আমার বন্ধু সফিক

ইদানীং পুরানো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা হলে বড় ধরনের ধাক্কা খাই–কি চেহারা একেকজনের–দাঁত পড়ে গেছে, গালের চামড়া গেছে কুঁচকে, মাথায় অল্প কিছু ফিনফিনে চুল। কলপ দিয়ে সেই চুলের বয়স কমানো হয়েছে কিন্তু সাদা সাদা গোড়া উঁকি দিচ্ছে।

ওদের দিকে তাকালে মনে হয়–হায় হায়, আমার এত বয়স হয়ে গেছে? এখন কি তাহলে যাবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করব? মীরপুর গোরস্থানে জমি দেখতে যাব?

আয়নায় যখন নিজেকে দেখি তখন এতটা বয়স মনে হয় না। হাস্যকর হলেও সত্যি, নিজেকে যুবক-যুবকই লাগে। ঐ তো কি সুন্দর চোখ! চোখের নিচে কালি পড়েছে। এটা এমন কিছু না, রাত জাগি, কালি তো পড়বেই। কয়েক রাত ঠিকমত ঘুমুতে পারলে চোখের কালি দূর হয়ে যাবে। মুখের চামড়ার বলিরেখা? ও কিছু না। অনেক যুবক ছেলেদের মুখেও এমন দাগ দেখা যায়। মাথার চুল সাদা হয়ে গেছে? এটা কোন ব্যাপারই না। চুল পাকা বয়সের লক্ষণ নয়। মানুষের বয়স শরীরে না, মনে।

আমাদের মত বয়েসীদের হঠাৎ রঙিন কাপড়ের দিকে ঝুঁকে যেতে দেখা যায়। চক্রাবক্রা হাওয়াই শার্ট পরে এরা তেজী তরুণের মত হাঁটতে চেষ্টা করে–জরাকে অগ্রাহ্য করার হাস্যকর চেষ্টা। চোখে-মুখে এমন একটা ভাব যেন এইমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পড়া চুকিয়ে রাস্তায় নেমেছি। বান্ধবীকে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই কোন কাফেতে চা খেতে যাব কিংবা বাদাম ভাঙতে ভাঙতে রাস্তায় হাঁটব।

এরকম একদিনের কথা। নাপিতের দোকান থেকে চুল কেটে বের হয়েছি। চুল কাটার ফলে গোড়ার শাদা চুল বের হয়ে এসেছে। বিশ্রী দেখাচ্ছে। মেজাজ খারাপ করে এক পান সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছি। সিগারেট কিনে বাসায় ফিরব। হঠাৎ দেখি যুবক একটা ছেলে কদবেল কিনছে। সে বসেছে উবু হয়ে। বেল খুঁকে শুকে দেখছে। তার পেছনেই শাড়ি পরা এক তরুণী। তরুণী লজ্জা পাচ্ছে বলে মনে হল। ছেলেটিকে খুব চেনা-চেনা মনে হচ্ছে। আবার চিনতেও পারছি না। সে দুটা কদবেল কিনে উঠে দাঁড়াল। আমাকে দেখে চেঁচিয়ে বলল, আরে তুই!

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এ হচ্ছে আমাদের সফিক। ঢাকা কলেজে এক সঙ্গে পড়েছি, ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। তারপর যোগাযোগ নষ্ট হয়ে গেছে।

সফিক বলল, তুই এত বিশ্রী করে চুল কেটেছিস। তোকে দেখাচ্ছে পকেটমারের মত।

আমার হতভম্ব ভাব তখনো কাটে নি। আমি অবাক হয়ে সফিককে দেখছি। ব্যাটার বয়স বাড়ে নি। জরা তাকে স্পর্শ করে নি। তাকে ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র বললে কেউ অবিশ্বাস করবে না।

সফিক বলল, দোস্ত, এ হচ্ছে আমার বড় মেয়ে। ইন্টারমিডিয়েট সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ে। এর নাম শাপলা। শাপলা মা, চাচাকে পা ছুঁয়ে সালাম কর।

আমি বললাম, বাজারের মধ্যে কিসের সালাম?

‘বাজার-টাজার বুঝি না। সালাম করতে হবে।‘

মেয়ে একগাদা লোকের মধ্যেই নিচু হয়ে সালাম করল। সফিক আমার হাত ধরে বলল, চল আমার সাথে।

‘কোথায়?’

‘আমার বাসায়, আবার কোথায়?’

‘আরে না। চুল কেটেছি–গোসল করব।‘

‘কোন কথা না। শাপলা মা–তুই শক্ত করে চাচার একটা হাত ধর। আমি আরেক হাত ধরছি। দু’জনে মিলে টেনে নিয়ে যাব।‘

আমাকে ওদের সঙ্গে যেতে হল। ছোট্ট ফ্ল্যাট বাড়ি। বোঝাই যাচ্ছে আর্থিক অবস্থা নড়বড়ে। বসার ঘরে বার ইঞ্চি ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভি। ইদানীং টিভির মাপ থেকে অর্থনৈতিক অবস্থা আঁচ করার একটা সুবিধা হয়েছে। সফিক আমাকে টানতে টানতে একেবারে রান্নাঘরে নিয়ে উপস্থিত–পঁড়া, বৌকে অবাক করে দিই–সে তোর নাটক দেখে গ্যালন গ্যালন চোখের পানি ফেলে। চোখের পানির মূল মালিক ধরে নিয়ে। এসেছি।

রান্নাঘরে আমাকে দেখে সফিকের স্ত্রী অত্যন্ত বিব্রত হল এবং দারুণ অস্বস্তির মধ্যে পড়ল। স্বামীর পাগলামির সঙ্গে বেচারী বোধহয় এত দিনেও মানিয়ে নিতে পারে নি।

‘ছিঃ ছিঃ, কি অবস্থা রান্নাঘরের! এর মধ্যে আপনাকে নিয়ে এসেছে। ওর। কোনদিন কাণ্ডজ্ঞান হবে না। ও কি ছাত্রজীবনেও এরকম ছিল?’

আমি জবাব দিতে পারলাম না। ছাত্রজীবনে সফিক কেমন ছিল আমার মনে নেই। ডিম-সিদ্ধ তার খুব পছন্দের খাবার ছিল–এইটুকু মনে আছে। সিদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়িয়ে আস্ত মুখে ঢুকিয়ে দিত। এই সময় তার আরামে চোখ বন্ধ হয়ে যেত।

আমি লক্ষ্য করলাম, সফিকের বয়স না বাড়লেও তার স্ত্রীর ঠিকই বেড়েছে। ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হয়, জীবনযুদ্ধে তিনি পরাজিত। ক্লান্তি ও হতাশা তাঁকে। পুরোপুরি গ্রাস করেছে। অসুখ-বিসুখেও মনে হয় ভুগছেন। যতক্ষণ কথা বললেন, ক্রমাগত কাশতে থাকলেন। কাশতে কাশতে বললেন, আপনি এসেছেন আমি খুশি হয়েছি। আপনাকে যে যত্ন-টত্ন করব সেই সামর্থ্য নেই। সংসারের অবস্থা ভাঙা নৌকার মত। কোনমতে টেনে নিচ্ছি। ইভিনিং শিফটে একটা স্কুলে কাজ করি। ঐ বেতনটাই ভরসা। কাজটা না থাকলে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে রাস্তায় ভিক্ষা করতে হত।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, সফিক কিছু করে না?

‘করে। ও একটা ব্যাংকের ম্যানেজার। তাতে লাভ কিছু নেই। আপনি আপনার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করুন তো–পুরো বেতন কখনো সে আমার হাতে দিয়েছে কি না। এমনও মাস যায় একটা পয়সা আমাকে দেয় না। আপনিই বলুন, আমি কি বাচ্চাগুলোকে পানি খাইয়ে মানুষ করব?’

সফিক বলল, চুপ কর। প্রথম দিনেই কী অভিযোগ শুরু করলে! এইসব বলার সুযোগ আরো পাবে। আজ না বললেও চলবে। ফাইন করে চা বানাও। হুমায়ুন খুব চা খায়। সে আগের জন্মে চা বাগানের কুলী ছিল।

সফিকের স্ত্রী কঠিন গলায় বলল, ভাই, চা আপনাকে খাওয়াচ্ছি–কিন্তু আমার কথা আপনাকে শুনতে হবে। এবং যাবার আগে আপনার বন্ধুকে বুঝিয়ে বলে যেতে হবে–তার নিজের সংসারটাই আসল–। আগে সংসার দেখতে হবে …

অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, ভদ্রমহিলার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।

বেড়াতে এসে এ কী পারিবারিক সমস্যার মধ্যে পড়লাম! সফিক প্রায় জোর করে তার স্ত্রীকে রান্নাঘরে পাঠিয়ে দিল। আমি বললাম, তোর সমস্যাটা কি?

‘আরেক দিন বলব।‘

‘আজই শুনে যাই।”

সফিক খানিকক্ষণ ইতস্তত করে সমস্যা বলা শুরু করল। সফিকের জবানীতেই তার সমস্যা শুনি।

‘বুঝলি দোস্ত, তখন সবে চাকরি পেয়েছি। বিয়ে-টিয়ে করিনি। নিউ পল্টন লাইনে এক কামরার একটা বাসা নিয়ে থাকি। দেশে টাকা পাঠাতে হয় না। বেতন যা পাই নিজেই খরচ করি। বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে হৈ-চৈ। এখানে ওখানে বেড়ানো খানিকটা বদ অভ্যাসও হয়ে গেল–মাঝে-মধ্যে মদ্যপান করা। বন্ধু বান্ধব এসে ধরে–একটা হুইস্কির বোতল কিনে আন। বেতন পেয়েছিস, সেলিব্রেট কর। কিনে ফেলি। অভ্যাসটা স্থায়ী হল না, কারণ আমার বডি সিস্টেম এলকোহল সহ্য করে না। সামান্য খেলেও সারা রাত জেগে থাকতে হয়–এবং অবধারিতভাবে শেষ রাতে হড়হড় করে বমি হয়।

এক রাতের কথা–সামান্য মদ্যপান করে বাসায় ফিরছি। সামান্যতেই নেশা হয়ে গেছে। একটা রিকশা নিয়েছি। মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে রিকশা থেকে পড়ে যাব। অনেক কষ্টে হুড ধরে বসে আছি, এমন সময় এক লোক তার ছেলেকে নিয়ে ভিক্ষা চাইতে এল। তার ছেলের চিকিৎসার জন্যে খরচ। আমি ছেলেটিকে দেখে চমকে উঠলাম। সাত-আট বছর বয়স। ফুটফুটে চেহারা। সম্পূর্ণ নগ্ন। নগ্ন থাকার কারণ হল–তার অসুখের ডিসপ্লে নগ্ন না হলে সম্ভব নয়। ছেলেটির অণ্ডকোষ ফুটবলের মত। প্রকাণ্ড। তাকালেই ঘেন্না হয়। আমি দ্রুত একটা একশ’ টাকার নোট বের করে দিলাম। ছেলের বাবা আনন্দের হাসি হাসল। এই হাসি দেখেই মনে হল–এই নোক তো। ছেলের চিকিৎসা করাবে না। ছেলেকে নিয়ে ভিক্ষা করাই তার পেশা। ছেলে সুস্থ হলে বরং তার সমস্যা।

আমি বললাম, রোজ ভিক্ষা করে কত পাওয়া যায়?

সে গা-ছাড়া ভাব করে বলল, ঠিক নাই। কোনদিন বেশি, কোনদিন কম।

‘আজ কত পেয়েছ? আমারটা বাদ দিয়ে কত?’

‘আছে কিছু।‘

‘কিছু টিছু না। কত পেয়েছ বল।‘

লোকটি বলতে চায় না। কেটে পড়তে চায়। আমি তখন নেশাগ্রস্ত। মাথার ঠিক নেই। আমি হুংকার দিলাম, যাচ্ছ কোথায়? এক পা গেছ কি খুন করে ফেলব। বল আজ কত পেয়েছ–?

‘ধরেন দুই শ”।

‘তুমি কি এই ছেলেকে চিকিৎসার জন্যে কোন দিন হাসপাতালে নিয়ে গেছ? বল ঠিক করে, মিথ্যা কথা বললে খুন করে ফেলব।‘

সে পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল। আমি বললাম, এখনি চল আমার সাথে হাসপাতালে। মেডিকেল কলেজে আমার এক বন্ধু আছে, ডাক্তার–তাকে দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। বাচ্চা কোলে নিয়ে রিকশায় উঠে আস।

সে কিছুতেই আমার সঙ্গে যাবে না। আমি নিয়ে যাবই। মাতালদের মাথায় একটা কিছু ঢুকে পড়লে সহজে বের হতে চায় না। আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ–চিকিৎসা করাবই। এর মধ্যে আমার চারদিকে লোক জমে গেছে। সবাই আমাকে সমর্থন করছে। লোকটা কঁদো কাঁদো হয়ে গেছে। সে মিনমিন করে বলল, ডাক্তার অপারেশন করব। অপারেশন করলে আমার পুলা মারা যাইব।

আমি আবারো হুংকার দিলাম–ব্যাটা ফাজিল। ছেলের অসুখের চিকিৎসা করাবে না। অসুখ দিয়ে ফায়দা লুটবে–চল্ হাসপাতালে।

অসাধ্য সাধন করলাম। দুপর রাতে এদের হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। বন্ধুকে খুঁজে বের করলাম। সে বিরক্ত হয়ে বলল, এই দুপুর রাতে রোগী ভর্তি করব কি ভাবে? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? এই যন্ত্রণা কোত্থেকে জুটিয়েছিস?

আমি বললাম, কিছু শুনতে চাই না। তুই এর ব্যবস্থা করবি। খরচ যা লাগে আমি দিব।

ব্যবস্থা একটা হল। দেখা গেল, অসুখ তেমন জটিল নয়। খাদ্যনালীর অংশবিশেষ মূত্রথলিতে নেমে গেছে। ডাক্তার খাদ্যনালীটা উপরে তুলে দেরে। মূত্রনালীর ফুটো ছোট করে দেবে। অসুখটা হল খারাপ ধরনের হার্নিয়া।

অপারেশনের তারিখ ঠিক হল। আমি মহাখুশি। শুধু ছেলের বাবা কেঁদেকেটে অস্থির। তার ধারণা, ছেলে মারা যাচ্ছে। তার একটাই ছেলে। স্ত্রী মারা গেছে। ছেলেকে নিয়ে সে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। একটাই তার একমাত্র শখ। মনে মনে বললাম, হারামজাদা! ছেলের অসুখ হওয়ায় মজা পেয়ে গেছিস? দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো বার করছি। শুওর কা বাচ্চা। ঘুঘু দেখেছ ফঁদ দেখনি। ছেলেকে শুধু যে ভাল করব তাই না স্কুলেও ভর্তি করাব। মজা বুঝবি।

অপারেশন হয়ে গেল। সাকসেসফুল অপারেশন। ছেলেটিকে অপারেশন টেবিল থেকে ইনটেনসিভ কেয়ারে নেয়া হল। আশ্চর্যের ব্যাপার, ইনটেনসিভ কেয়ারে নেয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে ছেলেটা মারা গেল। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। হায়, হায়! এ কি সর্বনাশ! আমার কারণে ছেলেটা মারা গেল? ছেলের বাবার সঙ্গে দেখা করার সাহসও হল না। আমি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে চলে এলাম।

আমি প্রতিজ্ঞা করলাম–আর পরোপকার করতে যাব না। যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। সারারাত এক ফোঁটা ঘুম হল না। কেন ছেলেটা মরে গেল? কেন?

বুঝলি দোস্ত, ছেলেটা মারা যাবার পর আমার আসল সমস্যা শুরু হল। আমার রোখ চেপে গেল। ঠিক করলাম–যখন যেখানে অসুস্থ ছেলেপেলে দেখব, চিকিৎসা করাব। দেখি কি হয়। দেখি এরা বাঁচে না মরে। সেই থেকে শুরু।

রাস্তায় অসুখ-বিসুখে কাতর কাউকে দেখলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। টাক পয়সা সব এতেই চলে যায়।

তারপর বিয়ে করলাম। সংসার হল। অভ্যাসটা গেল না। চিকিৎসার খরচ আছে। আমি বেতনও তো তেমন কিছু পাই না। সংসারে টানাটানি লেগেই থাকে। বিয়ের সময় তোর ভাবী বেশ কিছু গয়না-টয়না পেয়েছিল। সব বেচে খেয়ে ফেলেছি। এই নিয়েও সংসারে অশান্তি। হা হা হা।

‘কতজন রোগী এই ভাবে সুস্থ করেছিস?’

‘অনেক।‘

‘আর কেউ মারা যায় নি?’

‘না। আর একজনও না। প্রথমজনই শুধু মারা গেল। আর কেউ না।‘

‘এই মুহূর্তে কারোর চিকিৎসা করছিস?”

‘হ্যাঁ, এখনো একজন আছে। জয়দেবপুরের এক মেয়ে। ঠোঁট কাটা। প্লাস্টিক সার্জারী করে ঠোঁট ঠিক করা হবে।‘

আমি মুগ্ধ গলায় বললাম, তুই যে কত বড় কাজ করছিস সেটা কি তুই জানিস?

সফিক অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বড় কাজ করছি, না ছোট কাজ করছি তা জানি না, তবে আমার একেকটা রোগী যেদিন সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে, সেদিন যে আমার কত আনন্দ হয় তা শুধু আমিই জানি। এই আনন্দের কোন তুলনা নেই। প্রতিবারই আমি আনন্দ সামলাতে না পেরে হাউমাউ করে কাদি। লোকজন, ডাক্তার, নার্স সবার সামনেই কাদি।

বলতে বলতে সফিকের চোখে পানি এসে গেল। পানি মুছে সে স্বাভাবিক গলায় বলল, তারপর দোস্ত, তোর খবর বল। তুই কেমন আছিস?

আমি মনে মনে বললাম, শারীরিকভাবে আমি ভাল আছি। কিন্তু আমার মনটা অসুস্থ হয়ে আছে–তুই আমার মন সুস্থ করে দে। এই ক্ষমতা অল্প কিছু সৌভাগ্যবানদের থাকে। তুই তাদের একজন।

ইংলিশ ম্যান

কক্সবাজারে পর্যটনের কিছু কটেজ আছে। এদের বলে ওল্ড কটেজ। সুন্দর সুন্দর নাম–তন্ময়, তটিনি …। এক সময় এই কটেজগুলি সমুদ্রের কাছাকাছি ছিল। কটেজের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসলে সমুদ্র দেখা যেত। আজ আর দেখা যায় না। সমুদ্র দূরে সরে গেছে। কটেজগুলি আলাদা হয়ে গেছে। সমুদ্রের সঙ্গে আজ আর তাদের যোগ নেই। পর্যটন নতুন নতুন কটেজ বানিয়েছে, আধুনিক মোটেল তৈরি করেছে–তন্ময় তটিনিকে নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।

আমি এবার কি মনে করে পুরানো কটেজগুলির একটায় উঠলাম। এই কটেজে রান্না করে খাবার ব্যবস্থা আছে। মনে করলাম, ব্যাপারটা মন্দ হবে না, বাজার করে। রান্নাবান্না করে খাওয়া হবে। পিকনিক-পিকনিক ভাব।

কল্পনা এবং বাস্তবের ভেতরকার দূরত্ব অনেক বেশি। বাস্তবে দেখা গেল, রান্না করে খাওয়ার ব্যাপারটায় যন্ত্রণার কোন সীমা-পরিসীমা নেই। সন্ধ্যাবেলা বাজারে গিয়ে দেখি, অপরিচিত চেহারার কিছু সামুদ্রিক মাছ ছাড়া আর কিছু নেই। গোশত পাওয়া গেল। যিনি গোশত বিক্রি করছেন তিনি নিতান্তই সত্যবাদী। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, কিসের গোশত? তিনি অম্লান বদনে বললেন–বুড়া মহিষ। ইচ্ছা হইলে নেন।

ঢাকার নিউমার্কেট থেকে না জেনে মহিষের গোশত প্রায় রোজই খাচ্ছি। জেনে শুনে বৃদ্ধ মহিষ খাওয়া অসম্ভব। দুটা মুরগী পাওয়া গেল। মুরগী দু’জনও যথেষ্ট অভিজ্ঞ। ঘণ্টা দুই গনগনে আগুনে জ্বাল দেবার পর অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ্য করা গেল। যতই জ্বাল হচ্ছে মাংস ততই শক্ত হচ্ছে।

রাত ন’টায় আমাদের কাজের মেয়েটি এসে বলল, লাকড়ি শেষ হয়ে গেছে। আরো লাকড়ি লাগবে।

আমি লাকড়ি আনতে বের হলাম এবং প্রথমবারের মত উপলব্ধি করলাম, ঢাকার বাসিন্দা যারা গ্যাসের চুলায় রান্না করছেন তারা কত সুখেই না আছেন।

আমাদের খাওয়া শুরু হতে হতে রাত সাড়ে বারোটা বাজল। আমার বড় মেয়ে নোভা খেতে খেতে তার মাকে বলল, নিজে রান্না করে খাওয়ার এই বুদ্ধি আব্দুকে কে দিয়েছে মা?

নোভার মা আমার দিকে না তাকিয়ে বলল, তোমার বাবার কি বুদ্ধির কোন অভাব আছে যে অন্যদের কাছ থেকে ধার করবে? সে চলে তার নিজের বুদ্ধিতে। সেই বুদ্ধির ফলাফল তো তোমরা দেখছ–সবাই সমুদ্র দেখে, খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমুচ্ছে। আমরা কেবল খেতে বসেছি। মুরগী এখনো সিদ্ধ হয়নি।

‘মুরগী সিগ্ধ হচ্ছে না কেন মা?’

‘তোমার বাবা নিজের বুদ্ধি খরচ করে মুরগী কিনেছে তো, তাই সিদ্ধ হচ্ছে না। এই যন্ত্রণার আজই শেষ–কাল থেকে আমরা হোটেলে খাব।‘

খাওয়ার শেষে কটেজের বারান্দায় বিরস মুখে বসে মশার কামড় খাচ্ছি। স্বাস্থ্যকর স্থানের মশারাও স্বাস্থ্যবান হবে, বলাই বাহুল্য। এরা মনের সুখে কামড়ে যাচ্ছে। আকাশে বিশাল চাঁদ উঠেছে। গতকাল পূর্ণিমা ছিল। আজ পূর্ণিমার দ্বিতীয় দিবস। পূর্ণিমা কোন কাকতালীয় ব্যাপার নয়। কক্সবাজার রওনা হবার আগে পঞ্জিকা দেখে। রওনা হয়েছি। সমুদ্রে চাঁদের আলো দেখার মত ব্যাপার। সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখার জন্যে

আজ তেমন আগ্রহ বোধ করছি না। বাচ্চারা সব ঘুমিয়ে পড়েছে। বাচ্চাদের মা যে। পরিমাণ রেগে আছে তাতে মনে হয় না সে আমার সঙ্গে সমুদ্র দেখতে যাবে।

মোটামুটি শীত পড়েছে। চাঁদরে শরীর ঢেকে আমি বসে আছি। এত সুন্দর জোছনা যে ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে না। একা সমুদ্রের কাছে যেতেও ইচ্ছা করছে না। সৌন্দর্য একা দেখার জিনিস নয়।

রাত একটার দিকে গুলতেকিন শাল গায়ে দিয়ে বাইরে এসে বলল, চল, তোমার সমুদ্র-জোছনা দেখে আসি।

আমি আমার স্ত্রীর এই বাক্যটির জন্যে তার পূর্বের এক হাজার অপরাধ ক্ষমা করে দিলাম।

সমুদ্রের কাছে কিন্তু যাওয়া হল না। কটেজের বাইরে পা দিয়েই এক ধরনের অতিপ্রাকৃত দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম। দৃশ্যটি বর্ণনা করার চেষ্টা করি–

আমাদের কটেজের ডানপাশে অনেকখানি খালি জায়গা। জায়গাটার এক অংশে বেশকিছু বাশ পোঁতা। বাঁশগুলি সুতলি দিয়ে বাঁধা। সেই সব সুতলিতে রঙিন কাগজ, ছেঁড়া কাগজ, কাপড়ের টুকরা সাজানো। বোঝাই যাচ্ছে, যে সাজিয়েছে সে খুব যত্ন করে সাজিয়েছে। কিন্তু সেই সাজানোয় সুন্দরের চেয়ে অসুন্দর অনেক বেশি। তাকালেই মনে এক ধরনের ধাক্কা লাগে।

সাজানোর কাজটি যে করেছে তাকে আমরা এখন দেখলাম। খালি গায়ে রোগা লম্বা একজন মানুষ। তার জ্বলজ্বলে চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে–মানুষটা স্বাভাবিক। নয়। আস্তাকুঁড় থেকে সে রাজ্যের ময়লা নিয়ে এসেছে। ময়লা থেকে বেছে বেছে রঙিন কাগজ নিয়ে সুতলিতে সাজাচ্ছে। কাজটা সে মোটেই হেলাফেলার সঙ্গে করছে না। কয়েকটা রঙিন কাগজের টুকরা বের করে সে প্রথমে তার সামনে রাখে। দীর্ঘ সময় কাগজের টুকরাগুলির দিকে তাকিয়ে থেকে কি যেন ভাবে। তারপর একটা একটা করে কাগজ লাগায়। লাগিয়ে দূর থেকে, কাছে থেকে নানানভাবে সে পরীক্ষা করে।

আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি, পাগলদের খুব ভদ্র ভঙ্গিতে কিছু জিজ্ঞেস করলে তারা জবাব দেয়। ভালভাবেই জবাব দেয়। আমি শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি করছেন?

লোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকাল। আমি আবার বললাম, আপনি কি করছেন?

লোকটি চিটাগাং-এর কথ্য ভাষায় যা বলল তা হল–তুমি কি দেখতে পারছ না। আমি কি করছি?

আমার প্রশ্নটা ছিল বোকার মত। উত্তর শুনে খানিকটা হকচকিয়ে যেতে হল। আমি দ্বিতীয় প্রশ্ন করলাম–সাজাচ্ছেন কেন?

লোকটি সেই প্রশ্নের জবাব দিল না। গভীর মনোযোগে কাগজ বাছতে লাগল। সমুদ্র-জোছনার চেয়ে লোকটির কাণ্ডকারখানা আমার কাছে অনেক আকর্ষণীয় মনে হল। আমি কটেজের বারান্দায় ফিরে গেলাম। গভীর আগ্রহে পাগলের কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগলাম। কটেজের নাইট গার্ড আমাকে বলল–এই পাগল অনেকদিন থেকে কক্সবাজারে আছে। সারাদিন সে রঙিন কাগজ খুঁজে বেড়ায়। রাত বারোটার পর থেকে সাজাতে শুরু করে। সাজানো শেষ হলে কয়েকটা ইট বিছিয়ে আগুন জ্বালায়। সেই আগুনে নিজের খাবার নিজেই রান্না করে খায়। খাওয়া শেষ হবার পর নিজের শিল্পকর্মের সামনে মূর্তির মত বসে থাকে। রাত এই ভাবে কাটিয়ে ভোর হবার আগে আগে আবার বের হয়ে পড়ে রঙিন কাগজের খোঁজে।

নাইটগার্ড যা বলল সবই ঘটতে দেখলাম। যা সে বলেনি বা বলতে ভুলে গেছে তাও দেখলাম। লোকটি যে তার শিল্পকর্ম মুগ্ধ হয়ে দেখে তা না, শিল্পকর্মের সামনে কিছুক্ষণ আত্মভোলা ভঙ্গিতে নাচে।

এই লোকটির অতীত ইতিহাস কি?

কেন সে রঙিন কাগজে ঘর সাজায়? কি ভাবে সে? এই রহস্য কোনদিনও জানা হবে না। জগতের অনেক রহস্যের মত এই রহস্যও ঢাকা থাকবে অনেক দিন।

পাগলদের প্রতি আমার আগ্রহ এবং কৌতূহল সীমাহীন। এদের সবারই আলাদা নিজস্ব লজিক আছে। সেই লজিকের কারণে কাউকে কাউকে দেখা যায় গভীর একনিষ্ঠতায় ট্রাফিক কনট্রোল করছে, আবার কাউকে কাউকে দেখা যায় রঙিন কাগজ জড়ো করে বিচিত্র শিল্পকর্ম তৈরি করছে।

ঢাকা কলেজে যখন পড়ি তখন আমার ক্লাসেরই এক ছাত্রের সঙ্গে আমার। খানিকটা ঘনিষ্ঠতা হয়। চমঙ্কার ছেলে। ভদ্র, বিনয়ী, মেধাবী। দোষের মধ্যে একটিই–বড় বেশি ইংরেজি বলে। আমরা তার নাম দিয়েছিলাম ইংলিশম্যান। ইন্টারমিডিয়েট সে আমার সঙ্গেই পাস করল। স্টার মার্কস পেল। তারপর আর তার সঙ্গে আমার। কোন যোগাযোগ রইল না। দীর্ঘদিন পরের কথা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি করছি। হঠাৎ অবাক হয়ে দেখি, আমার ছাত্রদের মাঝে মাথা নিচু করে ইংলিশম্যান বসে আছে। আমি পড়ানো বন্ধ করে বিস্মিত হয়ে বললাম, তুমি অমুক না?

সে স্নান গলায় বলল, ইয়েস স্যার।

‘ক্লাস শেষ হবার পর তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে।‘

‘জ্বি, আচ্ছা স্যার।‘

ক্লাসের শেষে সে আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। বেচারা লজ্জায় মরে যাচ্ছে। চেয়ারে বসতে বললাম, কিছুতেই বসবে না। খুবই অস্বস্তিকর অবস্থা। তার কাছ থেকে যা জানলাম তা হল–ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর পর তার মাথা খারাপ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলে। শেষ পর্যায়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করানো হয়। এখন সে সুস্থ। আবার পড়াশোনা শুরু করেছে।

আমি তাকে যথেষ্ট উৎসাহ দিলাম। দীর্ঘদিন পার করে আবার পড়াশোনা শুরু করার সৎসাহস তুচ্ছ করার বিষয় নয়। আমি তাকে বললাম, কখনোই আমাকে স্যার ডাকবে না। আগের মত হুমায়ুন করেই ডাকবে।

আমি দূরত্ব দূর করতে চাইলাম, দূর হল না। রাস্তা ঘাটে দেখা হলে অন্য ছাত্রদের মতই বিনীত ভঙ্গিতে সে আমাকে সালাম দেয়। ক্লাসে মাথা নিচু করে বসে থাকে। আমি প্রায়ই আমার রুমে তাকে ডেকে নিয়ে আসি চা খাবার জন্যে। নানান ধরনের গল্প করার চেষ্টা করি। গল্প জমে না। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, পাগল হবার সময়ের কথা কি কিছু মনে আছে?

সে ইতস্তত করে বলল, না।

‘কোন কিছুই মনে নেই?’

সে চুপ করে রইল। আমি বললাম, যদি মনে থাকে আমাকে বল। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে।

সে নিচু গলায় বলল, পাগল হবার আগের সময়টার কথা মনে আছে।

‘বল শুনি।‘

‘আমি আমার পড়ার ঘরে বসেছিলাম। হঠাৎ দেখলাম ঘরটা ছোট হয়ে যাচ্ছে। দেয়ালগুলো আমার কাছে চলে আসছে। তখন ভয় পেয়ে আমি একটা বিকট চিৎকার দেই।‘

‘এর পরের কথা তোমার আর কিছু মনে নেই?’

‘না। শুধু মনে আছে–সারাক্ষণ একটা কুকুরের মুখ দেখতাম। মুখটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকত।‘

‘কি রঙের কুকুর?’

‘ঘিয়া রঙের। কুকুরটার শরীর ছোট কিন্তু মুখটা অনেক বড়। গরুর মুখের মত বড়।‘

‘আর কিছু তোমার মনে নেই?’

‘না।‘

ইংলিশম্যান রসায়ন বিভাগে দুই বছর পড়াশোনা করল। থার্ড ইয়ারে উঠে সে আবার পাগল হয়ে গেল। একদিন ক্লাসে এসে উপস্থিত হল সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায়। ভয়াবহ ব্যাপার! আমি তাকে ডেকে আমার ঘরে নিয়ে গেলাম। আমি বললাম, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ?

সে হেসে বলল, হ্যাঁ, তুমি হুমায়ূন।

আমি একটি এপ্রন এনে তাকে পরতে দিলাম। সে কোন আপত্তি না করেই এপ্রন। পরল। আমি বললাম, তুমি যে কোন কাপড় ছাড়া ডিপার্টমেন্টে এসেছ–এটা কি ঠিক হয়েছে? তোমার বন্ধুরা খুব লজ্জা পাচ্ছে। কেউ কেউ ভয়ও পাচ্ছে। তুমি কি তা বুঝতে পারছ না?

‘পারছি।‘

‘তুমি অসুস্থ।সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ডিপার্টমেন্টে আসার তোমার কোন দরকার নেই। আর যদি আস কাপড় পরে আসবে, কেমন?’

ইংলিশম্যান ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কাপড় পরলে সে রাগ করে।

‘কে রাগ করে?’

‘কুকুরটা রাগ করে।‘

‘কোথায় কুকুর?’

‘এইখানে নাই। রাস্তায় গেলেই আসে।‘

‘কুকুর রাগ করুক আর যাই করুক–তুমি সবসময় কাপড় পরে থাকবে।‘

‘আচ্ছা।‘

ইংলিশম্যানের এক ভাই পড়তো ফার্মেসী বিভাগে। তাকে খবর দিলাম। বেচারা কাঁদতে কাঁদতে বড় ভাইকে বাসায় নিয়ে গেল। সমস্যার শেষ হল না। এটা ছিল সমস্যার শুরু। ইংলিশম্যান দু-তিন দিন পর পরই ডিপার্টমেন্টে আসতে শুরু করল। এসেই সে খোঁজে আমাকে। ব্যাকুল হয়ে ডাকে–হুমায়ূন, হুমায়ুন। আমি একদিন তার ভাইকে ডেকে ধমকে দিলাম। এসব কি! অসুস্থ একটা ছেলেকে আটকে রাখতে হবে। তারা ছেড়ে দিচ্ছে কেন?

আমি তখন বাবর রোডের বাসায় থাকি। এক ছুটির দিন ভোরবেলায় সে আমার বাসায় উপস্থিত। আগের মত অবস্থা। গায়ে কোন কাপড় নেই, শুধু মাথায় একটা রুমাল বাঁধা। কথাবার্তা খুব স্বাভাবিক। আমি বললাম–বাসা চিনলে কিভাবে?

সে হাসল।

আমার বাসা তার চেনার কোনই কারণ নেই। আগে কোনদিন বাসায় নিয়ে আসিনি। ডিপার্টমেন্ট থেকে ঠিকানা জোগাড় করে আসবে, তাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। কেউ তাকে ঠিকানা দেবে না।

আমি তাকে বসার ঘরে এনে বসালাম। নিজের একটা পুরানো প্যান্ট পরিয়ে দিলাম। সে আপত্তি করল না। বরং আগ্রহ করে পরল। চা খেতে দিলাম। চা খেল।

আমি বললাম, ঠিকানা কোথায় পেলে?

ইংলিশম্যান বলল, ঠিকানা লাগে না। আমি আতংকিত বোধ করলাম। সে তো এখন রোজই এখানে আসবে। আমাকে অস্থির করে মারবে।

যা ভাবলাম তাই ঘটল। ইংলিশম্যান কয়েকদিন পরপরই আসে। তবে বিরক্ত করে না। প্রথম দিন সোফার যে জায়গায় বসেছিল রোজ এসে সেই জায়গাটায় বসে। চা দিলে খায়। ঘণ্টা দুই বসে থেকে চলে যায়। আমি তাকে অনেক বুঝালাম–রোজ এভাবে আসা ঠিক না। অনেক সমস্যা হয়। প্রতিবারই সে আন্তরিক ভঙ্গিতে বলে–আর আসব না। কিন্তু আবারো আসে। ইংলিশম্যানের যন্ত্রণায় অবস্থা এমন হল যে আমি বাসা ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবতে লাগলাম। নতুন কোন জায়গায় গিয়ে উঠব যাতে সে আমার খোঁজ না পায়। সেটাও সম্ভব হল না। আমার তখন আর্থিক সামর্থ্য নেই বললেই চলে। কোন রকমে জীবন ধারণ করে আছি। নতুন বাসা ভাড়া নেয়ার অবস্থা। নেই। বাবর রোডের যে বাসায় থাকি তা সরকারী বাসা। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে বরাদ্দ দেয়া। নামমাত্র ভাড়া। আমি মাটি কামড়ে সেখানেই পড়ে রইলাম। ইংলিশম্যান নিয়তির মতো হয়ে গেল। ধরেই নিলাম সে আসবেই। আসেতই থাকবে। হলও তাই।

পাগলদের প্রতি আমাদের সমাজ খুব নিষ্ঠুর আচরণ করে। এই নিষ্ঠুরতা সবচে’ বেশি দেখা যায় শিশুদের বেলায়। যে কোন কারণেই হোক শিশুরা পাগল সহ্য করতে পারে না।–ইংলিশম্যান যতবার আমার এখানে এসেছে ততবারই শিশুদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছে। শিশুরা তাকে তাড়া করে। পাথর ছুঁড়ে। বড়রা তাদের আটকায় না। দূরে দাঁড়িয়ে হাসে। মজা দেখে।

ইংলিশম্যানের উপদ্রব হঠাৎ একদিন বন্ধ হয়ে গেল। চার মাস কেটে গেল, তার দেখা নেই। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। আশংকা পুরোপুরি গেল না। এটা হয়ত সাময়িক বিরতি। আবার আসতে শুরু করবে। জীবন অর্থহীন করে দেবে। সে এল না। দেখতে দেখতে এক বছর কেটে গেল। মানুষ অস্বস্তিকর স্মৃতি মনে রাখে না। আমিও মনে রাখলাম না। ইংলিশম্যানের কথা ভুলে গেলাম।

এক শীতের সকালের কথা। ছুটির দিন। নিউমার্কেটে এসেছি–কাগজ কিনব। হঠাৎ দেখি ইংলিশম্যান। সুন্দর একটা বাদামী রঙের স্যুট পরে দাঁড়িয়ে আছে। স্যুটটায় তাকে খুব মানিয়েছে। তার গায়ের রঙ ফর্সা। সেই রঙ যেন আরো খুলেছে। মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। চোখে চশমা। চশমার ফ্রেমটাও সুন্দর। ইংলিশম্যানের হাতে একটা শপিং ব্যাগ, অনেক কেনাকাটা করেছে বলেও মনে হল।

আমি একবার ভাবলাম দেখা না করে চলে যাই। পরমুহূর্তেই সেই চিন্তা পাথর চাপা দিয়ে এগিয়ে গেলাম। ইংলিশম্যান আমাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এল।

আমি বললাম, কেমন আছ?

সে বলল, ভাল। মাঝখানে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। এখন ভাল।

‘করছ কি এখন?’

‘বিজনেস করি। বড় ভাই একটা বিজনেসের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।‘

‘কিসের বিজনেস?’

‘ডাই বিজনেস। কাপড়ে রঙ দেয়া হয় যে সেই রঙ।‘

‘একদিন আস আমার বাসায়। ইংলিশম্যান বলল, অবশ্যই যাব। তোমার বাসার ঠিকানা দিয়ে যাও। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, তুমি আমার বাসার ঠিকানা জান না?’

‘না। তুমি তো কখনো বাসার ঠিকানা দাওনি।‘

আমি একটা কাগজে বাসার ঠিকানা লিখে দিলাম। ইংলিশম্যান সেই কাগজের টুকরা পকেটে রাখতে রাখতে বলল, আমি অবশ্যই যাব। আমার বউকে নিয়ে যাব।

আমি বিয়ে করেছি ভাই।

‘কবে বিয়ে করলে?’

‘বেশিদিন হয়নি–মাস চারেক। আমার তো পড়াশোনা কিছুই হয়নি–এদিকে লাবনী জেনারেল হিস্ট্রিতে এ বছর এম. এ. পাস করেছে।‘

‘বাহ, ভাল তো।‘

‘দাঁড়াও তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। ও পনীর কিনতে গেছে। ভাই, তোমার কাছে সিগারেট আছে? আমাকে একটা সিগারেট দাও। লাবনীর জন্যে সিগারেট খেতে পারি না।‘

আমার কাছে সিগারেট ছিল না। আমি দু’টি সিগারেট কিনে নিয়ে এলাম। লাবনীর সঙ্গে পরিচয় হল। শ্যামলা রঙের বড় বড় চোখের মিষ্টি একটা মেয়ে। খুব হাসি-খুশি।

ইংলিশম্যান বলল, হুমায়ূন, আমার খুব ভাল বন্ধু। লাবনী বলল, আপনি ভাল বন্ধু, তাহলে আপনি আমাদের বিয়েতে আসেননি কেন?

.

ইংলিশম্যান সম্পর্কে আমার লেখা এখানে শেষ করতে পারলে ভাল হত। তা পারছি না। তার সঙ্গে আমার আবার দেখা হয় প্রায় দশ বছর পর। সম্পূর্ণ নগ্ন গায়ে সে বসেছিল ফুটপাতে। তার গা ঘেঁষে একটা ঘিয়া রঙের কুকুর। কুকুরটার মুখ শরীরের তুলনায় বড়। ইংলিশম্যানকে দেখলাম কুকুরটাকে খুব আদর করছে।

পরম রহস্যময় এই জগতের কোন রহস্যই কি আমরা পুরোপুরি জানি?

উমেশ

উমেশের সঙ্গে আমার পরিচয় নর্থ ডাকোটার ফার্গো সিটিতে। মাদ্রাজের ছেলে। বানরের মত চেহারা। স্বভাব-চরিত্রও বানরের মত–সারাক্ষণ তিড়িং-বিড়িং করছে। গলা খাঁকারি দিয়ে থুথু ফেলছে। হাসেও বিচিত্র ভঙ্গিতে খিকখিক করে, থেমে থেমে শব্দ হয়, সমস্ত শরীর তখন বিশ্রীভাবে দুলতে থাকে।

সে এসেছে জৈব রসায়নে M.s. ডিগ্রী নিতে। আমি তখন পড়াশোনার পাট শেষ করে ফেলেছি। একটা ইলেকট্রিক টাইপ রাইটার কিনেছি, দিন-রাত খটখট শব্দে থিসিস টাইপ করি। একেকটা চ্যাপ্টার লেখা শেষ হয়, আমি আমার প্রফেসরের কাছে নিয়ে যাই। তিনি পড়েন এবং হাসিমুখে বলেন, অতি চমৎকার হয়েছে। তুমি এই। চ্যাপ্টারটা আবার লেখ।

আমি হতাশ হয়ে বলি, অতি চমৎকার হলে নতুন করে লেখার দরকার কি? প্রফেসরের মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হয়। তিনি বলেন, অতি চমৎকার তো শেষ কথা নয়। অতি চমৎকারের পরে আছে অতি, অতি চমৎকার। আমি তার জন্যে অপেক্ষা করছি।

আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আবার লিখতে বসি। এই সময়ে উমেশের আবির্ভাব হল মূর্তিমান উপদ্রবের মত। তার প্রধান কাজ হল ‘আবে ইয়ার’ বলে আমার ঘরে ঢুকে পড়া। এবং আমাকে বিরক্ত করা।

আমেরিকায় সে পড়াশোনা করার জন্যে আসেনি। তার মূল উদ্দেশ্য সিটিজেনশীপ। অন্য কোনভাবে আমেরিকা আসার ভিসা পাওয়া যাচ্ছিল না বলেই সে স্টুডেন্ট ভিসায় এসেছে। এখন তার দরকার–‘সবুজপত্র’ বা গ্রীনকার্ড। ঐ বস্তু কি করে পাওয়া যায় সেই পরামর্শ করতেই সে আমার কাছে আসে।

আমি প্রথম দিনেই তাকে বলে দিলাম, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। জানার আগ্রহও বোধ করিনি। আমি এসেছি পড়াশোনা করতে। ঐ পর্ব শেষ হয়েছে, এখন দেশে চলে যাব। উমেশ চোখ-মুখ কুঁচকে ‘আবে বুরবাক . . . ‘ শব্দ দুটি দিয়ে একগাদা কথা বলল, যার কিছুই আমি বুঝলাম না। হিন্দী আমি বুঝতে পারি না। তাছাড়া উমেশ কথা বলে দ্রুত। তবে তার মূল বক্তব্য ধরতে অসুবিধা হল না। মূল বক্তব্য হচ্ছে–হুমায়ূন, তুমি মহা বুরবাক। এমন সোনার দেশ ছেড়ে কেউ যায়?

কাজের সময় কেউ বিরক্ত করলে আমার অসহ্য বোধ হয়। এই কথা আমি উমেশকে বুঝিয়ে বললাম। সে বিস্মিত হয়ে বলল, আমি তো বিরক্ত করছি না। চুপচাপ বসে আছি। তুমি তোমার কাজ কর।

সে চুপচাপ মোটেও বসে থাকে না। সারাক্ষণ তিড়িং-বিড়িং করে। এই বসে আছে, এই লাফ দিয়ে উঠছে। তাছাড়া তার শিস দিয়ে গান গাওয়ার শখও আছে। সে শিস দিয়ে নানান ধরনের সুর তৈরির চেষ্টা করে। সেই সুরের তালে পা নিজেই মুগ্ধ। হয়ে নাচায়।

সব মানুষের জীবনেই কিছু উপগ্রহ জুটে যায়। উমেশ হল আমার উপগ্রহ। সে . জৈব রসায়নের তিনটা কোর্স নিয়েছে। এর মধ্যে একটা ল্যাব কোর্স। কাজ করে আমার ঘরের ঠিক সামনের ঘরে। কাজ বলতে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করা, বোয়াধুয়ি … করা, তারপর আমার সামনে এসে বসে থাকা। পা নাচানো এবং শিস দেয়া। আমি তাকে বললাম, কোর্স যখন নিয়েছ মন দিয়ে কোর্সগুলি করা দরকার। তুমি তো সারাক্ষণ আমার সামনে বসেই থাক।

সে হাসিমুখে বলল, M.s. ডিগ্রীর আমার কোন শখ নেই। আমার দরকার। সিটিজেনশীপ। স্টুডেন্ট ভিসা যাতে বজায় থাকে এই জন্যেই কোর্স নিলাম। পড়াশোনা করে হবেটা কি ছাতা?

আমি বললাম, অনেক কিছুই হবে। একটা আমেরিকান ডিগ্রী পেলে এ দেশে চাকরি পেতে তোমার সুবিধা হবে। চাকরি পেলে গ্রীনকার্ড পাবে।

‘আবে ইয়ার–সাচ বাত।‘

উমেশকে এই উপদেশ দেয়ার মূল কারণ অন্য। আমি চাচ্ছিলাম তাকে পড়াশোনায় ব্যস্ত করে তুলতে, যাতে সে আমাকে মুক্তি দেয়। সিন্দাবাদের ভূতের মত সে কেন আমার উপর ভর করল কে জানে! এমন না যে, এই নর্থ ডাকোটায় আমিই একমাত্র কাল চামড়া। কাল চামড়া প্রচুর আছে। ভারতীয় ছাত্রই আছে দশ-বার জন। অনেকে পরিবার নিয়ে আছে। নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটির ইন্ডিয়ান স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন বেশ বড় এসোসিয়েশন। তারা প্রতিমাসেই টিকিট কেটে হিন্দী ছবি দেখানোর ব্যবস্থা করে। দোল উৎসব হয়। এর বাড়ি, ওর বাড়ি পার্টি লেগে থাকে। উমেশ ওদের সঙ্গে থাকতে পারে। তা কেন সে থাকছে না? কেন চেপে আছে আমার কাঁধে?

যে কোন কারণেই হোক তার ধারণা হয়েছে, এই বিদেশে আমিই তার সবচে’ নিকটজন। কাজেই আমার সময় নষ্ট করার পূর্ণ অধিকার তার আছে। একদিন না

পেরে তাকে কফিশপে নিয়ে কফি খাওয়ালাম এবং শীতল গলায় বললাম, উমেশ, একটা কথা শুনলে তোমার হয়ত খারাপ লাগবে, তবু কথাটা তোমাকে বলা দরকার।

‘বল।‘

‘আমি তোমাকে খুবই অপছন্দ করি।‘

উমেশ বলল, কেন, আমার চেহারা খারাপ বলে?

আমি কি বলব বুঝতে পারলাম না। উমেশ বলল, আমার চেহারা খুব খারাপ তা আমি জানি। স্কুলে আমার নাম ছিল ‘ছোটে হনুমান। কিন্তু চেহারা তো বন্ধুত্বের অন্তরায় হতে পারে না। ভুল বলেছি?

‘না, ভুল বলনি।‘

‘আমি তোমাকে খুব বিরক্ত করি তা আমি জানি। কি করব বল, আমার ভাল লাগে না। ল্যাবে কাজ করতে ভাল লাগে না। পড়াশোনা করতে ভাল লাগে না।‘

‘আমার সামনে বসে শিস দিয়ে গান গাইতে ভাল লাগে?’

‘হুঁ।‘

‘শোন উমেশ। আমি একা একা কাজ করতে পছন্দ করি। তুমি যে আমার সামনে বসে থাক, এতে আমার কাজ করতে অসুবিধা হয়।

‘ও আচ্ছা।‘

‘আমাকে থিসিস লেখার কাজটা দ্রুত শেষ করতে হবে।‘

‘আচ্ছা।‘

‘তুমি যদি আর আমাকে বিরক্ত না কর তাহলে ভাল হয়।‘

উমেশ কফির মগ হাত দিয়ে সরিয়ে উঠে চলে গেল। একবার ফিরেও তাকালো না। আমার খানিকটা খারাপ লাগলেও মুক্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আসলেই মুক্তি পেয়েছি কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না।

মুক্তি পেলাম। উমেশ আর আমার ঘরে আসে না। তার সঙ্গে দেখা হলে সে চোখ ফিরিয়ে নেয়। আমার সামনের ল্যাবে সে রোজই আসে। একা একা কাজ করে। করিডোরে দাঁড়িয়ে উদাস মুখে সিগারেট খায়। আমার সাড়া পেলে চট করে ল্যাবে ঢুকে যায়। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এতটা কঠিন না হলেও পারতাম।

মাসখানিক পরের কথা। নিজের ঘরে বসে কাজ করছি। হঠাৎ ফায়ার অ্যালার্ম বেজে উঠল। আমি বিচলিত হলাম না। এখানে কিছুদিন পরপর ফায়ার ড্রিল হয়। অ্যালার্ম বেজে উঠে। তখন ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে মাঠে দাঁড়াতে হয়। ফায়ার মার্শাল আসেন–পরীক্ষা করে দেখেন জরুরি অবস্থায় সব ঠিকঠাক থাকবে কি না। আজও নিশ্চয়ই তেমন কিছু হচ্ছে। আমি বিরক্ত মুখে ঘর থেকে বের হলাম। অকারণে খোলামাঠে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। প্রচণ্ড শীতে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা কোন সুখকর অভিজ্ঞতা নয়।

করিডোরে এসে আমাকে থমকে দাঁড়াতে হল। কারণ আজকেরটা ফায়ার ড্রিল নয়। পালে বাঘ পড়েছে। এবার সত্যি সত্যি আগুন লেগেছে। ধোয়ার কুণ্ডলি বের হচ্ছে উমেশের ল্যাব থেকে। সাদা ও কালো ধোয়ার জটিল মিশ্রণে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উমেশ।

আমি আতংকে জমে গেলাম। ল্যাবে আগুন মানেই ভয়াবহ ব্যাপার। প্রচুর দাহ্যবস্তুতে ল্যাব থাকে ভর্তি। বোতলে ভরা থাকে ফসফরাস। জার ভর্তি তীব্র গাঢ়ত্বের এসিড। আছে নানান ধরনের অক্সিডাইজার। এরা মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে দেবে। ল্যাব অগ্নিকাণ্ড সব সময়ই ভয়াবহ হয়। প্রায়ই দেখা যায় এইসব ক্ষেত্রে শুধু ল্যাব নয়, পুরো বিল্ডিং উড়ে যায়।

আমি লক্ষ করলাম, আমেরিকান ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকরা ছুটে বের হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে তীব্র আতংক। বিল্ডিং-এর বৈদ্যুতিক দরজা আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমার নিজেরও ইচ্ছা হল ছুটে বের হয়ে যাই। কিন্তু ল্যাবে উমেশ একা। সে। গরুর মত বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চিৎকার করে বললাম, দেখছ কি, বের হয়ে আস।

উমেশ বিড়বিড় করে বলল, নড়তে পারছি না।

উমেশের কি হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম। তীব্র আতংকে রিগরাস মর্টিসের মত হয়। শরীরের সমস্ত মাংসপেশী শক্ত হয়ে যায়। মানুষের নড়াচড়ার ক্ষমতা থাকে না।

আমি চিরকালের ভীতু মানুষ। কিন্তু সেদিন অসীম সাহসের কিংবা অসীম বোকামির পরিচয় দিয়ে ল্যাবে ঢুকে পড়লাম। প্রথম চেষ্টা করলাম উমেশকে টেনে বের করতে। পারলাম না–তার শরীর পাথরের মত ভারি। উমেশ বলল, তুমি থেকো না। তুমি বের হও। এক্ষুনি এক্সপ্লোশন হবে।

প্রাণী হিসেবে মানুষের অবস্থান আসলেই অনেক উপরে। আমি এই অসহায় ছেলেটিকে একা ফেলে রেখে বের হতে পারলাম না। আমার বুকের ভেতর থেকে কেউ একজন বলল, না, তা তুমি পার না। অথচ বাসায় আমার স্ত্রী আছে। ছোট ছোট দুটি মেয়ে–নোভা, শীলা। ছোট মেয়েটি সবে কথা শিখেছে। তাদের কথা মনে পড়ল না। প্রচণ্ড বিপদে আল্লাহকে ডাকতে হয়। সুরা পড়তে হয়। আমার কোন সুরা মনে পড়ছে না।

বিল্ডিং-এর ইলেকট্রিক লাইন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পুরো বিল্ডিং অন্ধকার। আগুনের হলকায় অস্পষ্টভাবে সবকিছু চোখে আসছে। আমি চলে গিয়েছি এক ধরনের ঘোরের মধ্যে।. হুস করে বড় একটা আগুন ধরল। তার আলোয় চোখে পড়ল, দেয়ালে বিরাট একটা কেমিক্যাল ফায়ার এক্সটিংগুইসার। সাধারণত ল্যাবের আগুনে এদের ব্যবহার করতে হয়। কিভাবে এদের ব্যবহার করতে হয় তাও জানি না। গায়ে বড় বড় অক্ষরে নির্দেশনামা আছে। চেষ্টা করা যাক। আমি ছুটে গেলাম ফায়ার এক্সটিংগুইসারের দিকে। নির্দেশ নাম্বার ওয়ান–বড় লিভারটি টেনে নিচে নামাও। কোনটি বড় লিভার? দুটিই তো এক রকম লাগছে। নির্দেশ নাম্বার দুই–ছোট লিভারটির কাউন্টার ক্লক ঘুরাও। কাউন্টার ক্লক মানে কি? ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিক? ঘড়ির কাঁটা কোনদিকে ঘুরে?

আশ্চর্যের ব্যাপার, ফায়ার এক্সটিংগুইসার চালু করতে পারলাম। এই অদ্ভুত যন্ত্রটি মুহূর্তের মধ্যে পুরো ল্যাব সূক্ষ সাদা ফেনায় ঢেকে দিল। আমরা ডুবে গেলাম ফেনার ভেতর। আগুন নিভে গেল। তারো মিনিট দশেক পর ফায়ার সার্ভিসের মুখোশ পরা লোকজন আমাদের দুজনকে উদ্ধার করল। উমেশকে নিয়ে গেল হাসপাতালে। তার কথাও বন্ধ হয়ে গেছে। কথা বলতে পারছে না। জিহ্বাও শক্ত হয়ে গেছে।

.

উমেশকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছি। আমি ভেবেছিলাম, সে আমাকে দেখে আনন্দিত হবে। তা হল না। মুখ কালো করে বলল, তুমি কেন এসেছ? তুমি তো আমাকে দেখতে পার না। আমি শুধু তোমাকে বিরক্ত করি। তুমি চলে যাও।

আমি হাসলাম।

উমেশ হাসল না। চোখ বন্ধ করে পাশ ফিরল। সে আসলেই আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না।

সে যে আমার ব্যবহারে কি রকম আহত হয়েছিল তা বুঝলাম যখন দেখলাম–তাকে আগুন থেকে উদ্ধারের মত ঘটনাতেও সে অভিভূত হয়নি। আমাকে দেখলে। আগের মতই চোখ ফিরিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে যায়। সে নর্থ ডাকোটা থেকে চলে গেল মুরহেড স্টেটে। যাবার আগের দিন আমাকে একটা খামবন্ধ চিঠি দেয়া হল। চিঠিটি তার লেখা না। তার বাবার লেখা। ভদ্রলোক লিখেছেন—

জনাব,
আপনি আমার মা-হারা পুত্রের জীবন রক্ষা করেছেন। এর প্রতিদান আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। ঈশ্বর আপনাকে তার প্রতিদান দেবেন। ঈশ্বর কোন সৎকর্ম অবহেলা করেন না। উমেশ লিখেছে, আপনি তার জন্যে আপনার জীবন বিপন্ন করেছেন। আপনার থিসিসের কাগজপত্র আগুনে নষ্ট হয়েছে। আপনাকে আবার নতুন করে লিখতে হয়েছে। আমি নিজে একজন পাপী মানুষ। পাপী মানুষের প্রার্থনায় ফল হয় না, তবু আমি প্রতিদিন ঈশ্বরের। কাছে আপনার জন্যে প্রার্থনা করি। যতদিন বাঁচব, করব। আপনি আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম গ্রহণ করুন।

.

আমেরিকার পর্ব শেষ করে দেশে ফিরছি। হেক্টর এয়ারপোর্টে অনেকেই আমাকে বিদায় দিতে এসেছে। হঠাৎ দেখি দূরে উমেশ দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই সে চোখ নামিয়ে নিল। দ্রুত চলে গেল ভেন্ডিং মেশিনের আড়ালে। আমি এগিয়ে গেলাম।

উমেশ বলল, আমি তো তোমাকে বিদায় দিতে আসিনি। আমি যাব লস এঞ্জেলস। তার টিকিট কাটতে এসেছি।

‘ঠিক আছে। যাবার আগে তোমার সঙ্গে দেখা হল। খুব ভাল লাগছে। একদিন তোমার মনে কষ্ট দিয়েছি। তার জন্যে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। প্লেনে ওঠার আগে তোমার হাসিমুখ দেখে যেতে চাই।‘

উমেশ বলল, আমি তোমাকে মিথ্যা কথা বলেছি। আমি আসলে তোমাকে বিদায় দিতেই এসেছি।

উমেশ আমাকে জড়িয়ে ধরল। সে ভেউ ভেউ করে কাঁদছে। প্লেনে ওঠার আগে সিকিউরিটি চেকিং-এ যাচ্ছি। বন্ধু বান্ধবরা হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে। রুমাল উড়াচ্ছে। শুধু উমেশ দু’হাতে তার মুখ ঢেকে আছে। সে তার কান্নায় বিকৃত মুখ কাউকে দেখাতে চাচ্ছে না।

উৎসব

ঈদের আগের দিন বিকেলে আমাদের বাসায় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো। বেশ বড় রকমের দুর্ঘটনা। আমার মেয়ের ঈদের জামাটা তার এক বান্ধবী দেখে ফেলো। দেখার কোন সম্ভাবনা ছিলো না। বাক্সে তালাবন্ধ করে একটা কাগজের প্যাকেটে মুড়ে রাখা হয়েছিলো। কপাল খারাপ থাকলে যা হয়–বোতাম লাগাবার জন্যে জামা বের করা হয়েছে ওমনি বান্ধবী এসে হাজির। আমার মেয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করেও তার জামা। লুকাতে পারলো না। সে আকাশ ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলো–জামা পুরানো হয়ে গেছে। জামা পুরানো হয়ে গেছে।

সবকিছুই পুরানো করা চলে। ঈদের জামা জুতো তো পুরানো করা চলে না। জুতোর প্যাকেটটি বুকের কাছে নিয়ে রাতে ঘুমুতে হয়। জামাটা খুব কম করে হলেও পঁচবার ইস্ত্রি করতে হয়। এবং দিনের মধ্যে অন্তত তিনবার বাক্স খুলে দেখতে হয় সব ঠিক আছে কি না। কিন্তু অন্য কেউ দেখে ফেললেই সর্বনাশ। ঈদের আনন্দের পনেরো আনাই মাটি।

বান্ধবী জামা দেখে ফেলেছে এই দুঃখে আমার মেয়ে যখন কঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলো, তখন বললাম, চল যাই আরেকটা কিনে দেব। রাত দশটায় তাকে নিয়ে জামা কিনতে বেরুলাম। চারদিকে কি আনন্দ! কি উল্লাস! শিশুদের হাতে বেলুন। মায়েদের মুখভর্তি হাসি। হাতে কেনাকাটার ফর্দ। বাবারা সিগারেট ধরিয়ে। গম্ভীর ভঙ্গিতে হাঁটছেন।

আগে যেসব ছোট ছোট শিশু শুকনো মুখে পলিথিনের ব্যাগ বিক্রি করতো, তারা আজ খুব হাসছে। খুব বিক্রি হচ্ছে ব্যাগ। এক ভদ্রলোককে দেখলাম তিনটি ব্যাগ কিনলেন। তিন টাকা দাম। তিনি একটা কচকচে পঁচ টাকার নোট দিয়ে বললেন, যা দুটাকা তোর বকশিশ। ছোট বাচ্চাটি পাঁচ টাকার নোটটি নিশানের মত এক হাতে উঁচু করে ধরে ছুটে চলে গেলো।

আমার মনে হলো আজ রাতে কোথাও কোন দুঃখ নেই। আজ কোন স্বামী-স্ত্রীর ভেতর ঝগড়া হবে না। প্রেমিকারা আজ সুন্দর সুন্দর চিঠি লিখবে ভুলে-যাওয়া। প্রেমিকদের। একজন ভিখিরিও হয়ত তার বহুদিনের শখ মেটানোর জন্যে দেড় টাকা খরচ করে একটা ৫৫৫ সিগারেট কিনে ফেলবে। উড়ির চরে আজ রাতে কোন বৃষ্টি হবে না। শিশুদের আনন্দ আমাদের সব দুঃখ ঢেকে ফেলবে।

বাস্তব অবশ্যই অন্যরকম। অনেক বাড়িতে অন্য সব রাতের মত আজ রাতেও হাঁড়ি চড়বে না। উপোসী ছেলেমেয়েরা মুখ কালো করে ঘুরঘুর করবে। যাদের বাড়িতে হাঁড়ি চড়বে, তাদের দুঃখও কি কম? হয়তো কারোর একটি ছোট ছেলে ছিল, আজ সে নেই। সে তার বাবা মা’র কাছে নতুন শার্ট-প্যান্টের বায়না ধরেনি। ঘুমুতে যাবার সময় মাকে জড়িয়ে ধরে বলেনি, আম্মা, খুব ভোরে ডেকে দিও। আজ রাত ঐ পরিবারটির বড় দুঃখের রাত! বাবা-মা আজ রাতে তাদের আদরের খোকনের ছবি বের করবেন। শূন্য ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখবেন। এখনো খোকনের ছোট্ট জুতো জোড়া সাজানো, তার ছোট্ট শার্ট, ছোট্ট প্যান্ট আলনায় ঝুলছে। শুধু সে নেই। আগামীকাল ভোরে হৈ-হৈ করে সে ঘর থেকে বেরুবে না।

ঈদের নামাজ পড়লাম নিউ মার্কেটের মসজিদে। ফিরবার পথে দেখি আজিমপুর কবরস্থানের গেট খুলে দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ সেখানে। একজন বাবা তার তিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে কবরস্থানে এসেছেন। ছেলেমেয়েদের গায়ে ঝলমলে পোশাক। ওরা একটি কবরের পাশে গোল হয়ে পঁড়িয়ে আছে। কবরটির উপরে একটি ময়লা কাগজ পড়ে ছিলো। বড় মেয়েটি সে কাগজটি তুলে ফেলে গভীর মমতায় কবরের গায়ে হাত রাখলো। বাবাকে দেখলাম রুমাল বের করে চোখ মুছছেন। এটি কার কবর? বাচ্চাগুলির মার? আজকের এই আনন্দের দিনে এই মা ফিনি রান্না করেননি। গভীর মমতায় শিশুদের নতুন জামা পরিয়ে দেননি। নতুন শাড়ি পরে তিনি আজ আর লজ্জিত ভঙ্গিতে স্বামীর পাশে এসে দাঁড়ায়ে বলেননি–কি, তোমাকেও সালাম করতে হবে নাকি?

আসলে আমাদের সবচে’ দুঃখের দিনগুলিই হচ্ছে উৎসবের দিন।*

———-

* এই লেখাটা ঈদের লেখা হিসেবে দৈনিক বাংলায় ছাপা হয়। তার কিছুদিন পর আমার ছোট ছেলেটি মারা যায়। আমি অবিকল এই রচনাটির মত আমার তিনটি বাচ্চা এবং স্ত্রীকে নিয়ে ঈদের দিন আমার বাচ্চাটির কবর দেখতে যাই। আমার বাচ্চারা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে থাকে…

কবি সাহেব

ভোরবেলা ঘুম ভেঙেই যদি শুনি–কেউ একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, চুপচাপ বসার ঘরে বসে আছে, তখন সঙ্গত কারণেই মেজাজ খারাপ হয়। ভোরবেলাটা মানুষের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করার জন্যে আদর্শ সময় না। ভোরবেলার নিজস্ব চরিত্র আছে, আছে কিছু আলাদা নীতিমালা। ভোরবেলার নীতিমালা হলো, ঘুম থেকে উঠে নিজের মতো থাকবে, কোনোরকম টেনশন রাখবে না। হাত-পা ছড়িয়ে চা খাবে। খবরের কাগজ পড়বে। মেজাজ ভালো থাকলে গান শোনা যেতে পারে। মেজাজ খারাপ থাকলে গান শোনারও দরকার নেই। ভোরবেলায় যা করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ তা হচ্ছে–অপরিচিত কারও সঙ্গে কথা বলা। এই সময়ে কথা বলতে হবে শুধু পরিচিত এবং প্রিয়জনদের সঙ্গে।

আমার কপাল মন্দ। যারা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন তারা ভোরবেলায় আসেন। যারা আসেন তারা সহজে যেতে চান না। ইশারা-ইঙ্গিতে অনেকভাবে তাঁদের বুঝানোর চেষ্টা করি দয়া করে এখন উঠুন। আমার ইশারা-ইঙ্গিত হয় তারা বুঝেন না, নয় বুঝেও না বোঝার ভান করে।

আজ যিনি এসেছেন তাঁকেও আমি বিদেয়-হতে-না-চাওয়া লোকদের দলে ফেললাম এবং মোটামুটি হতাশ হয়েই তার সামনে বসলাম। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের উপর। হালকা পাতলা গড়নের ছোটখাটো মানুষ। গায়ের রঙ ধবধবে সাদা। গায়ের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে মাথার চুলও সাদা। কোলের উপর কালো চামড়ার হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। তাঁকে দেখেই মনে হচ্ছে, কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকতেই তিনি অভ্যস্ত। আমি বললাম, আপনি কি কোনো কাজে এসেছেন?

তিনি মৃদু গলায় বললেন, না।

আমি আঁতকে উঠলাম। যারা সরাসরি বলেন, কোনো কাজে আসেন নি, তাঁরা সাধারণত অত্যন্ত বিপদজনক হয়ে থাকেন। দুপুরের আগে তাদের বিদেয় করা যায় না।

আমি বললাম, কী জন্যে এসেছেন আমি কি জানতে পারি?

জি পারেন।

দয়া করে বলুন।

আমি মফস্বলে থাকি। শহরের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কম। বড় শহর আমার ভালো লাগে না।

আমি ভদ্রলোকের কথার ধরন ঠিক বুঝতে পারছি না। শহর প্রসঙ্গে তার বিতৃষ্ণা আমাকে শোনানোর কারণও আমার কাছে ঠিক স্পষ্ট হলো না। আমি মনের বিরক্তি চেপে সিগারেট ধরালাম।

শহর পছন্দ করি না, তবু নানা কাজকর্মে শহরে আসতে হয়।

তা হয়। পছন্দ না করলেও এই জীবনে আমরা অনেক কিছু সহ্য করি। আপনি কি চা খাবেন?

জি-না। আমার সামান্য কিছু কথা আছে। কথাগুলো বলে আমি চলে যাব।

আমি আশান্বিত হয়ে বললাম, বলুন। কথা বলে যদি উনি চলে যান তাহলে কথাগুলো শুনে নেওয়াই ভালো। সামান্য কথা বলছেন, তা-ও আশার ব্যাপার, হয়ত, ঘণ্টাখানিকের মধ্যে উদ্ধার পাওয়া যাবে।

আমার বড়কন্যা-বিষয়ে একটি গল্প শোনাব।

শোনান।

আমি অনেক রাত জেগে পড়াশোনা এবং লেখালেখি করি–একরাতে লেখালেখি করছি হঠাৎ শুনি আমার কন্যা খিলখিল করে হাসছে। কিছুক্ষণ থামে, আবার হাসে। আবার থামে, আবার হাসে। আমি বিরক্ত হলাম। তাকে বললাম, হাসছ কেন মা? সে বলল, গল্পের বই পড়ে হাসছি বাবা। আমি বললাম, হাসির গল্প? সে বলল, না দুঃখের গল্প। কিন্তু মাঝে মাঝে হাসির কথা। আমি বললাম, নিয়ে আস। আমার মেয়ে নিয়ে এল। আমি সেই বই পড়লাম। আপনার লেখা বই। আমি আগে কখনো আপনার নাম শুনি নি। এই প্রথম শুনলাম।

এইটা কি আপনার গল্প।

জি।

আপনার গল্প শুনে খুশি হয়েছি। আপনি যে আমার একটি বই পড়েছেন সেটা জেনেও ভালো লাগল।

আমার কথা একটু বাকি আছে।

জি বলুন।

ভদ্রলোক নিচু গলায় বললেন, আমি নিজে একটি গল্পগ্রন্থ রচনা করেছি। সেই গ্রন্থটি নিয়ে এসেছি।

এতক্ষণ ভদ্রলোকের আগমনের কারণ আমার কাছে স্পষ্ট হলো। তিনি একজন গ্রন্থকার। গ্রন্থ প্রকাশে আমার সাহায্যের জন্যে এসেছেন। আমার মন খারাপ হলো এই ভেবে যে আমি ভদ্রলোককে কোনোভাবেই সাহায্য করতে পারব না। তার লেখা যত ভালোই হোক প্রকাশকরা ছাপবেন না। পরিচিতিহীন মফস্বলের লেখকদের প্রতি ঢাকার প্রকাশকদের কোনোই আগ্রহ নেই। আমি বললাম, আপনি কি বইটি প্রকাশের ব্যাপারে আমার সাহায্য চান?

জি-না। বইটি প্রকাশিত হয়েছে।

ভদ্রলোক অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বইটি আমার হাতে দিলেন। আমি বইয়ের পাতা উল্টে চমকে উঠলাম। দুটি কারণে চমকালাম প্রথম কারণ, বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে আমার নামে। উৎসর্গপত্রে এমন কথা লেখা হয়েছে–আমি যার যোগ্য নই। দ্বিতীয় কারণ হলো, এই নিরহংকারী চুপচাপ ধরনের মানুষটি একজন বিখ্যাত মানুষ। এতক্ষণ আমি তাকে চিনতে পারি নি। ইনি দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা। গবেষক, কবি ও প্রাবন্ধিক। বাংলা একাডেমী তার একটি জীবনী গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। লিপির উপর লেখা তাঁর গ্রন্থ ব্রাহমী অথবা ব্রাহ্মী লিপি ও সম্রাট প্রিয়দর্শী পশ্চিম বাংলার বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য।

লিপিতত্ত্বে এদেশে এবং ভারতে তার চেয়ে বেশি কেউ এ সময়ে জানেন বলে আমার জানা নেই।

আমি একই সঙ্গে মুগ্ধ, বিস্মিত এবং লজ্জিত হলাম। এই সরল সাদাসিধা মানুষটিকে এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছি–এ কী কাণ্ড! এতবড় ভুল মানুষ করে? গোলাম মোর্তাজা সাহেব উঠে দাঁড়ালেন এবং হাসিমুখে বলেন, আপনি কি একবার আমাদের হবিগঞ্জে যাবেন? আমার বাড়িতে একরাত থাকবেন?

আমি বললাম, অবশ্যই থাকব।

কথা দিচ্ছেন?

হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি।

আমার মেয়েরা খুব খুশি হবে। এরা যে আপনাকে কত পছন্দ করে আপনি তা কখনো জানবেন না। আমি আমার মেয়েদের জন্যে কিছু করতে পারি নি। আপনাকে নিয়ে গেলে ওদের জন্যে কিছু করা হবে।

আপনি যখন আমাকে যেতে বলবেন, আমি তখনি যাব।

আমি আপনাকে জানাব।

তিনি আমাকে কিছু জানাতে পারলেন না। হবিগঞ্জ ফিরেই অসুখে পড়লেন–প্রাণঘাতী ব্যাধি-ক্যানসার। চিকিৎসার জন্যে গেলেন জার্মানি। পত্রিকা মারফত তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেলাম। মনটা খারাপ হলো। কথা দিয়েছিলাম, কথা রাখা গেল না।

তার প্রায় বছরখানিক পরের কথা–দেওয়ান গোলাম মোতার্জার পরিবারের পক্ষ থেকে আমাকে জানানো হলো–দেওয়ান গোলাম মোর্তাজার নামে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। ট্রাস্টি বোর্ডের পক্ষ থেকে মোর্তাজা সাহেবের স্ত্রী আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন মোর্তাজা সাহেবের মৃত্যুদিবস উদ্যাপনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। কথা রাখার সুযোগ পাওয়া গেল। আমি তিন কন্যা নিয়ে হবিগঞ্জে উপস্থিত হলাম।

হবিগঞ্জে পৌঁছে মোর্তাজা সাহেবের পরিবারের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেলাম তার সঙ্গে আমার তেমন পরিচয় নেই। এরা আমার মতো অভাজনের জন্যে ভালোবাসার সোনার আসন বানিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। আমি একেবারেই হকচকিয়ে গেলাম।

মোর্তাজা সাহেব সেখানে কবি সাহেব নামে পরিচিত। তাঁর বাড়ি হলো-কবি সাহেবের বাড়ি। তার মেয়েদের পরিচয় হলো–কবি সাহেবের মেয়ে।

কবি-পত্নীর নাম আম্বিয়া খাতুন। অসম্ভব রূপবতী, কঠিন ধরনের মহিলা। থাকেন কানাডায়। স্বামীর মৃত্যুদিবস অনুষ্ঠান উপলক্ষে দেশে এসেছেন। স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন। লেখক-স্বামীকে পারিবারিক সব দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত রাখতে গিয়ে নিজের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে এখন ক্লান্ত এবং স্বামীর প্রতি কিছুটা হয়তো অভিমানী।

কবি-পত্নী তার সব কন্যাকে স্কুলের ছাত্রদের মতো লাইন করে দাঁড় করালেন। আমাকে দেখিয়ে কঠিন গলায় বললেন, ইনি তোমাদের বাবার বন্ধু। ইনি তোমাদের চাচা। চাচাকে পা ছুঁয়ে সালাম করো।

বড় বড় মেয়ে, সবাই বিবাহিতা। তাদের ছেলেমেয়েরাও বড় বড়। মার কথা শোনামাত্র আমাকে হতচকিত করে এরা একসঙ্গে আমাকে সালাম করবার জন্যে ছুটে এল। একজনকে দেখলাম কাঁদছে।

আমি বললাম, আপনি কাঁদছেন কেন?

সে জবাব দিল না। তাঁর এক বোন বলল, ও তো আপনার কথা শুনতে পাচ্ছে না। ও কানে শুনতে পায় না। বাচ্চা হওয়ার কী এক জটিলতায় ওর কান নষ্ট হয়ে গেছে। ওকে কোনো প্রশ্ন করলে কাগজে লিখে করতে হবে।

আমার মনটাই খারাপ হলো। আমি এক টুকরা কাগজ নিয়ে লিখলাম–আপনি এত কাঁদছেন কেন?

মেয়েটি তার উত্তরে বলল, চাচা, আপনি অবিকল আমার বাবার মতো। নিরহংকারী সাদাসিধা। আপনাকে দেখে বাবার কথা মনে পড়ছে–এইজন্যে আমি কাঁদছি।

আমি সারাজীবন শুনে এসেছি, আমি অহংকারী। এই প্রথম একটি মেয়ে আমাকে বলল, নিরহংকারী। আমার চোখ প্রায় ভিজে উঠার উপক্রম হলো।

কবি-কন্যা বলল, চাচা, আসুন, আমার বাবার লাইব্রেরিটা আপনাকে দেখাই। আমরা বাবার লাইব্রেরিতে যাই না। আজ আপনার সঙ্গে যাব। আর শুনুন, আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন।

আচ্ছা তুমি করেই বলব, তোমরা বাবার লাইব্রেরিতে যাও না কেন?

মা এক কাণ্ড করে রেখেছেন, এইজন্যে যেতে ইচ্ছা করে না।

কী কাণ্ড?

যে কফিনে করে বাবার লাশ জার্মানি থেকে এসেছিল মা সেই কফিনটা লাইব্রেরিতে সাজিয়ে রেখে দিয়েছেন।

সে কী?

