ করিয়া অবমানিত করেন। রোমান কাথলিকদিগের মধ্যে সংসারবিরাগী-ধর্ম্মাকাঙ্ক্ষী স্ত্রীপুরুষগণ যে আশ্রমে বাস করে, তাহার নাম কনভেন্ট। ইলইজা সেই আশ্রমে অবরুদ্ধ হইয়া বহু কষ্টে দিনপাত করিত। এবং আবেলার্ডও প্রাগুক্ত রূপে অবমানিত হইবার পর সংসারে বিরাগী হইয়া অন্য এক আশ্রমে প্রস্থান করেন। ইহাদিগের পরস্পরের প্রণয়ঘটিত উপাখ্যান ইউরোপীয় নানা ভাষায় আছে। আলেকজন্দর পোপ নামক একজন ইংরাজী কবি এই উপাখ্যান অবলম্বনে একটী কবিতা লেখেন; তদ্দৃষ্টে “মদনপারিজাত” নাম দিয়া নিম্নোক্ত কবিতা লিখিত হইয়াছে।]
ত্যজিয়ে সংসারধর্ম্ম তপস্বিনী হয়েছি,
মায়ামোহ আশাতৃষ্ণা বিসর্জ্জন দিয়েছি!
পরিয়ে বল্কল সাজ কমণ্ডলু করে,
ধরেছি কঠোর ব্রত কানন ভিতরে।
দিবাসন্ধ্যা পূজা ধ্যান দেব-আরাধনা
করি, তবু মনে কেন হয় সে ভাবনা?
যার জন্যে দেশত্যাগী কেন পুনরায়
অশান্ত হৃদয় হেন তারি দিকে ধায়?
কেন রে উন্মাদমন কেন দিলি তুলে
যে বাসনা এত দিন আছিলাম ভুলে?
জ্বালাতে নির্ব্বাণ বহ্নি কেন দিলি দেখা
অরে সুধাময় লিপি দয়িতের লেখা?
আয় তোরে বুকে রাখি বহু দিন পরে
পেয়েছি নাথের লেখা অমৃত অক্ষরে!
এজগতে ভালবাসা ভুলিবার নয়,
মদনের পারিজাত ব্রহ্মাণ্ড ঘোষয়!
ক্ষমা কর যোগী ঋষি জিতেন্দ্রিয় জন,
ক্ষমা কর সতী সাধ্বী তপস্বিনীগণ!
অয়ি শান্ত সুপবিত্র আশ্রমমণ্ডল,
তরু, বারি, লতা, পত্র যথায় নির্ম্মল,
নিষ্পাপ নিষ্কাম চিন্তা যথায় নিয়ত
পরমার্থ ধ্যানে মুগ্ধ আনন্দে জাগ্রত,
ক্ষমা কর এ দাসীরে, কলুষচিন্তায়
কলুষিত করিলাম তোমা সবাকায়।
আসিলাম যবে হেথা করে মহাব্রত
ভাবিলাম হব শীঘ্র তোমাদেরি মত;
ধবল শিলার সম স্বেদক্লেদহীন,
ধবল শিলার সম মমতাবিহীন।
কই হলো? অসাধ্য সে পবিত্র কামনা;
জীবিত থাকিতে, নাথ, যাবে না বাসনা।
অর্দ্ধেক দিয়াছি প্রাণ ঈশ্বর সেবিতে,
অর্দ্ধেক রেখেছি, হায়, নাথেরে পূজিতে।
অনাহার জাগরণে হলো দেহ ক্ষয়,
তবু দেখ স্বভাবের গতিরোধ নয়।
কাটালাম এতকাল সন্তাপে সস্তাপে,
সে নাম দেখিবামাত্র তবু চিত্ত কাঁপে।
কাঁপিতে কাঁপিতে নাথ খুলি এ লিখন;
প্রতি ছত্রে করিতেছি অশ্রু বিসর্জ্জন।
যেখানে তোমার নাম দেখি, প্রাণেশ্বর,
সেইখানে কেঁদে উঠে আমার অন্তর!
কতই আনন্দ আর কতই বিষাদ
আছে ও মধুর নামে কে জানে আস্বাদ।
কত বার ধীরে ধীরে করি উচ্চারণ,
কত বার ফিরে ফিরে করি নিরীক্ষণ।
ফেলি কত দীর্ঘশ্বাস সে সব স্মরিয়ে
আছি হেথা একাকিনী সে সব ত্যজিয়ে।
যেখানে আমার নাম দেখিবারে পাই,
সেইখানে, প্রাণনাথ, আতঙ্কে ডরাই।
পাছে কোন অমঙ্গল সঙ্গে থাকে তার,
অমঙ্গল হেতু, নাথ, আমি হে তোমার।
না পারি পড়িতে আর, সহে না হৃদয়;
শোকের সমুদ্র হেরি চতুর্দ্দিকময়।
অদৃষ্টে কি এই ছিল সেই ভালবাসা
এইরূপে হলো শেষ, শেষে এই দশা!
