আমি একবার ভাবলাম দেখা না করে চলে যাই। পরমুহূর্তেই সেই চিন্তা পাথর চাপা দিয়ে এগিয়ে গেলাম। ইংলিশম্যান আমাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এল।
আমি বললাম, কেমন আছ?
সে বলল, ভাল। মাঝখানে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। এখন ভাল।
‘করছ কি এখন?’
‘বিজনেস করি। বড় ভাই একটা বিজনেসের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।‘
‘কিসের বিজনেস?’
‘ডাই বিজনেস। কাপড়ে রঙ দেয়া হয় যে সেই রঙ।‘
‘একদিন আস আমার বাসায়। ইংলিশম্যান বলল, অবশ্যই যাব। তোমার বাসার ঠিকানা দিয়ে যাও। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, তুমি আমার বাসার ঠিকানা জান না?’
‘না। তুমি তো কখনো বাসার ঠিকানা দাওনি।‘
আমি একটা কাগজে বাসার ঠিকানা লিখে দিলাম। ইংলিশম্যান সেই কাগজের টুকরা পকেটে রাখতে রাখতে বলল, আমি অবশ্যই যাব। আমার বউকে নিয়ে যাব।
আমি বিয়ে করেছি ভাই।
‘কবে বিয়ে করলে?’
‘বেশিদিন হয়নি–মাস চারেক। আমার তো পড়াশোনা কিছুই হয়নি–এদিকে লাবনী জেনারেল হিস্ট্রিতে এ বছর এম. এ. পাস করেছে।‘
‘বাহ, ভাল তো।‘
‘দাঁড়াও তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। ও পনীর কিনতে গেছে। ভাই, তোমার কাছে সিগারেট আছে? আমাকে একটা সিগারেট দাও। লাবনীর জন্যে সিগারেট খেতে পারি না।‘
আমার কাছে সিগারেট ছিল না। আমি দু’টি সিগারেট কিনে নিয়ে এলাম। লাবনীর সঙ্গে পরিচয় হল। শ্যামলা রঙের বড় বড় চোখের মিষ্টি একটা মেয়ে। খুব হাসি-খুশি।
ইংলিশম্যান বলল, হুমায়ূন, আমার খুব ভাল বন্ধু। লাবনী বলল, আপনি ভাল বন্ধু, তাহলে আপনি আমাদের বিয়েতে আসেননি কেন?
.
ইংলিশম্যান সম্পর্কে আমার লেখা এখানে শেষ করতে পারলে ভাল হত। তা পারছি না। তার সঙ্গে আমার আবার দেখা হয় প্রায় দশ বছর পর। সম্পূর্ণ নগ্ন গায়ে সে বসেছিল ফুটপাতে। তার গা ঘেঁষে একটা ঘিয়া রঙের কুকুর। কুকুরটার মুখ শরীরের তুলনায় বড়। ইংলিশম্যানকে দেখলাম কুকুরটাকে খুব আদর করছে।
পরম রহস্যময় এই জগতের কোন রহস্যই কি আমরা পুরোপুরি জানি?