হ্যাঁ, কী ভয়াবহ ব্যাপার দেখুন না। আপনি মাকে একটু বলবেন কফিনটা যেন সরানো হয়। মা আপনার কথা ফেলতে পারবেন না।

কবি-পত্নী আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, তোমার বাবার কফিন সরানো হবে না। এটা তোমার বাবার শেষ স্মৃতিচিহ্ন। তোমাদের ভালো লাগুক না লাগুক-কফিন থাকবে লাইব্রেরিতে।

লাইব্রেরি দেখলাম। বিস্মিত হওয়ার মতোই লাইব্রেরি। সবই মূলত লিপি বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থ। দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি। কবি-পত্নী জানালেন, দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপির কিছু কিছু ঢাকা মিউজিয়ামে দেওয়া হয়েছে।

লাইব্রেরিতে বসেই গল্পগুজব হতে লাগল। বড় কেতলী করে চা চলে এসেছে। বাটা ভর্তি পান। যার ইচ্ছা চা খাচ্ছে, যার ইচ্ছা পান খাচ্ছ। একদল আবার খেতেও বসেছে। বাড়ির পাশেই শামিয়ানা খাটানো। খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে শামিয়ানার নিচে। এত লোক কোত্থেকে এল সে-ও এক রহস্য।

গল্প করছেন কবি-পত্নী। আমরা শ্রোতা, ভদ্রমহিলার গল্প বলার ভঙ্গি খুব সুন্দর, মাথা দুলিয়ে হাত-পা নেড়ে গল্প করেন। অত্যন্ত আবেগময় অংশগুলি আবেগশূন্যভাবে বলে যান। শুনতে কেমন কেমন জানি লাগে।

কবি সাহেবের কথা আপনাকে বলি। জমিদারের ছেলে ছিল। রাগ করে সব সম্পত্তি ভাইকে দিয়ে বিবাগী হলো। দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিল। তাও ভালো লাগে না। জন্ম ভবঘুরে বুঝলেন ভাই? পথই হলো তার ঘর। কপালের লিখন–বিবাহ হলো আমার সঙ্গে। তখন আবার তার লেখার রোগ মাথাচাড়া দিয়েছে। দিনরাত পড়ে আর লেখে। এই যে বইটা দেখছেন ভাই–এই বই লিখতে কবি সাহেবের লেগেছে সাত বছর। কী কষ্ট করে লিখেছে! বিছানার উপুড় হয়ে বসে লিখত। হাতের কনুই থাকত বিছানায়। ঘষায় ঘষায় কনুই এ ঘা হয়ে গেল। আমি বাজার থেকে তুলা কিনে এনে দিলাম। সেই তুলার প্যাড কনুই-এ রেখে লিখত। সংসার তখন অচল হয়েছে, বুঝলেন ভাই। সম্পূর্ণ অচল। সে তো সংসারে কিছু দেখে না। চালের দাম কত, আলুর দাম কত–কিছুই জানে না। সংসার টানি আমি। স্কুলের অতি সামান্য আয়ে বাঁচার চেষ্টা করি। কবি সাহেবকে কিছু বুঝতেই দেই না। একদিন কবি সাহেব মন খারাপ করে বললেন, আম্বিয়া, সংসারের জন্যে তো আমি কিছুই করছি না। আমি তাকে বললাম, সব মানুষকে আল্লাহ কিছু দায়িত্ব দিয়ে পাঠান। লেখার দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ তোমাকে পাঠিয়েছেন। তুমি লেখ। সংসার নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।

সে-ও ভাবত না। তার ছেলেমেয়ে কয়টা তা-ও বোধহয় সে জানতো না। হাসবেন না ভাই। অতি দুঃখে এই কথা বলছি। একদিন কী হয়েছে শুনুন–আমার মেজো ছেলে অসুস্থ। পেট ফুলে ঢোল হয়েছে। ছটফট করে, নিশ্বাস নিতে পারে না। আমি ছেলেকে কবি সাহেবের পাশে শুইয়ে দিয়ে বললাম তুমি ছেলেটাকে দেখ আমি স্কুলে যাই। স্কুল কামাই দিলে আমার তো চলবে না। স্কুলে গেলাম। ফিরে এসে দেখি–কবি সাহেব লিখতে বসেছে। পাশে আমার ছেলে–এখন যায় তখন যায় অবস্থা। আমাকে দেখে কবি সাহেব বলল, শোনো আম্বিয়া, তোমার এই ছেলের। মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত। আমি তার উপর থেকে ভালোবাসার দাবি উঠিয়ে নিয়েছি। তুমিও উঠিয়ে নাও। তোমার ছেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাবে।

আমি আঁতকে উঠলাম। কী বলে এই লোক! ছেলেকে কোলে নিয়ে দৌড়ে গেলাম এক কবিরাজের কাছে। রিকশাও নিলাম না। কারণ রিকশাভাড়া ছিল না। সেই ছেলেকে কবিরাজ চিকিৎসা করে ভালো করলেন। একদিন ছেলে চলে গেল আমেরিকায়। সেখান থেকে বাবার জন্যে সোনার কলম পাঠাল। কবি সাহেব সেই কলম পেয়ে খুশি। ডেকে সবাইকে দেখায়।

বুঝলেন ভাই, কবি সাহেব ছেলেমেয়েদের দিকে চোখ ফেলে নাই। কিন্তু ছেলেমেয়েরা যে কী ভালো তার বাবাকে বাসে। বাবাকে তারা যত ভালোবাসে তার এক হাজার ভাগের এক ভাগ ভালো আমাকে বাসে না। বাবার কিছু-একটা হলে সব ছেলেমেয়ের খাওয়াদাওয়া বন্ধ।

আরেক দিনের গল্প আপনাকে বলি ভাই। একই সঙ্গে দুঃখের গল্প, আবার হাসিরও গল্প। এই গল্প মনে এলে আমি কখনো হাসি, কখনো চোখের পানি ফেলি। হয়েছে কী শোনেন। এক রাতের কথা–আমি ঘুমাচ্ছিলাম। কবি সাহেব আমাকে ডেকে তুলল। বলল, আম্বিয়া, জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখো–কী সুন্দর জোছনা হয়েছে–চলো, জোছনার মধ্যে হাঁটি।

বুঝলেন ভাই? কথা শুনে আমার ভালো লাগল। এইরকম কথা তো কখনো বলে না। ভালো লাগারই কথা। আমি খুশিমনে কবি সাহেবের সঙ্গে হাঁটতে গেলাম। কবি সাহেব হঠাৎ বলল, দেখো আম্বিয়া, মাঝে মাঝে আমার মনটা খুব খারাপ হয়।

আমি বললাম, কেন?

যখন শুনি মানুষের ছেলেমেয়েরা ম্যাট্রিক পাশ করে, ভালো রেজাল্ট করে, তখন একটু আফসোস হয়। মনটা খারাপও হয়।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন?

কবি সাহেব বলল, তখন মনে হয়, আমার যদি এক আধটা ছেলেমেয়ে ম্যাট্রিক পাশ করত, আমি লোকজনদের বলতে পারতাম।

কী বলছ তুমি? তোমার যে দুইটা ছেলে ম্যাট্রিক পাশ করেছে। এত ভালো রেজাল্ট করেছে তুমি জানো না?

পাশ করেছে জানি না তো! কী আশ্চর্য!

কবি সাহেব অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। এই রকম একটা মানুষের সঙ্গে ঘর করেছি ভাই। সৃষ্টিছাড়া মানুষ। আমি খুশি যে আমার আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

মা’র কথা শুনে মেজো মেয়ে রাগী গলায় বলল, মা তুমি এটা কী রকম কথা বললে? তোমার আগে বাবা মারা যাওয়ায় তুমি খুশি। তোমার এই কথার মানে কী?

আম্বিয়া খাতুন কঠিন গলায় বললেন, মানে আছে রে মা, মানে আছে। মানে ছাড়া আম্বিয়া খাতুন কথা বলে না। তোর বাবার আগে যদি আমি মারা যেতাম–কে তাহলে এই পাগল মানুষটার সেবা করত? আমি বেঁচে আছি বলেই শেষ সময় পর্যন্ত সেবা করতে পেরেছি। আমি বেঁচে আছি বলেই তোর বাবার মৃত্যুর পর তাঁর নামে ট্রাস্ট করতে পেরেছি। মরে গেলে এইসব হতো না রে মা। বেঁচে আছি বলেই হচ্ছে। তোর বাবার দশ বছরের খাটুনির যে পাণ্ডুলিপি সেটা আমি বেঁচে আছি বলেই প্রকাশ হবে। বেঁচে না থাকলে প্রকাশ হতো না। তোর বাবা সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে কী করত? বালিশের নিচে রেখে ঘুমাতো। কাউকে মুখ ফুটে বলত না-পাণ্ডুলিপিটা প্রকাশ করো তো? বলতো মুখ ফুটে?

না।

এখন যা, মুখে মুখে আমার সঙ্গে তর্ক না করে–তোর বাবার পাণ্ডুলিপি এনে তোর চাচাকে দেখা।

মেয়েরা ছুটে গেল বাবার পাণ্ডুলিপি আনতে।

আমি পাণ্ডুলিপি দেখলাম। আমি কোনো লিপি বিশারদ নই কিন্তু পাণ্ডুলিপি দেখে বুঝলাম–বিরাট কাজ হয়েছে। বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক জনাব হারুন-অর রশিদ সাহেব এই পাণ্ডুলিপি গ্রহণ করেছেন। খুব শিগগিরই তা গ্রন্থাকারে বের হবে।

আম্বিয়া খাতুনের সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করলাম। গল্পের এক পর্যায়ে তিনি হঠাৎ করে বললেন, ভাই, আপনি কি ভূত-প্রেত এইসব বিশ্বাস করেন?

আমি বললাম, না।

আমিও করি না। আমি কোনো কিছুই বিশ্বাস করি না। ভূত-প্রেতের নানান ঘটনা শুনি। কিন্তু আমি জানি এর কোনো না কোনো ব্যাখ্যা আছে।

আমি বললাম, অবশ্যই আছে।

আম্বিয়া খাতুন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি আমার জীবনের একটা ঘটনা আপনাকে বলব। এই ঘটনার ব্যাখ্যা আমি করতে পারি নাই। কবি সাহেবও পারে নাই। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি পারবেন।

এ রকম মনে হওয়ার কারণ কী?

কোনো কারণ নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে। গল্পটা বলার আগে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। ভাই, আপনি তো অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বললেন, আপনি কি বুঝতে পেরেছেন আমি কঠিন ধরনের সাহসী মহিলা?

বুঝতে পেরেছি।

আপনি কি বুঝতে পেরেছেন যে আমি কখনো মিথ্যা বলি না?

তা-ও বুঝতে পেরেছি।

তাহলে গল্পটা শুনুন। খুব মন দিয়ে শুনবেন। আজ থেকে কুড়ি বছর আগের কথা। আমার এক কন্যা জেসমিনের বয়স তখন আড়াই বছর। খুব সুন্দর মেয়ে। ফুটফুটে চেহারা। সারা দিন নিজের মনে খেলে, কথা বলে। আমার বড়ই আদরের মেয়ে। একদিন দুপুর বেলা আমি বাথরুমে গিয়েছি। মফস্বল অঞ্চলের বাথরুম–মূল বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে, নির্জনে। বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করা মাত্র আমি একজনের কথা শুনলাম। পুরুষমানুষের গলা। খুব পরিষ্কার স্পষ্ট আওয়াজের কথা। কথাটা সে বলল, ঠিক আমার মাথার ভেতরে। কথাটা হলো–তোমার মেয়ে জেসমিন চৈত্র মাসের বারো তারিখ পানিতে ডুবে মারা যাবে। কিছুই করার নাই। কথা শুনে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। আমি চিৎকার করতে করতে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ঢুকলাম। কবি সাহেবকে বললাম।

আপনাকে আগে বলা হয় নাই–কবি সাহে ছিল ঘোর নাস্তিক। সে কোনোকিছুই বিশ্বাস করত না। আমার কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল, এটা আর কিছুই না, তোমার মনের বিকার। তোমার মেয়েটা ছোট, পাশেই পুকুর। সারাক্ষণ তুমি মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা করো। এই জন্যে মনে বিকার উপস্থিত হয়েছে। বিকারের ঘোরে এইসব শুনেছ।

কবি সাহেবের কথায় আমার মন শান্ত হলো না। খেতে পারি না। রাতে ঘুমাতে পারি না। চৈত্র মাসের বারো তারিখ আসতে বেশি বাকিও নেই। মনে হলেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। কবি সাহেবকে কিছু বলতে গেলে ও শুধু হাসে।

বারোই চৈত্র খুব ভোরবেলা কবি সাহেব আমাকে বলল, তোমার মন যখন এত অস্থির তুমি এক কাজ করো–আজ সারা দিন মেয়েটাকে চোখের আড়াল কোরো না। সারাক্ষণ তাকে চোখে চোখে রাখো। তোমার স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই। আমি হেডমিস্ট্রেসের কাছে একটা ছুটির দরখাস্ত লিখে নিয়ে যাব।

কবি সাহেব তা-ই করল। নিজেই একটা ছুটির দরখাস্ত লিখে নিয়ে গেল। আমি সারা দিন জেসমিনকে নিয়ে রইলাম। এক মুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল করি না। দুপুরবেলা আমার চোখে মরণঘুম নামল। কয়েক রাত অঘুমো কাটিয়াছি। অবস্থা এমন হয়েছে কিছুতেই চোখ ভোলা রাখতে পারছি না। ঘুমুতে গেলাম জেসমিনকে নিয়ে। দরজা-টরজা সব বন্ধ করে দিলাম। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যাবেলা। দেখি বিছানায় জেসমিন নেই। বুক ছ্যাঁৎ করে উঠল। তারপরই দেখি সে ঘরের মেঝেতে আপন মনে একটা বদনা নিয়ে খেলছে। মনটা শান্ত হলো। মেয়েটাকে কিছুক্ষণ আদর করলাম। বাইরে থেকে কবি সাহেব বলল, আম্বিয়া, আমার কাছে কিছু মেহমান এসেছেন। একটু চা করতে পারবে?

আমি চা বানাতে রান্নাঘরে ঢুকলাম। লাকড়ির চুলা ধরতে একটু সময় নিল। যখন আগুন ধরে উঠল তখনি মনে হলো–জেসমিন কোথায়? ওকে না আমার চোখে চোখে রাখার কথা! আমি ছুটে শোবার ঘরে ঢুকলাম। জেসমিন সেখানে নেই। আমি আর অপেক্ষা করলাম না–দৌড়ে গেলাম পুকুরপাআপনি ড়ে। গিয়ে দেখি–জেসমিন মাঝপুকুরে ভাসছে।

ভাই, আপনি অনেক জানেন। পৃথিবীর অনেক কিছুই দেখেছেন, শুনেছেন। আমার এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারবেন? কবি সাহেবের মতো ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাকবেন না, কথা বলুন।

আম্বিয়া খাতুনের কঠিন চোখ দ্রবীভূত হলো। তার চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগল। তিনি আঁচলে চোখ মুছে মেজো মেয়েকে ডেকে সহজ গলায় বললেন, তোর চাচার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। তাঁকে খেতে দে।

চান্নি পসর রাইত

আলাউদ্দিন নামে আমার নানাজানের একজন কামলা ছিল। তাকে ডাকা হত আলাদ্দি। কামলা শ্রেণীর লোকদের পুরো নামে ডাকার চল ছিল না। পুরো নাম ভদ্রলোকদের জন্যে। এদের আবার নাম কি? একটা কিছু ডাকলেই হল। ‘আলাদ্দি’ যে ডাকা হচ্ছে এই-ই যথেষ্ট।

আলাউদ্দিনের গায়ের রঙ ছিল কুচকুচে কালো। এমন ঘন কৃষ্ণবর্ণ সচরাচর দেখা যায় না। মাথাভর্তি ছিল বাবরি চুল। তার চুলের যত্ন ছিল দেখার মত। জবজবে করে তেল মেখে মাথাটাকে সে চকচকে রাখতো। আমাকে সে একবার কানে কানে বলল, বুঝলা ভাইগ্না ব্যাটা, মানুষের পরিচয় হইল চুলে। যার চুল ঠিক তার সব ঠিক।

কামলাদের মধ্যে আলাউদ্দিন ছিল মহা ফাঁকিবাজ। কোন কাজে তাকে পাওয়া যেত না। শীতের সময় গ্রামে যখন যাত্রা বা গানের দল আসতো তখন সে অবধারিতভাবে গানের দলের সঙ্গে চলে যেত। মাসখানিকতার আর কোন খোঁজ পাওয়া যেত না। অথচ শীতের মরশুম হচ্ছে আসল কাজের সময়। এমন ফাঁকিবাজকে কেউ জেনে-শুনে কামলা নেবে না। নানাজান নিতেন, কারণ তাঁর উপায় ছিল না। আলাউদ্দিন বৈশাখ মাসের শুরুতে পরিষ্কার জামাকাপড় পরে চোখে সুরমা দিয়ে উপস্থিত হত। নানাজানের পা ছুঁয়ে সালাম করে তৃপ্ত গলায় বলতো, মামুজী, দাখিল হইলাম।

নানাজান চেঁচিয়ে বলতেন, যা হারামজাদা, ভাগ।

আলাউদ্দিন উদাস গলায় বলতো, ভাইগ্যা যামু কই? আল্লাপাক কি আমার যাওনের জায়গা রাখছে? রাখে নাই। তার উপরে একটা নয়ন নাই। নয়ন দুইটা ঠিক থাকলে হাঁটা দিতাম। অফমান আর সহ্য হয় না।

এর উপর কথা চলে না। তাকে আবারো এক বছরের জন্যে রাখা হত। বারবার সাবধান করে দেয়া হত যেন গানের দলের সঙ্গে পালিয়ে না যায়। সে আল্লার নামে, পাক কোরানের নামে, নবীজীর নামে কসম কাটতো–আর যাবে না।

‘মামুজী, আর যদি যাই তাইলে আপনের গু খাই।‘

সবই কথার কথা। গানের দলের সঙ্গে তার গৃহত্যাগ ছিল নিয়তির মতো। ফেরানোর উপায় নেই। নানাজান তা ভালমতই জানতেন। বড় সংসারে অকর্মা কিছু লোক থাকেই। এদের উপদ্রব সহ্য করতেই হয়।

আলাউদ্দিনের সঙ্গে আমার পরিচয় নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে। আমরা থাকতাম শহরে। বাবা ছুটি-ছাটায় আমাদের নানার বাড়ি নিয়ে যেতেন। আমরা অল্প কিছুদিন থাকতাম। এই সময়টা সে আমাদের সঙ্গে ছায়ার মত লেগে থাকতো। রাতে গল্প শোনাতো। সবই তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গল্প। তার চেয়েও যা মজার তা হল, তার প্রতিটি গল্পের শুরু চান্নি পসর রাইতে।

‘বুঝলা ভাইগ্না ব্যাটা, সেইটা ছেল চান্নি পসর রাইত। আহারে কি চান্নি। আসমান যেন ফাঁইট্যা টুকরা টুকরা হইয়া গেছে। শইলের লোম দেহা যায় এমুন চান্দের তেজ।‘

সাধারণত ভূত-প্রেতের গল্পে অমাবস্যার রাত থাকে। গল্পের পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে অন্ধকার রাতের দরকার হয়। কিন্তু আলাউদ্দিনের ভূতগুলিও বের হয় চান্নি পসর রাতে। যখন সে বাঘের গল্প বলে, তখন দেখা যায় তার বাঘও চান্নি পসর রাতে পানি খেতে বের হয়।

ছোটবেলায় আমার ধারণা হয়েছিল, এটা তার মুদ্রাদোষ। গল্পে পরিবেশ তৈরির এই একটি কৌশলই সে জানে। দুর্বল গল্পকারের মত একই টেকনিক সে বারবার ব্যবহার করে।

একটু যখন বয়স হল তখন বুঝলাম চাঁদনি পসর রাত আলাউদ্দিনের অত্যন্ত প্রিয়। প্রিয় বলেই এই প্রসঙ্গে সে বারবার ফিরে আসে। সব কিছুই সে বিচার করতে চায় চান্নি পসর রাতের আলোকে। একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি। নানাজানদের গ্রামের স্কুলের সাহায্যের জন্য একটা গানের আসর হল। কেন্দুয়া থেকে দু’জন বিখ্যাত বয়াতী আনা হল। হ্যাঁজাক লাইট-টাইট জ্বালিয়ে বিরাট ব্যাপার। গান হলও খুব সুন্দর। সবাই মুগ্ধ। শুধু আলাউদ্দিন দুঃখিত গলায় জনে জনে বলে বেড়াতে লাগলো, হ্যাঁজাক বাত্তি দিয়া কি আর গান হয়? এই গান হওয়া উচিত ছিল চান্নি পসর রাইতে। বিরাট বেকুবি হইছে।

সৌন্দর্য আবিষ্কার ও উপলব্ধির জন্যে উন্নত চেতনার প্রয়োজন। তাহলে কি ধরে নিতে হবে আমাদের আলাউদ্দিন উন্নত চেতনার অধিকারী ছিল? যে সৌন্দর্যের উপাসক সে সবকিছুতেই সৌন্দর্য খুঁজে পায়। আলাউদ্দিন তো তা পায়নি। তার সৌন্দর্যবোধ চান্নি পসর রাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এমন তো হবার কথা না। মনোবিজ্ঞানীরা হয়তো আলাউদ্দিনের জোছনা-প্রীতির অন্য ব্যাখ্যা দেবেন। তারা বলবেন–এই লোকের অন্ধকার-ভীতি আছে। চাঁদের আলোর জন্যে তার এই আকুলতার পেছনে আছে তার আঁধার-ভীতি Dark Fobia. যে যাই বলুন, আমাকে জোছনা দেখাতে শিখিয়েছে আলাউদ্দিন। রূপ শুধু দেখলেই হয় না। তীব্র অনুভূতি নিয়ে দেখতে হয়। এই পরম সত্য আমি জানতে পারি মহামূর্খ বলে পরিচিত বোকা সোকা একজন মানুষের কাছে। আমার মনে আছে, সে আমাকে এক জোছনা রাতে নৌকা করে বড় গাঙে নিয়ে গেল। যাবার পথে ফিসফিস করে বলল, চান্নি পসর দেখন লাগে পানির উফরে, বুঝলা ভাইগ্না ব্যাটা। পানির উফরে চান্নির খেলাই অন্য রকম।

সেবার নদীর উপর চাঁদের ছায়া দেখে তেমন অভিভূত হইনি, বরং নৌকা ডুবে যাবে কি না এই ভয়েই অস্থির হয়েছিলাম। কারণ নৌকা ছিল ফুটো, গলগল করে পাটাতন দিয়ে পানি ঢুকছিল। ভীত গলায় আমি বললাম, পানি ঢুকছে মামা।

‘আরে থও ফালাইয়া পানি, চান্নি কেমন হেইডা কও।‘

‘খুব সুন্দর।‘

‘খাইয়া ফেলতে মনে লয় না কও দেহি।‘

জোছনা খেয়ে ফেলার তেমন কোন ইচ্ছা হচ্ছিল না, তবু তাকে খুশি করার জন্যে বললাম, হ্যাঁ। আলাউদ্দিন মহাখুশি হয়ে বলল, আও, তাইলে চান্নি পসর খাই। বলেই সে আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদের আলো খাওয়ার ভঙ্গি করতে লাগলো। সে এক বিচিত্র দৃশ্য! আমি আমার একটি উপন্যাসে ( অচিনপুর) এই দৃশ্য ব্যবহার করেছি। উপন্যাসের একটি চরিত্র নবু মামা জোছনা খেত।

আলাউদ্দিন যে একজন বিচিত্র মানুষ ছিল তা তার আশেপাশের কেউ ধরতে পারেনি। সে পরিচিত ছিল অকর্মা বেকুব হিসেবে। তার জোছনা-প্রীতিও অন্য কেউ লক্ষ করেছে বলে মনে হয় না। তার ব্যাপারে সবাই আগ্রহী হল যখন সে এক শীতে গানের দলের সঙ্গে চলে গেল, এবং ফিরে এলো এক রূপবতী তরুণীকে নিয়ে! তরুণীর নাম দুলারী। তার রূপ চোখ ঝলসানো রূপ।

নানাজী গম্ভীর গলায় বললেন, এই মেয়ে কে?

আলাউদ্দিন মাথা চুলকে বলল, বিবাহ করেছি মামুজী। বয়স হইছে। সংসারধর্ম করা লাগে। নবীজী সবেরে সংসারধর্ম করতে বলছেন।

‘সেইটা বুঝলাম। কিন্তু এই মেয়ে কে?’

‘হেইটা মামুজী এক বিরাট ইতিহাস।‘

‘ইতিহাসটা শুনি।

ইতিহাস শুনে নানাজান গম্ভীর হয়ে গেলেন। শুকনো গলায় বললেন, এরে নিয়া বিদায় হ। আমার বাড়িতে জায়গা নাই।

আলাউদ্দিন স্টেশনের কাছে ছাপড়া ঘর তুলে বাস করতে লাগল। ট্রেনের টাইমে স্টেশনে চলে আসে, কুলিগিরি করে। ছোটখাট চুরিতেও সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ল। থানাওয়ালারা প্রায়ই তাকে ধরে নিয়ে যায়। তার বৌ নানাজানের কাছে ছুটে আসে। নানাজান বিরক্তমুখে তাকে ছাড়িয়ে আনতে যান। নিজের মনে গজগজ করেন–এই যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না!

নানাজানকে যন্ত্রণা বেশিদিন সহ্য করতে হল না। আলাউদ্দিনের বৌ এক শীতে এসেছিল, আরেক শীতের আগেই মারা গেল। আলাউদ্দিন স্ত্রীর লাশ কবরে নামিয়ে নানাজানকে এসে কদমবুসি করে ক্ষীণ গলায় বলল, দাখিল হইলাম মামুজী।

বছর পাঁচেক পরের কথা। আমার দেশের বাইরে যাওয়া ঠিক হয়েছে। আমি সবার কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্যে নানার বাড়ি গিয়ে দেখি, আলাউদ্দিনের অবস্থা খুব খারাপ। শরীর ভেঙে পড়েছে। মাথাও সম্ভবত খানিকটা খারাপ হয়েছে। দিন-রাত উঠোনে বসে পাটের দড়ি পাকায়। দড়ির সঙ্গে বিড়বিড় করে কথা বলে। খুবই উচ্চ শ্ৰেণীর দার্শনিক কথাবার্তা। তার একটি চোখ আগেই নষ্ট ছিল। দ্বিতীয়টিতেও ছানি পড়েছে। কিছু দেখে বলে মনে হয় না। চোখে না দেখলেও সে চান্নি পসর সম্পর্কে এখনো খুব সজাগ। এক সন্ধ্যায় হাসিমুখে আমাকে বলল, ও ভাইগ্না ব্যাটা, আইজ যে পুরা চান্নি হেই খিয়াল আছে? চান্নি দেখতে যাবা না? যত পার দেইখ্যা লও। এই জিনিস বেহেশতেও পাইবা না।

সেই আমার আলাউদ্দিনের সঙ্গে শেষ চাঁদনি দেখতে যাওয়া। সে আমাকে মাইল তিনেক হাঁটিয়ে একটা বিলের কাছে নিয়ে এল। বিলের উপর চান্নি নাকি অপূর্ব জিনিস। আমাদের চান্নি দেখা হল না। আকাশ ছিল ঘন মেঘে ঢাকা। মেঘ কাটল না। এক সময় টুপটুপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। আলাউদ্দিন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চান্নি আমরার ভাগ্যে নাই। ভাগ্য খুব বড় ব্যাপার ভাইগ্রা ব্যাটা। ভাগ্যে না থাকলে হয় না।

আমরা ভিজতে ভিজতে ফিরছি। আলাউদ্দিন নিচু স্বরে কথা বলে যাচ্ছে, ভাগ্যবান মানুষ এই জীবনে একজন দেখছি। তোমার মামীর কথা বলতেছি। নাম ছিল দুলারী। তার মরণ হইল চান্নি পসর রাইতে। কি চান্নি যে নামল ভাইগ্না! না দেখলে বিশ্বাস করবা না। শইল্যের সব লোম দেহা যায় এমন পসর। চান্নি পসরে মরণ তো সহজে হয় না। বেশির ভাগ মানুষ মরে দিনে। বাকিগুলো মরে অমাবস্যায়। তোমার মামীর মত দুই-একজন ভাগ্যবতী মরে চান্নি পসরে। জানি না আল্লাপাক আমার কপালে কি রাখছে। চান্নি পসরে মরণের বড় ইচ্ছা।

আলাউদ্দিনের মৃত্যুর খবর আমি পাই আমেরিকায়। তার মরণ চাঁদনি পসরে হয়েছিল কি-না তা চিঠিতে লেখা ছিল না, থাকার কথাও নয়। কার কি যায় আসে তার মৃত্যুতে? সেই রাতে ঘুমুতে যাবার আগে আমার স্ত্রীকে বললাম, গুলতেকিন, চল যাই জোছনা দেখে আসি। সে বিস্মিত হয়ে বলল, এই প্রচণ্ড শীতে জোছনা দেখবে মানে?–তাছাড়া জোছনা আছে কিনা তাই-বা কে জানে।

আমি বললাম, থাকলে দেখব, না থাকলে চলে আসব।

গাড়ি নিয়ে বের হলাম। পেছনের সীটে বড় মেয়ে নোভাকে শুইয়ে দিয়েছি। সে আরাম করে ঘুমুচ্ছে। মেয়ের মা বসেছে আমার পাশে। গাড়ি চলছে উল্কার বেগে। গুলতেকিন বলল, আমরা যাচ্ছি কোথায়?

আমি হাসতে হাসতে বললাম, মন্টানার দিকে। মন্টানার জঙ্গলে জোছনা দেখব। সে যে কি সুন্দর দৃশ্য তুমি না দেখলে বিশ্বাস করবে না।

গাড়ির ক্যাসেট চালু করে দিয়েছি। গান হচ্ছে–আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে। আমার কেন জানি মনে হল আলাউদ্দিন আমার কাছেই আছে। গাড়ির পেছনের সীটে আমার বড় মেয়ের পাশে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। গভীর আগ্রহ ও আনন্দ নিয়ে সে আমার কাণ্ডকারখানা লক্ষ করছে।

চোখ

আজ বাদ-আছর খেজুর কাঁটা দিয়ে মতি মিয়ার চোখ তুলে ফেলা হবে চোখ তুলবে নবীনগরের ইদরিস। এই কাজ সে আগেও একবার করেছে।

মতি মিয়াকে আটকে রাখা হয়েছে বরকত সাহেবের বাংলা ঘরে। তার হাত-পা বাঁধা। একদল মানুষ তাকে পাহারা দিচ্ছে। যদিও তার প্রয়োজন ছিল না, পালিয়ে যাওয়া দূরের কথা, মতি মিয়ার উঠে বসার শক্তি পর্যন্ত নেই। তার পাঁজরের হাড় ভেঙেছে। ডান হাতের সব কটা আঙুল থেতলে ফেলা হয়েছে। নাকের কাছে সিকনির মত রক্ত ঝুলে আছে। পরনের সাদা পাঞ্জাবি রক্তে মাখামাখি হয়ে গায়ের সঙ্গে লেগে গেছে। ঘন্টাখানেক আগেও তার জ্ঞান ছিল না। এখন জ্ঞান আছে, তবে বোধশক্তি ফিরেছে বলে মনে হয় না। তার চোখ তুলে ফেলা হবে এই খবরেও সে বিচলিত হয়নি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলেছে, নয়ন কখন তুলবেন?

এই পর্ব বাদ-আছর সমাধা হবে শুনে সে মনে হল নিশ্চিন্ত হল। সহজ গলায় বলল, পানি খামু, পানি দেন।

পানি চাইলে দিতে হয়। না দিলে গৃহস্থের দোষ লাগে। রোজ হাশরের দিন পানি পিপাসায় বুক যখন শুকিয়ে যায় তখন পানি পাওয়া যায় না। কাজেই এক বদনা পানি এনে মতির সামনে রাখা হল। মতি বিরক্ত গলায় বলল, মুখের উপরে পানি ঢাইল্যা না দিলে খামু ক্যামনে? আমার দুই হাত বান্ধা, আপনেরার এইটা কেমুন বিবেচনা?

যে বদনা এনেছে সে মোড়ায় বসে থাকা একজনের দিকে তাকিয়ে বলল, পানি ঢাইল্যা দিমু হাসান ভাই?

হাসান আলী মতিকে কেন্দুয়া বাজার থেকে ধরে এনেছে। মতির ওপর এই কারণেই তার অধিকার সবাই স্বীকার করে নিয়েছে। মতির বিষয়ে যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে হাসান আলীর মতামত জানা দরকার। হাসান আলী পানি বিষয়ে কোন। মতামত দিল না, বিস্মিত হয়ে বলল, হারামজাদা কেমন টং-এ কথা কয় শুনছেন? তার চউখ তোলা হইব এইটা নিয়া চিন্তা নাই। ক্যাটক্যাট কইরা কথা বলতেছে। কি আচানক বিষয়! ঐ হারামজাদা, তোর মনে ভয়-ডর নাই?

মতি জবাব দিল না, থু করে থুথু ফেলল। থুথুর সঙ্গে রক্ত বের হয়ে এল। তাকে ঘিরে ভিড় বাড়ছে। খবর ছড়িয়ে পড়েছে। একজন জীবিত মানুষের চোখ খেজুর কাঁটা দিয়ে তুলে ফেলা হবে এমন উত্তেজক ঘটনা সচরাচর ঘটে না। আশা করা যাচ্ছে, আছর ওয়াক্ত নাগাদ লোকে লোকারণ্য হবে। মতিকে দেখতে শুধু যে সাধারণ লোকজন আসছে তা না, বিশিষ্ট লোকজনও আসছেন। কেন্দুয়া থেকে এসেছেন রিটায়ার্ড স্টেশন মাস্টার মোবারক সাহেব। নয়াপাড়া হাই স্কুলের হেডমাস্টার সাহেবও এসেছেন। হাসান আলী নিজ চেয়ার ছেড়ে দিয়ে তাকে বসতে দিল। তিনি পাঞ্জাবির পকেট থেকে চশমা। বের করতে করতে বললেন, এরই নাম মতি?

হাসান আলী হাসিমুখে বলল, জ্বে হেডমাস্টার সাব, এই হারামজাদাই মতি। বাদ আছর হারামজাদার চউখ তোলা হইব।

এরে ধরলা ক্যামনে?

সেইটা আপনের এক ইতিহাস।

পানদানিতে পান চলে এসেছে। হেডমাস্টার সাহেব পান মুখে দিতে দিতে উৎসাহে সঙ্গে বললেন, ঘটনাটা বল শুনি। সংক্ষেপে বলবা।

হাসান আলী এগিয়ে এল। মতিকে ধরে আনার গল্প সে এ পর্যন্ত এগারোবার বলেছে। আরো অনেকবার বলতে হবে। বিশিষ্ট লোকজন অনেকেই এখনো আসেন নি। সবাই আলাদা আলাদা করে শুনতে চাইবেন। তাতে অসুবিধা নেই। এই গল্প এক লক্ষবার করা যায়। হাসান আলী কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল।

ঘরে কেরাছি ছিল না। আমার পরিবার বলল, কেরাছি নাই। আমার মিজাজ গেল খারাপ হইয়া। হাটবারে কেরাছি আনলাম, আর আইজ বলে কেরাছি নাই, বিষয় কি! যাই হউক, কেরাছির বোতল হাতে লইয়া রওনা দিলাম। পথে সুলেমানের সাথে দেখা। সুলেমান কইল, চাচাজী, যান কই?…

.

মতি নিজেও হাসান আলীর গল্প আগ্রহ নিয়ে শুনছে। প্রতিবারেই গল্পের কিছু শাখা-প্রশাখা বের হচ্ছে। সুলেমানের কথা এর আগে কোন গল্পে আসেনি। এইবার এল। সুলেমানের ভূমিকা কি কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

হাসান আলী গল্প শেষ করল। হেডমাস্টার সাহেব মুগ্ধ গলায় বললেন, বিরাট সাহসের কাম করছ হাসান। বিরাট সাহস দেখাইছ। কামের কাম করছ। মতির সাথে

অস্ত্রপাতি কিছু ছিল না?

জ্বে না।

আল্লাপাক তোমারে বাঁচাইছে। অস্ত্রপাতি থাকলে উপায় ছিল না। তোমারে জানে শেষ কইরা দিত।

উপস্থিত সবাই মাথা নাড়ল। হেডমাস্টার সাহেব বললেন, চউখ তোলা হইব কথাটা কি সত্য?

জ্বে সত্য। এইটা সকলের সিদ্ধান্ত। চউখ তুললেই জন্মের মহ অচল হইব। থানা পুলিশ কইরা তো কোন ফয়দা নাই।

অতি সত্য কথা, কোন ফয়দা নাই। তবে থানাওয়ালা ঝামেলা করে কিনা এইটা বিবেচনায় রাখা দরকার।

আছে, সবই বিবেচনার মইধ্যে আছে। মেম্বার সাব থানাওয়ালার কাছে গেছে।

মতি লক্ষ্য করল, হেডমাস্টার সাহেব তার দিকে তাকিয়ে আছেন। হেডমাস্টার সাহেবের চোখে শিশুসুলভ বিস্ময় ও আনন্দ। মনে হচ্ছে, চোখ তোলার ঘটনা দেখার জন্যে তিনি আছর পর্যন্ত থেকে যাবেন। মতি তেমন ভয় পাচ্ছে না। প্রাথমিক ঝড় কেটে গেছে এটাই বড় কথা। প্রথম ধাক্কায় চোখ চলে যেতে পারত। সেটা যখন যায়নি তখন আশা আছে। আছরের আগেই কেউ-না-কেউ দয়াপবশ হয়ে বলে ফেলবে-থাউক, বাদ দেন। চউখ তুইলা লাভ নাই। শক্ত মাইর দিয়া ছাইড়া দেন। একজন বললেই অনেকে তাকে সমর্থন করবে। তবে একজন কাউকে বলতে হবে। মতি নিজে ক্ষমা চাইলে হবে না। এতে এরা আরো রেগে যাবে। সে দুর্বল হলে সর্বনাশ। দুর্বলকে মানুষ করুণা করে না, ঘৃণা করে। মতি ঠাণ্ডা মাথায় ভাবে। চোখ বাঁচানোর পথ বের করতে হবে। হাতে অবশ্যি সময় আছে। আছরের এখনো অনেক দেরি। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করাও সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারা শরীরে যন্ত্রণা। পিপাসায় বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির বদনা সামনে আছে কিন্তু কেউ মুখে ঢেলে না দিলে খাবে কিভাবে?

.

হেডমাস্টার সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, কি রে মতি, সিগ্রেট খাবি?

সবাই হো-হো করে হেসে ফেলল। মতি চিন্তিত বোধ করছে। এটা ভাল লক্ষণ। এরা তাকে দেখে মজা পেতে শুরু করেছে। মানুষ মজা পায় জন্তু-জানোয়ার দেখে। এরা তাকে জন্তু-জানোয়ার ভাবতে শুরু করেছে। হাত-পা বাঁধা একটা ভয়াবহ প্রাণী। ভয়াবহ প্রাণীর চোখ ওঠানো কঠিন কিছু না। তাছাড়া দূর দূর থেকে লোকজন মজা পাবার জন্যে আসছে। মজা না পেয়ে তারা যাবে না। মতি হেডমাস্টার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার পানি খাব। একজন বদনার পুরো পানিটা তার মুখের উপর ঢেলে দিল। সবাই আবার হো-হো করে হেসে উঠল। মতির বুক ধক করে উঠলো। অবস্থা ভাল না। তাকে দ্রুত এমন কিছু করতে হবে যেন সে পশুস্তর থেকে উঠে আসতে পারে। কি করা যায় কিছুই মাথায় আসছে না। চোখ দু’টা কি আজ চলেই যাবে? মায়া-মমতা দুনিয়া থেকে উঠে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন তার মত লোকের শাস্তি ছিল মাথা কামিয়ে গলায় জুতার মালা ঝুলানো। তারপর এল ঠেং ভাঙা শাস্তি, ঠেং ভেঙে লুলা করে দেয়া। আর এখন চোখ তুলে দেয়া। একটা খেজুর কাঁটা দিয়ে পূট করে চোখ বের করে আনা। এতগুলি লোক তাকে ঘিরে আছে, কারো চোখে কোন মমতা নেই। অবশ্যি হাতে এখনো সময় আছে। মমতা চট করে তৈরি হয় না। মমতা তৈরি হতেও সময় লাগে। মতি হাসান আলীর দিকে তাকিয়ে হাসল। মানুষের হাসি খুব অদ্ভুত জিনিস। জন্তু জানোয়ার হাসতে পারে না। মানুষ হাসে। একজন হাসন্ত মানুষের উপর রাগ থাকে না।

হাসান আলী চেঁচিয়ে উঠল, দেখ, হারামজাদা হাসে। ভয়ের চিহ্নটা নাই। কিছুক্ষণের মইধ্যে চউখ চইল্যা যাইতেছে, তারপরেও হাসি। দেখি, এর গালে একটা চড় দেও দেখি।

প্রচণ্ড চড়ে মতি দলা পাকিয়ে গেল। হাত-পা বাঁধা, নয়ত চার-পাঁচ হাত দূরে ছিটকে পড়ত। কিছুক্ষণের জন্যে মতির বোধশক্তি লোপ পেল। মাথার ভেতর ভোঁ ভো শব্দ হচ্ছে। চারদিক অন্ধকার। এরা কি চোখ তুলে ফেলেছে? মনে হয় তাই। পানির পিপাসা দূর হয়েছে। পিপাসা নেই। এটা মন্দ না। মাথার ভেতর পাক দিচ্ছে, মনে হচ্ছে সে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। অজ্ঞান হবার আগে আগে এরকম হয়। অজ্ঞান হওয়া খুব আনন্দদায়ক ব্যাপার। দ্রুত শরীরের ব্যথা-বেদনা চলে যায়, শরীর হাল্কা হতে থাকে।

না, চোখ যায়নি। চোখ এখনো আছে। এই তো সবকিছু দেখা যাচ্ছে। মতি মনে মনে বলল, শালার লোক কি হইছে! মেলা বইস্যা গেছে। বেলা পড়ে এসেছে। আছর ওয়াক্ত হয়ে গেল না-কি? না মনে হয়। আলো খুব বেশি। তাকে বাংলা ঘর থেকে বের করে উঠোনে শুইয়ে রাখা হয়েছে। এই জন্যেই আলো বেশি লাগছে।

মতি বলল, কয়টা বাজে?

কয়টা বাজে তা দিয়া দরকার নাই। সময় হইয়া আসছে। যা দেখনের দেইখ্যা নে রে মতি।

মতি চারদিকে তাকালো। তার আশেপাশে কোন ছোট ছেলেমেয়ে নেই। মহিলা নেই। এদের বোধহয় সরিয়ে দেয়া হয়েছে। লোকজন তাকে ঘিরে গোল হয়ে আছে। তার সামনে জলচৌকির উপর নীল গেঞ্জি এবং সাদা লুঙ্গি পরে যে বসে আছে সে-ই কি চোখ তুলবে? সে-ই কি নবীনগরের ইদরিস? কখন এসেছে ইদরিস? লোকটার ভাবভঙ্গি দশজনের মত না। তাকাচ্ছে অন্যরকম করে। তার চেয়ে বড় কথা, আশেপাশের লোকজন এখন নীল গেঞ্জিওয়ালাকেই দেখছে। মতির প্রতি তাদের এখন আর কোন আগ্রহ নেই। তারা অপেক্ষা করছে বড় ঘটনার জন্যে। নীল গেঞ্জি পরা। লোকটার সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটা জেনে নেয়া যায়। মতি অপেক্ষা করছে কখন। লোকটা তাকায় তার দিকে। যেই তাকাবে ওমি মতি কথা বলবে। চোখের দিকে না তাকিয়ে কথা বললে কোন আরাম নেই। কিন্তু লোকটা তাকাচ্ছে না।

ভাইজান, ও ভাইজান।

নীল গেঞ্জি তাকাল মতির দিকে। মতি সঙ্গে সঙ্গে বলল, আফনের নাম কি ইদরিস মিয়া? নীল গেঞ্জি জবাব দিল না। মাথা ঘুরিয়ে নিল। মতি আরো আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল, ভাইজান, আফনেই কি আমার চউখ তুলবেন?

পেছন থেকে একজন বলল, হারামজাদা কয় কি! সঙ্গে সঙ্গে সবাই হেসে উঠল। এই কথায় হাসার কি আছে মতি বুঝতে পারছে না। কথাটা কি সে বিশেষ কোন ভঙ্গিতে বলেছে? সাধারণ কথাও কেউ কেউ খুব মজা করে বলতে পারে। তার বৌ পারত। অতি সাধারণ কথা এমনভাবে বলত যে হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে যেত। ভাত বেড়ে ডাকতে এসে বলত, ভাত দিছি, আসেন। চট কইরা তিন-চাইরটা ভাত খান। না, বৌয়ের কথা ভাবার এখন সময় না। এখন নিজের নয়ন বাঁচানোর বুদ্ধি বের করতে হবে। নয়ন বাঁচলে বৌয়ের কথা ভাবা যাবে। নয়ন না বাঁচলেও ভাবা। যাবে। ভাবার জন্যে নয়ন লাগে না। বৌয়ের কথা সে অবশ্যি এম্নিতেও বিশেষ ভাবে না। শুধু হাজতে বা জেলখানায় থাকলেই তার কথা মনে আসে। তখন তার কথা ভাবতেও ভাল লাগে। মেয়েটার অবশ্যি কষ্টের সীমা ছিল না। সে জেলে গেলেই রাতদুপুরে চৌকিদার, থানাওয়ালা বাড়িতে উপস্থিত হত। বিষয় কি? খোঁজ নিতে আসছে মতি ঘরে আছে কি-না। সুন্দর একটা মেয়ে। খালি বাড়িতে থাকে। থানাওয়ালারা তো রাতদুপুরে সেই বাড়িতে যাবেই। বাড়িতে যাবে। পান খাবে। আরও কত কি করবে। ডাকাতের বৌ হল সবার বৌ। এই অবস্থায় কোন মেয়ে থাকে না। তার বৌ-টা তারপরেও অনেক দিন ছিল। মতি প্রতিবারই বাড়ি ফিরত আতংক নিয়ে। বাড়ির সামনে এসে মনে হত এইবার বাড়িতে ঢুকে দেখবে, বাড়ি খালি। কেউ নেই।

বৌ চলে গেছে গত বৈশাখ মাসে। কোথায় গেছে কেউ জানে না। পাড়ার কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছিল। কেউ বলতে পারে না। একজন বলল, অনেক দিন তো থাকল, আর কত? বাজারে গিয়া খোঁজ নেও। মনে হয় বাজারে ঘর নিছে। জগতের অনেক সত্যের মত এই সত্যও সে গ্রহণ করেছে সহজভাবে। চোর-ডাকাতের বৌদের শেষ আশ্রয় হয় বাজার। বাজারে তারা মোটামুটি সুখেই থাকে। মুখে রঙ-চঙ মেখে সন্ধ্যাকালে চিকন গলায় ডাকে, ও বেপারি, আহেন, পান-তামুক খাইয়া যান। শীতের দিন শইলডা গরম করন দরকার আছে।

অবসর পেলেই মতি আজকাল বাজারে-বাজারে ঘুরে। বৌটাকে পাওয়া গেলে মনে শান্তি। তাকে নিয়ে ঘর-সংসার আর করবে না। তাতে লাভ কি? বৌটা কোন এক জায়গায় থিতু হয়েছে এটা জানা থাকলেও মনে আনন্দ। মাঝে-মধ্যে আসা যাবে। আপনার মানুষের কাছে কিছুক্ষণ বসলেও ভাল লাগে। আপনার মানুষ সংসারে থাকলেও আপনার, বাজারে থাকলেও আপনার।

বৌ কেন্দুয়া বাজারে আছে এরকম একটা উড়া খবর শুনে মতি কেন্দুয়া এসেছিল। উড়া-খবর কখনো ঠিক হয় না। তার বেলা ঠিক হয়ে গেল। বৌ এখানেই আছে। নাম নিয়েছে মর্জিনা। বাজারে ঘর নিলে নতুন নাম নিতে হয়। মর্জিনার সঙ্গে দেখা করতে যাবার মুখে এই বিপদ।

.

আজান হচ্ছে। আছরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। মতি অনেক কষ্টে পাশ ফিরল। তারা চোখ কখন তুলবে? নামাজের আগে নিশ্চয়ই না। কিছুটা সময় এখনো হাতে আছে। এর মধ্যে কত কিছু হয়ে যেতে পারে। মহাখালি রেল স্টেশনে সে একবার ধরা পড়ল। তাকে মেরেই ফেলত। ট্রেনের কামরা থেকে একটা মেয়ে ছুটে নেমে এল। চিৎকার করে বলল, আপনারা কি মানুষটাকে মেরে ফেলবেন? খবর্দার, আর না। খবর্দার। মেয়েটির মূর্তি দেখেই লোকজন হকচকিয়ে গেল। লোকজনের কথা বাদ থাক, সে নিজেই হতভম্ব। জীবন বাঁচানোর জন্যে মেয়েটিকে সামান্য ধন্যবাদও দেয়া হয়নি। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। সেই মেয়ে চলে গেছে কোথায় না কোথায়।

আজ এই যে এত লোক চারপাশে ভিড় করে আছে এদের মধ্যেও নিশ্চয়ই কেউ -কেউ আছে ঐ মেয়েটির মত। সে অবশ্যই শেষ মুহূর্তে ছুটে এসে বলবে, করেন কি! করেন কি! আর এতেই মতির নয়ন রক্ষা পাবে। এইটুক বিশ্বাস তো মানুষের প্রতি রাখতেই হবে। মতি মিয়া অপেক্ষা করে। কে হবে সেই লোকটি? না জানি সে দেখতে। কেমন। সেই লোকটির চোখ কি ট্রেনের মেয়েটির চোখের মত মমতামাখা হবে? যে চোখের দিকে তাকালে ভাল হয়ে যেতে ইচ্ছা করে? মতি মিয়া চাপা উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করে, অপেক্ষা করতে তার ভালই লাগে।

নারিকেল-মামা

তার আসল নাম আমার মনে নেই।

আমরা ডাকতাম ‘নারকেল-মামা। কারণ নারকেল গাছে উঠে নারকেল পেড়ে আনার ব্যাপারে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। পায়ে দড়ি-টরি কিছু বাঁধতে হত না। নিমিষের মধ্যে তিনি উঠে যেতেন। নারকেল ছিঁড়তেন শুধু হাতে। তাঁর গাছে ওঠা, গাছ থেকে নামা, পুরো ব্যাপারটা ছিল দেখার মত। তাঁর নৈপুণ্য যে কোন পর্যায়ের তা দেখাবার জন্যেই একদিন আমাকে বললেন, এই পিঠে ওঠ। শক্ত কইরা গলা চাইপা ধর। আমি তাই করলাম। তিনি আমাকে নিয়ে তরতর করে নারকেল গাছের মগডালে উঠে দুই হাত ছেড়ে নানা কায়দা দেখাতে লাগলেন। ভয়ে আমার রক্ত জমে গেল। খবর পেয়ে আমার নানাজান ছুটে এলেন। হুংকার দিয়ে বললেন, হারামজাদা, নেমে আয়।

এই হচ্ছেন আমাদের নারিকেল-মামা। আত্মীয়ত-সম্পর্ক নেই। নানার বাড়ির সব ছেলেরাই যেমন মামা, ইনিও মামা। আমার নানার বাড়িতে কামলা খাটেন। নির্বোধ প্রকৃতির মানুষ। খুব গরম পড়লে মাথা খানিকটা এলোমেলো হয়ে যায়। কিংবা কে জানে মাথা হয়ত তার সব সময়ই এলোমেলো। শুধু গরমের সময় অন্যরা তা বুঝতে পারে।

নারিকেল-মামার মাথা এলোমেলো হবার প্রধান লক্ষণ হল–হঠাৎ তাঁকে দেখা যাবে গোয়ালঘর থেকে দড়ি বের করে হনহন করে যাচ্ছেন। পথে কারো সঙ্গে দেখা হল, সে জিজ্ঞেস করল, কই যাস?

নারিকেল-মামা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলবেন, ফাঁস নিব। উঁচা লম্বা একটা গাছ দেইখ্যা ঝুইল্যা পড়ব।

প্রশ্নকর্তা তাতে বিশেষ বিচলিত হয় না। বিচলিত হবার তেমন কারণ নেই। এই দৃশ্য তার কাছে নতুন নয়। আগেও দেখেছে। একবার না, অনেকবার দেখেছে। প্রশ্নকর্তা শুধু বলে, আচ্ছা যা। একবার জিজ্ঞেসও করে না, ফাঁস নেবার ইচ্ছেটা কেন হল।

তাঁর আত্মহননের ইচ্ছা তুচ্ছ সব কারণে হয়। তাকে খেতে দেয়া হয়েছে। ভাত তরকারি সবই দেয়া হয়েছে। কিন্তু লবণ দিতে ভুলে গেছে। তিনি লবণ চেয়েছেন। যে ভাত দিচ্ছে সে হয়ত শুনেনি। তিনি শান্তমুখে খাওয়া শেষ করলেন। পানি খেলেন। পান মুখে দিয়ে গোয়ালঘরে ঢুকে গেলেন দড়ির খোঁজে। এই হল ব্যাপার।

সবই আমার শোনা কথা। আমরা বছরে একবার ছুটির সময় নানার বাড়ি বেড়াতে যেতাম। থাকতাম দশ-পনেরো দিন। এই সময়ের মধ্যে নারিকেল-মামার দড়ি নিয়ে ছোটাছুটির দৃশ্য দেখিনি। তাকে আমার মনে হয়েছে অতি ভাল একজন মানুষ। আমাদের মনোরঞ্জনের চেষ্টায় তার কোন সীমা ছিল না। একটা গল্পই তিনি সম্ভবত জানতেন। সেই গল্পই আমাদের শোনাবার জন্যে তার ব্যস্ততার সীমা ছিল না। কাইক্যা মাছের গল্প।

এক দীঘিতে একই কাইক্যা মাছ বাস করত। সেই দীঘির পাড়ে ছিল একটা চাইলতা গাছ। একদিন কাইক্যা মাছ চাইলতা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে। হঠাৎ একটা চাইলতা তার গায়ে পড়ল। সে দারুণ বিরক্ত হয়ে বলল,

চাইলতারে চাইলতা তুই যে আমায় মাইলি?

উত্তরে চাইলতা বলল, কাঁইক্যারে কাঁইক্যা, তুই যে আমার কাছে আইলি?

এই হল গল্প। কেনই-বা এটা একটা গল্প, এর মানে কি আমি কিছুই জানি না। কিন্তু এই গল্প বলতে গিয়ে হাসতে হাসতে নারিকেল-মামার চোখে পানি এসে যেত। আমি তার কাছে এই গল্প বারবার শুনতে চাইতাম তার কাণ্ডকারখানা দেখার জন্যে।

সেবার রোজার ছুটিতে নানার বাড়ি গিয়েছি। তখন রোজা হত গরমের সময়। প্রচণ্ড গরম। পুকুরে দাপাদাপি করে অনেকক্ষণ কাটাই। আমরা কেউই সাঁতার জানি না। নারিকেল-মামাকে পুকুর পাড়ে বসিয়ে রাখা হয় যাতে তিনি আমাদের দিকে লক্ষ। রাখেন। তিনি চোখ-কান খোলা রেখে মূর্তির মত বসে থাকেন। একদিন এইভাবে বসে আছেন। আমরা মহানন্দে পানিতে ঝাপাচ্ছি, হঠাৎ শুনি বড়দের কোলাহল–ফাঁস। নিছে। ফাঁস নিছে।

পানি ছেড়ে উঠে এলাম। নারিকেল-মামা নাকি ফাঁস নিয়েছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। নানার বাড়ির পেছনের জঙ্গলে জামগাছের ডালে দড়ি হাতে নারিকেল-মামা বসে আছেন। দড়ির একপ্রান্ত জামগাছের ডালের সঙ্গে বাধা। অন্য প্রান্ত তিনি তার গলায় বেঁধেছেন। তিনি ঘোড়ায় চড়ার মত ডালের দুদিকে পা দিয়ে বেশ আয়েশ করে বসে। আছেন।

আমরা ছোটরা খুব মজা পাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা লোক দড়িতে ঝুলে মরবে, সেই দৃশ্য দেখতে পাব–এটা সে সময় আমাদের মধ্যে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। বড়রা অবশ্যি ব্যাপারটাকে মোটেও পাত্তা দিল না। আমার নানাজান বললেন, আজ গরমটা অতিরিক্ত পড়েছে। মাথায় রক্ত উঠে গেছে। তিনি নারিকেল মামার দিকে তাকিয়ে বললেন, নাম হারামজাদা! নারিকেল-মামা বিনীত গলায় বললেন, ‘জে না মামুজী। ফাঁস নিমু।‘

‘তোরে মাইরা আজ হাড্ডি গুঁড়া করব। খেলা পাইছস? দুইদিন পরে পরে ফাঁস নেওয়া। ফাঁস অত সস্তা। রোজা রাখছস?”

‘রাখছি।‘

‘রোজা রাইখ্যা যে ফাঁস নেওন যায় না এইটা জানস?”

‘জে না।‘

‘নাইম্যা আয়। ফাঁস নিতে চাস ইফতারের পরে নিবি। অসুবিধা কি? দড়িও তোর কাছে আছে। জাম গাছও আছে। নাম কইলাম। রোজা রাইখ্যা ফাঁস নিতে যায়! কত বড় সাহস! নাম।‘

নারিকেল-মামা সুড়সুড় করে নেমে এলেন। মোটেও দেরি করলেন না। আমাদের মন কি যে খারাপ হল। মজার একটা দৃশ্য নানাজানের কারণে দেখা হল না। নানাজানের ওপর রাগে গা জ্বলতে লাগল। মনে ক্ষীণ আশা, ইফতারের পর যদি নারিকেল-মামা আবার ফাঁস নিতে যান।

ইফতারের পরও কিছু হল না। খাওয়া-দাওয়ার পর নারিকেল-মামা হৃষ্টচিত্তে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। কোত্থেকে যেন একটা লাটিম জোগাড় করলেন। শহর থেকে আসা বাচ্চাদের খুশি করার জন্যে উঠোনে লাটিম খেলার ব্যবস্থা হল। আমি এক ফাঁকে বলেই ফেললাম, মামা, ফাঁস নিবেন না? তিনি উদাস গলায় বললেন, যাউক, রমজান মাসটা যাউক। এই মাসে ফাঁস নেয়া ঠিক না।

‘রমজানের পরে তো আমরা থাকব না। চলে যাব। আমরা দেখতে পারব না।‘

নারিকেল-মামা উদাস গলায় বললেন, এইসব দেখা ভাল না গো ভাইগ্না ব্যাটা। জিহ্বা বাইর হইয়া যায়। চউখ বাইর হইয়া যায়। বড়ই ভয়ংকর।

‘আপনি দেখেছেন?’

‘ভাইগ্না ব্যাটা কি কয়? আমি দেখব না! একটা ফঁসের মরা নিজের হাতে দড়ি কাইট্যা নামাইছি। নামাইয়া শইল্যে হাত দিয়ে দেখি তখনও শইল গরম। তখনও জান ভেতরে রইছে। পুরাপুরি কবজ হয় নাই।‘

‘হয়নি কেন?”

‘মেয়েছেলে ছিল। ঠিকমত ফাঁস নিতে পারে নাই। শাড়ি পেঁচাইয়া কি ফাঁস হয়? নিয়ম আছে না? সবকিছুর নিয়ম আছে। লম্বা একটা দড়ি নিবা। যত লম্বা হয় তত ভাল। দড়ির এক মাথা বানবা গাছের ডালে, আরেক মাথা নিজের গলায় ফাঁস গিটু বইল্যা একটা গিটু আছে। এইটা দিবা। তারপরে আল্লাহর কাছে তওবা কইরা সব। গোনার জন্যে মাফ নিবা। তারপর চউখ বন্ধ কইরা দিবা লাফ।‘

‘দড়ি যদি বেশি লম্বা হয় তাহলে তো লাফ দিলে মাটিতে এসে পড়বেন।‘

‘মাপমত দড়ি নিবা। তোমার পা যদি মাটি থাইক্যা এক ইঞ্চি উপরেও থাকে তাইলে হবে। দড়ি লম্বা হইলে নানান দিক দিয়া লাভ। দশের উপকার।

দড়ি লম্বা হলে দশের উপকার কেন তাও নারিকেল-মামা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করলেন।

‘ফঁসের দড়ি নানা কাজে লাগে বুঝলা ভাইগ্না ব্যাটা? এই দড়ি সোনার দড়ির চেয়েও দামী। এক টুকরা কাইট্যা যদি কোমরে বাইন্ধ্যা হয় তা হইলে বাত-ব্যাধির আরাম হয়। ঘরের দরজার সামনে এক টুকরা বাইন্ধ্যা থুইলে ঘরে চোর-ডাকাত ঢোকে না। এই দড়ি সন্তান প্রসবের সময় খুব কাজে লাগে। ধর, সন্তান প্রসব হইতেছে না–দড়ি আইন্যা পেটে ছুঁয়াইবা, সাথে সাথে সন্তান খালাস।‘

‘সত্যি?

‘হ্যাঁ সত্যি। ফাঁসির দড়ি মহামূল্যবান। অনেক ছোট ছোট পুলাপান আছে বিছানায় পেসাব কইরা দেয়। ফঁসের দড়ি এক টুকরা ঘুনসির সাথে বাইন্ধ্যা দিলে আর বিছানায় পেসাব করব না। এই জন্যেই বলতেছি, যত লম্বা হয় ফঁসের দড়ি ততই ভাল। দশজনের উপকার। ফাঁস নিলে পাপ হয়। আবার ফঁসের দড়ি দশজনের কাজে লাগে বইল্যা পাপ কাটা যায়। দড়ি যত লম্বা হইব পাপ তত বেশি কাটা যাইব। এইটাই হইল ঘটনা। মৃত্যুর পরে পরেই বেহেশতে দাখিল।‘

নারিকেল-মামার মৃত্যু হয় পরিণত বয়সে। ফাঁস নিয়ে না–বিছানায় শুয়ে। শেষ জীবনে পক্ষাঘাত হয়েছিল, নড়তে-চড়তে পারতেন না। চামচ দিয়ে খাইয়ে দিতে হত। মৃত্যুর আগে গভীর বিষাদের সঙ্গে বলেছিলেন–আল্লাহপাক আমার কোন আশা পূরণ করে নাই। ঘর দেয় নাই, সংসার দেয় নাই। কিছুই দেয় নাই। ফাঁস নিয়া মরণের ইচ্ছা ছিল এটাও হইল না। বড়ই আফসোস!

নুহাশ এবং সে

মাঝে মাঝে খুব সাধারণ কিছু দৃশ্য আমাকে অভিভূত করে। দারুণ মন খারাপ করিয়ে দেয়। বরিশাল থেকে লঞ্চে করে ঢাকায় আসছি। সাধারণত ঢাকা-বরিশাল লঞ্চগুলি রাতে চলাচল করে। এক সময় দিনেও লঞ্চ ছিল। আমি নদীর দু’পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে আসব ভেবে দিনের লঞ্চ নিয়েছি। বসেছি ছাদে। প্রচুর বাতাস, প্রচুর রোদ গায়ে মাখছি, চমৎকার লাগছে। হাওয়া এবং রোদ বোধহয় ক্ষুধা বৃদ্ধিতে কাজ করে। দুপুর একটায় ক্ষুধার্ত হয়ে নিচে নামলাম। গরম ভাত, টাটকা ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে দুপুরের খাবার সারলাম। লঞ্চের রান্নার কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে–হোটেলের মত এরা প্রচুর মশলা দেয় না। কম মশলায় রাঁধে এবং যত্ন করে রাঁধে। ভরপেট খাবার পরেও খিদে থাকে।

আমি তৃপ্তি করে খেলাম। খাবার পর ডবল পান মুখে দিলাম, সিগারেট ধরালাম, আর তখনি অভিভূত হবার মত দৃশ্যটি দেখলাম। একজন দরিদ্র যাত্রী দুপুরের খাবার। খাচ্ছে। একটা পাউরুটি তার হাতে। পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখে দিচ্ছে। অভিভূত হবার মত কোন দৃশ্য নয়। আমাদের এই হতদরিদ্র দেশে শুধু ভাত, শুধু রুটি দিয়ে দুপুরের খাবার অনেকেই খায়। এই দৃশ্য কোন অপরিচিত দৃশ্য নয়। আমরা সব সময় দেখছি। কিন্তু আজকের দৃশ্যটিতে অন্য ব্যাপার আছে। প্রথমত, মানুষটি পাউরুটি খুব আগ্রহ করে খাচ্ছে। তার সমস্ত চিন্তা-চেতনা পাউরুটিতে সীমাবদ্ধ। আশেপাশের জগৎ থেকে সে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। তাকে দেখেই মনে হয়–এই শুকনো পাউরুটি চিবিয়ে সে প্রচুর আনন্দ পাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, মানুষটি খেতে বসেছে বেশ আয়োজন করে। তার সামনে কাঁচের গ্লাস ভর্তি পানি। গ্লাসটার উপর একটা পিরিচ বসানো। সেই পিরিচে এক খিলি সাজানো পান।

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত লোকটির খাওয়া দেখলাম। খাওয়া শেষে গভীর তৃপ্তিতে তার পানি খাওয়া দেখলাম। পান মুখে পুরতে দেখলাম। পান মুখে দেয়া মানুষটিকে মনে হল এই পৃথিবীর সুখী মানুষদের একজন। আমার কাছে মনে হতে লাগল, আহা, এই মানুষটা যদি ইলিশ মাছের টাটকা ঝোল দিয়ে গরম গরম ভাত খেতে পারত তাহলে কি গভীর আনন্দেই না সে খেত! এই ঘটনা আমি অনেককে বলেছি, তাদের কেউই বুঝতে পারেনি অভিভূত হবার মত এর মধ্যে কি আছে? আমার এক বন্ধু বললেন–এটা। হচ্ছে এক ধরনের দুঃখবিলাস।, দরিদ্র মানুষের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে উচ্চবিত্তের মিথ্যা দুঃখ। শখের দুঃখ।

আমি বললাম, মিথ্যা হবে কেন?

সে বলল, মিথ্যা, কারণ তুমি যদি এতই অভিভূত, তাহলে তুমি তাকে বলতে পারতে–ভাই, আপনি আসুন তো, ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাবেন। আমি পয়সা দেব। তুমি তা বলনি। তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছ। অন্যের দুঃখ নিয়ে বিলাস করেছ।

বন্ধুর সঙ্গে আমি তর্কে যাইনি। যেতে পারতাম। ফট করে একজনকে বলা যায় না–আপনি ভাত খান, আমি পয়সা দেব। এই কাজটি তখন করা যায় যখন কেউ খেতে চায়। তাছাড়া ঐ মানুষটি নিজের অর্থে কেনা সামান্য খাবার অতি আগ্রহ করে খাচ্ছে–সেখানে আমি উপদ্রবের মত উপস্থিত হয়ে তার খাওয়া নষ্ট করতে পারি না। আমার প্রস্তাবে লোকটি বলে বসতে পারত–আপনি আমাকে খাওয়াবেন কেন? আপনি। কে? আমি কি আপনার কাছে ভিক্ষা চেয়েছি?

কেউ হয়ত আমার সঙ্গে একমত হবেন না, কিন্তু তবু আমার সব সময় মনে হয় দয়া দেখানোর মধ্যেও এক ধরনের দীনতা আছে। আমি দয়া দেখাচ্ছি, কারণ আমার অনেক আছে। ‘আমার অনেক আছে’–চিন্তাটাই তো এক ধরনের দীনতা।

আমার ছোটভাই গত বছর আমেরিকা থেকে আমার মা’র নামে এক হাজার ডলার পাঠিয়ে দিল। ডলারের সঙ্গে একটা ছোট্ট চিঠি।

আম্মা, আপনাকে এক হাজার ডলার পাঠালাম। একটা বিশেষ উদ্দেশে ডলার পাঠানো হয়েছে। আমি অনেকদিন দেশের বাইরে আছি। এখানে দান-খয়রাতের তেমন সুযোগ নেই। কেন জানি কিছু দান করতে ইচ্ছা করছে–আপনি ডলার ভাঙিয়ে যে টাকা পাবেন তা দরিদ্র মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দেবেন। তবে আমাদের দরিদ্র আত্মীয়স্বজনদের এই টাকাটা দেবেন না। আমি টাকা পাঠিয়েছি যারা সত্যিকার অর্থেই ভিক্ষুক–তাদের জন্যে।

মা ডলার ভাঙিয়ে প্রায় আটত্রিশ হাজার টাকার মত পেলেন। অনেক টাকা। ফকিরকে ভিক্ষা দেয়ার জন্যে তো প্রচুরই বলা চলে। এক সপ্তাহ ধরে মা সেই টাকা বিলি করলেন। মা’কে সাহায্য করল আমার সবচে’ ছোট ভাইয়ের স্ত্রী। দু’জনকেই দেখলাম ব্যাপারটায় প্রচুর আনন্দ পাচ্ছে। ফকির ভিক্ষা চাইতে আসে। তার চেহারা, কাপড়-চোপড় দেখে বিবেচনা করা হয় কি পরিমাণ সাহায্য তাকে দেয়া যায়। কেউ পায় ৫০ টাকা, কেউ একশ’। দু’-একজন মহাসৌভাগ্যবান পায় ৫০০ টাকা। এসব ক্ষেত্রে যা হয়–দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়ে–এবং হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে। মহা বিশৃঙ্খলা, মহা ভিড়ে–কেউ কেউ মারাও যায়। আমিও আশংকা করেছিলাম এরকম কিছু হবে। কেন জানি হল না। মা এক জায়গা থেকে টাকা না দিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিলেন বলেই খবরটা তেমন জানাজানি হল না।

টাকা বিলি শেষ হবার পর একদিন মা’র কাছে গিয়েছি। তিনি খুব উৎসাহ নিয়ে গল্প করছেন–টাকা পাবার পর একেক জনের কি অবস্থা হল। আমার তখন মনে। হল–এই দানে যে আনন্দ আমার মা পেলেন তা অন্যকে সাহায্য করার আনন্দ নয়। ক্ষমতার আনন্দ, এই আনন্দের সঙ্গে কিছুটা হলেও দীনতা মিশে আছে।

অন্যের দুঃখে অভিভূত হয়ে যে দান করা হয় তাতে দীনতার গ্লানি থাকে না। সেই আনন্দের ভাগ আমাদের ভাগ্যে জুটে না বললেই হয়। আমি দেখেছি, অন্যের দুঃখে অভিভূত হয়ে যে দান করা হয় তার বড় অংশই করা হয় সাময়িক ঝোঁকের মাথায়। ঝোঁক কেটে গেলে মনে হয়–এটা কি করলাম?

উদাহরণ দেই–আমার এক দূর সম্পর্কের মামার গল্প। তিনি একবার গুলিস্তান থেকে রিকশা করে ফিরছেন–প্রচণ্ড শীতের রাত। হঠাৎ লক্ষ করলেন, ফুটপাতে এক ভিখিরি-পরিবার ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে শুয়ে আছে। তাদের সম্বল একটামাত্র কাঁথা। কাঁথায় সবার হচ্ছে না। তারা টানাটানি করছে। মামার মন খুব খারাপ হল। বাসায় পৌঁছে কাউকে কিছু না বলে তাঁর নিজের লেপ নিয়ে রওনা হলেন। মামী বললেন, কি করছ তুমি? লেপ নিয়ে কোথায় যাচ্ছ? তিনি বললেন, চুপ করে থাক। কথা বলবে না। তিনি ওদের লেপ দিয়ে এসে বাসায় ফিরলেন। ততক্ষণে তাঁর ঝোঁক কেটে গেছে। তিনি হায় হায় করছেন–ছয়শ’ টাকা খরচ করে নতুন লেপ বানানো হয়েছে–লেপটা দেয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না। ত্রিশ টাকা দিয়ে একটা পুরানো কম্বল কিনে দিলেই যথেষ্ট হত।

এ জাতীয় ঘটনা আমার নিজের বেলাতেও ঘটেছে। তখন শহীদুল্লাহ হলে থাকি। সন্ধ্যাবেলায় একজন অন্ধ ছেলে এসে উপস্থিত। আমার কাছে সে নালিশ করতে। এসেছে। নালিশ করতে এসেছে অন্ধ কল্যাণ সমিতির বিরুদ্ধে। সে বল পয়েন্টের ব্যবসা করে। বল পয়েন্ট কিনে ছাত্রদের কাছে বিক্রি করে। অন্ধ কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি তাঁকে বলেছিলেন–ব্যবসার জন্যে টাকা দেবেন। এখন দিচ্ছেন না। আমি যদি সেক্রেটারিকে কিছু বলে দেই তাহলে সে টাকাটা পায়। কারণ সেক্রেটারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অন্ধ ছাত্র। আমি দেখলাম–বিরাট যন্ত্রণা। সেক্রেটারীকে কিভাবে পাব? তাকে বলবই বা কি? অন্ধ ছেলেটির জন্যেও মায়া লাগছে। বেচারা কাঁদতে শুরু করেছে। আমি বললাম, ব্যবসা করতে ক্যাপিটেল কত লাগে?

সে বলল, তিনশ’ টাকা স্যার।

আমি বিস্মিত। মাত্র তিনশ’ টাকা ক্যাপিটেলে ব্যবসা? মানিব্যাগ খুলে তিনশ’র বদলে তাকে পাঁচশ টাকা দিয়ে দিলাম। সে খুশি হয়ে কাঁদতে কাঁদতেই বিদেয় হল। তখন আমার মনে হল–তিনশ’ দিলেই তো হত। দুশ টাকা বাড়তি কেন দিলাম? মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল।

কেন আমাদের মধ্যে এই ক্ষুদ্রতা? আমরা কি এই ক্ষুদ্রতার উর্ধ্বে উঠতে পারি না? কেন পারি না?

এক দুপুরের কথা। দরজার কড়া নড়ছে। দরজা খুলে দেখি তিনজন ভিখিরি শিশু। সবচে’ বড়টির বয়স সাত-আটের বেশি না। তার কোলে দু’বছর বয়সী একজন। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে তিনজনের মুখই আনন্দে উদ্ভাসিত। তারা জানালো, ভাত লাগবে না। তাদের প্রচুর ভাত আছে। শুধু তরকারি হলেই তারা এখানে বসে খেয়ে নেবে। তরকারি না হলেও অসুবিধা নেই–ডাল দিলেই হবে। তাদের তরকারি দেয়া হল। ইতিমধ্যে আমাদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছে। ওদের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল এখনো তাদের খাওয়া হয়নি। ডাল এবং তরকারি নিয়ে বসে আছে। সমস্যাটা কি?

সমস্যা হল ভাত নিয়ে। এদের ভাত আছে ঠিকই–কিন্তু তারা খেতে পারছে না, কারণ ভাত বরফের মত শক্ত হয়ে আছে। এক দলা ভাত, ডীপ ফ্রীজে রাখায় জমে পাথর হয়ে আছে। দু-তিন ঘণ্টার আগে এই ভাত মুখে দেয়া যাবে না। বাচ্চারা বরফের দলায় কামড় বসানোর চেষ্টা করেছে–লাভ হয়নি। দাঁত বসানো যাচ্ছে না।

আমাদের বাসায় দেবার মত ভাত নেই। দিতে হলে নতুন করে ভাত চড়াতে হবে। আমি তাই করতে বললাম। হোক গরম ভাত, রান্না হোক–এরা এক বেলা অন্তত। আরাম করে খাক। ভাত রান্না করে দেয়া হল। কিন্তু এর মধ্যে এরা ডাল এবং তরকারি চেটেপুটে খেয়ে ফেলেছে। তাতে এদের অসুবিধা হল না–গরম ভাতই শুধু শুধু মুখ ভর্তি করে খাচ্ছে। দু’বছরের শিশুটিও মহানন্দে ভাত চিবুচ্ছে। এ কোন অদ্ভুত পৃথিবী!

আমরা বিশ্বাস করি–পৃথিবীর সব মানুষ একই বাব-মাসন্তান। আমাদের আদি পিতা হযরত আদম, আদি মাতা বিবি হাওয়া। একই বাবা-মা’র সন্তান হয়েও আজ আমরা এমনভাবে আলাদা হয়ে পড়লাম কি করে? একদলের কাপড় প্যারিস থেকে ধুইয়ে আনতে হয়, আরেকদলের কোন কাপড়ই নেই।

কাপড় প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বলি–আমার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান নুহাশ-এর জন্ম হয়। শীতকালে। মাঘ মাসের দুর্দান্ত শীত। শীতের বিরুদ্ধে সব ব্যবস্থা নেয়া হল। দুটি রুম হিটার। নরম লেপ, মাথায় কান-ঢাকা টুপি, হাতে-পায়ে নরম উলের মোজা। সাধ্য কি শীত তাকে স্পর্শ করে? তবু সারাক্ষণ ভয়–এই বুঝি ঠাণ্ডা লেগে গেল। এই বুঝি বুকে কফ বসে গেল। আরো গরম কাপড় দরকার। খবর পাওয়া গেল, গুলশান মার্কেটে স্লীপিং ব্যাগ জাতীয় এক ধরনের কম্বল পাওয়া যায়। বাচ্চাকে ভেতরে ঢুকিয়ে বোতাম লাগিয়ে দিলে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত।

গেলাম ব্যাগ কিনতে। ফেরার পথে দেখি ঠিক আমার ছেলের বয়েসী একটি ছেলেকে তার মা মেঝেতে শুইয়ে রেখেছে। বাচ্চাটা আছে চটের বস্তার ভেতর। বস্তায় একটা ফুটো করা হয়েছে। ফুটোর ভেতর দিয়ে বাচ্চাটার ফর্সা মুখ বের হয়ে আছে–সে চোখ বড় বড় করে দেখছে চারপাশের অকরুণ পৃথিবী।

আমার প্রচণ্ড ইচ্ছা হল–নতুন কেনা স্লীপিং ব্যাগ জাতীয় কম্বলটি এই বাচ্চাটিকে দিয়ে দেই। তারই এটি বেশি দরকার। মা তার বাচ্চাটিকে এর ভেতর ভরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারবে। তারা থাকবে খোলা বারান্দায়–শীতের প্রচণ্ড হাওয়া এই ব্যাগ ভেদ করে বাচ্চাটির গায়ে পৌঁছতে পারবে না।

আমি নিজেকে সামলে নিলাম। নিজেকে বুঝালাম, এদের এই জিনিস দিয়ে কোন লাভ হবে না। ভিখিরী-মা সঙ্গে সঙ্গে অন্যের কাছে এটা বিক্রি করে দেবে। তাছাড়া বাচ্চাটির শীতের সঙ্গে যুদ্ধ করে বড় হওয়া দরকার–কারণ তার জন্যে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।

নিতান্তই বাজে যুক্তি। নিজের অপরাধবোধ ঢাকার জন্যে তৈরি করা মিথ্যা যুক্তি। তারপরেও মনটা খারাপ হয়ে রইল। গরম কাপড়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢাকা আমার বাচ্চাটির দিকে তাকালেই মনে হত, আরেকটি শিশু আছে যে দেখতে ঠিক তার মত, হয়ত জন্মও হয়েছে একই দিনে–সে খালি গায়ে বাস করছে। তার হতদরিদ্র মা তার শরীরের সবটুক উত্তাপ বাচ্চাটিকে দিতে চেষ্টা করছে। আজকের অতি আধুনিক, সুসভ্য পৃথিবীতে ঐ শিশুটির সম্বল শুধু মা’র বুকের সামান্য উত্তাপ।

পরীক্ষা

একটা নির্দিষ্ট বয়সের বাবা-মা’রা মনে করতে শুরু করেন তাদের ছেলেমেয়েরা বোধহয় তাদের আর ভালবাসে না, বোধহয় তারা এখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নিজেদের সংসার। নিয়ে নিজেদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে। তবে এই ব্যাপারে তারা পুরোপুরি নিশ্চিতও হতে পারেন না। এক ধরনের সন্দেহ থাকে–হয়ত এখনো ভালবাসে। হয়ত বাবা মা’র প্রতি ভালবাসা নিঃশেষ হয়নি। এই সংশয়-জড়ানো দোদুল্যমান সময়ে বাবা-মা’রা নানান ধরনের ছোটখাট পরীক্ষা করতে থাকেন। ছেলেমেয়েদের ভালবাসা এখনো। আছে কি-না তা নিয়ে পরীক্ষা। পরীক্ষার ফলাফল নিয়েও তারা সংশয়ে ভুগেন। কোন ফলাফলই তাদের ১০০ ভাগ নিশ্চিত করতে পারে না।

আমার মা বর্তমানে এ জাতীয় মানসিক অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তার ছ’টি ছেলেমেয়েকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছেন। তাদের আচার-আচরণ থেকে ধরার চেষ্টা করছেন–ছেলেমেয়েদের মধ্যে তার প্রতি ভালবাসা কতটুকু অবশিষ্ট আছে।

ভালবাসা মাপার মত কোন যন্ত্র আমাদের হাতে আসেনি। সমস্যাটা এইখানেই। ভালবাসা ধরতে হয় আচার-আচরণে–হাক-ভাবে। একজনের আচার-আচরণের সঙ্গে অন্যের আচার-আচরণের কিছুমাত্র মিল নেই বলে ভালবাসার প্রমাণ সংগ্রহ করাও এক সমস্যা। কাজেই আমার মা নানান ধরনের পরীক্ষা শুরু করলেন।

যেমন অনেকদিন পার করে আমার বাসায় এলেন। রাতে না খেয়ে শুয়ে পড়লেন। বললেন, শরীর ভাল না। উদ্দেশ্য–দেখা, তার ছেলে এই খবরে কতটা বিচলিত হয়। সে কি সাধাসাধি করে খেতে বসায়, না নির্বিকার থাকে। না-কি অতি ব্যস্ত হয়ে ডাক্তার ডেকে আনে।

এই জাতীয় পরীক্ষায় আমি কখনো পাস করতে পারি না। আমার অন্য ভাই বোনরাও পারে না। সবাই ভাব করে, বয়স হয়েছে, এখন শরীর তো খারাপ করবেই।

শুধু আমার সর্বকনিষ্ঠ ভাই মায়ের অতিরিক্ত ভক্ত বলে ব্যস্ত হয়ে উঠে। জোর করে। তাকে টেবিলে এনে খাওয়ায়–খাওয়াতে না পারলে তৎক্ষণাৎ ডাক্তার আনতে যায়। তার একজন পরিচিত প্র্যাকটিসহীন ডাক্তার আছেন। যাকে যে কোন সময় কল দিলে। চলে আসেন। আমাদের মধ্যে মা’র ভালবাসা পরীক্ষায় সেই শুধু অনার্সসহ পাস। আমরা ফেল।

আমার বন্ধু মোজাম্মেল হোসেন সাহেবের মাও এই আমার মা’র মতই ছেলেমেয়েদের ভালবাসা আছে কি নেই পরীক্ষা শুরু করেছেন। তিনি শারীরিকভাবে বেশ সুস্থ। তবু একদিন দেখা যায়, কোন এক ছেলে বা মেয়ের কাছে গিয়ে অকারণে অনেকক্ষণ কাশলেন, হাঁচলেন। নিজেই নিজের কপালের উত্তাপ দেখলেন। তার উদ্দেশ্য–ছেলেমেয়েরা কেউ তার আচার-আচরণ দেখে জিজ্ঞেস করে কি-না–মা তোমার কি শরীর খারাপ? কি আশ্চর্য! তোমার শরীর খারাপ আমাদের বলবে না? দেখি কাপড় পর, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।

তিনি বিরস গলায় বললেন, বাদ দে, ডাক্তারের কাছে কি নিবি! বয়স হয়েছে, গলায় রোগ-ব্যাধি তো হবেই।

‘কথা বলে সময় নষ্ট করো না তো মা। কাপড় পর। ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।‘

তিনি আনন্দিত চিত্তে কাপড় পরতে চলে যান। ছেলেমেয়েরা তাকে ভালবাসে এই। ব্যাপারে নিশ্চিত হন।

আমার বন্ধু এবং বন্ধুর বোনরা তাঁদের মা’র এই ব্যাপারটা জানেন। তারা এখন নিয়ম করে সবাই তাদের মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। একেক জনের একেক ডাক্তার। মা মহাখুশি। তার সময় কাটে ডাক্তারের কাছে ঘুরে ঘুরে।

আমার মা’র প্রসঙ্গে ফিরে আসি–তিনি আমাদের নিয়ে অনেক ছোটখাট পরীক্ষা করলেন। বেশির ভাগ পরীক্ষার ফল হল–অনিশ্চিত। নিশ্চিত পরীক্ষা দরকার। কাজেই তিনি সেই পরীক্ষার জন্যে তৈরি হলেন। এক সন্ধ্যায় শুনলাম, তিনি বেশ কিছুদিন দেশের বাড়িতে গিয়ে থাকবেন। তিনি হয়ত ভেবেছিলেন, এটা শুনেই তার ছেলেমেয়েরা চেঁচিয়ে উঠবে–আরে না, অসম্ভব! আপনি দেশে যাবেন কি? না না, দেশে যেতে হবে না। ..