সে যশ-পিপাসা আর সে হেন প্রণয়
পত্রের কুটীরে হলো এইরূপে লয়।
যত পার হেন লিপি লিখ তবু নাথ,
করিব তোমার সঙ্গে শোক-অশ্রুপাত,
মিশাইব দীর্ঘশ্বাস তোমার নিশ্বাসে,
কাঁদিব তোমার সঙ্গে চিত্তের উন্নাসে;
ঘুচাইতে এ যন্ত্রণা সাধ্য নাই কার,
তাই নিবেদন করি লিখ যত পার।
অনাথা দুঃখীর দুঃখ করিতে সাত্ত্বনা
হয়েছে লিপির সৃষ্টি বিধির বাসনা।
বুঝি কোন নির্ব্বাসিত পুরুষপ্রেমিক,
অথবা রমণী কোন প্রেমের পথিক,
ঘুচাতে বিচ্ছেদজ্বালা আরাধনা করে
শিখেছিল এ কৌশল বিধাতার বরে।
প্রাণভোরে অন্তরের কথা প্রকাশিতে
এমন উপায় আর নাই এ মহীতে।
নাসা, কণ্ঠ, চক্ষু কিম্বা ওষ্ঠে যাহা নয়,
লিপির অক্ষরে ব্যক্ত হয় সমুদয়।
খুলে দেয় একেবারে প্রাণের কপাট,
ধারে না লজ্জার ধার, থাকে না ঝঞ্ঝাট।
উদয়-ভূধর হতে অস্তাচলে যায়,
প্রণয়ী জনের কথা গোপনে জানায়।
জান ত হে প্রিয়তম! প্রথমে কেমন
সখাভাবে কত ভক্তি করেছি যতন।
জানি নাই প্রথম সে প্রেমের সঞ্চার
ভাবিতাম যেন কোন দেবের কুমার;
ঈশ্বর আপনি যেন স্বহস্তে করিয়া
নির্ম্মাণ করিলা তোমা নিজ রশ্মি দিয়া;
সুধাংশুর অংশু যেন করে একত্রিত,
সহাস্য নয়নে তব করিলা স্থাপিত।
নেত্রে নেত্রে মিলাইয়া স্থিরদৃষ্টি হয়ে
দেখিয়াছি কতবার পবিত্র হৃদয়ে।
গাহিতে যখন তুমি অমর শুনিত
কি মধুর শাস্ত্রালাপ বদনে ক্ষরিত!
সে সুস্বরে কার মনে না হয় প্রত্যয়—
প্রেমেতে নাহিক পাপ ভাবিনু নিশ্চয়।
ভক্তি ছিঁড়ে পড়িলাম ইন্দ্রিয়কুহকে
ভজিনু নাগর ভাবে প্রাণের পুলকে।
দেবপুত্র ভাবিতাম, তা হোতে অধিক
প্রিয়তম হলে নাথ হইয়ে প্রেমিক।
তোমা হেন কান্ত যদি মর্ত্তভূমে পাই,
ঋষি হয়ে স্বর্গসুখ ভুঞ্জিতে না চাই।
যে ভাবে অধিক সুখ সে যাক সেখানে,
আমি যেন তোমা লয়ে থাকি এ ভুবনে।
অয়ি নাথ! কত জন, আছে ত স্মরণ,
বলেছিল পতিভাবে করিতে বরণ;
তখনি দিয়াছি শাপ হোক্ বজ্রাঘাত,
পরিণয় সংস্কার যাক্ রে নিপাত।
হাতে সুতো বেঁধে কভু প্রেমে বাধা যায়?
বন্ধন দেখিলে প্রেম তখনি পলায়।
স্বাধীন মকরকেতু, স্বাধীন প্রণয়,
না বুঝে অবোধ লোক চাহে পরিণয়।
পরিণয়ে ধন হয়, নাম হয়, যশ,
প্রণয় নহেক ধন বিভবের বশ।
ভূমণ্ডলপতি যদি চরণে আমার
ধরে দেয় ভূমণ্ডল, সিংহাসন তার,
তুচ্ছ করে দূরে ফেলি; মনে যদি ধরে
ভিকারীর দাসী হয়ে থাকি তার ঘরে।
যে রমণী সে সৌভাগ্য ভুঞ্জে চিরকাল
কত ভাগ্যবতী সেই, হায় রে কপাল!
কিবা সুধাময় সেই সুখের সময়,
সুখের সাগর যেন উচ্ছসিত হয়।
পরাণে পরাণ বাঁধা প্রণয়ের ভরে,
পরিপূর্ণ পরিতোষ প্রেমীর অন্তরে।
অাশার থাকে না ক্ষোভ, ভাষার যোজনা
হৃদয়ে হৃদয়ে কথা প্রকাশে আপনা।
সেই সুখ—সুখ যদি থাকে মহীতলে—
পারিজাত মদনের ছিল কোন কালে।
সে সুখের দিন এবে কোথায় গিয়েছে,
কোথা পারিজাত কোথা মদন রয়েছে!