উমেশ
উমেশের সঙ্গে আমার পরিচয় নর্থ ডাকোটার ফার্গো সিটিতে। মাদ্রাজের ছেলে। বানরের মত চেহারা। স্বভাব-চরিত্রও বানরের মত–সারাক্ষণ তিড়িং-বিড়িং করছে। গলা খাঁকারি দিয়ে থুথু ফেলছে। হাসেও বিচিত্র ভঙ্গিতে খিকখিক করে, থেমে থেমে শব্দ হয়, সমস্ত শরীর তখন বিশ্রীভাবে দুলতে থাকে।
সে এসেছে জৈব রসায়নে M.s. ডিগ্রী নিতে। আমি তখন পড়াশোনার পাট শেষ করে ফেলেছি। একটা ইলেকট্রিক টাইপ রাইটার কিনেছি, দিন-রাত খটখট শব্দে থিসিস টাইপ করি। একেকটা চ্যাপ্টার লেখা শেষ হয়, আমি আমার প্রফেসরের কাছে নিয়ে যাই। তিনি পড়েন এবং হাসিমুখে বলেন, অতি চমৎকার হয়েছে। তুমি এই। চ্যাপ্টারটা আবার লেখ।
আমি হতাশ হয়ে বলি, অতি চমৎকার হলে নতুন করে লেখার দরকার কি? প্রফেসরের মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হয়। তিনি বলেন, অতি চমৎকার তো শেষ কথা নয়। অতি চমৎকারের পরে আছে অতি, অতি চমৎকার। আমি তার জন্যে অপেক্ষা করছি।
আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আবার লিখতে বসি। এই সময়ে উমেশের আবির্ভাব হল মূর্তিমান উপদ্রবের মত। তার প্রধান কাজ হল ‘আবে ইয়ার’ বলে আমার ঘরে ঢুকে পড়া। এবং আমাকে বিরক্ত করা।
আমেরিকায় সে পড়াশোনা করার জন্যে আসেনি। তার মূল উদ্দেশ্য সিটিজেনশীপ। অন্য কোনভাবে আমেরিকা আসার ভিসা পাওয়া যাচ্ছিল না বলেই সে স্টুডেন্ট ভিসায় এসেছে। এখন তার দরকার–‘সবুজপত্র’ বা গ্রীনকার্ড। ঐ বস্তু কি করে পাওয়া যায় সেই পরামর্শ করতেই সে আমার কাছে আসে।
আমি প্রথম দিনেই তাকে বলে দিলাম, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। জানার আগ্রহও বোধ করিনি। আমি এসেছি পড়াশোনা করতে। ঐ পর্ব শেষ হয়েছে, এখন দেশে চলে যাব। উমেশ চোখ-মুখ কুঁচকে ‘আবে বুরবাক . . . ‘ শব্দ দুটি দিয়ে একগাদা কথা বলল, যার কিছুই আমি বুঝলাম না। হিন্দী আমি বুঝতে পারি না। তাছাড়া উমেশ কথা বলে দ্রুত। তবে তার মূল বক্তব্য ধরতে অসুবিধা হল না। মূল বক্তব্য হচ্ছে–হুমায়ূন, তুমি মহা বুরবাক। এমন সোনার দেশ ছেড়ে কেউ যায়?
কাজের সময় কেউ বিরক্ত করলে আমার অসহ্য বোধ হয়। এই কথা আমি উমেশকে বুঝিয়ে বললাম। সে বিস্মিত হয়ে বলল, আমি তো বিরক্ত করছি না। চুপচাপ বসে আছি। তুমি তোমার কাজ কর।
সে চুপচাপ মোটেও বসে থাকে না। সারাক্ষণ তিড়িং-বিড়িং করে। এই বসে আছে, এই লাফ দিয়ে উঠছে। তাছাড়া তার শিস দিয়ে গান গাওয়ার শখও আছে। সে শিস দিয়ে নানান ধরনের সুর তৈরির চেষ্টা করে। সেই সুরের তালে পা নিজেই মুগ্ধ। হয়ে নাচায়।
সব মানুষের জীবনেই কিছু উপগ্রহ জুটে যায়। উমেশ হল আমার উপগ্রহ। সে . জৈব রসায়নের তিনটা কোর্স নিয়েছে। এর মধ্যে একটা ল্যাব কোর্স। কাজ করে আমার ঘরের ঠিক সামনের ঘরে। কাজ বলতে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করা, বোয়াধুয়ি … করা, তারপর আমার সামনে এসে বসে থাকা। পা নাচানো এবং শিস দেয়া। আমি তাকে বললাম, কোর্স যখন নিয়েছ মন দিয়ে কোর্সগুলি করা দরকার। তুমি তো সারাক্ষণ আমার সামনে বসেই থাক।
সে হাসিমুখে বলল, M.s. ডিগ্রীর আমার কোন শখ নেই। আমার দরকার। সিটিজেনশীপ। স্টুডেন্ট ভিসা যাতে বজায় থাকে এই জন্যেই কোর্স নিলাম। পড়াশোনা করে হবেটা কি ছাতা?