কিন্তু তা বলা হল না। মা দেশে চলে গেলেন। আর ফেরার নাম নেই। সাত দিনের বেশি যে মহিলা তার ছেলেমেয়েদের না দেখে থাকতে পারেন না তিনি এক মাস কাটিয়ে দিলেন। ভাবলেন, ছেলেমেয়েরা খোঁজখবর করবে। আসতে না পারলেও চিঠি দেবে। না, কেউ চিঠিও দিল না। তিনি নিজেই লজ্জার মাথা খেয়ে সবার কাছে চিঠি লিখলেন–অতি সংক্ষিপ্ত পত্র।

‘আমি ভাল আছি। আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে না। নামাজ পড়বে।
সর্বদা আল্লাহপাককে স্মরণ করবে। ইতি তোমার মা।‘

আমরা কেউ সেই চিঠির জবাব দিলাম না। আসলে মা’র অভিমানের গুরুত্বই কেউ ধরতে পারলাম না। এই বয়সে তিনি যে ছেলেমেয়েদের এক জটিল পরীক্ষায় ফেলবেন। সেটা কে অনুমান করবে? আমরা ভাবলাম, নিজের বাড়িতে থাকতে মা’র নিশ্চয় খুব ভাল লাগছে। ভাল না লাগলে তো চলেই আসবেন।

দু মাস কেটে গেল। আমার ছোট মেয়ে একদিন বলল, আজ রাতে দাদীকে স্বপ্নে দেখেছি। দাদীকে দেখতে ইচ্ছা করছে। তখন আমার মনে হল, আরে তাই তো–অনেক দিন মা’কে দেখি না। বাসাটা খালি। আচ্ছা চল, মাকে ধরে নিয়ে আসি। মাইক্রোবাস নিয়ে চলে যাই ময়মনসিংহ। সবাইকে খবর দেয়া যাক। ক্ষীণ একটা আপত্তি উঠল–এই গভীর রাতে বাস নিয়ে এতদূর যাওয়াটা কি ঠিক হবে? সেই আপত্তি বাচ্চাদের উৎসাহের কাছে টিকল না। এক্ষুনি যেতে হবে। এক্ষুনি। রাত এগারোটায় বাস ভর্তি করে আমরা সব ভাই-বোন, তাদের বাচ্চা কাচ্চারা রওনা হলাম।

ময়মনসিংহ পৌঁছলাম রাত দুটায়। মা তার এক ভাইয়ের বাসায় আছেন। সেই বাসার ঠিকানা জানা নেই। ঠিকানা খুঁজে বাসা বের করতে করতে রাত তিনটা বেজে গেল। রাত তিনটায় কড়া নেড়ে মার ঘুম ভাঙানো হল।

বাচ্চা-কাচ্চারা চেঁচিয়ে বলল, দাদীমা, তোমাকে নিতে এসেছি।

মা’র চোখ ভিজে উঠল। তিনি কপট বিরক্তিতে বললেন, এদের যন্ত্রণায় অস্থির হয়েছি। কোথাও গিয়ে যে শান্তিমত দু-একটা দিন থাকব সেই উপায় নেই। রাত তিনটার সময় উপস্থিত হয়েছে। ছেলেমেয়েগুলিরও কাণ্ডজ্ঞান বলতে কিছু নেই–রাত তিনটায় দুধের বাচ্চা নিয়ে সব রওনা হয়েছে। রাস্তায় যদি বিপদ-আপদ কিছু ঘটতো? এদের বুদ্ধিশুদ্ধি কি কোন কালেই হবে না?

মা তার বুদ্ধিশুদ্ধি এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন ছেলেমেয়েদের বকাঝকা করতে করতে নিজের ব্যাগ গুছাতে শুরু করেছেন। ছেলেমেয়েদের ভালবাসা টের পাবার যে কঠিন পরীক্ষা মা শুরু করেছিলেন আমরা সবাই সেই পরীক্ষায় ফেল করতে করতে ভাগ্যক্রমে লেটার মার্ক পেয়ে পাস করে গেলাম।

ঢাকায় ফেরার পথে মনে হল, এই দিন খুব দূরে নয় যখন ভালবাসার পরীক্ষা নেবার কেউ থাকবে না। পরীক্ষায় পাস-ফেল নিয়ে আমাদের চিন্তিত হতে হবে না। আমরা সবাই নিজের নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকার অফুরন্ত সুযোগ পাব।

বাসের পেছনের সীটে দাদীর পাশে কে বসবে তা নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। মা’র গলা শুনতে পাচ্ছি–তোরা কি যে যন্ত্রণা করিস! এই জন্যেই মাঝে-মধ্যে তোদের ছেড়ে, চলে যাই।

পেট্রিফায়েড ফরেস্ট

অভিশাপে পাথর হয়ে যাবার ব্যাপার রূপকথার বই-এ পাওয়া যায়। ঐ যে দুষ্ট যাদুকর রাজকন্যাকে পাথর বানিয়ে ফেলল। বছরের পর বছর রোদ-বৃষ্টিতে পড়ে রইল সেই পাথরের মূর্তি। তারপর এক শুভক্ষণে রাজপুত্র এসে তাকে অভিশাপমুক্ত করল। পাথরের মূর্তি প্রাণ ফিরে পেল। তারা দু’জন সুখে শান্তিতে জীবন কাটাতে লাগল।

শৈশবের রূপকথার গল্পকে গুরুত্ব দেবার কোন কারণ নেই, কিন্তু যৌবনে আবার শৈশবের গল্প নতুন করে পড়লাম। উপন্যাসটির নাম “পেট্রিফায়েড ফরেস্ট” অর্থাৎ প্রস্তরীভূত অরণ্য। এই উপন্যাসের তরুণ নায়ক সন্ধ্যাবেলা বিষণ্ণ মুখে ‘পেট্রিফায়েড ফরেস্ট’-এ ঘুরে বেড়ায়। চারদিকে পাথরের গাছপালা। তার মাঝে পাথরের মত মুখ করে এ যুগের নায়ক বসে থাকে। আমার কাছে মনে হয়, এ কী ছেলেমানুষি! রূপকথার পাথরের অরণ্য এই যুগে কোত্থেকে আসবে? পাথরের অরণ্য থাকতে পারে না।

আমার অনেক ধারণার মত এই ধারণাও পরবর্তীতে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়। প্রস্তরীভূত অরণ্য দেখার দুর্লভ সৌভাগ্য হয়। সেই গল্প বলা যেতে পারে।

তখন থাকি আমেরিকার নর্থ ডাকোটায়। সংসার ছোট–আমি, আমার স্ত্রী এবং একমাত্র মেয়ে নোভা। টিচিং অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে মাসে চারশ’ ডলারের মত পাই। দিনে আনি দিনে খাই অবস্থা। ঘুরে বেড়ানোর প্রচণ্ড শখ। শখ মেটানোর উপায় নেই। খুবই খরচান্ত ব্যাপার। আমেরিকা বিশাল দেশ। দেখার জিনিস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তখনো কিছুই দেখা হয়নি। ছ’শ ডলার দিয়ে লক্কড় মার্কা একটি ফোর্ড গাড়ি কিনেছি। সেই গাড়ি নিয়ে বেরুতে সাহস হয় না। ইঞ্জিন গরম হলেই এই গাড়ি মহিষের মত বিচিত্র শব্দ করে।

এই অবস্থায় বেড়াতে যাবার নিমন্ত্রণ পেলাম। আমার পাশের ফ্ল্যাটের মালয়েশিয়ান ছাত্র এক সকালে এসে বলল, আহমাদ, আমি গতকাল একটা নতুন গাড়ি কিনেছি–শেলেট। পাঁচ হাজার ডলার পড়ল।

আমি বললাম, বাহ, ভাল তো!

‘এখন ঠিক করেছি গাড়িটা লং রুটে টেস্ট করব। গাড়ি হচ্ছে স্ত্রীর মত। স্ত্রীকে যেমন পোষ মানাতে হয়, গাড়িকেও পোষ মানাতে হয়। আমি আজ সন্ধ্যায় রওনা হচ্ছি সাউথ ডাকোটায়।‘

‘খুব ভাল।‘

‘তুমিও আমার সঙ্গে যাচ্ছ। তোমার সঙ্গে যদিও আমার তেমন পরিচয় নেই, তবু তুমি আমার প্রতিবেশী। তুমি যেমন মুসলমান, আমিও মুসলমান। অবশ্য আমি খারাপ মুসলমান, নিয়মিত মদ খাই।‘

আমি মালয়েশিয়ান ছেলেটির কথাবার্তায় চমৎকৃত হলাম। সে বলল, আমি তোমার নাম জানি, কিন্তু তুমি আমার নাম জান না। দশ ডলার বাজি। বল দেখি

আমার নাম কি?

আমি বললাম, ‘আইজেক।‘

‘আইজেক হচ্ছে আমার ছেলের নাম। আমার নাম আবদাল। যাই হোক, তুমি তৈরি থেকো। ঠিক সন্ধ্যায় আমরা রওনা হব।

আমি বললাম, নতুন গাড়িতে যাচ্ছ, তোমার স্ত্রী এবং ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গেলেই তো ভাল হবে।

‘মোটেই ভাল হবে না। তুমি আমার স্ত্রীকে চেন না। ওকে আমি সহ্য করতে পারি না। তাছাড়া তোমাকে আগেই বলেছি, গাড়ি হচ্ছে স্ত্রীর মত। দু’জন স্ত্রীকে নিয়ে বের হওয়া কি ঠিক?’

আমি আবদালের লজিকে আবারো চমৎকৃত হলাম। তাকে বিনীতভাবে বললাম, আমার পক্ষে আমার স্ত্রী ও কন্যাকে ফেলে একা একা বেড়াতে যাওয়া সম্ভব হবে না। ওদের মন খারাপ হবে। আমারও ভাল লাগবে না।

আবদাল বিমর্ষ মুখে চলে গেল। আমার স্ত্রী গুলতেকিন বলল, ওর সঙ্গে যেতে রাজি না হয়ে খুব ভাল করেছ। পাগল ধরনের লোক। তবে ওর বউটা খুব ভাল। তার নাম ‘রোওজি’। এমন ভাল মেয়ে আমি কম দেখেছি। চেহারাও রাজকন্যাদের মত।

বিকেলে আবদাল আবার এল। তার মুখের বিমর্ষ ভাব দূর হয়েছে। সে হাসিমুখে বলল, ঠিক আছে, তুমি তোমার স্ত্রী এবং কন্যাকে নিয়ে নাও। আমি আমারটাকে নিচ্ছি। ঘুরে আসি।

আমি বললাম, এত মানুষ থাকতে তুমি আমাকে নিতে আগ্রহী কেন? আবদাল বলল, অনেকগুলি কারণ আছে–তুমি আমার প্রতিবেশী, তুমি মুসলমান এবং তুমি রোজ বিকেলে তোমার মেয়েকে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। দেখতে বড় ভাল লাগে। আমারো ইচ্ছে করে আমার ছেলেটাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরতে। তবে আমার ছেলেটা হল মহাশয়তান। মা’র কাছ থেকে সব শয়তানি বুদ্ধি পেয়েছে। এইজন্যে ওকে কাঁধে নেই না। তাও একদিন নিয়েছিলাম। কাঁধে তোলামাত্র পিসাব করে দিল। প্রাকৃতিক কারণে করেছে তা না, ইচ্ছে করে করেছে।

‘রাতে রওনা হবার দরকার কি? আমরা বরং ভোরবেলা রওনা হই। দৃশ্য দেখতে দেখতে যাই।‘

‘আমেরিকায় দেখার মত কোন দৃশ্য নেই। মাইলের পর মাইল ধু-ধু মাঠ। ঐ মাঠগুলি গরুর পায়খানা করার জন্য অতি উত্তম। কাজেই রাতে যাচ্ছি। তাছাড়া স্ত্রীকে যেমন রাতে পোষ মানাতে হয়, গাড়িকেও তেমনি রাতে পোষ মানাতে হয়।

সন্ধ্যা মিলাবার পর আমরা রওনা হলাম। গ্যাস স্টেশনে গ্যাস নেবার জন্যে গাড়ি দাঁড়াল। আবদাল নেমে গেল, গ্যাস নিল, দু-একটা টুকিটাকি জিনিস কিনবে। আবদালের স্ত্রী রোজি আমার দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল, ভাইজান, আমি কি আপনার সঙ্গে দুটা কথা বলার অনুমতি পেতে পারি? আমি মেয়েটির চমৎকার ইংরেজি শুনে যেমন মুগ্ধ হলাম, তেমনি মুগ্ধ হলাম তার রূপ দেখে। মালয়েশিয়ানদের চামড়া আমাদের মত শ্যামলা। এই মেয়েটির গায়ের রং দুধে আলতায় মেশানো। মিশরী মেয়েদের মত টানা টানা চোখ, লম্বা চুল। লাল টকটকে কমলার কোয়ার মত ঠোঁট।

আমি বললাম, বলুন কি বলবেন। আমি শুনছি।

‘আপনি যে আপনার স্ত্রী এবং কন্যাকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন এতে আমি খুব খুশি হয়েছি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া! আপনি থাকায় আমি খুব ভরসা পাচ্ছি–আমার স্বামী খুব দ্রুত গাড়ি চালায়। আপনি একটু লক্ষ রাখবেন।‘

‘অবশ্যই লক্ষ রাখব।‘

‘তার চেয়েও বড় সমস্যা, রাতের বেলা হাইওয়েতে গাড়ি চালানোর সময় সে প্রায়ই স্টিয়ারিং হুইল ধরে ঘুমিয়ে পড়ে।

‘সে কি!’

‘জি–অনেকবার বড় ধরনের অ্যাকসিডেন্ট হতে হতে বেঁচে গেছি।‘

‘আরো কিছু বলার আছে?’

‘এখন বলব না। এখন বললে আপনি ভয় পাবেন। আল্লাহ আল্লাহ করে ট্রিপ শেষ করে ফিরে আসি, তারপর আপনাকে বলব।‘

সাউথ ডাকোটায় অনেক দেখার জিনিস আছে। টুরিস্টরা প্রথমে দেখে পাথরের গায়ে খোদাই করা চার প্রেসিডেন্টের মাথা। দল নিয়ে দেখতে গেলাম। আবদাল ভুরু কুঁচকে বলল, এর মধ্যে দেখার কি আছে বুঝলাম না। হাতুড়ি বাটাল দিয়ে পাহাড়গুলি নষ্ট করেছে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয়?

রোওজি বলল, আমার কাছে তো খুব সুন্দর লাগছে।

আবদাল বলল, তোমার কাছে তো সুন্দর লাগবেই। তুমি হলে বুদ্ধিহীনা নারী। বুদ্ধিহীনা নারী যা দেখে তাতেই মুগ্ধ হয়।

আমি রোওজিকে অপমানের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য বললাম, আমি বুদ্ধিহীনা নারী নই কিন্তু আমার কাছেও ভাল লাগছে।

‘ভাল লাগলে ভাল। তোমরা থাক এখানে, আমি দেখি কোন পাবটাব পাওয়া যায় কিনা। কয়েকটা বিয়ার না খেলে চলছে না।‘

আবদাল বিয়ারের খোঁজে চলে গেল।

আমরা অনেক ছবি-টবি তুলোম। খাঁটি টুরিস্টের মত ঘুরলাম। তারপর আবদালের খোঁজে গিয়ে দেখি সে পাঁড় মাতাল। টেবিল থেকে মাথা তুলতে পারছে না এমন অবস্থা। আমাকে দেখেই হাসিমুখে বলল, খবর সব ভাল?

আমি বললাম, ভাল! তোমার এ কী অবস্থা!

‘কোন চিন্তা করবে না। মাতাল অবস্থায় আমি সবচেয়ে ভাল গাড়ি চালাই। চল, রওনা হওয়া যাক।

এখনি রওনা হওয়া যাবে না। আরো অনেক কিছু দেখার আছে। তাছাড়া তোমারও মনে হয় বিশ্রাম দরকার।

‘আমার কোনই বিশ্রাম দরকার নেই এবং এখানে দেখারও কিছু নেই।‘

‘স্ফটিক গুহার খুব নাম শুনেছি। না দেখে গেলে আফসোস থাকবে।‘

আবদাল বলল, গুহা দেখার কোন দরকার নেই। গুহা জন্তু-জানোয়ারদের জন্যে। মানুষের জন্যে না।

তাকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে স্ফটিক গুহা দেখাতে নিয়ে গেলাম। সারা পৃথিবীতে সরটির মত স্ফটিক গুহা আছে। সেই সত্ত্বরটির মধ্যে ষাটটিই পড়েছে সাউথ ডাকোটায়।

পাঁচ ডলারের টিকিট কেটে আমরা স্ফটিক গুহায় ঢুকলাম। সে এক ভয়াবহ সৌন্দর্য! লক্ষ লক্ষ স্ফটিক ঝলমল করছে। প্রকৃতি যেন পাথরের ফুল ফুটিয়েছে। বিস্ময়ে হতবাক হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

রোওজি মুগ্ধকণ্ঠে বলল, আহ, কি সুন্দর!

আবদাল বলল, ন্যাকামি করবে না। তোমার ন্যাকামি অসহ্য! পাথর আগে দেখনি? পাথর দেখে ‘আহ কি সুন্দর’ বলে নেচে ওঠার কি আছে? ন্যাকামি না করলে ভাল লাগে না?

রোওজির মনটা খারাপ হল। আমারো মন খারাপ হল। এদের সঙ্গে না এলেই ভাল হত। কিছুক্ষণ পরপর একটি মেয়ে অকারণে অপমানিত হচ্ছে, এই দৃশ্য সহ্য করাও মুশকিল।

মেয়েটি মনে হচ্ছে স্বামীর ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। খানিকক্ষণ মন খারাপ করে থাকে। তারপর আবার আনন্দে ঝলমল করে ওঠে। গুহা থেকে বেরুবার পর গুহার কেয়ারটেকার বলল, কেমন দেখলে?

আমি বললাম, অপূর্ব!

আবদাল বলল, বোগাস! পাথর দেখিয়ে ডলার রোজগার। শাস্তি হওয়া উচিত।

কেয়ারটেকার বলল, স্ফটিক গুহা তোমাকে মুগ্ধ করতে পারেনি। এখান থেকে দশ কিলোমিটার দূরে আছে পেট্রিফায়েড ফরেস্ট। পুরো অরণ্য পাথর হয়ে গেছে। ঐটি দেখ।

আবদাল বলল, আমি আর দেখাদেখির মধ্যে নেই।

তাকে ছেড়ে গেলে সে আবার কোন একটা পাব-এ ঢুকে পড়বে। আমাদের আর বাড়ি ফেরা হবে না। কাজেই জোর করেই তাকে ধরে নিয়ে গেলাম। দেখলাম পেট্রিফায়েড ফরেস্ট। অবিশ্বাস্য ব্যাপার! গাছপালা, পোকামাকড় সবই পাথর হয়ে গেছে। এমন অস্বাভাবিক ব্যাপার যে প্রকৃতিতে ঘটতে পারে তাই আমার মাথায় ছিল না। আমি আবদালকে বললাম, কেমন দেখলে?

সে বলল, দূর, দূর।

পেট্রিফায়েড ফরেস্টে ছোট একটা দোকানের মত আছে। সেখানে স্যুভেনির বিক্রি হচ্ছে। পাথর হওয়া পোকা, পাথর হওয়া গাছের পাতা। কোনটার দাম কুড়ি ডলার, কোনটির পঁচিশ।

রোওজি ক্ষীণস্বরে তার স্বামীকে বলল, সে একটা পোকা কিনতে চায়। তার খুব শখ।

আবদাল চোখ লাল করে বলল, খবর্দার, এই কথা দ্বিতীয়বার বলবে না! পোকা কিনবে কুড়ি ডলার দিয়ে? ডলার খরচ করে কিনতে হবে পোকা?

‘পাথরের পোকা।‘

‘পাথরেরই হোক আর কাঠেরই হোক। পোকা হল পোকা। ভুলেও কেনার নাম মুখে আনবে না।‘

‘অদ্ভুত এই ব্যাপার কি তোমার কাছে মোটেও ভাল লাগছে না?’

‘ভাল লাগার কি আছে? আমার বমি করে ফেলার ইচ্ছা হচ্ছে। তোমরা ঘুরে বেড়াও। আমি সুভ্যেনির দোকানে গিয়ে বসি। ওদের কাছে বিয়ার পাওয়া যায় কিনা কে জানে।‘

আমরা ঘণ্টাখানিক ঘুরলাম। রোওজি বলল, চলুন ফেরা যাক। ও আবার দেরি হলে রেগে যাবে।

আবদাল রেগে টং হয়ে আছে। আমাকে দেখেই বলল, কুৎসিত একটা জায়গা। বিয়ার পাওয়া যায় না। চল তো আমার সঙ্গে, একটা পাব খুঁজে বের করি। ওরা এখানে থাকুক। আমি বললাম, না খেলে হয় না? আবদাল অবাক হয়ে বলল, বিয়ার না খেলে বাঁচব কিভাবে?

আমি আবদালকে নিয়ে পাবের সন্ধানে বের হলাম। যাবার আগে সে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কয়েকটা হুংকার দিল, খবর্দার, কিছু কিনবে না। পোকা-মাকড় বাসায় নিয়ে গেলে খুনোখুনি হয়ে যাবে। চুলের মুঠি ধরে গেটআউট করে দেব।

.

পাবে দু’জন মুখোমুখি বসলাম।

আবদাল বলল, আমি তোমাকে আলাদা নিয়ে এসেছি একটা গোপন কথা বলার জন্যে।

‘গোপন কথাটা কি?’

‘রোওজির জন্যে কিছু পাথরের পোকা-মাকড় কিনেছি। আমি সেসব তাকে দিতে পারি না। তুমি দেবে। তুমি বলবে যে, তুমি কিনে উপহার দিচ্ছ।‘

আমি তাকিয়ে আছি। ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।

আবদাল বলল, আমি আমার স্ত্রীকে পাগলের মত ভালবাসি। কিন্তু ব্যাপারটা তাকে জানতে দিতে চাই না। জানলেই লাই পেয়ে যাবে। এই কারণেই তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি।

‘ও আচ্ছা।‘

‘মেয়েটা যে কত ভাল তা তুমি দূর থেকে বুঝতে পারবে না।‘

‘তুমি লোকটাও মন্দ না।‘

‘আমি অতি মন্দ। ইবলিশ শয়তানের কাছাকাছি। সেটা কোন ব্যাপার না। দুনিয়াতে ভাল-মন্দ দু’ধরনের মানুষই থাকে। থাকে না?’

‘হ্যাঁ, থাকে।‘

‘এখন তুমি কি আমার স্ত্রীকে এইসব পোকা-মাকড়গুলি উপহার হিসেবে দেবে?’

‘তুমি চাইলে অবশ্যই দেব। কিন্তু আমার ধারণা, তোমার স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলবে–এইসব উপহার আসলে তোমারই কেনা।‘

‘না, বুঝতে পারবে না। আমি আমার ভালবাসা সব সময় আড়াল করে রেখেছি। ওর ধারণা হয়ে গেছে, ওকে আমি দু’চক্ষে দেখতে পারি না।‘

‘এতে লাভটা কি হচ্ছে আমি কিন্তু বুঝতে পারছি না।‘

‘লাভটা বলি–কোন একদিন রোওজি হঠাৎ করে সবকিছু বুঝতে পারবে–বুঝতে পারবে আমার সবই ছিল ভান। তখন কি গভীর আনন্দই না পাবে! আমি সেই দিনটির জন্যে অপেক্ষা করছি।‘

আবদাল বিয়ারের অর্ডার দিয়েছে। দু’ জগ ভর্তি বিয়ার। নিমিষের মধ্যে একটা জগ শেষ করে সে বলল, জিনিসটা মন্দ না।

আমরা আবার পের্টিফায়েড ফরেস্টে ফিরে গেলাম। রোওজি ক্ষীণস্বরে তার স্বামীকে বলল, সে ছোট একটা গোবরে পোকা কিনতে চায়। কি সুন্দর জিনিস! আবদাল চোখ লাল করে বলল, আবার! আবার ন্যাকামি ধরনের কথা? আমরা প্রস্তরীভূত অরণ্য দেখে ফিরে যাচ্ছি। আবদাল ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। মাতাল অবস্থায় সে আসলেই ভাল গাড়ি চালায়। পেছনের সীটে বিষণ্ণ মুখে রোওজি বসে আছে। কারণ গাড়িতে উঠার সময় সে আবদালের কাছ থেকে একটা কঠিন ধমক খেয়েছে।

ফ্রাংকেনস্টাইন

আমি কি করে এক দানব তৈরি করলাম সেই গল্প আপনাদের বলি। অয়োময়ের পর দু’বছর কেটে গেছে। হাতে কিছু সময় আছে। ভাবলাম সময়টা কাজে লাগানো যাক। টিভির বরকতউল্লাহ সাহেব অনেক দিন থেকেই তাঁকে একটা নাটক দেবার কথা বলছেন। ভাবলাম ছয় সাত এপিসোডের একটা সিরিজ নাটক তাকে দিয়ে আবার শুরু করা যাক। এক সকালবেলা তার সঙ্গে চা খেতে খেতে সব ঠিক করে ফেললাম। নাটক লেখা হবে ভূতপ্রেত নিয়ে। নাম ছায়াসঙ্গী। দেখলাম নাটকের বিষয়বস্তু শুনে তিনি তেমন ভরসা পাচ্ছেন না। আমি বললাম, ভাই আপনি কিছু ভাববেন না। এই নাটক দিয়ে আমরা লোকজনদের এমন ভয় পাইয়ে দেব যে তারা রাতে বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে পারবে না।

বরকতউল্লাহ সাহেব বিরস গলায় বললেন, মানুষদের ভয় দেখিয়ে লাভ কি?

অত্যন্ত যুক্তিসংগত প্রশ্ন। যেভাবে তিনি প্রশ্ন করলেন তাতে যে কেউ ঘাবড়ে যাবে। আমি অবশ্যি দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে তাকে বুঝাতে সক্ষম হলাম যে ভয় পাবার মধ্যেও আনন্দ আছে। কে না জানে সুকুমার কলার মূল ব্যাপারটাই হল আনন্দ। বরকতউল্লাহ সাহেব নিমরাজি হলেন। আমি পরদিনই গা ছমছমানো এক ভূতের নাটক নিয়ে তার কাছে উপস্থিত। নাটক পড়ে শুনালাম। নিজের নাটক পড়ে আমার নিজেরই গা ছমছম করতে লাগলো। বরকতউল্লাহ সাহেব বললেন, অসম্ভব! এই নাটক বানানোর মত টেকনিক্যাল সাপোর্ট আমাদের নেই। আপনি সহজ কোন নাটক দিন।

আমার মনটাই গেল খারাপ হয়ে। আমি বললাম, দেখি।

‘দেখাদেখি না। আপনাকে আজই নাটকের নাম দিতে হবে। টিভি গাইডে নাম। ছাপা হবে।‘

আমি একটা কাগজ টেনে লিখলাম, কোথাও কেউ নেই।

বরকত সাহেব বললেন, কোথাও কেউ নেই মানে কি? আমি তো আপনার সামনেই বসে আছি।

আমি বললাম, এটাই আমার নাটকের নাম। এই নামে আমার একটা উপন্যাস। আছে। উপন্যাসটাই আমি নাটকে রূপান্তরিত করে দেব।

বরকত সাহেব আঁৎকে উঠে বললেন, না না, নতুন কিছু দিন। উপন্যাস তো অনেকের পড়া থাকবে। গল্প আগেই পত্রিকায় ছাপা হয়ে যাবে।

আমি বললাম, এটা আমার খুব প্রিয় লেখার একটি। আপনি দেখুন সুবর্ণাকে পাওয়া যায় কিনা। সুবর্ণাকে যদি পাওয়া যায় তাহলে কম পরিশ্রমে সুন্দর একটা নাটক পাঁড়া হবে।

‘সুবর্ণাকে যদি না পাওয়া যায় তাহলে কি আপনি নতুন নাটক লিখবেন?’

‘হ্যাঁ লিখব।‘

সুবর্ণাকে পাওয়া গেল। আসাদুজ্জামান নূর বললেন, তিনি বাকেরের চরিত্রটি করতে চান। বাকেরের চরিত্রটি তাকেই দেয়া হল। ‘ফ্রাংকেনস্টাইন’ তৈরির দিকে আমি খানিকটা এগিয়ে গেলাম। বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রাংকেনস্টাইনের দানবটা তো মানুষ এক নামে চেনে। বাকের হল সেই ‘ফ্রাংকেনস্টাইন’।

নাটকটির সপ্তম পর্ব প্রচারের পর থেকে আমি অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করলাম। সবাই জানতে চাচ্ছে বাকেরের ফাঁসি হবে কি না। রোজ গাদাগাদা চিঠি। টেলিফোনের পর টেলিফোন। তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে এই ব্যাকুলতার মানেটা কি? আমি নাটক লিখতে গিয়ে মূল বই অনুসরণ করছি। বই–এ বাকেরের ফাঁসি আছে। নাটকেও তাই হবে। যারা আমাকে চিঠি লিখেছেন তাদের সবাইকেই আমি জানালাম, হ্যাঁ ফাঁসি হবে। আমার কিছু বক্তব্য আছে। বাকেরকে ফাঁসিতে না ঝুলালে সেই বক্তব্য আমি দিতে পারব না। তাছাড়া আমাকে মূল বই অনুসরণ করতে হবে।

এক অধ্যাপিকা আমাকে জানালেন—’শেক্সপিয়রের রোমিও জুলিয়েট বিয়োগান্তক লেখা। কিন্তু যখন রোমিও জুলিয়েট ছবি করা হল তখন নায়ক, নায়িকার মিল দেখানো হল। আপনি কেন দেখাবেন না? আপনাকে দেখাতেই হবে।‘

এ কি যন্ত্রণা!

তবে এটা যন্ত্রণার শুধু শুরু। তবলার ঠুকঠাক। মূল বাদ্য শুরু হল নবম পর্ব। প্রচারের পর। আমি দশ বছর ধরে টিভিতে নাটক লিখছি এই ব্যাপার আগে দেখিনি। পোস্টার, মিটিং, মিছিল–হুঁমায়ুনের চামড়া তুলে নেব আমরা। রাতে ঘুমুতে পারি না, দু’টা তিনটায় টেলিফোন। কিছু টেলিফোন তো রীতিমত ভয়াবহ–‘বাকের। ভাইয়ের কিছু হলে রাস্তায় লাশ পড়ে যাবে।‘ আপাতদৃষ্টিতে এইসব কাণ্ডকারখানা আমার খারাপ লাগার কথা নয়, বরং ভাল লাগাই স্বাভাবিক। আমার একটি নাটক নিয়ে এতসব হচ্ছে এতে অহংবোধ তৃপ্ত হওয়ারই কথা। আমার তেমন ভাল লাগল না। আমার মনে হল একটা কিছু ব্যাপার আমি ধরতে পারছি। দর্শক রূপকথা দেখতে চাচ্ছে কেন? তারা কেন তাদের মতামত আমার ওপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে? আমি কি লিখব বা না লিখব সেটা তো আমি ঠিক করব। অন্য কেউ আমাকে বলে দেবে কেন?

বাকেরের মত মানুষদের কি ফাঁসি হচ্ছে না?

এ দেশে কি সাজানো মামলা হয় না?

নিরপরাধ মানুষ কি ফাঁসির দড়িতে ঝুলে না?

ঐ তো সেদিনই পত্রিকায় দেখলাম ৯০ বছর পর প্রমাণিত হল লোকটি নির্দোষ। অথচ হত্যার দায়ে ৪০ বছর আগেই তার ফাঁসি হয়ে গেছে।

সাহিত্যের একটি প্রচলিত ধারা আছে যেখানে সত্যের জয় দেখানো হয়। অত্যাচারী মোড়ল শেষ পর্যায়ে এসে মৃত্যুবরণ করেন জাগ্রত জনতার কাছে। বাস্তব কিন্তু সেরকম নয়। বাস্তবে অধিকাংশ সময়েই মোড়লরা মৃত্যুবরণ করেন না। বরং বেশ সুখে-শান্তিতেই থাকেন। ৭১-এর রাজাকাররা এখন কি খুব খারাপ আছেন? আমার তো মনে হয় না। কুত্তাওয়ালীরা মরেন না, তাদের কেউ মারতে পারে না। ক্ষমতাবান লোকদের নিয়ে তারা মচ্ছব বসায়। দূর থেকে আমাদের তারা নিয়ন্ত্রণ করে।

আমি আমার নাটকে কুত্তাওয়ালীর প্রতি ঘৃণা তৈরি করতে চেয়েছি। তৈরি করেছিও। কুত্তাওয়ালীকে মেরে ফেলে কিন্তু সেই ঘৃণা আবার কমিয়েও দিয়েছি। আমরা হাঁপ ছেড়ে ভেবেছি–যাক দুষ্ট শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু কুত্তাওয়ালী যদি বেঁচে থাকতো তাহলে আমাদের ঘৃণা থেমে যেত না, প্রবহমান থাকতো। দর্শকরা এক ধরনের চাপ নিয়ে ঘুমুতে যেতেন।

আমার মূল উপন্যাসে কুত্তাওয়ালীর মৃত্যু হয়নি, নাটকে হয়েছে। কেন হয়েছে? হয়েছে, কারণ মানুষের দাবীর কাছে আমি মাথা নত করেছি। কেনই বা করব না? মানুষই তো সব, তাদের জন্যেই তো আমার লেখালেখি। তাদের তীব্র আবেগকে আমি মূল্য দেব না তা তো হয় না। তবে তাদের আবেগকে মূল্য দিতে গিয়ে আমার কষ্ট হয়েছে। কারণ আমি জানি, আমি যা করছি তা ভুল। আমার লক্ষ্য মানুষের বিবেকের উপর চাপ সৃষ্টি করা। সেই চাপ সৃষ্টি করতে হলে দেখাতে হবে যে কুত্তাওয়ালীরা বেঁচে থাকে। মারা যায় বাকেররা।

যে কারণে নাটকে কুত্তাওয়ালীর বেঁচে থাকা প্রয়োজন ছিল ঠিক সেই কারণেই বাকেরের মৃত্যুরও প্রয়োজন ছিল। বাকেরের মৃত্যু না হলে আমি কিছুতেই দেখাতে পারতাম না যে এই সমাজে কত ভয়াবহ অন্যায় হয়। আপনাদের কি মনে আছে যে একজন মানুষ (?) পনেরো বছর জেলে ছিল যার কোন বিচারই হয়নি। কোর্টে তার মামলাই ওঠেনি। ভিন দেশের কোন কথা না। আমাদের দেশেরই কথা।

ভয়াবহ অন্যায়গুলি আমরাই করি। আমাদের মত মানুষরাই করে এবং করায়। কিছু কিছু মামলায় দেখা গেছে পুলিশ অন্যায় করে, পোস্টমর্টেম যে ডাক্তার করেন তিনি অন্যায় করেন, ধুরন্ধর উকিলরা করেন। রহিমের গামছা চলে যায় করিমের কাঁধে।

পত্রিকায় দেখলাম, ১৮০ জন আইনজীবী আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন আমি নাকি এই নাটকে খারাপ উকিল দেখিয়ে তাদের মর্যাদাহানি করেছি। আমি ক্ষমা প্রার্থনা না করলে তারা আদালতের আশ্রয় নেবেন। উকিল সাহেবদের অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলছি, এই নাটকে একজন অসম্ভব ভাল উকিলও ছিলেন। মুনার উকিল। যিনি প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন সত্য প্রতিষ্ঠার। একশত আশিজন আইনজীবী নিজেদেরকে সেই উকিলের সঙ্গে সম্পর্কিত না করে বদ উকিলের সঙ্গে করলেন। কেন?

আমাদের সমাজে কি কুত্তাওয়ালীর উকিলের মত উকিল নেই? এমন আইনজীবী কি একজনও নেই যারা দিনকে রাত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন না? মিথ্যা সাক্ষী কি আইনজীবীদেরই কেউ কেউ তৈরি করে দেন না? যদি না দেন, তা হলে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেন কাঁদে?

অতি অল্পতেই দেখা যাচ্ছে সবার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। আমরা কি করি না করি তাতে কিছু যায় আসে না। আমাদের ভাবমূর্তি বজায় থাকলেই হল। হায়রে ভাবমূর্তি!

আমি মনে হয় মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছি। মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। নাটকটির শেষ পর্যায়ে আমি টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি আবেদন করলাম। শেষ পর্বের জন্যে আমি দুঘন্টা সময় চাইলাম। আমার পরিকল্পনা ছিল প্রথম এক ঘন্টায় শুধু কোর্ট দেখাব, পরের এক ঘন্টা যাবে বাকি নাটক। কোর্ট দৃশ্যের পর পনেরো দিন অপেক্ষা করা দর্শকের জন্যে কষ্টকর, নাটকের জন্যেও শুভ নয়। যে টেনশান কোর্ট দৃশ্যে তৈরি হবে, পনেরো দিনের বিরতিতে নিচে নেমে যাবে। টেনশান তৈরি করতে হবে আবার গোড়া থেকে। আমার বিশ্বাস ছিল টেলিভিশন আমার যুক্তি মেনে নেবে। অতীতে আমার ‘অয়োময়’ নাটকের শেষ পর্বের জন্য দু’ঘন্টা সময় দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া আমার সবসময় মনে হয়েছে, টেলিভিশনের উপর আমার খানিকটা দাবী আছে। গত দশ বছরে টিভির জন্যে কম সময় তো দেইনি। আবেদনে লাভ হল না। টিভি জানিয়ে দিল–এই নাটকের জন্যে বাড়তি সময় দেয়া হবে না। দর্শকদের জন্যে টিভি, টিভির জন্যে দর্শক নয়–এই কথাটা টিভির কর্তাব্যক্তিরা কবে বুঝবেন কে জানে। আমি ৭০ মিনিটে গল্পের শেষ অংশ বলার প্রস্তুতি নিলাম। কোর্টের দৃশ্য, কুত্তাওয়ালীর হত্যা দৃশ্য, বাকেরের ফাঁসি সব এর মধ্যেই দেখাতে হবে। শুধু দেখালেই হবে না–সুন্দর করে দেখাতে হবে। দর্শকদের মনে জাগিয়ে তুলতে হবে গভীর বেদনাবোধ।

সন্ধ্যাবেলা হাত-মুখ ধুয়ে লিখতে বসলাম, রাতে ভাত খেতে গেলাম না। পুরোটা এক বৈঠকে বসে শেষ করতে হবে। রাত তিনটায় লেখা শেষ হল। আমি পড়তে দিলাম আমার স্ত্রী গুলতেকিনকে। সে বলল, তোমার কোন একটা সমস্যা আছে। মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। আমি লক্ষ করেছি, তুমি অনেকখানি মমতা দিয়ে একটি চরিত্র তৈরি কর, তারপর তাকে মেরে ফেল। তুমি এইসব দিনরাত্রি’তে টুনীকে মেরেছ। এবার মারলে বাকেরকে।

আমি তাকে কোন যুক্তি দিলাম না। ক্লান্ত হয়ে ঘুমুতে গেলাম। ঘুম হল না। আবার উঠে এসে বারান্দায় বসলাম। অনেকদিন পর ভোর হওয়া দেখলাম। ভোরের প্রথম আলো মনের অস্পষ্টতা কাটাতে সাহায্য করে। আমার বেলাতেও করলো। আমার মন বলল, আমি যা করেছি ঠিকই করেছি। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে বাকেরকে মরতেই হবে।

যেদিন নাটক প্রচারিত হবে তার আগের দিন রাতে দৈনিক বাংলার আমার। সাংবাদিক বন্ধু হাসান হাফিজ ব্যস্ত হয়ে টেলিফোন করলেন। আমাকে বললেন, আগামীকাল প্রেসক্লাবের সামনে বাকের ভাইয়ের মুক্তির দাবীতে সমাবেশ হবে। সেখান থেকে তারা আপনার এবং বরকতউল্লাহ সাহেবের বাড়ি ঘেরাও করবে। পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। আপনি সরে যান।

নিজের ঘরে বসে সবাইকে নিয়ে আমার নাটক দেখার অভ্যাস। এই প্রথমবার নাটক প্রচারের দিন বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে যেতে হল। খবর নিয়ে জানলাম, বাড়ির সামনের রাস্তায় কয়েকটা ককটেল ফাটানো হয়েছে। রাগী কিছু ছেলে ঘোরাফেরা করছে। পুলিশ চলে এসেছে। বাসায় ফিরলাম রাত একটায়। দরজার ফাঁক দিয়ে কারা যেন দুটা চিঠি রেখে গেছে। একটা চিঠিতে লেখা, বাকেরের যেভাবে মৃত্যু হল আপনার মৃত্যুও ঠিক সেইভাবেই হবে। আমরা আপনাকে ক্ষমা করলেও আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। রাত দু’টার সময় ধানমন্ডি থানার একজন সাব ইন্সপেক্টর সাহেব আমাকে জানালেন, আপনি কোন ভয় পাবেন না। আমরা আছি।

প্রচন্ড মাথার যন্ত্রণা নিয়ে রাতে ঘুমুতে গেলাম। এপাশ-ওপাশ করছি। কিছুতেই ঘুম আসছে না। আমার ছোট মেয়েটাও জেগে আছে। সেও ঘুমুতে পারছে না। তার নাকি বাকের ভাইয়ের জন্যে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি মেয়েকে নিয়ে বারান্দায় এসে বসলাম। মেয়ে কঁদো কাঁদো গলায় বলল, বাবা তুমি উনাকে কেন মেরে ফেললে? আমি মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, গল্পের একজন বাকের মারা গেছে যাতে সত্যিকার বাকেররা কখনো না মারা যায়।

কথাটা হয়তো আমার ক্লাস ফোরে পড়া মেয়ের জন্যে একটু ভারী হয়ে গেল। ভারী হলেও এটাই আমার কথা। এই কথা নাটকের ভেতর দিয়ে যদি বুঝতে না পেরে থাকি তবে তা আমার ব্যর্থতা। আমি আমার সীমাবদ্ধ ক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা করেছি। আমার চেষ্টায় কোন খাদ ছিল না। এইটুকু আমি আপনাদের বলতে চাই। বাকেরের মৃত্যুতে আপনারা যেমন ব্যথিত আমিও ব্যথিত। আমার ব্যথা আপনাদের ব্যথার চেয়েও অনেক অনেক তীব্র। বিজ্ঞানী ডঃ ফ্রাংকেনস্টাইন নিজের তৈরি দানবটাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগে নিজেই ধ্বংস হলেন নিজের সৃষ্টির হাতে। আমি বেঁচে আছি। কিন্তু বাকের নামের একটি চরিত্রও তৈরি করেছিলাম। আজ সে নেই। মুনা আছে, সে কোনদিনই বাকেরকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে পারবে না। মুনার এই কষ্ট আমি বুকে ধারণ করে আছি। আপনারা ভুলে যাবেন। আমি তো ভুলব না। আমাকে বেঁচে থাকতে হবে মুনার কষ্ট হৃদয়ে ধারণ করে।

বটবৃক্ষ

রাত এগারোটায় গাড়িতে উঠলাম। যাব ময়মনসিংহ। ঢাকা থেকে ১২৭ কিলোমিটার পথ। তিন ঘণ্টার বেশি লাগার কথা না, কিন্তু ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। দশ হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। বুদ্ধিমানের কাজ হবে বৃষ্টি থামার জন্যে অপেক্ষা করা। সেই অপেক্ষাটুকু। করতে পারছি না। খবর এসেছে–আমার নানীজানের স্ট্রোক হয়েছে। শরীরের এক অংশ অবশ। মুখের কথা জড়িয়ে গেছে। তিনি আমাকে শেষবারের মত একবার দেখতে চাচ্ছেন। অন্য ভুবনের দিকে যাত্রার আগে আগে সবাই প্রিয়জনদের দেখতে চায়। আমি নানীজানের অতি প্রিয়দের একজন, কারণ তিনি এক অর্থে আমার দুধ-মা। আমার জন্মের পর পর মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমাকে লালন করার দায়িত্ব চলে যায়। নানীজানের কাছে। সেই সময় তাঁর নিজের একটি মেয়ে হয়েছে। তিনি তাঁর ডান বুকের দুধ আমার জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। বাঁ দিকেরটা তাঁর কন্যার জন্যে। বুকের দুধের কোন আকর্ষণী ক্ষমতা কি আছে? হয়ত আছে। আমি নানীজানের পাশে উপস্থিত হবার জন্য তীব্র ব্যাকুলতা অনুভব করছি।

নানীজান আমার শৈশবের একটি বড় অংশ দখল করে আছেন। চোখ বন্ধ করলেই নানার বাড়ির সব জায়গায় তাঁকে একসঙ্গে দেখতে পাই। এই দেখছি রান্নাঘরে। পিঠা তৈরি হচ্ছে, তিনি বসেছেন সরঞ্জাম নিয়ে, এই দেখছি উঠোনে, ধান শুকানো হচ্ছে, তিনি এক ফাঁকে এসে কাক তাড়িয়ে গেলেন। এই দেখছি পুকুর ঘাটে। বাচ্চারা সবাই পানিতে নামবে–তিনি তাদের একা ছেড়ে দিতে ভরসা পাচ্ছেন না, সঙ্গে আছেন।

রাতগুলি তো অপূর্ব! তিনিই তখন সম্রাজ্ঞী। গল্পের আসর বসেছে। তিনি একের পর এক ভূতের গল্প বলে যাচ্ছেন। রক্ত জমাট করা ভয়ংকর কিছু গল্প আমি নানীজানের কাছে শুনেছি। তাঁর বর্ণনাভঙ্গি খুব সাধারণ। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভূতের গল্পগুলি এমনভাবে বলেন যে এসব কিছুই না, সব সময় ঘটছে। পান খেতে খেতে একটু নিচু গলায় গল্প শুরু করবেন। ঘটনাটা কোথায় ঘটল সেই বিষয়ে আগে অনেকক্ষণ ধরে বলেন। তারপর হঠাৎ মূল গল্পে চলে যান–

“কি হল শোন। শীতের রাত, মশারি খাঁটিয়ে শুয়েছি, সঙ্গে আনোয়ারার ছোট মেয়ে। ঘরে একটা হারিকেন জ্বলছে। হঠাৎ দেখি মশারির চারদিকে ছায়ার মত একটা কি যেন ঘুরছে। চরকির মত ঘুরছে। মানুষের ছায়ার মত ছায়া, নাক-মুখ কিছু বুঝা যায় না, তবে চোখ দুটা দেখা যায়–শাদা ছোট ছোট চোখ। আমি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ডান হাতের আঙ্গুল ছায়াটার দিকে বাড়িয়ে চিৎকার করে উঠলাম–এইটা কি? এইটা কি? ওমি ছায়াটা আমার আঙ্গুলে কামড়ে ধরল। এই দেখ এখনো দাগ আছে।

আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়লাম আঙ্গুলের দাগ দেখার জন্যে। তারপর ভয়ে ভয়ে বললাম, জিনিসটা কি ছিল?

নানীজান হাই তুলতে তুলতে বললেন, কি আবার? জ্বীন।

যেন জ্বীন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। সব সময়ই চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে–সুযোগ। পেলেই মানুষের হাত কামড়ে ধরছে।

.

আমার ঝিমুনীর মত এসে গেছে।

গাড়ি চলছে ঘণ্টায় কুড়ি কিলোমিটার বেগে। বৃষ্টি কমার লক্ষণ নেই। বরং বাড়ছে। দমকা হাওয়া দিচ্ছে। নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যে গান ছেড়ে দিয়েছি। অলিভিয়া নিউটন জনের লালাবাই–

“Precious baby, sweetly sleep,
Sleep in peace.
Sleep in comfort, slumber deep.
I will rock you, rock you, rock you,
I will rock you, rock you, rock you …”

ঘুমপাড়ানি গান। স্নায়ুকে কেমন অবশ করে দেয়। আমি চোখ বন্ধ করে পড়ে আছি। গাড়ির ঝাঁকুনি, বৃষ্টির শব্দ, অলিভিয়া নিউটন জনের লালাবাই সব মিলিয়ে অন্যরকম পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেছে। আমি ভাবতে চেষ্টা করছি–পঁচাশি বছর বয়েসী আমার বৃদ্ধা নানীজান ঠিক এই মুহূর্তে কি ভাবছেন। অন্য ভুবনের দিকে যাত্রা শুরুর আগে মানুষ কী ভাবে, একজন অল্পবয়সী মানুষ এরকম অবস্থায় তীব্র হতাশায় ভুগবে। সুন্দর পৃথিবীর কিছুই না দেখে তাকে চলে যেতে হচ্ছে। কিন্তু একজন পরিণত বয়সের মানুষ? সে কি ভাববে? তার ভেতরেও কি হতাশা কাজ করবে? না-কি সে ভাববে -”অনেক তো দেখলাম। আর কত! এবার তোমরা আমাকে বিদায় দাও।”

আমার নানীজান আর দশজন বৃদ্ধার মতই সুখ-দুঃখের জীবন কাটিয়েছেন। সুখ দুঃখ দাড়িপাল্লায় মাপা যায় না। মাপা গেলে হয়তবা তাঁর দুঃখের পাল্লাই ভারি হবে। নিজের জীবনে বেশ ক’জন সন্তানের মৃত্যুশোক সইতে হয়েছে। স্বামী হারানোর ব্যথায় জর্জরিত হয়েছেন। আবার এগারোটি সন্তানকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখেছেন। প্রথম জীবনে অভাব দেখেছেন। শেষ জীবনে দেখলেন প্রাচুর্য। পুত্র-কন্যা, নাতি-নাতনি, এবং নাতি-নাতনিদের ছেলেমেয়েতে বটবৃক্ষের মত নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। কোন উৎসব উপলক্ষে সবাই যখন জড় হয় তখন মনে হয় হাট বসে গেছে। নানীজান বসে থাকেন জলচৌকিতে, লাইন বেঁধে তাঁকে সালাম করা হয়। বিশাল ডেকচিতে রান্না বসে। পুত্রবধূরা সেই ডেগ তাঁর সামনে এনে বলে, ‘মা, আপনি হাত দিয়ে একটু ছুঁয়ে দেন। আমরা রান্না বসাব।’ তিনি এক ধরনের গর্ব এবং অহংকারে পাতিল ছুঁয়ে দেন। শুরু হয় উৎসবের বাড়ির রান্না।

ন’ বছর বয়সে বৌ হয়ে এ বাড়িতে এসেছিলেন। পার করলেন আশি বছর। কত দীর্ঘ সময়! দীর্ঘ সময়ের কত না আনন্দ-বেদনার স্মৃতি! সব স্মৃতি পেছনে ফেলে কি করে তিনি যাত্রা করবেন অচেনা ঠিকানায়? পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে কেউ কি থাকবে তাঁর পাশে? তাঁর মৃত স্বামী, তাঁর মৃত পুত্র কন্যারা কি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে থাকবে তাঁর পাশে? না-কি যেমন একা পৃথিবীতে এসেছিলেন, তেমনি ফিরেও যাবেন একা? আমি জানি না। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে।

.

রাত তিনটায় ময়মনসিংহ পৌঁছলাম। বাড়ি অন্ধকার। সবাই নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে। কলিংবেলের শব্দে বাড়ির মানুষ জেগে উঠল। সবার মুখ হাসি-হাসি। রোগী সামলে উঠেছে। ডাক্তাররা বলেছেন, এযাত্রা টিকে গেছেন। যে হাত অবশ হয়ে গিয়েছিল সেই হাতে সাড় ফিরে এসেছে। কথা বললে খানিকটা বোঝা যায়।

হৈচৈয়ে নানীজান জেগে উঠলেন। মুখ ভর্তি পান নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কি কাণ্ড! তিনি আরো সুন্দর হয়েছেন। দুধে-আলতায় গায়ের রঙ এখন কেমন ঝিকমিক করছে। লাল টুকটুকে ঠোঁট, পান খাওয়ায় আরো লাল দেখাচ্ছে। আমি পাশে বসে বললাম, রাত তিনটায় ঝড়বৃষ্টির মধ্যে আমাকে টেনে এনে এখন দিব্যি আরাম করে সুপারি খাচ্ছেন। কাজটা কি ভাল হল?

নানীজান হাসতে হাসতে বললেন, এই পাগলা বলে কি?

আমি বললাম, আমি যেমন ভিজতে ভিজতে এসেছি–আপনাকেও এখন ভিজতে হবে। আপনাকে এখন কোলে করে ছাদে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজাব। ছাড়াছাড়ি নেই।

নানীজানের হাসি আর থামে না। মনে হচ্ছে আসলেই তিনি বৃষ্টিতে ভিজতে চান। ডাক্তার তাঁকে বিশ্রাম নিতে বলেছে। চুপচাপ সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। তিনি তাতে রাজি নন। বাড়ির সবাই জেগেছে, তিনি তাদের সঙ্গে নিশি যাপন করবেন। সবাই চা খাচ্ছে, তিনিও চা খাবেন, গল্প করবেন। যদিও কোন গল্প ঠিকমত করতে পারছেন না। খেই হারিয়ে ফেলছেন। এক কথা থেকে আরেক কথায় চলে যাচ্ছেন। একবার আমাকে বললেন, ‘তোর পরীক্ষা কবে রে? পড়াশোনা ঠিকমত করছিস তো?” তাঁর মনেও নেই পরীক্ষার যন্ত্রণা আমি অনেক অনেক আগে শেষ করেছি।

ভোরবেলা ঢাকা রওনা হব। নানীজানকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা নানীজান, আমাকে আপনি একটা কথা বলুন তো। আপনার কাছ থেকে ঠিক জবাবটা চাই।

‘কি জানতে চাস?’

‘মৃত্যু সম্পর্কে জানতে চাই। মৃত্যুভয় সম্পর্কে জানতে চাই। একজন মানুষ যখন মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থাকে তখন তার কেমন লাগে তা জানতে চাই। মৃত্যুর কথা ভাবতে কি আপনার ভয় লাগে?’

নানীজান কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, না, ভয় লাগে না। মৃত্যুর কথা ভাবতে ভাল লাগে।

‘ঠিক বলছেন তো নানীজান?’

‘ঠিকই বলছি।‘

‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে না?’

নানীজান এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। হাসলেন। সেই হাসির কি অর্থ কে জানে।

.

ঢাকায় ফিরে চলেছি। সুন্দর সকাল। ঝকঝকে রোদ। গাড়ি ছুটে চলেছে ঝড়ের গতিতে। অলিভিয়া নিউটন জনের গান আবারো হচ্ছে,

“Precious baby, sweetly sleep, sleep in peace.
Sleep in comfort, slumber deep.
I will rock you, rock you, rock you,
I will rock you, rock you, rock you …”

বর্ষাযাপন

কয়েক বছর আগের কথা। ঢাকা শহরের এক কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে খেতে গিয়েছি। চমৎকার ব্যবস্থা। অতিথির সংখ্যা কম। প্রচুর আয়োজন। থালা-বাসনগুলো পরিচ্ছন্ন। যারা পোলাও খাবেন না তাদের জন্যে সরু চালের ভাতের ব্যবস্থা। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে দেখলাম বেশ কিছু বিদেশি মানুষও আছেন। তারা বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে আগ্রহী। দেখাবার মতো কোনো অনুষ্ঠান নেই বলে কন্যা-কর্তা খানিকটা তি। এটা শুধু খাওয়ার অনুষ্ঠান তা বলতে বোধহয় কন্যা-কর্তার খারাপ লাগছে। বিদেশিরা যতবারই জানতে চাচ্ছে, মূল অনুষ্ঠান কখন শুরু হবে? ততবারই তাঁদের বলা হচ্ছে, হবে হবে।

কোনার দিকের একটা ফাঁকা টেবিলে খেতে বসেছি। আমার পাশের চেয়ারে এক বিদেশি ভদ্রলোক এসে বসলেন। আমার কিছুটা মেজাজ খারাপ হলো। মেজাজ খারাপ হওয়ার প্রধান কারণ ইনি সঙ্গে করে কাঁটা চামচ নিয়ে এসেছেন। এদের এই আদিখ্যেতা সহ্য করা মুশকিল। কাঁটা চামচ নিশ্চয়ই এখানে আছে। সঙ্গে করে নিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল না। আমি আগেও লক্ষ করেছি, যারা কাঁটা চামচ দিয়ে খায়—তারা হাতে যারা খায় তাদের বর্বর গণ্য করে। যেন সভ্য জাতির একমাত্র লগো হলো কাঁটা চামচ। পাশের বিদেশি তার পরিচয় দিলেন। নাম পল অরসন। নিবাস নিউমেক্সিকোর লেক সিটি। কোন এক এনজিও-এর সঙ্গে যুক্ত আছেন। বাংলাদেশে এসেছেন অল্প দিন হলো। এখনো ঢাকার বাইরে যান নি। বিমানের টিকিট পাওয়া গেলে সামনের সপ্তাহে কক্সবাজার যাবেন।

কিছু জিজ্ঞেস না করলে অদ্রতা হয় বলেই বললাম, বাংলাদেশ কেমন লাগছে?

পল অরসন চোখ বড় বড় করে বলল, Oh, wonderful!

এদের মুখে Oh, wonderful! শুনে আহ্লাদিত হওয়ার কিছু নেই। এরা এমন। বলেই থাকে। এরা যখন এদেশে আসে তখন তাদের বলে দেওয়া হয়, নরকের মতো একটা জায়গায় যাচ্ছ। প্রচণ্ড গরম। মশা-মাছি। কলেরা-ডায়রিয়া। মানুষগুলো খারাপ। বেশির ভাগই চোর। যারা চোর না তারা ঘুষখোর। এরা প্রোগ্রাম করা অবস্থায় আসে, সেই প্রোগ্রাম, ঠিক রেখেই বিদেয় হয়। মাঝখানে Oh, wonderful! জাতীয় কিছু ফাঁকা বুলি আওড়ায়।

আমি পল অরসনের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বললাম, তুমি যে ওয়ান্ডারফুল বললে, শুনে খুশি হলাম। বাংলাদেশের কোন জিনিসটা তোমার কাছে ওয়ান্ডারফুল মনে হয়েছে।

পল বলল, তোমাদের বর্ষা।

আমি হকচকিয়ে গেলাম। এ বলে কী! আমি আগ্রহ নিয়ে পলের দিকে তাকালাম। পল বলল, বৃষ্টি যে এত সুন্দর হতে পারে এদেশে আসার আগে আমি বুঝতে পারি নি। বৃষ্টি মনে হয় তোমাদের দেশের জন্যেই তৈরি করা হয়েছে। তুমি শুনলে অবাক হবে, আমি একবার প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে রিকশার হুড ফেলে মতিঝিল থেকে গুলশানে গিয়েছি। আমার রিকশাওয়ালা ভেবেছে, আমি পাগল।

আমি পলের দিকে ঝুঁকে এসে বললাম, তোমার কথা শুনে খুব ভালো লাগল। অনেক বিদেশির অনেক সুন্দর কথা আমি শুনেছি, কিন্তু তোমার মতো সুন্দর কথা আমাকে এর আগে কেউ বলে নি। এত চমৎকার একটি কথা বলার জন্যে তোমার অপরাধ ক্ষমা করা হলো।

পল অবাক হয়ে বলল, আমি কী অপরাধ করেছি?

পকেট থেকে কাঁটা চামচ বের করে অপরাধ করেছ।

পল হো-হো করে হেসে ফেলল। বিদেশিরা এমন প্রাণখোলা হাসি হাসে না বলেই আমার ধারণা। পল অরসনের আরও কিছু ব্যাপার আমার পছন্দ হলো। যেমন–খাওয়া শেষ হওয়ামাত্র পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে বলল, নাও, সিগারেট নাও।

বিদেশিরা এখন সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে। তারা সিগারেট তৈরি করে গরিব দেশগুলোতে পাঠায়। নিজেরা খায় না। ভাবটা এরকম–অন্যেরা মরুক, আমরা বেঁচে থাকব। তারপরেও কেউ কেউ খায়। তবে তারা কখনো অন্যদের সাধে না।

আমি পলের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিলাম। পানের ডালা সাজানো ছিল। পল নিতান্ত পরিচিত ভঙ্গিতে পান মুখে দিয়ে চুন খুঁজতে লাগল। এ ধরনের সাহেবদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করা যায়। বর্ষা নিয়েই কথা বলা যেতে পারে। তা ছাড়া গরম পড়েছে প্রচণ্ড। এই গরমে বৃষ্টির কথা ভাবতেও ভালো লাগে। আমি বললাম, পল, তোমার বর্ষা কখন ভালো লাগল?

পল অরসন অবিকল বৃদ্ধা মহিলাদের মতো পানের পিক ফেলে হাসিমুখে বলল, সে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। লন্ডন এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকা এসে পৌঁছেছি দুপুরে। প্লেন থেকে নেমেই দেখি প্রচণ্ড রোদ, প্রচণ্ড গরম। কিছুক্ষণের মধ্যে গা বেয়ে ঘাম পড়তে লাগল। আমি ভাবলাম, সর্বনাশ হয়েছে। এই দেশে থাকব কী করে? বনানীতে আমার জন্যে বাসা ঠিক করে রাখা হয়েছিল। সেখানে এয়ারকুলার আছে বলে আমাকে চিঠি লিখে জানানো হয়েছে। আমি ভাবছি, কোনোমতে বাসায় পৌঁছে। এয়ারকুলার ছেড়ে চুপচাপ বসে থাকব। ঘরে কোনো চৌবাচ্চা থাকলে সেখানেও গলা ডুবিয়ে বসে থাকা যায়।

বাসায় পৌঁছে দেখি, এয়ারকুলার নষ্ট। সারাই করার জন্যে ওয়ার্কশপে দেওয়া হয়েছে। মেজাজ কী যে খারাপ হলো বলার না। ছটফট করতে লাগলাম। এক ফোঁটা বাতাস নেই। ফ্যান ছেড়ে দিয়েছি, ফ্যানের বাতাসও গরম।

বিকেলে এক মির‍্যাকল ঘটে গেল। দেখি, আকাশে মেঘ জমেছে। ঘন কালো মেঘ। আমার বাবুর্চি ইয়াছিন দাঁত বের করে বলল, কালবোশেখি কামিং স্যার। ব্যাপার কিছুই বুঝলাম না। মনে হলো, আনন্দজনক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। হঠাৎ ঝপ করে গরম কমে গেল। হিম-শীতল হাওয়া বইতে লাগল। শরীর জুড়িয়ে গেল। তারপর নামল বৃষ্টি। প্রচণ্ড বর্ষণ, সেইসঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। বাবুর্চি ইয়াছিন ছুটে এসে বলল, স্যার শিল পড়তাছে, শিল। বলেই ছাদের দিকে ছুটে গেল। আমিও গেলাম পেছনে পেছনে। ছাদে উঠে দেখি, চারদিকে মহা আনন্দময় পরিবেশ। আশপাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করে শিল কুড়াচ্ছে। আমি এবং আমার বাবুর্চি আমরা দুজনে মিলে এক ব্যাগ শিল কুড়িয়ে ফেললাম। আমি ইয়াছিনকে বললাম, এখন আমরা এগুলো দিয়ে কী করব?

ইয়াছিন দাঁত বের করে বলল, ফেলে দিব।

আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল। প্রথম তুষারপাতের সময় আমরা তুষারের ভেতর ছোটাছুটি করতাম। তুষারের বল বানিয়ে একে অন্যের গায়ে ছুঁড়ে দিতাম। এখানেও তা-ই হচ্ছে। সবাই বৃষ্টির পানিতে ভিজে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।

আমি পলকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,

এসো করো স্নান নবধার জলে
এসো নীপবনে ছায়ৰীতলে।

পল বলল, তুমি কী বললে?

রবীন্দ্রনাথের গানের দুটি লাইন বললাম। তিনি সবাইকে আহ্বান করছেন–বর্ষার প্রথম জলে স্নান করার জন্যে।

বলো কী! তিনি সবাইকে বৃষ্টির পানিতে ভিজতে বলেছেন।

হ্যাঁ।

তিনি আর কী বলেছেন?

আরও অনেক কিছুই বলেছেন। তার কাব্যের একটা বড় অংশই জুড়ে আছে বর্ষা।

বলো কী!

শুধু তার না, এদেশে যত কবি জন্মেছেন তাঁদের সবার কাব্যের বড় একটা অংশ জুড়ে আছে বর্ষা।

পল খুব আগ্রহ নিয়ে বলল, বর্ষা নিয়ে এ পর্যন্ত লেখা সবচেয়ে সুন্দর কবিতাটি আমাকে বলো তো প্লিজ।

আমি তৎক্ষণাৎ বললাম,
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান।

এই এক লাইন?

হ্যাঁ, এক লাইন।

এর ইংরেজি কি?

এর ইংরেজি হয় না।

ইংরেজি হবে না কেন?

আক্ষরিক অনুবাদ হয়। তবে তার থেকে কিছুই বোঝা যায় না। আক্ষরিক অনুবাদ হচ্ছে—

Patter patter rain drops, flood in the river.

পল বিস্মিত হয়ে বলল, আমার কাছে তো মনে হচ্ছে খুবই সাধারণ একটা লাইন।

সাধারণ তো বটেই। তবে অন্যরকম সাধারণ। এই একটি লাইন শুনলেই আমাদের মনে তীব্র আনন্দ এবং তীব্র ব্যথাবোধ হয়। কেন হয় তা আমরা নিজেরাও ঠিক জানি না।

পল হাঁ করে তাকিয়ে রইল। একসময় বলল, বর্ষা সম্পর্কে এরকম মজার আর কিছু আছে?

আমি হাসিমুখে বললাম, বর্ষার প্রথম মেঘের ডাকের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের কিছু মাছের মাথা খারাপের মতো হয়ে যায়। তারা পানি ছেড়ে শুকনায় উঠে আসে।

আশা করি তুমি আমার সঙ্গে লেগ পুলিং করছ না।

না, লেগ পুলিং করছি না। আমাদের দেশে এরকম ফুল আছে যা শুধু বর্ষাকালেই ফোটে। অদ্ভুত ফুল! পৃথিবীর আর কোনো ফুলের সঙ্গে এর মিল নেই। দেখতে সোনালি একটা টেনিস বলের মতো। যতদিন বর্ষা থাকবে ততদিন এই ফুল থাকবে। বর্ষা শেষ ফুলও শেষ।

ফুলের নাম কী?

কদম।

আমি বললাম, এই ফুল সম্পর্কে একটা মজার ব্যাপার হলো বর্ষার প্রথম কদম ফুল যদি কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকাকে দেয় তাহলে তাদের সম্পর্ক হয় বিষাদমাখা। কাজেই এই ফুল কেউ কাউকে দেয় না।

এটা কি একটা মীথ?

হ্যাঁ, মীথ বলতে পারো।

পল তার নোটবই রের করে কদম ফুলের নাম লিখে নিল। আমি সেখানে রবীন্দ্রনাথের গানের চারটি চরণও লিখে দিলাম।

তুমি যদি দেখা না দাও
করো আমায় হেলা,
কেমন করে কাটে আমার
এমন বাদল বেলা।

(If thou showest me not thy face,
If thou leavest me wholly aside,
I know not how I am to pass
These long rainy hours.)

পল অরসনের সঙ্গে আর আমার দেখা হয় নি। তবে ঘোর বর্ষার সময় আমি যখন রাস্তায় থাকি তখন খুব আগ্রহ নিয়ে চারদিকে তাকাই, যদি রিকশার হুড-ফেলা অবস্থায় ভিজতে ভিজতে কোনো সাহেবকে যেতে দেখা যায়।

ভাইভা

চাকরি জীবনের প্রথম দিকে আমার প্রধান কাজ ছিল বিভিন্ন কলেজে পরীক্ষা নিয়ে বেড়ানো। রসায়নের পাস কোর্স, অনার্স, এম, এসসি, সব পরীক্ষাতেই আমি হলাম–বহিরাগত পরীক্ষক। ব্যবহারিক পরীক্ষা নেই, ভাইভা নেই। দূরের সব কলেজে যেতে হয়–পটুয়াখালি, চাখার, বরগুনা, ফরিদপুর …। পরীক্ষা নেয়া খুব যে আনন্দের কাজ তা না, তবে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়। অদ্ভুত অদ্ভুত সব পরিবেশ ও পরিস্থিতি।

একবার মফস্বলের এক কলেজে গিয়েছি। আমাকে থাকতে দেয়া হল এক শিক্ষকের বাসায়। ভদ্রলোকের স্ত্রী বাপের বাড়ি গেছেন। খালি বাসা। আমাদের খাওয়া আসে হোটেল থেকে। মোটা মোটা চালের ভাত। আগুনের মত ঝাল তরকারি। খাওয়ার পর অনেকক্ষণ মুখ হা করে বসে থাকতে হয়।

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ঘুমুতে গেছি। শিক্ষক ভদ্রলোক মুখ কাচুমাচু করে বললেন–হুমায়ূন সাহেব, আরাম করে ঘুমান, আমি একটা কাজে যাচ্ছি। ফিরতে রাত হবে। তবে দরজা খুলতে হবে না। আমি বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাব, যাতে রাতে আপনার ঘুম ভেঙে উঠতে না হয়। আমি বললাম, ফিরতে কত রাত হবে?

‘এই ধরুন, একটা-দুটা।‘

‘কি কাজ এত রাতে?’

‘ইয়ে মানে–একটু তা-টাস খেলি।‘

‘পয়সা দিয়ে খেলেন?”

‘আরে না। পয়সা পাব কোথায়? মাঝে মধ্যে খেলাটা ইন্টারেস্টিং করার জন্যে খুব অল্প স্টেকে খেলা হয়। নিতান্তই নির্দোষ আনন্দ।‘

ভদ্রলোক নির্দোষ আনন্দের সন্ধানে আমাকে তালা দিয়ে চলে গেলেন। বাড়ি থেকে বেরুবার একটি মাত্র দরজা, সেটি তালাবন্ধ। এই অবস্থায় সারাক্ষণ মনে হয় আগুন লেগে গেলে কি হবে? বেরুব কি করে?

দুশ্চিন্তায় অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম হল না। তন্দ্রামত আসে, আবার ভেঙে যায়। আমি ঘড়ি দেখি। রাত দুটার সময় শুরু হল ভূতের উপদ্রব। কলঘরে পানি পড়বার শব্দ হচ্ছে। রান্নঘরে হাড়ি-কুড়ি নড়ছে। ঝপাং করে বাড়ির টিনের ছাদে কি যেন লাফিয়ে পড়ল। সারা বাড়ি কেঁপে উঠল। নিজেকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম। ছাদে ঝাঁপ দিয়ে যা পড়েছে তা আর কিছুই না, বানর। কিছুক্ষণ পর স্পষ্ট শুনলাম বারান্দায় চটি পায়ে কে। যেন হাঁটছে। একবার এ-মাথায় যাচ্ছে, আরেকবার ও-মাথায়। ঘরের বাতি জ্বালিয়ে বিছানায় বসে রইলাম। প্রচন্ড বাথরুম পেয়েছে, বাথরুমে যাবার সাহস নেই। সেখানে কল থেকে পানি পড়ছে, পানি পড়া বন্ধ হচ্ছে। আবারো পানি পড়ছে। ঘড়িতে রাত বাজে তিনটা। এত ভয় জীবনে পাইনি।

শিক্ষক ভদ্রলোক রাত তিনটার দিকে নির্দোষ আনন্দ শেষ করে ফিরলেন। আমি

তাকে ঘটনাটা বললাম, তিনি নিতান্তই স্বাভাবিকভাবে বললেন, ও কিছু না, জ্বীন।

আমি বললাম, জ্বীন মানে?

‘এ বাড়িতে একটা জ্বীন থাকে। দুষ্ট প্রকৃতির। আমাদের কিছু বলে না তবে বাইরের কেউ একা থাকলে যন্ত্রণা করে। তবে কারো কোন অনিষ্ট করে না।‘

‘এসব কি বলছেন ভাই?’

‘বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার। আমি নিজেও বিশ্বাস করি না। লোকে যা বলে আপনাকে বললাম। আমার স্ত্রী জ্বীনটাকে কয়েকবার দেখেছেন। ছোট সাইজ। গা ভর্তি পশম।

‘জ্বীনের গা ভর্তি পশম?’

‘জি। খুব নরম।‘

‘আপনি হাত দিয়ে দেখেছেন যে নরম?’

‘আমি হাত দেইনি। আমার স্ত্রী হাত দিয়েছেন। বিড়ালের পশমের মত পশম, তবে আরো সফট।‘

বাকি যে ক’রাত ছিলাম, আমিও ভদ্রলোকের সঙ্গে নির্দোষ আনন্দে যেতাম। উনি হাইড্রোজেন নামের একটা খেলা খেলতেন। আমি পাশে বসে ঝিমাতাম।

.

বরিশাল বি এম কলেজে পরীক্ষা নিতে গিয়েও বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমার থাকার জায়গা হয়েছে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের অফিসে। একটা চৌকি পেতে থাকার ব্যবস্থা। রাতের বেলা ক্যাম্পাস ফাঁফা হয়ে যায়–কোথাও জনমানব নেই। আমি একা বাতি জ্বেলে জেগে বসে থাকি, ভয়ে ঘুম আসে না। গভীর রাতে জানালায় টুক করে। শব্দ হল। আমি ভয়ে শক্ত হয়ে গেছি–আস্তে আস্তে জানালা খুলছে। আমি চিৎকার করে বললাম, কে?

জানালা খোলা বন্ধ হল, তবে সামান্য যা ফাঁক হয়েছে সেই ফাঁক দিয়ে লিকলিকে কালো একটা হাত ঘরের ভেতর ঢুকতে লাগল। মনে হল ঘরে একটা সাপ ঢুকছে। সাপের মাথায় পাঁচটা আঙুল। আমার ধারণা হল–এক্ষুনি বোধহয় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। একধরনের ঘোরের মধ্যে বললাম, কে?

বাইরে থেকে উত্তর এল–স্যার আমি।

‘আমিটা কে?’

‘হুজুরের কাছে আমার একটা দরখাস্ত।‘

আস্তে আস্তে হাতের মুঠি খুলে গেল। টপ করে হাত থেকে একটা কাগজ পড়ল। হাত উধাও হয়ে গেল। সাহস সঞ্চয় করে কাগজ কুড়িয়ে নিলাম। সত্যি সত্যি দরখাস্ত! কেমিস্ট্রি বিভাগের জনৈক বেয়ারা দরখাস্ত করেছে আমার কাছে। বিভাগের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মত হল। পরের রাতেও একই ব্যাপার। চেয়ারম্যান সাহেবকে জানালাম। তিনি তাকে ডেকে এনে অনেক ধমকাধমকি করলেন। কঠিন গলায় বললেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চাও ভাল কথা, কর। দিনের বেলা কর। রাতদুপুরে উনাকে ভয় দেখাচ্ছ কেন? ধমকে কাজ হল না। পরের রাতে সে আবার এল। সব মিলিয়ে পাঁচ রাত ছিলাম। প্রতি রাতেই এই কাণ্ড ঘটেছে।

পরীক্ষা নিতে গিয়ে ভয়ের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে মজার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। পটুয়াখালি কলেজে পরীক্ষা নিতে গিয়ে এক গায়কের পাল্লায় পড়েছিলাম। সেই গায়কের গানের গলা ছাড়া আর সবই আছে। হাজার হাজার গান তিনি জানেন, সুর। জানেন শুধু গলাটা বেসুরো। তিনি গানের পর গান গেয়ে যেতেন। আমি একমনে প্রার্থনা করতাম–হে আল্লাহ পাক! এই গানের হাত থেকে আমাকে বাঁচাও। তোমার কাছে। আপাতত আর আমি কিছুই চাই না।

গায়ক ভদ্রলোককে অসংখ্যবার আমার বলার ইচ্ছা হয়েছে, ভাই, আমাকে ক্ষমা করুন। এই অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। তখন বয়স ছিল অল্প, মন ছিল নরম। কঠিন সত্যি কথা বলা সম্ভব হয়নি। পটুয়াখালি থেকে পরীক্ষা শেষ করে চলে আসবার দিন দেখি তিনি গাদা ফুলের একটা মালা হাতে লঞ্চঘাটে উপস্থিত। আমি শুকনো গলায় বললাম, আপনার গান খুব মিস করব। চর্চা রাখবেন। গান-বাজনা চর্চার ব্যাপার।

‘স্যার আপনি কি আমার গান শুনে আনন্দ পেয়েছেন?’

‘জি পেয়েছি।‘

গায়ক ভদ্রলোক শুধু গাদা ফুলের মালা নিয়েই আসেননি। ছোট্ট একটা ফ্লাস্ক এনেছেন। ফ্লাস্ক ভর্তি চা।

‘আপনি চা পছন্দ করেন। বাসা থেকে চা বানিয়ে এনেছি। ফ্লাস্কটাও আপনার জন্যে কিনেছি। সামান্য উপহার। দরিদ্র মানুষ।‘

আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। এটা আশা করিনি। ভদ্রলোককে কেবিনে নিয়ে বসালাম। লঞ্চ ছাড়তে দেরি আছে। কিছুক্ষণ গল্প করা যাক। ভদ্রলোক গল্পের ধার। দিয়ে গেলেন না। গাঢ় গলায় বললেন, চলে যাচ্ছেন মনটা খারাপ হয়ে গেছে। লাস্ট একটা গান শুনিয়ে দেই আপনাকে। আপনাকে গান শুনিয়ে খুব আনন্দ পেয়েছি। আপনার মত আনন্দ নিয়ে আর কেউ আমার গান শোনে না। কত ফাংশান হয়, অগা, মগা, বগা স্টেজে উঠে গান গায়। আমাকে কেউ ডাকে না। স্যার গাইব?

আমি বিরস গলায় বললাম, গান। ভদ্রলোক গান ধরল–বিদায়ের গান :

“আমার যাবার সময় হল দাও বিদায়।”

গাইতে গাইতে তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। আশ্চর্যের ব্যাপার, তিনি গাইলেন খুব সুন্দর করে। চারপাশে লোক জমে গেল। আমার নিজের চোখেও পানি এসে গেল।

.