কি হলো কি হলো হয় একি সর্ব্বনাশ,
নাথের দুর্দ্দশা এত, কোরে নগ্নবাস
কে করিল অস্ত্রাঘাত! কোথায় তখন
ছিল দাসী পারিজাত অভাগী দুর্জন?
সেই দণ্ডে, প্রাণনাথ, তীক্ষ্ণ অস্ত্র ধরে
নিবারণ করিতাম পাষণ্ড বর্ব্বরে।
দুজনে করেছি পাপ দুজনে সহিব
লজ্জা করে, প্রাণনাথ, কি আর বলিব।
অশ্রু বিসর্জ্জনে এবে মিটাই সে সাধ;
দগ্ধ বিধি ঘটাইলি ঘোর পরমাদ!
আনিল আমায় হেথা যে বিষম দিনে,
বসাইল ধরাতলে পবিত্র অজিনে,
পরাইল বৃক্ষছাল দণ্ড দিল হাতে,
ভাব কি সে দিন আমি ভুলেছিনু নাথে?
প্রাণেশ্বর, চারিদিকে ঋষিগণ যত
করে মন্ত্র উচ্চারণ আমি ভাবি তত
তোমার বদন-ইন্দু, তোমার লোচন,
মনে মনে করি তব গুণেরি কীর্ত্তন;
নয়নের কোণে মাত্র বেদী পানে চাই
মনে সুধু কিসে পুনঃ ফিরে কাছে যাই।
যৌবন রূপের ঘটা তখনো অতুল,
হেরে চমৎকৃত হলো যত ঋষিকুল;
সংশয়ে বিস্ময়ে ভাবে এ হেন বয়সে
রমণী ইচ্ছায় কভু আশ্রমে কি আসে?
সত্য ভেবেছিলা তারা মিথ্যা কথা নয়—
যুবতীর যোগ ধর্ম্ম মিথ্যা সমুদয়।
যাই হোক্, নাই হবে গতি মুক্তি মম
বারেক নিকটে এস অহে প্রিয়তম।
সেই রূপে নয়নের বিষাক্ত অমৃত
করি পান মনসাধে হব বিমোহিত,
অধরে অধর দিয়ে হয়ে অচেতন
মূর্চ্ছাভাবে বক্ষঃস্থলে দেখিব স্বপন।
না না না, দুরন্ত আশা হও রে অন্তর,
এসো নাথ ধর্ম্মপথে লও হে সত্বর,
পুণ্যধামে পুণ্যজন যে আনন্দ পায়
শিখাও এ অভাগীরে, স্নিগ্ধ কর কায়।
আহা এই শুদ্ধ শান্ত আশ্রম ভিতরে
কতই পুণ্যাত্মা জীব আনন্দে বিহরে;
তরু লতা আদি হেথা সকলি নির্ম্মল,
সকলেই ভক্তিরসে সদাই বিহ্বল।
পর্ব্বত শিখর গুলি সুন্দর কেমন
উঠিয়াছে চারিধারে মেঘের বরণ;
শাল, তাল, তমালের তরু সারি সারি
শুনাইছে মৃদুস্বর দিবস শর্ব্বরী;
সুর্য্যকরে দীপ্ত হয়ে স্রোতকুল যত
শিখরে শিখরে আহা ভ্রমে অবিরত;
করে কুলুকুলু ধ্বনি গিরিপ্রস্রবণ,
গুহার ভিতরে আহা মধুর শ্রবণ।
সন্ধ্যা সমীরণে এই হ্রদের উপরে
তরঙ্গ খেলায় যবে কিবা শোভা ধরে।
হেন স্নিগ্ধ তপোবন ভিতরে আমার
ঘুচিল না এ জনমে ইন্দ্রিয় বিকার।
হে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডপতি করুণা নিদান,
করুণা কটাক্ষপাতে কর পরিত্রাণ।
দেও, দেব, দেখাইয়ে মুক্তির আলয়,
ভক্তি ভাবে লইলাম তোমারি আশ্রয়।
যমুনাতটে
১
আহা কি সুন্দর নিশি, চন্দ্রমা উদয়,
কৌমুদীরাশিতে যেন ধৌত ধরাতল
সমীরণ মৃদু মৃদু ফুলমধু বয়,
কল কল করে ধীরে তরঙ্গিণী জল!