পরীক্ষা প্রসঙ্গে আরেকটি স্মৃতির কথা বলি। সঙ্গত কারণেই কলেজের নাম উল্লেখ করছি না।

কেমিস্ট্রির অনার্স ব্যবহারিক পরীক্ষা। পাঁচদিন ধরে চলছে। কঠিন পরীক্ষা। ছাত্র ছাত্রীদের নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। এর মধ্যে একজনকে দেখে খুব মায়া লাগল। অল্প বয়েসী একটি মেয়ে–খুব শিগগিরই মা হবে। শারীরিক অস্বাভাবিকতার কারণে সে লজ্জিত এবং সংকুচিত। অন্যদের মত সে পরিশ্রমও করতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর পর টুলে বসে তাকে বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। পরীক্ষার কাজগুলিও সে ঠিকমত পারছে বলে মনে হচ্ছে না। আমি কলেজের একজন ডেমনস্ট্রেটরকে বললাম, আপনি ঐ মেয়েটিকে সাহায্য করুন। ওকে বলুন চেয়ারে বসে কাজ করতে। তাকে নিচু একটা টেবিল এনে দিন। যন্ত্রপাতিগুলি টেবিলে রেখে সে কাজ করুক। কোন অসুবিধা নেই।

ব্যবহারিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার পর হয় মৌখিক পরীক্ষা। সবাই মৌখিক পরীক্ষা দিল, শুধু মেয়েটি দিল না। ইন্টারন্যাল একজামিনার আমাকে জানালেন–আজই মেয়েটির একটি বাচ্চা হয়েছে বলে সে পরীক্ষা দিতে পারেনি। ব্যাপারটা বেশ দুঃখজনক। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মে মৌখিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত হলে ব্যবহারিক পরীক্ষায় পাস হবে না। ব্যবহারিক পরীক্ষা ফেল মানে অনার্স পরীক্ষায় ফেল।

ভাইভা শেষ হল। রেজাল্ট শীট তৈরি করতে করতে রাত দশটা বেজে গেল। সীল গালা আনা হল। রেজাল্ট শীট খামে ঢুকিয়ে সীল গালা করা হবে। তখন আমি বললাম, এক কাজ করলে কেমন হয়? চলুন, আমরা সবাই মিলে মেয়েটার বাসায় চলে যাই। ভাইভা নিয়ে আসি।

কেমিস্ট্রির চেয়ারম্যান সাহেব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না। আমি বললাম, মেয়েটার বাসা কোথায় জানেন?

‘বাসা বের করা যাবে তবে শহরে থাকে না। অনেক দূরে থাকে। আপনি কি সত্যি : যেতে চান?’

‘হ্যাঁ চাই।‘

‘ইউনিভার্সিটির কোন সমস্যা যদি হয়!’

‘আমরা অন্যায় তো কিছু করছি না। বিশেষ পরিস্থিতির কারণে–একজামিনেশন। বোর্ডের সব মেম্বার পরীক্ষার্থীর বাসায় উপস্থিত হচ্ছি।‘

‘এরকম কখনো কি করা হয়েছে?’

‘আমার জানামতে করা হয়নি। তবে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে একজন ছাত্রের ভাইভা নেয়া হয়েছে। চলুন যাই।‘

‘ইউনিভার্সিটি যদি কোন সমস্যা করে?’

‘সেই দায়িত্ব আমার। চলুন যাই।‘

মেয়েটির বাড়ি শহর থেকে নয়-দশ মাইল দূরে। রিকশা করে, ঝাঁকুনি খেতে খেতে যাচ্ছি। রাস্তা কারোর চেনা নেই। জিজ্ঞেস করে করে এগুতে হচ্ছে। রাত বারটার দিকে আমরা চারজন শিক্ষক তার বাসায় উপস্থিত হলাম। চারদিকে হৈচৈ পড়ে গেল। মেয়ের বাবা এবং মা দুজনেই আনন্দে কাঁদছেন। আশেপাশের সব মানুষ খবর পেয়ে উপস্থিত হয়েছে। এমন একটা ব্যাপার যে ঘটতে পারে তা কেউ কল্পনাই করেনি। মেয়ের স্বামী সাইকেল নিয়ে উধ্বশ্বাসে শহরে ছুটেছে। মিষ্টি আনতে হবে।

আমরা ভাইভা নিতে মেয়ের ঘরে ঢুকলাম। মেয়েটি উজ্জ্বল মুখে শুয়ে আছে। তার পাশে ছোট্ট একটি বাচ্চা। আমরা মেয়েটির ভাইভা নিতে এসেছি শোনার পর থেকে সে নাকি খুব কাঁদছিল, এখন চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিয়েছে। ভাইভা শুরু হল। মেয়েটা বলল, স্যার, আমার বাচ্চাটাকে আগে একটু দেখুন।

আমি বললাম, তোমার বাচ্চা দেখতে তো আসিনি। ভাইভা নিতে এসেছি। আচ্ছা, ঠিক আছে, দেখি তোমার বাচ্চা!

মেয়েটি বাচ্চার মুখের উপর থেকে চাঁদর সরিয়ে দিল।

বাচ্চা ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর ছোট্ট একটা মুখ। মাথা ভর্তি রেশমী চুল। কি ছোট্ট, কি পাতলা ঠোঁট।

মেয়েটির ভাইভা খুব খারাপ হল। সে অধিকাংশ প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারল না। কিন্তু তাতে সে মোটেও নার্ভাস হল না। সহজ গলায় বলল, স্যার, এবারে অনার্স পরীক্ষা আমি পাস করতে পারব না। থিওরী খুব খারাপ হয়েছে। পড়াশোনা করতে পারিনি। কিন্তু আমার মনে কোন আফসোস নেই। আপনারা পরীক্ষা নিতে বাড়িতে এসেছেন এইটা আমার জন্য অনেক। আমার মত ভাগ্যবতী মেয়ে এই পৃথিবীতে নেই। বলতে বলতে মেয়েটি কাঁদতে লাগল।

ঘটনার বর্ণনা এইখানে শেষ করে দিলে পাঠকরা আমার সম্পর্কে একটি ভ্রান্ত ধারণা পাবেন। তাঁরা মনে করবেন–হুমায়ূন আহমেদ মানুষটা খুব হৃদয়বান। একজন। ছাত্রী যেন পরীক্ষায় পাস করতে পারে তার জন্যে রাতদুপুরে কত ঝামেলা করেছেন।

ব্যাপার মোটেই তা নয়। নানান সমস্যার কারণে অনেকেই পরীক্ষা দিতে পারে না, পরের বার পরীক্ষা দেয়। এটা তেমন কোন বড় ব্যাপার না। মেয়েটি পরীক্ষায় পাস। করতে পারবে না এ নিয়ে বিচলিত হয়ে আমি গভীর রাতে তার বাড়িতে উপস্থিত হইনি। এই কাণ্ডটি করেছি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। আমরা ভাইভা নিতে গভীর রাতে ছাত্রীর বাড়িতে উপস্থিত হয়েছি এই অদ্ভুত ঘটনায় ছাত্রী এবং তার আত্মীয়স্বজনের মনে কি অবস্থার সৃষ্টি হয় তাই আমি দেখতে চেয়েছিলাম। একদল অভিভূত মানুষ দৈখে আমি আনন্দ পেতে চেয়েছিলাম। আমি গিয়েছিলাম সম্পূর্ণ আমার নিজের আনন্দের। জন্যে। মেয়েটি সন্তানের জন্ম দিয়ে আমাকে গাঢ় আনন্দ পাবার একটি সুযোগ করে দিয়েছিল। তাকে এবং তার বাচ্চাটিকে ধন্যবাদ।

মাসাউকি খাতাঁওরা

মধ্যবিত্তদের জীবনে উত্তেজনা সৃষ্টির মতো ঘটনা বড় একটা ঘটে না। তাদের জীবনযাত্রা খাওয়া ঘুমানো এবং টিভি দেখার মধ্যেই মোটামুটি সীমাবদ্ধ। কিন্তু আমার ছোটভাইয়ের বাসায় ব্যতিক্রম হলো। তাদের বাসায় উত্তেজনা সৃষ্টির মতো একটা ঘটনা ঘটার উপক্রম হলো। শুনলাম, এক জাপানি যুবক নাকি তার বাসায় একমাস থাকবে। জাপান-বাংলাদেশ টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামের সে একজন কর্মী, বাংলাদেশের গ্রামে দু’বছর কাটাবে। তবে পোস্টিং হওয়ার আগে বাংলাদেশের কোনো এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সঙ্গে তাকে এক মাস কাটাতে হবে, যাতে সে আমাদের রীতি-নীতি, আচার-আচরণ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পায়।

জাপানি যুবকের জন্যে আমার ছোটভাইয়ের পল্লবীর বাসায় দোতলায় একটা ঘর খালি করা হলো। জানালায় নতুন পর্দা দেওয়া হলো। বিছানায় নতুন চাদর। টেবিলে ফুলদানিতে গোলাপ। বাথরুমে টয়লেট পেপার। বিদেশি অতিথি। আদর যতের যেন ক্রটি না হয়। এই অতিথি অন্য সব অতিথির মতো নয়। সে হচ্ছে পেইং গেস্ট। যে ক’দিন থাকবে সে-ক’দিনের জন্যে টাকা দেবে। পেইং গেস্ট হলেও তার মূল কাজ আমাদের জীবনযাত্রা লক্ষ করা। আমাদের কালচার সম্পর্কে ধারণা নেওয়া। যেহেতু বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে সে ধারণা নেবে। কাজেই আমাদের সচেতন থাকতে হবে, কোনো ভুল ধারণা যেন সে না পায়।

তার সন্ধ্যাবেলা আসার কথা। বাসার সবাই বিকেল থেকে সেজেগুঁজে অপেক্ষা করতে লাগল। বাচ্চাদের উৎসাহই সবচেয়ে বেশি। তারা কথাবার্তা কীভাবে বলবে তা-ই নিয়ে মহাচিন্তিত। দোকান থেকে কুৎসিত আকৃতির বিশাল সাইজের মিষ্টি আনা হয়েছে, যাতে বিদেশি অতিথিকে মিষ্টির আয়তন দেখিয়ে ভড়কে দেওয়া যায়।

অতিথি এল সন্ধ্যাবেলা। পায়ে বুটজুতা, পরনে চকচকে সবুজ লুঙ্গি, গায়ে ফতুয়া। আমরা তাকে ভড়কাতে চেয়েছিলাম। বিচিত্র পোশাক দিয়ে শুরুতেই সে আমাদের ভড়কে দিল। অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নুইয়ে বো করল। একবার না, কয়েকবার। তারপর হাসিমুখে পরিষ্কার বাংলায় বলল, আমার নাম মাসাউকি খাতাওরা। আশা করি আপনারা ভালো আছেন। শুভ সন্ধ্যা।

আমরা তার পোশাক দেখে মুগ্ধ। তার দুধে আলতা গায়ের রঙ দেখে মুগ্ধ। তার পরিষ্কার বাংলা শুনে মুগ্ধ। জানলাম প্রয়োজনীয় বাংলা সে জাপান থেকেই শিখে এসেছে।

হাসি-খুশি ধরনের নিতান্তই অল্পবয়স্ক একটি ছেলে। শুনেছি, জাতি হিসেবে জাপানিরা খুব বুদ্ধিমান। একে খানিকটা বেকুব ধরনের মনে হলো। সে প্রথম দিনেই তার বেকুবির অনেকগুলো প্রমাণ দেখাল। বিশাল আয়তনের সাতটি মিষ্টি খেয়ে বলল, মিষ্টিজাতীয় খাবার আমি পছন্দ করি না।

অনেক বাচ্চাকাচ্চা তার জন্যে অপেক্ষা করছে দেখে সে বাচ্চাদের আনন্দ দেওয়া অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে ধরে নিয়ে, ডিগবাজি, পা উপরে মাথা নিচে দিয়ে দাঁড়ানো জাতীয় কিছু খেলা দেখাল এবং এক সময় হুড়মুড় করে পড়ে গিয়ে একটা চায়ের কাপ ভেঙে ফেলে ভাঙা টুকরাগুলোর দিকে খুবই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। একটা ময়লা একশ টাকার নোট মা’র দিকে বাড়িয়ে বলল, দয়া করে কাপের দামটা এখান থেকে রাখুন। কাপ ভাঙায় আমি বিশেষ দুঃখী হয়েছি।

সাতদিনের মাথায় সে ঘরের লোক হয়ে গেল। রান্নাঘরে ঘুরঘুর করে। কাঁচামরিচ ছাড়া ভাত খেতে পারে না। আমার মা অবলীলায় তাকে বলেন, দোকান থেকে আধ কেজি লবণ এনে দাও তো। সে ছুটে যায় লবণ আনতে। মশারি টানানোর জন্যে পেরেক পুঁতে দেয়। একদিন দেখা গেল ঝাড়ু হাতে প্রবল উৎসাহে ঘর ঝাট দিচ্ছে। ভিক্ষুক দরজা ধাক্কা দিলে বলছে মাফ করো।

বাসার পাশে এক ধোপার দোকানে তাকে দীর্ঘ সময় কাটাতে দেখা গেল। জানা গেল, ধোপাকে সে একশ টাকা দিয়েছে যার বিনিময়ে বোপা তাকে তার টু-ইন ওয়ানটি ব্যবহার করতে দেয়। সে সেখানে জাপান থেকে নিয়ে আসা ক্যাসেটে জাপানি গান শোনে।

তাকে বলা হলো যে, বাসাতেই ক্যাসেট প্লেয়ার আছে। সে ইচ্ছা করলে ব্যবহার করতে পারে। তার জবাবে সে বলল, এই বাসায় সে জাপানি ক্যাসেট বাজাতে চায় না। সে বাঙালি কালচার শিখতে চায়।

আমাদের সঙ্গে থেকে সে যেসব কালচার শিখল তা বাঙালি কালচারে পড়ে না। পারিবারিক কালচার হিসেবে চালানো যায়। কিছু নমুনা দেওয়া যাক।

(১) ঘুমুতে যাওয়ার এবং ঘুম থেকে উঠার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। যার যখন ইচ্ছা ঘুমুতে যেতে পারে। কেউ রাত দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে আবার অনেকে রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে থাকে। কেউ কেউ ওঠে সূর্য ওঠার আগে এবং প্রার্থনা করে (আমার মা)! কেউ সকাল এগারোটায় অনেক কষ্টে বিছানা থেকে নামে (আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা), এক কাপ চা খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।

(২) দেশের বাড়ি থেকে প্রচুর মেহমান আসে। তখন ঘরের মেঝেতে নানা ধরনের বিছানা করা হয়।

(৩) রবীন্দ্র সংগীত, হিন্দি এবং ইংরেজি–এই তিন ধরনের গান সারাক্ষণ ক্যাসেটে বাজতে থাকে। যদিও কাউকে দেখেই মনে হয় না সে গান শুনছে।

মাসাউকিকে দেখে আমরাও জাপানিদের সম্পর্কে কিছু কিছু ধারণা করলাম। যেমন—

ক) জাপানি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা ঠিক না। তারা খানিকটা বেকুব ধরনের হয়। (উদাহরণ : একবার বাসায় একটা মিলাদ হলো। মাসাউকি সেখানে উপস্থিত। পাত্রে করে আতর-ভেজানো তুলা দেওয়া হয়েছে। সবাই তুলা। থেকে আঙুলে খানিকটা আতর মাখিয়ে নাকে দিচ্ছে। তুলার পাত্র মাসাউকির সামনে আসতেই সে পুরো তুলার টুকরা মুখে দিয়ে কপ করে গিলে ফেলে হাঁসের মতো গলা টেনে টেনে কাশতে লাগল)

খ) জাপানিরা খাদ্যের ব্যাপারে গোপালের মতো সুবোধ বালক। তাদের যা দেওয়া হয় সবই খায়। তবে তারা নুডলস খায় না। সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে এলু-বার্তা (আলুভর্তা] এবং তিরিকিরি [তরকারি]।

গ) এদের লজ্জাশরম একটু কম। লুঙ্গি পরে থাকে, ফট করে লুঙ্গি খুলে যায় –তারা তাতে মোটেও বিব্রত বোধ করেনা। শুধু ইয়েই ইয়েই জাতীয় শব্দ করে।

ঘ) জাপানিরা খুব রঙচঙে আন্ডারওয়ার পরে। মাসাউকির লুঙ্গি প্রায়ই খুলে যাওয়ায় তার বিচিত্র কক্ষে আন্ডারওয়ার দেখার সৌভাগ্য আমাদের সবারই হয়েছে।

মাসাউকিকে নিয়ে সবচেয়ে সমস্যায় পড়লেন আমার মা। গ্রামে তাঁর যত আত্মীয়স্বজন আছে তারা সবাই জাপানি দেখার অজুহাতে একবার করে ঢাকা ঘুরে গেল। নিতান্ত অসময়ে ছয়-সাতজন এসে উপস্থিত হয়। তাদের মুখভর্তি হাসি। তারা। খুশি খুশি গলায় বলে, জাপানি দেখতে আসছি। তাদের সেই দেখা তিন-চারদিনেও শেষ হয় না। তারা জাপানি দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিড়িয়াখানা দেখে, ঢাকা শহর দেখে, বলাকা সিনেমাহলে সিনেমা দেখে। দেশে ফিরে যাওয়ার সময় বলে, জাপানি দেইখ্যা বড় ভালো লাগল। অতদিন খালি জাপানি জিনিস দেখছি, এখন আল্লাপাক জাপানি আদম দেখাইল। এরার সব ভালো তবে বাংলা ভাষায় একটু দুর্বল।

তারা দেশে ফিরে অন্যদের খবর দেয়। অন্যরা তখন কাপড়-চোপড় গুছিয়ে ঢাকা রওনা দেয়।

একমাস পার হওয়ার পর মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মাসাউকি বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। বিদায়দৃশ্য যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং হলো। মাসাউকি হড়বড় করে জাপানি ভাষায় একগাদা কথা বলল। মনে হলো, তার মধ্যে গভীর আবেগের সঞ্চার হয়েছে। কারণ কথা বলতে বলতে তার গলা ধরে আসছিল। আমরা যে তার জাপানি ভাষা একবর্ণও বুঝতে পারছি না তা তাকে বুঝতে দিলাম না। আমরা সবাই খুব মাথা নাড়তে লাগলাম। মার বাসায় কাজের মেয়ে দুজনের একজন গলা ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল–মশা ভাইজান যাইতাছে [মাসাউকি বাসার বাচ্চাকাচ্চা এবং কাজের মানুষদের কাছে মশাভাই হিসেবে পরিচিত]।

মাসাউকির বিদায়ের ছ’মাস পরের কথা। কোরবানির ঈদের ছুটিতে আমরা সবাই পল্লবীর মা’র বাড়িতে জড়ো হয়েছি। এই ঈদ সবাই মিলে মা’র সঙ্গে করি–দীর্ঘদিনের নিয়ম। ঈদের দু’দিন আগে স্যুটকেস হাতে নিয়ে মাসাউকি উপস্থিত। দুটো এক শ’ টাকার নোট বের করে মা’র কাছে গিয়ে সে যা বলল, তা হচ্ছে, তাকে তিনদিনের ছুটি দিয়েছে। সে আমাদের সঙ্গে থাকতে এসেছে। দু’শ। টাকা সে দিচ্ছে খরচ হিসেবে।

মা বললেন, তুমি আমাদের একটা বড় উৎসবের সময় থাকতে এসেছ। আমি খুব খুশি হয়েছি। তুমি থাক। টাকা লাগবে না। এরপর যতবার ছুটি কাটাতে ইচ্ছা করবে চলে আসবে। তবে তোমার থাকতে অসুবিধা হবে। আমার সব ছেলেমেয়েরা চলে এসেছে। বাসা ছোট।

আমার অসুবিধা হবে না। আমি চেয়ারে ‘নিদ্রা’ করব।

বলেই সে দেরি করল না, বসার সোফায় তাঁর বিছানা পেতে ফেলল। ঈদ উপলক্ষে তাকে পায়জামা-পাঞ্জাবি উপহার দেওয়া হলো। সে নিজে গিয়ে একটা টুপি কিনে আনল। ঈদ উৎসবের নিয়ম-কানুন নিয়েও তাকে খুব চিন্তিত মনে হলো। সে কোনো নিয়ম বাদ দিতে চায় না।

গরু কেনার ব্যাপারেও তার আগ্রহ দেখা গেল। সে ঘোষণা করল, গরু কেনার সময় সে সঙ্গে যেতে চায় এবং সে গরুর গোশতের একটা জাপানি প্রিপারেশন আমাদের রেঁধে খাওয়াতে চায়।

আমরা তাকে নিয়েই গরু কিনলাম। গরুর দড়ি ধরে হটিয়ে গরু বাসায় নিয়ে আসার পবিত্র দায়িত্বও তার হাতে পড়ল। সে এক বিচিত্র দৃশ্য! এক জাপানি কোরবানির গরুর দড়ি ধরে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যে-ই দেখছে সে-ই থমকে দাঁড়াচ্ছে। বুঝতে পারছে না–এই জাপানি সাহেবকে গরুর দাম জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কি না। যেহেতু কোরবানির গরুর দাম জিজ্ঞেস করা পবিত্র দায়িত্বের একটি, কাজেই কেউ কেউ ভয়ে ভয়ে এবং খানিকটা অস্বস্তির সঙ্গে জিজ্ঞেস করছে–গরুর দাম কত?

জাপানি তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে পড়ছে। বো করছে, তারপর গম্ভীর গলায় বলছে–ইহা কোরবানির গরু হয়। ইহার দাম অষ্ট হাজার টাকা।

গরুর দাম যতই বলা হোক, প্রশ্নকর্তাকে বলতে হবে–সস্তা হয়েছে। খুব সস্তা। খুব জিতেছেন।

প্রশ্নকর্তা নিয়মমাফিক অষ্ট হাজার টাকা দাম শুনে বলেন, সস্তা হয়েছে।

মাসাউকি বলল, অবশ্যই সস্তা হয়েছে। বারো হাজার চেয়েছিল। আমরা মূলামূলি করেছি। (মূলামূলি শব্দটি সে সম্প্রতি শুনেছে)।

গাবতলী থেকে পল্লবী–অনেকখানি রাস্তা। সারাপথই মাসাউকি গরুর দাম বলতে বলতে এল। বোঝাই যাচ্ছে এই কাজটায় সে প্রচুর আনন্দ পাচ্ছে।

বাসায় পৌঁছে সে গরুকে পানি খাওয়াল। গা ডলে দিল। পানি দিয়ে গোসল দিয়ে দিল।

আমার মা বললেন, মাসাউকি নিশ্চয়ই কোনো চাষি পরিবার থেকে এসেছে। চাষি পরিবারের ছেলে বলেই গরুর প্রতি এত যত্ন। যত্নটা আমার কাছেও বাড়াবাড়ি বলে মনে হলো। সন্ধ্যাবেলা গেল–সে কলা কিনে এনেছে। গরুকে কলা খাওয়াচ্ছে। মাথা আঁচড়ানোর চিরুনি দিয়ে গরুর গলকম্বল আঁচড়ে দিচ্ছে।

যথাসময়ে কোরবানি হয়ে গেল। মাংস রান্না হলো। সবাই খেতে বসেছি, মাসাউকির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে রাস্তা থেকে ধরে আনা হলো। জানা গেল, সে রাস্তার পাশে খুব মন খারাপ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মন খারাপের কী কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। সে জবাব দিল না। বিদেশি অতিথি হিসেবে বিশাল মাংসের বাটি এগিয়ে দেওয়া হলো তার সামনে। সে ক্ষীণ গলায় বলল, গরুটাকে অনেক দূর থেকে হাঁটিয়ে আনার জন্যে গরুটার উপর তার মায়া পড়ে গেছে। এই গরুর গোশত সে খেতে পারবে না। গোশত না খাওয়ার এই অপরাধ আমরা যেন ক্ষমা করে দেই। সে শুধু পোলাও খাবে। তার কোনো অসুবিধা হবে না।

আমরা সবাই অবাক হয়ে মাসাউকির দিকে তাকালাম।

ঈদের পরে সে দুদিন রইল। ঘরে এত মাংস–সে একটা টুকরাও মুখে দিল না। দূর দেশের বোকাসোকা একটা ছেলে আমাদের সবার মর্মমূলে বড় ধরনের একটা নাড়া দিয়ে গেল। এর প্রয়োজন ছিল।

মিসির আলি ও অন্যান্য

কিশোর বয়সে সুবোধ ঘোষের একটি উপন্যাস পড়েছিলাম—’শুন বরনারী’! উপন্যাসের মূল চরিত্র একজন হেমিওপ্যাথ ডাক্তার, হিমাদ্রী। অনেকদিন সেই ডাক্তারের ছবি আমার চোখে ভাসতো। মাঝে মাঝে রাস্তায় কাউকে দেখে চমকে উঠে ভাবতাম, আরে, ইনি তো অবিকল হিমাদ্রীর মত। কিশোর বয়সে মাথায় অনেক পাগলামি ভর করে। সেই পাগলামির কারণেই হয়ত এক সন্ধ্যাবেলায় হিমাদ্রী বাবুর কাছে এক পাতার একটা চিঠি লিখে ফেললাম। চিঠিতে অনেক সমবেদনার কথা বলা হল। চিঠি পাঠানো যায় কি করে? হিমাদ্রী বাবুর ঠিকানা আমি জানি না, সুবোধ ঘোষের ঠিকানাও জানা নেই। চিঠিটা অনেক দিন অঙ্ক খাতায় বন্দী হয়ে পড়ে রইল। এক সময় হারিয়েও গেল। একজন মুগ্ধ কিশোরের আবেগ ও ভালবাসা হিমাদ্রী কিংবা সুবোধ ঘোষ জানতে পারলেন না।

চিঠিটি কিন্তু হারায়নি। প্রকৃতি কোন কিছুই হারাতে দেয় না। যত্ন করে তুলে রাখে। কোন এক বিশেষ সময়ে বিশেষ মুহূর্তে সেই হারানো জিনিস বের করে এনে সবাইকে হকচকিত করে দেয়। আমার বেলায় এই ব্যাপারটা ঘটল। লক্ষ্মীপুর থেকে সপ্তম শ্রেণীর জনৈক বালক মিসির আলিকে একটা একপাতার চিঠি লিখল। মিসির আলির প্রতি সমবেদনায় সেই চিঠি পূর্ণ। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, এই চিঠির ভাষা এবং আমার চিঠির ভাষা একই রকম। যেন প্রকৃতি পঁয়ত্রিশ বছর পর আমার চিঠিই আমাকে ফেরত পাঠাল।

আমার উপন্যাসে বারবার ফিরে আসা চরিত্রগুলিকে নিয়ে একটা লেখা তৈরি করতে বলা হয়েছে। লিখতে গিয়ে তাই মিসির আলির কথাই প্রথম মনে পড়ল। তাকে দিয়েই শুরু করি।

মিসির আলি

মিসির আলি মানুষটা দেখতে কেমন? আমি ঠিক জানি না। জানলে বই-এ তাঁর চেহারার বর্ণনা থাকতো। তেমন কোন বর্ণনা নেই। চশমা পরেন এটা বলা হয়েছে। চশমা তো আর চেহারার বর্ণনা হবে না। চশমা অনেকেই পরেন।

বলা হয়েছে, তীক্ষ্ণ চোখে তিনি তাকান। সেই তীক্ষ্ণ চোখও তো কারোর বোঝার উপায় নেই। কারণ চোখ ঢাকা থাকে চশমার মোটা কাঁচের আড়ালে। মানুষটার কি মাথাভর্তি চুল? না-কি টাকমাথা? চুলের কথা কোন উপন্যাসে বলিনি, তবে চুল আছে। চুল যে আছে তা বুঝলাম মিসির আলিকে নিয়ে প্রচারিত দুটা টিভি নাটকে। নাটক দুটিতে মিসির আলির চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেতা আবুল হায়াত। টেকো মিসির আলিকে দেখে চমকে উঠলাম। চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করল, না না, মিসির আলির মাথায় টাক নেই। তাঁর মাথাভর্তি ঘন চুল। এখন বললে তো হবে না, বই-এ কিছু বলিনি।

মিসির আলিকে নিয়ে যখন কিছু লিখি তখন কি কোন চেহারা আমার মনে ভাসে? সচেতনভাবে কিছু ভাসে না। অবচেতন মনে নিশ্চয়ই ছবি আঁকা থাকে। সেই ছবি সাধারণ মানুষের ছবি। অন্তর্মুখী একজন মানুষ, যিনি বই পড়তে ভালবাসেন। অন্তর্মুখী মানুষরা অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করেন না, কিন্তু মিসির আলি। পছন্দ করেন। প্রায়ই দেখা যায়–আগ্রহ নিয়ে তিনি অনেককে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেন। অন্তর্মুখী মানুষ এই কাজটি কখনো করবে না। এই মানুষটির প্রধান গুণ কি? আমার মতে, কৌতূহল এবং বিস্ময়বোধ করার অসাধারণ ক্ষমতা। কৌতূহল আমাদের সবারই আছে, কিন্তু কৌতূহল মেটানোর জন্যে প্রয়োজনীয় পরিশ্রমটি আমরা করি না। করতে চাই না। অন্তর্মুখী মানুষ হয়েও মিসির আলি কিন্তু এই পরিশ্রমটা করেন। উদাহরণ দেয়া যাক। উদাহরণ থেকে মিসির আলির কৌতূহলের ধরন পরিষ্কার হবে। আমরা প্রায়ই ইউনানী তিব্বিয়া দাওয়াখানা জাতীয় সাইনবোর্ড দেখি। খুব কি। কৌতূহলী হই? মিসির আলি কিন্তু হন। যেমন,

“মুগদাপাড়া থেকে যে রাস্তাটা মান্ডার দিকে গিয়েছে তার প্রথম ডানদিকের বাঁকে বেশ কয়টা দোকান। একটা স্টেশনারী শপ, দু’টা সাইকেল টায়ারের দোকান, একটা সেলুন এবং একটি হেকিমী ঔষধের দোকান। সাইনবোর্ডে লেখা–ইউনানী তিব্বিয়া দাওয়াখানা। হেকিম আবদুর রব।

মিসির আলি ইদানিং এই পথে যাওয়া-আসা করেন, কারণ তিনি বাসা নিয়েছেন মান্ডায়। ঢাকায় আসতে হলে তাকে অতীশ দীপংকর রোড ধরতে হয়। এই পথে আসা ছাড়া উপায় নেই। দোকানগুলির সামনে এসে তিনি থমকে দাঁড়ান। আগ্রহ এবং কৌতূহল নিয়ে ইউনানী তিব্বিয়া দাওয়াখানার দিকে তাকান।

মানুষের কৌতূহল জাগ্রত করার মত তেমন কিছু দোকানে নেই। ভেতরটা অন্ধকার। ঘরের অর্ধেকটা জুড়ে পুরানো ভারী আলমিরা। আলমিরার পাল্লা কাঠের বলে ভেতরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। দু’পাশে বইয়ের র‍্যাকের মত বেশ কিছু র‍্যাক। র‍্যাক ভর্তি কাঁচের এবং চিনামাটির বৈয়ম। সব দোকানেই টেবিল বা টেবিল জাতীয় কিছু থাকে। এখানে নেই। দুটা বেতের চেয়ার পাশাপাশি বসানো। একটিতে সারাক্ষণ ভয়ংকর রোগা, লম্বা এবং অস্বাভাবিক ফর্সা একজন মানুষ বসে থাকেন। সম্ভবত তিনিই হেকিম আবদুর রব। তার হাতে একটা পত্রিকা থাকে, তবে সব সময় পত্রিকা পড়েন না। বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায়, হাতে পত্রিকা আছে ঠিকই, কিন্তু ভদ্রলোক তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে।

মিসির আলি এখন পর্যন্ত এই দোকানে দ্বিতীয় কোন মানুষ দেখেননি। সঙ্গত কারণেই হেকিমী, আয়ুর্বেদী জাতীয় চিকিৎসার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে আসছে। এই দোকানের সামনে এলেই মিসির আলির জানতে ইচ্ছা করে, এই লোকটির সংসার কি করে চলে? অনেক ব্যাপার আছে জানতে ইচ্ছা করলেও জানা যায় না। মিসির আলির পক্ষে সম্ভব নয় দোকানে ঢুকে হেকিম সাহেবকে জিজ্ঞেস করবেন, আপনার কাছে তো কখনো কাউকে আসতে দেখি না। আপনার সংসার কি করে চলে?

মানুষটা দিনের পর দিন খবরের কাগজ হাতে নিয়ে কি ভাবেন, তাও মিসির আলির জানতে ইচ্ছে করে। নিজে নিঃসঙ্গ বলেই বোধহয় আরেকজন নিঃসঙ্গ মানুষের। প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। এবং প্রায়ই ভাবেন কোন একদিন দোকানটির সামনে। রিকশা থেকে নেমে পড়বেন। কৌতূহল মিটিয়ে নেবেন। সেই কোন একদিন এখনো। আসছে না। কেন আসছে না এই নিয়েও মিসির আলি ভেবেছেন। তার ধারণা, মানুষের কৌতূহলের একটি থ্রেসহোল্ড লিমিট আছে। কৌতূহল সেই লিমিটের নিচে হলে মানুষ কখনো তা মেটাতে চেষ্টা করে না। যখন লিমিট অতিক্রম করে কেবল তখনি কৌতূহল মেটানোর জন্যে প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ড শুরু করে। রাস্তায় কোন ভিখিরী শিশুকে একা একা কাঁদতে দেখলে আমাদের কৌতূহল হয়। জানতে ইচ্ছে করে কেন সে কাঁদছে। কিন্তু সেই কৌতূহল থ্রেসহোল্ড লিমিটের নিচে বলে কখনো জিজ্ঞেস করা হয় না–এই মেয়ে কাঁদছ কেন?

পৌষ মাসের এক বিকেলে মিসির আলির কৌতূহল থ্রেসহোল্ড লিমিট অতিক্রম করল। তিনি দাওয়াখানার সামনে রিকশা থেকে নামলেন। এম্নিতেই হেকিম সাহেবের ঘর থাকে অন্ধকার। আজ আরো অন্ধকার লাগছে, কারণ সন্ধ্যা হয় হয় করছে, আকাশ মেঘলা। ঘরে এখনো বাতি জ্বালানো হয়নি।

খবরের কাগজ হাতে চেয়ারে বসে থাকা ভদ্রলোক চোখ তুলে মিসির আলির দিকে তাকালেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি নিস্পৃহ। সেখানে আগ্রহ বা অনাগ্রহ কোন কিছুরই ছোঁয়া নেই। দূর থেকে ভদ্রলোকের বয়স বোঝা যাচ্ছিল না। এখন বোঝা যাচ্ছে। বয়স ষাট ছাড়িয়ে গেছে, তবে হালকা পাতলা গড়ন বলে বোঝা যাচ্ছে না। এই বয়সে মানুষের মাথার চুল কমে যায়, তবে ভদ্রলোকের বেলায় তা হয়নি। তাঁর মাথা ভর্তি ধবধবে শাদা চুল।

মিসির আলি অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, আমি একটা সামান্য জিনিস আপনার কাছে জানতে এসেছি। আমি আপনার কাছেই থাকি, মান্ডার নয়াবাজারে।

‘বসুন।‘

মিসির আলি বসলেন। ভদ্রলোক খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, কি জানতে চান বলুন?

ভদ্রলোকের গলার আওয়াজ পরিষ্কার। মানুষের গলার শব্দেও বয়সের ছাপ পড়ে। এই ভদ্রলোকের তা পড়েনি। ভদ্রলোক তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন। মনে। হচ্ছে খানিকটা বিরক্ত হচ্ছেন। মিসির আলির অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল।

‘কি জানার জন্য এসেছেন বলুন?’

‘আপনার দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা–ইউনানী তিব্বিয়া দাওয়াখানা। ইউনানী তিব্বিয়া–শব্দ দুটার মানে কি?’

‘এটা জানার জন্যে এসেছেন?”

‘কেন জানতে চান?’

‘কৌতূহল, আর কিছু না।‘

‘আপনি কি করেন?’

‘তেমন কিছু করি না। এক সময় অধ্যাপনা করতাম। এখন সাইকোলজির উপর একটা বই লেখার চেষ্টা করছি। আপনিই কি হেকিম আবদুর রব?’

‘না। হেকিম আবদুর রব আমার দাদা। আমরা চার পুরুষের হেকিম। আমি হচ্ছি শেষ পুরুষ। আপনি শুধুমাত্র ইউনানী এবং তিব্বিয়া এই শব্দ দুটির অর্থের জন্যে আমার কাছে এসেছেন দেখে বিস্ময় বোধ করছি। অর্থ বলছি। আপনি কি চা খাবেন? সন্ধ্যাবেলা আমি এক কাপ চা খাই।‘

‘চা কি দোকান থেকে আনাবেন?’

‘না, আমি নিজেই বানাব। ভাল কথা, আপনার নাম জানা হয়নি।‘

‘আমার নাম মিসির আলি।‘

‘মিসির আলি সাহেব, আপনি কি ধূমপান করেন?’

‘জি করি।‘

‘আমার নাম আবদুল গনি। হেকিম আবদুল গনি। আপনি বসুন, আমি চা বানাচ্ছি।‘

মিসির আলি বসে রইলেন। আবদুল গনি সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। দোকানের পেছনে, র‍্যাকগুলির ওপাশে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। চায়ের সরঞ্জাম সেখানেই রাখা। মিসির আলি লক্ষ করলেন, বেশ দামী একটি ইলেকট্রিক কেতলিতে চায়ের পানি গরম হচ্ছে। চা দেওয়াও হল দামী কাপে। ভদ্রলোক সিগারেটের টিন বের করলেন। আবদুল্লাহ নামের মিশরীয় সিগারেট। ড্যাম্প যাতে না হয় তার জন্যে বাজারজাত করা হয় টিনের কৌটায়। বাংলাদেশে এই বস্তু সচরাচর চোখে পড়ে না।

আবদুল গনি সাহেব চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, আমার বড় মেয়ে কায়রোতে থাকে। সে মাঝে-মধ্যে উপহার হিসেবে এটা-সেটা পাঠায়। চায়ে চিনি হয়েছে?

‘জি।‘

‘এখন আপনার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। ইউনানী শব্দটা এসেছে খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীর ইউনান থেকে। ইউনান হল–গ্রীস দেশ। খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীর ইউনান বা গ্রীস ছিল চিকিৎসা শাস্ত্রের লীলাভূমি। হিপোক্রেটিসের মত পণ্ডিত এবং গ্যালেনের মত চিকিৎসকের কারণে চিকিৎসা শাস্ত্রের চরম উন্নতি হয়। গ্রীস থেকে এই বিদ্যা মুসলিম চিকিৎসকদের হাতে আসে। যেহেতু ইউনান হচ্ছে এই শাস্ত্রের কেন্দ্রভূমি, কাজেই তাঁরা এর নাম দেন ইউনানী।‘

‘আর তিব্বিয়া? তিব্বিয়াটা কি?’

‘তিব্বিয়া এসেছে ‘তিব্ব’ থেকে। আরবিতে ‘তিব্ব’ মানে চিকিৎসা সম্পর্কিত। আপনার কৌতূহল কি মিটেছে?’

‘জি।‘

‘আরো কিছু জানতে চাইলে আসবেন। এই বিষয়ে আমার কিছু পড়াশোনা আছে। আজ তাহলে উঠুন। সন্ধ্যার পর আমি দোকান বন্ধ করে দি। আমার চোখের অসুবিধা আছে। রাতে আমি ভাল দেখি না।‘

মিসির আলি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, রোগী আপনার কাছে কেমন আসে?

‘আসে না। আসার কথাও না। বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা অনেক দূর এগিয়েছে। এদের হাতে আছে শক্তিশালী এন্টিবায়োটিক, সালফা ড্রাগ। চিকিৎসা পদ্ধতি সহজ হয়েছে, দ্রুত হয়েছে। হেকিমী বিদ্যা আগে যেখানে ছিল এখনো সেখানেই আছে।

‘আপনার কথা থেকে তো মনে হচ্ছে বর্তমান আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার শুরুটা হচ্ছে ইউনানী।‘

‘হ্যাঁ তাই। বর্তমান কালের ডাক্তাররা হিপোক্রেটিস শপথ নেন। ইউনানী শাস্ত্রের উন্নতি হয় হিপোক্রেটিসের পৃষ্ঠপোষকতায়। মিসির আলি সাহেব, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। আজ তাহলে আপনি আসুন। রাতে আমি একেবারেই চোখে দেখি না। রিকশা এসে আমাকে বাড়িতে নিয়ে যায়।‘

.

মিসির আলি ঘর থেকে বের হয়ে এলেন।

তাঁর কৌতূহল শুধু ইউনানী তিব্বিয়া দাওয়াখানায় নয়–তাঁর কৌতূহল পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনেও। তিনি এই সব বিজ্ঞাপন গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়েন। শুধু পড়েই ভুলে যান না। ভাবেন। আবারো উদাহরণ–

“পত্রিকায় ছোট্ট একটি বিজ্ঞাপন বের হয়েছে। সব পত্রিকায় নয়, একটি মাত্র পত্রিকায়। হারানো বিজ্ঞপ্তি, বাড়ি ভাড়া, ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে নতুন ধরনের একটি বিজ্ঞাপন। শিরোনাম–পুরস্কৃত করা হবে। পুরস্কার শব্দটির আলাদা একটি মোহ আছে। বিজ্ঞাপনটা অনেকেই পড়ল। কেউ মাথা ঘামাল না। কারণ একটা অংকের ধাঁধা দেয়া। বলা হয়েছে, কেউ এটা পারলে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। কোন ঠিকানা নেই, বক্স নম্বর দেয়া। অল্প বয়েসী কিছু উৎসাহী ছেলেপুলে ধাঁধাটি নিয়ে কিছু চিন্তা-ভাবনা করল। কেউ মনে হয় সমাধান করতে পারল না। কারণ পরের সপ্তাহে আবার বিজ্ঞাপনটি বেরুল। তার পরের সপ্তাহে আবার। পরপর চার সপ্তাহ ছাপা হবার পর বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু না, অন্য একটি পত্রিকায় আবার ছাপা হল। সেই পত্রিকায় পরপর চার সপ্তাহ ছাপা হবার পর অন্য একটি পত্রিকায়। বিজ্ঞাপনটি এ রকম–

পুরস্কৃত করা হবে।

নীচে একটি অংকের সমস্যা দেয়া হল।
এর সমাধান কেউ করতে পারলে তাঁকে
পুরস্কৃত করা হবে। সমাধান ও পূর্ণ।
নাম-ঠিকানাসহ যোগাযোগ করুন।

জিপিও পোস্ট বক্স নং ৩১১

ছ’মাস ধরে বিজ্ঞাপন ঘুরে ঘুরে সব কটি বড় বড় পত্রিকায় ছাপা হল। তারপর বন্ধ হয়ে গেল। কেউ এটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। পত্র-পত্রিকায় বিচিত্র সব জিনিস ছাপা হয়। দেশে বাতিকগ্রস্তের পরিমাণ আশংকাজনকভাবে বাড়ছে। বাতিকগ্রস্তরা নিজেদের বাতিক অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চায়। এ জন্যে পয়সা খরচ করতে তাদের বাধে না। অংকের বিজ্ঞাপনটি নিশ্চয়ই এ রকম অংকের বাতিকওয়ালা কেউ দিয়েছে। কিছুদিন পর আবার নতুন কোন ধাঁধা তার মাথায় আসবে। আবার পয়সা খরচ করে বিজ্ঞাপন দেবে।”

.

মিসির আলি এক সকালে বিজ্ঞাপনটা পড়লেন। কাগজ কলম নিয়ে বসলেন, যদি অঙ্ক সমস্যার কোন সমাধান করা যায়।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, মিসির আলি সব সমস্যার সমাধান করতে পারেন না। কারণ তিনি অতিমানব নন। সাধারণ একজন মানুষ। সুন্দর যুক্তি উঁড়া করাতে পারেন। সর্বপ্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে চিন্তা করতে পারেন। তিনি বিশ্বাস করেন, এ জগতে কোন রহস্য নেই। কারণ প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে না। তারপরেও বারবার প্রকৃতির রহস্যের কাছে তিনি পরাজিত হন। এই পরাজয়ে আনন্দ আছে। সে আনন্দ মিসির আলি পান না। পাঠক হিসেবে আমরা পাই। মিসির আলি চরিত্রটির ধারণা কোত্থেকে পেলাম, কিভাবে পেলাম সেই প্রসঙ্গে একটি গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছি। নতুন করে সেই প্রসঙ্গে লিখতে ইচ্ছা করছে না বরং ভূমিকার অংশবিশেষ তুলে দি–

“তখন থাকি নর্থ ডাকোটার ফার্গো শহরে। এক রাতে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি মন্টানায়। গাড়ি চালাচ্ছে আমার স্ত্রী গুলতেকিন। পেছনের সীটে আমি আমার বড় মেয়েকে নিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছি। গুলতেকিন তখন নতুন ড্রাইভিং শিখেছে। হাইওয়েতে এই প্রথম বের হওয়া। কাজেই কথাবার্তা বলে তাকে বিরক্ত করছি না। চুপ করে বসে আছি এবং খানিকটা আতঙ্কিত বোধ করছি। শুধু মনে হচ্ছে, অ্যাকসিডেন্ট হবে না তো! গাড়ির রেডিও অন করা। কান্ট্রি মিউজিক হচ্ছে। ইংরেজি গানের কথা মন দিয়ে শুনতে ইচ্ছে করে না। কিছু শুনছি, কিছু শুনছি না এই অবস্থা। হঠাৎ গানের একটা কলি শুনে চমকে উঠলাম–

Close your eyes and try to see

বাহ, মজার কথা তো! আমি নিশ্চিত, মিসির আলি চরিত্রের ধারণা সেই রাতেই আমি পেয়ে যাই। মিসির আলি এমন একজন মানুষ যিনি দেখার চেষ্টা করেন চোখ বন্ধ করে। চোখ খুলেই যেখানে কেউ দেখে না সেখানে চোখ বন্ধ করে পৃথিবী দেখার এক আশ্চর্য ফলবতী চেষ্টা।

মিসির আলিকে নিয়ে লিখলাম অবশ্যি তারো অনেক পরে। প্রথম লেখা উপন্যাস ‘দেবী’। মিসির আলি নামের অতি সাধারণ মোড়কে একজন অসাধারণ মানুষ তৈরির। চেষ্টা ‘দেবী’তে প্রথম করা হয়। মিসির আলি এমন একজন মানুষ যাঁর কাছে প্রকৃতির নিয়ম-শৃঙ্খলাই একমাত্র সত্য। রহস্যময়তায় অস্পষ্ট জগৎ ইনি স্বীকার করেন না। সাধারণত যুক্তিবাদী মানুষ আবেগবর্জিত হন। যুক্তি এবং আবেগ পাশাপাশি চলতে পারে না। মিসির আলির ব্যাপারে একটু ব্যতিক্রমের চেষ্টা করা হল। যুক্তি ও আবেগকে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে দিলাম।…”

মিসির আলিকে নিয়ে আর কি লিখি! সবই তো মনে হয় লেখা হয়ে গেছে। একটা কথা না বললে প্রসঙ্গ অপূর্ণ থাকবে। কথাটা হল–মিসির আলি আমার প্রিয় চরিত্রের একটি। তাঁকে নিয়ে লিখতে আমার সব সময়ই ভাল লাগে। এই নিঃসঙ্গ, হৃদয়বান, তীক্ষ্ণ ধীশক্তির মানুষটি আমাকে সব সময় অভিভূত করেন। যতক্ষণ লিখি, ততক্ষণ তাঁর সঙ্গ পাই। বড় ভাল লাগে।

.

হিমু

হিমুর ভাল নাম হিমালয়।

বাবা খুব আদর করে ছেলের নাম হিমালয় রাখলেন, যাতে ছেলের হৃদয় হিমালয়ের মত বড় হয়। আকাশ রাখতে পারতেন। আকাশ হিমালয়ের চেয়েও বড়, বিস্তৃত। আকাশ রাখলেন না, কারণ আকাশ স্পর্শ করা যায় না। হিমালয় স্পর্শ করা যায়।

বাবা হিমালয়কে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলেন। তার ধারণা, বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা করে যদি ডাক্তার, ইজিনীয়ার বানানো যায়, তাহলে মহাপুরুষ বানানো যাবে না কেন? ট্রেনিং-এ মহাপুরুষ কেন হবে না? তিনি ছেলেকে মহাপুরুষ বানানোর বিশেষ ট্রেনিং দেয়া শুরু করলেন। হিমালয় কি মহাপুরুষ হল? না হয়নি। সে যা হয়েছে তা হচ্ছে—‘হিমু’।

হিমুকে নিয়ে প্রথম লিখি ময়ূরাক্ষী। ময়ূরাক্ষীর পর, দরজার ওপাশে–সর্বশেষ গ্রন্থের নাম –‘হিমু’।

আসলে হিমু কে? খুব সচেতন পাঠক চট করে হিমুকে চিনে ফেলবেন, কারণ হিমু হল মিসির আলির উল্টো পিঠ। বিজ্ঞানের ভাষায় এন্টি-মিসির আলি।

হিমুর কাজকর্ম রহস্যময় জগৎ নিয়ে। সে চলে এন্টিলজিকে। সে বেশির ভাগ সময়ই বাইরে বাইরে ঘুরে। রাত জেগে পথে পথে হাঁটে কিন্তু সেই সবচে’ বেশি। অন্তর্মুখী। মিসির আলি চোখ বন্ধ করে পৃথিবী দেখেন। সে চোখ খোলা রাখে কিন্তু কিছুই দেখে না।

মিসির আলি দেখতে কেমন আমি যেমন জানি না, হিমু দেখতে কেমন তাও জানি না। কোন বই-এ হিমুর চেহারার বর্ণনা নেই। যা আছে তাও খুব সামান্য। সে বর্ণনা থেকে চরিত্রের ছবি আঁকা যায় না। আমার নিজের মনে যে ছবিটি ভাসে তা হল–হাসি-খুশি ধরনের একজন যুবকের ছবি। যে যুবকের মুখে আছে কিশোরের সারল্য। শুধু চোখ দুটি মিসির আলির চোখের মতই তীক্ষ্ণ। তবে এই দুটি তীক্ষ্ণ চোখে কৌতুক ঝিকমিক করে। যেন সে সবকিছুতেই মজা পায়।

হিমুকে আনতে হয়েছে একটি বিশেষ কারণে। মিসির আলির জগৎ যে একমাত্র জগৎ নয় তা দেখানোর জন্যেই হিমুর প্রয়োজন হল। লজিক খুব ভাল কথা, সেই সঙ্গে এন্টিলজিকও যে লজিক এই তথ্যটিও মনে রাখা দরকার। ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রনে এসে পৃথিবী থেমে যায়নি। বস্তুজগতের মূল অনুসন্ধান করতে করতে এখন বিজ্ঞানীরা পাচ্ছেন–আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক, চার্ম, স্ট্রেঞ্জ … হচ্ছে কি

এসব!–কোথায় যাচ্ছি আমরা? আমরা কি খুব ধীরে ধীরে লজিকের জগতের। বাইরে পা বাড়াচ্ছি না? এই জগতের কথা তো মিসির আলিকে দিয়ে বলানো যাবে না। আমাদের দরকার একজন হিমু।

সম্প্রতি এক ইন্টারভ্যুতে আমাকে জিজ্ঞেস করা হল–কার প্রভাব আপনার। উপর বেশি–হিমুর, না মিসির আলির? আমি একটু থমকে গেলাম। দুটি চরিত্রই আমার তৈরি। প্রশ্নকর্তার কি উচিত ছিল না জিজ্ঞেস করা–আপনার প্রভাব এই দুটি চরিত্রের উপর কেমন পড়েছে?

পরক্ষণেই মনে হল প্রশ্নকর্তা ঠিক প্রশ্নই করেছেন–এক সময় আমি এদের সৃষ্টি করেছিলাম কিন্তু এরা এখন আমার পুরো নিয়ন্ত্রণে নেই। এদের ভেতর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এরাই বরং এখন আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমার নিজের সত্তার ৩০% হিমু, ৩০ মিসির আলি। বাকি চল্লিশ কি আমি জানি না। জানতে চাইও না।

.

মহামতি ফিহা

আমার লেখা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে ফিহা ঘুরেফিরে আসেন। হিমু এবং মিসির আলির মত তিনি কিন্তু এক ব্যক্তি নন। ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি। কোনটাতে তিনি মহাগণিতজ্ঞ। কোনটাতে পদার্থবিদ। যিনি চতুর্মাত্রিক জগতের সন্ধান দিয়েছেন। আমি নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র। বিজ্ঞান আমার অতিপ্রিয় বিষয়ের একটি। মহাপুরুষদের জীবনী। আমি যতটুক আগ্রহ নিয়ে পড়ি, মহান বিজ্ঞানীদের জীবনীও ঠিক ততটুক আগ্রহ নিয়েই পড়ি। সৃষ্টির রহস্য জানার জন্যে যে ব্যাকুলতা বিজ্ঞানীদের মধ্যে কাজ করে সেই ব্যাকুলতা মহাপুরুষদের ব্যাকুলতার চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। আমি আমার। লেখায় ঠিক এই কারণেই মহান বিজ্ঞানীদের ছবি এঁকেছি গভীর মমতায়। যেমন–ফিহা। ইনি দেখতে কেমন? চোখ বন্ধ করলে যে ছবিটি ভেসে উঠে তা অনেকটা আইনস্টাইনের ছবির মত। তবে মাথার সব চুল ধবধবে শাদা। চোখে-মুখে একটু রাগী ভঙ্গি আছে। এই রাগী ভঙ্গিটি কেন আছে আমি ঠিক জানি না। ইনি বাস করেন। শিশুদের জগতে। কেউ কখনো সেই জগৎ থেকে মহামতি ফিহাকে বের করতে পারে না। মজাটা এখানেই। মিসির আলি, হিমু এবং ফিহাদের একটা জায়গায় মিল–এরা সবাই নিঃসঙ্গ, বন্ধুহীন। সচেতন পাঠকরা এর থেকে কিছু বের করতে পারেন?

.

জরী, পরী, তিলু, বিলু, নীলু ও রানু

নারী চরিত্রে এই নামগুলি আমি বারবার ব্যবহার করেছি। এবং এখনো করছি। বারবার ব্যবহার করা হলেও এরা একই চরিত্র নয়। আলাদা চরিত্র। উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এইসব দিনরাত্রির নীলু হল বড় ভাবী। আর নীল হাতীর নীলুর বয়স হল সাত।

সে যাই হোক, আমার নায়িকারা সবাই অসম্ভব ‘রূপবতী’। ওরকম কেন? রূপ দেয়ার ক্ষমতা যখন আমার হাতে তখন কেন জানি কার্পণ্য করতে ইচ্ছে করে না।

আমার ছাব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত যত লেখালেখি তার বেশির ভাগ নায়িকা পরী, তিলু, বিলু, নীলু, রানু। নামগুলি সহজ এবং ঘরোয়া। ব্যবহার করতে ভাল লাগে। খুব পরিচিত মনে হয়।

ছাব্বিশ বছর বয়সে একটি বালিকার সঙ্গে পরিচয় হবার পর নতুন একজন নায়িকা লেখায় উঠে আসে। তার নাম জরী। বলাই বাহুল্য, সেও অসম্ভব রূপবতী। এই নায়িকা আমার পরবর্তী সব লেখাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করতে শুরু করে। কারণ যে বালিকার ছায়া দিয়ে জরী নামক চরিত্রের সৃষ্টি, সেই বালিকাটি আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। সাতাশ বছর বয়সে তাকে আমি বিয়ে করি। তখন তার বয়স মাত্র পনেরো। এই মেয়েটি আমার লেখালেখিতে খুব কাজে আসে। না, রাত জেগে চা বানানোর কথা বলছি না। আমি তাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই। বলেই কিশোরীর বিচিত্র মনোজগৎ সম্পর্কে জানতে পারি। একজন কিশোরীর। তরুণীতে রূপান্তরের সেই বিস্ময়কর প্রক্রিয়াটিও দেখা হয়। সবই উঠে আসে লেখায়।

আমার প্রথম দিকের লেখায় নায়িকাদের বয়স খুব কম–কারণ আমার স্ত্রী, তার বয়স কম। আস্তে আস্তে আমার নায়িকাদের বয়স বাড়ে, কারণ আমার স্ত্রীর বয়স বাড়ছে। ইদানিংকালের উপন্যাসে আমার নায়িকারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। কারণ গুলতেকিন (আমার স্ত্রীর কথা বলছি) বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তাহলে কি এই দাঁড়াবে যে সে যখন বৃদ্ধা হয়ে যাবে তখন আমার নায়ক-নায়িকারা হবে বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা?

নিজেকে এই ভেবে সান্ত্বনা দেই–না তা কেন হবে? আমার মেয়েরা এখন বড় হচ্ছে। আবারো খুব কাছ থেকে তাদের দেখছি। এরা হবে আমার ভবিষ্যৎ উপন্যাসের নায়িকা।

এখনো আমার কত কথা জমা হয়ে আছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, কিছুই তো বলা হয়নি, অথচ সময় কত দ্রুত চলে যাচ্ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরের ছুটি নিয়েছিলাম। সেই ছুটিও ফুরিয়ে যাচ্ছে, অথচ একটি পৃষ্ঠাও লেখা হয়নি। মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায়। বুকের ভেতর ধক করে উঠে। মনে হয়–

“ফুরায় বেলা, ফুরায় খেলা, সন্ধ্যা হয়ে আসে।”

আমি প্রার্থনা করি–হে মঙ্গলময়, তুমি আমাকে শক্তি দাও। ক্ষমতা দাও যেন আমি আমার কাজ শেষ করতে পারি। তুমি আমাকে পথ দেখাও। আমি পথ দেখতে পাচ্ছি না।

গুলতেকিন একসময় জেগে উঠে বলে, কি হয়েছে?

আমি হেসে তাকে আশ্বস্ত করি। সে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। আমি জেগে থাকি। আমার ঘুম আসে না।

লাউ মন্ত্র

জামালপুর গিয়েছিলাম, আশেক মাহমুদ কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল মুজিবর রহমান সাহেবের বাসায় দুপুরে খাওয়ার দাওয়াত। খেতে বসেছি–অনেক আয়োজনের একটি হচ্ছে চিংড়ি মাছ এবং লাউয়ের ঘণ্ট। ভাইস প্রিন্সিপাল সাহেবের স্ত্রী শংকিত গলায় জানতে চাইলেন–লাউ সিদ্ধ হয়েছে কি না। আমি বললাম, হয়েছে। মনে হলো তিনি তবুও নিশ্চিত বোধ করছেন না। পাশের জনকে জিজ্ঞেস করলেন। সে ও বলল, সেদ্ধ হয়েছে। আমি একটু বিস্মিত বোধ করলাম। খেতে ভালো হয়েছে কি না, ঝাল বেশি কি না সাধারণত এগুলো চাওয়া হয়। লাউ সেদ্ধ হয়েছে কি না, সচরাচর জানতে চাওয়া হয় না। কোনো ব্যাপার আছে কি?

ব্যাপার অবশ্যই আছে। সেটা জানা গেল রাতে গল্পের আসরে। ভদ্রমহিলা একজনের কাছ থেকে ছেলেবেলায় একটা মন্ত্র শিখেছেন। লাউয়ের দিকে তাকিয়ে সেই মন্ত্র পাঠ করলে লাউ সিদ্ধ হয় না। তিনি নাকি অসংখ্যবার পরীক্ষা করেছেন। একবার মন্ত্র পাঠ করবার পর লাউ যতই জ্বাল দেওয়া হোক নরম হবে না। বরং আরো শক্ত হবে। তিনি যখন লাউ রান্না করেন, মন্ত্র ভুলে থাকতে চেষ্টা করেন। তবু এক আধবার মনে পড়ে যায়। তিনি তটস্থ হয়ে থাকেন-লাউ বুঝি সেদ্ধ হয় না।

জগতে প্রচুর মন্ত্র-তন্ত্র আছে। বিশ্বকাপ ফুটবলে একটি আফ্রিকান দল সঙ্গে মন্ত্র পড়ার গুণীনও নিয়ে এসেছিল। সেই গুণীন বিংশ শতাব্দীর টিভি ক্যামেরার সামনে মন্ত্র পাঠ করেছে, সাদা রঙের মুরগি কেটে খেলার মাঠে রক্ত ছড়িয়ে দিয়েছে। মন্ত্রপাঠে শেষ রক্ষা হয় নি–খেলা জেতা হয় নি। ফুটবল খেলা একটা বড় ব্যাপার। এখানে জয়-পরাজয় আছে। জয়-পরাজয় যেখানে আছে সেখানেই মন্ত্র থাকতে পারে। কিন্তু লাউ সেদ্ধ হবে কী সেদ্ধ হবে না, এ নিয়েও যে মন্ত্র থাকতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল।

ভদ্রমহিলাকে বললাম, আপনি আমাকে মন্ত্রটা শিখিয়ে দিন। তিনি চেঁচিয়ে বললেন, কী সর্বনাশ! না! না!

তিনি যদি অন্য একজনের কাছে শিখতে পারেন, আমিও তার কাছ থেকে শিখতে পারি। ভদ্রমহিলা আমার এই যুক্তিতে কাবু হলেন না। আমার মন্ত্র শেখা হলো না।

আমাদের দেশে মন্ত্র-তন্ত্রের একটা প্রবল জোর সব সময়ই ছিল। সব বিষয়ে মন্ত্র ছিল। বসন্ত রোগ দূরীকরণ মন্ত্র। বসন্ত রোগ আনয়ন মন্ত্র। সাপে কাটার মন্ত্র, বশীকরণ মন্ত্র। বিয়ের মন্ত্র, বিয়ে ভাঙার মন্ত্র।

মজার ব্যাপার হলো, একদল শিক্ষিত মানুষ আবার এইসব বিশ্বাস করছেন। শুধু যে বিশ্বাস করছেন তা-ই না নিজেদের বিশ্বাস অন্যদের মাঝে ছড়ানোর চেষ্টা করছেন।

এই তো সেদিন মাথাব্যথায় কাতর হয়ে আছি। আমার বড় ভাই স্থানীয় বন্ধু টি এন্ড টির মুনীর আহমেদ সাহেব টেলিফোন করলেন। আমি বললাম, কথা বলতে পারছি না মুনীর ভাই, প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা। তিনি বললেন, আপনি টেলিফোন ধরে চুপচাপ বসে থাকুন তো, আমি মাথাব্যথা সারিয়ে দিচ্ছি।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কীভাবে সারাবেন?

মেডিটেশন করে সারানো যায়। আমি সিলভা কোর্স নিয়েছি। আপনি টেলিফোন রিসিভার কানে নিয়ে চুপ করে বসুন।

ও আচ্ছা।

ও আচ্ছা না। যা করতে বলছি করুন।

আমি মিনিট পাঁচেক টেলিফোন ধরে বোকার মতো বসে রইলাম এবং এক সময় বলতে বাধ্য হলাম যে আপনার মেডিটেশনে তেমন উপকার হচ্ছে না। যদি কিছু মনে না করেন দুটো প্যারাসিটামল খেয়ে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকব।

মুনীর আহমেদ সাহেব একসময় ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর মতো আধুনিক মানুষ যদি বিশ্বাস করেন–টেলিফোনে মাথাধরা সারানো যায় তাহলে আমাদের অশিক্ষিত মানুষজন মন্ত্র-তন্ত্র কেন বিশ্বাস করবে না?

মন্ত্রপাঠ করে গনগনে কয়লার আগুনের উপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য আমেরিকান টিভিতে দেখানো হয়েছিল। ব্যাপারটা আমেরিকানদের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। একদল সাহেব মন্ত্রতন্ত্রের পক্ষে খুব লেখালেখি শুরু করলেন। তখন ‘কেলটেকে’র (California Institute of Technology) বিজ্ঞানীরা ঠিক করলেন, পরীক্ষাটা তাঁরাও করবেন। তাঁরা থিওরি বের করলেন, হাঁটার কায়দা বের করলেন। যে কায়দায় হাঁটলে কয়লার তাপ পায়ের পাতা পুড়িয়ে ফেলার মতো শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে না। হাজার হাজার দর্শকের সামনে এই পরীক্ষাটি কেলটেকের বিজ্ঞানী করে দেখালেন যে গনগনে কয়লার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়। এসব বিজ্ঞানীর একজন আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ড. জাফর ইকবাল। তার কয়লার উপর দিয়ে হাঁটা নিয়ে দৈনিক বাংলার ফিচার পাতায় একটি ফিচারও প্রকাশিত হয়েছে।

এইসব ঘটনা মন্ত্র বিশ্বাসী মানুষকে টিলাতে পারে না। যে যা বলুক মন্ত্র আছে এই বিশ্বাসে তারা বোধহয় মনে এক ধরনের ভরসা পান। তন্ত্রের মূল উৎপত্তি নাকি কামরূপ কামাখ্যায়। সেটি নাকি নারী রাজত্ব। নারীরা সবাই মন্ত্র-তন্ত্র এবং বশীকরণ বিদ্যায় অতিশয় পটু। তারা সবাই উদ্ভিন্ন যৌবনা এবং পরীর মতো রূপবতী। কোনো পুরুষ ওই অঞ্চলে চলে গেলে সহজে জীবন নিয়ে ফিরতে পারে না–অসংখ্য তরুণীর মনোরঞ্জন করতে করতেই তার মৃত্যু হয় (বলাই বাহুল্য–সে মরণও স্বর্গ সমান) তবে কেউ যদি ফিরতে পারে সে মহা সৌভাগ্যবান) কারণ সে তন্ত্র-মন্ত্র শিখে আসে। বাকি জীবনটা তন্ত্র-মন্ত্র ব্যবহার করে সুখেই কাটিয়ে দিতে পারে।

ছোটবেলায় দেখেছি গরুর মন্ত্র জানা গুণীন। বছরের একটা বিশেষ সময়ে এরা উপস্থিত হয়। মন্ত্র পাঠ করে গরুর গায়ে ফুঁ দেয়। এই ফুঁ এমনই জোরালো যে আগামী এক বছর কোনো রোগবালাই গরুকে স্পর্শ করে না। মন্ত্রটা পুরোপুরি আমার মনে নেই, তবে মন্ত্রের শুরু এ রকম :

‘গোয়াল ঘরের পাশে।
খুকখুক কাশে
ছেলেমেয়েরা হাসে…’

গুণীনরা শুধু যদি মন্ত্রপাঠ করে চলে যেত তাহলে ব্যাপারটা তেমন অসহনীয় হতো না, কিন্তু মন্ত্র পাঠের সঙ্গে সঙ্গে তারা নিতান্তই অমানবিক একটা কাজ করে–গরুটাকে হাত পা বেঁধে শুইয়ে লোহা গনগনে গরম করে গরুর গায়ে ছ্যাঁকা দেওয়া হয়। চামড়া পুড়ে ধোঁয়া বের হতে থাকে। বেচারা গরু আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে।

এ জাতীয় নির্যাতন শুধু যে পশুদের উপর হয় তা না মানুষের উপরও হয়। খুব শৈশবে দেখা ছবি। গ্রামের একটি তরুণী বধূকে ভূতে ধরেছে। ভূতে ধরলে লজ্জা শরম নাকি থাকে না–মেয়েটি গায়ের কাপড় বারবার ফেলে দিচ্ছে। গ্রামে পর্দা প্রথা কঠিন। কিন্তু ভূত ধরা মেয়েদের জন্যে মনে হয় পর্দা প্রথার কড়াকড়ি তেমন নেই। অনেক পুরুষ মানুষ উঁকি দিয়ে দেখছে। যে ওঝা মন্ত্র পাঠ করছে-সে-ও মাঝ বয়সী। মন্ত্র পাঠ করার ফলে মেয়েটির সারা গায়ে হাত বুলাবার সুযোগ পাচ্ছে। এই কাজটিতে সে আনন্দ পাচ্ছে বলেই মনে হয়। একপর্যায়ে সে মেয়েটির গায়ের সব কাপড় খুলে ফেলল। বড়া আমাদের তাড়া দিল, পুলাপান কী দেখে? দূর হও, দূর। হও। আমরা দূর হলাম। বড়দের জগতের সব কাণ্ডকারখানা আমরা বুঝি না। দূর হওয়াই ভালো। তা ছাড়া ওঝা এখন শুকনা মরিচ পোড়াতে দিয়েছে মেয়েটির দুই নাকের ফুটায় জ্বলন্ত শুকনো মরিচ ঠেসে ধরা হবে। এই দৃশ্য না দেখাই ভালো।

আমার শহীদুল্লাহ হলের বাসায় একবার এক বৃদ্ধ মহিলা তার কলেজে পড়া নাতিকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন। নাতিকে খুব লায়েক মনে হলো। তার গায়ে রঙচঙা শার্ট, দিনের বেলাতেও চোখে কালো চশমা। তাঁদের সঙ্গে পেটমোটা কালো ব্যাগ। ভদ্রমহিলা ব্যাগ খুলে নানা কাগজপত্র বের করতে লাগলেন। কাগজপত্রের। সঙ্গে আছে পত্রিকার ক্লিপিং, প্রশংসাপত্র। আমি বললাম, ব্যাপার কী? তিনি বললেন, আগে এইগুলান মন দিয়া পাঠ করেন। পরে কথা বলব। কথার দাম নাই–লেখার দাম আছে।

আমি যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে কাগজপত্র পড়ে যা জানলাম তা হচ্ছে–তিনি ক্যানসার, এপিলেপ্সি এবং জলাতংক রোগ সারাতে পারেন এবং গ্যারান্টি সহকারে সারান। এই তিন কালান্তর ব্যাধি যিনি সারাতে পারেন তার অবস্থা দেখে মায়া লাগে। পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। শাড়িতে কোনো তালি চোখে পড়ল না, তবে গায়ের চাদরে তালি।

বুঝলেন ভাইডি, আমি তিন ধরনের চিকিৎসক। আফনেরে ভাই ডাকলাম। আফনে আমার মর্ম বুঝবেন।

আমি বোনের মর্ম তেমন বুঝলাম না। ভদ্রমহিলাকে দেওয়া প্রশংসাপত্র দেখতে লাগলাম। একটি প্রশংসাপত্র জনৈক সিভিল সার্জনের দেওয়া। তিনি লিখেছেন (ইংরেজি ভাষায়) এই মহিলা ম্যালিগন্যান্ট টিউমারে আক্রান্ত একজনকে সারিয়ে তুলেছেন। তিনি তার চাক্ষুষ সাক্ষী। তিনি এই মহিলার সাফল্য কামনা করেন।

যে মানুষ ম্যালিগন্যান্ট টিউমার সারিয়ে তোলে তাকে নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে হৈচৈ পড়ে যাওয়ার কথা। সিভিল সার্জন ভদ্রলোক কোনো হইচই-এ না গিয়ে একটি প্রশংসাপত্র দিয়েছেন।

আমি বললাম, আপনি কী করে রোগ সারান? ওষুধপত্র দেন?

ওষুধপত্র আমার কিছু নাই ভাইডি। আমার আছে মন্ত্র।

মন্ত্র পেয়েছেন কীভাবে?

গায়েবিতে পাইছি। আছরের নামাজ পইড়ে জায়নামাজে বইস্যে তসবি টানতেছি তখন গায়েবিতে পাইলাম।

তিন রোগের জন্যে এক মন্ত্র? না তিন রোগের তিন মন্ত্র?

একই মন্ত্র। তয় ভাইডি পড়নের কায়দা ভেন্ন।

আমার কাছে কী জন্যে এসেছেন?

এইটা কী কথা কলেন ভাইডি? বোন ভাইয়ের কাছে আসবি না?

তা তো আসবেই। তবু আপনার কোনো উদ্দেশ্য থাকলে বলুন।

একটা চিডি যে দেওয়া লাগে ভাইডি। একটা কাগজে লিখে দেবেন–আমার। চিকিৎসায় রোগ সারে। তারপরে নাম সই করবেন।

আমি বিরস গলায় বললাম, ক্যানসার, এপিলেপ্সি এবং জলাতংক এই তিন রোগের যে কোনো একটা যদি আমার হয়, আপনারে খবর দেব। তারপর আপনি এসে মন্ত্রপাঠ করে আমার অসুখ সারাবেন। তখন আমি প্যাডে সুন্দর করে সার্টিফিকেট দেব।

আমার বোন কথা শুনে রেগে গেলেন। খিটমিটে গলায় বললেন, এতগুলান লোক যে চিডি দেল? এরা কী মিথ্যা দেল? এর মধ্যে একজনায় আছে মন্ত্রী। ওরে, সেকান্দর মন্ত্রীর চিড়ি উনারে দেখা।

সেকান্দর মন্ত্রীর চিঠি বের করে দিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্যাডে প্রশংসাপত্র।

কী, ভাইডি দেখলেন?

জি দেখলাম।

বিশ্বেস হলো?

হয় নি।

না হইলে কী আর করা? জোর কইরে তো বিশ্বাস করানো যায় না! তা ভাইডি, জোহর হয়েছে–জায়নামাজ দিতে বলেন, নামাজ পড়া লাগবে।

আপনি নিয়মিত নামাজ পড়েন?

এইটা কী কথা বলেন ভাইডি? সাত বছর বয়স থেইকে নামাজ পড়ি। একবার অসুখে কাজা গেল। কাফফারা দিলাম।

আমি বললাম, ইসলাম ধর্মে মন্ত্র-তন্ত্র নিষিদ্ধ, তা কি জানেন না? আমাদের ধর্মে বলা হয়েছে যারা মন্ত্র-তন্ত্র করে এবং যারা এইসব বিশ্বাস করে তারা কবিরা গুহাহ করে।

সবই জানি ভাইডি। তয় এর মধ্যে বিষয় আছে। তুমি বুঝবা না, তোমার জ্ঞান কম।

আমার বোনকে বিদেয় করতে যথেষ্ট কষ্ট করতে হলো। বোনের হাঁটুতে বাতের ব্যথা, চিকিৎসা করাবেন। সেই চিকিৎসার খরচ বাবদ একশ টাকা এবং রিকশা ভাড়া বাবদ দশ টাকা দিতে হলো।

তিনটি কালান্তক ব্যাধির চিকিৎসায় যিনি সিদ্ধহস্ত তাঁকে সামান্য হাঁটুর ব্যথায় কাতর হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখলাম।

.

সম্প্রতি আমার বাসায় উইপোকার আগমন ঘটেছে। উইপোকা বই কেটে লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। নানান ওষুধপত্র দিয়েও তাদের কাবু করা যাচ্ছে না। এরা শুধু যে বই খাচ্ছে তাই না, বইয়ের আলমিরাও খেয়ে ফেলছে। মন খুব খারাপ, এই অবস্থায় আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক বললেন, উইপোকা এম্নিতে দূর হবে না। এরা ভয়াবহ। সব ছারখার করে দেবে। তবে তিনি উইপোকা দূর করার মন্ত্র জানেন। আমি যদি চাই তিনি মন্ত্র পাঠ করে উইপোকা দূর করবেন। আমি বললাম, মন্ত্রে উইপোকা দূর হবে?

অবশ্যই দূর হবে। মন্ত্র পাঠ করলে রানি উইপোকা মারা যাবে। উইপোকার বংশবৃদ্ধি হবে না।

আপনি কি আগেও উইপোকা দূর করেছেন?

হা করেছি। আপনি পরীক্ষা করে দেখুন। পরীক্ষা করতে তো আপত্তি নেই।

আমি বললাম, এক শর্তে আমি পরীক্ষা করতে রাজি আছি–মন্ত্রটা আপনি কাগজে লিখে দিবেন। তারপর মন্ত্র পাঠ করবেন। ভদ্রলোক রাজি হলেন না। মন্ত্র নাকি শেখাতে নেই। এতে মন্ত্রের জোর কমে যায় এবং যে মন্ত্র প্রকাশ করে দেয় তার ক্ষতি হয়।

যা-ই হোক, আমি উইপোকা তাড়াবার মন্ত্র জোগাড় করেছি। যাদের বাসায় উইপোকা আছে তারা এই মন্ত্রের ক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। মন্ত্র পাঠের নিয়ম হলো, উইপোকার কিছু মাটি হাতে নিতে হবে, তাতে সমপরিমাণ লবণ মিশাতে হবে। মাটি এবং লবণ মাখতে মাখতে মন্ত্র পাঠ করতে হবে। অবশ্যই মন্ত্র পাঠের সময় শরীর শুদ্ধ হতে হবে। চোখ থাকবে বন্ধ। মন্ত্র পাঠ হলে–লবণ মাখা মাটি উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমে ছড়িয়ে দিতে হবে।

মন্ত্রে কাজ হয় কি?

আমার বেলায় হয় নি। তবে আমি অবিশ্বাসী লোক, আমার বেলায় কাজ না হওয়ারই কথা। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর।

(মন্ত্র)
উত্তর দক্ষিণ সান
বজরং প্রমাণ
উই উই সান।
বজরং প্রমাণ
পূর্ব পশ্চিম সান
উই উই প্রমাণ।
কালীর দিব্যি ধরি
অহমন্তি ধাম

দুর্জনং বন্দেৎ
পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর দক্ষিণ সান।
উই উই প্রমাণ।

লালচুল

ভদ্রলোকের বয়স সত্তরের মত।

মাথার চুল টকটকে লাল। মাথার লালচুলের জন্যেই হয়ত তাকে রাগী রাগী। দেখাচ্ছে। তাছাড়া কোমরের মাংসপেশীতে টান পড়ায় তিনি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভঙ্গিটা অনেকটা সাপের ফণা তোলার মত। যেন এক্ষুনি ছোবল দেবেন। আমি বললাম, স্লামালিকুম।

তিনি বললেন, হুঁ।

সালামের উত্তরে সালাম দেয়াটাই প্রচলিত বিধি। তিনি হুঁ বলে এড়িয়ে গেলেন। তবে আপ্যায়ন বা শিষ্টতার কোন অভাব হল না। আমাকে হাত ধরে বসালেন। কাজের ছেলেকে চা দিতে বললেন।

আমার কাছে মনে হল ভদ্রলোক অসুস্থ। তার মাথার চুল যেমন লাল চোখ দুটিও লাল। খুব ঘন ঘন চোখের পাতা ফেলছেন। আমি এত দ্রুত কাউকে চোখের পাতা ফেলতে দেখিনি। বয়স বাড়লে মানুষ ঘন ঘন চোখের পাতা ফেলে কিনা তাও লক্ষ করিনি। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ভদ্রলোক বললেন, আমার চোখে সমস্যা। আছে। চোখে অশ্রুগ্রন্থি বলে কিছু ব্যাপার আছে। সেখান থেকে জলীয় পদার্থ বের হয়ে সব সময় চোখ ভিজিয়ে রাখে। আমার ঐসব গ্রন্থি নষ্ট হয়ে গেছে।

আমি বললাম, আপনার চুল এমন লাল কেন?

উনি বললেন, রঙ দিয়ে লাল করেছি। মেন্দী পাতা এবং কাঁচা হলুদের সঙ্গে সামান্য থানকুনি পাতা বেটে মিশিয়ে একটা পেস্টের মত তৈরি করে চুলে মাখলেই চুল এমন লাল হয়। আপনি যখন আমার মত বুড়ো হবেন, মাথার চুল সর্ব পেকে যাবে, তখন মাথায় রঙ ব্যবহার করতে পারেন। মাথায় রঙ ব্যবহার করা ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ নয়। নবী করিমের হাদিস আছে। তিনি খেজাব ব্যবহার করার পক্ষে মত দিয়েছেন। খেজাব’ হচ্ছে এক ধরনের রঙ যা চুলে লাগানো হয়।

‘ও আচ্ছা।‘

‘মাথাভর্তি সাদা চুল আমার পছন্দ না। সাদা চুল হল White Flag, যা মনে। করিয়ে দেয় খেলা শেষ হয়ে গেছে। তৈরি হয়ে নাও। দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি, বেলা শেষ প্রহর।‘

‘আপনি তৈরি হতে চাচ্ছেন না!’