কুসুম, পল্লব, লতা নিশার তুষারে
শীতল করিয়া প্রাণ শরীর জুড়ায়,
জোনাকির পাঁতি শোভে তরু শাখাপরে,
নিরবিলি ঝিঁ ঝিঁ ডাকে, জগত ঘুমায়;—
হেন নিশি একা আসি, যমুনার তটে বসি,
হেরি শশী ভুলে ভুলে জলে ভাসি যায়।
২
কে আছে এ ভূমগুলে, যখন পরাণ
জীবন-পিঞ্জরে কাঁদে যমের তাড়নে,
যখন পাগল মন ত্যজে এ শ্মশান
ধায় শূন্যে দিবানিশি প্রাণ অন্বেষণে,
তখন বিজন বন, শান্ত বিভাবরী,
শান্ত নিশানাথজ্যোতি বিমল আকাশে,
প্রশস্ত নদীর তট, পর্ব্বত উপরি,
কার না তাপিত মন জুড়ায় বাতাসে।
কি সুখ যে হেনকালে, গৃহ ছাড়ি বনে গেলে,
সেই জানে প্রাণ যার পুড়েছে হুতাশে।
৩
ভাসায়ে অকুল নীয়ে ভবের সাগরে
জীবনের ধ্রুবতারা ডুবেছে যাহার,
নিবেছে সুখের দীপ ঘোর অন্ধকারে,
হু হু করে দিবা নিশি প্রাণ কাঁদে যার,
সেই জানে প্রকৃতির প্রাঞ্জল মূরতি,
হেরিলে বিরলে বসি গভীর নিশিতে,
শুনিলে গভীর ধ্বনি পবনের গতি,
কি সাত্ত্বনা হয় মনে মধুর ভাবেতে।
না জানি মানব মন, হয় হেন কি কারণ,
অনন্ত চিন্তার গামী বিজন ভূমিতে।
৪
হায় রে প্রকৃতি সনে মানবের মন,
বাঁধা আছে কি বন্ধনে বুঝিতে না পারি,
নতুবা যামিনী দিবা প্রভেদে এমন,
কেন হেন উঠে মনে চিন্তার লহরী?
কেন দিবসেতে ভুলি থাকি সে সকলে
শমন করিয়া চুরি নিয়াছে যাহায়?
কেন রজনীতে পুনঃ প্রাণ উঠে জ্বলে,
প্রাণের দোসর ভাই প্রিয়ার ব্যথায়?
কেন বা উৎসবে মাতি, থাকি কভু দিব রাতি,
আবার নির্জনে কেন কাঁদি পুনরায়?
৫
বসিয়া যমুনাতটে হেরিয়া গগন,
ক্ষণে ক্ষণে হলো মনে কত যে ভাবনা,
দাসত্ব, রাজত্ব, ধর্ম্ম, আত্ম্যবন্ধুজন,
জরা, মৃত্যু, পরকাল, যমের তাড়না!
কত আশা, কত ভয়, কতই আহ্লাদ,
কতই বিষাদ আসি হৃদয় পূরিল,
কত ভাঙি, কত গড়ি, কত করি সাধ,
কত হাসি, কত কাঁদি, প্রাণ জুড়াইল।
রজনীতে কি আহ্লাদ, কি মধুর রসাস্বাদ,
বৃন্তভাঙা মন যার সেই সে বুঝিল!
লজ্জাবতীলতা
১
ছুঁইও না ছুঁইও না উটি লজ্জাবতীলতা।
একান্ত সঙ্কোচ করে, এক ধারে অাছে সরে,
ছুঁইও না উহার দেহ, রাখ মোর কথা।
তরু লতা যত আর, চেয়ে দেখ চারি ধার,
ঘেরে আছে অহঙ্কারে—উটি আছে কোথা!
আহা অই খানে থাক, দিও না ক ব্যথা ।
ছুঁইলে নখের কোণে, বিষম বাজিবে প্রাণে,
যেইও না উহার কাছে খাও মোর মাথা;
ছুঁইও না ছুঁইও না উটি লজ্জাবতীলতা।
২
লজ্জাবতীলতা উটি অতি মনোহর ।
যদিও সুন্দর শোভা নাহি তত মনোলোভা,
তবুও মলিন বেশ মরি কি সুন্দর।
যায় না কাহার পাশেমান মর্যাদার আশে,
থাকে কাঙ্গালির বেশে এক নিরন্তর—
লজ্জাবতী লতা উটি মরি কি সুন্দর!
নিশ্বাস লাগিলে গায়, অমনি শুকায়ে যায়,
না জানি কতই ওর কোমল অন্তর।
এ হেন লতার হয়, কে জানে আদর!
৩
হায় এই ভূমণ্ডলে, কত শত জন,
দণ্ডে দণ্ডে ফুটে উঠে, অবনী মণ্ডল লুঠে,
শুনায় কতই রূপ যশের কীর্ত্তন!
কিন্তু হেন ম্রিয়মাণ, সদা সঙ্কুচিত প্রাণ,
পুরুষ রমণী হেরে কে করে যতন?
স্বভাব মৃদুল ধীর, প্রকৃতিটী সুগম্ভীর,
বিরলে মধুরভাষী মানসরঞ্জন;
কে জিজ্ঞাসি তাহাদের করে সম্ভাষণ?