‘তৈরি তো হয়েই আছি। শাদা ফ্ল্যাগ উড়িয়ে সবাইকে জানাতে চাচ্ছি না।‘

ভদ্রলোকের বাড়ি প্রকাণ্ড। বেশির ভাগ প্রকাণ্ড বাড়ির মত এ বাড়িটিও খালি। তার দুই মেয়ে। দু’জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। তারা স্বামীর সঙ্গে বাইরে থাকে। পত্নী বিয়োগ হয়েছে চার বছর আগে। এগারো কামরার বিশাল বাড়িতে ভদ্রলোক কিছু কাজের লোকজন নিয়ে থাকেন। পুরোপুরি নিঃসঙ্গ মানুষরা নানান ধরনের জটিলতায় ভুগেন। বিচিত্র সব কাজকর্মে তারা থাকতে চেষ্টা করেন। সঙ্গী হিসেবে এরা কখনোই খুব ভাল হয় না। কারণ তারাই সঙ্গী হিসেবে কাউকে গ্রহণ করতে চান না।

এই ভদ্রলোকও দেখলাম তার ব্যতিক্রম নন। তিনি দেখলাম, এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারছেন না। জায়গা বদল করছেন। এবং কিছুক্ষণ পরপর ঘরের ছাদের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাচ্ছেন। ভাবটা এ রকম যেন ঘরের ছাদটা কিছুক্ষণের মধ্যে ভেঙে তাঁর মাথায় পড়ে যাবে।

আমি যে কাজের জন্যে এসেছিলাম সেই কাজ সারলাম। ভদ্রলোকের ছোট মেয়ের স্বামীর ঠিকানা দরকার ছিল। তিনি ঠিকানা দিতে পারছেন না, তবে টেলিফোন নাম্বার দিলেন। আমি চা খেয়ে উঠতে যাচ্ছি, তিনি বললেন, আহা, বসুন না। বসুন। অল্পক্ষণ বসুন। গল্প করুন।

নিঃসঙ্গ একজন বৃদ্ধের অনুরোধ এড়ানো মুশকিল। আমি বসলাম, কিন্তু কি বলব ভেবে পেলাম না। এই বয়সের মানুষ কি ধরনের গল্প পছন্দ করে? পরকালের গল্প? ধর্ম? আমি জানি, একটা বিশেষ বয়সের পর মানুষজন ঘোর আস্তিক হয়ে যায়। কঠিনভাবে ধর্ম-কর্ম পালন করে। ধর্মের কথা শুনতে ভালবাসে। মৃত্যুতেই সব শেষ না–মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকার সম্ভাবনাই তাদের জন্যে মৃত্যু নামক অমোঘ বিধান। মেনে নিতে সাহায্য করে।

আমি বললাম, আপনি বলুন আমি শুনি। পরকাল সম্বন্ধে বলুন। মৃত্যুর পর কি হবে?

তিনি চোখ পিটপিট করে বললেন, মৃত্যুর পর কি হবে মানে? কিছুই হবে না। শরীর পঁচে-গলে যাবে। শরীরের যে ফান্ডামেন্টাল পার্টিকেলস আছে–ইলেক্ট্রন, প্রোটন, নিউট্রন এরা ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। ফান্ডামেন্টাল পার্টিকেলস-এর ক্ষয় নেই। কাজেই এদেরও ক্ষয় হবে না।

‘আপনি কি ধর্ম-টর্ম বিশ্বাস করেন না?”

তিনি উত্তরে এমন সব কথা বলতে লাগলেন যা শুনলে ঘোর নাস্তিকরাও নড়ে-চড়ে বসবে এবং বলবে–বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এতটা বাড়াবাড়ি ভাল না। সালমান রুশদী তার কাছে কিছু না। একটু আগে যিনি নবীজীর খেজাব ব্যবহারের হাদিস দিলেন সেই তিনিই তার সম্পর্কে এমন সব উক্তি করতে লাগলেন যা শুনলে নিরীহ টাইপের মুসলমানরাও চাকু হাতে তার পায়ের রগ খুঁজতে বের হয়ে যাবে। এই আলোচনা আমার তেমন পছন্দ হচ্ছিল না। আরবের মরুভূমির একজন নিরক্ষর ধর্মপ্রচারক হয়েও যিনি সেই সময়কার ভয়াবহ আইয়ামে জাহেলিয়াত লোকজনদের মন মানসিকতাই শুধু পরিবর্তন করেননি–সারা পৃথিবীতে এই ধর্মের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাকে তুচ্ছ করা ঠিক না। সমাজে অবিশ্বাসী তো থাকতেই পারে। অবিশ্বাসীদের যে কুৎসা ছড়াতে হবে তা তো না। আমি লক্ষ করেছি, অবিশ্বাসীরা কুৎসা ছড়ানো তাদের পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করেন। বছর দু-এক আগে যীশু খ্রিস্ট সম্পর্কে জনৈক আমেরিকান স্কনার (?)-এর একটি লেখা পড়েছিলাম, যাতে তিনি প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে, যীশু খ্রিস্ট ছিলেন একজন হমোসেকসুয়েল।

আমি লালচুল এই ভদ্রলোকের সঙ্গে তর্কে যেতে পারতাম। ইচ্ছা করল না। তার। চেয়েও বড় কথা, ধর্ম সম্পর্কে আমার পড়াশোনাও তেমন নেই। ভদ্রলোকের দেখলাম। পড়াশোনা ব্যাপক। কোরান শরীফ থেকে মূল আরবী এবং সেখান থেকে সরাসরি ইংরেজী অনুবাদ যেভাবে স্মৃতি থেকে বের করতে লাগলেন তা আমার মত মানুষকে ভড়কে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আমার উঠা দরকার। উসখুস করছি। ভদ্রলোক যে উৎসাহের সঙ্গে কথা বলছেন তাতে তাকে থামাতেও মন সায় দিচ্ছে না। তিনি এর মধ্যে চায়ের কথা বলেছেন। আমি তাতেও আগ্রহ বোধ করছি না। এ বাড়িতে কাজের মানুষ চা বানানো এখনো শিখেনি। আগের চা-টা দু চুমুক দিয়ে রেখে দিয়েছি। নতুন চা এরচে’ ভাল হবে এই আশা করা বৃথা। এমন সময় এক কাণ্ড হল, লালচুল ভদ্রলোক হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, একটু বসুন। মাগরেবের নামাজের সময় হয়েছে। নামাজটা শেষ করে আসি। মাগরেবের নামাজের জন্যে নির্ধারিত সময় আবার অল্প। আমি মনে মনে বললাম–”হলি কাউ।”

ভদ্রলোক নামাজ পড়ার জন্যে সময় বেশি নিলেন না। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে বসলেন। হাসিমুখে বললেন, স্যরি, আপনাকে বসিয়ে রাখলাম। তাহলে আবার ডিসকাশন শুরু করা যাক–তিনি আবারো কথা বলা শুরু করলেন। কথার মূল বিষয় হচ্ছে–ধর্ম মানুষের তৈরি, আল্লাহ মানুষ তৈরি করেননি। মানুষই আল্লাহ তৈরি করেছে।

আমি বললাম, আপনি ঘোর নাস্তিক। কিন্তু একটু আগে নামাজ পড়তে দেখলাম। নামাজ পড়েন!

‘হ্যাঁ পড়ি। গত পঁচিশ বছর যাবত পড়ছি। খুব কমই নামাজ কাজা হয়েছে।‘

‘রোজাও রাখেন?’

‘অবশ্যই।‘

‘পঁচিশ বছর ধরে রাখছেন?’

‘হবে, তবে দু’বার রাখতে পারিনি। একবার গল ব্লাডারের জন্যে অপারেশন হল তখন, আরেকবার–হার্নিয়া অপারেশনের সময়। দুটাই পড়ে গেল রমজান মাসে।‘

‘ঘোর নাস্তিক একজন মানুষ নামাজ-রোজা পড়ছেন এটা আপনি ব্যাখ্যা করবেন কি ভাবে? আপনি তো মন থেকে কিছু বিশ্বাস করছেন না। অভ্যাসের মত করে যাচ্ছেন। তাই না কি!’

ভদ্রলোক জবাব দিলেন না। আমি বললাম, না-কি আপনার মনে সামান্যতম হলেও সংশয় আছে?

‘না, আমার মনে কোন সংশয় নেই। আমার নামাজ-রোজার পেছনে একটি গল্প আছে। শুনতে চাইলে বলতে পারি।‘

‘বলুন।‘

‘আমি জজীয়তি করতাম। তখন আমি বরিশালের সেসান ও দায়রা জজ। আমি কঠিন প্রকৃতির মানুষ। খানিকটা বোধহয় নির্দয়। অপরাধ প্রমাণিত হলে কম শাস্তি দেবার মানসিকতা আমার ছিল না। অপরাধ করেছে, শাস্তি ভোগ করবে। এই আমার নীতি। দয়া যদি কেউ দেখাতে চায় তাহলে আল্লাহ বলে যদি কেউ থাকে সে দেখাবে। আল্লাহ দয়ালু। আমি দয়ালু না।

এই সময় আমার কোর্টে একটি মামলা এল। খুনের মামলা। সাত বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে খুন হয়েছে। পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলা মেয়েটিকে ডেকে নিয়ে গেছে, তারপর সে আর তার স্বামী মিলে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। জমিজমা নিয়ে শত্রুতার জের। সাক্ষ্য-প্রমাণ সবই আছে। আমার মনটা খারাপ হল। শত্রুতা থাকতে পারে। তার জন্যে বাচ্চা একটা মেয়ে কেন প্রাণ হারাবে? মেয়েটার বাবা সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদতে কাঁদতে কাঠগড়াতেই অজ্ঞান হয়ে গেল।

মামলা বেশিদিন চলল না। আমি মামলার রায় দেবার দিন ঠিক করলাম। যেদিন রায় হবে তার আগের রাতে রায় লিখলাম। সময় লাগল। হত্যা মামলার রায় খুব সাবধানে লিখতে হয়। এমনভাবে লিখতে হয় যেন আপিল হলে রায় না পাল্টায়। আমি মৃত্যুদণ্ড দেব, আপিলে তা খারিজ হয়ে যাবে, তা হয় না।

আমি স্বামীটিকে মৃত্যুদণ্ড দিলাম। তার স্ত্রীকেও মৃত্যুদণ্ড দেবার ইচ্ছা ছিল। এই মহিলাই বাচ্চা মেয়েটিকে ডেকে নিয়ে এসেছে। প্রধান অপরাধী সে। আইনের হাত সবার জন্যেই সমান হলেও মেয়েদের ব্যাপারে কিছু নমনীয় থাকে। আমি মহিলাকে দিলাম যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

রায় লেখা শেষ হল রাত তিনটার দিকে। আমি হাত-মুখ ধুয়ে নিজেই লেবুর সরবত বানিয়ে খেলাম। খুব ক্লান্ত ছিলাম। বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর ঘুম। এমন গাঢ় নিদ্রা আমার এর আগে কখনো হয়নি।

আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নের অংশটি মন দিয়ে শুনুন। স্বপ্নে দেখলাম, ৭/৮ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে। কোকড়ানো চুল। মেয়েটি আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সে তার নাম-টাম কিছুই বলল না। কিন্তু মেয়েটিকে দেখেই বুঝলাম–এ হল সেই মেয়ে যার হত্যার জন্যে আমি রায় লিখেছি। একজনের ফাঁসি এবং অন্যজনের যাবজ্জীবন। আমি বললাম, কি খুকী, ভাল আছ?

মেয়েটি বলল, হুঁ।

‘কিছু বলবে খুকী?’

‘হুঁ।‘

‘বল।”

মেয়েটি খুব স্পষ্ট করে বলল, আপনি ভুল বিচার করেছেন। এরা আমাকে মারে নি। মেরেছে আমার বাবা। বাবা দা দিয়ে কুপিয়ে আমাকে মেরে দা’টা ওদের খড়ের। গাদায় লুকিয়ে রেখেছে। যাতে ওদেরকে মামলায় জড়ানো যায়। ওদের শাস্তি দেয়া যায়। আমাকে মেরে বাবা ওদের শাস্তি দিতে চায়।

‘তুমি এসব কি বলছ? অন্যকে শাস্তি দেয়ার জন্য কেউ নিজের মেয়েকে মারবে?”

মেয়েটি জবাব দিল না। সে তার ফ্রকের কোণা দিয়ে চোখ মুছতে লাগল।

আমার স্বপ্ন ভেঙে গেল। দেখলাম ভোর প্রায় হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফজরের আজান হল। আমি রান্নাঘরে ঢুকে নিজেই এক কাপ চা বানিয়ে খেলাম। স্বপ্নের ব্যাপারটিকে তেমন গুরুত্ব দিলাম না। স্বপ্ন গুরুত্ব দেয়ার মত কোন বিষয় না। দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ এইসবই স্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়। আমি মামলাটা নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা করেছি। স্বপ্ন হচ্ছে সেই চিন্তারই ফসল। আর কিছু না।

স্বপ্নের উপর নির্ভর করে বিচার চলে না।

রায় নিয়ে কোর্টে গেলাম। কোর্ট ভর্তি মানুষ। সবাই এই চাঞ্চল্যকর মামলার রায় শুনতে চায়।

রায় প্রায় পড়তেই যাচ্ছিলাম হঠাৎ কি মনে হল–বলে বসলাম, এই মামলার তদন্তে আমি সন্তুষ্ট নই। আবার তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছি। কোর্টে বিরাট হৈচৈ হল। আমি কোর্ট এডজড় করে বাসায় চলে এলাম। আমার কিছু বদনামও হল। কেউ কেউ বলতে লাগল, আমি টাকা খেয়েছি। আমি নিজে আমার দুর্বলতার জন্যে মানসিকভাবে খানিকটা বিপর্যস্তও হলাম। আমার মত মানুষ স্বপ্নের মত অতি তুচ্ছ একটা ব্যাপার দ্বারা পরিচালিত হবে, তা হতে পারে না। আমার উচিত জজীয়তি ছেড়ে দিয়ে আলুর ব্যবসা করা।

যাই হোক, সেই মামলার পুনঃ তদন্ত হল। আশ্চর্যের ব্যাপার, মেয়েটির বাবা নিজেই হত্যাপরাধ স্বীকার করল। এবং আদালতের কাছে শাস্তি প্রার্থনা করল। আমি তার ফাঁসির হুকুম দিলাম। বরিশাল সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসি কার্যকর হল। ঘটনার পর আমার মধ্যে সংশয় ঢুকে গেল। তাহলে কি পরকাল বলে কিছু আছে? মৃত্যুর পর আরেকটি জগৎ আছে? ঘোর অবিশ্বাস নিয়ে ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা শুরু করলাম। নামাজ রোযা আরম্ভ হল। আশা ছিল, এতে আমার সংশয় দূর হবে। যতই পড়ি ততই আমার। সংশয় বাড়ে। ততই মনে হয় God is created by man. তারপর নামাজ পড়ি এবং প্রার্থনা করি–বলি, হে মহাশক্তি, তুমি আমার সংশয় দূর কর। কিন্তু এই সংশয় দূর হবার নয়।

‘নয় কেন?’

কারণ আমাদের পবিত্র গ্রন্থেই আছে–সূরা বাকারার সপ্তম অধ্যায়ে বলা আছে।

“Allah hath set a seal
On their hearts and on their hearing
And on their eyes is a veil.”

“আল্লাহ তাদের হৃদয় এবং শ্রবণেন্দ্রিয়কে ঢেকে দিয়েছেন, এবং টেনে দিয়েছেন চোখের উপর পর্দা।”

আমি তাদেরই একজন। আমার মুক্তি নেই।

ভদ্রলোক চুপ করলেন। আমি বিদায় নেবার জন্যে উঠলাম। তিনি আমাকে বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। আমি বললাম, আপনি আসছেন কেন? আপনি আসবেন না। তিনি মুখ কুঁচকে বললেন, আমাদের নবীজীর একটা হাদিস আছে। নবীজী বলেছেন–কোন অতিথি এলে তাকে বিদায়ের সময় বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিও।

এই বলেই তিনি বিড়বিড় করে নবী সম্পর্কে অত্যন্ত আপত্তিকর কিছু কথা বলে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। সম্ভবত এশার নামাজের সময় হয়ে গেছে।

লেখালেখি খেলা

ময়মনসিংহে গ্রন্থমেলা হচ্ছে।

আমি এক ফাঁকে একটু দূরে সরে গিয়ে চা খাচ্ছি। তখনি তাকে দেখলাম। অল্প বয়েসী ছেলে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। আমি বললাম, তুমি কি আমাকে কিছু বলবে?

সে বলল, হ্যাঁ।

বলে ফেল।

আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব। আপনি ঠিকঠাক জবাব দেবেন। মিথ্যা জবাব না।

আমি বললাম, তোমার কেন ধারণা হল আমি মিথ্যা জবাব দেব?

সে চুপ করে রইল। আমি বললাম, কি তোমার প্রশ্ন?

ব্যর্থ কবিরাই ঔপন্যাসিক হন। আপনি কবি হিসেবে ব্যর্থ বলেই ঔপন্যাসিক হয়েছেন।

আমি বললাম, এটা তো কোন প্রশ্ন না। তুমি আমার উপর একটি বক্তব্য রেখেছ। আমার তো এখানে বলার কিছু নেই। বলতে চাচ্ছিও না।

ছেলেটি রাগী গলায় বলল, আপনাকে স্বীকার করতে হবে যে আপনি একজন ব্যর্থ কবি।

আমি লক্ষ্য করলাম, ছেলেটির চোখ-মুখ কঠিন হয়ে গেছে। সে কথা বলছে রাগী ভঙ্গিতে। এইসব ক্ষেত্রে ছেলেটি যা বলছে তাতে রাজি হয়ে গেলেই সমস্যা মিটে যায়। রাজি হয়েও যেতাম। নিজেকে ব্যর্থ কবি বলতে আমার অহংবোধ আহত হবে না। কিন্তু ছেলেটির জেদী ভঙ্গি আমার ভাল লাগল না। কাজেই চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে আমি ছেলেটির মতই চোখ-মুখ কঠিন করে বললাম, নিজেকে ব্যর্থ কবি আমি কেন বলব? আমি তো কবিতা লিখি না। কবিতা লিখে যদি ব্যর্থ হতাম তখন বলতাম আমি ব্যর্থ। কবি। আমি যে যুক্তিতে নিজেকে ব্যর্থ গায়ক বা ব্যর্থ অভিনেতা বলব না, একই যুক্তিতে ব্যর্থ কবি অপবাদও মাথা পেতে নেব না।

ছেলেটি আমার যুক্তির ধার দিয়েও গেল না, চোখ-মুখ আরো কঠিন করে বলল, আপনি কবিতা লিখতে পারেন না বলেই উপন্যাস লিখছেন। এটা আপনাকে স্বীকার করতেই হবে।

এটা স্বীকার করলে কি তুমি খুশি হও?

আমার খুশি হওয়া না হওয়া কিছু না, আপনাকে স্বীকার করতেই হবে যে আপনি একজন ব্যর্থ কবি।

আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, আচ্ছা বেশ, স্বীকার করলাম।

মুখে স্বীকার করলে হবে না। কাগজে লিখে দিতে হবে।

কাগজ নিয়ে এসো, লিখে দিচ্ছি।

সে কাগজ নিয়ে এল, আমি সেখানে লিখলাম–আমি কবিতা লিখতে পারি না বলেই গল্প-উপন্যাস লিখি। আমি একজন ব্যর্থ কবি। সই করলাম, তারিখ দিলাম। ছেলেটি যুদ্ধজয়ের আনন্দ নিয়ে চলে গেল।

সে কেন এরকম করল?

কোন কারণে সে কি আমার উপর রেগে ছিল? তাকে রাগাবার মত আমি কি করতে পারি? হয়ত আমার লেখা তার ভাল লাগে না। তা তো হতেই পারে। লেখা। ভাল না লাগলে পড়বে না, কিন্তু রাগ করবে কেন? হয়ত সে নিজে একজন কবি। কবিরা অভিমানী হয়, রাগী হয়, এবং কেন জানি খানিকটা ছেলেমানুষও হয়। এদেশের বেশকিছু কবিকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কাব্যপ্রতিভা ছাড়াও আরো যা আছে তা রাগ, অভিমান এবং ছেলেমানুষী।

আমার নিজের কাব্যপ্রতিভা নেই, কিন্তু বাকি তিনটি যথেষ্ট পরিমাণেই আছে। ময়মনসিংহের ঐ ছেলেটিকে যখন কাগজে লিখে দিলাম–”কবিতা লিখতে পারি না বলেই গল্প-উপন্যাস লিখি” তখন ভুল লিখিনি, ঠিকই লিখেছি। ব্যাপারটা আসলে তাই।

ছাপার অক্ষরে আমার প্রথম প্রকাশিত রচনা কবিতা। পাঠক-পাঠিকারা শুনে হাসবেন, সেই কবিতা ইংরেজি ভাষায় লেখা। তখন পড়ি বগুড়া জিলা স্কুলে। স্কুল ম্যাগাজিনে লেখা দিতে হবে। চারটা কবিতা (বাংলায়) জমা দিলাম। স্যার বললেন, হাবিজাবি এইসব কি লিখেছিস? অগা-বগা লিখলেই কবিতা হয়?

আমি মরমে মরে গেলাম। স্যার বললেন, ইংরেজি সেকশান খালি যাচ্ছে, যদি পারিস ইংরেজিতে কিছু লিখে দে। সুন্দর করে একটা Essay লিখে নিয়ে আয়–A journey by boat PapeTi Village carnival.

আমি পরদিন একটা ইংরেজি কবিতা লিখে ফেললাম। কবিতার নাম ‘God’, প্রথম চার লাইন ও

Let the Earth move
Let the Sun shine
Let them to prove
All are in a line.

স্যার বললেন–মন্দ না। শেষে মিল আছে।

কবিতা ছাপা হল। কবির ছবিসহ। বাবা কবিতা পড়ে গম্ভীর গলায় বললেন, মধুসূদন হবার চেষ্টা করছিস না-কি? ইংরেজিতে কে তোকে কবিতা লিখতে বলল? বাংলা ভাষাটা আছে কি জন্যে?

ঘটনার তিন বছর পর বাংলা ভাষায় দুটি কবিতা প্রসব করলাম। ‘প্রসব’ শব্দটা আমার পছন্দ নয় তবু ব্যবহার করলাম এই কারণে যে কবিতা দুটি বের করতে প্রসব যন্ত্রণার মতই যন্ত্রণা হল। রাতে ঘুম হয় না। মাথার ভেতর কবিতার লাইন ঘুরে। পুরো কবিতা না, একটা মাত্র লাইন।

কবিতার ছন্দ-টন্দ কিছুই জানি না, অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, পয়ার, অমিত্রাক্ষর এইসব শুনেছি–কোনটা কি জানি না। অথচ দুটা কবিতা লেখা হয়ে গেছে।

তখন পড়ি ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে। ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র ছাত্রীরা খুব সাহসী হয়। কাজেই আমিও খুব সাহসী হয়ে এক কাজ করে বসলাম। দুটি কবিতা কপি করে পাঠিয়ে দিলাম দৈনিক পাকিস্তানে (এখন দৈনিক বাংলা)। তবে নিজের নাম দিলাম না। আমার ছোটবোনের নাম দিলাম–মমতাজ আহমেদ শিখু। ছোটবোনের নাম দেয়ার পেছনে যুক্তি হচ্ছে–কবিতা দুটি আমার কাছে পুরুষ কবির কবিতা হিসেবে বেশ দুর্বল মনে হচ্ছিল। তবে মহিলা কবির লেখা হিসেবে মন্দ নয়। দৈনিক পত্রিকার মহিলা পাতায় ছাপা যায়।

আমার এই বক্তব্যে মহিলারা রাগ করবেন না, ফার্স্ট ইয়ারে পড়া একটি বাচ্চা ছেলে এরকম ভাবলে ক্ষতি নেই। এখন আমি এরকম ভাবি না। মেয়েদের ছোট করে দেখার প্রবণতা আমাদের সমাজে আছে। আমার মধ্যে তা নেই। অনেক অনেক আগেই। তা দূর হয়েছে। আমি নিশ্চিত, মেয়েদের মানসিক ক্ষমতা পুরুষদের চেয়ে বেশি। তবে। সেই ক্ষমতার অনেকটাই তাঁদের নষ্ট করতে হয় শিশুদের লালন-পালন করে বড় করতে গিয়ে। কিছু ক্ষমতা নষ্ট হয় স্বামী নামক মানুষটিকে সুখী রাখার নানান প্রক্রিয়া উদ্ভাবনে। তার উপর আছে নিজেকে আড়াল করে রাখার এক বিচিত্র প্রবণতা।

মূল গল্পে ফিরে আসি–ছোটবোনের নামে কবিতা পাঠিয়ে অপেক্ষা করছি। ছাপা হবে এমন দুরাশা নেই–কারণ, শুনেছি সম্পাদকরা অপরিচিত কারোর লেখা পড়েন না। তাঁদের এত সময় নেই।

কি আশ্চর্য কাণ্ড! যে সপ্তাহে কবিতা পাঠালাম, তার পরের সপ্তাহে দৈনিক পাকিস্তানের মহিলা পাতায় দুটি কবিতাই এক সঙ্গে ছাপা হয়ে গেল। শুধু তাই না, সম্পাদিকা একটি চিঠিও পাঠালেন–

“প্রিয় আপা,
কবিতা ছাপা হল। আরো কবিতা পাঠাবেন।”

কি সর্বনাশ! শেষে কিনা মহিলা কবি? সম্পাদিকার চিঠি পাওয়ার পর ঠিক করলাম, না, আর কবিতা না। যথেষ্ট হয়েছে। এবার মন দিয়ে পড়াশোনা করা যাক। কবিতার খাতা নষ্ট করে ফেললাম। কবিতার ভূত মাথা থেকে নেমে গেল।

ছোটবোনের নামে প্রকাশিত আমার সেই দু’টি কবিতার একটির কয়েকটি লাইন তুলে দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। কবিতার নাম “একশ’ ফানুস”।

দিতে পার একশ’ ফানুস এনে
আজন্ম সলজ্জ সাধ
একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই।

দীর্ঘদিন ধরে গদ্য লিখছি। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়–আহা, কেন লেগে থাকলাম না! সমগ্র মনপ্রাণ দিয়ে কবিতাকে কাছে পেতে চাইলে হয়ত সে কাছে আসত। দরজার ওপাশ থেকে ফিরে যেত না। কিংবা কে জানে সে হয়ত এখনো অপেক্ষা করছে–যদি তাকে ডাকি।

শিল্পী সুলতান

ভাইবোনদের নিয়ে বেড়াতে গিয়েছি যশোহর। আমাদের লম্বা পরিকল্পনা–যশোহর থেকে যাব কুষ্টিয়া–রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি দেখব। তারপর যাব মেহেরপুর, দেখব আমবাগানে মুজিবনগর। আমরা পনেরোজন মানুষ, সম্বল একটা নয় সীটের মাইক্রোবাস। মাইক্রোবাসের ড্রাইভার আমাদের কাদের মিয়া। ড্রাইভিং ছাড়া অন্যসব কাজ সে খুব ভাল জানে। আমার প্রবল সন্দেহ সে ডান চোখে দেখে না। রাস্তার ডানদিকে কোন গাড়ি এলে সে মোটেই বিচলিত হয় না। ঐ গাড়ির দিকে সরাসরি। মাইক্রোবাস চালাতে থাকে। আমাদের সবাইকে এক সঙ্গে চেঁচাতে হয়–কর কি? কর কি? কাঁদেরের যন্ত্রণায় গাড়ির ক্যাসেটে গান শোনা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। গান বাজালেই সে মাথা নাড়তে থাকে এবং দু’হাতে স্টিয়ারিং হুইলে তাল দেয়। হাঁটু নাচায়।

এমন বিপদজনক ড্রাইভার নিয়ে দীর্ঘ ভ্রমণ কেউ করবে না। কিন্তু আমার উপায় নেই। কাদেরকে নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছি। সে গাড়ি নিয়ে নানান কায়দা-কানুন করে যাচ্ছে। উদাহরণ দেই, ফাঁকা রাস্তায় ঘণ্টায় সত্ত্বর কিলোমিটার বেগে গাড়ি যাচ্ছে। আচমকা সে ব্রেক কষল। আমরা একে অন্যের গায়ে গড়িয়ে পড়লাম। আমি বললাম, কি ব্যাপার কাদের?

কাদের নির্বিকার গলায় বলল, ব্রেক ঠিক আছে কিনা একটু টেস্ট করলাম।

টেস্টে কি পাওয়া গেল, ব্রেক ঠিক আছে?

জি, ঠিক আছে আলহামদুলিল্লাহ।

ভবিষ্যতে এরকম টেস্ট করবে না।

জি আচ্ছা।

আরেক দিনের কথা–হঠাৎ কাঁদেরের দিকে তাকিয়ে দেখি সে আপন মনে হাসছে। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, হাসছ কেন?

সে আনন্দিত স্বরে বলল, গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম স্যার। ঘুম ভাঙার পরে দেখি গাড়ি ঠিকমতই চলছে। এইজন্যে হাসতেছি। আল্লাহপাকের কি কুদরৎ!

তুমি তো আমাদের সবাইকে মারবে।

এটা স্যার ভুল কথা বললেন, হায়াৎ-মউতের মালিক আল্লাহপাক। উনার হুকুম ছাড়া কিছু হবে না।

তোমার অবস্থা যা, আমার তো মনে হয় উনি খুব শিগগিরই হুকুম দেবেন। সাবধানে গাড়ি চালাও, খুব সাবধানে।

আমি স্যার খুব সাবধান। এই প্রথম গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়েছি।

এই সাবধানী ড্রাইভারকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানে মানসিক নির্যাতনের ভেতর দিয়ে যাওয়া। যশোরে পৌঁছে ঠিক করলাম–প্রোগ্রাম কাটছাঁট করব। যেখানে না গেলেই নয় সেখানে যাব। যেমন যশোরে দু’টি জায়গায় যাওয়ার কথা–সাগরদাড়ি, মাইকেল মধুসূদনের বসতবাড়ি। এবং নড়াইল, শিল্পী সুলতানের বাড়ি।

সাগরদাঁড়িতে গেলে বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ মাইকেল মধুসূদনের বিখ্যাত মৃত্যুগাথা পড়ে আসা যায়–

“দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে ….
তিষ্ঠ ক্ষণকাল …”

অন্যদিকে আছেন জীবন্ত কিংবদন্তী শিল্পী সুলতান। যিনি ছবি আঁকেন নাচতে নাচতে। ছবি আঁকার সময় অপার্থিব কিছু যেন তাঁর উপর ভর করে। তিনি ঘোরের মধ্যে চলে যান। বিশাল সব ক্যানভাসে যখন তুলি টানেন তখন তাঁর সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপে। এসব অবশ্যি আমার শোনাকথা। তাঁকে আমি কখনো ছবি আঁকতে দেখিনি। তাঁর সম্পর্কে শোনাকথারও কোন অন্ত নেই। বিচিত্র সব গল্প তাঁকে নিয়ে প্রচলিত। একটি হচ্ছে–শিল্পী সুলতানের পাঞ্জাবীর দু’পকেটে দুটি বিড়াল থাকে। তিনি পাঞ্জাবী গায়ে একবার নিউমার্কেটে এসেছেন। এক পকেটমার মানিব্যাগ হাতানোর জন্যে তাঁর পকেটে হাত ঢুকিয়েছে। বিড়াল তার হাত কামড়ে দিল। শুধু যে কামড়ে দিল তাই না, কামড় দিয়ে হাতে ঝুলতে লাগল। কিছুতেই সেই বিড়াল ছাড়ানো যায় না। পকেটমারকে ঘিরে লোকে লোকারণ্য।

শিল্পী সুলতানকে নিয়ে আরেকটি খবর কয়েকদিন আগে পড়লাম। খবরের ক্যাপশান–‘সুলতানের সমুদ্রযাত্রা। শিল্পী সুলতান ৬০ ফুট লম্বা এক নৌকা বানিয়েছেন। পরিকল্পনা হল–তিনি তার জন্মদিনে নৌকা ভর্তি করবেন তাঁর পোষা। পঞ্চাশটা বিড়াল দিয়ে। তারপর যাত্রা করবেন সমুদ্রের দিকে। আর লোকালয়ে ফিরবেন না।

এত কাছে এসে এমন একজন বিচিত্র মানুষের কর্মকাণ্ড না দেখে আসা অন্যায় হবে। আমরা নড়াইলে যাওয়া ঠিক করলাম। মাইক্রোবাসে সবাই বসলাম গাদাগাদি করে। বোঝার উপর শাকের আঁটির মত স্থানীয় দু’জন গাইডও আমাদের সঙ্গে আছেন। কাদেরকে বললাম–গাড়ি খুব আস্তে চালাবে। যা করতে বলা হয় সে তার উল্টোটা করে। কাজেই সে ঝড়ের গতিতে চলল।

শিল্পী সুলতানের বাড়ি ‘চিত্রা নদীর তীরে। বাড়ির ঠিক পেছনেই শান্ত চিত্রা নদী। কি আশ্চর্য! সেই নদীতে সত্যি সত্যি বিশাল এক রঙিন নৌকা। সমুদ্রযাত্রার জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছে। আমরা নদীর দিকে তাকিয়ে, নৌকার দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম, অপূর্ব! সুলতান সাহেব আনন্দে হেসে ফেললেন। একমাত্র শিশুরাই এত সুন্দর করে হাসতে পারে। তিনি গভীর আগ্রহে বললেন–আমার বাড়িটা দেখুন।

বাড়ির দিকে তাকালাম। প্রাচীন কালের মুনি ঋষিদের তপোবন। তপোবন আমি দেখিনি কিন্তু তপোবনের যে ছবি আমার কল্পনায় আছে তার সঙ্গে সুলতান সাহেবের বাড়ির কোন অমিল নেই। চারদিকে বিচিত্র গাছপালা, লতাগুল্ম। আলো এবং আঁধার। কি পরিষ্কার উঠোন, একটা শুকনো পাতাও নিচে পড়ে নেই। আমি কিছু বলার আগেই সুলতান সাহেব বললেন, কী সুন্দর, ঠিক না?

আমি বললাম, খুবই সুন্দর! এতটা সুন্দর ভাবিনি।

খুশি হয়েছেন?

খুব খুশি হয়েছি।

কাউকে খুশি হতে দেখলে আমার ভাল লাগে।

তিনি ক্রমাগত হাসছেন। তার চোখে-মুখে আনন্দ ঝরে পড়ছে। রোগা লম্বা একজন মানুষ। গায়ে শাদা পাঞ্জাবী। ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে মাথার অগোছালো চুল। স্বপ্নময় চোখ। আমি বললাম, আপনাকে দেখে বুঝতে পারছি ঢাকার পত্রিকায় আপনার সম্পর্কে যেসব খবর ছাপা হয় তা ঠিক না।

সুলতান সাহেব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি ছাপা হয়?

আপনার না-কি পঞ্চাশটা পোষা বিড়াল আছে।

সুলতান সাহেব দুঃখিত গলায় বললেন, কেন যে এরা বানিয়ে বানিয়ে খবর দেয়। আমার বিড়ালের সংখ্যা খুবই কম–মাত্র পঁচিশ।

কত বললেন?

পঁচিশটা। আর কুকুর তার চেয়েও কম–আটটা মাত্র কুকুর।

ও।

আপনি দেখবেন?

জি দেখব।

এরা বড় ভাল।

সুলতান সাহেব ডাক দিতেই প্রকাণ্ড সব কুকুর নানাদিক থেকে বের হতে শুরু করল। এ কী কাণ্ড! আমি জানলাম, প্রতিটি কুকুর এবং প্রতিটি বিড়ালের আলাদা আলাদা নাম আছে। সেই নামে তাদের ডাকলে তারা সাড়া দেয়।

সুলতান সাহেব তাঁর কুকুরদের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, পত্রিকার লোকেরা বানিয়ে বানিয়ে লেখে। এইসব বানানো লেখা পড়ে আমার মনটা খারাপ হয়। এক পত্রিকায় লিখেছে–আমি নাকি বেজী পুষি। পকেটে বেজীর বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াই।

আপনি বেজী পুষেন না?

সুলতান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, না। আমি সাপ পুষি।

কি পুষেন বললেন?

সাপ। আমার গোটা দশেক কেউটে সাপ আছে। দেখবেন?

আমি আঁৎকে উঠে বললাম, জি না, দেখব না। এরা থাকে কোথায়?

বাগানেই ঘোরাফিরা করে। বড় লক্ষ্মী। যখন এঁকেবেঁকে যায়, বড়ই মায়া লাগে।

আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল–কি শুনছি এসব? বাগানে ঘোরাফেরা করে পোষা কেউটে?

সুলতান সাহেব হাসিমুখে বললেন, লোকজন সাপকে কেন এত ভয় করে আমি কিছুই বুঝি না। আল্লাহ তো এদের খুব পছন্দ করেন।

আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম, আল্লাহ এদের পছন্দ করেন?

অবশ্যই করেন। পছন্দ করেন বলেই এমন তীব্র বিষ এদের এতটা করে। দিয়েছেন। অন্য কোন প্রজাতিকে তো এত বিষ দেয়া হয়নি–।

বাগানে ঘুরে বেড়ানোর প্রাথমিক আনন্দ আমার কেটে গেছে। আমি এখন ঘুরছি ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে। আমার দলের অন্যরাও বিচলিত। তবে সুলতান সাহেবের ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা দেখার উত্তেজনায় মনে হচ্ছে তারা খানিকক্ষণের জন্যে সাপের কথা ভুলে গেছে।

চিড়িয়াখানায় নানান ধরনের জীবজন্তু। প্রকাণ্ড এক সারসপাখিও তাদের মধ্যে আছে। আলাদা আলাদা খাঁচায় নানান প্রজাতির বানর। একটি বিশাল আকৃতির বানর। খুব হৈচৈ করছিল। সুলতান সাহেব তাকে আহত গলায় বললেন, তুমি এরকম করছ কেন? তুমি তো বড়ই দুষ্টামি করছ। এরা মেহমান। মেহমানদের সামনে হৈচৈ করা কি ঠিক?

বানর সঙ্গে সঙ্গে ভদ্র হয়ে গেল এবং মাথা চুলকাতে লাগল। যেন সে বলছে–মাফ করে দেবেন স্যার। মিসটেক হয়ে গেছে। আর হবে না।

এর মধ্যে চা দেয়া হয়েছে। চায়ের সঙ্গে দু’তিন রকমের মিষ্টি। নারিকেলের নাড়। এক হিন্দু মহিলা তদারকি করছেন। কঠিন ধরনের মহিলা বলে মনে হল। সুলতান। সাহেব আমাদের সঙ্গে চা খেতে চাচ্ছেন–মহিলা চা দেবেন না। রাগী গলায় তিনি বললেন, লোভ করবেন না। লোভ করা ভাল না। আপনার শরীর কত খারাপ আপনি জানেন না। রোজ আপনাকে অক্সিজেন খাওয়াতে হয়। আজ সকালেও একবার অক্সিজেন খাওয়ালাম।

বিছানার পাশে অক্সিজেন সিলিন্ডার। এমন অসুস্থ একজন মানুষকে বেশিক্ষণ বিরক্ত করা ঠিক না। উঠে দাঁড়ালাম। সুলতান সাহেব বললেন, শরীরটা বড় খারাপ করেছে। ছবি আঁকতে পারছি না। একটা বড় কাজে হাত দিয়েছি–কিন্তু …। আগেও একবার মরতে বসেছিলাম। রওশন এরশাদ আমাকে ঢাকায় নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। একমাস হাসপাতালে ছিলাম। তিনি রোজ খাবার। পাঠাতেন। যখনই সময় পেতেন আমাকে দেখতে আসতেন।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কোন রওশন এরশাদ?

এরশাদ সাহেবের স্ত্রী।

সে কি!

জানি না কি কারণ। উনি আমাকে বড়ই স্নেহ করেন। উনি কেমন আছেন আপনি কি জানেন?

জি না, আমি জানি না। ঐ মহিলার প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই।

আমাকে বড়ই স্নেহ করতেন। মানুষের স্নেহ-ভালবাসা তুচ্ছ করার জিনিস নয়। আমি করি না। ভালবাসা মনে রাখি।

সুলতান সাহেব হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন। বিষণ্ণতা তার চোখ থেকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, অনেক কিছু করার শখ ছিল। করতে পারিনি। এখন মনে হচ্ছে সময় বোধহয় ফুরিয়ে গেল।

আমি প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বললাম, এখন তো ঢাকা হয়েছে শিল্প-সাহিত্যের কেন্দ্র। ঢাকা থেকে এত দূরে আছেন, আপনার অসুবিধা হয় না?

না। দূরেই ভাল আছি। কোলাহল ভাল লাগে না। এখানে প্রবল শান্তি অনুভব করি। ফার ফ্রম দি মেডিং ক্রাউড।

আপনার রুটিন কি? সময় কাটান কি করে?

বেশির ভাগ সময় বাগানে বসে বসে ভাবি।

কি ভাবেন?

সুলতান সাহেব হাসলেন। তিনি কি ভাবেন তা হয়ত কাউকে জানতে দিতে চান। আমি বললাম, আপনি কি আনন্দে আছেন?

হ্যাঁ, আনন্দে আছি। খুব আনন্দে আছি। একদল ছেলেমেয়ে আমার কাছে ছবি আঁকা শিখতে আসে। এরা মনের আনন্দে কাগজে রঙ লাগায়–দেখে খুব আনন্দ পাই। নৌকা তৈরি শেষ হলে ওদের নিয়ে বের হয়ে পড়ব।

কোথায় যাবেন?

সমুদ্রের দিকে যাব। আপনি কি লক্ষ্য করেছেন নৌকায় অনেক জানালা?

লক্ষ্য করেছি।

বাচ্চারা বসবে জানালার পাশে। যা দেখবে তার ছবি আঁকবে। ভাবতেই ভাল লাগছে।

আমারও ভাবতে ভাল লাগছে।

আমি বললাম, আজ উঠি।

সুলতান সাহেব বললেন, আরো খানিকক্ষণ বসুন।

বসলাম আরো কিছুক্ষণ। লক্ষ্য করলাম সুলতান সাহেবের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তিনি এই শারীরিক কষ্ট অগ্রাহ্য করার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। মনটা খুব খারাপ হল।

বিদায় নেবার আগে সুলতান সাহেবের স্টুডিওতে ঢুকলাম। মাটি থেকে ছাদ পর্যন্ত উঁচু বিশাল এক ক্যানভাস। ছবি অনেকখানি আঁকা হয়েছে। একদল পেশীবহুল নারী পুরুষ কাজ করছে। কি অপূর্ব ছবি! শিল্পী সুলতান তাঁর নিজের স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়েছেন ক্যানভাসে। ক’জন মানুষ তা পারে?

শ্বেতপদ্ম

আমাদের ছোটবেলায় নাপিতের দোকানে কিছু ‘অতি আবশ্যকীয় চিত্রকলা সাজানো থাকতো। এমন কোন নাপিতের দোকান ছিল না যেখানে (১) তীরবিদ্ধ বোররাকের ছবি, (২) ক্ষুদিরামের ফাঁসির ছবি, (৩) তাজমহলের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি না ঝুলতো। এই তিন ছবির সঙ্গে চুল কাটার কি সম্পর্ক আমি জানি না–নাপিতরা হয়ত জানেন। তাঁদের জিজ্ঞেস করা হয়নি।

এই তিন ছবির একটি, তাজমহলের প্রচার অনেক বেশি ছিল। প্রায় প্রতিটি মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বসার ঘরে ফ্রেমে বাঁধানো সূচিকর্ম হিসেবে তাজমহল থাকত। তার সঙ্গে থাকত দু’লাইনের কবিতা–

ভেতরে তাহার মমতাজ নারী
বাহিরেতে শাহজাহান।

সবার শেষে থাকত সৃচি শিল্পীর নাম এবং তারিখ। তারিখের শেষে ইং অর্থাৎ ইংরেজি সন কিংবা বাং অর্থাৎ বাংলা সন। সেই সময়ে বিয়ে নামক ইন্সটিটিউশনে ঢোকার আগে মেয়েদের অবশ্য শিক্ষণীয় কর্মকাণ্ডের একটি ছিল–সেলাইয়ের কাজ। সেলাইয়ের কাজের অনেকগুলি ধাপ ছিল। জরীর তাজমহল হচ্ছে সর্বশেষ ধাপ। সঁচকর্মের এম.ফিল. ডিগ্রীর মত। মেয়ে দেখতে এসে মুরব্বিরা এক পর্যায়ে বলতেন–কই, তাজমহলটা দেখি?

রূপালী জরীর একটি তাজমহল আমার মাও বানিয়েছিলেন (কবিতা সহ)। সেই তাজমহল দীর্ঘদিন আমাদের বসার ঘরে রবীন্দ্রনাথের ছবির পাশে শোভা পেয়েছে। মা’র তাজমহল দেখে আমি তাজমহলের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। এটাকে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য কেন বলা হয় কিছুতেই বুঝতে পারি না। মসজিদের মত একটা দালান, সুন্দর হলেই বা কতটা সুন্দর হবে? যেমন মস্কোর ঘণ্টা। এটিও সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য। ব্যাপার হচ্ছে একটা ঘণ্টা বড় হলেও সেটা ঘণ্টাই। তার সামনে গিয়ে হা করে দাঁড়িয়ে থাকার কি থাকতে পারে? এরচে’ ব্যবিলনের শূন্যোদ্যানকে অনেক আকর্ষণীয় মনে হয়। নাম শুনলেই মনে হয়–চমৎকার একটা বাগান আকাশে ঝুলছে। ব্যবিলনের শূন্যোদ্যান দেখতে যাওয়া যেতে পারে কিন্তু তাজমহল না।

লেবু কচলে তিতা বানানোর ব্যাপার তাজমহলের ক্ষেত্রে ঘটেছে। ছবি এঁকে, কবিতা লিখে, গান লিখে তাজমহলকে শুধু যে তিতা বানানো হয়েছে তাই না–যক্ষতিতা বানানো হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে–অধিকাংশ কবি তাজমহল নিয়ে কবিতা লিখেছেন তাজমহল না দেখে। এর মধ্যে আছেন কবি রবীন্দ্রনাথ। তাজমহল না দেখেই তিনি যে কবিতা লিখলেন–তার নাম ‘তাজমহল’। তবে তাঁর অতি বিখ্যাত কবিতা ‘শা-জাহান’ অবশ্যি তাজমহল দেখার পরে লেখা পূর্ণেন্দু পত্রী ও সাহিত্যের তাজমহল।]

কবিদের তাজমহল নিয়ে এত যে উচ্ছ্বাস, এত যে লেখালেখি তার সবটাই প্রেম বিরহ নিয়ে। তাজমহলের সৌন্দর্য নিয়ে কাউকে তেমন মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি। তাজমহলের সৌন্দর্য হয়ত তাঁদের আকৃষ্ট করেনি–তাজমহলে প্রেমের মীথটাই তাঁদের আকৃষ্ট করেছে। যাঁরা তাজমহল দেখেছেন তাঁরা সবাই যে মুগ্ধ হয়ে আহা-উঁহু করেছেন তা না। অনেকের কাছেই ভাল লাগেনি। অনেকের মধ্যে একজন হলেন রুডইয়ার্ড কিপলিং (নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কথাশিল্পী)। অন্যজনও অতি বিখ্যাত মানুষ। এলডুস হাক্সলি। তিনি বললেন -”The Taj was a disappointment.

তারপরও প্রতিবছর পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ এসে জড় হয়। তারা ফিরে যায়। তাদের মধ্যে একদল আবার আসে। অনেকের নেশা ধরে যায়। ঘুরে ঘুরে আসতেই থাকে। এমন একজন হলেন–নর্থ ডাকোটায় আমি যে বাড়িতে থাকতাম, তার বাড়িউলী। মহিলার বয়স আশির উপরে। তিনি এ পর্যন্ত চারবার ‘তাজ’ দেখেছেন–আবারো যাবার ইচ্ছা। আমি ‘তাজের’ এত কাছাকাছি থেকেও তাজ দেখিনি শুনে তিনি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন আমি প্রস্তরযুগের একজন মানুষ–‘পিকিংম্যান’। তিনি প্রায় ধমক দেয়ার মত বললেন, দেখনি কেন?

আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, দেখতে ইচ্ছা করেনি।

কেন দেখতে ইচ্ছা করেনি?

আমি তাজমহল সম্পর্কে এত শুনেছি যে দেখতে ইচ্ছা করে না। আমার নিজের কল্পনায় একটা তাজমহল আছে–সেই তাজমহল বাস্তবের চেয়ে সুন্দর বলে আমার ধারণা।

বুড়ি বলল, খুব ভুল বললে। বাস্তবের তাজমহল তোমার কল্পনার চেয়ে অনেক সুন্দর!

আমি বললাম, কি করে বলছ–আমার কল্পনার তাজমহল তো তুমি দেখনি! ।

আমি অনুমান করতে পারি। তুমি আমার উপদেশ শোন–একবার দেখে এসো।

আচ্ছা, সময় পেলে এবং সুযোগ পেলে যাব।

.

সময় সুযোগ দুই-ই পেয়েছিলাম–দেখতে ইচ্ছা করল না। দু’বার খুব কাছ থেকে (দিল্লী) ঘুরে এসেছি। ট্রেনে চেপে ঘন্টা দু-একের মধ্যে আগ্রা যাওয়া যায়–যেতে ইচ্ছা করল না। আমি আমার কল্পনা নষ্ট করতে চাই না। কল্পনা নষ্ট হলে আঘাত পেতে হয়। চীনের মহাপ্রাচীর দেখে এই কষ্ট পেয়েছিলাম। কল্পনায় ভয়াবহ কিছু ভেবে রেখেছিলাম–কাছে গিয়ে মন খারাপ হল। মনে হল–মানুষের ক্ষমতার কি বিপুল অপচয়!

তাজমহল তৈরির কাহিনীও আমাকে কষ্ট দেয়। সম্রাট শা-জাহান যে মূল্যে যমুনার তীরে এ সমাধি সৌধ তৈরি করলেন–সেই মূল্যে প্রেমের সৌধ তৈরি করা যায় না। কিংবদন্তী বলে, ওস্তাদ ইসা আফেন্দি ছিলেন মূল স্থাপত্যবিদ। তিনি কুড়ি হাজার শ্রমিক। নিয়ে বাইশ বছরে শেষ করলেন তাজমহল। সম্রাট দেখলেন। তাঁর কাছে মনে হল–সম্রাটের প্রেমের যথাযথ রূপ দেয়া হয়েছে। তিনি খুশি হলেন–এবং ওস্তাদ ইসা খা আফেন্দির মৃত্যুদণ্ডের হুকুম দিলেন। যেন এই ওস্তাদ দ্বিতীয় কোন তাজ তৈরি করতে না পারেন। শুধু তাই না–তিনি হুকুম দিলেন ক্যালিগ্রাফারদের চোখ উপড়ে ফেলতে–যেন তাজের ক্যালিগ্রাফির মত ক্যালিগ্রাফি আর না হয়। স্থাপত্য বিভাগের সব। প্রধানদেরই মৃত্যুদণ্ডাদেশ হল। যারা মর্মর পাথর কাটত তিনি তাদের হাত কেটে ফেলার হুকুমও দিলেন। একটি মহান শিল্পকর্মের জন্যে এই ছিল তাদের পুরস্কার।

তাজ নিয়ে প্রচলিত এই কিংবদন্তী আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। প্রথমত, শা-জাহান একজন প্রেমিক মানুষ। পত্নী বিয়োগ-ব্যথায় কাতর। এমন একজন মানুষ–এত নিষ্ঠুর হতে পারেন না। তার চেয়েও বড় যুক্তি হচ্ছে–শাজাহান যমুনার অপর তীরে একটি কালো তাজমহল বানানোর পরিকল্পনাও করেছিলেন। যা হবে মূল তাজমহলের হুবহু ছবি–শুধু তা করা হবে কালো পাথরে। স্থপতিদের তিনি যদি হত্যা করেন তাহলে কারা বানাবে ‘কৃষ্ণতাজ’?

অবশ্যি সম্রাটরা তো সাধারণ মানুষদের মত না। আমাদের কাছে যা নিষ্ঠুরতা তাদের কাছে তা হয়ত না। সম্রাট হুমায়ুনের মত দরদী সম্রাটকেও তো দেখি কত সহজে তার বিদ্রোহী ছোটভাই মীর্জা কামরানের চোখ উপড়ে ফেলার হুকুম দেন। চোখ উপড়ে ফেলার পর সেই অক্ষিগহ্বরে লেবুর রস ঢেলে দেয়া হয়। মীর্জা কামরানের চিৎকারে দিল্লীর পশুপাখি কাঁদতে থাকে। কিন্তু দিল্লীর বাদশাহ হুমায়ূন বিচলিত হন না। তিনি শান্তমুখে তাঁর প্রিয় লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করতে চলে যান।

যাই হোক, এই বহু-বিতর্কিত তাজমহল দেখতে যাবার পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত করলাম। তিন কন্যা এবং স্ত্রীকে নিয়ে এক বিকেলে উপস্থিত হলাম তাজের সামনে–।

বিস্ময়ে আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করল না–মানুষের হাত এই জিনিস তৈরি করেছে। মহান শিল্পকর্মের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালে হৃদয়ে প্রবল হাহাকার তৈরি হয়। চোখে জল আসে। আমার চোখ জলে ভরে গেল। জলভরা চোখে দেখলাম–সম্রাটের স্বপ্ন–মানুষের হাতে তৈরি শ্বেতপদ্ম। আমার কল্পনা। কখনো এর কাছাকাছি যেতে পারেনি।

সমুদ্র দর্শন

তেত্রিশ বছর আগের কথা।

ক্লাস সিক্সে পড়ি। স্কুলের নাম চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুল। ক্লাস টিচারের নাম মুখলেসুর রহমান, যদিও সবাই তাকে চেনে দেড় ব্যাটারী নামে। দেড় ব্যাটারী নামকরণের উৎস জানি না। সম্ভবত শারীরিক উচ্চতার সঙ্গে এই নাম সম্পর্কিত। স্যার হলেন বেঁটেখাট মানুষ, ভারিক্কি গড়ন, মিলিটারীর প্যারেডের ভঙ্গিতে হাঁটেন। তাঁর শারীরিক কোন সমস্যা আছে, খানিকক্ষণ পরপর মাথা দুলিয়ে বিচিত্র এক ঋকি দেন। আমরা হাসতে গিয়েও হাসি না। হাসি গিলে ফেলি, কারণ দেড়-ব্যাটারী স্যারের ধমক স্কুল-বিখ্যাত। তার ধমকে প্রতি বছরই নিচের ক্লাসের ভীতু টাইপের কিছু ছাত্র প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে। স্যার নিজেই এদের স্কুলের বারান্দায় নিয়ে গোসল করিয়ে দেন। বিরক্ত গলায় বলেন, এত ভয় পাস কেন রে গাধা? আমি তো শুধু ধমকই দেই। কখনো কি মারি? আমার হাতে কখনো বেত দেখেছিস?

মজার ব্যাপার হচ্ছে স্যারের মারও স্কুল-বিখ্যাত। কি-চড়, কানে মলা, পেনসিলের ডলা, ডাস্টারের বাড়ি–শাস্তির প্রতিটি শাখাতেই তাঁর যথেষ্ট সুনাম আছে, তবে বেত না। স্যারের হাতে বেত আমরা আসলেই দেখিনি।

তেত্রিশ বছর আগে শারীরিক শাস্তি শিক্ষাব্যবস্থার অংগ হিসেবে ধরা হত। বছরের শুরুতে স্কুলের জন্যে চক ডাস্টারের সঙ্গে সঙ্গে নানান ধরনের বেত কেনা হত। স্যাররা ক্লাসে ঢুকতেন ডাস্টার এবং বেত নিয়ে। পড়া শুরু করার আগে শরীর গরম করে। নেয়ার কায়দায় শাস্তি চলত। বাবা-মা’রা এতে কিছু মনে করতেন না। বরং খুশি হতেন, ছেলে ঠিক জায়গায় আছে। শরীরের যেসব জায়গায় বেতের দাগ পড়বে সেইসব জায়গা বেহেশতে যাবে, এমন কথাও শোনা যেত।

দেড় ব্যাটারী স্যার প্রচলিত প্রথার ব্যতিক্রম ছিলেন না, তবে একটি বিষয়ে অন্য স্যারদের সঙ্গে তার ঘোরতর অমিল ছিল। ছাত্রকে শাস্তি দেয়ার পর তার মন খারাপ হত। তীব্র অনুশোচনায় কাতর হতেন। প্রায়ই এমন হয়েছে যে শাস্তি প্রদানের পর তার রাগ পড়ে গেছে। ছাত্র ব্যথায় কাঁদছে, তিনিও অনুশোচনায় কাঁদছেন। বড়ই মজার দৃশ্য। এর মধ্যেই নানান কাণ্ড ঘটে যেত।

অস্বস্তির সঙ্গে বলছি–ছাত্র পড়ানো ছাড়া অন্য সব কাজ তিনি খুব চমৎকার পারতেন। সম্ভবত এই কারণে তাকে জটিল কোন ক্লাস দেয়া হত না। তিনি ড্রয়িং ক্লাস নিতেন, লাইব্রেরী ক্লাস নিতেন। ড্রীল করাতেন, অন্য স্যারদের অনুপস্থিতিতে হঠাৎ যদি তাকে অংক বা ভূগোল ক্লাসে আসতে হত–তিনি খুব বিমর্ষ বোধ করতেন। অংক ক্লাসে তিনি আমাদের নামতা ধরতেন। “বল দেখি তিন সাতে কত? না পারলে আজ কিন্তু কিয়ামত। অংক কিছু না, আসল জিনিস নামতা।” ভূগোল ক্লাসে ঢুকতেন একটা গ্লোব নিয়ে। করুণ চোখে গ্লোবটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তিনি সময় পার করে দিতেন।

আমরা এই স্যারকে নানাবিধ কারণে খুব পছন্দ করতাম। প্রথম কারণ, তিনি ক্লাসে কিছু পড়াতেন না এবং পড়া ধরতেন না। বাড়ির কাজ দিতেন, তবে দেখতেন না। দ্বিতীয় কারণ, তিনি আমাদের প্রত্যেকের নামে দু লাইন থেকে চার লাইনের ছড়া বলতেন। উদাহরণ দিয়ে বলি–আমার নাম হুমায়ুন। আমাকে দেখলেই বলতেন,

হুমায়ুন
তোমার নেই কোন গুণ।

আমাদের ক্লাসের ছাত্র হামিদ রেজা খানকে দেখলেই বলতেন–

হামিদ রেজা খান
রাখবে দেশের মান।

আমাদের স্কুলের দপ্তরী রাসমোহন। তাকে দেখলেও বলতেন–

রাসমোহন
তুমি আছ কেমন?

স্যারকে পছন্দ করার তৃতীয় কারণ হল–তিনি ছিলেন আমাদের সংগীত শিক্ষক। আমরা সব ছাত্র তাঁর লেখা এবং তার সুর দেয়া গান সমবেতভাবে গাইতাম, স্যার বিমলানন্দ উপভোগ করতেন। এইসব সংগীতের সবই গণসংগীত। একটা ছিল ছাদ পিটানো গান। আমরা বেঞ্চিতে দু’হাতে ছাদ পিটাবার মত করে থাবা দিতে দিতে গাইতাম–

ঘড়িতে দশটা বাজে
পাঁচটা কেন বাজে না বাবুজী।

বেঞ্চিতে হাত দিয়ে পরপর তিনবার শব্দ–ধপ, ধপ, ধপ]।

ঘড়িতে ১১টা বাজে।
পাঁচটা কেন বাজে না বাবুজী।

[ ধপ, ধপ, ধপ ]

ঘড়িতে ১২টা বাজে
পাঁচটা কেন বাজে না বাবুজী।

[ ধপ, ধপ, ধপ ]

এইভাবে ঘড়িতে পঁচটা বাজলে গান শেষ হত।

স্যারের নিয়ম ছিল ক্লাসে একজন অপরাধ করলে সবার শাস্তি পেতে হত। গণসংঙ্গিতের মতই গণশাস্তি। সে শাস্তিও খুব মজার। সবাইকে বেঞ্চির উপর উঠে দাঁড়াতে বলা হত। আমরা উঠে দাঁড়াতাম। স্যার বলতেন ওয়ান-টু-থ্রী …

আমরা এক সঙ্গে গানের সুরে বলতাম,

“অপরাধ করেছি।”

স্যার বলতেন থ্রী-টু-ওয়ান। আমরা বলতাম,

“ক্ষমা চাই।”

স্যার বলতেন–যা, ক্ষমা করলাম।

এমন একজন বিচিত্র মানুষকে পছন্দ না করার কোন কারণ নেই। সবচে বড় কথা হল–তিনিই ছিলেন একমাত্র শিক্ষক যিনি বলতেন–পড়াশোনাটা কোন বড় ব্যাপার না রে গাধা। ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়াটা কিছু না। যে কেউ নিয়মমত পড়লে ফার্স্ট সেকেন্ড হবে। বড় ব্যাপার হল …।

বড় ব্যাপার কি তা স্যার বলতেন না। চিন্তিত মুখে আমাদের দিকে তাকাতেন। নিজের মাথা চুলকাতেন, ভুরু কুঁচকাতেন। সম্ভবত কোটি বড় ব্যাপার তা তার নিজের কাছেও স্পষ্ট ছিল না।

সেবার আমাদের ক্লাসের সবাই ফাঁইন্যাল পরীক্ষায় পাস করে সেভেনে উঠেছি। শুধু ফেল করেছে জামাল-কামাল দুই ভাই। দু’জনেই মহাবিচ্ছু। একবার পকেটে করে গুই সাপ নিয়ে এসেছিল। আমরা সবাই ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠলাম–জামাল কামাল দুই ভাই পুরোনো ক্লাসে পড়ে রইল এবং চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। তাদের দুঃখে ব্যথিত হয়ে কাঁদতে লাগলেন মুখলেস স্যার। স্যারের কান্নায় দ্রবীভূত হয়েই আমাদের হেড স্যার জামাল কামালকে প্রমোশন দিয়ে দিলেন। আনন্দে সবচে বেশি লাফালাফি করতে লাগলেন আমাদের স্যার। সেই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হল স্যারের ঘোষণায়। স্যার আমাদের ডেকে বললেন–তিনি আমাদের রেজাল্টে অত্যন্ত খুশি। সেন্ট পারসেন্ট পাস, এরকম কখনো হয় না। কাজেই উপহারস্বরূপ তিনি আমাদের সমুদ্র দেখিয়ে আনবেন। কক্সবাজার নিয়ে যাবেন, দু’ টাকা করে চাদা।

কক্সবাজার কোন হাতের কাছের ব্যাপার নয়, একশ মাইল দূরের পথ। দু’ টাকায় এত দূর যাওয়া, এক রাত থেকে ফিরে আসা কি করে সম্ভব আমি জানি না–স্যার যখন বলেছিলেন কোন একটা ব্যবস্থা হবেই। আমরা চাঁদার টাকা জোগাড় করবার জন্য। প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে লাগলাম। আমাদের সময় বাবা-মা’র কাছ থেকে টাকা বের করা কঠিন ব্যাপার ছিল।

একদিন সত্যি সত্যি পঁয়ত্রিশ জন ছেলেকে নিয়ে স্যার কক্সবাজার রওনা হলেন। মুড়ির টিন জাতীয় বাস। সেই বাস দুলতে দুলতে চলেছে। কিছু দূর গিয়ে অনেকক্ষণ থেমে থাকে। যাত্রী জোগাড় করে আবার হেলতে দুলতে চলে। আজকাল তিন ঘণ্টায় কক্সবাজার পৌঁছা যায়। তখন সময়ের কোন হিসাব ছিল না। আমরা সকাল ন’টায় রওনা হয়ে রাত দশটায় পৌঁছলাম। স্যার আমাদের সমুদ্রে নিয়ে গেলেন না–এক স্কুল ঘরে নিয়ে তুললেন। মেঝেতে চাটাই পেতে দেয়া আছে। চাটাইয়ের উপর খড় বিছানো। সেই খড়ের উপর চাঁদর। আমরা খিচুড়ি খেয়ে ঘুমুতে গেলাম। স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব আমাদের জন্যে খিচুড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। স্যার বলে দিলেন খুব ভোরে উঠতে হবে। ভোরে আমাদের সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাবেন, তবে কেউ সমুদ্রে নামতে পারবে না। কেউ যদি সমুদ্রে নামে–মেরে তক্তা বানিয়ে দেবেন। এতগুলি ছেলের দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন। তিনি একা মানুষ, ইত্যাদি ইত্যাদি।

ভোরবেলায় সমুদ্র দেখতে গেলাম। সমুদ্র দেখে হকচকিয়ে গেলাম। আকাশের মত বিশাল কিন্তু নিঃস্তব্ধ নয়–প্রাণময়। এমন বিশাল এবং প্রায় জীবন্ত কিছু যে পৃথিবীতে থাকতে পারে তা ছেলেমানুষী কল্পনায় এর আগে কখনো আসেনি। সমুদ্রের তীব্র আকর্ষণী ক্ষমতা আছে। সে সারাক্ষণ ডাকে, আয় আয়–কাছে আয়। সেই আকর্ষণ অগ্রাহ্য করা সম্ভব হল না। স্যারের কঠিন নিষেধ ভুলে গিয়ে জুতা পায়ে ছুটে গেলাম–প্রায় হাঁটু পানিতে। স্যার এসে ঘাড় ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে আমাকে নিয়ে এলেন। তারপর শুরু হল মার। কঠিন মার। সমগ্র স্কুল জীবনে আমি প্রচুর শাস্তি পেয়েছি–এমন কঠিন শাস্তি কখনো পাইনি। শারীরিক দুঃখের চেয়েও গভীর অপমানবোধ আমাকে আচ্ছন্ন করল। স্যার বললেন, এইখানে বসে থাকবি। সমুদ্রের দিকে তাকাবি না–উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে বোস। এখান থেকে এক পা নড়লে টান দিয়ে মাথা ছিঁড়ে ফেলব।

আমি সমুদ্রের কাছে এসে, সমুদ্রের উল্টোদিকে মুখ হয়ে বসে রইলাম, আমার বন্ধুরা মহানন্দে সমুদ্র দেখতে লাগল। দুপুর দশটায় বাসে করে চিটাগাং রওনা হব। সবাই বাসে উঠেছি। বাস ছাড়ার আগে আগে স্যার গিয়ে বাস ড্রাইভারের কানে কানে কি বললেন। তারপর এলেন আমার কাছে। আগের মতই হুংকার দিয়ে বললেন, নাম বাস থেকে। নাম বলছি।

আমি নামলাম। মনে হল শাস্তিপর্ব শেষ হয়নি। স্যার আমাকে সমুদ্রের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, খোল জুতা। জুতা খুলোম। স্যার আমার হাত ধরে হঠাৎ অসম্ভব কোমল গলায় বললেন–চল যাই সমুদ্রে। একবার ভাবলাম অভিমান দেখিয়ে বলি–‘না’। কিন্তু ইচ্ছা করল না। স্যারের হাত ধরে সমুদ্রে নামলাম। তিনি বললেন–ব্যাটা আমার উপর রাগ করিস না। একদল ছেলেকে নিয়ে এসেছি। এদের কেউ সমুদ্রে ভেসে গেলে সমস্যা না? তোকে শাস্তি দেয়া অন্যায় হয়েছে। ভুল হয়েছে। আমি মানুষ। আমি তো ভুল করবই। আমি কি ফেরেশতা যে আমার ভুল হবে না? তোর যতক্ষণ ইচ্ছা সমুদ্রে হাঁটাহাঁটি কর। আর আমার উপর রাগ খুব বেশি হলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সমুদ্রে ফেলে দে। দেখি তোর কেমন শক্তি।

আমি স্যারের দিকে তাকিয়ে দেখি, স্যার তাঁর পুরোনো অভ্যাসমত কঁদতে শুরু করেছেন।

আমরা টাকা-পয়সা খরচ করে দূরের সমুদ্র দেখতে যাই, অথচ আমাদের আশেপাশের মানুষরাই বুকে সমুদ্র ধারণ করে ঘুরে বেড়ান। সেই সমুদ্র আমাদের চোখে পড়ে না।

.

পঁচিশ বছর পর স্যারের সঙ্গে আবার দেখা। তিনি আজিমপুর কবরস্থানের পাশের রাস্তা দিয়ে হনহন করে যাচ্ছেন। আগের মতই আছেন, শুধু আকাশের শাদা মেঘ ভর করেছে তার মাথার চুলে। তিনিই প্রথম আমাকে দেখলেন–চেঁচিয়ে ডাকলেন, হুমায়ূন না? হুমায়ূন, তোর নেই কো কোন গুণ। আরে গাধা, তুই কেমন আছিস?

সমুদ্র দেখলে সমুদ্রের জল স্পর্শ করতে হয়। আমি কদমবুছি করবার জন্যে নিচু হলাম। স্যার আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। লক্ষ্য করলাম বয়সজনিত কারণে স্যারের কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আগে আমাদের শাস্তি দিয়ে কাঁদতেন। এখন কাঁদছেন কোন শাস্তি না দিয়েই।

আমি বললাম, কেমন আছেন স্যার?

স্যার চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ভাল আছি রে ব্যাটা। ভাল আছি। প্রেসিডেন্ট মেডেল পেয়েছি, বুঝলি? বেস্ট টিচার হিসেবে প্রেসিডেন্ট মেডেল। কি হাস্যকর কথা। আমি নাকি বেস্ট টিচার! হা হা হা। তিনি হাসছেন। কিন্তু তার চোখ ভেজা।

সে

এরশাদ সাহেবের সময়কার কথা। সরকারি পর্যায়ে শিলাইদহে রবীন্দ্রজয়ন্তী হবে। আমার কাছে জানতে চাওয়া হল আমি সেই উৎসবে যোগ দেব কি-না।

আমি বললাম, রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে যে কোন নিমন্ত্রণে আমি আছি। এরশাদ সাহেবের উদ্যোগে অনুষ্ঠান হচ্ছে, হোক না, আমি কোন সমস্যা দেখছি না। রবীন্দ্রনাথকে ভালবাসার অধিকার সবারই আছে।

যথাসময়ে শিলাইদহে উপস্থিত হলাম। কুঠিবাড়িতে পা দিয়ে গায়ে রোমাঞ্চ হল। মনে হল পবিত্র তীর্থস্থানে এসেছি। এক ধরনের অস্বস্তিও হতে লাগল, মনে হল–এই যে নিজের মনে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। চারদিকে রবীন্দ্রনাথের পায়ের ধুলা ছড়িয়ে আছে। কবির কত স্মৃতি, কত আনন্দ-বেদনা মিশে আছে প্রতি ধূলিকণায়। সেই ধূলার উপর দিয়ে আমি হেঁটে যাব, তা কি হয়? এত স্পর্ধা কি আমার মত অভাজনের থাকা উচিত?

নিজের মনে ঘুরে বেড়াতে এত ভাল লাগছে! কুঠিবাড়ির একটা ঘরে দেখলাম কবির লেখার চেয়ার টেবিল। এই চেয়ারে বসেই কবি কত-না বিখ্যাত গল্প লিখেছেন। কুঠিবাড়ির দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখে পড়ল কবির প্রিয় নদী প্রমত্তা পদ্মা। ১২৯৮ সনের এক ফাগুনে এই পদ্মার দুলুনি খেতে খেতে বজরায় আধশোয়া হয়ে বসে কবি লিখলেন,

শ্রাবণ গগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।

একদিকে উৎসব হচ্ছে, গান, কবিতা আলোচনা, অন্যদিকে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি নিজের মনে। সন্ধ্যাবেলা কুঠিবাড়িতে গানের অনুষ্ঠানে আমি নিমন্ত্রিত অতিথি, উপস্থিত না থাকলে ভাল দেখায় না বলে প্যান্ডেলের নিচে গিয়ে বসেছি। শুরু হল বৃষ্টি, ভয়াবহ বৃষ্টি। সেই সঙ্গে দমকা বাতাস। বাতাসে সরকারি প্যান্ডেলের অর্ধেক উড়ে গেল। আমি রওনা হলাম পদ্মার দিকে। এমন ঝমঝমে বৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথও নিশ্চয়ই ভিজতেন। আমি যদি না ভিজি তাহলে কবির প্রতি অসম্মান করা হবে।

বৃষ্টিতে ভেজা আমার জন্য নতুন কিছু না। কিন্তু সেদিনকার বৃষ্টির পানি ছিল বরফের চেয়েও ঠাণ্ডা। আর হাওয়া? মনে হচ্ছে সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসছে। আমি ঠকঠক করে কাঁপছি। নব ধারা জলে স্নানের আনন্দ ধুয়ে-মুছে গেছে। রেস্ট। হাউসে ফিরে শুকনো কাপড় পরতে পারলে বাচি।

কাঁপতে কাঁপতে ফিরছি। পদ্মা থেকে কুঠিবাড়ি অনেকটা দূর। কাঁচা রাস্তা। বৃষ্টির পানিতে সেই রাস্তা কাদা হয়ে গেছে। দ্রুত হাঁটা যাচ্ছে না। জায়গাটাও অন্ধকার। আধাআধি পথ এসে থমকে দাঁড়ালাম। কে যেন রাস্তার পাশে গাছের নিচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চারদিক আলো করে বিদ্যুৎ চমকালো। আর তখনি আমার সারা শরীর দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। আমি স্পষ্ট দেখলাম, গাছের নিচে যুবক বয়সের রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আছেন। এটা কি কোন মায়া? কোন ভ্রান্তি? বিচিত্র কোন হেলুসিনেশন? আমার চিন্তা-চেতনা জুড়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বলেই তাকে দেখছি?

আমি চিৎকার করতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই ছায়ামূর্তি বলল, কে, হুমায়ূন ভাই না?

নিজেকে চট করে সামলে নিলাম। রবীন্দ্রনাথের প্রেতাত্মা নিশ্চয়ই আমাকে হুমায়ূন ভাই বলবে না। আমি ভৌতিক কিছু দেখছি না। এমন একজনকে দেখছি যে আমাকে চেনে, এবং যাকে অন্ধকারে খানিকটা রবীন্দ্রনাথের মত দেখায়। ছায়ামূর্তি বলল, হুমায়ূন ভাই, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কোথায় যাচ্ছেন?

আমি বললাম, কুঠিবাড়ির দিকে যাচ্ছি। আমি কি আপনাকে চিনি?

‘জ্বি না, আপনি আমাকে চেনেন না। হুমায়ূন ভাই, আমি আপনার অনেক ছোট। আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন।‘

‘তোমার নাম কি?’

‘রবি।‘

‘ও আচ্ছা, রবি।‘

আমি আবার বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেলাম। নাম রবি মানে? হচ্ছেটা কি?

রবি বলল, চলুন, আমি আপনার সঙ্গে যাই।

‘চল।‘

.

ভিজতে ভিজতে আমরা কুঠিবাড়িতে উপস্থিত হলাম। ঝড়ের প্রথম ঝাঁপটায় ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়েছিল, এখন আবার এসেছে। চারদিকে আলো ঝলমল করছে। আলোতে আমি আমার সঙ্গীকে দেখলাম, এবং আবারো চমকালাম। অবিকল যুবক বয়সের রবীন্দ্রনাথ। আমি বললাম, তোমাকে দেখে যে আমি বারবার চমকাচ্ছি তা কি তুমি বুঝতে পারছ?

‘পারছি। আপনার মত অনেকেই চমকায়। তবে আপনি অনেক বেশি চমকাচ্ছেন।‘

‘তোমার নাম নিশ্চয়ই রবি না?’

‘জি না। যারা যারা আমাকে দেখে চমকায় তাদের আমি এই নাম বলি।‘

‘এসো, আমরা কোথাও বসে গল্প করি।‘

‘আপনি ভেজা কাপড় বদলাবেন না? আপনার তো ঠাণ্ডা লেগে যাবে।‘

‘লাগুক ঠাণ্ডা।‘

আমরা একটা বাঁধানো আমগাছের নিচে গিয়ে বসলাম। রবি উঠে গিয়ে কোত্থেকে এক চা-ওয়ালাকে ধরে নিয়ে এল। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। আমি আধভেজা সিগারেট ধরিয়ে টানছি। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। সেই চা-ও বৃষ্টির পানির মতই ঠাণ্ডা। খুবই লৌকিক পরিবেশ। তারপরেও আমি লক্ষ্য করলাম, আমার বিস্ময়বোধ দূর হচ্ছে না।

রবি হাসিমুখে বলল, হুমায়ূন ভাই! আমি শুনেছিলাম আপনি খুব সিরিয়াস ধরনের মানুষ। আপনি যে বাচ্চাদের মত বৃষ্টিতে ভিজে আনন্দ করেন তা ভাবিনি। আপনাকে দেখে আমার খুব মজা লেগেছে।

আমি বললাম, তোমাকে দেখে শুরুতে আমার লেগেছিল ভয়। এখন লাগছে বিস্ময়।

‘আপনি এত বিস্মিত হচ্ছেন কেন? মানুষের চেহারার সঙ্গে মানুষের মিল থাকে?’

‘থাকে, এতটা থাকে না।‘

রবির সঙ্গে আমার আরো কিছুক্ষণ গল্প করার ইচ্ছা ছিল। সম্ভব হল না। সরকারি বাস কুষ্টিয়ার দিকে রওনা হচ্ছে। বাস মিস করলে সমস্যা। রবি আমার সঙ্গে এল না। সে আরো কিছুক্ষণ থাকবে। পরে রিকশা করে যাবে। তবে সে যে কদিন অনুষ্ঠান চলবে, রোজই আসবে। কাজেই তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ রয়ে গেল।

রাতে রেস্ট হাউসে ফিরে আমার কেন জানি মনে হল পুরো ব্যাপারটাই মায়া। ছেলেটির সঙ্গে আর কখনোই আমার দেখা হবে না। রাতে ভাল ঘুমও হল না।

আশ্চর্যের ব্যাপার! পরদিন সত্যি সত্যি ছেলেটির দেখা পেলাম না। অনেক খুঁজলাম। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, দেখতে অবিকল রবীন্দ্রনাথের মত এমন একজনকে দেখেছেন?

তারা সবাই আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন আমি কিছুক্ষণ আগেই গাঁজা খেয়ে এসেছি। ঐ জিনিস তখন কুঠিবাড়ির আশেপাশে খাওয়া হচ্ছে। লালন শাহর কিছু অনুসারী এসেছেন। তাঁরা গাঁজার উপরই আছেন। উৎকট গন্ধে তাঁদের কাছে। যাওয়া যায় না। তাঁদের একজন আমাকে হাত ইশারা করে কাছে ডেকে বলছেন, আচ্ছা স্যার, রবিঠাকুর যে লালন শাহ র গানের খাতা চুরি করে নবেল পেল এই বিষয়ে ভদ্রসমাজে কিছু আলোচনা করবেন। এটা অধীনের নিবেদন।

তৃতীয় দিনেও যখন ছেলেটার দেখা পেলাম না, তখন নিশ্চিত হলাম, ঝড়-বৃষ্টির রাতে যা দেখেছি তার সবটাই ভ্রান্তি। মধুর ভ্রান্তি। নানান ধরনের যুক্তিও আমার মনে আসতে লাগল। যেমন, আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি কর? সে জবাব দেয়নি। আমার সঙ্গে সরকারি বাসে আসতেও রাজি হয়নি। নিজের আসল নামটিও বলেনি।

অনুষ্ঠানের শেষ দিনে দেখি সে প্যান্ডেলের এক কোণায় চুপচাপ বসে আছে। আমি এগিয়ে গেলাম।

‘এই রবি, এই!’

রবি হাসিমুখে তাকাল, এবং সঙ্গে সঙ্গে উঠে এল। আমি বললাম, এই ক’দিন আসনি কেন?

‘শরীরটা খারাপ করেছিল। ঐ দিন বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডা লেগে গেল।‘

‘আজ শরীর কেমন?’

‘আজ ভাল।‘

‘এই ক’দিন আমি তোমাকে খুব খুঁজেছি।‘

‘আমি অনুমান করেছি। আচ্ছা হুমায়ূন ভাই, দিনের আলোতেও কি আমাকে রবীন্দ্রনাথের মত লাগে?’

‘হ্যাঁ লাগে, বরং অনেক বেশি লাগে।‘

সে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দেখুন মানুষের ভাগ্য! আমি শুধু দেখতে রবীন্দ্রনাথের মত এই কারণে আপনি কত আগ্রহ করে আমার সঙ্গে কথা বলছেন।

‘তার জন্য কি তোমার খারাপ লাগছে?’

‘না, খারাপ লাগছে না। ভাল লাগছে। খুব ভাল লাগছে। নিজেকে মিথ্যামিথ্যি রবীন্দ্রনাথ ভাবতেও আমার ভাল লাগে।‘

‘তুমি টিভিতে কখনো নাটক করেছ?’

‘কেন বলুন তো?’

‘তোমাকে আমি টিভি নাটকে ব্যবহার করতে চাই।‘

‘আমি কোনদিন নাটক করিনি কিন্তু আপনি বললে আমি খুব আগ্রহ নিয়ে করব। কি নাটক?’

‘এই ধর, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নাটক। যৌবনের রবীন্দ্রনাথ। কুঠিবাড়িতে থাকেন। পদ্মার তীরে হাঁটেন। গান লিখেন, গান করেন। এইসব নিয়ে ডকুমেন্টারি ধরনের নাটক।‘

‘সত্যি লিখবেন?’

‘হ্যাঁ লিখব। একটা কাগজে তোমার ঠিকানা লিখে দাও।‘

‘ঠিকানা আপনি হারিয়ে ফেলবেন। আমি বরং আপনাকে খুঁজে বের করব।‘

ছুটির সময়ে মন সাধারণত তরল ও দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। ছুটির সময়ে দেয়া প্রতিশ্রুতি পরে আর মনে থাকে না। আমার বেলায় সেরকম হল না। আমি ঢাকায় ফিরেই টিভির নওয়াজিশ আলি খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। আমার পরিকল্পনার কথা বললাম। তিনি এক কথায় বাতিল করে দিলেন। তিনি বললেন, রবিঠাকুরকে সরাসরি দেখাতে গেলে অনেক সমস্যা হবে। সমালোচনা হবে। রবীন্দ্র ভক্তরা রেগে যাবেন। বাদ দিন। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।

মাস তিনেক পর ছেলেটার সঙ্গে আবার দেখা হল টিভি ভবনে। সে আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল–নাটকটা লিখেছি কিনা। আমি সত্যি কথাটা তাকে বলতে পারলাম না। তাকে বললাম, লিখব লিখব। তুমি তৈরি থাক।

‘আমি তৈরি আছি। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি।‘

‘চেহারাটা ঠিক রাখ, চেহারা যেন নষ্ট না হয়।‘

আমি টিভির আরো কিছু লোকজনের সঙ্গে কথা বললাম। কোন লাভ হল না। ছেলেটির সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়। আমি বলি–হবে হবে, ধৈর্য ধর। এই মিথ্যা আশ্বাস যতবার দেই ততবারই খারাপ লাগে। মনে মনে বলি, কেন বারবার এর সঙ্গে দেখা হয়? আমি চাই না দেখা হোক। তারপরেও দেখা হয়।

একদিন সে বলল, হুমায়ূন ভাই, আপনি কি একটু তাড়াতাড়ি নাটকটা লিখতে পারবেন?

‘কেন বল তো?’

‘এমনি বললাম।‘

‘হবে হবে, তাড়াতাড়িই হবে।‘

তারপর অনেক দিন ছেলেটির সঙ্গে দেখা নেই। নাটকের ব্যাপারটাও প্রায় ভুলে গেছি। ব্যস্ত হয়ে পড়েছি অন্য কাজে। তখন ১৪০০ সাল নিয়ে খুব হৈচৈ শুরু হল। আমার মনে হল, এই হচ্ছে সুযোগ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নাটকটা লিখে ফেলা যাক। নাটকের নাম হবে ১৪০০ সাল। প্রথম দৃশ্যে কবি একা একা পদ্মার পাড়ে হাঁটছেন, আবহ সংগীত হিসেবে কবির বিখ্যাত কবিতাটি (আজি হতে শতবর্ষ পরে …) পাঠ করা হবে। কবির মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাবে একঝাক পাখি। কবি আগ্রহ নিয়ে তাকাবেন পাখির দিকে, তারপর তাকাবেন আকাশের দিকে।

দ্রুত লিখে ফেললাম। আমার ধারণা, খুব ভাল দাঁড়াল। নাটকটা পড়ে শুনালে টিভির যে কোন প্রযোজকই আগ্রহী হবেন বলে মনে হল। একদিন ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করছি টিভি-র বরকতউল্লাহ সাহেবের সঙ্গে। পাশে আছেন জিয়া আনসারী সাহেব। তিনি কথার মাঝখানে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, রবিঠাকুরের ভূমিকায় আপনি যে ছেলেটিকে নেবার কথা ভাবছেন তাকে আমি চিনতে পারছি। গুড চয়েস।

আমি বললাম, ছেলেটার চেহারা অবিকল রবিঠাকুরের মত না?

‘হ্যাঁ। তবে ছেলেটিকে আপনি অভিনয়ের জন্যে পাবেন না।‘

‘কেন?’

‘ওর লিউকোমিয়া ছিল। অনেক দিন থেকে ভুগছিল। বছরখানিক আগে মারা গেছে।

আমি অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারলাম না। গভীর আনন্দ ও আগ্রহ নিয়ে ছেলেটা অপেক্ষা করছিল। তার সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। সে কাউকে তা জানতে দেয়নি।

বাসায় ফিরে নাটকের পাণ্ডুলিপি নষ্ট করে ফেললাম। এই নাটকটি আমি রবিঠাকুরের জন্যে লিখিনি। ছেলেটির জন্যে লিখেছিলাম। সে নেই, নাটকও নেই।*

————-

  • ছেলেটির নাম নিয়ে আমি সমস্যায় পড়েছি। নাম মনে করতে পারছি না। ভোরের কাগজের সাংবাদিক জনাব সাজ্জাদ শরিফের ধারণা তার নাম হাফিজুর রশিদ। ডাক নাম রাজু।

হিজ মাস্টারস ভয়েস

কুকুর সম্পর্কে আমাদের নবীর (তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক) একটি হাদিস আছে। হাদিসটি হলো নবী তাঁর সাহাবীদের বলেছেন, কুকুর যদি আল্লাহর সৃষ্টির কোনো প্রজাতি না হতো তাহলে আমি কুকুর হত্যার নির্দেশ দিতাম।

এই হাদিসটি আমাকে বলেন আমার একজন প্রকাশক–কারেন্ট বুকস-এর মালিক–বইপাড়ায় যিনি হুজুর নামে পরিচিত। একদিন তিনি আমার শহীদুল্লাহ হলের বাসায় এসেছেন। আমি কথায় কথায় তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম–কুকুর সম্পর্কে আমাদের ইসলাম ধর্ম কী বলে? হুজুর আমাকে এই হাদিসটি শোনালেন।

কুকুর সম্পর্কে নবীজি এমন কঠিন মনোভাব প্রকাশ করেছেন–আমার জানা ছিল না। অবশ্যি ছোটবেলায় মাকে দেখেছি কুকুর ঘরে ঢুকলেই দূর দূর করে উঠতেন। কুকুর ঘরে ঢুকলে নাকি ঘর অশুচি হয়। ঘরে ফেরেশতা আসে না। এই প্রসঙ্গে একটা মজার গল্পও আছে। ভয়ংকর পাপী এক লোক–তার মৃত্যুর সময় উপস্থিত। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সে চি চি করে বলল, ওরে, আমি মরতে চাই না রে। তোরা তাড়াতাড়ি একটা কুকুর এনে আমার পায়ের সঙ্গে বেঁধে দে। লোকটির স্ত্রী অবাক হয়ে বলল, কুকুর বেঁধে রাখলে কী হবে? লোকটি বিরক্ত গলায় বলল, আরে বোকা মাগি, কুকুর বাঁধা থাকলে ফিরিশতা আসবে না। ফিরিশতা না এলে জান কবজ হবে না। সহজ হিসাব।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাণী হিসেবে কুকুর গ্রহণযোগ্য না, বিড়াল গ্রহণযোগ্য। ছোটবেলায় নানীজান বলতেন, খবরদার, বিড়ালের গায়ে হাত তুলবি না। বিড়াল নবীজির খুব পেয়ারা জানোয়ার। নবীজি বেড়ালের গায়ে হাত বুলাতেন। ধর্মীয় ট্যাবু সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের কাছে কিন্তু কুকুরের আদর বিড়ালের চেয়ে বেশি।

গ্রামের একটি প্রচলিত গল্পে তার প্রমাণ মেলে। গল্পটি হলো, কুকুর সব সময় প্রার্থনা করে গৃহস্থের সাত ছেলে হোক। সাত সাতটা ছেলে হলে তারা ফেলে-ছড়িয়ে ভাত খাবে! সেখান থেকে সে ভাগ পাবে। আর বিড়াল বলে, গৃহস্থ অন্ধ হোক। অন্ধ হলে গৃহস্থ বুঝবে না–কোন খাবার কোথায়। এই ফাঁকে সে খেয়ে যাবে।

কুকুর প্রাণীটির প্রতি আমার তেমন কোনো মমতা নেই। র‍্যাবিজ ক্যারিয়ার হিসেবেই আমি কুকুরকে দেখি। বগুড়ায় আমি জলাতঙ্কের এক রোগীকে দেখেছিলাম। না দেখলেই ভালো ছিল। ভয়াবহ দৃশ্য! রোগীর কষ্টের বর্ণনা দিচ্ছি না। দেওয়া সম্ভবও না। মনে আছে রোগীর বাবা কাঁদতে কাঁদতে সবাইকে বলছিলেন, আপনারা দোয়া করেন যেন আমার ছেলেটা তাড়াতাড়ি মরে যায়।

পঁচিশ বছর আগের দেখা ছবি এখনো দুঃস্বপ্নের মতো মনে পড়ে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। যে প্রাণী এই ভয়াবহ ব্যাধির ভাইরাস বহন করে তার প্রতি মমতা থাকার কথাও না। তারপরেও কিছু গোপন ভালোবাসা এই প্রাণীটির প্রতি আমার আছে। আমার সবচেয়ে ছোট ভাইটির জীবন একটি কুকুর তার নিজের জীবনের বিনিময়ে বাঁচিয়েছিল। সেই স্মৃতি ভোলা বা ভোলার চেষ্টা করা অন্যায়।

.

অরণ্যচারী মানুষের প্রথম সঙ্গী হলো কুকুর। মানব জাতির ঊষালগ্নে এই সাহসী পশু তার পাশে এসে দাঁড়াল, মানুষকে শক্তি ও সাহস দিল। মানুষকে বলল, আমি আছি। আমি তোমার পাশেই আছি। এখনো গভীর রাতে কোনো নিঃসঙ্গ মানুষ রাস্তায় হাঁটলে কোত্থেকে একটা কুকুর এসে তার পাশে পাশে চলতে থাকে।

কুকুর প্রসঙ্গে আমার নিজের অভিজ্ঞতার দুটি গল্প বলি :

শহীদুল্লাহ হলে থাকাকালীন ঘটনা। একদিন দুপুরবেলা ঠিক ভাত খাবার সময় কে যেন দরজা ধাক্কাতে লাগল। কলিংবেল টিপছে না, দরজা ধাক্কাচ্ছে–কাজেই ধরে নিলাম ভিক্ষুক। দুপুরবেলা ভাত ভিক্ষা চাওয়ার জন্যে খুব ভালো সময়। আমি দরজা খুলে দেখি বিশাল এক কুকুর। আমাদের দেশি কুকুর এত বড় হয় না। আমি কুকুটাকে কিছু খাবার দিতে বললাম। খাবার দেওয়া হলো। সে খাওয়াদাওয়া করে চলে গেল। পরদিন আবার এল–সেই দুপুরবেলা। আবারও খাবার দেওয়া হলো। তারপর সে আসতেই থাকল। আমার ছোট মেয়ে একদিন বলল, বাবা দেখ, কুকুটা ঠিক দুটোর সময় আসে।

কুকুরের নিশ্চয়ই হাতঘড়ি নেই। ঘণ্টা-মিনিট মিলিয়ে তার খেতে আসার কথা নয় দেখা গেল এই কুকুরটা তা-ই করছে। ঠিক দুটোর সময়ই আসছে। সময় সম্পর্কে প্রাণিজগতের নিশ্চয়ই সে রকম কোনো ঘড়ি আছে, যা ব্যবহার করে ঠিক দুটোর সময় চলে আসে।

এই অদ্ভুত ঘটনা কিছু নিমন্ত্রিত বন্ধু-বান্ধবকে দেখিয়ে তাদের চমৎকৃত করা হলো।

ব্যাপার এমন হলো–ঠিক দুটো বাজতেই আমরা অপেক্ষা করি–কখন সে আসবে। সবদিন আসেও না। মাঝে মাঝে এমন হয়েছে পর পর চার-পাঁচদিন দেখা নেই। তারপর একদিন সে উপস্থিত। দরজায় মাথা দিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। ঘড়িতে বাজছে দুটো। কোথায় সে থাকে–তা-ও জানি না। যেখানে থাকুক সে যে কষ্টে নেই তা বোঝা যায় তার স্বাস্থ্য দেখে। মনে হয় না সে কখনো ক্ষুধার্ত থাকে, কারণ প্রায়ই দেখা গেছে, দুপুরে সে আসছে ঠিকই কিন্তু কিছু মুখে দিচ্ছে না। যেন সে দেখা করার জন্যেই এসেছে। খাবার জন্যে আসে নি।

আমরা কুকুরটার একটা নাম দিলাম, দি ওয়ান্ডারার-পরিব্রাজক। কুকুরদের বাংলা নাম মানায় না বলেই ইংরেজি নাম। তারপর হঠাৎ একদিন দি ওয়ান্ডারার আসা বন্ধ করে দিল। দুপুর হলেই আমরা অপেক্ষা করি, সে আসে না। দুপুরে কেউ দরজা ধাক্কা দিলে আমার বাচ্চারা ছুটে যায়–না, দি ওয়ান্ডারার না–অন্য কেউ। নানা জল্পনা-কল্পনা হয়–কী হলো ওয়ান্ডারের? রাস্তায় গাড়িচাপা পড়ল? নাকি মিউনিসিপ্যালিটির লোকজন এসে তাকে ধরে নিয়ে গেল।

একদিন আমাদের জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটল, দি ওয়ান্ডারার এসে উপস্থিত। তার চেহারা ভয়ংকর। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে–চোখ রক্তবর্ণ, কিছুক্ষণ পরপর চাপা গর্জন। কালান্তক র‍্যাবিজ নিয়ে সে উপস্থিত। লোকজনের তাড়া খেয়ে সে ফিরে এসেছে পুরানো জায়গায় এবং আশ্চর্য, এসেছে ঠিক দুপুর দুটোয়। কুকুরের বুদ্ধি এবং কুকুরের আবেগ দিয়ে সে হয়ত ধারণা করেছে এই একটি বাড়িতে তার আশ্রয় আছে। এই বাড়ির লোকজন তাকে কিছু বলবে না। তাকে শান্তিতে মরতে দেবে।

আমরা দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে আছি। দরজার বাইরে দি ওয়ান্ডারার। মাঝে মাঝে তার চাপা হুংকার শোনা যাচ্ছে। সে দরজা আঁচড়াচ্ছে। পিপহোলে চোখ রাখলে। তার ভয়ংকর মূর্তি দেখা যায়। আমরা ঘরে আটকা পড়ে গেলাম। হলের দারোয়ানরা খবর পেয়ে লাঠি-সোটা নিয়ে ছুটে এল। দি ওয়ান্ডারারকে হলের সামনে পিটিয়ে মারা হলো–আমি আমার তিন কন্যাকে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে এই হত্যাদৃশ্য দেখলাম। দি ওয়ান্ডারার বারবারই তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। তার চোখে ভয় নয়–তার চোখে রাজ্যের বিস্ময়। কিংবা কে জানে সবই হয়তো আমার কল্পনা–হয়তো কুকুররা বিস্মিত হয় না। মানুষদের নিষ্ঠুরতার সঙ্গে যুগ যুগ ধরেই তো তাদের পরিচয়। মানুষদের নিষ্ঠুরতায় তারা বিস্মিত হবে কেন?

আরো একটি কুকুরের কথা বলি। প্রায় তেইশ বছর আগের কথা। আমার বাবার তখন কুমিল্লায় পোস্টিং। আমাদের বাসা ঠাকুরপাড়ায়। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছুটিছাটায় কুমিল্লা যাই। ছুটি কাটিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি। সেবারও তা-ই গিয়েছি। ছুটির পুরো সময়টা আমি বাসাতেই থাকিবই পড়ে এবং গান শুনে সময় কাটাই। গান শোনার রোগ তখন খুব মাথাচাড়া দিয়েছে। বাবা একটি রেকর্ড প্লেয়ার কিনে দিয়েছেন। দিনরাত সেটা বাজে। সবার কান ঝালাপালী।

কুমিল্লায় তখন একটাই রেকর্ডের দোকান। 78 RPM-এর ডিস্ক পাওয়া যায়। একদিন ওই দোকানে গিয়ে রেকর্ড খুঁজছি, বাজিয়ে বাজিয়ে দেখছি, কোনটা নেওয়া যায়। কোনো গানই মনে ধরছে না। হঠাৎ লক্ষ করলাম, দোকানের বাইরে কালো রঙের একটা কুকুর বসে বসে গান শুনছে। হিজ মাস্টারস ভয়েস রেকর্ডের কুকুরের সঙ্গে এই কুকুরটির খুব মিল। বসেও আছে ঠিক সেই ভঙ্গিতে। আমি দোকানদারকে বললাম, এই কুকুরটি কি প্রায়ই আপনার দোকানে গান শুনতে আসে? দোকানদার মহাবিরক্ত হয়ে বলল, কুকুর গান শুনতে আসবে কেন? কী বলেন এইসব? দোকানদারের বিরক্তির প্রধান কারণ হচ্ছে–আমি শুধু তার রেকর্ড বাজিয়ে যাচ্ছি, কিনছি না। তা ছাড়া গান শুনতে কুকুর আসে–এই বাক্যটি বোধহয় তাকে আহত করল। রেকর্ডের দোকানের কর্মচারীদের মান-অপমান বোধ তীব্র হয়।

যা-ই হোক, দোকান থেকে বের হয়ে আমি কুকুরটাকে বললাম, গান শুনতে চাইলে আমার সঙ্গে চল। সে আমাকে বিস্মিত করে আমার সঙ্গে রওনা হলো। আমি বাসায় এসে ঘোষণা করলাম, সংগীতপ্রেমিক এক কুকুর নিয়ে এসেছি। গান শুনলে সে পাগল হয়ে যায়। কেউ তেমন উৎসাহ বোধ করল না। আমার ছোটবোন বলল, এমন নোংরা কুকুর সে নাকি তার জীবনে দ্বিতীয়টি দেখে নি। আমি বললাম, লাইফবয় দিয়ে একটা গোসল দিলেই চেহারা ফিরে যাবে। রেকর্ড প্লেয়ার বাজালে দেখবি কী কাণ্ড ঘটে! সংগীতের সে বিরাট সমঝদার।

লাইফবয় সাবান কিনে এনে তাকে গোসল দেওয়া হলো। সে কোনোরকম আপত্তি করলো না। খেতে দেওয়া হলো। খুব অনাগ্রহের সঙ্গে খেল। যেন খাওয়াটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। বেশ আয়োজন করে রেকর্ড প্লেয়ারে গান দেওয়া হলো। দেখা গেল গানের প্রতি তার কোনো আগ্রহই নেই। সে হাই তুলে কুণ্ডুলি পাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আমার ছোটবোন বলল, আধুনিক গান বোধহয় সে পছন্দ করছে। না। ক্লাসিক্যাল বেইজ-এর কিছু বাজাও। অনেক কিছুই বাজানো হলো। আধুনিক, হিন্দি, গজল, রবীন্দ্রসংগীত। অবস্থার উনিশ—বিশ হলো না। সংগীত-রসিক হিসেবে বাড়িতে ঢুকে সে স্থান করে নিল বেরসিক হিসেবে। তার সব কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রইল খাওয়া এবং ঘুমে। অন্য কিছুই করে না। কুকুর সম্প্রদায়ের প্রধান যে দায়িত্ব-অপরিচিত কেউ এলে ঘেউ ঘেউ করা–সেই সামান্য দায়িত্ব পালনেও তার ঘোর অনীহা। অপরিচিত কেউ এলে সে যা করে–তা হচ্ছে মাথা উঁচু করে খানিকক্ষণ দেখে, তারপর এক দৌড়ে বাড়ির ভেতরে বারান্দায় চলে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। শুধু পালিয়ে বেড়ায় বলেই তার নাম হলো পলা। [এই পলার উল্লেখ আমার প্রথম গ্রন্থ নন্দিত নরক-এ আছে। রুনু বলছে দাদা, আমাদের পলার নাকটা এত ঠান্ডা কেন?]

খেয়ে খেয়ে এবং ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পলার চেহারা ফিরে গেল কিন্তু সাহস বাড়ল। বরং সাহস কমে গেল–সে বিড়াল দেখলে ভয় পায়, ইঁদুর দেখলে ভয় পায়। মায়ের পোষা মোরগ নিয়মিত তাকে ঠোকর দিয়ে যায়। সে বিরক্ত হয়, কিন্তু রাগ করে না। ঘোঁৎ জাতীয় শব্দ করে, যার মানে হচ্ছে–কেন বিরক্ত করছ? দেখছ না ঘুমুচ্ছি? আমাদের একসময় ধারণা হলো–বেশি খাবার খেয়ে এর এই দশা হয়েছে। পেটে খিদে থাকলে এদের শরীরে রাগ আসে–ঘেউ ঘেউ করে। পলাকে পুরো একদিন উপোস রাখা হলো। তাতে সে মোটেই বিচলিত হলো না। খাবারের সন্ধানে বাইরে কোথাও গেল না। তার মুখের ভাব দেখে মনে হলো–নিয়তিকে সে গ্রহণ করেছে সহজভাবেই। কে জানে সে হয়তো কুকুর সম্প্রদায়ের অতি উঁচু স্তরের একজন সাধু।

পলা নাম বদলে তার নতুন নামকরণ হলো–দি সেইন্ট। ছুটি কাটিয়ে আমি ঢাকায় ফিরে এলাম। গরমের ছুটিতে আবার গেলাম। এই তিনমাসে দি সেইন্টের, স্বাস্থ্যের অনেক উন্নতি হয়েছে, তবে সাহসের কোনো উন্নতি হয় নি। বাইরের কেউ এলে আগের মতো দৌড়ে ভেতরে চলে আসে। তবে নিজের অধিকার সম্পর্কে সে দেখলাম এবার বেশ সজাগ। যথাসময়ে খাবার না দিলে রান্নাঘরে ঢুকে মা’র শাড়ির আঁচল কামড়ে ধরে। তবে নিজ থেকে কখনো কোনো খাবারে মুখ দেয় না।

সবচেয়ে যা দুঃখজনক তা হলো, গান বাজালে তার ঘুমের অসুবিধা হয় বলে সে বড় বিরক্ত হয়। উঠে চলে যায়।

একদিন এক কাণ্ড হলো। মুরগি কাটা হচ্ছে। দি সেইন্ট থাবা মেলে মা’র মুরগি কাটা গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছে। এমন সময় টেলিফোন ধরার জন্যে মা মুরগি রেখে ভেতরে গেলেন। ফিরে এসে দেখেন দি সেইন্ট ঠিক আগের মতোই থাবা মেলে বসে আছে। কোত্থেকে এক বিড়াল এসে কাটা মুরগি কামড়াচ্ছে। দি সেইন্ট কিছুই বলছে না। সম্ভবত তার ভদ্রতায় বাধছে। মা আমাকে ডেকে বললেন, তুই এই যমের অরুচিকে যেখান থেকে এনেছিস সেখানে ছেড়ে দিয়ে আয়।

আমি মার মতোই রাগলাম এবং দি সেইন্টের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললাম, ফাজিলের ফাজিল–তুমি বিদায় হয়ে যাও। আর কোনোদিন যেন তোমার ছায়া না দেখি। অপদার্থ কোথাকার!

দি সেইন্ট খোলা গেট দিয়ে গম্ভীর মুখে বের হয়ে গেল। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললাম, আপদ বিদেয় হয়েছে। বাঁচা গেছে। ছোট বোন বলল, আপদ মোটেই বিদেয় হয় নি। আপদ হাওয়া খেতে গেছে। হাওয়া খেয়ে ফিরবে। পল ফিরল না। সন্ধ্যার পর থেকে আমাদের খারাপ লাগতে লাগল। আমার মা বললেন, আহা, বেচারা বোকাসোকা–কোথায় আছে কে জানে? আমি বললাম, যাবে কোথায়, খিদে লাগলে নিজেই আসবে।

দি সেইন্ট এল না। পরদিন আমরা খুঁজতে বেরুলাম। কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। সম্ভব-অসম্ভব সব জায়গা দেখা হলো। সে নেই। একটি সামান্য কুকুর আমার কঠিন কথায় মর্মাহত হতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। আমার নিজেরও খুব মন খারাপ হলো। ত্রিশ টাকা খরচ করে কুমিল্লা শহরে মাইক দিয়ে ঘোষণা দেওয়া হলো একটি কালো রঙের দেশি কুকুর হারানো গিয়াছে। কুকুরটার ডান কান সাদা। সে আমলে ত্রিশ টাকা অনেক টাকা। সামান্য কুকুরের জন্যে ত্রিশ টাকা খরচ করার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। তবু খরচ করা হলো। তাতেও লাভ হলো না।

প্রায় এক বছর পর দি সেইন্ট এল। তবে একা না। তার সঙ্গে চারটি ফুটফুটে বাচ্চা। বাচ্চাগুলো কী যে সুন্দর–শুধু তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছা করে। আমি তখন ঢাকায়। আমাকে টেলিগ্রাম করা হলো–আমি ক্লাস বাদ দিয়ে কুমিল্লায় চলে এলাম। পলার সামনে দাঁড়িয়ে আন্তরিকভাবেই বললাম, পলা, তুমি যে তোমার বাচ্চাদের নিয়ে এসেছ এতে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। আমি আমার ব্যবহারের জন্যে লজ্জিত। যতদিন ইচ্ছা তুমি এ বাড়িতে থাকতে পার।

পলা উঠে এসে আমার পায়ের কাছে শুয়ে পড়ল। ঘেউ ঘেউ করে সে তার বাচ্চাগুলোকে কী যেন বলল, বাচ্চারা চোখ বড় বড় করে আমাকে দেখতে লাগল। হয়ত তার মা বলেছে মানুষটাকে দেখে রাখ। একে যতটা খারাপ ভাবা গিয়েছিল–এ ততটা খারাপ না।

পলা তার বাচ্চাদের নিয়ে আমাদের বাসাতেই থেকে গেল। তার বাচ্চারা মার মতো হয় নি। এরা সবাই দুর্দান্ত সাহসী। অপরিচিত কেউ আমাদের বাসায় বাচ্চাগুলোর জন্যে ঢুকতে পারত না। তারা একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ত। সে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য! তার চেয়েও অবিশ্বাস্য দৃশ্য হচ্ছে–গান বাজলেই সব কটা বাচ্চা এক সঙ্গে ছুটে এসে হিজ মাস্টারস ভয়েসের কুকুরের মতো গম্ভীর ভঙ্গিতে কান উঁচু করে বসে থাকত। তাদের চোখের পলক পড়ত না। যতক্ষণ গান বাজতো ততক্ষণ এরা কেউ নড়তো না।

একজীবনে কত অদ্ভুত দৃশ্যই না দেখলাম!

হোটেল আহমেদিয়া

আমি একবার একটা ভাতের হোটেল দিয়েছিলাম। নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে হোটেলের নাম–আহমেদিয়া হোটেল। আসুন, আপনাদের সেই হোটেলের গল্প বলি।

১৯৭১ সনের কথা। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়। রোজার মাস। থাকি মহসিন হলে ৫৬৪ নম্বর রুমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলি তখন ছাত্রদের জন্যে নিরাপদ বলে ভাবা হত। কারণ যারা এই সময়ে হলে থাকবে তারা অবশ্যই পাকিস্তান অনুরাগী। হলে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করছে। এরা সবাই শান্ত এবং সুবোধ ছেলে। মুক্তিবাহিনীতে না গিয়ে পড়াশোনা করছে। আমার তখন কোথাও থাকার জায়গা নেই। নানার বাড়ি মোহনগঞ্জে অনেক দিন লুকিয়ে ছিলাম। আর থাকা যাচ্ছে না। আমার নানাজান। দীর্ঘদিনের মুসলিম লীগ কর্মী। তখন শান্তি কমিটির সভাপতি হয়েছেন। নানাজানের শান্তি কমিটিতে যোগ দেবার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করছি। আমি আমার নানাজনের জন্যে সাফাই গাইছি না। আমার সাফাইয়ের তাঁর প্রয়োজন নেই। তবু সুযোগ যখন পাওয়া গেল বলি। চারদিকে তখন ভয়ংকর দুঃসময়। আমার বাবাকে পাকিস্তানী মিলিটারী গুলি করে হত্যা করেছে। নানাজান আমাদের সুদূর বরিশালের গ্রাম থেকে উদ্ধার করে নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন। তাও এক দফায় পারেননি। কাজটি করতে হয়েছে দু’বারে। তাঁর অনুপস্থিতিতেই তাকে শান্তি কমিটির সভাপতি করা হল। তিনি না বলতে পারলেন না। না বলা মানেই আমাদের দু ভাইয়ের জীবন সংশয়। আমাদের আশ্রয় সুরক্ষিত করার জন্যেই মিলিটারীদের সঙ্গে ভাব রাখা তিনি প্রয়োজন মনে করেছিলেন। তার পরেও আমার মা এবং আমার মামারা নানাজানের এই ব্যাপারটি সমর্থন করতে পারেননি। যদিও নানাজানকে পরামর্শ দিতে কেউ এগিয়ে আসেননি। সেই সাহস তাদের ছিল না। তারা নিজেদের সমর্পণ করেছিলেন নিয়তির হাতে। শান্তি কমিটিতে থাকার কারণে মিলিটারীদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কত মানুষের জীবন তিনি রক্ষা করেছেন সেই ইতিহাস আমি জানি এবং যারা আজ বেঁচে আছেন তাঁরা জানেন। গুলির মুখ থেকে নানাজানের কারণে ফিরে-আসা কিছু মানুষই পরবর্তী সময়ে তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁকে মরতে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। তাঁর মত অসাধারণ একজন মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মারা গেলেন, এই দুঃখ আমার রাখার জায়গা। নেই!

মিলিটারীরা নানাজানকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি। হঠাৎ হঠাৎ অদ্ভুত সময়ে তার বাড়িতে উপস্থিত হয়। বাড়ি ঘুরেফিরে দেখে। একদিন তারা আমাদের দেখে ফেলল। ভুরু কুঁচকে বলল, এরা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র? দেখে তো সে রকমই মনে হয়। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়ে ঘরে বসে আছে কেন? নানাজান কোন সদুত্তর দিতে পারলেন না। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ঢাকায় পাঠাতে ভরসা পাচ্ছি না বলে আটকে রেখেছি। তবে শিগগিরই ঢাকা পাঠাব।

আমি নিজেও এক জায়গায় বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করে একটি চিঠি পাঠিয়েছি ৬ নম্বর সেক্টরের সালেহ চৌধুরীকে (দৈনিক বাংলার সালেহ চৌধুরী)। তিনি তখন ভাটি অঞ্চলে প্রবল। প্রতাপে মুক্তিবাহিনী নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি আমার চিঠির জবাব দিলেন না। এটা অবশ্যি আমার জন্যে ভালই হয়েছে। মনের দিক থেকে আমি চাচ্ছি না জবাব আসুক। জবাব এলেই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে হবে, এবং অবধারিতভাবে মিলিটারীর গুলি। খেয়ে মরতে হবে। এত তাড়াতাড়ি মৃত্যুকে স্বীকার করে নেবার মত মানসিক প্রস্তুতি আমার ছিল না। আমি ভীতু হয়ে জন্মেছি।

কাজেই চলে এলাম ঢাকায়, উঠলাম হলে। বলা চলে, হাঁপ ছেড়ে বাচলাম। আমার অতি প্রিয়জন–আনিস ভাইও দেখি হলেই আছেন। আমার পাশের ঘরে থাকেন। ফিজিক্সে পড়াশোনা বাদ দিয়ে তিনি তখন সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করেন, একটা চিত্রনাট্যও তৈরি করেছেন। তার একটা দামী ট্রানজিস্টার রেডিও আছে। সেই ট্রানজিস্টার রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা শোনা হয়। রাত যখন গম্ভীর হয় তখন আমরা চলে যাই ছ’তলায়। সেখানে দুটি ছেলে আছে (দু’ভাই)। তারা প্ল্যানচেটের বিষয়ে না-কি বিশেষজ্ঞ। তারা প্ল্যানচেটে ভূত নামায়। ভূতের মারফতে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। কবে দেশ স্বাধীন হবে, এইসব। প্ল্যানচেটে দেশী বিদেশী সবধরনের ভূত আসে। দেশী ভূতদের মধ্যে সবাই আবার ভুবন বিখ্যাত। তাদের ভূত না বলে আত্মা বলা উচিত। নয়ত তাদের অসম্মান হবে। যেমন রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, শেরে বাংলা। এঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ খুবই মিশুক প্রকৃতির, ডাকলেই চলে আসেন। দেশ কবে স্বাধীন হবে জানতে চাইলে বলেন–ধৈর্য ধর। ধৈর্য ধরতে শেখ। দু থেকে তিন বছরের মধ্যেই স্বাধীনতা পাবে।

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার উপর আমাদের আস্থা কম ছিল বলেই বোধহয় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকেও এক রাতে আনা হয়। তিনি এসেই আমাদের স্টুপিড, ননসেন্স বলে গালাগালি করতে থাকেন।

মোটের উপর আমাদের সময়টা ভাল কাটে। ভূত বিশেষজ্ঞ দুই ভাই পরকাল, আত্মা, সৃষ্টিকর্তা বিষয়ে নানান জ্ঞান দেয়, শুনতে মন্দ লাগে না। সবচে’ বড় কথা–মিলিটারী এসে ধরে নিয়ে মেরে ফেলবে, এই সার্বক্ষণিক ভয়ের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি যার আনন্দ কম নয়। কষ্ট একটাই, খাওয়ার কষ্ট। রোজার সময় বলেই সব দোকান বন্ধ। হোটেল তো বন্ধই, চায়ের দোকানও বন্ধ। হলের মেসও বন্ধ। ধর্মীয় কারণে নয়, নিতান্ত বাধ্য হয়েই হলের অনেকেই রোজা রাখছে। সেখানেও বিপদ আছে। বিকেলে ইফতারী কিনতে নিউমার্কেট গিয়ে একজন মিলিশিয়ার হাতে বেধড়ক মার খেল। মিলিশিয়ার বক্তব্য–রোজার দিনে এই ছাত্র নাকি ‘ছোলা ভাজা খাচ্ছিল।

আমি নিজে ক্ষুধা সহ্য করতে পারি না। খিদে পেলেই চোখে অন্ধকার দেখি। অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা প্রথম এবং শেষ রোজা রেখে রোজা বেঁধে ফেলার যে প্রক্রিয়া করে, আমি তা-ও পারি না। প্রথম রোজাটা রাখি–শেষটা রাখি না, সম্ভব হয় না।

আমি মহাবিপদে পড়লাম। দুপুরে চিনি দিয়ে পাউরুটি খাই–খিদে যায় না। সারাক্ষণ খিদে লেগে থাকে। একদিন দোকান থেকে একটা হিটার কিনে আনলাম, টিনের বাটিতে কিছু চাল ফুটিয়ে নিলাম। ডিম ভাজলাম। লবণ কেনা হয়নি–লবণহীন ডিম ভাজা দিয়ে ভাত খেলাম। অমৃতের মত লাগল। আনিস ভাই এসে আমার সঙ্গে যোগ দিলেন। পরের দিন ভূত বিশেষজ্ঞ দুই ভাই এসে উপস্থিত। তারা জানতে চায়, তাদের কাছে এলুমিনিয়ামের একটা বড় সসপ্যান আছে, আমরা সেটা চাই কি-না।

আমি বললাম, অবশ্যই চাই।

তখন দুই ভাই মাথা চুলকে বলল, তারা কি আমার সঙ্গে খেতে পারবে? খরচ যা লাগবে দেবে। তারাও নাকি দুপুরে পাউরুটি খেয়ে আছে।

আমি বললাম–অবশ্যই খেতে পারবে।

চতুর্থ দিনে আমাদের সদস্য সংখ্যা হল দশ। অতি সস্তায় দুপুরের খাওয়া। ভাত ডাল এবং ডিম ভাজি। সবাই খুব মজা পেয়ে গেল। আসলে কারোরই তখন কিছু করার নেই। বিশ্ববিদ্যালয় নামে মাত্র খোলা, কেউ সেখানে যায় না। সবাইকে হলে বন্দী থাকবে হয়। বন্দি জীবনে বৈচিত্র্য হল এই রান্নাবান্না খেলা। আমরা একদিন একটা বড়

ফুলস্কেপ কাগজে লিখলাম–

আহমেদিয়া ভাতের

হোটেল ভাত এক টাকা। ডাল আট আনা। ডিম এক টাকা।

হোটেলের নিয়মাবলী :

১. যাহারা খাদ্য গ্রহণ করিবেন, তাঁহারা সকাল দশটার মধ্যে নাম এন্ট্রি করাইবেন।

২ খাওয়ার সময় ভাত নরম না শক্ত এই বিষয়ে কোন মতামত দিতে পারিবেন না।

ফুলস্কেপ কাগজে আমার ঘরের দরজায় আঠা দিয়ে সেঁটে দেয়া হল।

এক রোববারে ইমপ্রুভ ডায়েটের ব্যবস্থা হল। ভূনা খিচুড়ি এবং ডিম ভাজা। ভূনা খিচুড়ি কি করে রাখতে হয় তখন জানি না। ভূত বিশেষজ্ঞ দুই ভাই বলল, তারা জানে–খিচুড়ি তারা বঁধবে। এই বিষয়ে কাউকে কোন চিন্তা করতে হবে না। শুধু খিচুড়ি না–তারা নাকি ‘কলিজিও ব্রাধবে।

সকাল থেকে রান্নার আয়োজন শুরু হল। সদস্যদের আগ্রহের সীমা নেই। রান্না শেষ হতে হতে দুটো বেজে গেল। আমরা খেতে বসব, তখন হঠাৎ একজন ছুটে এসে বলল, মিলিটারী হল ঘেরাও করে ফেলেছে। আমরা হতভম্ব। হল কেন ঘেরাও করবে? হল তো খুব নিরাপদ হবার কথা। দেখতে দেখতে হলে মিলিটারী ঢুকে পড়ল। ভেড়ার পালের মত আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে গেল নিচে। সবাইকে লাইন বেঁধে দাঁড় করালো। আমরা আতংকে জমে গেলাম। কি হচ্ছে এসব? সব মিলে চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ জন ছাত্র। হলের কিছু কর্মচারী। হলের সামনে সাক্ষাত মৃত্যুদূতের মত একটি মিলিটারি জীপ, একটি ট্রাক এবং মুড়ির টিন জাতীয় গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। মুড়ির টিন গাড়িটির দরজা-জানালা সব বন্ধ। তবে ভেতরে লোক আছে। কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। গাড়ির একটি ছোট্ট জানালা আধখোলা। জানালার ওপাশে কেউ একজন বসে আছে। বাইরে থেকে আমরা তাকে দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের বলা হল লাইন বেঁধে সেই জানালার সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে। জানালার সামনে দিয়ে যাবার সময়–গাড়ির ভেতরে বসা কেউ একজন হঠাৎ বলে বসে–একে আলাদা কর। তাকে আলাদা করা হয়। এইভাবে চারজনকে আলাদা করা হল। তিন জন ছাত্র। একজন হলের কর্মচারী। তিনজন ছাত্রের মধ্যে একজন আমি।

কি সর্বনাশ! এখন কি করি। মিলিটারী ধরে নিয়ে যাওয়ার নাম তো নিশ্চিত মৃত্যু। এত তাড়াতাড়ি মরে যাব?

আমাদের খোলা ট্রাকে তোলা হল। মিলিটারীরা আমাদের নিয়ে রওনা হল। আমি হলের দিকে তাকালাম, আমার বন্ধুদের দিকে তাকালাম–আমি জানি–এই হল, বন্ধুদের প্রিয় মুখ আমি আর কখনো দেখতে পাব না।

আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হল আণবিক শক্তি কমিশন ভবনে। ঐ ভবনটি তখন মিলিটারীদের অস্থায়ী ঘাটির একটি। সেখানে পৌঁছে জানতে পারলাম–আমাদের সবার বিরুদ্ধেই সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, আমরা দেশদ্রোহী। ঢাকায় গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে–কি ভয়ানক অবস্থা। সেখান থেকে জীপে করে

আমাদের পাঠানো হল বন্দি শিবিরে। বিরাট একটা হলঘরের মত জায়গায় আমাদের। রাখা হল। আরো অনেকেই সেখানে আছেন। সবার চোখেই অদ্ভুত এক ধরনের ছায়া। সম্ভবত মৃত্যুর ছায়া। তারা তাকাচ্ছে, কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু দেখছে না। মানুষের প্রধান যে বৈশিষ্ট্য–কৌতূহল–সেই কৌতূহলের কিছুই তাদের চোখে নেই। এখান থেকে একজন একজন করে নিয়ে যাচ্ছে পাশের ঘরে–তারপরই বীভৎস চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। সে চিৎকার মানুষের চিৎকার নয়–পশুর চিৎকার। এক সময় চিৎকারের শব্দ কমে আসে। শুধু গোঙানির শব্দ কানে আসে। সেই শব্দও যখন কমে আসে তখন শুধু ক্লান্ত কাতরধ্বনি কানে আসে, পানি, পানি …।

আমি আমার পাশে বসা এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম–এরা কি সবাইকে এ রকম শাস্তি দেয়?

ভদ্রলোক আমার প্রশ্নে বিস্মিত হয়ে তাকালেন, জবাব দিলেন না। সম্ভবত এ রকম ছেলেমানুষী প্রশ্নের জবাব দিয়ে তিনি সময় নষ্ট করতে চান না।

অনেককেই দেখলাম নামাজ পড়ছেন। নামাজের সময় নয় তবু পড়ছেন, নিশ্চয়ই নফল নামাজ। কি ভয়াবহ আতংক তাদের চোখে-মুখে!

জিজ্ঞাসাবাদ এবং শাস্তির জন্যে আমার ডাক পড়ল রাত এগারোটার দিকে। ছোট্ট একটা ঘরে নিয়ে আমাকে ঢোকানো হল। সেই ঘরের মেঝেতে তখন একজন শুয়ে আছে। লোকটা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। শুধু মৃদু গোঙানির শব্দ আসছে। মৃত্যুর আগে মানুষ হয়ত এরকম শব্দ করে। মানুষটার গায়ে একটি গেঞ্জী–গেঞ্জীতে চাপ চাপ রক্ত। এ ছাড়াও ঘরে আরো দু’জন মানুষ? আছে। একজনের মুখে শ্বেতীর দাগ। সে গোশত এবং পরোটা খাচ্ছে। অন্য একজনের হাতে এক কাপ চা। সে পিরিচে ঢেলে ঢেলে চা খাচ্ছে। দু’জনের মুখই হাসি হাসি। মেঝেতে একজন মানুষ মারা যাচ্ছে, তা নিয়ে তাদের কোন রকম মাথাব্যথা নেই। মৃত্যু তখন এতই সহজ। আমি ঘরে ঢুকতেই মুখে শ্বেতীর দাগওয়ালা মানুষটা বলল (উর্দুতে), আমি খাওয়া শেষ করে নেই–তারপর তোমার সাথে খোশ গল্প করব। আপাতত বিশ্রাম কর। হা হা হা।

লোকটার খাওয়া দেখে এই প্রথম মনে হল–আজ সারাদিন আমি কিছু খাইনি। হোটেল আহমেদিয়ায় আজ ইমপ্রুভ ডায়েট রান্না হয়েছে। আমার বন্ধুরা কি কিছু খেতে পেয়েছে?

না, ঐদিন আমার বন্ধুরা কিছু খেতে পারেনি। আমাদের ধরে নিয়ে যাবার পর–তারা সবাই এসে বসল আমার রুমে। আনিস সাবেত বললেন, হুমায়ূনকে বাদ দিয়ে এই খাবার আমি খেতে পারব না, তোমরা খাও। অন্যরাও রাজি হল না। ঠিক করা হল–যদি আমি জীবিত অবস্থায় ফিরে আসি তাহলে আবারো ইমপ্রুভ ডায়েট রান্না হবে। হৈ চৈ করে খাওয়া হবে। আনিস সাবেত আমার দরজার সামনে থেকে আহমেদিয়া হোটেলের সাইনবোর্ড তুলে ফেললেন।

পরম করুণাময়ের অসীম কৃপায় আমি জীবিত অবস্থায় ফিরে আসি। বন্ধু বান্ধবরা তখন নানান দিকে ছড়িয়েছিটিয়ে পড়েছে।

আমি ফিরে আসি জনশূন্য ফাঁকা হলে। জীবিত ফিরে আসার উত্তেজনায় দু’রাত আমি এক ফোঁটা ঘুমুতে পারিনি। বার বার মনে হত এটা হয়ত স্বপ্ন। স্বপ্ন কেটে যাবে, আমি দেখব মুখে শ্বেতী দাগওয়ালা মানুষটা বলছে, একে নিয়ে যাও, মেরে ফেল।

দেখতে দেখতে কুড়ি বছর পার হয়ে গেল। আনিস সাবেত মারা গেল ক্যানসারে। বন্ধু-বান্ধবরা আজ কে কোথায় জানিও না। মাঝে মাঝে হলের সামনের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় মনে হয়–আবার সবাইকে খবর দেয়া যায় না? আবার কি হিটার জ্বালিয়ে ভূনা খিচুড়ি রান্না করে সবাইকে নিয়ে খাওয়া যায় না? খেতে খেতে আমরা পুরোনো দিনের গল্প করব। যে দুঃসময় পার হয়ে এসেছি সেই দুঃসময়ের কথা ভেবে ব্যথিত হব।

হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের প্রায়ই দেখতে ইচ্ছা করে। হঠাৎ হঠাৎ এক-আধজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। খানিক আগে একজনের সঙ্গে দেখা হল। সে তার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে করে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে গাড়ি থামাল। নেমে এসে আনন্দিত গলায় বলল–আরে তুই?

হাত ধরে সে আমাকে টেনে নিয়ে গেল তার ছেলেমেয়েদের কাছে। গাঢ় গলায় বলল, পরিচয় করিয়ে দেই। এর নাম হুমায়ূন আহমেদ। আমরা একবার একটা হোটেল দিয়েছিলাম–আহমেদিয়া হোটেল। হুমায়ূন ছিল সেই হোটেলের বাবুর্চি।

বলতে বলতে তার চোখে পানি এসে গেল। সে কোটের পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছতে থাকল। তার ছেলেমেয়েরা বাবার এই কাণ্ডের কোন অর্থ বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আজকালকার ছেলেমেয়ের কাছে আমাদের চোখের এই অশ্রুর কারণ আমরা কোনদিনও স্পষ্ট করতে পারবো না। ৭১-এর স্মৃতির যে বেদনা আমরা হৃদয়ে লালন করি–এরা তার গভীরতা কোনদিনই বুঝবে না। বোঝার প্রয়োজনও তেমন নেই। এরা সুখে থাকুক। কোনদিনও যেন আমাদের মত দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে তাদের যেতে না হয়। এরা যেন থাকে দুধে-ভাতে।

শোনা কথা

আমার ছেলেবেলা

উৎসর্গ

বড়মামা শেখ ফজলুল করিম যিনি এই পৃথিবীতে খুব অল্প আয়ু নিয়ে এসেছিলেন সেই অল্প আয়ুর সবটাই খরচ করে গেলেন আমাদের পেছনে।

তৃতীয় মুদ্রণের ভূমিকা

সিলেটের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী জনাব লিয়াকত হোসেন সাহেব আমার ছেলেবেলায় উল্লিখিত শুক্লাদি এবং মাথামোটা শংকর সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছেন। আমি তার চিঠি থেকে সেই অংশ হুবহু তুলে দিলাম।

শুক্লাদি : মীরা বাজারের এস. কে. রায় চৌধুরী-এর বড় কন্যা শুক্লা রায় চৌধুরী ভারতে অধ্যয়নকালে অকাল মৃত্যুবরণ করেন। তিনি এম. সি, কলেজের রসায়ন বিভাগ-এর বিভাগীয় প্রধানের মেয়ে ছিলেন। তিনি ১৯৫৪-তে সিলেট গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তার বড় ভাই সাধন ১৯৬১-তে পাটনায় অকাল মৃত্যুবরণ করেন এবং অধ্যাপক রায় চৌধুরী ১৯৭১-এর কিছুদিন আগে আসামের করিমগঞ্জে মৃত্যুমুখে পতিত হন। ওঁদের পরিবারের সঙ্গে আমার জানাশোনা ছিল। বর্তমানে রত্না, শংকর ও মানস ভারতে চাকুরি করছে। ঐ বাড়ি লতিফ চৌধুরী নামে একজন ব্যবসায়ী কিনেছেন। তিনিও আমার খুব পরিচিত। আপনার দেওয়া বাড়ির বর্ণনা ঠিক আছে—হিন্দুবনেদী বাড়ি গাছপালা বেষ্টিত থাকতো। মাথামোটা শংকরঃ আপনার ক্লাসমেট শংকর তার ছাত্রজীবন ইতি দিয়ে মাদ্রাসা মাঠে মোটা মাথা নিয়ে বাদাম বিক্রি করতো। জানি না এখন কোথায় আছে। মীরা বাজারের কারো সঙ্গে দেখা হলে তার খবর জানতে পারবো। নতুন খবর জানলে আপনাকে জানাবার ইচ্ছা রাখি।

হুমায়ূন আহমেদ
শহীদুল্লাহ হল
৫. ১০. ৯১

ভূমিকা

এক দুপরে ভাত খেতে বসেছি। আমার মেজো মেয়ে কী-একটা দুষ্টুমি করায় মার কাছে বকা খেয়েছে। মুখ অন্ধকার করে ভাতের থালা সামনে নিয়ে বসে আছে। অনেক সাধাসাধি করেও তাকে খাওয়ানো যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, মা, তোমাকে আমি আমার ছেলেবেলার একটা গল্প বলব। গল্প শুনে তুমি যদি হেসে ফেলো তা হলে কিন্তু ভাত খেতে হবে।

আমি গল্প শুরু করলাম। সে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল না হাসার। শেষ পর্যন্ত খিলখিল করে হেসে ফেলে বলল, তুমি যদি তোমার ছেলেবেলার আরেকটা গল্প বল তা হলে ভাত খাব।

আমি যে একসময় তাদের মতো ছোট ছিলাম এবং খুব দুষ্ট ছিলাম এই বিস্ময়ই তাদের জন্যে যথেষ্ট। তার সঙ্গে যুক্ত হল মজার মজার ঘটনা। ওদের সঙ্গে গল্প করতে করতে মনে হল ছেলেবেলাটা লিখে ফেললে কেমন হয়। বিশ-পঁচিশ পৃষ্ঠা লিখেও ফেললাম। আমার বড় মেয়ে খুব উৎসাহ নিয়ে সেই পাণ্ডুলিপি আমার মাকে পড়াল। মার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি শীতল গলায় আমাকে বললেন, এইসব কী লিখেছিস? নিজের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে রসিকতা?

আমার ছোট বোনও পাণ্ডুলিপি পড়ল। সে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, আমাকে নিয়ে মাকড়সা প্রসঙ্গে যে গল্পটা লিখেছ ঐটা কেটে দাও। লোকে কী ভাববে? পাণ্ডুলিপির খবর ছড়িয়ে পড়ল। আমার ছোটমামা খুলনা থেকে চলে এলেন পড়ার জন্যে। তিনি পড়লেন এবং কোনো কথা না বলে খুলনা চলে গেলেন। বুঝলাম তারও পছন্দ হয়নি। তবু একসময় শেষ করলাম এবং কোথাও কোনো ভুলটুল আছে কি না তা যাচাই করবার জন্য নিজেই নানিজানকে পড়ে শোনালাম।

নানিজান বললেন, অনেক ভুলভ্রান্তি আছে। এই ধর, তুই লিখলি তোর মা পাগল হয়ে গিয়েছিল। পাগল হবে কীজন্যে? মানুষ চিনত না। উলটাপালটা কথা বলত-এর বেশি তো কিছু না। এটাকে পাগল বলে?

আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম। আমার মেজো মেয়ে বলল, তুমি মন-খারাপ করছ কেন? লেখাটা তো মোটামুটি ভালোই হয়েছে। তবে তুমি একটা জিনিস লিখতে ভুলে গেছ।

কোন জিনিস মা? ছেলেবেলায় দুধ আর ডিম খেতে তোমার কেমন খারাপ লাগত তা তো লেখনি। দুধ ডিম তো মা তোমরা খাচ্ছ। আমরা খেতে পারিনি। এত পয়সা আমার বাবা-মার ছিল।

মেজো মেয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, আহা কী সুখের ছিল তোমাদের ছেলেবেলা! হ্যাঁ, সুখেরই ছিল।

সেই সুখের খানিকটা ভাগ আজকের পাঠক-পাঠিকাদের দেয়ার জন্যেই এই লেখা। ছেলেবেলা লেখার সময় শৈশবে ফিরে গিয়েছিলাম। যতক্ষণ লিখেছি গভীর আনন্দে হৃদয় আচ্ছন হয়ে ছিল। পেছনে ফিরে তাকানো যে এত আনন্দময় হবে কে জানত?

হুমায়ূন আহমেদ

০১. শোনা কথা

মানুষ অসম্ভব স্মৃতিধর।

নব্বই বছরের একজন মানুষও তার ছেলেবেলার কথা মনে করতে পারে।  মস্তিষ্কের অযত নিযুত নিওরোনে বিচিত্র প্রক্রিয়ায় স্মৃতি জমা হয়ে থাকে। কিছুই নষ্ট হয় না। প্রকৃতি নষ্ট হতে দেয় না। অথচ আশ্চর্য, অতি শৈশবের কোনো কথা আর মনে থাকে না। দুবছর বা তিন বছর বয়সের কিছুই সে মনে করতে পারে না। মাতৃগর্ভের কোনো স্মৃতি থাকে না, জন্মমুহূর্তের কোনো স্মৃতিও না। জন্মসময়ের স্মৃতিটি তার থাকা উচিত ছিল। এত বড় একটা ঘটনা অথচ এই ঘটনার স্মৃতি প্রকৃতি মুছে ফেলে। মনে হয় প্রকৃতির কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য এতে কাজ করে। প্রকৃতি হয়তো চায় না পৃথিবীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের কথা আমরা মনে করে রাখি।

আমি যখন মন ঠিক করে ফেললাম ছেলেবেলার কথা লিখব, তখন খুব চেষ্টা করলাম জন্মমুহূর্তের স্মৃতির কথা মনে করতে এবং তারও পেছনে যেতে, যেমন মাতৃগর্ভ। কেমন ছিল মাতৃগর্ভের সেই অন্ধকার? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করল। এল এস ডি (Lysergic acid dietlyamide) নামের একধরনের ডাগ নাকি মাতৃগর্ভ এবং জন্মমুহূর্তের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। আমেরিকা থাকাকালীন এই ড্রাগের খানিকটা জোগাড় করেছিলাম। সাহসের অভাবে খেতে পারিনি। কারণ এই হেলুসিনেটিং ড্রাগ প্রায়ই মানুষের মানসিক অবস্থায় বড় রকমের ঢেউ তোলে।

আসল ব্যাপার হচ্ছে, খুব পুরানো কথা আমার কিছুই মনে নেই। তবে জন্মের চার বছরের পর থেকে অনেক কিছুই আমি মনে করতে পারি। সেইসব কথাই লিখব। শুরুটা করছি শোনা কথার উপর নির্ভর করে। শোনা কথার উপর নির্ভর করাও বেশ কঠিন। একই গল্প একেক জন দেখি একেক রকম করে বলেন। যেমন একজন বললেন, তোমার জন্মের সময় খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। অন্য একজন বললেন, কই না তো, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ছিল এইটা খেয়াল আছে, ঝড়বৃষ্টি তো ছিল না!

আমি সবার কথা শুনে শুনে একটি ছবি দাঁড় করিয়েছি। এই ছবি খানিকটা এদিক-ওদিক হতে পারে, তাতে কিছু যায় আসে না। আমি এমন কেউ না যে

আমার জন্মমুহূর্তের প্রতিটি ঘটনা হুবহু লিখতে হবে। কোনো ভুলচুক করা যাবে না। থাকুক কিছু ভুল। আমাদের জীবনের একটা বড় অংশ জুড়েই তো আছে ভুল এবং ভ্রান্তি।

আমার জন্ম ১৩ই নভেম্বর। ১৯৪৮ সন। শনিবার, রাত ১০টা তিরিশ মিনিট। শুনেছি ১৩ সংখ্যাটাই অশুভ। এই অশুভের সঙ্গে যুক্ত হল শনিবার। শনি মঙ্গলবারও নাকি অশুভ। রাতটাও কৃষ্ণপক্ষের। জন্মমুহূর্তে দপ করে হারিকেন নিভে গেল। ঘরে রাখা গামলার পানি উলটে গেল। একজন ডাক্তার, যিনি গত তিনদিন ধরে মার সঙ্গে আছেন, তিনি টর্চলাইট জ্বেলে তার আলো ফেললেন আমার মুখে। ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, এই জানোয়ারটা দেখি তার মাকে মেরেই ফেলছিল!

আমি তখন গভীর বিস্ময়ে টর্চলাইটের ধাঁধানো আলোর দিকে তাকিয়ে আছি। চোখ বড় বড় করে দেখছি-এসব কী? অন্ধকার থেকে এ আমি কোথায় এলাম?

জন্মের পরপর কাঁদতে হয়। তাই নিয়ম।

চারপাশের রহস্যময় জগৎ দেখে কাঁদতেও ভুলে গেছি। ডাক্তার সাহেব আমাকে কাঁদাবার জন্য ঠাশ করে গালে চড় বসালেন। আমি জন্মমুহূর্তেই মানুষের হৃদয়হীনতার পরিচয় পেয়ে আকাশ ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলাম। ঘরে উপস্থিত আমার নানিজান আনন্দিত স্বরে বললেন, বামুন রাশির ছেলে। বামুন রাশি বলার অর্থ প্রেসেন্টার সঙ্গে যুক্ত রক্তবাহী শিরাটি বামুনের পৈতার মতো আমার গলা পেঁচিয়ে আছে।

শিশুর কান্নার শব্দ আমার নানাজানের কানে যাওয়ামাত্র তিনি ছুটে এসে বললেন, ছেলে না মেয়ে?

ডাক্তার সাহেব রহস্য করবার জন্যে বললেন, মেয়ে, মেয়ে। ফুটফুটে মেয়ে।

নানাজান তৎক্ষণাৎ আধমণ মিষ্টি কিনতে লোক পাঠালেন। যখন জানলেন মেয়ে নয় ছেলে-তখন আবার লোক পাঠালেন-আধমণ নয়, এবার মিষ্টি আসবে একমণ। এই সমাজে পুরুষ এবং নারীর অবস্থান যে ভিন্ন তাও জন্মলগ্নেই জেনে গেলাম।

নভেম্বর মাসের দুর্দান্ত শীত।

গারো পাহাড় থেকে উড়ে আসছে অসম্ভব শীতল হাওয়া। মাটির মালশায় আগুন করে নানিজান সেক দিয়ে আমাকে গরম করার চেষ্টা করছেন।

আশেপাশের বৌ-ঝিরা একের পর এক আসছে এবং আমাকে দেখে মুগ্ধ গলায়

বলছে-সোনার পুতলা।

এতক্ষণ যা লিখলাম সবই শোনা কথা। মার কাছ থেকে শোনা। কিন্তু আমার কাছে খুব বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। কারণ আমি ঘোর কষ্ণবর্ণের মানুষ। আমাকে দেখে সোনার পুতলা বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার কিছু নেই। তা সদ জনামহুর্তের এতসব কথা আমার মারও মনে থাকার কথা নয়। তার তখন জীবন সংশয়। প্রসববেদনায় পুরো তিনদিন কাটা মুরগির মতো ছটফট করেছেন। অতিরিক্ত রকমের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। পাড়াগার মতো জায়গায় তাকে বত দেবার কোনো ব্যবস্থা নেই। এই অবস্থাতেও তিনি লক্ষ্য করছেন, তার সোনার পাতলা গভীর বিস্ময়ে চারপাশের পৃথিবীকে দেখছে, কাঁদতে ভুলে গেছে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমার ধারণা, মা যা বলেছেন তা অন্যদের কাছ থেকে শুনেই বলেছেন।

ধরে নিচ্ছি, মা যা বলেছেন সবই সত্যি। ধরে নিচ্ছি, একসময় আমার গাত্রবর্ণ কাঁচা সোনার মতো ছিল। ধরে নিচ্ছি, আমার জন্মের আনন্দপ্রকাশের জন্য সেই রাতে একমণ মিষ্টি কিনে বিতরণ করা হয়েছিল। মিষ্টি কেনার অংশটি বিশ্বাসযোগ্য। নানাজানের অর্থবিত্ত তেমন ছিল না, কিন্তু তিনি দিলদরিয়া ধরনের মানুষ ছিলেন। আমার মা ছিলেন তাঁর সবচে আদরের প্রথমা কন্যা, বিয়ে হয়ে যাবার পরও যে-কন্যার মাথার চুল তিনি নিজে পরম যত্নে আঁচড়ে দিতেন। এই অতি আদরের কন্যার বিয়ের সময়ও তিনি জমিটমি বিক্রি করে খরচের চুড়ান্ত করলেন। পিতৃহৃদয়ের মমতা প্রকাশ করলেন দুহাত খুলে টাকা খরচের মাধ্যমে।

উদাহরণ দিই—মোহনগঞ্জ স্টেশন থেকে বর আসবে, হাঁটাপথে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। পালকির ব্যবস্থা করলেই হয়। আমার নানাজান হাতির ব্যবস্থা করলেন। সুসং দুর্গাপুর থেকে দুটি হাতি আনানো হল। যে-লোেক এই কাজ করতে পারেন, তিনি তার প্রিয় কন্যার প্রথম সন্তানজন্মের খবরে বাজারের সমস্ত মিষ্টি কিনে ফেলতে পারেন।

আমার বাবা তখন সিলেটে। বিশ্বনাথ থানার ওসি।

ছেলে হবার খবর তাঁর কাছে পৌঁছল। তাঁর মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। বেচারার খুব শখ ছিল প্রথম সন্তানটি হবে মেয়ে। তিনি মেয়ের নাম ঠিক করে বসে আছেন। একগাদা মেয়েদের ফ্রক বানিয়েছেন। রূপার মল বানিয়েছেন। তার মেয়ে মল পায়ে দিয়ে ঝমঝম করে হাঁটবে—তিনি মুগ্ধ হয়ে দেখবেন। ছেলে। হওয়ায় সব পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল। তিনি একগাদা ফ্রক ও রূপার মল নিয়ে ছেলেকে দেখতে গেলেন। পাঠক-পাঠিকাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, এইসব মেয়েলি পোশাক আমাকে দীর্ঘদিন পরতে হয়। বাবাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে মা আr, মাথার চুলও লম্বা রেখে দেন। সেই বেণিকরা চুলে রংবেরঙের রিবন পতে আমার শৈশবের শুরু।

বাবা-মার প্রথম সন্তান হচ্ছে চমৎকার একটি জীবন্ত খেলনা। এই খেলনার সবই ভালো। খেলনা যখন হাসে, বাবা-মা হাসেন। খেলনা যখন কাঁদে, বাবা, মার মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। আমার বাবা-মার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হল না। তারা তাদের শিশুপুত্রের ভেতর নানান প্রতিভার লক্ষণ দেখে বারবার চমৎকৃত হলেন। হয়তো আমাকে চাবি-দেয়া একটা ঘোড়া কিনে দেয়া হল, আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া ভেঙে ফেললাম। আমার বাবা পুত্রপ্রতিভায় মুগ্ধ। হাসিমুখে বললেন, দ্যাখো দ্যাখো, ছেলের কী কৌতূহল! সে ভেতরের কলকবজা দেখতে চায়।

হয়তো আমাকে খাওয়ানোর জন্য মা থালায় করে খাবার নিয়ে গেলেন, আমি সেই থালা উড়িয়ে ফেলে দিলাম। বাবা আমার প্রতিভায় মুগ্ধ-দ্যাখো দ্যাখো, ছেলের রাগ দ্যাখো। রাগ থাকা ভালো। এই যে থালা সে উড়িয়ে ফেলে দিল এতে প্রমাণিত হল তার পছন্দ-অপছন্দ দুটিই খুব তীব্র।

এই সময় বই ছিড়ে ফেলার দিকেও আমার ঝোঁক দেখা গেল। হাতের কাছে বই পাওয়ামাত্র টেনে ছিড়ে ফেলি। এর মধ্যেও বাবা আমার প্রতিভার লক্ষণ দেখতে পেলেন। তিনি মাকে বোঝালেন-এই যে সে বই ছিড়ছে, তার কারণ বইয়ের লেখা সে পড়তে পারছে না, বুঝতে পারছে না। যে-জিনিস সে বুঝতে পারছে না সেই জিনিস সে নষ্ট করে দিচ্ছে। এটি প্রতিভার লক্ষণ।

আদরে বাঁদর হয়।

আমি পুরোপুরি বাঁদর হয়ে গেলাম। এবং আমার প্রতিটি বাঁদরামিতে প্রতিভার লক্ষণ দেখে আমার বাবা-মা বারবার চমৎকৃত হতে লাগলেন। বাবা মার সঙ্গে যুক্ত হলেন বাবার এক বন্ধু গনি সাহেব এবং তার স্ত্রী। এই নিঃসন্তান দম্পতি তাঁদের বুভুক্ষু হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা আমার জন্যে ঢেলে দিলেন। তাদের ভালোবাসার একটা ছোট্ট নমুনা দিচ্ছি। একদিন বেড়াতে এসে দেখেন। আমি চামচে করে চিনি খাচ্ছি। গনি চাচা বললেন, আরে এ তো আগ্রহ করে চিনি খাচ্ছে। চিনি খেতে পছন্দ করে তা তো জানতাম না! তিনি তৎক্ষণাৎ বের হয়ে গেলেন। ফিরে এলেন পাঁচ সের চিনি নিয়ে। মেঝেতে পাটি পেতে আমাকে বসিয়ে দিলেন। আমার চারদিকে চিনি ছড়িয়ে দেয়া হল। গনি চাচা হষ্টচিত্তে বললেন, খা ব্যাটা, কত চিনি খাবি খা।

আমাকে ঘিরে বাবা-মার আনন্দ স্থায়ী হল না। আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কালান্তক জ্বর। টাইফয়েড। তখন টাইফয়েডের অষুধ বাজারে আসেনি। রুগীকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া কিছুই করণীয় নেই। যতই দিন যেতে লাগল মার শরীর ততই কাহিল হতে থাকল। এক সময় দেখা গেল তিনি কাউকে চিনতে পারলে না। এক গভীর রাতে বাবাকে ঘুম ভাংগিয়ে অত্যন্ত অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আমার পাশে এই যে ছোট্ট ছেলেটা শুয়ে আছে এ কে?

বাবা হতভম্ব হয়ে গেলেন। মা বললেন, এই ছেলেটা এখানে কেন? এ কার ছেলে?

আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হল নানাজানের কাছে। সিলেটের বিশ্বনাথ থেকে ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জে। পিতৃমাতৃ স্নেহ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হয়ে আমার দ্বিতীয় জীবন শুরু হল। আমার নানিজান আমাকে লালনপালনের ভার গ্রহণ করলেন। তখন তাঁর একটি মেয়ে হয়েছে। তার এক কোলে সেই মেয়ে, অন্য কোলে আমি। নানিজানের বুকের দুধ খেয়ে দুজন একসঙ্গে বড় হচ্ছি।

দুমাস জ্বরে ভোগার পর মা সেরে উঠলেন কিন্তু টাইফয়েড তার প্রবল থাবা বসিয়ে গেল। মার মস্তিষ্কবিকৃতি দেখা গেল। কাউকে চেনেন না। যার সঙ্গে দেখা হয় তাকেই বলেন, কত টাকা লাগবে তোমার বলো তো! আমার কাছে অনেক টাকা আছে। যত টাকা চাইবে ততই পাবে। ফেরত দিতে হবে না।

বলেই তোশকের নিচ থেকে লক্ষ লক্ষ কাল্পনিক টাকা বের করতে শুরু করেন। মাঝে মাঝে এইসব কাল্পনিক টাকা জানালা দিয়ে উড়িয়ে দেন। চিকন স্বরে চেঁচিয়ে বলেন, টাকা নিয়ে যাও। টাকা। আমি টাকা উড়াচ্ছি। যার যত দরকার, নাও। ফেরত দিতে হবে না।

মা বিয়ের পর খুব কষ্টে পড়েছিলেন। টাকাপয়সার কষ্ট। বিশ্বনাথ থানার ওসি হিসেবে বাবার বেতন ছিল আশি টাকা। বেতনের এই আশিটি টাকা বাবা তার খামখেয়ালি স্বভাবের জন্য অতি দ্রুত বরচ করে ফেলতেন। মাসের দশ তারিখেই বাবার হাতে একটা পয়সা নেই। থানার ওসিদের টাকাপয়সার অভাব হবার কথা না। কিন্তু আজ লিখতে গিয়ে গর্ব এবং অহংকারে বুক ভরে যাচ্ছে যে আমার বাবা ছিলেন সাধু প্রকৃতির মানুষ। বেতনের টাকাই ছিল তার একমাত্র রোজগার। মার কাছে শুনেছি, পুলিশের রেশনই তাদের বাঁচিয়ে রাখত। মাসের প্রথমেই রেশন তোলা হত। রেশনে চাল, ডাল এবং তেল পাওয়া যেত। সারা মাসে তাদের খাবারের মেনু ছিল ডাল, ডালের বড়া এবং নিমপাতা ভাজা। বাসার সঙ্গে লাগোয়া একটা নিমগাছ ছিল। সেই নিমের কচি পাতা ভাজা করা হত। মাকে শাড়ি কিনে দেবার সামর্থ্য বাবার ছিল না। মার শাড়ি পাঠাতেন নানাজান। সতেরো বছরের একটি মেয়ে, যে মোটামুটি সচ্ছলতায় মানুষ হয়েছে তার জন্য এই অর্থকষ্ট বড়ই ভয়াবহ ছিল। অর্থনৈতিক পীড়ন তার উপর যে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল মানসিক বিকৃতির সময় তা-ই ফুটে বের হল। যার সঙ্গেই দেখা হয় তাকেই মা এক লাখ বা দুলাখ টাকা দিয়ে দেন।

দুবছর এমন করেই কাটল। আমি নানিজানের কাছে। মা বাবার সঙ্গে সিলেটে। পুরোপুরি পাগল একজন মানুষ।

এক শ্রাবণ মাসের রাতে মার ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। হাওয়ায় বাড়ি যেন উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির পেছনের-ঝাকড়া জামগাছে শোশে শব্দ হচ্ছে। মা বাবাকে ডেকে তুলে ভয়ার্ত স্বরে বললেন, বাতি জ্বালাও, ভয় লাগছে।

বাবা চমকে উঠলেন। দিব্যি সুস্থ মানুষের মতো কথাবার্তা।

হারিকেন জ্বালানো হল। মা তীব্র স্বরে বললেন, আমার ছেলে কোথায়?

বাবা তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মন আশা-নিরাশায় দুলছে। তা হলে কি মাথা ঠিক হয়ে গেল?

কথা বলছ না কেন? আমার ছেলে কোথায়?

আয়েশা, তোমার কি সবকিছু মনে পড়ছে।

আমার ছেলে কোথায়?

ও আছে। ও ভালো আছে, তোমার মার কাছে আছে। তুমি দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে ছিলে। তাকে পাঠিয়ে দেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তুমি শান্ত হও, কাল ভোরেই তোমাকে নিয়ে আমি মোহনগঞ্জ রওনা হব।

আমি অসুস্থ ছিলাম?

হ্যাঁ।

মা উঠে গিয়ে একটা আয়না আনলেন। আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। মাথাভরতি চুল ছিল। কোনো চুল নেই। দাঁতের রং কুচকুচে কালো। আয়নায় যার ছায়া পড়েছে সে উনিশ বছরের তরুণী নয়, যেন ষাট বছর বয়সের এক বৃদ্ধা।

আয়েশা, তোমার কি সব মনে পড়ছে।

হ্যাঁ।

বলো তো কত তারিখে আমাদের বিয়ে হয়েছিল?

আষাঢ় মাসে। পয়লা আষাঢ়।

আনন্দে বাবার চোখ ভিজে উঠল।

বাইরে ঝড়বৃষ্টির মাতামাতি। ঘরে নিবুনিবু হারিকেনের রহস্যময় আলো।

সেই আলোয় মূর্তির মতো বসে আছেন পুত্রবিরহকাতর এক মা, যিনি ততক্ষণ আগে তার হারানো স্মৃতি ফিরে পেয়েছেন।

মাকে নিয়ে মোহনগঞ্জ উপস্থিত হলেন। আমাকে মার কোলে বসিয়ে দেয়া হল। মা বিস্মিত হয়ে বললেন, এই কি আমার ছেলে?

নানিজান বললেন, হ্যাঁ।

ছেলে এত বড় কেন?

ছেলের বয়স দুই বছর, বড় হবে না?

কথা বলতে পারে?

পারে, সব কথা বলতে পারে।

মা নানিজানের দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বললেন, আমার ছেলের কোনো অনাদর হয়নি তো?

নানিজান হেসে ফেললেন।

আমার ছেলের সোনার মতো গায়ের রং ছিল। ও এত কালো হল কেন?

সারাদিন রোদে রোদে ঘোরে।

কেন, আপনারা দেখেন না? কেন আমার ছেলে সারাদিন রোদে রোদে ঘোরে।

মা যতই রাগ করেন সবাই তত হাসে।

বাড়িভরতি মানুষ। মাতা-পুত্রের মিলনদৃশ্য দেখতে পাড়া ভেঙে বৌ-ঝিরা এসেছে। আমার নানাজান আবার একমণ মিষ্টি কিনতে লোক পাঠিয়েছেন।

আসরের মধ্যমণি হয়ে আমার মা একটা জলচৌকিতে আমাকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। এই তার মুখে তৃপ্তি, এই তার চোখে জল। মেঘ ও রৌদ্রের খেলা চলছে। পৃথিবীর মধুরতম একটি দৃশ্য সবাই দেখছে মুখ হয়ে। এর মধ্যে মা সবাইকে সচকিত করে একটি ক্ষুদ্র প্রার্থনা করলেন। তিনি উচ্চস্বরে বললেন, আমার এই ছেলের শৈশব বড় কষ্টে কেটেছে, আল্লাহ, তার বাকি জীবনটা তুমি সুখে সুখে ভরে দিও। বাকি জীবনে সে যেন কোনো দুঃখ না পায়।

ঈশ্বর মার এই প্রার্থনা গ্রহণ করেননি। এই ক্ষুদ্র জীবনে আমি বারবার দুঃখ পেয়েছি। বারবার হৃদয় হা-হা করে উঠেছে। চারপাশের মানুষদের নিষ্ঠুরতা, হৃদয়হীনতায় আহত হয়ে কতবার মনে হয়েছে—এই পৃথিবী বড়ই বিষাদময়! আমি এই পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোনো পৃথিবীতে যেতে চাই, যে-পৃথিবীতে মানুষ নেই। চারপাশে পত্ৰপুষ্পশোভিত বৃক্ষরাজি। আকাশে চিরপূর্ণিমার চাঁদ, যে-চাদের ছায়া পড়েছে ময়ূরাক্ষী নামের এক নদীতে। সেই নদীর স্বচ্ছ জলে সারাক্ষণ খেলা করে জোছনার ফুল। দূরের বন থেকে ভেসে আসে অপার্থিব সংগীত।

মা আমাকে নিয়ে সিলেটে চলে এলেন। কিছুদিন তার নিশ্চয়ই খুব সুখে কাটল। কোনো সুখই স্থায়ী হয় না। এই সুখও স্থায়ী হল না, আবার টাইফয়েড হল। টাইফয়েডের বীজ হয়তো লুকিয়ে ছিল। প্রাণসংহারক মূর্তিতে সে আবার আত্মপ্রকাশ করল। বাবা দিশাহারা হয়ে পড়লেন। মা সারাদিন প্রবল জুরের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরে এলে ব্যাকুল হয়ে তার শিশুপুত্রকে খোঁজেন। সেই শিশুকে তার কাছে যেতে দেয়া হয় না। মা কাকুতি মিনতি করেন, ওকে একটু দেখতে দাও। একবার শুধু দেখব।

কাজের মেয়ে আমাকে নিয়ে দরজার পাশে এসে দাঁড়ায়। মা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন। গভীর বিষাদ এবং গভীর আনন্দে তার চোখে জল আসে।

এর মধ্যেই একদিন ডাক্তার সাহেব বাবাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, আপনার স্ত্রী বাঁচবেন না। আপনি মানসিকভাবে এর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করুন।

বাবা বললেন, কোনো আশাই কি নেই?

না। টাইফয়েড দ্বিতীয়বার হলে আর রক্ষা নেই, তবে …

তবে কী?

টাইফয়েডের নতুন একটা অষুধ বাজারে এসেছে। শুনেছি অষুধটা কাজ করে। ইন্ডিয়াতে হয়তোবা পাওয়া যায়। আপনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

আসামের শিলচরে বাবা লোক পাঠালেন। অষুধ পাওয়া গেল না। বাবা স্ত্রীর মৃত্যুর জন্যে মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। সেই প্রস্তুতির প্রমাণ হচ্ছে আমার নামকরণ। আমার নাম রাখলেন কাজল। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীর অপুর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছিল। অপুর ছেলের নাম ছিল কাজল। আমার ভালো নাম রাখা হল শামসুর রহমান। বাবার নাম ফয়জুর রহমান। বাবার নামের সঙ্গে মিলিয়ে ছেলের নাম। ছয় বছর বয়স পর্যন্ত আমাকে শামসুর রহমান নাম নিয়ে চলাফেরা করতে হল। সপ্তম বছরে বাবা হঠাৎ সেই নাম বদলে রাখলেন হুমায়ূন আহমেদ। বছর দুই হুমায়ূন আহমেদ নামে চলার পর আবার আমার নাম বদলে দেবার ব্যবস্থা হল। আমি কঠিন আপত্তি জানালাম। বারবার নাম বদলানো চলবে না। আমাদের সব ভাইবোনই প্রথম ছসাত বছর এক নাম, তারপর অন্য নাম। আমার বাবার মৃত্যুর পর তাঁর পেনশন এবং গ্যাচুইটির টাকাপয়সা তুলতে গিয়ে বিরাট যন্ত্রণায় পড়লাম। দেখা গেল, তিনি তার টাকাপয়সা তাঁর স্ত্রী এবং তিন ছেলেমেয়েকে দিয়ে গেছেন। কিন্তু তিন ছেলেমেয়ের যে নাম লিখে রেখে গেছেন, এখন কারওরই সেই নাম নেই। বাবা তার ছেলেমেয়ের নাম বদলেছেন। কিন্তু কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে ভুলে গেছেন।

আমি এখন আমার বিচিত্র বাবা সম্পর্কে বলব। মৃত্যুপথযাত্রী মার প্রসঙ্গটা আপাতত থাক। শুধু এইটুকু বলে রাখি, তিনি দ্বিতীয়বার টাইফয়েডের ধাক্কাও সামলে ওঠেন জনৈক হিন্দু সাধুবাবার দেয়া তাৰ্পিন তেল খেয়ে। নিতান্তই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তাৰ্পিন টাইফয়েডের অষুধ নয়। নিশ্চয়ই অন্য কোনো ব্যাপার আছে। আমি যা শুনেছি তা-ই লিখলাম। সাধুবাবার ফুঁ-দেয়া তার্পিন খেয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে কেউ ফিরে আসবে এই তথ্য হজম করা আমার পক্ষে বেশ কঠিন। যেহেতু মা দাবি করছেন, সেহেতু লিখছি।

এবার বাবার কথা বলি।

হোটেল গ্রেভার ইন

হোটেল গ্রেভার ইন

এলেম নতুন দেশে। লরা ইঙ্গেলস ওয়াইল্ডারের প্রেইরি ভূমি, ডাকোটা রাজ্য। ভোর চারটায় পৌঁছলাম, বাইরে অন্ধকার, সূর্য এখনো ওঠেনি, হেক্টর এয়ারপোর্টর খোলামাঠে হু-হু করে হাওয়া বইছে। শীতে গা কাপছে। যদিও শীত লাগার কথা নয়। এখন হচ্ছে–ফল, শীত আসতে দেরি আছে।

আমার মন খুব খারাপ।

দেশ ছেড়ে দীর্ঘদিনের জন্যে বাইরে যাবার উৎসাহ আমি কখনো বোধ করিনি। বর্ষাকালে বৃষ্টির শব্দ শুনবো না, ব্যাঙের ডাক শুনবো না চৈত্র মাসের রাতে খোলা ছাদে পাটি পেতে বসবো না, শীতের দিনে গ্রামের বাড়িতে আগুনের কাছে হাত মেলে থরবো না, এটা হতে পারে না।

অনেকের পায়ের নিচে সর্ষে তাকে। তারা বেড়াতে ভালোবাসেন। বিদেশের নামে তাদের রক্তে বাজনা বেজে ওঠে। আমার কাছে ভ্রমণের চেয়ে ভ্রমণকাহিনী ভালো লাগে। একটা বই হাতে, নিজের ঘরে নিজের চেনা জায়গাটায় বসে থাকবো, পাশে থাকবে চায়ের পেয়ালা, অথচ আমি লেখকের সঙ্গে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। লেখক হয়তো সুন্দর একটা হ্রদের বর্ণনা দিচ্ছেন, আমি কল্পনায় সেই হ্রদ দেখছি। সেই হ্রদের জল নীল। জলে মেঘের ছায়া পড়েছে। আমার কল্পনাশক্তি ভালো। লেখক তার চোখে যা দেখছেন আমি আমার কল্পনার চোখে তার চেয়ে ভালো দেখতে পাচ্ছি। কাজেই কষ্ট করে যাযাবরের মতো দেশ-বিদেশ দেখার প্রয়োজন কি?