সমাজের প্রান্ত ভাগে তাপিত অন্তরে জাগে,
মেঘে ঢাকা আভাহীন নক্ষত্র যেমন।
ছুঁইও না উহার দেহ করি নিবারণ;
লজ্জাবতী লতা উটি মানসরঞ্জন।
হতাশের আক্ষেপ
(১)
আবার গগনে কেন সুধাংশু উদয় রে!
কাঁদাইতে অভাগারে, কেন হেন বারে বারে,
গগন মাঝারে শশী আসি দেখা দেয় রে।
তারে যে পাবার নয়, তবু কেন মনে হয়,
জ্বলিল যে শোকানল, কেমনে নিবাই রে।
আবার গগনে কেন সুধাংশু উদয় রে!
( ২ )
অই শশী অই খানে, এই স্থানে দুই জনে,
কত অাশা মনে মনে কত দিন করেছি!
কত বার প্রমদার মুখচন্দ্র হেরেছি!
পরে সে হইল কার, এখনি কি দশা তার,
আমারি কি দশা এবে কি আশ্বাসে রয়েছি!
(৩)
কৌমার যখন তার, বলিত সে বারম্বার,
সে আমার আমি তার অন্য কারো হবো না।
অরে দুষ্ট দেশাচার, কি করিলি অবলার,
কার ধন করে দিলি, আমার সে হলো না!
(৪)
লোক-লজ্জা মান ভয়ে, মা বাপ নিদয় হয়ে,
আমার হৃদয়-নিধি অন্য কারে সঁপিল,
অভাগার যত আশা জন্ম-শোধ ঘুচিল।
(৫)
হারাইনু প্রমদায়, তৃষিত চাতক প্রায়,
ধাইতে অমৃত আশে বুকে বজ্র বাজিল;—
সুধাপান অভিলাষ অভিলাষি থাকিল ।
চিন্তা হলো প্রাণাধার, প্রাণত্যুল্য প্রতিমার
প্রতিবিম্ব চিত্তপটে চিরাঙ্কিত রহিল,
হায়, কি বিচ্ছেদ-বাণ হৃদয়েতে বিঁধিল ।
(৬)
হায়, সরমের কথা, আমার স্নেহের লতা,
পতিভাবে অন্য জনে প্রাণনাথ বলিল ;
মরমের ব্যথা মম মরমেই রহিল।
(৭)
তদবধি ধরাসনে, এই স্থানে শূন্যমনে
থাকি পড়ে, ভাবি সেই হৃদয়ের ভাবনা;
কি যে ভাবি দিবানিশি তাও কিছু জানি না।
সেই ধ্যান সেই জ্ঞান, সেই মান অপমান—
অরে বিধি, তারে কি রে জন্মান্তরে পাব না ?
(৮)
এ যন্ত্রণা ছিল ভালো, কেন পুনঃ দেখা হলো,
দেখে বুক বিদারিল, কেন তারে দেখিলাম ।
ভাবিতাম আমি দুখে, প্রেয়সী থাকিত সুখে,
সে ভ্রম ঘুচিল, হায়, কেন চখে দেখিলাম !
(৯)
এই রূপে চন্দ্রোদয়, গগন তারকাময়,
নীরব মলিনমুখী অই তরুতলে রে;
এক দৃষ্টে মুখপানে, চেয়ে দেখে চন্দ্রাননে,
অবিরল বারিধারা নয়নেতে ঝরে রে;
কেন সে দিনের কথা পুনঃ মনে পড়ে রে?
(১০)
সে দেখে আমার পানে, আমি দেখি তার পানে,
চিতহারা দুই জনে বাক্য নাহি সরে রে;
কতক্ষণে অকস্মাৎ, “বিধবা হয়েছি নাথ”
বলে প্রিয়তমা ভূমে লুটাইয়ে পড়ে রে।
(১১)
বদন চুম্বন করে, রাখিলাম ক্রোড়ে ধরে,
শুনিলাম মৃদু স্বরে ধীরে ধীরে বলে রে—
“ছিলাম তোমারি আমি, তুমিই আমার স্বামী,
ফিরে জন্মে, প্রাণনাথ, পাই যেন তোমারে।”—
কেন শশী পুনরায় গগনে উঠিলি রে!