প্রেইরি ভূমি সম্পর্কে আমি ভালো জানি। লরা ইঙ্গেলস-এর প্রতিটি বই আমার অনেকবার করে পড়া। নিজের চোখে এই দেশ দেখার কোন আগ্রহ আমার নেই। আমি এসেছি পড়াশোনা করতে। নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিস্ট্রির মতো রসকষহীন একটি বিষয়ে পি-এইচ-ডি ডিগ্রি নিতে হবে। কতো দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী কেটে যাবে। ল্যাবরেটরিতে, পাঠ্য বইয়ের গোলকধাঁধায়। মনে হলেই হৃৎপিণ্ডের টিটি খানিকটা হলেও শ্লথ হয়ে যায়। হেক্টর এয়ারপোর্টের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ার মত বুকের ভেতরটাও হু-হু করে।

মন খারাপ হবার আমার আরেকটি বড় কারণও আছে। দেশে সতেরো বছর বয়সী আমার স্ত্রীকে ফেলে এসেছি। তার শরীরে আমাদের প্রথম সন্তান। ভালোবাসাবাসির প্রথম পুষ্প। ঢাকা এয়ারপোর্টে আরো অনেকের সঙ্গে সে-ও এসেছিল। সারাক্ষণই সে একটু দূরে-দূরে সরে রইলো। এই বয়সেই সন্তান ধারণের লজ্জায় সে ম্রিয়মাণ। কালো একটা চাদরে শরীরটা ঢেকেঢুকে রাখার চেষ্টাতেই তার সময় কেটে যাচ্ছে। বিদায়ের আগমুহূর্তে সে বললো, আমাদের প্রথম বাচ্চার জন্মের সময় তুমি পাশে থাকবে না?

আমার চোখে প্রায় পানি এসে যাবার মতো অবস্থা হলো। ইচ্ছে করলো টিকিট এবং পাসপোর্ট ছুঁড়ে ফেলে তার হাত ধরে বলি–চলো, বাসায় যাই।

অল্প কিছুদিন আমাদের আয়ু। এই অল্পদিনের জন্যে আমাদের মতো আয়োজন–পাস, ডিগ্রি, চাকরি, প্রমোশন, টাকা-পয়সা, বাড়িঘর–কোনো মানে হয়? কোনোই মানে হয় না।

আমার মনের অবস্থা সে টের পেলো। মুহূর্তের মধ্যে কথা ঘুরিয়ে বললো, যদি ছেলে হয় নাম রাখবো আমি। আর যদি মেয়ে হয় নাম রাখবে তুমি। কেমন?

প্লেনে আসতে-আসতে সারাক্ষণ আমি আমার মেয়ের নাম ভেবেছি। কতো লক্ষ লক্ষ নাম পৃথিবীতে, কিন্তু কোনোটিই আমার মনে ধরছে না। কোনোটিই যেন মায়ের গর্ভে ঘুমিয়ে থাকা রাজকন্যার উপযুক্ত নাম নয়। এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নামটি আমাকে আমার মেয়ের জন্য খুঁজে বের করতে হবে। আজ থেকে আঠারো, উনিশ বা কুড়ি বছর পর কোনো-এক প্রেমিক পুরুষ এই নামে আমার মেয়েকে ডাকবে। ভালোবাসার কতো না গল্প সে করবে? হেক্টর এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে এইসব ভাবছি। চীষ্কার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। পৃথিবীটা এমন যে বেশির ভাগ ইচ্ছাই কাজে খাটানো যায় না। আমি বসে বসে ভোর হবার জন্যে অপেক্ষা করছি। এতো ভোরে কেউ আমাকে নিতে আসবে এরকম মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রতিবছর হাজার খানিক বিদেশী ছাত্র নর্থডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করতে আসে। কার এতে গরজ পড়েছে এদের এয়ারপোর্ট থেকে খাতির করে ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে যাওয়ার?

তুমি কি বাংলাদেশের ছাত্র-আহামাদ? আমি চমকে তাকালাম। পঁচিশ-ত্রিশ বছরের যে মহিলা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তার দিকে বেশিক্ষণ তাকানো যায় না। চোখ ঝলসে যায়। অপূর্ব রূপবতী। যে পোশাক তার গায়ে তার উদ্দেশ্য সম্ভবত শরীরের সুন্দর অংশগুলোর দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। আমি জবাব দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। ভদ্রমহিলা আবার বললেন–তুমি কি বাংলাদেশের ছাত্র আহামাদ?

আমি হ্যাঁ-সুচক মাথা নাড়লাম।

আমার নাম টয়লা ক্লেইন। আমি হচ্ছি নর্থডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির ফরেন স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজার। আমি খুবই লজ্জিত যে দেরি করে ফেলেছি। চলো, রওনা হওয়া যাক। তোমার সঙ্গে সব জিনিসপত্র কি এই?

ইয়েস।

আমার সব জবাব এক শব্দে, ইয়েস এবং নো-র মধ্যে সীমাবদ্ধ। ইংরেজিতে একটা পুরো বাক্য বলার মতো সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে একটা পুরো বাক্য বলেই এই ভদ্রমহিলা হা হা করে হেসে উঠবেন।

আহামাদ, তুমি কি রওনা হবার আগে এক কাপ কফি খাবে? বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। হঠাৎ কেন জানি ঠাণ্ডা পড়ে গেছে। কফি আনাবো?

না।

আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি পূর্বদেশীয় ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো কিছু খাবার কথা বললেই তারা প্রথমে বলে না। অথচ তাদের খাবার ইচ্ছা আছে। আমি শুনেছি ‘না’ বলাটা তাদের ভদ্রতার একটা অংশ। কাজেই আমি আবার তোমাকে জিজ্ঞেস করছি–তুমি কি কফি খেতে চাও?

চাই।

ভদ্রমহিলা কাগজের গ্লাসে দুকাপ কফি নিয়ে এলেন। এর চেয়ে কুৎসিত কোনো পানীয় আমি এই জীবনে খাইনি। কষা তিতকুটে একটা জিনিস। নাড়ীভূঁড়ি উল্টে আসার জোগাড়। দ্রমহিলা বললেন, হট কফি ভালো লাগছে না? আমি মুখ বিকৃত করে বললাম, খুব ভালো।

টয়লা ক্লেইন হেসে ফেলে বললেন, আহামাদ তোমাকে আমি একটা উপদেশ দিচ্ছি। আমেরিকায় পূর্বদেশীয় দ্রতা অচল। এদেশে সব কিছু তুমি সরাসরি বলবে। কফি ভালো লাগলে বলবে–ভালো। খারাপ লাগলে কফির কাপ ‘ইয়াক বলে ছুঁড়ে ফেলবে ডাস্টবিনে।

আমি ইয়া বলে একটা শব্দ করে ডাস্টবিনে কফির কাপ ছুঁড়ে ফেললাম। এই হচ্ছে আমেরিকায় আমেরিকানদের মতো আমার প্রথম আচরণ।

টয়া ক্লেইনের গাঢ় লাল রঙের গাড়ি ডাউনটাউন ফারেগের দিকে যাচ্ছে। আমি ঝিম ধরে পেছনের সিটে বসে আছি। আশেপাশের দৃশ্য আমাকে মোটেই টানছে না। টয়লা ক্লেইন একটা ছোটখাট বক্তৃতা দিলেন। প্রতিটি শব্দ খুব স্পষ্ট করে বললেন। তাতে বুঝতে আমার তেমন কোনো অসুবিধা হলো না। আমেরিকানদের ইংরেজি বোঝা যায়। ব্রিটিশদেরটা বোঝা যায় না। ব্রিটিশরা

অনেক কথা বলে, অর্ধেক পেটে রেখে দেয় বলে তা-ও বলার আগে মুখে খানিকক্ষণ রেখে গার্গল করে বলে আমার ধারণা।

আহামাদ, তোমাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি ‘হোটেল গ্রেভার ইনে’। হোটেল গ্রেভার ইন পুরোদস্তুর একটা হোটেল। তবে হোটেলের মালিক গত বছর এই হোটেল স্টেট ইউনিভার্সিটিকে দান করে দিয়েছেন। বর্তমানে ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা হোটেলটা চালাচ্ছে। অনেক গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট এই হোটেলে থেকেই পড়াশোনা করে। তুমিও ইচ্ছা করলে তা করতে পারো। হোটেলের সব সুযোগ সুবিধা এখানে আছে। বার আছে, বল রুম আছে, সাওয়ানা আছে। একটাই অসুবিধা, হোটেলটা ইউনিভার্সিটি থেকে দশ কিলোমিটার দূরে। তোমাকে বাসে যাতায়াত করতে হবে। এটা কোনো সমস্যা হবে না, হোটেল থেকে দু’ঘণ্টা পর পর ইউনিভার্সিটির বাস যায়। আমি কি বলছি বুঝতে পারছো তো?

পারছি।

তুমি এসেছো একটা অড় টাইমে, স্প্রিং কোয়াটার শুরু হতে এখনো এগীরো দিনের মতো বাকি। সামারের ছুটি চলছে। এই কদিন বিশ্রাম নাও। নতুন দেশের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতেও কিছু সময় লাগে। তাই না?

ইয়েস।

টয়লা ক্লেইন হেসে বলেন–ইয়েস এবং নো–এই দুটি শব্দ ছাড়াও তোমাকে আরো কিছু শব্দ শিখতে হবে। দুটি শব্দ সম্বল করে কথাবার্তা চালানো বেশ কঠিন।

তিনি আমাকে হোটেলের রিসিপশনে নিয়ে অতিদ্রুত কি সব বলতে লাগলেন ডেস্কে বসে থাকা পাথরের মতো মুখের মেয়েটিকে। সেইসব কথার এক বর্ণও আমি বুঝলাম না। বোঝার চেষ্টাও করলাম না। আমি তখন একটা দীর্ঘ বাক্য ইংরেজিতে তৈরি করার কাজে ব্যস্ত। বাক্যটা বাংলায় এ রকম–মিসেস টয়লা ক্লেইন, আপনি যে এই ভোররাতে আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে আনার জন্য নিজে গিয়েছেন এবং নিজে হোটেলে পৌঁছে দিয়েছেন তার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি আপনার প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ বোধ করছি।

বাক্যটা মনে মনে যখন প্রায় গুছিয়ে এনেছি তখন টয়লা ক্লেইন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাই। বলেই ছুটে বেরিয়ে গেলেন। আমার আর ধন্যবাদ দেয়া হলো না। এই মহিলার আচার-ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছিল উনি একজন অত্যন্ত কর্মঠ, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন হাসিখুশি ধরনের মহিলা। পরে জানলাম ইনি একজন খুবই ইনএফিসিয়েন্ট মহিলা। তার অকর্মণ্যতা ও অযোগ্যতার জন্যে পরের বছরই তার চাকরি চলে যায়।

হোটেল গ্রেভার ইনে আমার জীবন শুরু হলো।

তিনতলা একটা হোটেল। পুরোনো ধরনের বিল্ডিং। এর সবই পুরোনো, কার্পেট পুরোনা, ঘরের বাতাসে পর্যন্ত একশ’ বছর আগের গন্ধ। আমেরিকানরা ট্রাডিশনের খুব ভক্ত এটা বলা ঠিক হবে না। তবে ডাকোটা কান্ট্রির অনেক জায়গাতেই দেখেছি ওয়াইল্ড ওয়েস্ট ধরে রাখার একটা চেষ্টা। পুরোনো হোটেলগুলোকে পুরোনো করেই রাখা হয়েছে। দেয়ালে বাইসনের বড় বড় শিং। যত্ন করে ঝুলানো আগের আমলের পাইপ গান, বারুদের থলে। মেঝেতে বিছানো ভারী কার্পেটের রঙ বিবর্ণ। আমেরিকানরা হয়তো বা এসব দেখে নস্টালজিক হয়। আমি হলাম বিরক্ত। কোথায় এরা আমাকে এনে তুললো?

আমার ঘরটা দোতলায়। বিরাট ঘর। দুটো খাট পাশাপাশি বিছানো। ঘরে আসবাবপত্র কোনোটাই আমার মন কাড়লো না। তবে দেয়ালজোড়া পুরোনো কালের আয়নাটা অপূর্ব। যেন বাংলাদেশের দিঘির কালো জলকে জমিয়ে আয়না বানিয়ে দেয়ালে সাজিয়ে রেখেছে। এ রকম চমৎকার আয়না এ যুগে তৈরি হয় কিনা আমি জানি না।

আমার পাশের ঘরে থাকেন নব্বই বা এক শ’ বছরের একজন বুড়ি। এই হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাড়াও বাইরের গেস্টরা ভাড়া দিয়ে থাকতে পারেন। লক্ষ করলাম গেস্টদের প্রায় সবাই বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা শ্রেণীর। পরে জেনেছি, এদের অনেকেই জীবনের শেষের দিকে বছরের পর বছর হোটেলে কাটিয়ে দেন। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্যে নির্মিত ওল্ডহোমগুলো তাদের পছন্দ নয়। ওল্ড হোমগুলোতে তাঁরা হসপিটাল হসপিটাল গন্ধ পান। লোকজনও ওল্ট হাউসগুলোকে দেখে করুণার চোখে, এর চেয়ে হোটেলই ভালো।

পাশের ঘরের বৃদ্ধার নাম মনে পড়ছে না–সুসিন বা সুজি জাতীয় কিছু হবে। দেখতে অবিকল পথের পাঁচালির সত্যজিতের ছবির ইন্দিরা ঠাকরুণের মতো। মাথার চুল সেই রকম ছোটছোট করে কাটা, বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীর। শুধু পরনে শতছিন্ন শাড়ির বদলে স্কার্ট, ঠোঁটে লিপস্টিক। এই বৃদ্ধা, হোটেলে ঢোকার এক ঘণ্টার মধ্যে আমার দরজায় নক করলেন। দরজা খোলামাত্র বললেন, সুপ্রভাত। তোমার কাছে কি ভারতীয় মুদ্রা আছে?

না।

স্ট্যাম্প আছে?

না, তা-ও নেই।

ও আচ্ছা। আমি মুদ্রা এবং স্ট্যাম্প দুটাই জমাই। এটা আমার হবি।

বৃদ্ধা বিমর্যমুখে চলে গেলেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এই মহিলা জীবনের শেষ কটি দিন স্ট্যাম্প বা মুদ্রা জমিয়ে যাচ্ছেন কেন বুঝতে পারলাম না। অন্য কোনো সঞ্চয় কি তার জীবনে নেই? বৃদ্ধা চলে যাবার পর পরই হোটেলের লন্ড্রির লোক ঢুকলো। কালো আমেরিকান। এর নাম জর্জ ওয়াশিংটন। নিগ্রোদের মধ্যে আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের নাম অনুসারে নাম রাখার একটা প্রবণতা আছে। এই জর্জ ওয়াশিংটন সম্ভবত আমার গায়ের কৃষ্ণবর্ণের কারণে আমার প্রতি শুরুতেই গভীর মমতা দেখাতে শুরু করলো। গম্ভীর মুখে বললো, প্রথম এসেছো আমেরিকায়?

হ্যাঁ।

পড়াশোনার জন্যে?

হ্যাঁ।

নিজেদের দেশে পড়াশোনা হয় না যে এই পচা জায়গায় আসতে হয়?

আমি নিশ্রুপ। সে গলা নামিয়ে বলল, বুড়িগুলোর কাছ থেকে সাবধানে থাকবে, এরা বড় বিরক্ত করে। মোটেই পাত্তা দেবে না।

ঠিক আছে।

মদ্যপান করো?

না।

মাঝে-মধ্যে করতে পারো, এতে দোষের কিছু নেই। তবে মেয়েদের সঙ্গে মেশার ব্যাপারে সাবধান থাকবে। হুকার (বেশ্যা)-দের নিয়ে বিছানায় যাবে না। অসুখ-বিসুখ হবে। তাছাড়া হুকারদের বেশিরভাগই হচ্ছে চোর, টাকা-পয়সা, ঘড়ি এইসব নিয়ে পালিয়ে যাবে। হুকার কি করে চিনতে হয় আমি তোমাকে শিখিয়ে দেবো।

আচ্ছা।

খাওয়া-দাওয়া কোথায় করবে? হোটেলে?

হুঁ।

খবরদার, এই হোটেলের রেস্টুরেন্টে খাবে না। রান্না কুৎসিত, দামও বেশি। দুই ব্লক পরে একটা হোটেল আছে নাম–বিফ এন্ড বান।

বিফ এন্ড বান?

হ্যাঁ। ঐখানে খাবার ভালো, দামেও সস্তা।

তোমাকে ধন্যবাদ।

ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই। বিয়ে করেছো?

হ্যাঁ।

বউয়ের ছবি আছে?

আছে।

দেখাও।

আমি ছবি বের করে দেখালাম। জর্জ ওয়াশিংটন নানা ভঙ্গিতে ছবি দেখে বলল–অপূর্ব সুন্দরী। তুমি অতি ভাগ্যবান।

আমেরিকানদের অনেক কুৎসিত অভ্যাসের পাশে-পাশে অনেক সুন্দর অভ্যাসও আছে। যার একটি হচ্ছে, ছবি দেখে মুগ্ধ হবার ভান করা। আমি লক্ষ করেছি, অতিসামান্য পরিচয়েও এরা বলে–ফ্যামিলি ছবি সঙ্গে আছে? দেখি কেমন?

ছবিতে যদি তাড়কা রাক্ষসীর মতো কোনো দাঁত বের করা মহিলাও থাকে, এরা বলবে, অপূর্ব। তুমি ভাগ্যবান পুরুষ, লাকি ভগ।

এরা মানিব্যাগে ক্রেডিট কার্ডের পাশে নিজের স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের ছবি রাখে। এর কোনো ব্যতিক্রম পাওয়া যাবে না বলেই আমার ধারণা। অবশ্যি স্ত্রী বদলাবার সঙ্গে সঙ্গে ছবিও বদলায়। নতুন স্ত্রীকে দিনের মধ্যে একশবার মধুর কণ্ঠে হানি ডাকে। সেই হানি এক সময় হেমলক হয়ে যায়, তখন খোঁজ পড়ে নতুন কোনো হানির। মানিব্যাগে আর ছবি বদল হয়।

জর্জ ওয়াশিংটন চলে গেল। আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত একা-একা নিজের ঘরে বসে রইলাম। কিছুই ভালো লাগে না। ঘরে চিঠি লেখার কাগজপত্র আছে। চিঠি লিখতে ইচ্ছে করলো না। সঙ্গে একটিমাত্র বাংলা বই–রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ। ভেবেছিলাম একাকীত্বের জীবন গল্পগুলো পড়তে ভালো লাগবে। আমার প্রিয় গল্পের একটি পড়তে চেষ্টা করলাম–

… সুরবালার সঙ্গে একত্রে পাঠশালায় গিয়াছি এবং বউ বউ খেলিয়াছি। তাহাদের বাড়িতে গেলে সুরবালার মা আমাকে বড় যত্ন করিতেন এবং আমাদের দুইজনকে একত্র করিয়া আপনা আপনি বলাবলি করিতেন, আহা দুটিতে বেশ মানায়…।

আমার এতো প্রিয় গল্প অথচ পড়তে ভালো লাগলো না, ইচ্ছে হলো হোটেলের জানালা খুলে নিচে লাফিয়ে পড়ি।

রাতে খেতে গেলাম ‘বিফ এন্ড বান রেস্টুরেন্টে। আলো ঝলমল ছোটখাট একটা রেস্টুরেন্ট বিমানবালাদের মতো পোশাকের তিনটি ফুটফুটে তরুণী খাবার দিচ্ছে। অর্ডার নিচ্ছে। মাঝে-মাঝে রসিকতা করছে। এদের চেহারা যেমন সুন্দর কথাবার্তাও তেমনি মিষ্টি। আমেরিকান সুন্দরীরা কেমন তা দেখতে হলে এদের বার রেস্টুরেন্টে উঁকি দিয়ে ওয়েট্রেসদের দেখতে হয়।

আমি কোণার দিকের একটা টেবিলে বসলাম। আমার পকেটে আছে মাত্র পনেরো ডলার। উনিশশেী বাহাত্তর সালের কথা, তখন দেশের বাইরে কুড়ি ডলারের বেশি নেয়া যেতো না। আমি কুড়ি ডলার নিয়েই বের হয়েছিলাম। পথে লোভে পড়ে এক কার্টুন মার্লবোরো সিগারেট কিনে ফেলায় ডলারের সঞ্চয় কমে গেছে। মেনু দেখে আঁতকে উঠলাম। সব খাবারের দাম আট ডলার নয় ডলার। স্টেক জাতীয় খাবারগুলোর দাম আরো বেশি। বেছে-বেছে সবচেয়ে কমদামী একটা খাবারের অর্ডার দিলাম–ফ্রেঞ্চ টোস্ট। দামে সস্তা, তাছাড়া চেনা খাবার। ওয়েট্রেস অবাক হয়ে বলল, এটাই কি তোমার ডিনার? আমি বললাম, ইয়েস।

সঙ্গে আর কিছু নেবে না? কোল্ড ড্রিংক কিংবা কফি?

নো।

রাতের খাবার শেষ করে একা-একা হোটেলের লাউঞ্জে বসে রইলাম। লাউঞ্জ প্রায় ফাঁকা। এক কোণায় দুইজন বুড়োবুড়ি ঝিম মেরে বসে আছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে জীবনের বাকি দিনগুলো কী করে কাটাবে এরা এই নিয়েই চিন্তিত। ওদের চেয়ে আমি নিজেকে আলাদা করতে পারলাম না।

পাশের ঘরেই হোটেলের বার। সেখানে উদ্দাম গান হচ্ছে। খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে নারী-পুরুষ জড়াজড়ি করে নাচছে। গানের কথাগুলো পরিষ্কার নয়। একটি চরণ বার বার ফিরে ফিরে আসছে–Whom do you want to love yea? Yea শব্দটির মানে কি কে জানে?

রাতে ঘুম এল না ভয়ে–ভুতের ভয়।

এই ভূতের ভয়ের মুল কারণ, আমার ঘরে রাখা হোটেল গ্রেভার ইন সম্পর্কে একটি তথ্য-পুস্তিকা। সেখানে আছে, এই পাথরের হোটেলটি কে প্রথম বানিয়েছিলেন সেই সম্পর্কে তথ্য। বিখ্যাত ব্যক্তি কারা-কারা এই হোটেলে ছিলেন তাঁদের নাম-ধাম। সেই সব বিখ্যাত ব্যক্তির কাউকেই চিনতে পারলাম না, তবে এই হোটেলে একটি ভৌতিক কক্ষ আছে জেনে আঁতকে উঠলাম। রুম নম্বর ৩০৯-এ একজন অশরীরী মানুষ থাকেন বলে একশ বছরের জনশ্রুতি আছে। যিনি এখানে বাস করেন তার নাম জন পাউল। পেশায় আইনজীবী ছিলেন। এই হোটেলেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর হোটেলের মায়া কাটাতে পারেননি। পুস্তিকায় লেখা এই বিদেহী আত্মা অত্যন্ত শান্ত ও ভদ্র স্বভাবের। কাউকে কিছুই বলেন না। গভীর রাতে পাইপ হাতে হোটেলের বারান্দা দিয়ে হেঁটে বেড়ান।

হোটেলের তিনশ নয় নম্বর কক্ষটিতে কোনো অতিথি রাখা হয় না। বছরের পর বছর এটা খালি থাকে, তবে রোজ পরিস্কার করা হয়। বিছানার চাদর বদলে দেয়া হয়। বাথরুমে নতুন সাবান, টুথপেস্ট দেয়া হয়। ঘরের সামনে একটা সাইন বোর্ড আছে, সেখানে লেখা–’মি, জন পাউলের ঘর। নীরবতা পালন করুন। জন পাউল নীরবতা পছন্দ করেন।‘

পুরো ব্যাপারটা একধরনের রসিকতা কিংবা আমেরিকানদের ব্যবসা কৌশলের একটা অংশ, তবু রাত যতই বাড়তে লাগলো মনে হতে লাগলো এই বুঝি জন পাউল এসে আমার দরজায় দাঁড়িয়ে বলবেন–তোমার কাছে কি আগুন আছে? আমার পাইপের আগুন নিভে গেছে।

এমনিতেই ভয়ে কাঠ হয়ে আছি, তার উপর পাশের ঘরের বৃদ্ধা বিচিত্র সব শব্দ করছেন এই খকখক করে কাশছেন, এই চেয়ার ধরে টানাটানি করছেন, গানের সিকি অংশ শুনছেন, দরজা খুলে বেরুচ্ছেন আবার ঢুকছেন। শেষ রাতের দিকে মনে হলো দেশ-গাঁয়ের মেয়েদের মতো সুর করে বিলাপ শুরু করেছেন।

নিঃসঙ্গ মানুষদের অনেক ধরনের কষ্ট থাকে।

পুরোপুরি না ঘুমিয়ে কেউ রাত কাটাতে পারে না। শেষ রাতের দিকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ঘুম আসে। কিন্তু আমার এল না। পুরো রাত চেয়ারে বসে কাটিয়ে দিলাম। ভোরবেলা আমার ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল টেলিফোন করলো ওয়াশিংটন সিয়াটল থেকে। সে আমার আগে এদেশে এসেছে। পি-এইচ ডি করছে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে। পরিষ্কার লজিকের ঠাণ্ডা মাথায় একটা ছেলে। ভাবালুতা কিংবা অস্থিরতার কিছুই তার মধ্যে নেই। জটিল বিষয় নিয়ে গবেষণার ফাঁকে-ফাঁকে সে অসম্ভব সুন্দর কিছু লেখা লিখে ফেলেছে–কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ, দীপু নাম্বার টু, হাত কাটা রবীন। প্রসঙ্গের বাইরে চলে যাচ্ছি, তবু বলার লোভ সামলাতে পারছি না। জাফর ইকবালের লেখা পড়লে ঈর্ষার সূক্ষ্ম খোঁচা অনুভব করি। এই ক্ষমতাবান প্রবাসী লেখক দেশে তার যোগ্য সম্মান পেলেন না, এই দুঃখ আমার কোনোদিন যাবে না।

মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ইকবাল টেলিফোন করে খাস ময়মনসিংহের উচ্চারণে বললো–দাদাভাই কেমন আছো?

আমি বললাম, তুই আমার টেলিফোন নাম্বার কোথায় পেলি?

আমেরিকায় টেলিফোন নাম্বার পাওয়া কোনো সমস্যা না। তুমি কেমন আছো বল?

তোর কাছে ডলার আছে?

তোমাকে একশ ডলারের একটা ড্রাফট পাঠিয়ে দিয়েছি। আজই পাবে।

একশ ডলারে হবে না। তুই আমাকে একটা টিকিট কেটে দে আমি দেশে tলে যাবে।

আমার কথায় সে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। সহজ গলায় বললো, যেতে চাও কোনো অসুবিধা নেই টিকিট কেটে দেবো। কয়েকটা দিন যাক। একটু ঘুরে ফিরে দেখো। এখানে বাংলাদেশী ছেলে নেই?

বাংলাদেশেী ছেলে আমার কোনো দরকার নেই। তুই টিকিট কেটে পাঠা।

আচ্ছা পাঠাবে। তুমি কি পৌঁছার সংবাদ দেশে দিয়েছো? ভাবীকে চিঠি লিখেছো?

চিঠি লেখার দরকার কি আমি নিজেই তো যাচ্ছি।

তা ঠিক। তবু লিখে দাও। যেতে-যেতেও তো সময় লাগবে। আজই লিখে ফ্যালো। আর শোনো, তোমার যে খুব খারাপ লাগছে দেশে চলে যেতে চাচ্ছো এইসব না লিখলেই ভালো হয়।

আমি চুপ করে রইলাম। ইকবাল বললো, রাতে তোমাকে আবার টেলিফোন করবো। আর আমি তোমাদের ফরেন স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজারকেও ফোন করে বলে দিচ্ছি যাতে তিনি বাংলাদেশী ছেলেদের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ করিয়ে দেন।

সেই সময় ফার্গো শহরে আর একজন মাত্র বাঙালি ছিলেন–সুফী সাহেব। তিনি এসেছেন এগ্রোনমিতে পি-এইচ-ড়ি করতে। তার সঙ্গে আমার কোনো রকম যোগাযোগ হলো না। দিনের বেলাটা ইউনিভার্সিটিতে খানিকক্ষণ ঘুরলাম। চারদিকে বড় বেশি ঝকঝকে, তকতকে। বড় বেশি গোছানো। বিশ্ববিদ্যালয় সামারের বন্ধ থাকলেও কিছু কিছু ক্লাস হচ্ছে। একটা ক্লাস রুমে উঁকি দিয়ে দেখি অনেক ছেলেমেয়ের হাতে কফির কাপ কিংবা কোল্ড ড্রিংকের বোতল। আরাম করে খাওয়া-দাওয়া করতে করতে অধ্যাপকদের বক্তৃতা শুনছে। পৃথিবীতে দু’ধনের মানুষ আছে। এক ধরনের কাছে বিদেশের সব কিছুই ভালো লাগে, অন্যদের কিছুই ভালো লাগে না। আমি দ্বিতীয় দলের। আমার কাছে কিছুই ভালো লাগে না। যা দেখি তাতেই বিরক্ত হই।

রাতে আবার খেতে গেলাম বি এন্ড বানে। সেই পুরাতন খাবার। ফ্রেঞ্চ টোস্ট। রুটিনটি হলো এ-রকম : সকালবেলা ইউনিভার্সিটি এলাকায় যাই। একা একা হাঁটাহাঁটি করি–যা দেখি তাই খারাপ লাগে। সন্ধ্যায় হোটেলে ফেরত আসি। রাতে খেতে যাই বিফ এন্ড বানে। ফ্রেঞ্চ টোস্টের অর্ডার দেই। অন্য কিছু খেতে ইচ্ছে করে না। ডলারের অভাব এখন আর আমার নেই। ইউনিভার্সিটি আমাকে চারশ ডলার অগ্রিম দিয়েছে। সিয়াটল থেকে পাঠানো ছোট ভাইয়ের চেকটাও ভাঙিয়েছি। টাকার অভাব নেই। বিফ এন্ড বানে খাবারেরও অভাব নেই। কিন্তু কোনো খাবারই খেতে ইচ্ছা করে না। খেতে গেলেই চোখের সামনে ভাসে এক প্লেট ধবধবে সাদা ভাত–একটা বাটিতে সর্ষেবাটা দিয়ে রাধা ইলিশ। ছোট্ট পিরিচে কাঁচা লংকা, আধখান কাগজী লেবু। আমার প্রাণ ই-হু করে। ওয়েট্রেস যখন অর্ডার নিতে আসে, আমি বলি ফ্রেঞ্চ টোস্ট। সে অবাক হয়ে তাকায়। হয়তো ইতিমধ্যে এই রেস্টুরেন্টে আমার নামই হয়ে গেছে ‘ফ্রেঞ্চ টোস্ট’। আমি লক্ষ করছি–আমাকে দেখলেই ওয়েট্রেসরা নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ি করে এবং এক সময় এসে কোমল গলায় বলে, সে-ই খাবার?

আমি বলি, ইয়েস।

ছটি দীর্ঘ রজনী কেটে গেল। তারপর চমৎকার একটা ঘটনা আমার জীবনে ঘটলো। ঘটনাটা বিশদভাবে বলা দরকার। এই ঘটনা না ঘটলে হয়তো আমি আমেরিকায় থাকতে পারতাম না। সব ছেড়েছুঁড়ে চলে আসতাম।

যথারীতি রাতে খাবার খেতে গিয়েছি। ওয়েট্রেস অর্ডার নিতে আমার কাছে আর আসছে না। আমার কেন জানি মনে হলো দূর থেকে সবাই কৌতূহলী ভঙ্গিতে আমাকে দেখছে। ফিসফাস করছে। তাদের দোষ দিচ্ছি না। দিনের পর দিন ফ্রেঞ্চ টোস্ট খেয়ে-খেয়ে আমিই এই অবস্থাটা তৈরি করেছি। একা অনেকক্ষণ বসে থাকবার পর অর্ডার নিতে একটি মেয়ে এল। আমাকে অবাক করে দিয়ে বসলো আমার সামনের চেয়ারে। যে কথাগুলো সে আমাকে বললো তা শোনার জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। মেয়েটি নিচু গলায় বললো,

দ্যাখো আহামাদ, আমরা জানি তোমার সময়টা ভালো যাচ্ছে না। দিনের পর দিন তুমি একটা কুৎসিত খাবার মুখ বুজে খেয়ে যাচ্ছে। টাকা-পয়সার কষ্টের মতো কষ্ট তো আর কিছুই হতে পারে না। তবু বলছি, নিজের উপর বিশ্বাস রাখো। দুঃসময় একদিন অবশ্যই কাটবে।

আমি একবার ভাবলাম বলি, তোমরা যা ভাবছো ব্যাপারটা সে রকম নয়। পরমুহূর্তেই মনে হলো–এটা বলার দরকার নেই। এটা বলা মানেই এদের ভালোবাসার অপমান করা। আমি তা হতে দিতে পারি না।

মেয়েটি বললো, আজ তোমার জন্যে আমরা ভালো একটা ডিনারের ব্যবস্থা করেছি। এর জন্যে তোমাকে কোনো পয়সা দিতে হবে না। তুমি আরাম করে খাও এবং মনে সাহস রাখো।

সে উঠে গিয়ে বিশাল ট্রে-তে করে টি-বোন স্টেক নিয়ে এল। সঙ্গে নানান ধরনের টুকিটাকি। কফি এল, আইসক্রিম এল। ওয়েট্রেসরা সবাই একবার করে দেখে গেল আমি ঠিকমতো খাচ্ছি কিনা। আমি খুব আবেগপ্রবণ ছেলে, আমার চোখে পানি এসে গেল। এরা এতো মমতা একজন অচেনা-অজানা ছেলের জন্যে রেখে দিয়েছিল? মেয়েগুলো আমার চোখের জল দেখতে পেলেও ভান করলো যেন দেখতে পায়নি।

গভীর আনন্দ নিয়ে হোটেল গ্রেভার ইনে ফিরে এলাম। রিসিপশনে বসে থাকা গোমড়া মুখের মেয়েটাকে আজ অনেক ভালো লাগলো। আমি হাসিমুখে বললাম, হ্যালো।

সে-ও হাসিমুখে বললো হ্যালো।

গ্রেভার ইন বার-এর উদ্দাম গান আজ শুনতে ভালো লাগলো। ইচ্ছে করলো ভেতরে ঢুকে খানিকক্ষণ শুনি।

আমার পাশের বৃদ্ধার ঘরে নক করে তাকে বললাম আমার কাছে দুটো বাংলাদেশী মুদ্রা আছে তুমি কি নেবে?

অনেক রাতে স্ত্রীকে চিঠি লিখতে বসলাম। সেই চিঠিটা খুব অদ্ভুত ছিল। কারণ চিঠিতে তুষারপাতের একটা বানানো বর্ণনা ছিল। তুষারপাত না দেখেই আমি লিখলাম–আজ বাইরে খুব তুষারপাত হচ্ছে। রাস্তাঘাট ঢেকে গেছে সাদা বরফে। সে যে কি অপূর্ব দৃশ্য তুমি না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না। আমি হোটেলের জানালার কাছে বসে-বসে লিখছি। তুমি পাশে থাকলে দুজন হাত ধরাধরি করে তুষারের মধ্যে দাঁড়াতাম।

যে তিনজন তরুণী আমেরিকা প্রসঙ্গে আমার ধারণাই বদলে দিলো আজ তাদের কথা গভীর মমতা ও গভীর ভালোবাসায় স্মরণ করছি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে আজ আমরা বিভক্ত। কতো দেশ, কতো নাম-কিন্তু মানুষ একই আছে। আসছে লক্ষ বছরেও তা-ই থাকবে।

কজন অদ্ভুত বাবা

আমার ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার লেখা প্রথম গ্রন্থ কপোট্রনিক সুখ দুঃখের উৎসর্গপত্রে লিখেছে ও।

পৃথিবীর সবচে ভালমানুষটিকে বেছে নিতে বললে
আমি আমার বাবাকে বেছে নেব।

বইয়ের উৎসর্গপত্রে লেখকরা সবসময় আবেগের বাড়াবাড়ি করেন। আমার ভাইয়ের এই উৎসর্গপত্র আবেগপ্রসূত ধরে নিতে খানিকটা অসুবিধা আছে। সে যদি লিখত পৃথিবীর সবচে ভালো মানুষ আমার বাবা এবং মা তা হলে আবেগের ব্যাপারটি চলে আসত। সে তা না করে বাবার কথাই লিখেছে। পৃথিবীর সবচে ভালোমানুষের মধ্যে মাকে ধরেনি। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে তার উৎসর্গপত্র আবেগপ্রসূত নয়। চিন্তাভাবনা করে লেখা। ইকবালকে আমি যতটুকু চিনি সে চিন্তাভাবনা না করে কখনো কিছু বলে না এবং লেখেও না।

আমার বাবা পৃথিবীর সবচে ভালো মানুষদের একজন কি না তা জানি না, তবে বিচিত্র একজন মানুষ, তা বলতে পারি। তার মতো খেয়ালি, তাঁর মতো আবেগবান মানুষ এখন পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। আবেগ ছাড়াও তাঁর চরিত্রে আরও সব বিস্ময়ের ব্যাপারও ছিল। তিনি ছিলেন জন স্টেইনবেকের উপন্যাস থেকে উঠে-আসা এক রহস্যময় চরিত্র।

সবার আগে ছোট্ট একটা ঘটনা বলি। রাত প্রায় বারোটা। রঙমহল সিনেমা হল থেকে সেকেন্ড শো ছবি দেখে বাবা এবং মা রিকশা করে ফিরছেন। বড় একটা দিঘির পাশ দিয়ে রিকশা যাচ্ছে। মা হঠাৎ বললেন, আহা দ্যাখো কী সুন্দর দিঘি! টলটল করছে পানি। ইচ্ছে করছে পানিতে গোসল করি।

বাবা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, রিকশা থামাও।

রিকশাওয়ালা থামল।

বাবা বললেন, চলো দিঘিতে গোসল করি।

মা হতভম্ব। এই গভীর রাতে দিঘিতে নেমে গোসল করবেন কী? নিতান্ত পাগল না হলে কেউ এরকম বলে?

মা বললেন, কী বলছ তুমি!

বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, দ্যাখো আয়েশা, একটাই আমাদের জীবন। এই এক–জীবনে আমাদের বেশির ভাগ সাধই অপূর্ণ থাকবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যেসব সাধ আছে, যা মেটানো যায় তা মেটানোই ভালো। তুমি আসো আমার সঙ্গে।

বাবা হাত ধরে মাকে নামালেন। স্তম্ভিত রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে দেখল হাত ধরাধরি করে দুজন নেমে গেল দিঘিতে।

এই গল্প যতবার আমার মা করেন ততবার তার চোখে পানি এসে যায়। তাঁর নিজের ধারণা, তাঁর জীবনে যে অল্প কিছু শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত এসেছিল ঐ দিঘিতে অবগাহন তার মধ্যে একটি।

বাবার চরিত্রকে স্পষ্ট করার জন্যে আরও কিছু ঘটনার উল্লেখ করি। বাবা তখন সিলেট সদরে পুলিশের ইন্টেলিজেন্সিতে আছেন। পদমর্যাদায় সাব ইন্সপেক্টর। বেতন সর্বসাকুল্যে মাসে নব্বই টাকা। সেই টাকার একটা অংশ দেশের বাড়িতে চলে যায়, এক অংশ ব্যয় হয় বই কেনা বাবদ। বাকি যা থাকে তা দিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চালিয়ে নিয়ে যান মা। যাকে বলে ভয়াবহ জীবনসংগ্রাম। জীবনসংগ্রামের এই অংশটি বাবার কখনো চোখে পড়ে না। কারণ দেশের বাড়িতে পাঠানো টাকা এবং বই কেনার টাকা আলাদা করে বাকি টাকাটা মার হাতে তুলে দেন। বাবার দায়িত্ব শেষ। বাকি মাস টেনে নিয়ে যাবার দায়িত্ব হচ্ছে মার। তিনি তা কীভাবে নেবেন সেটা তাঁর ব্যাপার। বাবার কোনোই মাথাব্যথা নেই।

এইরকম অবস্থায় মাসের প্রথম তারিখে বাবাকে খুব হাসিমুখে বাড়ি ফিরতে দেখা গেল। তিনি বিশ্বজয়-করা হাসি দিয়ে বললেন, আয়েশা, একটা বেহালা কিনে ফেললাম।

মা বিস্মিত হয়ে বললেন, কী কিনে ফেললে?

বেহালা।

বেহালা কীজন্যে?

বেহালা বাজানো শিখব।

কত দাম পড়ল?

দাম সস্তা, সত্তর টাকা। সেকেন্ড হ্যান্ড বলে এই দামে পাওয়া গেল।

বাবা সংসার চালাবার জন্য মার হাতে দশটা টাকা তুলে দিলেন; মা হাসবেন না কাঁদবেন ভেবে পেলেন না।

বাবার খুব শখ ছিল ওস্তাদ রেখে তাঁর কাছে বেহালা বাজানো শিখবেন। একাদকে বেতন দিয়ে বেহালা বাজানো শেখার সামর্থ্য তার ছিল না। কাজেই অতি যত্নে বেহালা তুলে রাখা হল। যেদিন সামর্থ্য হবে তখন ওস্তাদ রেখে বেহালা শেখা হবে।

মাঝে মাঝে দেখতাম কাঠের বাক্স থেকে তিনি বেহালা বের করছেন। অতি যতে ধুলো সরাচ্ছেন। হুড়ে রজন মাখাচ্ছেন এবং একসময় লাজুক ভঙ্গিতে বেহালায় হড় ঘষছেন। কান্নার মতো একরকম আওয়াজ উঠছে বেহালা থেকে। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছি।

বাবার অসংখ্য অপূর্ণ শখের মতো বেহালা বাজানো শেখার শখও পূর্ণ হয়নি। বাক্সবন্দি থাকতে থাকতে একসময় বেহালার কাঠে ঘুণ ধরে গেল। দুড়ের সুতা গেল ছিড়ে। বেহালা চলে এল আমাদের দখলে। আমার ছোট বোন শেফ বেহালার বাক্স দিয়ে পুতুলের ঘর বানাল। বড় চমৎকার হল সেই ঘর। ডালা বন্ধ করে সেই ঘর হাতলে ধরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়।

আরেক দিনের ঘটনা। শীতকালের এক ভোরে মার গলা শুনে ঘুম ভেঙে গেল। কী নিয়ে যেন বাবার সঙ্গে রাগারাগি করছেন। এরকম তো কখনো হয় না! তারা ঝগড়া-টগড়া অবশ্যই করেন, তবে সবটাই চোখের আড়ালে। আজ হল কী? আমি কান পেতে আছি যদি কিছু টের পাওয়া যায়। কিছুই টের পাওয়া যাচ্ছে না। মা বারবার শুধু বলছেন, ঘোড়া দিয়ে তুমি করবে কী? আমাকে বুঝিয়ে বলো, কে পুষবে এই ঘোড়া?

বাবা বলছেন, এত রাগছ কেন? একটা কোনো ব্যবস্থা হবেই।

মা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, আমরা নিজেরা খেতে পাচ্ছি না, এর মধ্যে ঘোড়া! তোমার কি মাথা-খারাপ হল?

আমি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামলাম। কথাবার্তা থেকে মনে হচ্ছে একটা ঘোড়া কেনা হয়েছে।

আমাকে জেগে উঠতে দেখে বাবা হাসিমুখে বললেন, ঘরের বাইরে গিয়ে দেখে আয় ঘোড়া কিনেছি।

কী অদ্ভুত কাণ্ড! ঘরের বাইরে সুপারিগাছের সঙ্গে বাঁধা বিশাল এক ঘোড়া। ঘোড়াটাকে আমার কাছে আকাশের মতো বড় মনে হল। সে ক্রমাগত পা দাপাচ্ছে এবং ফোঁসফোঁস করে শব্দ করছে। আমাদের কাজের ছেলে আহদ [তার নাম সম্ভবত আসাদ, সে বলত আছদ] ভীতমুখে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে।

ঘটনা হচ্ছে—বাবা মাকে না জানিয়ে প্রভিডেন্ট ফান্ডে এ পর্যন্ত জমা সব টাকা তুলে একটা ঘোড়া কিনে ফেলেছেন। এই সেই ঘোড়া। মহাতেজি প্রাণশক্তিতে ভরপুর একটি প্রাণী, যে-প্রাণীদের সঙ্গে বাবার প্রথম পরিচয় হয় সারদা পুলিশ একাডেমীতে। তার বড়ই পছন্দ হয়। বাবা তার পছন্দের জিনিস যে-করেই হোক জোগাড় করেন। এতদিন পর ঘোড়াও জোগাড় হল। তখন পুলিশ অফিসাররা ব্রিটিশ নিয়মের সূত্র ধরে ঘোড়া পুষলে অ্যালাউন্স পেতেন। বাবা আশা করছেন সেই অ্যালাউন্সের টাকাতেই এর পোষর খরচ উঠে আসবে।

ঘোড়া সুপারিগাছের সঙ্গে বাঁধা। বাবা-মার মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হচ্ছে। উত্তাপ পুরোটাই মা-ই চালাচ্ছেন, বাবা শুধু কাটান দেয়ার চেষ্টা করছেন।

কী করবে তুমি এই ঘোড়া দিয়ে শুনি? সিলেট শহরে ঘোড়ায় করে ঘুরবে?

হুঁ। অসুবিধা কী? ছেলেমেয়েদেরও ঘোড়ায় চড়া শেখাব।

ছেলেমেয়েরা ঘোড়ায় চড়া শিখে কী করবে?

কিছু করবে না, একটা বিদ্যা শেখা থাকল।

ঘোড়ার পেছনে কত খরচ হবে সেটা ভেবেছ?

এত ভাবলে বেঁচে থাকা যায় না।

বেঁচে থাকা যাক আর না-যাক এই ঘোড়া তুমি এক্ষুনি বিদেয় করো।

পাগল হয়েছ? এত শখ করে কিনলাম!

বাবা ছিলেন আবেগনির্ভর মানুষ। যুক্তি দিয়ে তাঁকে টলানো মুশকিল। কিন্তু তাকেও টলতে হল। কারণ ঘোড়া দ্বিতীয় দিনেই লাথি মেরে আছদের পা ভেঙে ফেলল। মা হাতে অস্ত্র পেয়ে গেলেন। কঠিন গলায় বললেন, তোমার ছেলেমেয়েরা সারাক্ষণ ঘোড়াকে ঘিরে নাচানাচি করে। লাথি খেয়ে ওরা মারা পড়বে। তাই কি তুমি চাও? বাবা ঘোড়া বিক্রি করে দিলেন। সেই টাকায় কিনলেন একটা দামি কোডাক ক্যামেরা। তবে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ঘোড়ার জিন রেখে দিলেন। আমাদের খেলার সামগ্রী-তালিকায় আরেকটি জিনিস যুক্ত হল।

দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের জিনিসের প্রতি তাঁর আমৃত্যু শখ ছিল-একটি হচ্ছে। পামিস্ট্রি, অন্যটি ফটোগ্রাফি। তার কোডাক ক্যামেরা তিনি আগলে রাখতেন যক্ষের মতো। শুধু যে ছবি তুলতেন তা-ই না, সেই ছবি নিজেই ডেভেলপ এবং প্রিন্ট করতেন। আমার পরিষ্কার মনে আছে, আমাদের শৈশবের আনন্দময় মুহূর্তের একটি হচ্ছে বাবাকে ঘিরে আমরা বসে আছি। একটা গামলায় পানি। সেই পানিতে কিছু কাগজ ভাসছে। ধবধবে সাদা কাগজে আস্তে আস্তে মানুষের মুখের আদল ফুটতে শুরু করেছে। আমরা আনন্দে লাফাচ্ছি। বাবার মুখে আনন্দের হাসি। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগের কথা লিখছি। সেই সময় পুলিশের একজন দরিদ্র সাব-ইন্সপেক্টর নিতান্তই শখের কারণে ঘরে ডার্করুম বানিয়ে ছবি প্রিন্ট করছেন-ব্যাপারটা বেশ মজার।

পামিস্ট্রি নিয়েও বাবার উৎসাহ ছিল বাড়াবাড়ি রকমের। আমার মনে হয় তার রস ঝোকটা ছিল রহস্যময়তার দিকে। তিনি রহস্যের সন্ধান পেয়েছিলেন ফটোগ্রাফিতে, ঝুঁকে পড়েছেন সেদিকে। রহস্য ছিল জ্যোতিষবিদ্যায়, সেদিকেও ঝুঁকলেন।

কিছুদিন পরপরই ছুটির দিনের সকালে একটা আতশি কাচ নিয়ে বসতেন। গভীর গলায় বলতেন, বাবারা আসো তো দেখি, হাতের রেখায় কোনো পরিবর্তন হল কি না।

একবার ইকবালের হাত দেখে বললেন-চমত্তার রেখা। চন্দ্র এবং মঙ্গলের ক্ষেত্রও ভালো। দীর্ঘ আয়ু। তুই খুব কম করে হলেও আশি বছর বাঁচবি। সেই রাতের ঘটনা। ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দে সবার ঘুম ভেঙে গেল। ইকবাল হাউমাউ করে কাঁদছে। কী হয়েছে, কী হয়েছে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আশি বছর পর আমি মরে যাব এইজন্যে খুব খারাপ লাগছে আর কান্না পাচ্ছে।

বাবা বললেন, গণনায় ভুল হতে পারে। আরেকবার দেখা দরকার। কই, ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা দেখি।

গভীর রাতে বাবা তার আতশি কাচ নিয়ে বসলেন। আমরা সবাই তাকে ঘিরে বসলাম। ইকবালের এক হাত বাবার কাছে, অন্য হাতে সে চোখ কচলাচ্ছে। বাবা অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বললেন, আগের গণনায় ভুল হয়েছিল। তোর হাতে আছে ইচ্ছামৃত্যুর চিহ্ন। তোর হবে ইচ্ছামৃত্যু।

ইচ্ছামৃত্যু কী?

যতক্ষণ পর্যন্ত মরার ইচ্ছা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তুই মরবি না। বেঁচে থাকবি।

কোনোদিন যদি মরার ইচ্ছা না হয়?

তা হলে বেঁচে থাকবি। মরবি না।

ইকবাল হৃষ্টচিত্তে ঘুমুতে গেল।

জ্যোতিষবিদ্যা কোনো বিদ্যা নয়। জ্যোতিষবিদ্যা হচ্ছে একধরনের অপবিদ্যা, অপবিজ্ঞান। মানুষের ভবিষ্যৎ তার হাতের রেখায় থাকে না। থাকার কোনো কারণ নেই। তবু অত্যন্ত অস্বস্তির সঙ্গে বলছি, আমাদের সব ভাইবোন সম্পর্কে তিনি যা বলে গিয়েছিলেন তা মিলে গিয়েছিল। তিনি নিজের মৃত্যু সম্পর্কেও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। বলেছিলেন, তার কপালে অপঘাত মৃত্যু লেখা। সেই মৃত্যু হবে ভয়ংকর মৃত্যু।

এইসব তথ্য তিনি হাত দেখে পেয়েছিলেন, না অন্য কোনো সত্রে পেয়েছিলেন, আমার জানা নেই। মিলগুলি কাকতালীয় বলেই মনে হয়।

জ্যোতিষশাস্ত্রের চর্চার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরেকটি বিষয়েও জড়িত ছিলেন। সেটাকে প্রেতচর্চা বলা যেতে পারে। প্লানচেট, চক্র, ভূত নামানো এইসব নিয়ে খুব মাতামাতি ছিল। দাদাজান এই নিয়ে বাবার উপর খুব বিরক্ত ছিলেন। তিনি বাবাকে ডেকে তওবা করালেন যাতে তিনি কোনোদিন প্রেতচর্চা না করেন। বাবা তওবার পর প্রেতচর্চা ছেড়ে দেন, তবে এই বিষয়ে বই পড়া ছাড়েননি। বাবার সগ্রহের বড় অংশ ছিল প্রেতচর্চাবিষয়ক বইপত্র।

প্রসঙ্গক্রমে বলি, তিনি আস্তিক মানুষ ছিলেন। আমরা কখনো তাকে রোজা ভাঙতে দেখিনি। নামাজ খুব নিয়মিত পড়তেন না, তবে রোজ রাতে এশার নামাজে দাঁড় হতেন। গম্ভীর স্বরে সুরা আবৃত্তি করতেন। পরিবেশ হয়ে উঠত রহস্যময়।

আমার বাবা যে একজন রহস্যময় পুরুষ ছেলেবেলায় তা কখনো বুঝতে পারিনি। তখন ধরেই নিয়েছিলাম সবার বাবাই এরকম। আমার বাবা অন্যদের চেয়ে আলাদা কিছু না। তা ছাড়া বাবার সঙ্গে আমাদের কিছু দূরত্বও ছিল। ছেলেমেয়েদের প্রতি আদরের বাড়াবাড়ি তার চরিত্রে ছিল না। নিজে খুব ব্যস্তও থাকতেন। সারাদিন অফিস করে বিকেলে বই পড়তে যেতেন কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে। ফিরতে ফিরতে রাত নটা। দিনের পর দিন কাটত, তাঁর সঙ্গে আমাদের কথা হত না। এই কারণে মনেমনে চাইতাম তার যেন কোনো-একটা অসুখ হয়। বাবার অসুখ খুবই মজার ব্যাপার। অসুখ হলে তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের চারপাশে বসিয়ে উঁচুগলায় কবিতা আবৃত্তি করতেন। এতে নাকি তার অসুখের আরাম হত।

এই অসুখের সময়ই তিনি একবার ঘোষণা করলেন, সঞ্চয়িতা থেকে যে একটা কবিতা মুখস্থ করে তাকে শোনাতে পারবে সে এক আনা পয়সা পাবে। দুটো মুখস্থ করলে দুআনা।

আমি বিপুল উৎসাহে কবিতা মুখস্থ করতে শুরু করলাম। এর মধ্যে কোনো কাব্যপ্রীতি কাজ করেনি। আর্থিক ব্যাপারটাই ছিল একমাত্র প্রেরণা। যথাসময়ে একটা কবিতা মুখস্থ হয়ে গেল। নাম এবার ফিরাও মোরে। দীঘ কবিতা। এই দীর্ঘ কবিতাটা মুখস্থ করার পেছনের কারণ হল, এটা বাবার খুব প্রিয় কবিতা। তাঁদের সময় নাকি বি. এ. ক্লাসে পাঠ্য ছিল।

বাবা আমার কবিতা আবৃত্তি শুনলেন।

কোনো ভুল না করে এই দীর্ঘ কবিতাটি বলতে পারায় তিনি আনন্দে অভিভূত হলেন। এক আনার বদলে আমি চার আনা পয়সা পেলাম। সাহিত্যবিষয়ক কর্মকাণ্ড থেকে ওটাই ছিল আমার প্রথম রোজগার।

প্রসঙ্গ থেকে আবার সরে এসেছি। পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা হয়ে পসছে ফিরে যাই। বুঝতে পারছি, এরকম সমস্যা বারবার হবে, মূলধারা থেকে সরে আসব উপধারায়। কে জানে সেই উপধারাই হয়তোবা মূলধারা। তা হাড়া আত্মজীবনীমূলক রচনায় মূল্যহীন অংশগুলিই বেশি মূল্য পায়।

গানবাজনা বাবার বড়ই প্রিয় ছিল। বি. এ. পাশ করার পর কলকাতায় কী-একটা পার্ট-টাইম কাজ জুটিয়ে কিছু পয়সা করেন। তা দিয়ে যে-বস্তুটি কেনেন তার। নাম কলের গান। দম দিয়ে চালানো কলের গান। কোডাক ক্যামেরাটা ছাড়া অন্য কোনো জাগতিক বস্তুর প্রতি তার বিন্দুমাত্র মমতা ছিল না; কিন্তু এই যন্ত্রটির প্রতি তার মমতার সীমা ছিল না। পার্ট-টাইম চাকরিটি চলে যাবার পর তিনি অথই জলে পড়েন। কলকাতার যে-মেসে থাকতেন তার ভাড়া বাকি পড়ে। শখের জিনিস এক এক করে বিক্রি করে ফেলার অবস্থায় পৌঁছে যান। বিক্রি করার মতো অবশিষ্ট যা থাকে তা হচ্ছে কলের গান, যা বিক্রি করা আমার বাবার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। সেই সময় তাঁর বন্ধুবান্ধবরা বললেন, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের সঙ্গে দেখা করলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়।

শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক তখন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। শিক্ষিত মুসলমান ছেলে তার কাছে চাকরির আবেদন করলেই কাজ সমাধা। কিছু-না কিছু তিনি জুটিয়ে দেবেনই। বাবা বি এ. পাশ করেছেন ডিসটিংশন নিয়ে। খুব শখ ছিল ইংরেজি সাহিত্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. পড়বেন। অর্থের অভাবে তা হয়ে উঠছে না। সেই সময় মুসলমান ছেলেদের চাকরিবাকরির প্রায় সব দরজাই বন্ধ। বাবা ঠিক করলেন, দেখা করবেন শেরে বাংলার সঙ্গে। এই অভাব আর সহ্য করা যাচ্ছে না।

অতিব্যস্ত মুখ্যমন্ত্রী বাবাকে সাক্ষাতের সুযোগ দিলেন। তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত কথাবার্তা হল :

বি. এ. পাশ করেছ?

জি।

ফলাফল কী?

বি. এ.-তে ডিসটিংশন ছিল।

বাহ্‌, খুব খুশি হলাম শুনে। এম. এ. পড়বে তো?

জি জনাব, ইচ্ছা আছে।

ইচ্ছে আছে বললে হবে না—পড়তেই হবে। তুমি কি আমার কাছে বিশেষ কোনো কাজে এসেছ? কোনো সাহায্য বা কোনো সুপারিশ, কিংবা চাকরি?

বাবার খুবই লজ্জা লাগল। তিনি বললেন, জি না, আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। অন্য কোনো কারণে না।

শেরে বাংলা বেশ খানিকক্ষণ বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, সবাই আমার কাছে তদবির নিয়ে আসে। অনেকদিন পর একজনকে পাওয়া গেল যে কোনো তদবির নিয়ে আসেনি। আমি খুব আনন্দিত হলাম। তুমি এম. এ. পাশ করার পর পেশা হিসাবে শিক্ষকতা বেছে নেবে। আমার ধারণা তুমি ভালে। শিক্ষক হবে।

বাবা সেই রাতেই কলকাতা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের কুতুবপুর চলে আসেন। বাড়ি থেকে সাত মাইল দূরে মীরকাশেম নগরের এক স্কুলে বিপুল উৎসাহে শিক্ষকতা শুরু করেন। মাসের শেষে বেতন নিতে গেলে হেডমাস্টার সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, আদায়পত্র কিছুই নেই, বেতন দেব কী? দেখা যাক পরের মাসে।

পরের মাসেও একই অবস্থা। তার পরের মাসেও তা-ই। হেডমাস্টার সাহেব মাথা দুলিয়ে বললেন, শিক্ষকতা হচ্ছে মহান পেশা। আত্মনিবেদন থাকতে হয়। শুধু টাকা টাকা করলে কি হয়?

অভাব-অনটনে বাবার জীবন পর্যদস্ত হয়ে গেল। চাকরির দরখাস্ত করেন—চাকরি পান না। এর মধ্যে বিয়েও করে ফেলেছেন। স্ত্রীকে নিজের কাছে এনে রাখার সামর্থ্য নেই। ঘোর অমানিশা। এই অবস্থায় কী মনে করে জানি ব্রিটিশ সরকারের বেঙ্গল পুলিশে সাব-ইন্সপেক্টরির পরীক্ষায় বসলেন। সেই সময়ের অত্যন্ত লোভনীয় এই চাকরিতে নির্বাচিত হবার জন্যে কঠিন সব পরীক্ষায় বসতে হত। তিনি পরীক্ষা দিতে বসলেন। গ্রহের ফেরে এই পরীক্ষায় প্রথম হয়ে গেলেন। ট্রেনিং নিতে গেলেন পুলিশ একাডেমী সারদায়।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পুলিশের চাকরিটি তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন। বাবার মৃত্যুর পর দেখা গেল, এই জীবনে তিনি চার হাজারের মতো বই এবং পোস্টাপিসের পাশবই-এ একশত তিরিশ টাকা ছাড়া কিছুই রেখে যাননি। বইয়ের সেই বিশাল সংগ্রহও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্দেশে পিরোজপুরের একদল হৃদয়হীন মানুষ লুট করে নিয়ে যায়। বাবাকে ধরে নিয়ে যায় বলেশ্বর নদীর তীরে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। ভরা পূর্ণিমায় ফিনকি-ফোটা জ্যোৎস্নায় তার রক্তাক্ত দেহ ভাসতে থাকে বলেশ্বর নদীতে। হয়তো নদীর শীতল জল তার রক্ত সে-রাতে ধুয়ে দিতে চেষ্টা ভেবেছে। পূর্ণিমার চাদ তার সবটুকু আলো ঢেলে দিয়েছে তার ভাসন্ত শরীরে। মমতাময়ী প্রকৃতি পরম আদরে গ্রহণ করেছে তাকে।

এই প্রসঙ্গ থাক। এই প্রসঙ্গে আর লিখতে ইচ্ছে করছে না। বরং মার কথা বলি।

ডানবার হলের জীবন

নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটির ক্লাসগুলো যেখানে হয় তার নাম ডানবার হল। ডানবার হলের তেত্রিশ নম্বর কক্ষে ক্লাস শুরু হলো। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ক্লাস। কোর্স নাম্বার ৫২৯।

কোর্স নাম্বারগুলি সম্পর্কে সামান্য ধারণা দিয়ে নেই। টু হানড্রেড লেভেলের কোর্স হচ্ছে আণ্ডার-গ্রাজুয়েটের নিচের দিকের ছাত্রদের জন্যে। থ্রি হানড্রেড লেভেল হচ্ছে আণ্ডার-গ্রাজুয়েটের উপরের দিকের ছাত্রদের জন্যে। ফোর হানড্রেড এবং ফাইভ হানড্রেড লেভেল হচ্ছে গ্রাজুয়েট লেভেল।

ফাইভ হানড্রেড লেভেলের যে কোর্সটি আমি নিলাম সে সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অল্প কিছু কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়েছি। একেবারে কিছুই যে জানি না তাও না। তবে এই বিষয়ে আমার বিদ্যা খুবই ভাসাভাসা। জলের উপর ওড়াউড়ি, জল স্পর্শ করা নয়।

একাডেমিক বিষয়ে নিজের মেধা এবং বুদ্ধির উপর আমার আস্থাও ছিল সীমাহীন। রসায়নের একটি বিষয় আমি পড়ে বুঝতে পারব না, তা হতেই পারে

আমাদের কোর্স কো-অর্ডিনেটর আমাকে বললেন, ফাইভ হানড্রেড লেভেলের এই কোর্সটি যে তুমি নিচ্ছ, ভুল করছ না তো? পারবে?

আমি বললাম, ইয়েস।

তখনো ইয়েস এবং নো-র বাইরে তেমন কিছু বলা রপ্ত হয়নি। কোর্স কো অর্ডিনেটর বললেন, এই কোর্সে ঢুকবার আগে কিন্তু ফোর হানড্রেঙ লেভেলের কোর্স শেষ করনি। ভালো করে ভেবে দেখ, পারবে?

ইয়েস।

কোর্স কো-অর্ডিনেটরের মুখ দেখে মনে হলো তিনি আমার ইয়েস শুনেও বিশেষ ভরসা পাচ্ছেন না।

ক্লাস শুরু হলো। ছাত্র সংখ্যা পনেরো। বিদেশী বলতে আমি এবং ইন্ডিয়ান এক মেয়ে কান্তা। ছাত্রদের মধ্যে একজন অন্ধ ছাত্রকে দেখে চমকে উঠলাম। সে তার ব্রেইলি টাইপ রাইটার নিয়ে এসেছে। ক্লাসে ঢুকেই সে বিনীত ভঙ্গিতে বলল, আমি বক্তৃতা টাইপ করব! খটখট শব্দ হবে, এ জন্যে আমি ক্ষমা চাচ্ছি আমি হতভম্ব। অন্ধ ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এটা আমি জানি। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছু অন্ধ ছাত্র-ছাত্রী আছে, তবে তাদের বিষয় হচ্ছে সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা বা দর্শন। কিন্তু থিওরিটিক্যাল কেমিস্ট্রিও কেউ পড়তে আসে আমার জানা ছিল না।

আমাদের কোর্স টিচারের নাম, মার্ক গর্ডন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মস্তান লোক। থিওরিটিক্যাল কেমিস্ট্রির লোকজন তাঁর নাম শুনলে চোখ কপালে তুলে ফেলে। তার খ্যাতি প্রবাদের পর্যায়ে চলে গেছে।

লোকটি অসম্ভব রোগা এবং তালগাছের মতো লম্বা। মুখ ভর্তি প্রকাণ্ড গোঁফ। ইউনিভার্সিটিতে আসেন ভালুকের মতো বড় একটা কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি যখন ক্লাসে যান কুকুরটা তার চেয়ারে পা তুলে বসে থাকে।

মার্ক গর্ডন ক্লাসে ঢুকলেন একটা টি শার্ট গায়ে দিয়ে। সেই টি শার্টে যা লেখা, তার বঙ্গানুবাদ হলো, সুন্দরী মেয়েরা আমাকে ভালোবাসা দাও।

ক্লাসে ঢুকেই সবার নামধাম জিজ্ঞেস করলেন। সবাই বসে বসে উত্তর দিল। একমাত্র আমি দাঁড়িয়ে জবাব দিলাম। মার্ক গর্ডন বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি দাঁড়িয়ে কথা বলছ কেন? বসে কথা বলতে কি তোমার অসুবিধা হয়?

আমি জবাব দেবার আগেই কান্তা বলল, এটা হচ্ছে ভারতীয় ভদ্রতা।

মার্ক গর্ডন বলেন, হুমায়ুন তুমি কি ভারতীয়?

না। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি।

ও আচ্ছা, আচ্ছা। বাংলাদেশ। বস। এর পর থেকে বসে বসে কথা বলবে।

আমি বসলাম। মানুষটাকে ভালো লাগল এই কারণে যে সে শুদ্ধভাবে আমার নাম উচ্চারণ করেছে। অধিকাংশ আমেরিকান যা পারে না কিংবা শুদ্ধ উচ্চারণের চেষ্টা করে না। আমাকে যে সব নামে ডাকা হয় তার কয়েকটি হচ্ছে : মায়ান, হিউমেন, হেমনি।

মার্ক গর্ডন টেবিলে পা তুলে বসলেন এবং বললেন, ক্লাস শুরু করার আগে একটা জোক বলা যাক। আমি আবার ডার্টি জোক ছাড়া অন্য কিছু জানি না। যারা ডার্টি জোক শুনতে চাও না, তারা দয়া করে কান বন্ধ করে ফেল।

গল্পটি হচ্ছে এক ফরাসি তরুণীকে নিয়ে যার একটি স্তন বড় অন্যটি ছোট। বিয়ের রাতে তার স্বামী…

গল্পটি চমৎকার, তবে এ দেশে তা আমার পক্ষে লেখা সম্ভব না বলে শুধু শুরুটা বললাম। গল্প শেষ হবার পর হাসি থামতে পাঁচ মিনিটের মতো লাগল। শুধু কান্তা হাসল না, মুখ লাল করে বসে রইল। যেন পুরো রসিকতাটা তাকে নিয়েই করা হয়েছে।

মার্ক গর্ডন লেকচার শুরু করলেন। ক্লাসের উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেল। বক্তৃতার শেষে তিনি বললেন, সহজ ব্যাপারগুলি নিয়ে আজ কথা বললাম, প্রথম ক্লাস তো তাই।

আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। কিছু বুঝতে পারিনি। তিনি ব্যবহার করছেন গ্রুপ থিওরি, যে গ্রুপ থিওরির আমি কিছুই জানি না।

আমি আমার পাশে বসে থাকা আমেরিকান ছাত্রটিকে বললাম, তুমি কি কিছু বুঝতে পারলে?

সে বিস্মিত হয়ে বলল, কেন বুঝব না, এসব তো খুবই এলিমেন্টারি ব্যাপার। এক সপ্তাহ চলে গেল। ক্লাসে যাই, মার্ক গড়নের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকি। কিছু বুঝতে পারি নাই। নিজের মেধা এবং বুদ্ধির উপর যে আস্থা ছিল তা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর প্রচুর বই জোগাড় করললাম। রাত দিন পড়ি। কোনও লাভ হয় না। এই জিনিস বোঝার জন্য ক্যালকুলাসের যে জ্ঞান দরকার তা আমার নেই। আমার ইনসমনিয়ার মতো হয়ে গেল। ঘুমুতে পারি না। গ্রেভার ইনের লবিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকি। মনে মনে বলি-কী সর্বনাশ।

আমার পাশের ঘরের বৃদ্ধা আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, তোমার কি হয়েছে বলতো? তুমি কি অসুস্থ? স্ত্রীর চিঠি পাচ্ছ না?

দেখতে দেখতে ডিম-টার্ম পরীক্ষা এসে গেল। পরীক্ষার পর পর যে লজ্জার সম্মুখীন হতে হবে তা ভেবে হাত-পা পেটের ভেতর ঢুকে যাবার জোগাড় হ’ল। মার্ক গর্ডন যখন দেখবে বাংলাদেশের এই ছেলে পরীক্ষার খাতায় কিছুই লেখেনি তখন তিনি কি ভাববেন? ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানই বা কী ভাববেন?

এই চেয়ারম্যানকেই ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের রসায়ন বিভাগের সভাপতি প্রফেসর আলি নওয়াব আমার প্রসঙ্গে একটি চিঠিতে লিখেছেন–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ যে অল্প সংখ্যক অসাধারণ মেধাবী ছাত্র তৈরি করেছে, হুমায়ুন আহমেদ তাদের অন্যতম।

অসাধারণ মেধাবী ছাত্রটি যখন শূন্য পাবে তখন কী হবে? রাতে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।

মিড-টার্ম পরীক্ষায় বসলাম। সব মিলিয়ে দশটি প্রশ্ন।

এক ঘন্টা সময়ে প্রতিটির উত্তর করতে হবে। আমি দেখলাম একটি প্রশ্নের অংশবিশেষের উত্তর আমি জানি, আর কিছুই জানি না। অংশবিশেষের উত্তর লেখার কোনো মানে হয় না। আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। এক ঘণ্টা পর সাদা খাতা জমা দিয়ে বের হয়ে এলাম।

পরদিনই রেজাল্ট হ’ল। এ-তো আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় যে পনেরোটি খাতা দেখতে পনেরো মাস লাগবে।

তিনজন এ পেয়েছে। দু’জন বি। বাকি সব সি। বাংলাদেশের হুমায়ুন আহমেদ পেয়েছে শূন্য। সবচে বেশি নম্বর পেয়েছে অন্ধ ছাত্রটি। [এ ছেলেটির নাম আমার মনে পড়ছে না। তার নামটা মনে রাখা উচিত ছিল।]

মার্ক গর্ডন আমাকে ডেকে পাঠালেন। বিস্মিত গলায় বললেন, ব্যাপারটা কী বলতো?

আমি বললাম, কোয়ান্টাম মেকানিক্সে আমার কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না। এই হায়ার লেভেলের কোর্স আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

বুঝতে পারছ না তাহলে ছেড়ে দিচ্ছ না কেন? ঝুলে থাকার মানে কী?

আমি ছাড়তে চাই না।

তুমি বোকামি করছ। তোমার গ্রেড যদি খারাপ হয়, যদি গড় গ্রেড সি চলে আসে তাহলে তোমাকে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যেতে হবে। গ্রাজুয়েট কোর্সের এই নিয়ম।

এই নিয়ম আমি জানি।

জেনেও তুমি এই কোর্সটা চালিয়ে যাবে?

হ্যাঁ।

তুমি খুবই নির্বোধের মতো কথা বলছ।

হয়ত বলছি। কিন্তু আমি কোর্সটা ছাড়ব না।

কারণটা বল।

একজন অন্ধ ছাত্র যদি এই কোর্সে সবচে বেশি নম্বর পেতে পারে আমি পারব কেন? আমার তো চোখ আছে।

তুমি আবারো নির্বোধের মতো কথা বলছ। সে অন্ধ হতে পারে কিন্তু তার এই বিষয়ে চমৎকার ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। সে আগের কোর্স সবগুলি করেছে। তুমি করনি। তুমি আমার উপদেশ শোন। এই কোর্স ছেড়ে দাও।

না।

আমি ছাড়লাম না। নিজে নিজে অংক শিখলাম। গ্রুপ থিওরি শিখলাম, অপারেটর এলজেব্রা শিখলাম। মানুষের অসাধ্য কিছু নেই এই প্রবাদটি সম্ভবত ভুল নয়। এক সময় অবাক হয়ে লক্ষ করলাম কোয়ান্টাম মেকানিক্স বুঝতে শুরু করেছি।

ফাইন্যাল পরীক্ষায় যখন বসলাম তখন আমি জানি আমাকে আটকানোর কোনো পথ নেই। পরীক্ষা হয়ে গেল। পরদিন মার্ক গড়ন একটি চিঠি লিখে আমার মেইল বক্সে রেখে দিলেন। টাইপ করা একটা সংক্ষিপ্ত চিঠি, যার বিষয়বস্তু হচ্ছে :

–তুমি যদি আমার সঙ্গে থিওরিটিক্যাল কেমিস্ট্রিতে কাজ কর তাহলে আমি আনন্দিত হব এবং তোমার জন্যে আমি একটি ফেলোশিপ ব্যবস্থা করে দেব। তোমাকে আর কষ্ট করে টিচিং অ্যাসিসটেন্টশিপ করতে হবে না।

একটি পরীক্ষা দিয়েই আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচিত হয়ে গেলাম। বিভাগীয় চেয়ারম্যান নিজের উদ্যোগে ব্যবস্থা করে দিলেন যেন আমি আমার স্ত্রীকে আমেরিকায় নিয়ে আসতে পারি।

পরীক্ষায় কত পেয়েছিলাম তা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। পাঠক পাঠিকারা আমার এই লোভ ক্ষমার চোখে দেখবেন বলে আশা করি। আমি পেয়েছিলাম ১০০ তে ১০০।

বর্তমানে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে কোয়ান্টাম কেজিস্ট্রি পড়াই। ক্লাসের শুরুতে ছাত্রদের এই গল্পটি বলি। শ্রদ্ধা নিবেদন করি ঐ অন্ধ ছাত্রটির প্রতি, যার কারণে আমার পক্ষে এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছিল। আরেকটি কথা, আমি কিন্তু মার্ক গর্ডনের সঙ্গে কাজ করতে রাজি হইনি। এই বিষয়টি নিয়ে আর কষ্ট করতে ইচ্ছা করছিল না, তাছাড়া আমার খানিকটা কুকুরভীতি আছে। মার্ক গর্ডনের লুকের মতো কুকুরটিকে পাশে নিয়ে কাজ করার প্রশ্নই উঠে না।

আমার মা

আমার মা ছিলেন তাঁর পরিবারের প্রথম সন্তান। শ্যামলা ধরনের একহারা গড়নের মেয়ে। অতি আদরের মেয়ে। কেমন করে জানি সবার ধারণা হল, এই মেয়ে তেমন বুদ্ধিমতী হয়নি। তাকে বুদ্ধিমতী বানানোর জন্যে ছোট বয়সেই পাঠিয়ে দেওয়া হল বারহাট্টায়। বারহাট্টায় আমার মার মামার বাড়ি। মার নানিজান অসম্ভব বুদ্ধিমতী। তিনি যদি ট্রেনিং দিয়ে এই মেয়েকে কিছুটা মানুষ করতে পারেন।

তাঁর ট্রেনিং-এ তেমন কাজ হল না। মার বুদ্ধি বিশেষ বাড়ল না। তবে ক্লাস টুতে তখন সরকারি পর্যায়ে একটি বৃত্তি পরীক্ষা হত। মা এই পরীক্ষা দিয়ে মাসে দুটাকা হারে বৃত্তি পেয়ে চারদিকে চমক সৃষ্টি করে ফেললেন। একি কাণ্ড! মেয়েমানুষ সরকারি জলপানি কী করে পায়?

মার দুর্ভাগ্য বৃত্তির টাকা তিনি পাননি। কারণ তাঁকে উপরের কোনো ক্লাসে ভরতি করানো হল না। মেয়েদের পড়াশোনার দরকার কী! চিঠি লিখতে পারার বিদ্যা থাকলেই যথেষ্ট। না থাকলেও ক্ষতি নেই। মেয়েমানুষের এত চিঠি

লেখালেখিরই-বা কী প্রয়োজন? তারা ঘর-সংসার করবে। নামাজ-কালাম পড়বে। এর জন্যে বাংলা-ইংরেজি শেখার দরকার নেই। তারচে বরং হাতের কাজ শিখুক। রান্নাবান্না শিখুক, আচার বানানো শিখুক, পিঠা বানানো শিখুক। বিয়ের সময় কাজে লাগবে।

আমার মা পড়াশোনা বাদ দিয়ে এইসব কাজ অতি যত্নের সঙ্গে শিখতে লাগলেন। তা ছাড়া নানিজান প্রতি বৎসর একটি করে পুত্র বা কন্যা জন্ম দিয়ে ঘর ভরতি করে ফেলছেন। তাঁর সর্বমোট বারোটি সন্তান হয়। বড় মেয়ে হিসেবে ছোট ছোট ভাইবোনদের মানুষ করার কিছু দায়িত্বও মার উপর চলে আসে।

এই করতে করতে একদিন তার বয়স হয়ে গেল পনেরো। কী সর্বনাশের কথা! পনেরো হয়ে গেছে এখনও বিয়ে হয়নি! বারহাট্টা থেকে কঠিন সব চিঠি আসতে লাগল যেন অবিলম্বে মেয়ের বিয়ের চেষ্টা করা হয়। চারদিকে সুপাত্র খোঁজা চলতে লাগল। একজন সুপাত্রের সন্ধান আনলেন মার দূর-সম্পর্কের চাচা, শ্যামপুরের দুদ মিয়া। দুদু মিয়াও পাগল ধরনের মানুষ। বি. এ. পাশ করেছেন। দেশ নিয়ে মাথা ঘামান। কী করে অশিক্ষিত মূখ মুসলমানদের রাতারাতি শিক্ষিত করা যায়, সেই চিন্তাতেই তার বেশির ভাগ সময় কাটে। শ্যামপুরের অতি দুর্গম অঞ্চলে তিন ইতিমধ্যে একটা স্কুল দিয়ে ফেলেছেন। সেই স্কুলে একদল রোগাভোগা ছেলে সারাদিন স্বরে অ, স্বরে আ বলে চঁাচায়। যে-মানুষটি এইসব কর্মকাণ্ডের মূলে তাঁর বিচারবুদ্ধির উপর খুব আস্থা রাখা যায় না। তবু আমার নানাজান তাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁদের মধ্যে নিম্নলিখিত কথাবার্তা হয়?

ছেলে কী করে?

কিছু করে না। করার মধ্যে যা করে তা হল ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বসে সারাদিন বই পড়ে।

তুমি তাকে চেন কী করে?

দীর্ঘদিন তার সঙ্গে কলকাতার এক মেসে ছিলাম। তাকে খুব ভালো করে দেখার সুযোগ হয়েছে।

বাড়ির অবস্থা কী?

বাড়ির অবস্থা শোচনীয়।

ছেলের নামকরা আত্মীয়স্বজন কে আছেন?

কেউ নেই। সবাই হতদরিদ্র। তবে ছেলের বাবা উলা পাশ। বড় মৌলানা-অতি সজ্জন ব্যক্তি।

অতি সজ্জন ব্যক্তি দিয়ে কাজ হবে না। ছেলের মধ্যে তো তেমন কিছু দেখছি না। রাতদিন যে-ছেলে বই পড়ে সে আবার কেমন ছেলে বই পড়লে তো সংসার চলে না।

দুদু মিয়া খানিকক্ষণ গম্ভীর থেকে বললেন, এত ভালো ছেলে আমি আমার জীবনে দেখিনি এইটুকু বলতে পারি।

দেখতে কেমন?

রাজপুত্র!

কী বললে?

রাজপুত্র!

ছেলে দেখতে রাজপুত্রের মতো শুধু এই কারণেই নানাজান ছেলের বাবার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হলেন। কথা বলে মুগ্ধ হয়ে গেলেন।

আমার দাদা মৌলানা আজিমুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আরবি-ফারসিতে তার অগাধ জ্ঞান ছিল। অতি বিনয়ী মানুষ ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে তিনি হাত তুলে যে-প্রার্থনা করেন তার থেকে মানুষটির চরিত্র স্পষ্ট হবে বলে আমার ধারণা। তিনি বলেন—

হে পরম করুণাময়, আমার পুত্রকন্যা এবং তাদের পুত্রকন্যাদের তুমি আরো অর্থবিত্ত দিও না। তাদের জীবনে যেন অর্থকষ্ট লেগেই থাকে। কারণ টাকাপয়সা মানুষকে ছোট করে। আমি আমার সন্তানসন্ততিদের মধ্যে ছোট মানুষ চাই না। বড় মানুষ চাই।

আমার দাদার চরিত্র আরও স্পষ্ট করার জন্যে আমি আর-একটি ঘটনার লেখ করি। আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফল বের হয়েছে। কেমন করে যেন পরীক্ষায় খুব ভালো করে ফেলি। পাঁচটি লেটার নিয়ে বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান পেয়ে যাই। টেলিগ্রামে দাদাকে এই খবর পাঠানো হয়। যে-পিওন দাদাকে টেলিগ্রামটি দেন দাদা তাকে বসতে বলেন।

পিওন বসে আছেন। দাদা ভেতরবাড়ি চলে গেছেন। বেশ খানিকক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন, শোকরানা নামাজ পড়ার জন্যে খানিক বিলম্ব হয়েছে। আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। ভাই, আমি অতি দরিদ্র একজন মানুষ, এই মুহূর্তে আমার কাছে যা টাকাপয়সা ছিল সবই আমি নিয়ে এসেছি। আপনি এই টাকা গ্রহণ করলে আমি মনে শান্তি পাব। কারণ আজ যে-খবর আপনি আমাকে দিলেন এত ভালো খবর এই জীবনে আমি পাই নাই।

এই বলে দাদা নগদ টাকা এবং ভাংতি পয়সায় প্রায় চল্লিশ টাকা একটা রুমালে বেঁধে বিস্মিত পিওনের হাতে দিলেন। শুধু তা-ই না, বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, আমি খুব খুশি হব আপনি যদি দুপুরে চারটা ডালভাত আমার সঙ্গে খান।

তার কিছুদিন পরেই আমি দাদার একটা চিঠি পাই। তাতে তিনি লিখলেন তোমাকে ছোটবেলায় একটি প্রশ্ন করিয়াছিলাম। তুমি জবাব দিতে পার নাই। আমার মন খারাপ হইয়াছিল। আমার ধারণা ছিল তোমার বুদ্ধি তেমন নাই। আজ তুমি তা ভুল প্রমাণিত করিয়াছ। আমি জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়াইয়া মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করিতেছি। এই সময়ে তোমার কারণে মনে প্রবল সুখ পাইলাম। মৃত্যুপথযাত্রী একজন বৃদ্ধকে তুমি সুখী করিয়াছ-আল্লাহ তোমাকে তার প্রতিদান দিবেন। আল্লাহ সবাইকে সবার প্রাপ্য দেন।

যে প্রশ্নটির জবাব শৈশবে দিতে পারিনি সেটা বলি। তখন ক্লাস টুতে পড়ি। সিলেটের বাসায় দাদা বেড়াতে এসেছেন। অসহ্য গরম। হাতপাখায় হাওয়া খাচ্ছেন। হঠাৎ আমাকে বললেন, এই শোন, পাখার ভেতর তো বাতাস ভরা নেই। তবু পাখা নাড়লেই আমরা বাতাস পাই কীভাবে? বাতাসটা আসে কোত্থেকে?

আমি সেই কঠিন প্রশ্নের জবাব দিতে পারিনি। প্রশ্ন শুনে হকচনি, গিয়েছিলাম।

দাদা দুঃখিত গলায় বললেন, আমার ধারণা ছিল-তুই পারবি। এই .. আমার মনটাই খারাপ করে দিলি।

প্রসঙ্গ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি—আবার প্রসঙ্গে ফিরে যাই।

ছেলের সঙ্গে কোনো কথাবার্তা না বলে শুধুমাত্র ছেলের বাবার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলার পরই নানাজান একজন বেকার ছেলের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দেবার প্রস্তুতি নিয়ে নিলেন।

মেয়েকে বিবাহিত জীবন কী তা বোঝানোর জন্য বর্ষীয়ান মহিলারা দুর দর থেকে নাইওর চলে এলেন। নকশি পিঠা তৈরি হয়ে টিনবন্দি হতে লাগল। সন্ধ্যাবেলায় হাতে গড়া সেমাই তৈরি করতে করতে পাড়ার বৌরা মিহি গলায় বিয়ের গীত গাইতে লাগল।

নানাজান কী মনে করে চলে গেলেন মৈমনসিংহ। ছেলে নাটক-নভেল পড়ে, মেয়েকেও তার জন্য প্রস্তুত থাকা দরকার। দুএকটা নাটক-নভেল পড়া থাকলে মেয়ের সুবিধা হবে।

লাইব্রেরিতে গিয়ে বললেন, ভালো একটা নভেল দিন তো। আমার মেয়ের জন্যে বুঝেশুনে দেবেন।

লাইব্রেরিয়ান গম্ভীর মুখে বললেন, মেয়েছেলেকে নাটক-নভেল বই দেওয়া ঠিক না, একটা ধর্মের বই নিয়ে যান-তাপসী রাবেয়া।

জি না, একটা নভেলই দেন।

দোকানদার একটা বই কাগজে মুড়ে দিয়ে দিল। নানাজান মার হাতে সেই বই তুলে দিলেন। মার জীবনে এটাই প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসের নাম-নৌকাডুবি। লেখক শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম উপন্যাস পড়েই মা মোহিত। একবার, দুবার, তিনবার পড়া হল, তবু যেন ভালোলাগা শেষ হয় না।

বাসররাতে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি কখনো বইটই পড়েছ? এই ধরো, গল্প-উপন্যাস।

মা লাজুক ভঙ্গিতে হ্যাঁসূচক মাথা নাড়লেন।

দুই-একটা বইয়ের নাম বলতে পারবে?

মা ক্ষীণ স্বলে বললেন, নৌকাডুবি।

গভীর বিস্ময়ে বাবা দীর্ঘ সময় কোনো কথা বলতে পারলেন না। এই অজ। পাড়াগাঁয়ের একটি মেয়ে কিনা রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবি পড়ে ফেলেছে!

সেই রাতে বাবা-মার মধ্যে আর কী কথা হয়েছে আমি জানি না। জানার কথাও না। তাঁরা আমাকে বলেননি। কিন্তু আমি কল্পনা করে নিতে পারি, কারণ এবং আমার অন্য পাঁচ ভাইবোন তো তাদের সঙ্গেই ছিলাম। লুকিয়ে ছিলাম তাঁদের ভালোবাসায়।

গ্রামের যে-বোকা ধরনের মেয়ে বিয়ের পর শহরে চলে এল, আমার ধারণা সে অসম্ভব বুদ্ধিমতী মেয়েদেরই একজন। আমি এখনও তার বুদ্ধির ঝলকে যন্ত চমকে উঠি। মা শুধু যে বুদ্ধিমতী তা-ই না, অসম্ভব সাহসী এবং স্বাধীন ধরনের মহিলা।

১৬ই ডিসেম্বরের পর মা আমাদের ভাইবোন সবাইকে নিয়ে ঢাকায় চলে এলেন। হাতে একটি পয়সাও নেই। এই অবস্থায় পুরানা পল্টনে বাড়ি ভাড়া করলেন। আমাদের সবাইকে একত্র করে বললেন, তোরা তোদের পড়াশোনা চালিয়ে যা। সংসার নিয়ে কাউকে ভাবতে হবে না। আমি দেখব।

পুরানা পল্টনের ঐ বাড়িতে আমাদের কোনো আসবাবপত্র ছিল না। আমরা মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে ঘুমুতাম। কেউ বেড়াতে এলে তাকে মেঝেতেই বসতে হত।

মা নানান সমিতিতে ঘুরে ঘুরে সেলাইয়ের কাজ জোগাড় করলেন। দিনরাত মেশিন চালান। জামাকাপড় তৈরি করেন। সেলাইয়ের রোজগারের সঙ্গে বাবার পেনশনের নগণ্য টাকা যুক্ত হয়ে সংসার চলত। তিনি শুধু যে ঢাকার সংসার চালাতেন তা-ই না, মোহনগঞ্জে তাঁর বাবার বাড়ির সংসারও এখান থেকেই দেখাশোনা করতেন। অনেক কাল আগে গ্রামের এই বোকা-বোকা ধরনের লাজুক কিশোরী মেয়েটি কখনো কল্পনাও করতে পারেনি কী কঠিন সংগ্রামময় জীবন অপেক্ষা করছে তার জন্যে। যুদ্ধক্লান্ত এই বৃদ্ধা এখন কী ভাবেন আমি জানি না। তাঁর পুত্রকন্যারা নানানভাবে তাঁকে খুশি করতে চেষ্টা করে। তিনি তাদের সে সুযোগ দিতে চান না। আমার ছোট ভাই ডঃ জাফর ইকবাল আমেরিকা থেকে টিকিট পাঠিয়ে দিয়ে লিখল-মা, আপনি আসুন, আপনাকে আমেরিকা এবং ইউরোপ ঘুরিয়ে দেখাব। আপনার ভালো লাগবে।

মা বললেন, যে-জিনিস তোমার বাবা দেখে যেতে পারেননি, আমি তা দেখব।

আমি বললাম, আম্মা, আপনি কি হজে যেতে চান? যেতে চাইলে বলুন, ব্যবস্থা করি।

না।

ছোটবেলায় দেখেছি আপনি জরি দিয়ে তাজমহলের ছবি এঁকেছিলেন, তাজমহল দেখতে ইচ্ছা করে?

না। আমি একা একা কিছু দেখব না।

বাবা যেসব জিনিস খেতে পছন্দ করতেন তাঁর মৃত্যুর পর কোনোদিন সেই খাবার বাসায় রান্না করেননি। সেইসব খাবারের একটি হচ্ছে বুটের ডাল দিয়ে গোরুর গোশত। আর একটি-বরবটির চচ্চড়ি। আহামরি কোনো খাবার নয়।

আমি একবার বললাম, আমাদের জন্যে আপনার কি কোনো উপদেশ আছে?

তিনি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, উপদেশ নয়, একটি আদেশ আছে। আদেশটি হচ্ছে–কেউ যদি কখনো তোমাদের কাছে টাকা ধার চায় তোমরা না বলবে না। আমাকে অসংখ্যবার মানুষের কাছে ধারের জন্যে হাত পাততে হয়েছে। ধার চাওয়ার লজ্জা এবং অপমান আমি জানি।

(অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলি) মার অসাধারণ-ইএসপি বা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা ছিল। প্রায় সময়ই ভবিষ্যতে কী ঘটনা ঘটবে তা হুবহু বলে দিতে পারতেন। মার এই অস্বাভাবিক ক্ষমতা সম্পর্কে বাবা পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিলেন। মাকে তিনি ঠাট্টা করে ডাকতেন মহিলা পীর। মার এই ক্ষমতা বাবার মৃত্যুর পরপরই পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়।*

——
* আমার ছেলেবেলা গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পর কী মনে করে জানি মা আমেরিকা যেতে রাজি হলেন। মাস সেখানে কাটিয়ে এসেছেন। কিছুদিন আগে আমাকে বললেন হজ করতে চান।

বাংলাদেশ নাইট

ভোর চারটার সময় টেলিফোন বেজে উঠল, অসময়ে টেলিফোন মানেই রিসিভার না নেয়া পর্যন্ত বুক ধড়ফড়। নির্ঘাৎ বাংলাদেশের কল। একগাদা টাকা খরচ করে কেউ যখন বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় কল করে তখন ঘটনা খারাপ ধরেই নিতে হবে। নিশ্চয়ই কেউ মারা-টারা গেছে।

তিনবার রিং হবার পর আমি রিসিভার তুলে ভয়ে ভয়ে বললাম, হ্যালো।

ওপার থেকে ভারী গলা শোনা গেল, হুমায়ূন ভাই, খিচুড়ি কি করে রান্না করতে হয় জানেন?

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। টেলিফোন করেছে মোরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটির মিজানুল হক। সেখানকার একমাত্র বাঙালি ছাত্র। অ্যাকাউন্টিং-এ আন্ডার গ্রাজুয়েট কোর্স করছে।

হ্যালো হুমায়ূন ভাই, কথা বলছেন না কেন? খিচুড়ি কী করে রান্না করতে হয় জানেন?

না।

তাহলে তো বিগ প্রবলেম হয়ে গেল।

আমি চুপ করে রইলাম। মিজানুল হক হড়বড় করে বলল, কাচ্চি বিরিয়ানির প্রিপারেশন জানা আছে?

আমি শীতল গলায় বললাম, কটা বাজে জান?

ক’টা?

রাত চারটা।

বলেন কি? এতরাত হয়ে গেছে? সর্বনাশ।

করছিলে কি তুমি?

বাংলাদেশের ম্যাপ বানাচ্ছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন হুমায়ুন ভাই। সকালে টেলিফোন করব, বিরাট সমস্যায় পড়েছি।

মিজানুল হক খট করে টেলিফোন রেখে দিল। আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। পার্কোলেটরে কফি বসিয়ে দিলাম। আমার ঘুমাবার চেষ্টা করা বৃথা। মিজানুল হকের মাথার ঠিক নেই, কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার টেলিফোন করবে। অন্য কোনও খাবারের রেসিপি জানতে চাইবে।

এ ব্যাপারটা গত তিন দিন ধরে চলছে। মোরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক বর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে অন্যান্য দেশের সঙ্গে উদ্যাপিত হবে বাংলাদেশ নাইট। এই অঞ্চলে বাংলাদেশের একমাত্র ছাত্র হচ্ছে মিজান, আর আমি আছি নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। মিজানের একমাত্র পরামর্শদাতা। আশপাশে সাতশ মাইলের মধ্যে দ্বিতীয় বাঙালি নেই।

কফির পেয়ালা হাতে নেবার সঙ্গে সঙ্গে মিজানের টেলিফোন—

হ্যালো হুমায়ুন ভাই?

হ্যাঁ।

প্ল্যান-প্রোগ্রাম নিয়ে আপনার সঙ্গে আরেকবার বসা দরকার।

এখনো তো দেরি আছে।

দেরি আপনি কোথায় দেখলেন? এক সপ্তাহমাত্র। শালাদের একটা ভেলকি দেখিয়ে দেব। বাংলাদেশ বললে চিনতে পারে না, হা-করে তাকিয়ে থাকে। ইচ্ছা করে চড় মেরে মুখ বন্ধ করে দেই। এইবার শালারা বুঝবে বাংলাদেশ কি জিনিস। ঠিক না হুমায়ুন ভাই?

হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।

শালাদের চোখ ট্যারা হয়ে যাবে দেখবেন। আমি আপনার এখানে চলে আসছি।

মিজান টেলিফোন নামিয়ে রাখলো। আমি আরেকটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। এই ছেলেটিকে আমি খুবই পছন্দ করি। তার সমস্যা একটাই, সারাক্ষণ মুখে বাংলাদেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন একটা খোলার চেষ্টা করেছিল। একজন ছাত্র থাকলে এসোসিয়েশন হয় না বলে সেই চেষ্টা সফল হয়নি। অন্য স্টেট থেকে বাংলাদেশী ছাত্র আনার চেষ্টাও করেছে, লাভ হয়নি। এই প্রচণ্ড শীতের দেশে কেউ আসতে চায় না। শীতের সময় এখানকার তাপমাত্রা শূন্যের ত্রিশ ডিগ্রি নিচে নেমে যায়, কে আসবে এই রকম ভয়াবহ ঠাণ্ডা একটা জায়গায়?

মিজান এই ব্যাপারে বেশ মনমরা হয়েছিল। বাংলাদেশ নাইট-এর ব্যাপারটা এসে পড়ায় সেই দুঃখ খানিকটা কমেছে। এই বাংলাদেশ নাইট নিয়েও বিরাট কাও। মোরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটির ফরেন স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজার মিজানকে বলল, তুমি এক কাজ কর–তুমি বাংলাদেশ নাইট পাকিস্তানীদের সঙ্গে কর।

মিজান হুংকার দিয়ে বলল, কেন?

এতে তোমার সুবিধা হবে। ডবল ডেকোরেশন হবে না। এক খরচায় হয়ে যাবে। তুমি একা মানুষ।

তোমার এত বড় সাহস, তুমি পাকিস্তানীদের সঙ্গে আমাকে বাংলাদেশ নাইট করতে বলছ? তুমি কি জান, ওরা কী করেছে? তুমি কি জান ওরা আমাদের কতজনকে মেরেছে? তুমি কি জান…?

কী মুশকিল–তুমি এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন?

তুমি আজেবাজে কথা বলবে, তুমি আমার দেশকে অপমান করবে, আর আমি তোমার সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলব?

মিজান, ফরেন স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজারের সামনের টেবিলে প্রকাণ্ড এক ঘুসি বসিয়ে দিল। টেবিলে রাখা কফির পেয়ালা উন্টে পড়ল। লোকজন ছুটে এল। প্রচণ্ড হৈচৈ।

এরকম মাথা গরম একটা ছেলেকে সব সময় সামলে-সুমলে রাখা মুশকিল। তবে ভরসা একটাই–সে আমাকে প্রায় দেবতার পর্যায়ে ফেলে রেখেছে। তার ধারণা আমার মতো জ্ঞানী-গুণী মানুষ শতাব্দীতে এক-আধটা জন্মায়। আমি যা বলি, শোনে।

মিজান তার ভাঙা মরিস মাইনর নিয়ে ঝড়ের গতিতে চলে এল। সঙ্গে বাংলাদেশের ম্যাপ নিয়ে এসেছে। সেই ম্যাপ দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম। যে কটা রঙ পাওয়া গেছে সব কটাই সে লাগিয়েছে।

জিনিসটা দাঁড়িয়েছে কেমন বলুন তো?

রঙ একটু বেশি হয়ে গেল না?

ওরা রঙ-চঙ একটু বেশি পছন্দ করে হুমায়ূন ভাই।

তাহলে ঠিকই আছে।

এখন আসুন প্রোগ্রামটা ঠিক করে ফেলা যাক। বাংলাদেশী খাবারের নমুনা হিসাবে খিচুড়ি খাওয়ানো হবে। খিচুড়ির শেষে দেওয়া হবে পান-সুপারি।

পান-সুপারি পাবে কোথায়?

শিকাগো থেকে আসবে। ইন্ডিয়ান শপ আছে–ওরা পাঠাবে। ডলার পাঠিয়ে চিঠি দিয়ে দিয়েছি।

খুব ভালো।

দেশ সম্পর্কে একটা বক্তৃতা দেয়া হবে। বক্তৃতার শেষে প্রশ্ন-উত্তর পর্ব।

সবার শেষে জাতীয় সঙ্গীত।

জাতীয় সঙ্গীত গাইবে কে?

কেন, আমি আর আপনি।

তুমি পাগল হয়েছ? জীবনে আমি কোনোদিন গান গাইনি।

আর আমি বুঝি হেমন্ত? এইসব চলবে না, হুমায়ুন ভাই। আসুন গানটা একবার প্রাকটিস করি।

মিজান, মরে গেলেও আমাকে দিয়ে গান গাওয়াতে পারবে না। তাছাড়া এই গানটার আমি কথা জানি না, সুর জানি না।

কথা সুর তো আমিও জানি না হুমায়ূন ভাই। চিন্তা নেই, একটা ব্যবস্থা হবেই।

উৎসবের দিন ভোর বেলাতে আমরা প্রকাণ্ড সসপ্যানে খিচুড়ি বসিয়ে দিলাম। চাল, ডাল, আনাজপাতি সেদ্ধ হচ্ছে। দুটো মুরগি কুচি কুচি করে ছেড়ে দেয়া হলো। এক পাউন্ডের মতো কিমা ছিল তাও ঢেলে দিলাম। যত ধরনের গরম মসলা ছিল সবই দিয়ে দিলাম। জ্বাল হতে থাকল।

মিজান বলল, খিচুড়ির আসল রহস্য হলো মিক্সিং-এ। আপনি ভয় করবেন। জিনিস ভালোই দাঁড়াবে।

সে একটা খুন্তি দিয়ে প্রবল বেগে নাড়াতে শুরু করল। ঘণ্টা দুয়েক পর যা দাঁড়াল তা দেখে বুকে কাঁপন লাগে। ঘন সিরাপের মতো একটা তরল পদার্থ। উপরে আবার দুধের সরের মতো সর পড়েছে। জিনিসটার রঙ দাঁড়িয়েছে ঘন কৃষ্ণ। মিজান শুকনো গলায় বলল, কালো হলো কেন বলুন তো হুমায়ূন ভাই। কালো রঙের কিছুই তো দেইনি।

আমি সেই প্রশ্নের জবাব দিতে পারলাম না। মিজান বলল, টমেটো পেস্ট দিয়ে দেব নাকি?

দাও।

টমেটো পেস্ট দেয়ায় রঙ আরো কালচে মেরে গেল। মিজান বলল, লাল রঙয়ের কিছু পুড কালার কিনে এনে ছেড়ে দেব?

দাও।

তাও দেয়া হলো। এতে কালো রঙের কোনো হেরফের হলো না। তবে মাঝে মাঝে লাল রঙ ঝিলিক দিতে লাগলো। দুজনেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। জাতীয় সংগীতেরও কোনো ব্যবস্থা হলো না। মিজানের গানের গলা আমার চেয়েও খারাপ। যখন গান ধরে মনে হয় গলায় সর্দি নিয়ে পাতিহাঁস ডাকছে। শিকাগো থেকে পানও এসে পৌঁছল না।

অনুষ্ঠান সন্ধ্যায়। বিকেলে এক অদ্ভুত ব্যাপার হলো। অবাক হয়ে দেখি দূর দূর থেকে গাড়ি নিয়ে বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা আসতে শুরু করেছে। শুনলাম মিজান নাকি অশপাশের যত ইউনিভার্সিটি আছে সব ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশ নাইটের খবর দিয়ে চিঠি দিয়েছিল। দেড় হাজার মাইল দূরে মন্টানো স্টেট ইউনিভার্সিটি, সেখান থেকে একটি মেয়ে গ্রে হাউন্ড বাসে করে একা একা চলে এসেছে। মিনেসোটা থেকে এসেছে দশজনের একটা বিরাট দল। তারা সঙ্গে নানান রকম পিঠা নিয়ে এসেছে। গ্রান্ড ফোকস থেকে এসেছেন করিম সাহেব, তাঁর ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রী! এই অসম্ভব কর্মঠ মহিলাটি এসেই আমাদের খিচুড়ি ফেলে দিয়ে নতুন খিচুড়ি বসালেন। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে সাউথ ডাকোটার ফলস স্প্রিং থেকে একদল ছেলেমেয়ে এসে উপস্থিত হল।

মিজান আনন্দে লাফাবে না চেচাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। চুপচাপ বসে আছে, মাঝে মাঝে গম্ভীর গলায় বলছে–দেখ শালা বাংলাদেশ কী জিনিস। শালা দেখে যা।

অনুষ্ঠান শুরু হল দেশাত্মবোধক গান দিয়ে।

–এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি…।

অন্যান্য স্টেট থেকে মেয়েরা যারা এসেছে তারাই শুধু গাইছে। এত সুন্দর গাইছে। এই বিদেশ-বিভূইয়ে গান শুনে দেশের জন্যে আমার বুক হু-হু করতে লাগল। চোখে জল এসে গেল। কেউ যেন তা দেখতে না পায় সে জন্যে মাথা নিচু করে বসে রইলাম।

পরদিন ফার্গো ফোরম পত্রিকায় বাংলাদেশ নাইট সম্পর্কে একটা খবর ছাপা হ’ল। খবরের অংশবিশেষ এ রকম–একটি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ জাতির অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। অনুষ্ঠানটি শুরু হয় দেশের গান দিয়ে। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম গান শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশী ছেলেমেয়েরা সব কাঁদতে শুরু করল। আমি আমার দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতা-জীবনে এমন মধুর দৃশ্য দেখিনি…।

কিসিং বুথ

অমেরিকানদের বিচিত্র কাণ্ডকারখানার গল্প বলার সময় কিসিং বুথের গল্পটা আমি খুব আগ্রহ করে বলি। শ্রোতারা চোখ বড় বড় করে শোনে। যুবক বয়েসীরা গল্প শেষ হবার পর মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হয়ত-বা ভাবে, আহা তারা কী সুখেই না আছে।

গল্পটা বলা যাক।

আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে “হোম কামিং” বলে একটি উৎসব হয়। এই উৎসবে আনন্দ মিছিল হয়, হৈচৈ গান-বাজনা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচে সুন্দরী ছাত্রীটিকে হোম কামিং কুইন নির্বাচিত করা হয়। এই হোম কামিং রানীকে ঘিরে সারাদিন ধরে চলে আনন্দ-উল্লাস।

আমার আমেরিকাবাসের প্রথম বর্ষে হোম কামিং কুইন হলো আণ্ডার-গ্রাজুয়েট ক্লাসের এক ছাত্রী। স্পেনিশ আমেরিকান, রূপ ফেটে পড়ছে। কিছুক্ষণ এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে বুকের মধ্যে এক ধরনের হাহাকার জমে উঠতে থাকে, জগৎ-সংসার তুচ্ছ বোধ হয়। সম্ভবত এই শ্রেণীর রূপবর্তীদের প্রসঙ্গেই বলা হয়েছে, মুনীগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল।

মেয়েটিকে নিয়ে ভোর এগারোটার দিকে একটা মিছিল বের হ’ল। আমার ইচ্ছা করল মিছিলে ভীড়ে যাই। শেষ পর্যন্ত লজ্জা লাগল। ল্যাবরেটরিতে চলে এলাম। অনেকগুলি স্যাম্পল জমা হয়েছে। এদের এক্সরে ডিফেকশান প্যাটার্ন জানাতে হবে। ডিফ্রেকশান মেশিনটা ভালো কাজ করছে না। ছবি পরিষ্কার আসছে না। দুপুর একটা পর্যন্ত কাজ করলাম। ঠিক করে রাখলাম লাঞ্চ সারার জন্যে আধ ঘণ্টার বিরতি দেব।

মেমোরিয়াল ইউনিয়নে লাঞ্চ খেতে গিয়েছি। লক্ষ করলাম মেমোরিয়াল ইউনিয়নের দোতলায় অস্বাভাবিক ভীড়। কৌতূহলী হয়ে দেখতে গেলাম।

জটলা আমাদের হোম কামিং কুইনকে ঘিরেই। এই রূপবতী বড় বড় পোস্টার সাজাচ্ছে। পোস্টারগুলিতে লেখা : নীল তিমিরা আজ বিপন্ন। নীল তিমিদের বাঁচান।

জানা গেল এই হোম কামিং কুইন–নীল তিমিদের বাঁচাও–সংঘের একজন কর্মী। সে আজ নীল তিমিদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করবে।

নীল তিমিদের ব্যাপারে আমি তেমন কোনো আগ্রহ বোধ করলাম না। মানুষই যেখানে বিপন্ন সেখানে নীল তিমি নিয়ে লাফালাফি করার কোনো অর্থ হয় না। তবু দাঁড়িয়ে আছি। রূপবতী মেয়েটির আনন্দোজ্জ্বল মূর্তি দেখতে ভালো লাগছে।

আমি লক্ষ করলাম, কাঠগড়ার মতো একটা বেষ্টনী তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে লাল কালিতে ঠোঁটের ছবি এঁকে নিচে লেখা হ’ল “কিসিং বুথ”-চুম্বন কক্ষ। তার নিচে লেখা চুমু খাবার নিয়মকানুন।

(১) জড়িয়ে ধরবেন না, মুখ বাড়িয়ে চুমু খান।

(২) চুমু খাবার সময় খুবই সংক্ষিপ্ত।

(৩) প্রতিটি চুমু এক ডলার।

(৪) চেক গ্রহণ করা হবে না। ক্যাশ দিতে হবে।

(৫) বড় নোট গ্রহণযোগ্য নয়।

ব্যাপারটা কী কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার পাশে দাঁড়ানো আমেরিকান ছাত্র বুঝিয়ে দিল।

হোম কামিং কুইন কিসিং বুথে দাঁড়িয়ে থাকবে। অন্যরা তাকে চুমু খাবে এবং প্রতিটি চুমুতে এক ডলার করে দেবে। সেই ডলার চলে যাবে নীল তিনি বাঁচাও ফান্ডে।

আমি হতভম্ব।

প্রথমে মনে হলো পুরো ব্যাপারটাই হয়ত এক ধরনের রসিকতা। আমেরিকানরা রসিকতা পছন্দ করে। এটাও বোধ হয় মজার রসিকতা।

দেখা গেল ব্যাপারটা মোটেই রসিকতা নয়। মেয়েটি কিসিং বুথে দাঁড়িয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে লাইন। এক একজন এগিয়ে আসছে, ডলার দিচ্ছে, মেয়েটিকে চুমু খেয়ে সরে যাচ্ছে, এগিয়ে আসছে দ্বিতীয় জন। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছি।

মেয়েটির মুখ হাসি হাসি। তার নীল চোখ ঝকমক করছে। যেন পুরো ব্যাপারটায় সে খুবই আনন্দ পাচ্ছে। আনন্দ ছেলেরাও পাচ্ছে। একজনকে দেখলাম দশ ডলারের একটা নোট দিয়ে পর পর দশবার চুমু খেল। এতেও তার স্বাদ মিটল না। মানি ব্যাগ খুলে বিশ ডলারের আরেকটি নোট বের করে উঁচু করে সবাইকে দেখাল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড হাত তালি, যার মানে চালিয়ে যাও।

ইউনিভার্সিটির মেথর, ঝাড়ুদার এরাও ডলার নিয়ে এগিয়ে এল। এরা বেশ গম্ভীর। যেন কোনো পবিত্র দায়িত্ব পালন করছে। চুমু খেল খুবই শালীন ভঙ্গিতে মন্দিরের দেবীমূর্তিকে চুমু খাবার ব্যবস্থা থাকলে হয়ত এভাবেই খাওয়া হত।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারতীয় ছাত্ররা চলে এল। এরী চুমু খাবার লাইনে দাঁড়াল না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে জটলা পাকাতে লাগল। এ ওকে ঠেলাঠেলি করছে। কেউ যেতে চাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত একজন এগিয়ে এল, এর নাম উমেশ। বোম্বের ছেলে। মানুষ যে বানর থেকে এসেছে এটা উমেশকে দেখলেই বোঝা যায়। তার জন্যে ডারউইনের বই পড়তে হয় না। উমেশ চুমু খাবার পর পরই অন্য ভারতীয়দের লজ্জা ভেঙে গেল। তারাও লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। আমি ল্যাবোরেটরিতে চলে এলাম। আমার প্রফেসর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই এক্সরের কাজ কী হচ্ছে তার খোঁজ নিতে এলেন। ডিফেকশন পাটার্ন দেখতে দেখতে বললেন, তুমি কি এ মেয়েটিকে চুমু খেয়েছ?

আমি বললাম, না।

না কেন? মাত্র এক ডলারে এমন রূপবতী একটি মেয়েকে চুমু খাবার সুযোগ নষ্ট করা কি উচিত?

আমি বললাম, এভাবে চুমু খাওয়াটা আমাদের দেশের নীতিমালায় বাধা আছে।

বাধা কেন? চুমু হচ্ছে ভালোবাসার প্রকাশ। তুমি যদি তোমার শিশুকন্যাকে প্রকাশ্যে চুমু খেতে পার তাহলে একটি তরুণীকে চুমু খেতে পারবে না কেন? মূল ব্যাপারটা হচ্ছে ভালোবাসা।

আমি বললাম, এই মেয়েটির ব্যাপারে তো ভালোবাসার প্রশ্ন আসছে না।

তিনি অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, আসবে না কেন? এই মেয়েটিকে তুমি হয়তো ভালোবাসছ না, কিন্তু তার রূপকে তুমি ভালোবাসছ। বিউটি ইজ টুথ। তাই নয় কি?

আমি চুপ করে রইলাম। তিনি বললেন, একটি নির্জন দ্বীপে যদি তোমাকে এ মেয়েটির সঙ্গে ছেড়ে দেয়া হতো তাহলে তুমি কী করতে? চুপ করে বসে থাকতে?

আমি নিচু গলায় বললাম, মুনীগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল।

অধ্যাপক বিরক্ত গলায় বললেন, এর মানে কি?

আমি ইংরেজীতে তাকে ব্যাখ্যা করে দিলাম। অধ্যাপক পরম প্রীত হলেন।

আমি বললাম, তুমি কি চুমু খেয়ে এসেছ?

না। এখন ভীড় বেশি। ভীড়টা কমলেই যাব।

বিকেল চারটায় এক্সরে টেকনিশিয়ান ছুটে এসে বলল, বসে আছো কেন? এক্ষুণি মেমোরিয়েল ইউনিয়নে চলে যাও। কুইক। কুইক।

কেন?

চারটা থেকে চারটা ত্রিশ, এই আধঘণ্টার জন্যে চুমুর দাম কমানো হয়েছে। এই আধঘন্টার জন্যে ডলারে দুটো করে চুমু।

টেকনিশিয়ান যেমন ঝড়ের গতিতে এসেছিল তেমনি ঝড়ের গতিতেই চলে গেল। আমি গেলাম দেখতে। লাইন এখনও আছে? লাইনের শুরুতেই উমেশকে দেখা গেল। সে মনে হয় লাইনে লাইনেই আজকের দিনটা কাটিয়ে দিচ্ছে। আমার প্রফেসরকেও দেখলাম। এক ডলারের একটা নোট হাতে দাঁড়িয়ে। তিনি আমাকে দেখে হাত ইশারা করে ডাকলেন।

গল্পটা আমি এই জায়গাতে শেষ করে দেই। শ্রোতারা ব্যাকুল হয়ে জানতে চায়, আপনি কি করলেন? দাঁড়ালেন লাইনে

আমি তাদের বলি, আমি লাইনে দাঁড়ালাম কি দাঁড়ালাম না, তা মূল গল্পের জন্যে অনাবশ্যক।

অনাবশ্যক হোক আর না হোক, আপনি দাঁড়ালেন কি না বলুন।

আমি কিছুই বলি না। বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসি। যে হাসির দুরকম অর্থই হতে পারে।

জোছনার ফুল

আমাদের বাসা ছিল সিলেটের মীরাবাজারে।

সাদা রঙের একতলা দালান। চারদিকে সুপারিগাছের সারি। ভেতরের উঠোনে একটি কুয়া। কুয়ার চারপাশ বাঁধানো। বাড়ির ডানদিকে প্রাচীন কয়েকটা কাঁঠালগাছ। কাঁঠালগাছের পাতায় আলো-আঁধারের খেলা। কুয়ার ভেতর উকি মারছে নীল আকাশ। একটু দূরে দুটো আতাফল গাছ। সোনালি রঙের আতাফলে পুরো গাছ সোনালি হয়ে আছে। পাকা আতার লোভে ভিড় করেছে। রাজ্যের পাখি। তাদের সঙ্গে ঝগড়া বেধে গেছে কাকদের। কান পাতা দায়। এমন একটা রহস্যময় পরিবেশে আমার শৈশবের শুরু। শুরুটা খুব খারাপ না। তবু শৈশবের কথা মনে হলেই প্রথমে কিছু দুঃখময় স্মৃতি ভিড় করে। কিছুতেই তাদের তাড়াতে পারি না। সেগুলো দিয়েই শুরু করি।

একদিন কী যেন একটা অপরাধ করেছি। কাপ ভেঙে ফেলেছি কিংবা পাশের ডির জানালায় ঢিল মেরেছি। অপরাধের শাস্তি দেয়া হবে। মা শাস্তির ভার নে আমার মেজো চাচাকে। তিনি আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। সিলেটে এম. & কলেজে আই. এ. পড়তেন এবং প্রতি বছর ফেল করতেন। মেজো চাচা আমাকে শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করলেন। আমাকে একহাতে শূন্যে ঝুলিয়ে কুয়ার মুখে ধরে বললেন, দিলাম ছেড়ে।

আমার সমস্ত শরীর ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। সত্যি যদি ছেড়ে দেন! নিচে গহিন কুয়া। একটা হাত ধরে আমাকে কুয়ার ভেতর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। মেজো চাচা মাঝে মাঝে এমন ভঙ্গি করছেন যেন আমাকে সত্যি সত্যি ছেড়ে দিচ্ছেন। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আর কোনোদিন করব না। আর কোনোদিন না।

আমার বয়স তখন কত? পাঁচ কিংবা ছয়। নিতান্তই শিশু। এরকম একটা শিশুকে কুয়ায় ঝুলিয়ে যে-ভয়ংকর মানসিক শাস্তি মেজো চাচা দিলেন তা ভাবলে আমি আজও আতঙ্কে নীল হয়ে যাই। লিখতে লিখতে চোখের সামনে সেই অতলস্পর্শী কুয়া ভেসে উঠছে। বুক ধড়ফড় করা শুরু হয়েছে।

আমার মেজো চাচা কিংবা আমার মা দুজনের কেউই বুঝলেন না একটি শিশুকে এইভাবে মানসিক শাস্তি দেয়া যায় না। এটা অমানবিক। এ-ধরনের শান্তিতে শিশুর মনোজগতে বড় রকমের বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। বরং তারা দুজনই দেখলেন–আমি একটিমাত্র জিনিসকেই ভয় পাই, সেটা কুয়ায় ঝুলিয়ে ধরা। কাজেই বারবার আমাকে এই শাস্তি দেয়া হতে লাগল।

অসম্ভব দুষ্ট ছিলাম। নানানভাবে সবাইকে জ্বালাতন করতাম। শাস্তি আমার প্রাপ্য ছিল, কিন্তু এত কঠিন শাস্তি না, যে-শান্তি চিরকালের মতো আমার মনে ছাপ ফেলে যাবে।

আমাকে এই অমানবিক নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করে আমার ছোট বোন শেফু। তাকেও একদিন এই শাস্তি দেয়া হল। মেজো চাচা তাকে কুয়ার ভেতর ঝুলিয়ে দিয়ে বললেন, দিলাম ছেড়ে।

সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, দেন ছেড়ে।

চাচা বললেন, সত্যি সত্যি ছেড়ে দেব?

সে থমথমে গলায় বলল, ছাড়েন। আপনাকে ছাড়তে হবে।

শেফুর কথাবার্তায় আমার চাচা এবং মা দুজনই খুব মজা পেলেন। বাবা অফিস থেকে ফেরামাত্র তাকে এই ঘটনা বলা হল। বাবা অবাক হয়ে বললেন, এদের এইভাবে শাস্তি দেয়া হয়? কই, আমি তো জানি না! কী ভয়ংকর কথা! এই জাতীয় শাস্তির কথা আর যেন কোনোদিন না শুনি।

মা বললেন, এরা বড় যন্ত্রণা করে। তুমি তো বাসায় থাক না। তুমি জান না।

বাবা কঠিন গলায় বললেন, এ-ধরনের শাস্তির কথা আর যেন না শুনি।

শাস্তি বন্ধ হল, কিন্তু মন থেকে স্মৃতি মুছল না। কতদিন পার হয়েছে, অথম এখনও দুঃস্বপ্নের মতো গহিন কুয়াটার কথা মনে পড়ে। প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, আমার এই চাচা শুধু শাস্তিদাতাই ছিলেন না, প্রচুর আদরও তাঁর কাছে পেয়েছি। আমার অক্ষরজ্ঞানও হয়েছে তাঁর কাছে।

কুয়ার হাত থেকে বাঁচলেও মাকড়সার হাত থেকে বাঁচলাম না। মাকড়সার ব্যাপারটি বলি। কোনো-এক বিচিত্র এবং জটিল কারণে আমাদের ছ ভাইবোনেরই ভয়ংকর মাকড়সাভীতি আছে। নিরীহ ধরনের এই পোকাটিকে দেখামাত্রই আমাদের সবার মনোজগতে একধরনের বিপ্লব ঘটে যায়। আমরা আতঙ্কে ঘৃণায় শিউরে উঠি, বমিভাব হয়, চিৎকার করে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। মনোবিজ্ঞানীরা এই ভীতির নিশ্চয়ই একটা ব্যাখ্যা দেবেন। আমার কাছে কোনো ব্যাখ্যা নেই।

মাকড়সাভীতির মাত্রা বোঝানোর জন্যে আমি আমাদের তিন ভাইবোনের তিনটি ঘটনা উল্লেখ করছি।

আমার ছোট বোন শেফু কলেজে অধ্যাপনা করে। একদিন রিকশা করে ক্লাসে যাচ্ছে, হঠাৎ রিকশা থেকে একটা মাকড়সা তার শাড়িতে উঠে পড়ল। সে লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নেমে অসংখ্য মানুষের দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে শাড়ি খুলে দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, মাকড়সা! আমার শাড়িতে মাকড়সা! লোকজন হৃদয়হীন নয়। তারা শাড়ি থেকে মাকড়সা সরিয়ে হাতে শাড়ি তুলে দিল।

দ্বিতীয় ঘটনাটি আমার ছোট ভাই ডঃ জাফর ইকবালকে নিয়ে। সে শিকাগো বাস-স্টেশনের টয়লেটে গেছে। হঠাৎ লক্ষ্য করল ইউরিন্যালে সবুজ রঙের একটা বড়সড় মাকড়সা। সে বিকট একটা চিৎকার দিয়ে বের হয়ে এল। লোকজন দৌড়ে এল, পুলিশ ছুটে এল, সবার ধারণা কোনো ধুনটুন হয়ে গেছে।

এবার আমার নিজের কথা বলি। ঢাকা থেকে বরিশাল যাচ্ছি। বি এম কলেজে রসায়নশাস্ত্রের এম. এস-সি, পরীক্ষার এক্সটারন্যাল হয়ে। প্রথম শ্রেণীর একটি কেবিন রিজার্ভ করা। রাত দশটার মতো বাজে। হঠাৎ দেখি কেবিনের ছাদে বিশাল এক মাকড়সা পেটে ডিম নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। আমি ছিটকে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। দশ টাকা কবুল করে একজন ঝাড়ুদার নিয়ে এলাম। সে অনেক খুঁজেও মাকড়সা পেল না, কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছে। কেবিনে আর ঢুকলাম না। যদি মাকড়সা আবার কোনো অন্ধকার কোণ থেকে তার হয়ে আসে। প্রচণ্ড শীতের রাত পার করে দিলাম ডেকে হাঁটাহাঁটি করে। সতবার মাকড়সার কথা মনে পড়ল ততবারই শিউরে উঠতে লাগলাম।

এই ভীতি আমরা ভাইবোনেরা জন্মসূত্রে নিয়ে এসেছি। হয়তোবা আমাদের র ছয়চল্লিশটির ক্রমোজমের কোনো-একটিতে কোনো গণ্ডগোল আছে যার কারণে এই অস্বাভাবিক ভীতি।

শৈশবে আমাকে ঘুম-পাড়ানোর জন্যে এই মাকড়সাভীতিও কাজে লাগানো হত।

অধিকাংশ শিশুর মতো আমারও রাতে ঘুম আসত না। মা বিরক্ত হয়ে মেজো চাচাকে বলতেন, ওকে ঘুম পাড়িয়ে আন।

মেজো চাচা আমাকে কোলে নিয়ে চলে যেতেন বাড়ির দক্ষিণে কাঁঠালগাছের কাছে। সেই কাঁঠালগাছে বিকটাকার মাকড়সা জাল পেতে চুপচাপ বসে থাকত। আমাকে সেইসব মাকড়সার কাছে নিয়ে গিয়ে বলা হত-ঘুমাও। না ঘুমালে মাকড়সা গায়ে দিয়ে দেব। আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়তাম। এখন আমার ধারণা, ঘুম না, ভয়ে হয়তোবা অচেতনের মতো হয়ে যেতাম। কেউ তা বুঝতে পারত না। ভাবত ঘুম-পাড়ানোর চমৎকার অষুধ তাদের কাছে আছে।

এখন ভাবলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। না বুঝে বয়স্ক মানুষরা নিতান্তই অবোধ একটি শিশুর উপর কী ভয়াবহ নির্যাতনই-না চালিয়েছেন!

আমি ছেলেবেলার কথা লিখব বলে স্থির করার পর আমার সব আত্মীয়স্বজনকে চিঠি লিখে জানালাম—আমার ছেলেবেলা সম্পর্কে কেউ যদি কোনোকিছু জানেন আমাকে যেন লিখে জানান। আমার এই আহ্বানের জবাবে ছোট চাচা ময়মনসিংহ থেকে যে-চিঠি লিখলেন তার অংশবিশেষ এইরকম-হুমায়ূন শৈশবে বড়ই দুষ্ট প্রকৃতির ছিল। রাত্রিতে কিছুতেই ঘুমাইত না। তখন তাহাকে মাকড়সার কাছে নিয়া গেলে দুই হাতে গলা জড়াইয়া সঙ্গে সঙ্গে ঘুমে অচেতন হইয়া যাইত। ইহার কি যে কারণ কে জানে।

কুয়া এবং মাকড়সা এ দুটি জিনিস বাদ দিলে আমার শৈশবকে অসাধারণ আনন্দময় সময় বলা যায়। আমার ছিল পূর্ণ স্বাধীনতা। আজকালকার মায়েরা সন্তান চোখের আড়াল হলেই চোখ কপালে তুলে হৈচৈ শুরু করে দেন। আমাদের সময় অবস্থা ভিন্ন ছিল। শিশুদের খোঁজ পড়ত শুধু খাওয়ানোর সময়। তাদের পড়াশোনা নিয়েও বাবা-মাদের খুব দুশ্চিন্তা ছিল না। একটি শিশুশিক্ষা এবং ধারাপাতের চটি একটা বই এবং স্লেট-পেনসিল কিনে দিলেই বাবা-মারা মনে করতেন অনেক করা হল। বাকি পড়াশোনা ধীরেসুস্থে হবে, এমন তাড়া কিসের?

ক্লাস ওয়ান টুর পরীক্ষাগুলিতে ফার্স্ট হতে হবে এমন কোন কথা নেই। পাশ করে পরের ধাপে উঠতে পারলেই হল। না পারলেও ক্ষতি নেই, পরের বার উঠবে। স্কুলতো পালিয়ে যাচ্ছে না। পুরো ব্যাপারটায় এক ধরনের ঢিলেঢালা ভাব।

এমনিতেই নাচুনি বুড়ি তার উপর ঢাকের বাড়ি। বাবা আদেশ জারি করলেন তার ছেলেমেয়েদের যেন পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো চাপ না দেয়া। পড়াশোনার জন্যে সারাজীবন তো পড়েই রইল, শিশুকালটা আনন্দে কাটুক। মহানন্দে সময় কাটতে লাগল। শিশুদে্র আনন্দের উপকরণ চারদিকে ছড়ানো। অতি তুচ্ছ বিষয় থেকেও তারা আনন্দ আহরণ করে। আমিও তাই করছি আমার মার কোলে তখন আমার ভাই ইকবাল। মা তাকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। আমার দিকে তাকানোর সময় নেই। আমি মনের আনন্দে একা একা ঘুরি। যা দেখি তা-ই ভালো লাগে। ক্লান্তিহীন হাঁটা? মাঝে মাঝে পথ হারিয়ে ফেলি। তখন একে তাকে জিজ্ঞেস করতে হয় মীরাবাজার কোন দিকে?

আমার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতেও বাসায় কাউকে কখনো চিন্তিত হতে দেখিনি দুপুরে খাবার সময় উপস্থিত থাকলেই হল। দুপুরের খাবার শেষ হবার পর আরও আনন্দ। মা দিবানিদ্রায়। ঝিমধরা দুপুর। আমি ঘুরছি নিজের মনের আনন্দে এই পর্যায়ে একজন আইসক্রিম ওয়ালার সঙ্গে আমার খাতির হয়ে গেল। তখনকার আইসক্রিমওয়ালারা দুহাতে দুটা আইসক্রিমের বাক্স নিয়ে মধুর গলায় ডাকত~~দুধমালাই আইসক্রিম, দুধমালাই।

দুরকম আইসক্রীম ছিল। দুপয়সা দামের সাধারণ আর এক আনা দামের অসাধারণ। আইসক্রীম খাবার পরম সৌভাগ্য মাসে একবারের বেশী হত না। হবার কথাও নয়। যাই হোক এমনি এক ঝিম ধরা দুপুরে চাই দুধমালাই আইসক্রিম শুনে ছুটে ঘর থেকে বের হলাম। আইসক্রীমওয়ালা বলল, আইসক্রিম কিনবে?।

আমি মনের দুঃখ মনে চেপে বললাম, না। পয়সা নাই। আইসক্রিমওয়ালা কিছুক্ষণ কী জানি ভেবে বলল, খাও একটা আইসক্রিম, পয়সা লাগবে না।

আমার তখন বিস্মিত হবার ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে গেছে। কী বলে এই লোক? না চাইতেই দিয়ে দিচ্ছে কোহিনূর হীরা! লোকটি একটা আইসক্রিম বের করে হাতে দিয়ে বলল, আরাম করে খাও। আমি বসে বসে দেখি।

সে উবু হয়ে বসল। আমি অতি দ্রুত আইসক্রিম শেষ করলাম। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হতে পারে। দেখল না। রোজ এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে লাগল। ঠিক দুপুরবেলা সমস্ত মীরাবাজারের মায়েরা যখন ঘুমে অচেতন তখন সে আসে। চাপা গলায় ডাকে, এই খোকা, এই!

আমি ছুটে বের হয়ে আসি। সে আইসক্রীম বের করে দেয়। আমি মহানন্দে খাই। খেতে খেতে মনে হয় আমার মানব জনম সার্থক হল। পুরো এক মাস ধরে এই ব্যাপার বলল। তারপর মা কি করে জানি টের পেলেন। তিনি আঁতকে উঠলেন, তার ধারণা এ ছেলেধরা। বাসায় সবারই ভয় আমাকে নিয়ে যাবে। বাবাকে খবর দিলেন। তিনিও চিন্তিত হলেন এবং অফিস বাদ দিয়ে এক দুপুরে বাসায় বসে রইলেন। আইসক্রীমওয়ালাকে ধরতে হবে। বেচারা ধরা পড়ল।

বাবা তাঁর পুলিশী গলায় কঠিন ধমক দিলেন। মেঘ স্বরে বললেন, তুমি একে রোজ আইসক্রীম খাওয়াও, কারণটা কি?

এমনি খাওয়াই স্যার, কোন কারণ নাই।।

বিনা কারণে কিছুই হয় না— তুমি কারণ বল।

আইসক্রীমওয়ালা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। বাবার হাজারো প্রশ্নের জবাব দিল না। বাবা পুরো মাসে ত্রিশটি আইসক্রীম হিসাব করে তাকে দাম দিয়ে দিলেন এবং বললেন, আর কখনো যেন সে না আসে। সে টাকা নিয়ে চলে গেল কিন্ত পরদিনই আবার এল। একটা দুধ মালাই আইসক্রীম বের করে নীচুগলায় বলল, খোকা তুমি খাও। আর তোমার সংগে আমার দেখা হবে না। আমি আইসক্রীম বেচা ছেড়ে দিব।

আমি চিন্তিত স্বরে বললাম, কেন?

সে তার জবাব না দিয়ে কোমল গলায় বলল, খোকা, আমার কথা মনে থাকবে?

মানুষকে দেয়া বেশির ভাগ কথাই আমি রাখতে পারিনি। কিন্তু হত দরিদ্র আইসক্রিমওয়ালার কথা আমি মনে রেখেছি। এখনও মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি কি জন্যে সে বিনাপয়সায় আমাকে আইসক্রিম খাওয়াত? আমার বয়েসি কোনো ছেলে কি তার ছিল যে অল্প বয়সে মারা গেছে? দরিদ্র পিতা তার স্নেহ ঢেলে দিয়েছে অচেনা একটি শিশুকে? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?

রহস্যময় এই পৃথিবীতে কিছু-কিছু ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। প্রায় তিরিশ বছর পর আইসক্রিম খাওয়ার ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি হল। তখন শ্যামলীতে থাকি। আইসক্রিমওয়ালা এসেছে। আমার বড় মেয়ে নোভা আমার কাছ থেকে দুটো টাকা নিয়ে ছুটে গেল আইসক্রিম কিনতে। আইসক্রিম-হাতে হাসিমুখে ফিরে এসে বলল, আইসক্রিম ওয়ালা আমার কাছ থেকে টাকা নেয়নি। বিনা টাকায় আইসক্রিম দিল। বলল, টাকা দিতে হবে না।

আমার স্ত্রী চমকে উঠে বলল, নির্ঘাত ছেলেধরা! তুমি এক্ষুনি নিচে যাও।

আমি নিচে গেলাম না। ছেলেবেলার সেই আইসক্রিমওয়ালার কথা ভেবে বড়ই মন কেমন করতে লাগল।

শীতের শুরুতে আমার আনন্দময় আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা যেতে লাগল। শুনলাম আমি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পুরোপুরি বাঁদর হয়ে গেছি। প্যান্ট পরা বলে লেজটা দেখা যায় না। প্যান্ট খুলে ফেললে লেজও দেখা যাবে। আমার বাঁদরজীবনের সমাপ্তি ঘটানোর জন্যই আমাকে নাকি স্কুলে ভরতি করিয়ে দেয়া হবে। আমার প্রথম স্কুলে যাওয়া উপলক্ষে একটা নতুন খাকি প্যান্ট কিনে দেয়া হল। সেই প্যান্টের কোনো জীপার নেই। সারাক্ষণ হাঁ হয়ে থাকে। অবশ্যি তা নিয়ে আমি খুব-একটা উদ্বিগ্ন হলাম না। নতুন প্যান্ট পরছি—এই আনন্দেই আমি আত্মহারা।

মেজো চাচা আমাকে কিশোরীমোহন পাঠশালায় ভরতি করিয়ে দিয়ে এলেন এবং হেডমাস্টার সাহেবকে বললেন চোখে-চোখে রাখতে হবে। বড়ই দুষ্ট।

আমি অতি সুবোধ বালকের মতো ক্লাসে গিয়ে বসলাম। মেঝেতে পাটি পাতা। সেই পাটির উপর বসে পড়াশোনা। ছেলেমেয়ে সবাই পড়ে। মেয়েরা বসে প্রথম দিকে, তাদের পেছনে ছেলেরা। আমি খানিকক্ষণ বিচার-বিবেচনা করে সবচে রূপবতী বালিকার পাশে ঠেলেঠুলে জায়গা করে বসে পড়লাম। রূপবতী বালিকা অত্যন্ত হৃদয়হীন ভঙ্গিতে তুই তুই করে সিলেটি ভাষায় বলল, এই, তোর প্যান্টের ভেতরের সবকিছু দেখা যায়।

ক্লাসের সবকটা ছেলেমেয়ে একসঙ্গে হেসে উঠল। মেয়েদের আক্রমণ করা অনুচিত বিবেচনা করে সবচে উচ্চস্বরে যে-ছেলেটি হেসেছে, তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। হাতের কনুইয়ের প্রবল আঘাতে রক্তারক্তি ঘটে গেল। দেখা গেল ছেলেটির সামনের একটি দাঁত ভেঙে গেছে। হেডমাস্টার সাহেব আমাকে কান ধরে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দিলেন। ছাত্রছাত্রীদের উপদেশ দিলেন—এ মহাগুণ্ডা, তোমরা সাবধানে থাকবে। খুব সাবধান। পুলিশের ছেলে গুণ্ডা হওয়াই স্বাভাবিক।

ক্লাস ওয়ান বারোটার মধ্যে ছুটি হয়ে যায়। এই দুই ঘণ্টা আমি কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার সময়টা যে খুব খারাপ কাটল তা নয়। স্কুলের পাশেই আনসার ট্রেনিং ক্যাম্প। তাদের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। লেফট রাইট, লেফট রাইট। দেখতে বড়ই ভালো লাগছে। মনেমনে ঠিক করে ফেললাম, বড় হয়ে আনসার হব।

ক্লাসে দ্বিতীয় দিনেও শাস্তি পেতে হল। মাস্টারসাহেব অকারণেই আমাকে শাস্তি দিলেন। সম্ভবত প্রথম দিনের কারণে আমার উপর রেগে ছিলেন। তিনি মেঘস্বরে বললেন, গাধাটা মেয়েদের সঙ্গে বসে আছে কেন? এই, তুই কান ধরে দাঁড়া।

দ্বিতীয় দিনেও সারাক্ষণ কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার, তৃতীয় দিনেও একই শাস্তি। তবে এই শাস্তি আমার প্রাপ্য ছিল। আমি একটা ছেলের স্লেট ভেঙে ফেললাম। ভাঙা স্লেটের টুকরায় তার হাত কেটে গেল। আবার রক্তপাত, আবার কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি।

আমি ভাগ্যকে স্বীকার করে নিলাম। ধরেই নিলাম যে স্কুলের দুঘণ্টা আমাকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। মাস্টারসাহেবেরও ধারণা হল যে আমাকে কানে ধরে সারাক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলে আমি অন্যদের বিরক্ত করার সুযোগ পাব না।

আজকের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি সত্যি আমাকে পাঠশালার প্রথম শ্রেণীটি কান ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কাটাতে হয়েছে। তবে আমি একা ছিলাম না, বেশির ভাগ সময় আমার সঙ্গী ছিল শংকর। (এই শংকর বর্তমানে বাংলাদেশের ছবিতে অভিনয় করে বলে শুনেছি।) সে খানিকটা নির্বোধ প্রকৃতির ছিল। ক্লাসে দুইজন শংকর ছিল। আমি যার কথা বলছি তার নাম মাথামোটা শংকর। মোটা বুদ্ধি অর্থে মাথামোটা নয়, আসলেই শরীরের তুলনায় তার মাথা অস্বাভাবিক বড় ছিল। ক্লাস ওয়ানে সে যতখানি লম্বা ছিল, ক্লাস ফাইভে ওঠার পরও সে ততখানি লম্বাই রইল, শুধু মাথাটা বড় হতে শুরু করল।

ক্লাসে শংকর ছাড়া আমার আর-কোনো বন্ধু জুটল না। সে আমার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে রইল। আমি যেখানে যাই সে আমার সঙ্গে আছে। মারামারিতে সে আমার মতো দক্ষ নয়, তবে মারামারির সময় দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে আঁ-আঁ ধরনের গরিলার মতো শব্দ করে প্রতিপক্ষের দিকে ছুটে যেত। এতেই অনেকের পিলে চমকে যেত।

শংকরকে নিয়ে শিশুমহলে আমি বেশ ত্রাসের সঞ্চার করে ফেলি।

এই সময় স্কুলে কিছুদিনের জন্যে কয়েকজন ট্রেনিং-স্যার এলেন। ট্রেনিং স্যার ব্যাপারটা কী আমরা কিছুই জানি না। হেডস্যার শুধু বলে গেছেন, নতুন স্যাররা আমাদের কিছুদিন পড়াবেন। দেখা গেল নতুন স্যাররা বড়ই ভালো। পড়া না পারলেও শাস্তি দেবার বদলে মিষ্টি করে হাসেন। হৈচৈ করলেও ধমকের বদলে করুণ গলায় চুপ করতে বলেন। আমরা মজা পেয়ে আরও হৈচৈ করি। একজন ট্রেনিং-স্যার কেন জানি না সব ছাত্রছাত্রীকে বাদ দিয়ে আমাকে নিয়ে পড়লেন। অদ্ভুত সব প্রশ্ন করেন। আমার যা মনে আসে বলি আর উনি গম্ভীর মুখে বলেন, তোর এত বুদ্ধি হল কী করে? বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার! তোর ঠিকমতো যত্ন হওয়া দরকার। তোকে নিয়ে কী করা যায় তা-ই ভাবছি। কিছু-একটা করা দরকার।

কিছু করার আগেই স্যারের ট্রেনিংকাল শেষ হয়ে গেল। তিনি চলে গেলেন। তবে কেন জানি কিছুদিন পরপরই আমাকে দেখতে আসেন। গভীর আগ্রহে পড়াশোনা কেমন হচ্ছে তার খোঁজ নেন। সব বিষয়ে সবচে কম নম্বর পেয়ে ক্লাস টুতে ওঠার সংবাদ পাবার পর স্যারের উৎসাহে ভাটা পড়ে যায়। শুধু যে উৎসাহে ভাটা পড়ে তা-ই না, উনি এতই মন-খারাপ করেন যে আমার নিজেরও খারাপ লাগতে থাকে।

ক্লাস টুতে উঠে আমি আরেকটি অপকর্ম করি। যে-রূপবতী বালিকা আমার হৃদয় হরণ করেছিল, তাকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলি। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করি বড় হয়ে সে আমাকে বিয়ে করতে রাজি আছে কি না। প্রকৃতির কোনো-এক অদ্ভুত নিয়মে রূপবতীরা শুধু যে হৃদয়হীন হয় তা-ই না, খানিকটা হিংস্র স্বভাবেরও হয়। সে আমার প্রস্তাবে খুশি হবার বদলে বাঘিনীর মতো আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। খামচি দিয়ে হাতের দুতিন জায়গার চামড়া তুলে ফেলে। স্যারের কাছে নালিশ করে। শাস্তি হিসেবে দুই হাতে দুটি ইট নিয়ে আমাকে নীলডাউন হয়ে বসে থাকতে হয়।

প্রেমিকপুরুষদের প্রেমের কারণে কঠিন শাস্তি ভোগ করা নতুন কোনো ব্যাপার নয়, তবে আমার মতো এত কম বয়সে প্রেমের এমন শাস্তির নজির বোধহয় খুব বেশি নেই।

স্কুল আমার ভালো লাগত না। মাস্টাররা অকারণে কঠিন শাস্তি দিতেন। পাঠশালা ছুটির পর বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি যাচ্ছে, এ ছিল প্রাত্যহিক ঘটনা। আমাদের পাঠশালায় প্রথম শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার ব্যবস্থা। কিন্তু একটা ক্লাস থেকে অন্য ক্লাস আলাদা করা নয়, অর্থাৎ কোথাও কোনো পার্টিশনের ব্যবস্থা নেই। কোনো ক্লাসে একজন শাস্তি পেলে পাঠশালার সবাই তা দেখে বিমলানন্দ ভোগ করত। শিক্ষকরাও যে মমতা নিয়ে পড়াতেন, তাও না। তাদের বেশির ভাগ সময় কাটত ছাত্রছাত্রীদের শাস্তি দেয়ার কলাকৌশল বের করার কাজে। পড়ানোর সময় কোথায়? আমার পরিষ্কার মনে আছে, একজন শিক্ষক ক্লাস ফোর-এর একজন ছাত্রের দিকে একবার প্রচণ্ড জোরে ডাক্টার ছুঁড়ে মারেন। ছাত্রটির মাথা ফেটে যায়। অজ্ঞান হয়ে-যাওয়া ছাত্রের মাথায় প্রচুর পানি ঢালাঢালি করে তার জ্ঞান ফেরানো হয়। জ্ঞান ফেরার পর প্রথম যে-প্রশ্নটি তাকে করা হয় তা হচ্ছে, আর এইরকম করবি কোনোদিন?

স্কুলজীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা বলি।

একদিন কাসে গিয়ে দেখি চারদিকে চাপা উত্তেজনা। পড়াশোনা এবং শাস্তি সব বন্ধ। শিক্ষকদের মুখ হাসিহাসি। আমাদের জানানো হল, আমেরিকা নামের এক ধনী দেশ আমাদের দরিদ্র দেশের ছেলেমেয়েদের কিছু সাহায্য দিয়েছে। সেই সাহায্য আমাদের দেয়া হবে।

সাহায্য হিসেবে আমরা সবাই এক টিন গুড়া দুধ এবং এক টিন মাখন পেলাম। দুই হাতে দুই টিন নিয়ে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরে গেলাম। মা বিস্মিত হয়ে বললেন, সবাইকে দিয়েছে?

আমি বললাম, হুঁ। স্যার বলেছেন, পাকিস্তানের সব স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের দুই টিন করে দিয়েছে। মা অবাক বিস্ময়ে বললেন, একটা দেশ কত ধনী হলে এমন সাহায্য দিতে পারে! মা আমেরিকার প্রতি বড়ই কৃতজ্ঞ হলেন। আমরা সকালের নাশতায় রুটি-মাখন খেতে শুরু করলাম।

টিন দুটি শেষ হবার আগেই দ্বিতীয় দফায় আবার পাওয়া গেল। এবং জানা গেল প্রতি মাসে দুবার করে দেয়া হবে। স্কুলের হেডমাস্টার সাহেবের ঘর দুধ এবং মাখনের টিনে ভরতি হয়ে গেল। মার মুখের হাসি আরও বিস্তৃত হল। আমেরিকা নামের সোনার দেশের সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করে তিনি সম্ভবত শোকরানা নামাজও আদায় করলেন।

যদিও হেডস্যারের ঘর ভরতি ছিল দুধ এবং মাখনের টিনে, আমরা আর পেলাম না। হেডমাস্টার সাহেব ঠিক করলেন, ছাত্রদের স্কুলেই দুধ বানিয়ে খাওয়ানো হবে। দুধ বানানোর আনুষঙ্গিক খরচ আছে। চুলা কিনতে হবে, ছাত্রদের জন্যে মগ কিনতে হবে, জ্বালানির খরচ আছে। এইসব খরচ মেটানো হবে মাখনের টিন বিক্রি করে।

দুই-তিনদিন তা-ই হল। বিশাল কড়াইয়ে দুধ জ্বাল দেয়া হল। অতি অখাদ্য সেই দুধ জোর করে আমাদের খাওয়ানো হল। শারীরিক শাস্তির চেয়েও সেই শান্তি ভয়াবহ ছিল। আমরা প্রতিটি ছাত্রছাত্রী মনেপ্রাণে প্রার্থনা করলাম, আল্লাহ, তুমি আমাদের এই দুধের হাত থেকে বাঁচাও!

আল্লাহ শিশুদের প্রার্থনা শুনলেন। শাস্তি বন্ধ হল। দুধ খাওয়ানো শেষ হল। আমাদের শিক্ষকরা সবাই রিকশা ভরতি করে দুধ ও মাখনের টিন বাড়ি নিয়ে গেলেন। আমার বয়স তখন খুবই কম। এই বয়সে দুর্নীতি সম্পর্কে কোনো ধারণা হবার কথা নয়, কিন্তু আমাদের সম্মানিত শিক্ষকরাই সেই ধারণা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিলেন। আমার জীবনে শিক্ষকেরা এসেছেন দুষ্টগ্রহের মতো আমি সারাজীবনে অনেক কিছু হতে চেয়েছি–আইসক্রিমওয়াল, পালিশওয়ালা থেকে ডাক্তার, ব্যারিস্টার—কিন্তু কখনো শিক্ষক হতে চাইনি। বলেই বোধহয় এখন জীবন কাটাচ্ছি শিক্ষকতায়।

প্রথম তুষারপাত

ভিসকোমিটারটা ঠিকমতো কাজ করছিল না। একেক সময় একেক রকম রিডিং দিচ্ছে। আমার সঙ্গে কাজ করে পাল রেইমেন। ভিসকোমিটার কাজ করছে না শুনে সে কোখেকে লম্বা একটা স্কু ড্রাইভার নিয়ে এল এবং পটপট করে ভিসকোমিটারের সব অংশ খুলে ফেলল। আমি মনে মনে বললাম, বাহ বেশ ওস্তাদ ছেলে তো! এত জটিল যন্ত্র অথচ কী অবলীলায় খুলে ফেলল।

আমি বললাম, পল। তুমি কি এই যন্ত্র সম্পর্কে কিছু জান?

পল বলল, না।

আমি অবাক হয়ে বললাম, জান না তাহলে এটা খুলে ফেললে যে?

দেখি ব্যাপারটা কী?

পল ভিসকোমিটারের স্প্রিং খুলে বের করে আনল এবং দু’হাতে কিছুক্ষণ টানাটানি করে বলল–এটা গেছে। বলেই ক্রু ড্রাইভার নিয়ে উঠে চলে গেল। আমি টেবিলের উপর একগাদা যন্ত্রপাতির অংশ ছড়িয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। কী করব কিছু বুঝতে পারলাম না।

আমেরিকানদের এই বিচিত্র অভ্যাসটি সম্পর্কে বলা দরকার। আমি এর নাম দিয়েছি স্কু ড্রাইভার প্রেম। সব আমেরিকানদের পকেটে কয়েক সাইজের স্কু ড্রাইভার থাকে বলে আমার ধারনা। প্রথম সুযোগেই এরা সমস্ত স্কু খুলে ফেলবে।

যন্ত্রপাতি সম্পর্কে আমাদের এক ধরনের ভীতি আছে। ভীতির কারণ আমাদের শৈশব। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি–বাড়িতে হয়ত একটা রেডিও আছে। ছোট ছেলে রেডিও ধরতে গেল। বাবা চেঁচিয়ে উঠবেন, খবরদার হাত দিবি না। মা চেঁচাবেন, খোকন হাত দিও না, ব্যথা পাবে। ছোট্ট খোকনের মনের ভেতর ঢুকে গেল যন্ত্রপাতিতে হাত দেয়া যাবে না। হাত দিলেই খারাপ কিছু ঘটে যাবে। বড় হবার পরেও শৈশবের স্মৃতি থেকেই যায়। ঘরের ফিউজ কেটে গেলেও আমরা একজন মিস্ত্রি ডেকে আনি।

আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি–টেবিলে যন্ত্রপাতির অংশ ছড়িয়ে বসে আছি। মনটা খারাপ, এইসব খুঁটিনাটি জোড়া লাগাব কীভাবে তাই ভাবছি। তখন পল আবার ঘরে ঢুকল। উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, তাড়াতাড়ি বাইরে যাও, তুষারপাত হচ্ছে।

আমাদের সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে বর্ষা। মেঘমেদুর আকাশ। শ্রাবণের ধারা। আষাঢ়ের পূর্ণিমা। তেমনি ইংরেজী সাহিত্যে আছে তুষারপাত ) বিশেষ করে বছরের প্রথম তুষারপাতের বর্ণনা। বছরের প্রথম বৃষ্টি বলে আমাদের কিছু নেই। সারা বছরই বৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষাকালে বেশি, অন্য সময় কম।

এদেশে তুষারপাতের নির্দিষ্ট সময় আছে। সামারে তুষারপাত হবে না। স্প্রিং বা ফলেও হবে না। তুষারপাত হবে শীতের শুরুতে। এবং প্রথম তুষারপাতের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে দীর্ঘ শীতের প্রস্তুতি। ফায়ারিং প্লেস ঠিক করতে হবে। হিটিং সিস্টেম ঠিক আছে কিনা দেখতে হবে। শীতের দিনের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা দেখতে হবে। দিনের পর দিন ঘর বন্দি হয়ে থাকতে হবে, তার জন্যও প্রস্তুতি দরকার। ব্লিজার্ড হতে পারে। ব্লিজার্ড হলে ছ’সাত দিন একনাগাড়ে গৃহবন্দি থাকতে হবে। তারও প্রস্তুতি আছে। দেখতে হবে সেলারে প্রচুর মদের বোতল আছে কি না। পছন্দসই বিয়ারের পেটি কটা আছে। শীতের সিজনে স্কিইং করার পরিকল্পনা থাকলে তার জন্যও প্রস্তুতি দরকার। অনেক কাজ। সব কাজের শুরুর ঘটা হচ্ছে বছরের প্রথম তুষার।

তুষারপাত দেখবার জন্যে ডানবার হলের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি। আকাশ ঘোলাটে। বইপত্রে পড়েছি পেঁজা তুলার মতো তুষার পড়ে। এখন সে রকম দেখলাম না, পাউডারের কণীর মতো গুড়ো গুঁড়ো তুষার পড়ছে। গায়ে পড়া মাত্রই তা গলে যাচ্ছে। খুব যে একটা অপরূপ দৃশ্য তা নয়। তবুও মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি।

দেখতে দেখতে পট পরিবর্তন হলো। শিমুলতুলার মতো তুষার পড়ছে। মনে হচ্ছে মেঘের টুকরো। এই টুকরোগুলি গায়ে পড়া মাত্র গলে যাচ্ছে না। গায়ের সঙ্গে লেগে থাকছে। চেনা এই জায়গা মুহূর্তের মধ্যে অচেনা হয়ে গেল। যেন এটা ডানবার হলের সামনের জায়গা নয়। এটা ইন্দ্রলোকের কো-এক মেঘপুরী।

মাত্র দুঘন্টা সময়ে সমস্ত ফার্গো শহর তুষারে ঢাকা পড়ে গেল। চারদিক সাদা। এই সাদা রঙের কী বর্ণনা দেব? তুষারের সাদা রঙ অন্য সাদার মতো নয়। এই সাদা রঙে একটা হিম ভাব থাকে যা ঠিক কাছে টানে না, একটু যেন দূরে সরিয়ে দেয়। তুষারের শুভ্রতার সঙ্গে অন্য কোনো শুভ্রতার তুলনা চলে না। এই শুভ্রতা অপার্থিব।

ল্যাবরেটরি বন্ধ করে সকাল সকাল হোটেল গ্রেভার ইনে ফিরছি। বাস নিলাম। তুষারের রূপ দেখতে দেখতে যাবো। মাইল দু’এক পথ। কতক্ষণ আর লাগবে?

পথে নেমেই বুঝলাম খুব বড় বোকামি করেছি। রাস্তা অসম্ভব পিছল। পা ফেলা যায় না, তার উপর ঠাণ্ডা। টেম্পারেচার দ্রুত নেমে যাচ্ছে। গায়ে সেই অনুপাতে গরম কাপড় নেই। ঠাণ্ডায় প্রায় জমে যাচ্ছি। তবু ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে সারা পৃথিবী বরফের চাদরে ঢাকা। নিজেকে মনে হচ্ছে ক্যাপটেন স্কট এগুচ্ছি মেরুবিন্দুর খোঁজে। চারদিকের কী অপরূপ দৃশ্য। সুন্দর। সুন্দর!! সুন্দর!!! আবেগে ও আনন্দে আমার চোখ ভিজে উঠল।

“Winter for a moment takes the mind; the snow
Falls past the archlight; icicles guard a wall;
The wind moans through a crack in the window
A keen sparkle of frost is no the sill”

মাথামোটা শংকর এবং গ্রীন বয়েজ ফুটবল ক্লাব

থ্রী থেকে ফোরে উঠব।

বার্ষিক পরীক্ষা এসে গেছে। বাড়িতে বাড়িতে পড়াশোনার ধুম। আমি নির্বিকার। বই নিয়ে বসতে ভালো লাগে না, যদিও পড়তে বসতে হয়। সেই বসাটা পুরোপুরিই ভান। সবাই দেখল, আমি বই নিয়ে বসে আছি, এই পর্যন্তই। তখন প্রতি সন্ধ্যায় সিলেট শহরে মজাদার ব্যাপার হত-তার নাম লেমটন লেচকার। কথাটা বোধহয় লণ্ঠন লেকচার-এর বিকৃত রূপ। ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে করে জায়গায় জায়গায় সিনেমা দেখানো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ম্যালেরিয়া এইসব ভালো ভালো জিনিস। আমাদের কাজের ছেলে রফিক খোঁজ নিয়ে আসে আজ কোথায় লেমটন লেচকার হচ্ছে—মুহূর্তে আমরা দুজন হাওয়া। রফিক তখন আমার বন্ধুস্থানীয়। তার কাছ থেকে বিড়ি খাওয়ার উপর কোর্স নিচ্ছি। বিড়ি খেলে কচি পেয়ারা পাতা চিবিয়ে মুখের গন্ধ নষ্ট করতে হয় এসব গুহ্যবিদ্যা শিখে নিচ্ছি। এই জাতীয় শিক্ষায় আমার আগ্রহের কোনো অভাব দেখা যাচ্ছে না।

লেমটন লেকচারের ভূত আমার ঘাড় থেকে নামানোর অনেক চেষ্টা করা হল। নামানো গেল না। মা হাল ছেড়ে দিলেন। এখন আর সন্ধ্যা হলে পড়তে বসতেও বলেন না। আমি মোটামুটি সুখে আছি বলা চলে।

এমন এক সুখের সময়ে মাথামোটা শংকর খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, তার মা তাকে বলেছেন সে যদি ক্লাস থ্রী থেকে পাশ করে ফোর-এ উঠতে পারে তা হলে তাকে ফুটবল কিনে দেবেন।

সে আমার কাছে এসেছে সাহায্যের জন্য, কী করে এক ধাক্কায় পরের ক্লাসে ওঠা যায়। একটা চামড়ার ফুটবলের আমাদের খুবই শখ। সেই ফুটবল এখন মনে হচ্ছে খুব দূরের ব্যাপার নয়। সেইদিনই পরম উৎসাহে শংকরকে পড়াতে বসলাম। যে করেই হোক তাকে পাশ করাতে হবে। দুজন একই ক্লাসে পড়ি। এখন সে ছাত্র, আমি শিক্ষক। ওকে পড়ানোর জন্যে নিজেকে প্রথম পড়তে হয়, বুঝতে হয়। যা পড়াই কি করে মাথায় ঢোকে না। মনে হয় তার দুই কানে রিফ্লেক্টর লাগানো। যা বলা হয় সেই রিফ্লেক্টরে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে, ভেতরে ঢুকতে পারে না। যাই হোক প্রাণপণ পরিশ্রমে ছাত্র তৈরী হল। দুজন পরীক্ষা দিলাম। ফল বের হলে দেখা গেল আমার ছাত্র ফেল করেছে এবং আমি মকুলের সমস্ত শিক্ষকদের স্তম্ভিত করে প্রথম হয়ে গেছি। ফুটবল পাওয়া যাবে না এই দুঃখে রিপোর্ট কার্ড হাতে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরলাম।

এই রুদ্র ঘটনা বাবাকে খুব মুগ্ধ করল। বাসায় যে-ই আসে বলেন, আমার ছেলের কাণ্ড শুনুন। পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরেছে। কারণ হল…চ

এই ঘটনার আরেকটি সুফল হল বাবা মাকে ডেকে বলে দিলেন-কাজলকে পড়াশোনা নিয়ে কখনো কিছু বলার দরকার নেই। ও ইচ্ছা হলে পড়বে, ইচ্ছা না হলে না। তাকে নিজের মতো থাকতে দাও।

আমি পরিপূর্ণ স্বাধীনতা পেয়ে গেলাম।

এই আনন্দের চেয়েও বড় আনন্দ, বিশেষ বিবেচনায় মাথামোটা শংকরকে প্রমোশন দিয়ে দেয়া হল। তার মা সেই খুশিতে তাকে একটা একনম্বরি ফুটবল এবং পাম্পার কিনে দিলেন।

গ্রীন বয়েজ ফুটবল ক্লাবের প্রতিষ্ঠা হল। আমি ক্লাবের প্রধান এবং শংকর আমার অ্যাসিসটেন্ট। আমাদের বাসার কাজের ছেলে রফিক আমাদের ফুলব্যাক। অসাধারণ খেলোয়াড়।

জননী

ছোট বেলায় আমার ঘর-পালানো রোগ হয়েছিল।

তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। স্কুলের নাম কিশোরীমোহন পাঠশালা। থাকি সিলেটের মীরাবাজারে। বাসার কাছেই স্কুল। দুপুর বারোটায় স্কুল ছুটি হয়ে যায়। বাকি দীর্ঘ সময় কিছুতেই আর কাটে না। আম