১.০৪ ছেলেধরা
ছেলেধরা
আমরা ভূমিষ্ঠ হয়েই শুলেম, সহরে ছেলেধরার বড় প্রাদুর্ভাব! কাবুলি মেওয়াওয়ালারা ঘুরে ঘুরে ছেলে ধরে কাবুলে নিয়ে যায়। সেথায় নানাবিধ মেওয়া ফলের বিস্তর বাগান আছে, ছেলেটাকে তারি একটা বাগানের ভিতর ছেড়ে দেয়, সে অনবরত পেটপুরে মেওয়া খেয়ে খেয়ে যখন একেবারে ফুলে উঠে রং দুধে আলতার মত হয়, এমন কি টুস্কি মাল্লে রক্ত বেরোয়, তখন এক কড়া ঘি চড়িয়ে ছেলেটাকে ঐ কড়ার উপর, উপরপানে পা করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়; ক্রমে কড়ার ঘি টগবগিয়ে ফুটে উঠলে ছেলের মুখ দিয়ে রক্ত বেরুতে আরম্ভ হয় ও সেই রক্ত টোসা টোসা ঘিয়ের কড়ার উপর পড়ে; ক্রমে ছেলের সমুদায় রক্ত বেরিয়ে এলে নানাবিধ মেওয়া ও মিছরির ফোড়ন দিয়ে কড়াখানি নাবান হয়। নবাব ও বড় বড় মোসলমানরা তাই খান। আমরা এই ভয়ানক কথা শুনে অবধি একলা বাড়ার বাহিরে প্রাণান্তেও যেতাম না, ও সেই অবধি কাবুলীদিগের উপর বিজাতীয় ঘৃণা জন্মে গেল।
বিলাতের কথা
উনি আমাদের জ্ঞাতি শ্ৰীযুক্ত জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরকে আমার বিলেত যাবার কথা লিখেছিলেন। তাঁরা আমাদের নাবিয়ে নিতে জাহাজে লোক পাঠিয়েছিলেন। তিনি খ্ৰীস্টান হয়ে খ্রীস্টান কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে বিয়ে করেছিলেন বলে তার বাপ প্রসন্নকুমার ঠাকুর তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। সেই অবধি তিনি সপরিবারে বিলেতে বাস করছিলেন। তাঁর দুই মেয়ে ছিল—বলেন্দ্রবালা ও সত্যেন্দ্রবালা, তাঁদের ডাকনাম ছিল বালা ও সতু। জ্ঞানেন্দ্রমোহনের রং খুব সাফ ছিল। তিনি আদরের ছেলে ছিলেন বলে বাপ অল্প বয়সে যশোরের এক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। সেই স্ত্রীর তিনি খুব অতুগত হয়ে পড়েছিলেন, এমন কি পাখার বাতাস দিয়ে ঘুম পাড়াতেন ও দিনরাত কাছে কাছে থাকতেন। সেই স্ত্রী মারা যেতে তিনি খুব অস্থির হয়ে পড়েন, সেই সময় কৃষ্ণ বন্দ্যোঃ নামে এক পাদ্রী তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে খ্ৰীস্টান করে ফেল্লেন। বাপের মৃত্যুর সময় নাকি তিনি একবার দেখা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সব দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল বলে ঢুকতে পারেন নি।
প্রসন্নকুমার ঠাকুর অত্যন্ত বেঁটে ছিলেন বলে’ তাঁর গুষ্টিসুদ্ধ তিন চার পুরুষ পর্যন্ত বেঁটে রয়ে গেছে। বালা ও সতু খুব বেঁটে ছিলেন, চেহারাও তেমন ভাল ছিল না, কেবল খুব চুল ও বড় বড় চোখ ছিল। তখনকার ধরণের ইংরিজী পোশাক পরতেন। তাদের ওখানে যে-সব ইংরাজ ভদ্রলোকের নিমন্ত্রণ হত—হয়ত বিয়ের সম্বন্ধ করবার উদ্দেশ্যে—তাঁদের মধ্যে একজন আমাকে চুপি চুপি বলেছিলেন যে, এদের বিয়ে করব কি, শরীরে যে কিছু নেই, শুধু কাঠি। বালা ও সতুর শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়নি। আর সকলে মারা গেলে অনেকদিন পর সতু বিষয়-কর্মের পরামর্শের জন্য মহারাজা যতীন্দ্রমোহনের কাছে কলকাতায় এসেছিল। যদিও জ্ঞানেন্দ্রমোহন বাপের বিষয় থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, তবু কিছু বিষয় তাঁর ছিল, তার থেকে তাঁর চলত। শেষে তাঁর এক বন্ধু উকীল Ramsdenকে বলেছিলেন যে সে যদি Tagore নাম নেয় ত তাঁর বিষয়ের উত্তরাধিকারী হতে পারবে।
আমরা প্রথম বিলেতে গিয়ে তাঁর বাড়ীতে উঠেছিলুম আর আমার ছেলেদের দেখে খুশি হয়ে বলেছিলেন যে, বেশ ঠাকুরবাড়ীর উপযুক্ত হয়েছে। তাদের খেলনাও দিয়েছিলেন। পরে তিনি আমাদের অন্যত্র থাকবার ব্যবস্থা করে দেন। Miss Sharp ও Miss Donkins বলে দুই মেমের সঙ্গে আমার ভাব হয়েছিল। Miss Sharpএর বয়স হয়েছিল, কিন্তু কুমারীর মত বেশ সাজগোজ করে থাকতেন। তাঁর একজন দাসী ছিল, সে তাঁর পাকাচুল কুঁক্ড়ে দিয়ে সাজিয়ে রাখত। আমি মনে করতুম তিনি আমার বয়সী, পরে শুনলুম ৪০৷৫০ হয়ে গেছে। তাঁর সঙ্গে ব্রাইটন গিয়েছিলুম মনে আছে। সেখানে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যেতুম। তখন একটু একটু কাজ-চালানো ইংরিজী বলতে পারতুৎ। বিলেতে প্রথম বরফ-পড়া দেখে আমি এত মোহিত হয়েছিলুম যে, পাতলা রেশমী শাড়ি পরেই বাইরে ছুটে গেলুম, আর যেমন পড়ছে কুড়তে লাগলুম। সবাই বারণ করেছিল যে এখন বাইরে যেও না। তার দরুণ খুব অম্লখ করেছিল। উপর-হাতে ফুলো হয়ে ভিতরে ঘা হয়ে গেল। তখন Lord Lister আমাকে দেখেছিলেন—যিনি পরে antiseptic বের করেন। বহুদিন পরে যখন দেশে এলুম গুরুচরণ কবিরাজের তেলে সেই নালি ঘা সেরে গেল। বিলেতে অনেক দিন slingএ হাত বেঁধে বেঁধে শেষে এতটা উঁচুর বেশি হাত তুলতে পারতুম না।
বিলেতে আমার যে ছেলেটি অসময়ে হয়, তার মাথাটা ভাল করে হয়নি, শীঘ্রই মারা গেল। তাকে বলেছিলুম দ্বারকানাথ ঠাকুরের গোরের কাছে গোর দিতে। গত বৎসরও হেমলতা বউমারা গিয়ে সেটা দেখে এসেছেন। তার উপরের চোবি বলে’ ছোট ছেলেটিও বিলেতে মারা যায়। আমার মনে হয় রামা বলে চাকরটা তাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে বেশি জোরে জোরে হাঁটাত। আমার এখনো তার জন্য দুঃখ হয়। সে Lily of the Valley ফুলের নাম করতে বড় ভালবাসত মনে পড়ে।
ছেলেদের অসুখের সময় Miss Donkins বলে মেমটি আমাকে খুব সাহায্য করেছিল। সে গৃহস্থের মেয়ে, পরের উপকার করে বেড়াত। ছেলেদের যখন খুব খারাপ অবস্থা, তখন রাত্রি-বেশেই ছুটে বেরিয়ে পড়েছিল ডাক্তার ডাকতে।
বিলেতে প্রায় আড়াই বছর ভিন্ন ভিন্ন ভাড়া বাড়ীতে ছিলুম। উনি মাঝে বিলেতে এলেন, রবিকেও সঙ্গে এনেছিলেন। বালা পিয়ানো বাজাত, সেই সঙ্গে রবি গাইতেন, তাতে সে খুব খুশি হত। দুজনে খুব জমে গেল। রবির মাথা পরিষ্কার করে আমি চুল আঁচড়ে দিতুম। তারপর তিনি গান গাইতে শিখলে খুব সুখ্যাতি পেলেন। ছেলেরা শুনত ‘পাপা আসছে, পাপা আসছে’। কিন্তু সেখানে যত ছেলের পাপার রং সাদা দেখে, আর ওঁর রং কালো দেখে বিবি দরজার আড়ালে দরজার আড়ালে লুকিয়ে গিয়ে বল্ল “That’s not my Papa!” ওদের ‘পাপার’ সঙ্গে ভাব করতে অনেক সময় লাগল। কিছুদিন পরে আমরা একসঙ্গে ফ্রান্সে যাই। Mediterranean-এর নীল জল খুব সুন্দর। ফরাসীতে সমুদ্রের নাম “Mer” আর মায়ের নাম Mère-এর একই উচ্চারণ। এই দুইএর তারা তুলনা করত। আমরা Nice-এ একটা হোটেলে ছিলুম। সেখানে ছেলেমেয়েদের একটু একটু ফরাসী শেখাবার জন্ম হোটেলের চাকরদের কাছে নিজে গিয়ে দুধ জল প্রভৃতি চাইতে বলতুম।
আর একটি সুন্দর ছোট সাদা কুকুর সেখান থেকে এনেছিলুম বলে’ তার নাম রেখেছিলুম Nicois। দেশে এলে বাড়ীর দু’ একটি ছেলে তার ভেউ ভেউ ডাক শুনে ভয়ে খাটের উপর উঠে পড়ত মনে আছে। কিন্তু সে আসলে দুষ্টু ছিল না, কামড়াত না। ট্রেনে তাকে টুকরিতে লুকিয়ে বেঞ্চির তলায় রেখে দিলে সে স্টেশনে থামবার সময় গার্ডকে গাড়িতে আসতে দেখলে ভেউ ভেউ করে নিজের অস্তিত্ব জাহির করত, তাও মনে আছে। হোটেলে আমার মেয়ের চুল দেখে কোন মেম নাকি বলেছিল যে ঠিক যেন কালো রেশমের মত। তাই আবার বিবি এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলে সে কথা ঠিক কিনা। আর তাকে একটা ছোট পুতুল দিয়েছিলুম; তার সঙ্গে একবাক্স কাপড় ছিল, বদ্লে বদ্লে পরাবার জন্য। সেই পুতুলটাকে খাবার টেবিলে বিবি রেখে দিত, আর হোটেলের ওয়েটর তাকে ক্ষেপাবার জন্যে তুলে তুলে নিয়ে যেত।
ফরাসীদের জাতীয় সঙ্গীত Marseillaise আমার খুব ভাল লাগত। এখনো একটু একটু মনে পড়ে। ওখানে একটা বাড়ী ছেড়ে যখন আর একটা বাড়ীতে উঠে গেলুম তখন প্রথম বাড়িওয়ালী খুব রেগে গেল, বল্লে—এখানে যেরকম ভাল খাবার পাও সেখানে কী তা পাবে? –একটু একটু ফরাসী বলতে পারতুম। একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ফরাসী বলতে পারি কিনা; তাতে আমি বল্লুম—Je ne parle pas francais; তখন তিনি বল্লেন, এইত বল্লে। আর একটা কথা মনে আছে, রাস্তা কোথায় জানতে হলে বলতে হত Par où faut-il prendre pour aller অমুক জায়গায়। Ollendorf-এর একরকম বই পাওয়া যেত তাতে কথাবার্তা চালান একরকম শেখা যায়। ছোট ছেলেপিলে নিয়ে এই অল্প জ্ঞান নিয়ে বিদেশে যে কি করে কাটিয়েছিলুম, আর উনিই বা কি করে এই অবস্থায় আমাকে একলা পাঠালেন তাই এখন ভাবি। অবশ্য সেখানকার লোক আমাকে মায়া করত আর সবাই আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করত।
বিলেতে থাকতে Tunbridge Wells, Brighton ও Torquay তে গিয়েছিলুম। সমুদ্রের ধারের জায়গায় ছেলেরা বালি নিয়ে বালতি নিয়ে খেলা করত। দেশের লোকের মধ্যে Mabel Dutt (পরে ওঁর বন্ধু তারকনাথ পালিতের বউ হন) বেশ সুন্দরী ছিলেন। তার বাপ ক্ষেত্র দত্ত মেম বিয়ে করেছিলেন। মাঝে মাঝে আমাদের ওখানে আসতেন। একদিন মদ খেয়ে গেলাসে অল্প রেখেছিলেন, বিবি সেটুকু খেয়ে ফেলেছিল। সেজন্যে তাকে খুব বকলুম, কারণ তাঁর জিভে একটা অসুখ ছিল। মেবল আমার ছেলেদের চেয়ে বয়সে কিছু বড় ছিল ও তাদের শোবার সময় গল্প বলত। তাতে Beelzebub-এর কথা থাকত, তারা এখনো মনে করে। আর একজন ছিলেন অ্যানি চক্রবর্তী। তার বাপ গুডীব (সূর্যকুমার) চক্রবর্তী দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে বিলেত গিয়ে ডাক্তার হয়ে এসেছিলেন ও মালয় ফিরিঙ্গী মেম বিয়ে করেছিলেন। তার বড় মেয়ে সিসটার বেনেডিক্টা নামে নান্ হন আগেই বলেছি। এই অ্যানি ছিলেন তাঁর আর একটি মেয়ে ও তাঁর চেহারায় মাতৃকুলের কিছু ছাপ ছিল। তিনি এদেশে এসে প্যারী রায় নামক ব্যারিস্টারকে বিয়ে করে অনেকগুলি ছেলেমেয়ে নিয়ে বহু দিন সুখে সচ্ছন্দে সংসার করেন। তিনি সামাজিক মেলামেশায় খুব পটু ছিলেন। তাঁর সঙ্গে অনেক কাল ধরে আমাদের বন্ধুত্ব ছিল। তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর সম্প্রতি পঙ্গু অবস্থায় বেঁচে আছেন শুনতে পাই, তবে আমার সঙ্গে আর দেখাশুনো হয় না।
আমারও এখন শরীর প্রাচীন ও অপটু। চোখে কানে ভাল দেখতে শুনতে পাইনে। সব কথা ভুলে যাই। সেইটেই আমার বেশী কষ্টকর মনে হয়। কাজেই পূর্বজীবনের কথা ধারাবাহিক ভাবে বলা আমার পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তবু আমার মেয়ে ছাড়েন না, তাই তাঁর প্রশ্নের যতটুকু পারি উত্তর দিয়ে যাই। তাতে খাপছাড়া ভাবে কিছু জানা যায় মাত্র।